মুসলিম রক্তে সিক্ত আল্লাহর যমীন
মুহাম্মাদ আবু হুরায়রা ছিফাত
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক 923 বার পঠিত
শুরুকথা : ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী ভূখন্ড ফিলিস্তীন বা প্যালেস্টাইন মুসলিম, খৃষ্টান ও ইহুদী তথা সকল ধর্মাবলম্বীর নিকট একটি পবিত্র ভূমি। সুদীর্ঘ ইতিহাস বিজড়িত ফিলিস্তীন মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্ব মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অঞ্চল। অথচ জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়া বেষ্টিত এ ভূখন্ডের প্রতিটি বালুকণার সাথে মিশে আছে ছোপ ছোপ রক্ত। ক্রসেড যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই ছোট্ট অঞ্চলটি আজ ইসরাঈল নামক এক আস্ত হায়েনার করতলগত। গত ৬০ বছর থেকে ফিলিস্তীনীদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলছে আমেরিকার অনৈতিক সমর্থনপুষ্ট ইসরাঈল। অন্যদিকে সারা বিশ্বের মোড়লরা কেউবা এ অন্যায়ের সহযোগিতা করছে, কেউবা কাপুরুষের ন্যায় চোখ বুজে সহ্য করছে এই হোলি খেলা। এ বছরের ৩১ মে সারা বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে এ ইহুদী রাষ্ট্রটি তার আসল চেহারা আরেকবার উন্মোচন করল। গাজার ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত, ভুখা-নাঙ্গা মানুষের মুখে এক মুঠো আহার তুলে দেওয়ার জন্য রওয়ানা হয় তুর্কী ত্রাণবাহী জাহাজ ফ্রিডম ফ্লোটিলা মাভি মারমারা। গাজার উপকণ্ঠে পৌঁছার পূর্বেই ইসরাঈলী সন্ত্রাসীরা এই জাহাজে বর্বর হামলা চালিয়ে ৯ জন তুর্কী মানবাধিকার কর্মীকে হত্যা করে। এই গণহত্যা সারা বিশ্বের মানুষকে আরো একবার ইসরাঈল সম্পর্কে ভাবাতে শুরু করে।
ইহুদী জাতির পরিচয় :
ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতেই ইহুদীদের সম্পর্কে বলা প্রয়োজন। কেননা ইহুদী রাষ্ট্র হিসাবেই ইসরাঈলের জন্ম। ইহুদীদের প্রধান নবী হলেন মূসা (আঃ), যার কিতাব হল তাওরাত। ইহুদীরা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, যার নাম তাদের কাছে জেহোভা। এখান থেকেই ইহুদী নামের উৎপত্তি। কারো মতে, ইহুদীদের অপর নাম বনী ইসরাঈল। ইসরাঈল মূলত ইয়াকুব (আঃ)-এর অপর নাম। তাঁর মোট ১২ জন সন্তান ছিল। ১২ ভাইয়ের বড় ইয়াহুদার নামানুসারেই বনী ইসরাঈলকে ‘ইহুদী’ বলা হয়। বনু ইসরাঈলরা পথভ্রষ্ট হয়ে গেলে আল্লাহ তাদের হেদায়াতের জন্য মূসা (আঃ)-কে তাওরাত সহ প্রেরণ করেন। বনী ইসরাঈলের উপর আল্লাহর ছিল অগণিত নিয়ামত, অফুরন্ত অনুগ্রহ। পবিত্র কুরআনে প্রায় ৪৩টি স্থানে বনী ইসরাঈলের আলোচনা রয়েছে। তন্মধ্যে প্রায় ১৬টি স্থানে বনু ইসরাঈলের উপর আল্লাহ প্রদত্ত নে‘আমতরাজির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর যখন আমি সমুদ্রকে পৃথক করে দিলাম অতঃপর তাদেরকে রক্ষা করলাম এবং ফেরাঊনকে ডুবিয়ে দিলাম’ (বাক্বারাহ ৫০)। তাদেরকে প্রদত্ত আরো নে‘আমতসমূহ যেমন- রাজাধিপতির মর্যাদা প্রদান (মায়েদাহ ৬০), রিযিক প্রদান (জাছিয়া ১৬), তীহ প্রান্তরে ছায়া ও খাবারের ব্যবস্থা (বাক্বারাহ ৫৭), পানির ব্যবস্থা (বাক্বারাহ ৬০)।
এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর আরো অনেক অনুগ্রহ করেছেন। যেমন- গো-বৎসের পূজা করার পরও আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন’ (বাক্বারাহ ৫১-৫২)। বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটানোর পর তাদেরকে আবার পুনর্জীবন দান করেন’ (বাক্বারাহ ৫৫)। এ রকম আরো অভাবনীয়, আশাতীত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নে‘আমতরাজি দিয়ে আল্লাহ ইহুদীদের মান-মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, শান-শওকত বৃদ্ধি করেছেন।
