ডেমু ট্রেনের সম্মুখের লাল রংটা দূর থেকে চোখে পড়তেই হাটার গতি বাড়ানোর চেষ্টা করলাম। সমতল রাস্তা থেকে রেলের সিলপার ছুয়ে পথচলা খানিকটা কষ্টকর, সাথে যুক্ত হয়েছে ট্রেন অবধি পেঁŠছতে পারা না পারার টেনশন। ট্রেনের সাথে সাক্ষাৎ হওয়াটাও যরূরী যেহেতু পরিবহন ধর্মঘট (গতকাল) চলছে। আলহামদুলিল্লাহ! কিছু সময় পর ট্রেনে উঠলাম।
ট্রেনের ভেতরে সিটের একটা অংশ ফাঁকা দেখে জিজ্ঞেস করলাম বসা যাবে? অন্য এক ভাইয়ের সাথে মুখোমুখি আলোচনারত ভাইটি বললেন, অবশ্যই; বসেন। পাশেই বোরখায় পুরো আবৃত তরুণী তার পাশে সিটের উপর ব্যাগ নিয়ে বসেছেন। পরবর্তীতে দেখা গেল তার স্বামীর জন্য সিটটি সংরক্ষিত রেখেছেন। ছালাউদ্দিন আইয়ূবীর উপর কিশোরদের জন্য লেখা ঈমানদীপ্ত দাস্তান সিরিজের ১ম খন্ডের শেষাংশের পিডিএফ পড়তে শুরু করেছি (যদিও বয়সটা এখন আর কৈশোরে নেই, হঠাৎ পড়তে গিয়ে কিছুটা ভালোলাগা তৈরী হয়েছে) কিন্তু মন বসাতে পারছি না কারণ পাশের ভাইটি অপর পার্শ্বের ভাইয়ের সাথে তাবলীগ নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। তাই তাদের কথার দিকেই মনোযোগ যাচ্ছে বারংবার। কে কয়বার চিল্লা দিয়েছেন, পুনরায় কবে দিবেন? আপনি কোনপন্থী? পরিশেষে জানা গেল একজন দেওবন্দপন্থী অন্যজন মাওলানা সা‘দপন্থী। ট্রেন ছাড়তে বিলম্ব হওয়ার কারণে দেওবন্দপন্থী ভাই ট্রেন থেকে নেমে গেলেন।
মাওলানা সা'দপন্থী তাবলীগের ভাইটি অন্য এক যাত্রীকে বলছেন, টাখনুর নিচে কাপড় গেলে জাহান্নামী, হাটু পর্যন্ত কাপড় উঠলেই ফরয তরক! বললাম ভাই, দলীল কি? আমার দিকে ফিরে বললেন দলীল জানেন না! বেহেশতি যেওরে আছে। (ইতোমধ্যেই বাম পাশে বসা তরুণীটি তার স্বামীর আহবানে অন্যপাশে চলে গিয়েছেন। দাঁড়িয়ে থাকা অন্য দু'জন ভাই ঐ স্থানে বসেছেন) বললাম বেহেশতি যেওর কি দলীল? আপনি শরী‘আত বিষয়ে যে কথা বলবেন তা আপনাকে হাদীছের দলীল সনদসহ উল্লেখ করতে হবে যাতে প্রমাণিত হয় প্রিয় রাসূল (ছাঃ) এটা করেছেন/ ছাহাবারা করেছেন তাতে রাসূল (ছাঃ) এর মৌণ সম্মতি আছে।
ফাযায়েলে আমল এর বিষয়ে কথা উঠলে বললাম, লেখক জনাব মাওলানা যাকারিয়া বইটির ভূমিকায় তাবলীগ জামা'আতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ)-কে লক্ষ্য করে লিখেছেন, এত বড় বযুর্গের সন্তুষ্টি হাসিল করা আমার পরকালে নাজাতের উসীলা হইবে মনে করিয়া আমি উক্ত কাজে সচেষ্ট হই! এটা স্পষ্ট শিরক, অথচ সকল কাজ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করা আবশ্যক। ভূমিকাটা আজ পুনরায় ভালোভাবে পড়ে দেখবেন।
বিবিধ কথার ফাঁকে বললেন, টুপি পড়াও তো সুন্নাত (তার মাথায় ৫কোলি টুপি)। বাম পাশের ভাইটি বললেন, টুপি পড়া সুন্নাত ঠিক আছে, তবে তা এমন সুন্নাত না যে পড়তেই হবে, না পড়লে গুনাহ হবে। টুপি ছাড়াও ছালাত পড়া যায়। টুপির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাঁচওয়াক্ত ছালাত আদায়ের সাথে সাথে টাখনুর উপর কাপড় রাখা, গোঁফ খাটো করা, দাড়িকে ছেড়ে দেয়া যা ওয়াজীব। পাশে এমন একজন সাথী পেয়ে আরও ভালো লাগল।
