মহান আল্লাহ তাঁরই ইবাদতের জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেছেন (যারিয়াত ৫৬)
এবং তাদের হেদায়াতের জন্য ১ লক্ষ ২৪ হাজার নবী ও রাসূলকে প্রেরণ করেছেন।
নাযিল করেছেন কিতাবসমূহ, যাতে মানবজাতি তাঁর স্পষ্ট পরিচয় লাভ করে তাঁর
ইবাদত করে এবং সমস্ত প্রার্থনা নিবেদন যেন তাঁরই নিকটে হয়। কেননা এসবের
বিপরীত কর্মকান্ড ও বিশ্বাসই শিরক তথা তাঁর সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্ত করা।
আল্লাহর জাত বা সত্তা, তাঁর নাম ও গুণাবলী সমূহ এবং তাঁর ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক সাব্যস্ত করাই হচ্ছে শিরক।
শিরক
হল ক্ষমার অযোগ্য জঘন্যতম গোনাহ। এ শিরক মিশ্রিত যেকোন আমল ইসলামের
দৃষ্টিতে মূল্যহীন এবং আল্লাহর নিকটে তা প্রত্যাখ্যাত। কেউ শিরক করে তওবা
না করে মৃত্যুবরণ করলে এই শিরকই তার ঈমান ও জীবনের যাবতীয় সৎকর্মকে নিষ্ফল
করে দেবে। এ ধরনের লোকদের ঈমান ও আমলের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা
বলেন, ‘বলুন, আমি তোমাদেরকে কি সংবাদ দেব নিজেদের আমলের ক্ষেত্রে কারা
সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত? তারা সেসব লোক দুনিয়ার জীবনে যাদের চেষ্টা-সাধনা
ব্যর্থ হয়ে গেছে আর তারা নিজেরা মনে করছে যে, তারা সৎকর্ম করছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তাদের আমলের দিকে অগ্রসর হব, অতঃপর তা
(তাওহীদ শূন্য হওয়ার কারণে) বিক্ষিপ্ত ধূলিকণার ন্যায় উড়িয়ে দিব’ (ফুরক্বান ২৫/২৩)।
আল্লাহর
তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এ
পৃথিবীতে আগমনকারী প্রতিটি নবী বা রাসূল সর্বপ্রথম তাওহীদের দিকেই আহবান
করেছেন এবং শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য বারবার তাকিদ জানিয়েছিলেন (নাহ্ল ৩৬)।
তাওহীদের মর্মবাণী প্রচারের জন্য জীবনের সবচেয়ে বেশী সময় অতিবাহিত করেছেন
নূহ (আঃ)। মুহাম্মাদ (ছাঃ)ও এজন্য অশেষ কষ্ট স্বীকার করেছেন। এ বিষয়টি এত
গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এ সম্পর্কে খুব কমই গুরুত্বারোপ করা হয়। এমনকি
ইসলামের অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় এ বিষয়ে তেমন লেখালেখিও হয় না। ফলে তাওহীদ
সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে তাওহীদের পরিপন্থী বিষয় শিরক মুসলিম
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তার লাভ করেছে। অথচ ভয়াবহ ও জঘন্যতম পাপ শিরক
থেকে বেঁচে থাকা প্রতিটি মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য। শিরকের ব্যাপারে
রাসূল (ছাঃ)-কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘(হে নবী!) কিন্তু তোমার কাছে আর
তোমাদের পূর্ববর্তীদের কাছে ওহী করা হয়েছে যে, তুমি যদি (আল্লাহর) শরীক
স্থির কর, তাহলে তোমার কর্ম অবশ্য অবশ্যই নিষ্ফল হয়ে যাবে। আর তুমি অবশ্যই
ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (যুমার ৩৯/৬৫)। পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতে শিরকের ভয়াবহতা সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে (বাক্বারাহ, ২/২২; নিসা /১১৬; মায়েদাহ ৫/৭২; আন‘আম ৬/৮৮)।
এ
কারণে বান্দার ওপর সর্বপ্রথম অপরিহার্য বিষয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল তাওহীদ
সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা। নিজের ঈমান, আক্বীদা ও যাবতীয় আমল শিরক
মুক্ত রাখা। শিরক নামের মহা অপরাধ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান রাখা। অন্যথা