এরপরও কুটিল ইহুদীরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় না করে একের পর এক নাফরমানী করে চলেছিল। গোবৎসের পূজা, যুদ্ধ করতে অস্বীকার, আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখতে চাওয়ার মত ধৃষ্টতা, মান্না ও সালওয়ার উপর আপত্তি, নবীদেরকে হত্যা, শনিবারের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা লংঘন (বাকারা ৫১-৫২; মায়েদা ২৪; ঐ ৬১; নিসা ১৫৭; বাকারা ৬৫-৬৬) ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে তারা আল্লাহর নাফরমানী করে। ফলে আল্লাহ তাদের উপর নানাবিধ গযব নাযিল করেন। যেমন- লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা (বাক্বারাহ ৬১, আলে ইমরান ১১২)। এছাড়াও ক্ষণিক গযবসমূহ ছিল- (ক) তীহ প্রান্তরে ৪০ দিন উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ানো (মায়েদা ২৪)। (খ) বজ্রপাতে ধ্বংস হওয়া (বাক্বারাহ ৫৫)। (গ) গো-বৎস পূজার জন্য পরস্পরকে হত্যার মাধ্যমে নিষ্ঠুর শাস্তি প্রাপ্ত হওয়া (বাক্বারাহ ৫৪)। (ঘ) মাথার উপর তূর পাহাড়কে ঝুলিয়ে দেয়া (আ‘রাফ ১৭১)। (ঙ) বৈধ ও পূত-পবিত্র বস্ত্ত হারাম হয়ে যাওয়া (নিসা ১৬০-১৬১)। (চ) নিকৃষ্ট বানর ও শুকরে পরিণত হওয়া (বাক্বারাহ ৬৫-৬৬) প্রভৃতি।
মূলত ইহুদীরা হচ্ছে একটি প্রতারক, ধুরন্ধর, বিশ্বাসঘাতক নিষ্ঠুর জাতি। তাই লাঞ্ছনা ও অপমান এদের চিরসঙ্গী। এদের উপর আল্লাহর সবচেয়ে বড় গযব হচ্ছে মুসলমান বা অন্য কোন জাতির ন্যায় তারা কোন স্থানে একত্রিত জীবন যাপন করতে পারবে না। এজন্য ইতিহাসের পাতায় তাদেরকে সবসময় দুরাচারী, অপমানিত, বহিষ্কৃত অবস্থাতেই দেখা যায়। এইতো গত শতাব্দীতেই তারা মুসলিম খিলাফত আমলে আরব থেকে বহিষ্কৃত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আশ্রয় নেয়। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার কর্তৃক নিষ্ঠুরভাবে আক্রান্ত ও বিতাড়িত হয়।
ফিলিস্তীনের ভৌগলিক পরিচয় :
Palestine এর আরবী নাম فلسطين যার অর্থ সুন্দর কিছু। এর আরেকটি অর্থ আল্লাহর ভূমির রক্ষক (ইসলামী বিশ্বকোষ ১৫তম খন্ড, পৃঃ ১৫৩)। মূলত শব্দটি গ্রীক। যার অর্থ- ফিলিসিয়াবাসীদের ভূখন্ড। অর্থাৎ যারা আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ১২০০ শতকের দিকে কেনান তথা জর্ডান নদীর বেলাভূমির দক্ষিণ তীরাঞ্চল দখল করেছিল। এরা ছিল প্রাচীন জুডা রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ফিলিসিয়ার অধিবাসী। এশিয়ার পশ্চিম প্রান্তসীমা ও ভূমধ্যসাগরের পূর্ব সীমানা বরাবর ফিলিস্তীন রাষ্ট্রটি অবস্থিত। এর উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণে ইসরাঈলের অস্তিত্ব থাকলেও মূলত উত্তরে লেবানন এবং সিরিয়া, দক্ষিণে সুয়েজ উপসাগর ও মিশরীয় সিনাই উপদ্বীপ, পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর ও পূর্বে জর্ডান অবস্থিত। এর মোট আয়তন ৬৩৩৫ বর্গকিলোমিটার। ১৯৪৮ সালে এই পরিমাণ ছিল ২৬,৩২৩ বর্গকিলোমিটার। মোট জনসংখ্যা ৪০ লাখ। ১৯৪৮ সালে ছিল ১ কোটি। তন্মধ্যে পশ্চিমতীরে বাস করে ২৫ লাখ, গাজায় ১৫ লাখ, ইসরাঈলে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ১১ লাখ, জর্ডানে ২৮ লাখ, অন্যান্য আরব দেশে ১৭ লাখ এবং সারা পৃথিবীতে ১ লাখ। প্রায় ১ কোটি মানুষের একটি জাতিগোষ্ঠী এমনইভাবে আজ স্বদেশ থেকে বিতাড়িত, ভাগ্যবিড়ম্বিত। তাদেরকে পাশবিক শক্তি প্রতারণার মাধ্যমে এ অবস্থায় নিক্ষেপ করেছে।
গাজা : আয়তন ৩৬০ বর্গ কিঃমিঃ। দৈর্ঘ্য ৪১ কিঃমিঃ। প্রস্থ ১২ কিঃমিঃ। প্রাচীর বেষ্টিত একটি কারাগারের মত। ইসরাঈলের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় ভূমধ্যসাগর ঘেঁসে এক চিলতে জায়গা গাজা।
পশ্চিম তীর : ২ হাযার ৩৯০ বর্গ মাইল। এখানকার অনেকেই উচ্চ মধ্যবিত্ত ও বিদেশে কর্মরত।
ইসরাঈলের ইতিহাস :