পুরো কামরায় উপবিষ্ট পুরুষ-মহিলা যাত্রীদের চোখগুলো আমাদের দিকে। কেউ মনোযোগ দিয়ে শুনছেন, কারো ভাবখানা এমন পাঞ্জাবী পড়া হুজুররা নিজেরা নিজেরা ঝগড়া করছে! একজন তো বলেই ফেললেন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। উত্তরে বললাম, বাড়াবাড়ি না হ'লে আপনি সঠিকটা জানবেন কিভাবে? মধু ক্রয় করতে গিয়ে বাজারে খাঁটি মধু কেন বলেন? উত্তরে অন্য এক যাত্রী বললেন যেহেতু মধুতে ভেজাল দেয়া হয় তাই।
এই তো সহজেই বুঝেছে, আপনি দুনিয়ার সামান্য মধু কিনতে গিয়ে খাঁটি টা খোঁজেন, অসুখ হ’লে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার খোঁজেন আর ধর্ম মানতে গেলে তখন হুজুরের পাঞ্জাবী, টুপি, দাড়ি দেখে ফৎওয়া নেন! একবার যাচাই করেন না হুজুরের যোগ্যতা কতটুকু! ইসলাম মদীনা (সউদী আরব) থেকে প্রসার হয়ে বিবিধ দেশ ঘুরে এই উপমহাদেশে এসেছে। যার যার মতো করে বিবিধ আলেম ও শাসকগণ নিজেদের স্বার্থে ধর্মে সংযুক্তি ও বিয়োজন ঘটানোর ফলে আজ এই পর্যায়ে এসেছে। মদীনার ইসলাম আর এই ইসলামে ফারাক যোজন-যোজন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে প্রকৃত ইসলামকেই হাইব্রিড ইসলামধারীরা অযোগ্য বলে প্রচার দিচ্ছে! মুসলমান শাসক হয়েও সম্রাট আকবর নিজের মতো করে ধর্ম তৈরী করেছেন। তাই ধর্মের বিবিধ রুপ দেখা যাচ্ছে সমাজে। তাবলীগের ভাইটিকে বললাম, না জেনে ধর্মের বিষয়ে কাউকে ফতোয়া দিবেন না কারণ আপনার এই ভুল জানা বিষয়টা অন্য আর একজন সঠিক মনে করেই আমল করবে তাতে আপনি দ্বিগুণ গুনাহগার হবেন। অবশ্য তিনি তার আক্বীদাকেই সমর্থন করছেন।
তর্কের শেষ পরিণতি যা হলো, একজন কলেজ পড়ুয়া বললেন, ভাই আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, পুরুষ কাপড় হাটু পর্যন্ত উঠালেই ফরয তরক হবে আর টুপি সুন্নাত পড়তেই হবে। এই দু'টি বিষয়ে হুজুরদের জিজ্ঞাসা করবো। বললাম জ্বী ভাই, জিজ্ঞাসা করবেন তবে উত্তর নিবেন হাদীছের দলীলসহ। হুজুরকে এই কথাও বলবেন পবিত্র কুরআনের পর হাদীছের কোন গ্রন্থগুলো ছহীহ? আপনার হুজুর যে গ্রন্থের কথা বলবেন সেই গ্রন্থের তাওহীদ, পোশাক, পবিত্রতা, ছালাত অধ্যায়গুলো পড়বেন তাহ'লে নিজেই কিছুটা অবগত হ'তে পারবেন। ছালাত বিষয়ে ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ বইটা পড়তে পারেন। গুগলে সার্চ দিলেই হবে। সম্মতি জানালেন। তাবলীগি ভাইটি নিজে নিজে বিড়বিড় করছেন।
ট্রেন থেকে নেমে হাটছি তরুণ এক ভাই বললেন, আমি ডুয়েটে পড়ি। এতক্ষণ আপনাদের আলাপ শুনেছি আসলেই তো রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীরা যা করেছেন তা মানতে হবে। বললাম আপনার ফেসবুক আইডিটা দিন, মেসেঞ্জারে পিডিএফ বই দিয়ে দেব ইনশাআল্লাহ।
বাম পাশে বসা যে ভাইটি তাবলীগের ভাইয়ের সাথে তর্ক করছিলেন তিনি বললেন, ভাই আপনি কি মাসিক আত-তাহরীক পড়েন। জ্বী, পড়ি তো। আমার বাড়ি বগুড়া, কৃষি গবেষণায় চাকুরী করি। মাসিক আত-তাহরীক খুব ভালো পত্রিকা, বিশেষ করে ৪০টা প্রশ্নের উত্তর অসাধারণ। ড. গালিব স্যার কয়েকদিন পূর্বে আমাদের এলাকায় গিয়েছিলেন, বিশাল সভা হয়েছে। আমি ২০০৪ এ রাজশাহী তাবলীগী ইজতেমায় গিয়েছিলাম তারপর বিবিধ কারণে আর যাওয়া হয়নি।