যেকোন সময় শয়তানের খপ্পরে পড়ে যে কারো ঈমান ও জীবনের সৎকর্মের যাবতীয় সাধনা
ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। এহেন পরিণতির হাত থেকে যেমন নিজেকে রক্ষা করা
আবশ্যক, তেমনি এত্থেকে অন্য সকল মুসলমানকেও রক্ষা করা যরূরী। নিম্নে আমাদের
বাস্তব জীবনে ও সমাজে প্রচলিত নানা ধরনের শিরক সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল :
সমাজে প্রচলিত কতিপয় শিরক :
আমাদের
দেশের গ্রাম-গঞ্জে ও শহর-বন্দরে কতিপয় শিরক, বিদ‘আত ও নানাবিধ কুসংস্কার
ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কুসংস্কারজনিত এমন শিরক রয়েছে যা এসব দেশের লোকজন
ধর্মীয় বিধান বা নিয়ম মনে করেই পালন করে থাকে। যেমন-
- আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ক্ষমতায় বিশ্বাস করা :
আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর জগতের উপর কর্তৃত্ব রয়েছে বলে বিশ্বাস করা। যদি
কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সম্পর্কে এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, সে অলৌকিক
শক্তির অধিকারী এবং অলৌকিকভাবেই কোন ঘটনা সংঘটিত করতে, বিপদগ্রস্তকে
বিপদমুক্ত করা, আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দান, সন্তানহীনকে সন্তান দিতে পারে, তাহলে
সে মুশরিক বলে গণ্য হবে।
- জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত : জ্যোতির্বিদ্যা
হল সৌরজগতের বিভিন্ন অবস্থা পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনা সংঘটিত
হওয়ার কারণ বর্ণনা করা। জ্যোতির্বিদরা বলে থাকেন যে, অমুক নক্ষত্রের অমুক
স্থানে অবস্থানের সময়ে যে ব্যক্তি বিবাহ করবে তার অমুক অমুক জিনিস অর্জিত
হবে। যে ব্যক্তি অমুক নক্ষত্রের অমুক জায়গায় অবস্থানের ক্ষণে সফরে থাকবে সে
ভাগ্যবান কিংবা ভাগ্যহীন হবে। বর্তমানে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ ধরনের
অর্থহীন-আজগুবি খবরাখবর পরিবেশন করা হয়। আর এগুলোর আশে-পাশে বিক্ষিপ্ত
তারকারাজি, সরলরেখা, বক্ররেখা ইত্যাদি ধরনের অাঁকা-বাঁকা রেখা অংকিত থাকে।
মূর্খ ও দুর্বল ঈমানের কোন কোন মানুষ বিভিন্ন সময় জ্যোতিষীদের নিকট গমন করে
থাকে এবং তাদেরকে স্বীয় ভবিষ্যৎ ও বিবাহ-শাদী ইত্যাদি সম্পর্কেও প্রশ্ন
করে থাকে।
- যাদু-টোনা, বাণ মারা বা বধ করা : আমাদের
সমাজে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যদি কারো সাথে কারো শত্রুতা সৃষ্টি হয় এবং এ
দু’পক্ষের কোন এক পক্ষ যদি দুর্বল হয়, তবে দুর্বল পক্ষ সাধারণত বিভিন্ন জিন
সাধকের মাধ্যমে যাদুর আশ্রয় গ্রহণ করে সবল পক্ষকে বাণ মারে বা বধ করে।
আবার অনেক ক্ষেত্রে সবল পক্ষও দুর্বল পক্ষকে সমূলে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে
যাদুর আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এভাবেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অধিকতর ভালবাসা
সৃষ্টি, কারো সাথে শত্রুতা সৃষ্টি, কারো বিবাহ হতে না দেয়া, কারও প্রতি
ভালবাসা সৃষ্টি, কাউকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র
করে চলে যাদুর খেলা। আবার এ সকল যাদুকে নিষ্ক্রিয় করতে পুনরায় আশ্রয় গ্রহণ
করা হয় যাদুমন্ত্রের। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট তথা জিন, পীর,
ওলী-আওলিয়া, এমনকি হিন্দুদের দেব-দেবী প্রভৃতির নিকটেও আশ্রয় প্রার্থনা
করা, নির্দিষ্ট দিনে লাল বা কালো মোরগ জিন বা ভূতের নামে রোগীকে যবহ করতে
বলা কিংবা মিষ্টি ও ফলমূল গায়রুল্লাহর নামে এমনকি হিন্দুদের মন্দিরে
অবস্থিত দেব-দেবীকেও মানত করা।
- রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে ধাতব আংটি ও বালা পরিধান করা :
রাজধানী সহ বিভিন্ন শহরের ফুটপাতে এবং বড় বড় পাইকারী বাজারে এমন কিছু
ব্যবসায়ের দোকান পাওয়া যায়, যারা ধাতব নির্মিত আংটি ও বালা বিক্রি করে
থাকে। অনেক লোকদেরকে তা বাত রোগ নিরাময়, যে কোন উদ্দেশ্য সফল হওয়া, শনি ও
মঙ্গল গ্রহের কুদৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষা ইত্যাদির জন্য করে আংগুলে ও হাতে
ব্যবহার করতে দেখা যায়। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কোন বস্ত্তই নিজস্ব গুণে কোন
রোগের ক্ষেত্রে উপকারী বা অপকারী হতে পারে না। এতে রোগীর অন্তরে ধাতব
বস্ত্তর প্রতি উপকারী হওয়ার ধারণার সৃষ্টি হয় এবং রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে
আল্লাহর পরিবর্তে বস্ত্তর উপর ভরসা করা হয়। তাই কোন বস্ত্তকে কোন ক্ষেত্রে
উপকারী বা অপকারী ধারণা করে ব্যবহার করা।
- তা‘বীয ব্যবহার করা : জিনের
অশুভ দৃষ্টি এবং বিভিন্ন রোগের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ মুসলিমদের
মাঝে তা‘বীয ব্যবহার একটা সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়েছে। অথচ সকল ধরনের তা‘বীয
ব্যবহার করা শিরক।
- কবর ও মাযারের সম্মান করা : মাযার
স্পর্শ করা, শরীর মাসেহ করা বা চুমু খাওয়া, কবরের মাটি বরকতের নিয়তে নিয়ে
তা‘বীযে করে গলায় বাঁধা, গায়ে মালিশ করা, রওযা শরীফ, মাযার বা কবর ইত্যাদির
ছবি বরকতের জন্যে রাখা, চুমু খাওয়া, সম্মান করা। বিপদাপদ, বালা-মুছীবাত
থেকে বাঁচার জন্য ঘর-বাড়িতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে বরকতের জন্য দোকান, অফিস,
হোটেলে ছবি রেখে আদবের সাথে দাঁড়িয়ে এগুলো করা। মাযারকে মাঝে মাঝে মহা
ধুমধামের সাথে ধোয়া হয়। আর এ কবরধোয়া পানি বোতলে করে নিয়ে যাওয়া এবং নেক
মাকসূদ পূরণের নিয়তে পান করা।
- মাযারে গিলাফের তা‘যীম :
বিভিন্ন পীর, ওলী-আওলিয়া, বুযুর্গানে দ্বীনের মাযারে বা কবরের ওপরে আজকাল
গিলাফ পরানো হয়। অজ্ঞ, অশিক্ষিত মানুষ অনেক ক্ষেত্রে এসব গিলাফে চুমু খায়,
গিলাফ ধরে ফরিয়াদ জানায়, আদবের সাথে মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এ গিলাফের
সুতা তা‘বীযে ভরে গলায় বাঁধে। এমনকি অনেকেই আরো একধাপ এগিয়ে গিলাফের কাছেই
দো‘আ চেয়ে বসে।
- ওরশ : অনেক মাযারে ও পীরের দরবারে
অমাবস্যা, পূর্ণিমা, পীরের জন্ম বা মৃত্যু তারিখ নির্দিষ্ট করে ওরশ হয়ে
থাকে। বিজলী বাতি, গেট, চকমকি কাগজ ইত্যাদি দিয়ে প্যান্ডেল, স্টেজ সাজানো
হয়। বেপর্দা অবস্থায় নারী-পুরুষ একত্রে বসে যিকির করে, কাওয়ালী-সামা শোনে।
ভন্ড পীর, ফকীররা এ সব ওরশে ওয়ায নছীহতের নামে শরী‘আত বিরোধী
আক্বীদা-বিশ্বাস প্রচার করে। শাহী তবারক রান্না করা হয়। ওরশের পরে যে টাকা
অবশিষ্ট থেকে যায়, তা পীর ও তার খাদেমদের পকেটে চলে যায়। ওরশ মূলত
আনন্দোৎসব ও বিনা পুঁজিতে টাকা উপার্জনের পন্থা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
- খাজা বাবার ডেগ :
একদল লোক বিশেষত যুবকেরা রজব মাস এলেই পথে-ঘাটে, বাজারে যেখানেই সুযোগ পায়
সেখানেই একটা ডেগ বা বড় হাড়ি বসায়। লালসালু কাপড় বিছিয়ে, বাঁশ দিয়ে ছাউনি
দিয়ে, বিজলী বাতি জ্বালিয়ে, চকমকি কাগজ এবং বিভিন্ন ধরনের রং লাগিয়ে ঘর
সাজিয়ে তার মধ্যে স্থাপন করে ডেগ। তারা একে বলে ‘খাজা বাবার ডেগ’।
- প্রতিকৃতি, মূর্তি ও ভাস্কর্য ইত্যাদির হুকুম :
কোন নেতা বা স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তিবর্গের ছবি, চিত্র, প্রতিকৃতি, মূর্তি ও
ভাস্কর্য ইত্যাদি তৈরি করা, মাঠে-ঘাটে, অফিস-আদালতে ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ
স্থানে এগুলো স্থাপন করা, এগুলোকে সম্মান করা, এগুলোর উদ্দেশ্যে পুষ্পস্তবক
অর্পণ ইত্যাদি করা।
- স্মৃতিস্তম্ভ ও শহীদ মিনার : সম্মানিত
ব্যক্তিবর্গের স্মরণে সমাধি, স্মৃতিস্তম্ভ, স্মৃতিসৌধ বা শহীদ মিনার
নির্মাণ, এগুলোকে সম্মান জানানো, সামনে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা ইত্যাদি।
- অগ্নিপূজা, শিখা চিরন্তন ও শিখা অনির্বাণ :
‘অগ্নি শিখা’ অগ্নিপূজকদের উপাস্য দেবতা। তারা বিভিন্নভাবে আগুনের পূজা
করে থাকে। এ অগ্নিপূজা সম্পূর্ণ শিরক ও আল্লাহদ্রোহী কাজ। ‘শিখা চিরন্তন’
বা ‘শিখা অনিবার্ণের’ নামে অগ্নি মশালকে সারা দেশে ঘুরিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা
জানানো এবং এগুলোর প্রজ্জ্বলনকে অব্যাহত রাখার জন্য বিশেষ ধরনের বেদীর ওপর
এগুলো স্থাপন করা এবং অলিম্পিক মশাল সহ বিভিন্ন ক্রীড়ানুষ্ঠানের মশাল
প্রজ্জ্বলনও শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
- মঙ্গল প্রদীপ : হিন্দুদের অনুকরণে কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে বা কোন প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন উপলক্ষে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা পালন করা।
- তাছাওউফের শায়খ বা পীরের কল্পনা : তাছাওউফের শায়খ বা পীরের চেহারা, আকৃতি ইত্যাদি কল্পনা করে মোরাকাবা, ধ্যান, যিকির বা অন্য যে কোন ইবাদত করা শিরক।
- পীরকে ডাকা ও তার জন্য ঘর সাজিয়ে রাখা :
অনেকে স্বীয় পীর বা কোন বুযুর্গ ব্যক্তিকে বহুদূর হতে ডাকে এবং মনে করে
যে, তিনি এটা জানতে ও শুনতে পারছেন। অনেক সময় ‘ইয়া গাওছুল আযম’, ‘ইয়া খাজা
মুঈনুদ্দীন চিশতী’ ইত্যাদি বলে ডাকতে থাকে এবং নিজেদের ফরিয়াদ পেশ করতে
থাকে। কিছু সংখ্যক পীরের অনুসারীরা তাদের বাড়ির মধ্যে একটি ঘর পীরের জন্য
সারা বছর সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে। একটা বড় খাটের ওপর চাদর বিছিয়ে বড় বড় কয়েকটা
কোল বালিশ সেট করে ‘বিশেষ আসন’ তৈরি করা হয়। পীরের ছবিকে মালা পরিয়ে সযত্নে
ঐ ঘরে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়। ফুল ও জরি দিয়ে ঘরটি সুন্দর করে সাজানো হয়। সারা
বছর ঐ ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয়া হয় না। মাঝে মাঝে মুরীদরা ঐ ঘরে ঢুকে ছবি ও
আসনের সামনে আদবের সাথে চুপ করে বসে থাকে।
- পীরের বাড়ি বা আস্তানার খাদেম ও জীবজন্তুর প্রতি সম্মান :
অনেককে দেখা যায়, পীরের বা মাযারের খাদেম, গরু, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদিকে
দেখামাত্র দাঁড়িয়ে যায়। এগুলোর সামনে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। অনেকে
আবার এসব গরু, কুকুর, বিড়ালের পা ধরে বসে থাকে নেক মাকছূদ পূরণের জন্য।
খানজাহান আলীর মাযারের পুকুরে কুমীর আছে, চট্টগ্রামে কথিত বায়েজীদ
বোস্তামীর মাযারে কচ্ছপ আছে। আবার কোন কোন জায়গায় গজার মাছ, জালালী কবুতর
ইত্যাদি পীর-ওলীদের স্মৃতি বহন করছে বলে মানুষের বিশ্বাস। অজ্ঞ অশিক্ষিত
মানুষেরা মাযারের ব্যবসায়ী খাদেমদের খপ্পরে পড়ে এ সব কচ্ছপ, গজার মাছ,
কুমীর, জালালী কবুতর ইত্যাদিকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করে এবং এদের জন্য
বিভিন্ন খাদ্যবস্ত্ত পূজাস্বরূপ নিয়ে যায় ও এদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা
করে।
- পীর, ওলী-আওলিয়াদের কবরের মাটি ও সেখানে প্রজ্জ্বলিত মোমবাতিকে বিভিন্ন রোগের জন্য উপকারী মনে করা : এ
ধরনের কর্ম আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে অহরহ পরিলক্ষিত হয়। তারা
বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে আওলিয়াদের কবরের মাটি ও সেখানে জ্বালানো মোমবাতি
অনেক উপকারী মহৌষধ মনে করে অত্যন্ত যত্নের সাথে তা ব্যবহার করে থাকে এবং এর
দ্বারা কোন রোগ মুক্তি হলে তা কবরস্থ ব্যক্তির দান বা তাঁর ফয়েয বলে মনে
করে।
- গায়রুল্লাহর নামে যিকির বা অযীফা : আল্লাহর
যিকিরের ন্যায় কোন নবী বা রাসূল, পীর, ওলী-আওলিয়া, বুযুর্গ, আলিমের নাম জপ
করা, বিপদে পড়লে তাদের নামের অযীফা পড়া। যেমন- ‘ইয়া রাহমাতুল্লিল আলামীন’,
‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’, ‘নূরে রাসূল, নূরে খোদা’, ‘হক বাবা, হক বাবা’ ইত্যাদি।
- কামেল পীরের গোনাহ নেই : খোদা পাক, কামেল পীরও পাক। তাদের কোন গোনাহ নেই। তারা নিষ্পাপ। এ ধরনের কথা বলা ও বিশ্বাস করা।
- পীরের পায়ে সিজদা করা বা কদমবুসি করা :
সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে পীরের পায়ে সিজদা করা বা নেক মাকছূদ পূরণের
জন্য, রোগমুক্তির নিয়তে পীরের পা চাটা, পায়ে চুমু খাওয়া, দাড়ি চাটা, দাড়িতে
চুমু খাওয়া, ব্যবহার্য থালাবাটি বা অন্য কোন বস্ত্ত চাটা বা চুমু খাওয়া,
মাযারে চুমু খাওয়া।
- আল্লাহর সত্তার সাথে মিশে যাওয়া :
অনেকের ধারণা মুরীদ যখন ‘ফানাফিল্লাহ’ পর্যায়ে পৌঁছে, তখন সে আল্লাহর
সত্তার সাথে মিশে বিলীন হয়ে যায় এবং তাঁর পৃথক কোন অস্তিত্ব থাকে না।
খাওয়া, ঘুম, স্ত্রী সহবাস সহ যাবতীয় কাজকর্ম তখন আর নিজস্ব থাকে না। এগুলো
সব আল্লাহর হয়ে যায় অর্থাৎ এসব কাজ আল্লাহ নিজেই করেন (নাঊযুবিল্লাহ)।
- আল্লাহ যা করান, তাই করি :
একদল ফকীর বলে, আল্লাহ যা করান, তা-ই করি। আল্লাহ ছালাত আদায় করান না, তাই
আদায় করি না, আল্লাহ গাঁজা টানাচ্ছেন, তাই টানি। তাক্বদীরে ছালাত থাকলে তো
আদায় করব।
- দিলে দিলে ছালাত পড়ি : অনেক পীর
ছালাত, ছওমের ধার ধারে না; কিন্তু খুব সাধনা করে। দু’তিন দিন পর পর একটু
খায়। কম কথা বলে। লোকজনের সাথে কম মিশে। দিনের বেশিরভাগ সময় চুপ করে
ধ্যান-মগ্ন অবস্থায় বসে থাকে। এরা বলে, আমরা দিলে দিলে ছালাত পড়ি। তোমরা
মাত্র ৫ ওয়াক্ত পড়, আর আমরা সারা দিন-রাতই ছালাত পড়ি।
- সীনায় সীনায় মা‘রেফতী :
পীর বা দরবেশ দাবীদার একদল লোক বলে থাকে, ‘কুরআন শরীফ মোট ৪০ পারা। ৩০
পারায় যাহেরী ইলমের বিষয় আছে। বাকি ১০ পারা মা‘রেফতী বিদ্যায় ভরাপুর। এ ১০
পারা আমরা সীনায় সীনায় পেয়েছি। শরী‘আতের আলেমরা এগুলোর খবর রাখেন না।
- শরী‘আতের ইত্তেবা সর্বাবস্থায় ফরয নয় : অনেকের ধারণা, মুরীদ যখন মা‘রেফাতের উচ্চ শিখরে পৌঁছে যায়, তখন তার জন্য শরী‘আতের হুকুম-আহকাম, ছালাত, ছওম ইত্যাদি মাফ হয়ে যায়।
- শিরকের গন্ধযুক্ত নাম ও উপাধি :
যে সকল নাম বা সম্বোধনে শিরকের সংস্পর্শ পাওয়া যায়, সেগুলোকে ইসলাম
নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। জাহেলী যুগে মানুষ নিজের সন্তান-সন্ততির নাম সূর্য,
চন্দ্র ইত্যাদির নামের সাথে সম্পৃক্ত করে রাখত। যেমন- আবদে শামস্ বা
সূর্যের গোলাম, আবদে মানাফ বা মানাফের গোলাম ইত্যাদি। সন্তানের নামকরণে নবী
ও পীর-আওলিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। যেমন- গোলাম মুছত্বফা (মুছত্বফার
গোলাম), আব্দুন্নবী (নবীর দাস), আব্দুর রাসূল, আলী বখশ (আলী (রাঃ)-এর দান),
হোসেন বখশ (হুসাইন (রাঃ)-এর দান), পীর বখশ (পীরের দান), মাদার[1] বখশ
(মাদারের দান), গোলাম মহিউদ্দীন (পীর মহিউদ্দীনের গোলাম), আব্দুল হাসান
(হাসানের গোলাম), আব্দুল হুসাইন (হুসাইনের গোলাম), গোলাম রাসূল (রাসূলের