৬৩৬ খৃষ্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলীয় ওমর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ফিলিস্তীন সর্বপ্রথম ইসলামী খিলাফতের অধিকারভুক্ত হয়। অতঃপর দীর্ঘ চারশত বছর পর ১০৯৬ সালে ক্রসেডাররা মুসলামানদের হাত থেকে ফিলিস্তীন দখল করে নেয়। পুনরায় ১১৮৭ সালে গাজী ছালাহুদ্দীন আইউবীর নেতৃত্বে মুসলামানরা জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করে। ১৫১৭ সালে সুলতান প্রথম সেলিম ফিলিস্তীন রাষ্ট্রটি মামলুক সুলতান কানজুল ঘোরীর নিকট থেকে ওছমানীয় খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। ১৯১৮ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তীন কার্যত বৃটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। ইতিমধ্যে তুর্কী খিলাফতের বিরুদ্ধে আরব ভূখন্ডে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ধীরে ধীরে শুরু হতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মক্কার ইমাম বা শাসক ছিলেন শরীফ হুসাইন। তিনি এ আন্দোলনের গতিবৃদ্ধিতে বিস্তর ভূমিকা রাখেন। ঠিক এই সময়ের কিছু পূর্বেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে জায়নিজম (Zionism) নামে একটি আন্দোলন শুরু হয়। এই জায়নিজম আন্দোলনের উদ্ভব হয় ভিয়েনা শহরে। থিওডর হারজল নামক একজন হাঙ্গেরীয় ইহুদী সাংবাদিক ভিয়েনার ইহুদীদের নিয়ে শুরু করেন জায়োনিস্ট আন্দোলন। ১৮৯৭ সালে তিনি সুইজারল্যান্ডে প্রথম ‘আন্তর্জাতিক জায়োনিস্ট কংগ্রেস’ আহবান করেন (অধ্যাপক কে আলী, মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস, পৃঃ ৩৩৮)।
এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ইহুদীদের জন্য একটি আলাদা আবাসভূমি তৈরী করা। এই উদ্দেশ্যকে সামান রেখে থিওডর দাবী করলেন, প্যালেস্টাইন ছিল ইহুদীদের আদি নিবাস। অতএব সব ইহুদীকে সেখানে ফিরে যেতে হবে, গড়তে হবে পৃথক আবাসভূমি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম নেতা শরীফ হুসাইন প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি তুরস্কের বিরুদ্ধে বৃটেনকে সহযোগিতা করবেন। আর ব্রিটিশ সরকার তাঁকে আরব সাম্রাজ্য গড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিলাতে এসিটনের দারুণ অভাব দেখা দেয়। ঐ সময় জায়োনিস্ট আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা ও রসায়নবিদ হাইম ওয়াইজম্যান। যিনি বিলেতের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারকে বলেন, তিনি এসিটন উৎপাদন করতে পারবেন। ব্রিটিশ সরকারকে তিনি এ বিষয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করতে রাজি তবে শর্ত হচ্ছে যে, যুদ্ধে জিতলে প্যালেস্টাইনে গড়তে দিতে হবে ইহুদীদের বিশেষ আবাসভূমি। (এবনে গোলাম সামাদ, ইহুদীদের জাতীয় পরিচয়, নয়া দিগন্ত, ১৯ জানুয়ারী ২০০৯, পৃঃ ৬)।
ইহুদীদের দাবী অনুযায়ী ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার নানা স্বার্থকে সামনে রেখে ইহুদীদের জাতীয় আবাসভূমি সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এটাকে ‘বেলফোর ঘোষণা’ (Belfour Declaration) বলা হয় (মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস, পৃঃ ৩৩৮)। এখান থেকেই শুরু ফিলিস্তীন সমস্যার। যাহোক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হারার পর ফিলিস্তীন আসে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে। ফলে বহু ইহুদী ইউরোপ থেকে গিয়ে প্যালেস্টাইনে বসবাস করতে শুরু করে। তারা কিনতে শুরু করে জলাভূমি। ইহুদীরা এসব জলাভূমি সেচে বের করে আবাদি ভূমি। এরকম একটি জলাভূমি সেচে তারা তৈরী করে তেল আবিব শহর এবং প্রতিষ্ঠা করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ক্রমে ক্রমে আরবগণ নিজ দেশে পরবাসীতে পরিণত হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকারের নীতির ফলে আরবদের অসন্তোষ বেড়ে চলল। এ অসন্তোষ আত্মপ্রকাশ পেল আরব-ইহুদী দাঙ্গার মধ্য দিয়ে। ১৯২১, ১৯২৯ ও ১৯৩৬ খৃষ্টাব্দে আরব ও ইহুদীদের মধ্যে যে দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে অসংখ্য লোক হতাহত হয়। ব্রিটিশ সরকার সামরিক শক্তির সাহায্যে এসব দাঙ্গা বন্ধ করে। ১৯৩৬ সালে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ব্রিটিশ সরকার একটি ‘রয়েল কমিশন’ (Royal Commission) নিয়োগ করে। কিন্তু এই কমিশনের প্রস্তাব আরব-ইহুদী উভয়ই প্রত্যাখ্যান করে। ফলে কোন সমাধান ছাড়াই আরব-ইহুদী সংঘর্ষ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিস্তীনের অবস্থার পরিবর্তন হল। আরব ও ইহুদীরা কিছু সময়ের জন্য সংগ্রাম হতে নিরত হয়ে মিত্রশক্তির খেদমতে আত্মনিয়োগ করল। এ সময় ইহুদীরা আমেরিকার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে তাদের সাহায্য লাভ করে। আমেরিকারও মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী ঘাটির প্রয়োজন ছিল। সে মনে করল ইহুদী-ফিলিস্তীনী দ্বন্দ্ব তার সে প্রয়োজন মেটাতে পারে। সুতরাং সে ফিলিস্তীনে ইহুদীদের জাতীয় আবাসভূমি সৃষ্টির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাল। ১৯৪২ সালে ডা. হাইম ওয়াইজম্যান ও আরও কয়েকজন ইহুদী নেতা আমেরিকার সাথে এক বৈঠকে মিলিত হয় এবং সেখানে বিটমোর প্রোগ্রাম (Bitmore Programme) নামে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়।এ প্রস্তাব অনুসারে ইহুদী সাধারণতন্ত্র হিসাবে ফিলিস্তীন প্রতিষ্ঠার দাবী করা হয়। এ সংবাদে সমগ্র আরব জাহান ক্ষেপে ওঠে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৫ সালে আরবলীগ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে আরবলীগের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাশ হয় ফিলিস্তীনকে বিভক্ত করে ইসরাইল নামে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব। ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এর প্রেসিডেন্ট হন হাইম ওয়াইজম্যান (ঐ)।
জাতিসংঘের অবিচারে হতাশ হয়ে আরব বিশ্ব সশস্ত্র পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। আরবলীগের সমস্ত সদস্য অস্ত্রশক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালে ইহুদী ও আরবদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ বাধে। আরবগণ যখন নিশ্চিত বিজয়ের পথে তখন জাতিসংঘ ৪ সপ্তাহের জন্য যুদ্ধবিরতি করতে বলে। এই সুযোগে ইসরাঈল আমেরিকা থেকে অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করে। অন্যদিকে উদ্বাস্ত্তবেশে আমেরিকাও সৈন্য পাঠায়। ফলে ইহুদীরা প্রভূত শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়। অতঃপর পুনরায় যুদ্ধ শুরু হলে আরবরা আর পেরে উঠেনি। ইহুদীরা ফিলিস্তীনের একটি অংশ অধিকার করে ইসরাঈল নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে দীর্ঘ ষড়যন্ত্র-সংগ্রামের পর ইহুদীরা একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হয় (ঐ)।
৬০ বছরের রক্তস্নাত পথ :
ইসরাঈল নামক এই রাষ্ট্রটির অবৈধ জন্মলাভের পর থেকেই তার ভিতরে লুকানো পশুবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ক্রমেই ঘটতে থাকে। ১৯৪৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত দীর্ঘ ৬১ বছরে ইসরাঈল যে বর্বরতা ও পাশবিকতা দেখিয়েছে তা মানুষ কোন দিন কল্পনাও করেনি।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তীন-ইসরাঈল যুদ্ধের সময় পশ্চিমতীর জর্ডানের এবং গাজা মিসরের দখলে চলে আসে। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের ভয়াবহ যুদ্ধে ইসরাঈল পুনরায় সেগুলো দখল করে নেয়। ১৯৮২ সালে ইসরাঈল লেবাননে আগ্রাসন চালিয়ে ১৭ হাযার ৫০০ মানুষকে হত্যা করে। এদের বেশীর ভাগই ছিল নিরীহ জনসাধারণ। ঐ একই বছর লেবাননের শাবরা-শাতিলা গণহত্যায় ১ হাযার ৭শ নিরীহ মানুষ নিহত হয়। লেবাননে ইসরাঈলের উপর্যুপরি আক্রমণে ইয়াসির আরাফাত তাঁর পিএলও-এর ঘাটি বৈরুত থেকে তিউনিশিয়ার রাজধানী তিউনিসে সরিয়ে আনেন। তাতেও রক্ষা হয়নি। তিউনিসেও ১৯৮৬ সালে হামলা চালিয়ে বহু লোককে হত্যা করে ইসরাঈল।