গোলাম), গোলাম সাকলায়েন ইত্যাদি নাম রাখা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ ধরনের নাম
রাখতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আবার পীর বা ওলীকে এমন কোন উপাধিতে সম্বোধন
করা উচিত নয় যা অর্থগত দিক দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার জন্য প্রযোজ্য। যেমন-
গাউছুল আযম (সর্বশ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী), গরীবে নেওয়াজ (গরীবরা যার
মুখাপেক্ষী), মুশকিল কোশা (যার মাধ্যমে বিপদাপদ দূর হয়), কাইয়ূমে যামান
(যামানা কায়েম করেছেন যিনি) ইত্যাদি।
- বিপদে পড়ে জিন, ফেরেশতা, পীর, ওলী-আওলিয়াদের ডাকা : দ্বীন
সম্পর্কে অজ্ঞ মূর্খ, পীর ও মাযার পূজারী অনেক লোককে দেখা যায় বিপদে-আপদে,
রোগে-শোকে আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে পীর, ওলী, জিন ও ফেরেশতাদের আহবান
করতে থাকে। যেমন- ‘ইয়া গাওছুল আযম বড় পীর আব্দুল কাদের জীলানী’, ‘ইয়া খাজা
বাবা’, ‘ইয়া সুলতানুল আওলিয়া’, ‘হে পীর কেবলাজান’, ‘হে জিন’, ... আমাকে
রক্ষা করুন, আমাকে বিপদ হ’তে বাঁচান, আমার মাকছূদ পূরা করুন, সন্তান দিন
ইত্যাদি। কোন কোন মূর্খলোক বালা মুছীবতের সময় বুযুর্গ লোকদের উদ্দেশ্যে
দো‘আ করে, ফরিয়াদ জানায়। এভাবে গাইরুল্লাহ্কে ডাকা এবং তাদের কাছে নিজের
ফরিয়াদ পেশ করা, তা কাছ থেকে হোক আর দূর থেকেই হোক।
- পীর, ওলী-আওলীয়াদের স্মৃতিচিহ্নের তা‘যীম করা এবং এদের কাছে সাহায্য চাওয়া : অনেকে
পীর, ওলী-আওলিয়াদের স্মৃতিচিহ্নকে এমন তা‘যীম করে যে তা শিরকের পর্যায়ে
পৌঁছে যায়। পীর হয়তো কোন গাছের নীচে বসতেন, বিশ্রাম করতেন। পীরের মৃত্যুর
পর মুরীদরা ঐ গাছ বা পাথরের গোড়ায় আগরবাতি, মোমবাতি, ধূপ ইত্যাদি জ্বালায়,
মীলাদ পড়ায়, বিপদ মুক্তির জন্য ফরিয়াদ জানায়।
- মন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তন :
সিলভা, কোয়ান্টাম বা অন্য কোন মেথডের (পদ্ধতি) দ্বারা মন নিয়ন্ত্রণের
মাধ্যমে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানো এবং সকল সমস্যার সমাধান লাভ করার মাধ্যমে
জীবনে সফলতা অর্জন করার কথা বলা।
- কপালে টাকা স্পর্শ করে তা সম্মান করা :
টাকা-পয়সা মানুষের সম্পদ। তা মানুষের জীবনের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে
সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই টাকা-পয়সা মানুষের খাদেম। কিন্তু মানুষ টাকার
খাদেম বা গোলাম নয়। সম্পদের সম্মান হচ্ছে তাকে সংরক্ষণ করা, তাকে অবজ্ঞা ও
তুচ্ছ জ্ঞান না করা, পায়ের নিচে ফেলে দলিত-মথিত না করা। কিন্তু যে মাথা ও
কপাল ঠেকিয়ে আল্লাহর ইবাদত করা হয় এবং তাঁকে সম্মান জানানো হয়, সেই কপালে
টাকা স্পর্শ করে টাকাকে সম্মান করা টাকাকে পূজা করারই শামিল। এ কাজটি অনেক
মুসলিম ব্যবসায়ীদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়। দোকান খোলার পর প্রথম বিক্রি হলেই
তারা এ কাজটি করে থাকে।[2]
- গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব : অনেকের
ধারণা মানুষের ভাল-মন্দ, বিপদ-আপদ, উন্নতি-অবনতি ইত্যাদি গ্রহ-নক্ষত্রের
প্রভাবে হয়। কেউ বিপদে পড়লে বলা হয়, ‘এ ব্যক্তির ওপর শনি গ্রহের প্রভাব
পড়েছে’। কারো আনন্দের খবরে বলা হয়, ‘এ ব্যক্তি মঙ্গল গ্রহের সুনজরে আছে’।
- চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের প্রভাব : অনেকের ধারণা চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণ মানুষের ভাল-মন্দ, জন্ম-মৃত্যু, বিপদ-আপদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
- কোন মাস বা সময়কে ভাল বা খারাপ জানা : আমাদের