এরপর ১৯৯৬ সালে কানা গণহত্যায় নিহত হয় ১০৬ সাধারণ লেবাননী জনগণ। এরা ছিল জাতিসংঘ আশ্রিত এবং নিহতদের অনেকেই ছিল শিশু। ২০০৬ সালে তারা লেবাননের মারওয়াহিন গ্রামের অধিবাসীদের ঘরবাড়ী ছেড়ে চলে যেতে বলে। সবাই তা মেনে নিয়ে রাস্তায় নামতেই হেলিকপ্টার থেকে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয় (রবার্ট ফিস্ক, কেন পশ্চিমা বিশ্বকে তারা ঘৃণা করে, দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, ৭ জানুয়ারী, ২০০৯ অনুবাদ : মু. আবু তাহির, নয়া দিগন্ত, ১১ জানুয়ারী ২০০৯, , পৃঃ ৬)।
বিভক্ত ফিলিস্তিনীদের ভাগ্য বিড়ম্বনা :
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে আজ ভাগ্যবিড়ম্বিত ফিলিস্তীন জাতি দুইভাগে বিভক্ত- হামাস/গাজা বনাম ফাতাহ/পশ্চিম তীর। মিশরের ‘ইখওয়ানুল মুসলিমীন’ (ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ)-এর আদর্শে গঠিত হয় হামাস। মিশরে ইখওয়ানের উদয় হয় ১৯২৬ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন হাসান আল-বান্না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই দল মিসরে খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠে। মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসের দলটিকে নিষিদ্ধ করেন। দলটি এখনো মিসরে বেআইনী। গাজায় হামাস দল হিসাবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ১৯৮৭ সালের ১৪ই ডিসেম্বর। এরপর থেকেই জনসমর্থন সঞ্চয় করে চলেছে এ সমাজসেবামূলক রাজনৈতিক দলটি। পাশাপাশি ফিলিস্তীনকে ইসরাঈলের করাল গ্রাস থেকে উদ্ধার করার জন্য তারা সশস্ত্র সংগ্রামেও যুক্ত হয়েছে। ফিলিস্তীনের মুক্তি সংগ্রামে আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে ওঠায় সংগঠনটি ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিজয় লাভ করে। কিন্তু হামাসকে সন্ত্রাসী দল আখ্যা দিয়ে আমেরিকা-বৃটেনসহ বিশ্ব মোড়লরা তাদেরকে ফিলিস্তীনের শাসনভার গ্রহণে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং তাদেরকে নির্বাচিত করার অপরাধে (?) শাস্তিস্বরূপ গাজার অধিবাসীদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক অবরোধ। ফলে এক অঘোষিত কারাগারে পরিণত হয়েছে গাজা। বিশ্ববাসীর চোখের সামনে আজ এক বুক শূন্যতা নিয়ে খাদ্যসহ জীবনোপকরণের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে দিনাতিপাত করছে সেখানকার কয়েক লক্ষ বনু আদম। অথচ হামাস কোন সন্ত্রাসী দল নয়। এটা জনসমর্থিত বিপ্লবী রাজনৈতিক দল। সন্ত্রাসবাদ ও বিপ্লববাদ সমার্থক নয়। সন্ত্রাসীদের সাথে বৃহত্তর সমাজের যোগাযোগ থাকে না, কিন্তু বিপ্লবীদের থাকে। জাতিসংঘ চার্টারের ৫১ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে- ‘কোন দেশ যদি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং তার নাগরিকরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে, তখন সেই দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের এবং সমস্ত নাগরিকের এককভাবে বা সংঘবদ্ধভাবে থেকে তাদের আত্মরক্ষার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। সেই হিসাবে হামাসের পূর্ণ অধিকার রয়েছে ইসরাঈলের বিরুদ্ধে লড়াই করার। কেননা তারা হল অত্যাচারিত ফিলিস্তিনী জাতির মুক্তিকামী সংগঠন। অন্যদিকে Palestine Liberation Organization (PLO)-এর একটি অংশ হচ্ছে আল-ফাতাহ, যা ১০ অক্টোবর ১৯৫৯ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি ইয়াসির আরাফাতের আপোষহীন সাহসী নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের লেজুড়দের বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এই আল-ফাতাহর সংগ্রামের ফসল হিসাবে ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর স্বাধীন ফিলিস্তীনের ঘোষণা আসে। সর্বশেষ ২০০১ সালে আসলো শান্তি প্রক্রিয়ার সকল চড়াই-উৎরাই পেরোনোর শেষ পর্যায়ে বিল ক্লিনটনের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিকে দ্বিতীয় ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিতে ইসরাঈল-ফিলিস্তীন উভয়পক্ষকেই স্বাক্ষর করানোর জন্য একত্রিত করা হয়েছিল। কিন্তু আরাফাত ঐ প্রতারণামূলক চুক্তির কতগুলো Volted line-এ স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে আমেরিকা-ইসরাঈলের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ইয়াসিরকে দৃশ্যপট থেকে সরানো। তাই তারা তাকে আল-ফাতাহ-র সদর দপ্তর রামাল্লায় টানা দুই বছর বন্দী করে রাখে। অতঃপর রহস্যজনকভাবে ১১ নভেম্বর ২০০৪ সালে প্যারিসের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এভাবে বিদায় ঘটে এককালের মজলুম জনতার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর আরাফাতের। এরপর দলটির হাল ধরেন তাঁরই ডেপুটি আপোষকামী মাহমূদ আববাস। নেতৃত্বের পরিবর্তনে বিপ্লবী আপোষহীন দলটি এখন মার্কিন-ইসরাঈল চক্রের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েছে। ফলে মার্কিন-ইসরাঈলী ষড়যন্ত্রকে বাস্তবে রূপদান করতে আরাফাতের আল-ফাতাহ এখন আর কোন বাধা নয়।
জরাজীর্ণ এই সংগঠনটি এখন দুর্বলচিত্ত আববাসের পরিচালনায় একটি জনসমর্থনহীন দলে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় ফিলিস্তিনী জনগণ আরাফাতের ফাতাহ-এর বিকল্প খুঁজতে থাকে এবং পেয়ে যায় আরাফাতের জীবদ্দশায় নিষ্ক্রিয় থাকা সংগঠন হামাসকে। এভাবেই দৃশ্যপটে আগমন হামাসের। ইসরাঈলের জন্য স্পর্শকাতর ইস্যুগুলো যেমন ফিলিস্তীনী উদ্বাস্ত্তদের প্রত্যাবর্তন, প্রস্তাবিত ফিলিস্তীন রাষ্ট্রে জেরুজালেমের অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি দাবীতে হামাস আপোষহীন ও অটল। ফলশ্রুতিতে হামাস একদিকে যেমন ইসরাঈলের চক্ষুশুলে পরিণত হয়, অন্যদিকে পরিণত হয় ফিলিস্তিনীদের নয়নমণিতে, যা প্রতিফলিত হয় ২০০৬ সালের ২৫শে জানুয়ারীর নির্বাচনে। নির্বাচনে মাহমূদ আববাস নেতৃত্বাধীন দল পরাজিত হলেও সঊদী আরবের মধ্যস্থতায় ফাতাহ ও হামাস উভয়ের অংশগ্রহণে কোয়ালিশন সরকার গঠন করা হয়। এরপর থেকে এই কোয়ালিশন সরকারকে ভেঙ্গে দেয়ার জন্য ইসরাঈল তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে। অবশেষে পশ্চিমাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রেসিডেন্ট মাহমূদ আববাস কোয়ালিশন সরকার ভেঙ্গে দেন। এহেন মুহূর্তে আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরে হামাস দারিদ্র্যপীড়িত গাজার অধিকার গ্রহণ করে এবং ফাতাহ পশ্চিম তীরের অধিকার গ্রহণ করে। এইভাবে একটি জাতি হিসাবে ফিলিস্তীন বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে ফিলিস্তীন জাতির একতাবদ্ধ শক্তিও ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়ে যায়।
বর্তমান ফিলিস্তীনের অবস্থা :
বর্তমানে ইসরাঈল পশ্চিম তীরের চারিদিকে আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী একটি নিরাপত্তা প্রাচীর তৈরী করেছে, যা সেখানে বসবাসরত ২০ লাখ ফিলিস্তিনীকে বস্ত্তত খাঁচাবন্দী করে রেখেছে। এছাড়া প্রতিমাসে বসবাসরত হাযার হাযার ইহুদীর সাথে যোগ হচ্ছে আরো অগণিত ইহুদী। অন্যদিকে ইসরাঈল সরকার পশ্চিম তীরের ইফরাত এলাকার ৪২৫ একর (১৭২ হেক্টর) ভূখন্ড দখল করে নিয়েছে। এই ভূখন্ডে অন্তত ২ হাযার ৫০০ নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। এই ভবনগুলোতে অন্তত ৩০ হাযার ইসরাঈলীর থাকার ব্যবস্থা করা হবে (নয়া দিগন্ত, ১৮ ফেব্রুয়ারী ’০৯, পৃঃ ৫)।
পশ্চিম তীরের ইহুদী বসতিগুলোতে বর্তমান প্রায় ২ লাখ ৯০ হাযার ইসরাঈলী বসবাস করে। ২০০১ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ লাখের নিচে। অন্যদিকে গাজা থেকে রকেট ছোঁড়া হলেও পশ্চিম তীর থেকে কোন রকেট ছোড়া হয়নি। তারপরও গত বছর সেখানে ইসরাঈলী হামলায় ৫০ জন ফিলিস্তীনী নিহত হয় (খালেদ মিশাল, কোন বর্বরতাই মুক্তির সংকল্প দমাতে পারবে না, অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ, প্রথম আলো, ৭ জানুয়ারী, ২০০৯, পৃঃ ১১)।