দেশের অধিকাংশ মানুষ সময় ও দিনক্ষণের ভালমন্দে বিশ্বাসী। মুহাররম, কার্তিক
প্রভৃতি মাসে বিয়ে-শাদী করা উচিত নয়, রবি ও বৃহস্পতিবারে বাঁশ কাটা যায় না[3],
সোম ও বুধবারে গোলা হতে ধান বের করা যায় না, শুক্র ও রবিবারে পশ্চিম দিকে
যাত্রা করলে ক্ষতি হবে, শনি ও মঙ্গলবারে বিয়ে করা ও ঝাড়ু বাঁধা উচিত নয়,
রাতের বেলা ঝাড়ু দিলে আয়-উন্নতি হয় না, রাতে আয়না দেখলে কঠিন পীড়া হয়, রাতে
নখ কাটা ঠিক নয়, নতুন বউকে ভাদ্র মাসে শ্বশুর বাড়ীতে রাখা হয় না (কারণ
নতুন বছরের পা ভাদ্র মাসে শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর জন্য দেখা অকল্যাণকর), ভাদ্র ও
পৌষ মাসে মেয়ে লোকের সওয়ারী পাঠানো যায় না, আশ্বিন মাসের শেষ দিন মুটে
বানিয়ে গরুকে গা ধৌত করা ও ‘গো ফাল্গুন’ বলে মান্য করা ইত্যাদি।
- নবজাতকের জন্য : নবজাতকের
হাতে চামড়ার চিকন তার, তাগা বা গাছ বা এ ধরনের অন্য কোন কিছু চুড়ির মতো
করে বেঁধে দেয়া হয় যাতে কোন অশুভ রোগ-বালাই বা বদ জিন-ভূত স্পর্শ করতে না
পারে। আবার নবজাতককে জিনের অশুভ দৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য বাচ্চার কান ছিদ্র
করা, বাচ্চার বালিশের নিচে জুতার টুকরা রাখা অথবা শিশুর মাথার চুল না
কাটা। চোখ লাগা থেকে শিশুকে রক্ষার জন্য তার গলায় মাছের হাড়, শামুক ইত্যাদি
ঝুলিয়ে রাখা, কপালে কালো টিপ বা দাগ দেয়া।
- গায়রুল্লাহর নামে কসম করা : আব্দুল্লাহ
ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি
গায়রুল্লাহর নামে কসম করল, সে কুফরী করল অথবা শিরক করল’।[4] মূলত আল্লাহ
ব্যতীত অন্য কোন নামে কসম করলে কসম হয় না। যেমন- রাসূলুল্লাহর কসম, কা‘বা
শরীফের কসম, নিজ চোখের কসম, বিদ্যা বা বই-এর কসম ইত্যাদি।
- পীর, ওলী বা বুযুর্গ ব্যক্তির অসীলা গ্রহণ : আল্লাহকে
পাওয়ার জন্য, তাঁর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে, ক্ষমা ও সাহায্য
পাওয়ার আশায় কোন জীবিত বা মৃত পীর, ওলী বা বুযুর্গ ব্যক্তিকে অসীলা বা
মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা।
৩৭. শুভ-অশুভ আলামত : বাহ্যিক
দৃষ্টিতে কোন বস্ত্ত, স্থান, শব্দ বা সংকেতকে পসন্দ করা বা না করা মানুষের
মানবীয় স্বভাব। এটা দোষের কিছু নয়। তবে ভালকে নিশ্চিতভাবে ভাল এবং মন্দকে
অকল্যাণকর বলে জানতে হলে শরী‘আতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন। তাওহীদের
প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে শুভ-অশুভ আলামতে বিশ্বাস করা স্পষ্টভাবে
শিরকের পর্যায়র্ভুক্ত করা যায়। ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ দ্বারা এ
বিধানটি আরও দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়। এ হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘অশুভ বা
অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা শিরক, কথাটি তিনবার বলেন’।[5]
পাখি
ও প্রাণীর চলাচলের গতিপথকে প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের লোকেরা সৌভাগ্য বা
দুর্ভাগ্যের আলামত বলে গণ্য করত এবং তাদের জীবনের পরিকল্পনা গ্রহণের
প্রক্রিয়া এ সব আলামতকে ঘিরেই কেন্দ্রীভূত ছিল। শুভ বা অশুভ আলামত
নির্ধারণের এই চর্চাকে আরবীতে তিয়ারা[1] (উড়াল
দেয়া) বলা হত। যেমন- কোথাও যাবার উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তি যাত্রা শুরু করলে
যদি একটি পাখি তার উপর দিয়ে উড়ে বামে চলে যেত, তাহলে সে ভাবত যে তার
দুর্ভাগ্য অবশ্যম্ভাবী; ফলে সে পুনরায় ঘরে ফিরে যেত। ইসলাম এ ধরনের সকল
কুপ্রথাকে বাতিল করেছে। সকল মুসলিমকে এ ধরনের বিশ্বাস হতে উদ্ভূত অনুভূতিকে