অন্যদিকে গাজা মূলত একটি বড় আকারের শরণার্থী শিবির, যার ৮৩ ভাগ মানুষ দরিদ্র। গাজার ফিলিস্তীনীদের সাথে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তীনীদের বৈবাহিক সম্পর্কও নেই। এমনকি গাজার ছাত্র পশ্চিম তীরের কোন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনারও সুযোগ পায় না। এইভাবে একটি জাতিকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সাথে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে ইসরাঈল। ১৯৬৭ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত গাজা এলাকা ইসরাঈলের দখলে ছিল। ফিলিস্তীনীদের অবিরাম প্রতিরোধ-আন্দোলনে অপদস্থ ইসরাঈলীরা ২০০৫ সালে গাজা ছেড়ে গেলেও অত্যাচারী প্রতারক ইসরাঈল গাজার উপর অবরোধ চাপিয়ে দেয়। তারা গাজায় ঢোকার ও বেরুনোর সব পথ বন্ধ করে দেয়। দক্ষিণ মিসরের সিনাইয়ের দিকে একটা প্রবেশ পথ আছে। কিন্তু মার্কিন-ইসরাঈলের চাপের মুখে মিসর সে পথটিও বন্ধ করে দেয়।
এই অবরুদ্ধ গাজার উপর তারা ২০০৬ সালে বিমান হামলা চালিয়ে ২৯০ জন নিরীহ গাজাবাসীকে হত্যা করে। তারপর ২০০৮ সালের জানুয়ারীতে গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে ১৪০ জনকে হত্যা করে। এরপর ২০০৮ সালের জুন মাসে ৬ মাসের যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে গাজায় ইসরাঈলের অবরোধ প্রত্যাহার এবং গাজা থেকে রকেট নিক্ষেপ বন্ধে সম্মত হয় হামাস।
কিন্তু ইসরাঈল ৪ ও ১৭ নভেম্বর আকাশ ও স্থলপথে গাজায় হামলা চালিয়ে যুদ্ধ বিরতি ভঙ্গ করলেও ওবামার নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত মিডিয়ায় তা ধামাচাপা পড়ে যায়। ১৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে ইসরাঈল-হামাস ৬ মাসের যুদ্ধ বিরতির মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ২৭ ডিসেম্বর যুদ্ধ বিরতি ভঙ্গকারী ইসরাঈল গাজায় নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। বিনা উসকানীতে ঠান্ডা মাথায় গাজার ঘুমন্ত, নিরীহ মানব সমাজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরাঈল। ইসরাঈলী জঙ্গী বিমানগুলো আকাশ পথে, যুদ্ধ জাহাজগুলো নৌপথে এবং ট্যাংক বহরের দুর্ভেদ্য নিরাপত্তাবূহ্য নিয়ে ইসরাঈলী পদাতিক বাহিনী প্রায় ২২ দিন যাবত মানবতার বিরুদ্ধে সভ্য দুনিয়ার এক নজীরবিহীন নৃশংস তান্ডব চালায়। নবাবিষ্কৃত ফসফরাস বোমায় মানবহত্যার নিষ্ঠুর পরীক্ষা চালায়। এমনিতেই দীর্ঘ অবরোধের কারণে গাজাবাসী নিঃস্ব, অসহায় ও সম্বলহারা। নেই তাদের পর্যাপ্ত খাদ্য-পানীয়। তার উপর নিষ্ঠুর ইসরাঈল বাহিনীর বর্বর আক্রমণে গাজাবাসী অসহায় হয়ে পড়ে। টানা ২২ দিনের মর্মন্তুদ হত্যাকান্ডে গাজা পরিণত হয় সাক্ষাৎ বধ্যভূমিতে। ফিলিস্তীনের সরকারী পরিসংখ্যান মতে এই হামলায় ৪১০ শিশু ও ১০০ নারী সহ ১৩০০ শ’রও বেশী লোক নিহত হয়, আহত হয় ৫ হাযার ৩শ’ লোক। ৪ হাযার ১শ’ বাড়ীঘর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে ইসরাঈলী সেনা মারা যায় মাত্র ১৩ জন।
এই নৃশংস হামলার কারণ হিসাবে ইসরাঈল অজুহাত দেয় হামাস গাজা থেকে রকেট ছুঁড়লে তার জবাবে আমরা এই হামলা চালিয়েছি। অথচ হামাসের রকেট হামলায় ইসরাঈলে মারা যায় ১৩ জন, আর তার জবাবে ইসরাঈল হত্যা করে ১৩০০ জন !! এরপরেও কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, শক্তির ব্যবধানে বহুগুণ পিছিয়ে থেকেও খামাখা রকেট হামলা চালিয়ে ইসরাঈলকে উস্কানী দেয়ার পিছনে হামাসের যুক্তি কি? হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান খালিদ মিশেল এর উত্তরে লেখেন, ‘আমাদের ঘরে বানানো রকেটগুলো আর কিছুই নয়, দুনিয়ার কাছে আমাদের ফরিয়াদ। যেন তারা শুনতে পায় যে, আমরা এখনো বেঁচে আছি মরে যাইনি। ইসরাঈল ও মার্কিন শক্তি চাচ্ছে আমরা মরব কিন্তু আওয়াজ করব না। আমরা বলছি আমরা মরব তবু নীরব হব না (প্রথম আলো, জানুয়ারী ২০০৯, পৃঃ ১১)।
শান্তির ললিতবাণী প্রচারকরা কোথায়?