পরিহার করতে বিশেষভাবে যত্নশীল হ’তে হবে। এ ক্ষেত্রে অজ্ঞাতসারে যদি কেউ
কোন কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে যা এ প্রকৃতির বিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট,
তাহ’লে অবশ্যই আল্লাহর নিকটে এর থেকে পরিত্রাণ চেয়ে নিম্নের দো‘আ দ্বারা
আকুল প্রার্থনা জ্ঞাপন করা উচিত : اَللَّهُمَّ لاَ خَيْرَ إِلاَّ خَيْرُكَ
وَلاَ طَيْرَ إِلاَّ طَيْرُكَ وَلاَ إِلٰهَ غَيْرُكَ ‘আল্লাহুম্মা লা খায়রা
ইল্লা খায়রুকা ওয়া লা ত্বায়রা ইল্লা ত্বায়রুক ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা’। অর্থ
: হে আল্লাহ্! আপনার কল্যাণ ব্যতীত কোন কল্যাণ নেই এবং আপনার দেয়া শুভাশুভ
ব্যতীত কোন শুভ বা অশুভ নেই এবং আপনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।[6]
শুভ-অশুভ
আলামত বিষয়ে বেশি রকমের বাড়াবাড়ি করা নিরর্থক। বৃহৎ শিরকের উৎসমূলে পরিণত
হওয়ার আশংকায় ইসলাম এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। মূর্তি, মানুষ,
তারা, সূর্য ইত্যাদি পূজার উৎপত্তি হঠাৎ করে হয়নি। এ ধরনের পৌত্তলিকতার
চর্চা দীর্ঘকালব্যাপী ক্রমান্বয়ে বিকাশমান হয়েছে। বৃহৎ শিরকের শিকড় যত
বিস্তার লাভ করে, আল্লাহর একত্বের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ক্রমশ বিলুপ্ত হতে
থাকে। এভাবে শয়তানের কুমন্ত্রণার বীজ অঙ্কুরিত হয়ে মুসলিমদের বিশ্বাসের
ভিত্তিমূল ধ্বংস করার পূর্বেই তা সমূলে উৎখাত করতে হবে।
শিরক সম্পর্কে সর্বদা স্মর্তব্য হল :
১.
জীবন বিপন্ন হলেও শিরক করা যাবে না, ২. শিরকের পাপের কোন ক্ষমা নেই, ৩.
শিরকের পরিণতি ধ্বংস, ৪. শিরক সমস্ত নেক আমলকে নিষ্ফল করে দেয়, ৫. মুশরিকরা
চিরস্থায়ী জাহান্নামী, ৬. মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নিষেধ, ৭.
শিরক মিশ্রিত ঈমান কখনোই ঈমান হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়, ৮. শিরক অতি সন্তর্পনে
আগমন করে।
সুতরাং শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য সবসময় আল্লাহ তা‘আলার
নিকটে প্রাণখুলে দো‘আ করা ও সাহায্য প্রার্থনা করা কর্তব্য। রাসূল (ছাঃ)
শিরক হ’তে বাঁচার জন্য আমাদেরকে দো‘আ শিখিয়েছেন : اَللَّهُمَّ إِنَّا
نَعُوْذُبِكَ أَنْ نُشْرِكَ شَيْئًا نَعْلَمُهُ وَنَسْتَغْفِرُكَ لَمَا لاَ
نَعْلَمُ ‘আল্লাহুম্মা ইন্না না‘ঊযুবিকা আন নুশরিকা শাইআন না‘লামুহু, ওয়া
নাসতাগফিরুকা লিমা লা না‘লামুহ।’ অর্থ: হে আল্লাহ্, জেনে বুঝে শিরক করা
থেকে আমরা আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং আমাদের অজ্ঞাত শিরক থেকে
আপনার নিকটে ক্ষমা চাচ্ছি।[7] আল্লাহ আমাদের সবাইকে ছোট-বড় সকল প্রকার শিরক হ’তে রক্ষা করুন, আমীন!
[1]. ‘মাদার’-কে বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলের হিন্দুরা বড় ঋষি বলে জানে।
[2]. ড. মুয্যাম্মিল আলী, শিরক কী ও কেন (ঢাকা : তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃ. ৩৫০।
[3].
এ ধরনের বিশ্বাসের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের অনেক এলাকা যেখানে বাঁশের হাট
রয়েছে, সেসব হাটগুলো সাধারণত রবিবার ও বৃহস্পতিবার ছাড়া অন্য দিনগুলোতে হয়।
[4]. তিরমিযী, হা/১৫৩৫; মুসতাদরাক হাকিম, ১/১৮, সনদ ছহীহ ।
[5]. তিরমিযী, ৪/১৬০; ইবনু হিববান, ১৩/৪৯১; হাকেম, আল-মুসতাদরাক, ১/৬৪; আবূ দাউদ, ৪/১৭।
[6]. আহমাদ, ২/২২০; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১০৬৫; সনদ সহীহ।
[7]. আহমাদ ও আত্ব-ত্বাবারানী, ছহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩৬, সনদ হাসান।