সন্ধ্যার মৃদুমন্দ হাওয়ায় ঘুমাতে যাওয়া আর পাখির কোলাহলে আনন্দঘন পরিবেশে ঘুম জাগা শিশুটি যখন নিমিষেই হচ্ছে পিতৃহারা, মায়েরা হচ্ছে সন্তানহারা, স্ত্রীরা হচ্ছে স্বামীহারা। পিতৃহারা সন্তানের বুকফাটা আর্তনাদ, স্বামীহারা বিধবার গগণবিদারী চিৎকার, সন্তানহারা পিতার শোকের মাতম যখন পৃথিবীর আকাশ-বাতাসকে কাপিয়ে তুলেছে; সকলের অলক্ষ্যে নির্যাতিত বান্দার আর্তচিৎকারে আল্লাহর আরশটিও যেন কেঁপে উঠেছে। সমগ্র পৃথিবী যখন এ গণহত্যায় শোকে মুহ্যমান। সেই মুহূর্তেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ নির্লজ্জভাবে উল্টো সহায়হীন ফিলিস্তীনীদের দায়ী করে বিষোদগার করেন। অন্যদিকে শপথ না নেয়ার ঠুনকো অজুহাতে চুপটি মেরে ঠিকই বসে ছিলেন তথাকথিত ‘পরিবর্তন’-এর বার্তা নিয়ে হাজির হবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা। অথচ ক’দিন আগেই তিনি মুম্বাই বোমা হামলার নিন্দা করতে ভুলেননি। দ্বিমুখী আচরণের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে শপথ নেয়ার পূর্বেই ওবামা তার আসল চেহারা উন্মোচন করে দেন।
শান্তির বার্তাবাহক (!) তকমা লাগিয়ে এই আমেরিকাই আবার পৃথিবীব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তার দরস দিয়ে যাচ্ছে। শিশু ও নারীর অধিকারের পক্ষে অবিরাম বুলি আওড়াচ্ছে। অথচ দীর্ঘ ৬২ বছর যাবৎ ফিলিস্তীনের বুকে যে অন্তহীন কান্নার প্রস্রবণ বয়ে চলেছে তা তাদেরকে বিন্দুমাত্র অাঁচড় কাটে না। পশ্চিমা মিডিয়াগুলোতে সবসময় সোচ্চারভাবে প্রচারিত হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোতে তথাকথিত নারী নির্যাতনের কাহিনী। কিন্তু ইসরাঈলের প্রকাশ্য লোমহর্ষক নারকীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তারা মুখে কুলুপ এঁটে আছে। হাজারো মানবাধিকারবাদী, নারীবাদী, প্রাণীবাদী সংস্থা যারা দেশে দেশে মানব-প্রাণীকুল নির্যাতনের চিত্র সন্ধানে হয়রান হয়ে বেড়াচ্ছে তাদের কাছেও ফিলিস্তীনী নারী ও শিশুর বুকফাটা আর্তনাদ কোনই প্রভাব ফেলে না। তবে কি মুসলিম নারী ধর্ষণ মানবতাবিরোধী কাজ নয়? মুসলিমদের উপাসনাস্থল ধ্বংস করা কি ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ণ করা নয়? নিরীহ মুসলিমদের হত্যা করা কি গণহত্যা নয়? কেন শান্তির ললিতবাণী প্রচারকরা এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকে? কেন তাদের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের হুংকার সেখানে স্তব্ধ হয়ে যায়? এভাবেই কেবল আপন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরগরম গণতন্ত্র, শান্তি ও নিরাপত্তার ভড়ংধারী এই রাষ্ট্রগুলো মুসলিম বিশ্বের উপর চালিয়ে যাচ্ছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক নীরব গণহত্যা।
মুসলিম বিশ্বের নীরবতা :
গাজার নিরীহ নির্যাতিত সম্বলহারা ভাইয়ের বুকফাটা আর্তনাদ যখন পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে মুসলমানদের চক্ষুকে অশ্রুসিক্ত করছে, তখন মুসলিম বিশ্বের শাসকদের কাপুরুষোচিত নীরবতা যেন মড়ার উপর খাড়ার ঘা। বিশেষ করে আরব বিশ্ব পাশ্চাত্যের সুবোধ তল্পীবাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আজ মুসলিম বিশ্বের শাসকগণ ইহুদী-খৃীষ্টানদেরকে পরম শুভাকাংখী মনে করে তাদের মনোরঞ্জনে নিয়োজিত রয়েছে। যে মুহূর্তে পবিত্র বায়তুল আকসায় ইহুদীদের সিনাগগ তৈরী হচ্ছে, মুসলিম ভাইদের উপর অকথ্য যুলুম-নির্যাতন চালানো হচ্ছে, তাদেরকে মরু বিয়াবানে শিয়াল-কুকুরের মত তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রতিবাদ করতে গেলে বুলেট-বোমায় বুক ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে, ট্যাংকের চাকায় পিষে মারছে, উদ্বাস্ত্ত শিবির গুড়িয়ে দিচ্ছে, পাইকারীভাবে গণহত্যা চলছে, সেই মুহূর্তে আমাদের কাপুরুষ, হীন নেতাদের উপদেশবাণী (?) হল- ওদের হাতে পারমাণবিক বোমা আর মিসাইল, আকাশে ওদের একচ্ছত্র আধিপত্য, দরিয়ায় তাদের সুবিশাল নৌবহর, জমিনে ওদের ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান, দুনিয়াটা ওরা নিমিষে খতম করে দিতে পারে, ওদের মোকাবেলা করতে গিয়ে খামাখা তাজাপ্রাণ, মাল-সম্পদ নষ্ট করে লাভ কী?
হে কাপুরুষ মুসলিম শাসক! ঐ শোন ধর্ষিতা বোনের কান্না। ঐ শোন এতিম শিশুর বুকফাটা আহাজারী। শোন ঐ আশ্রয়হীন ছিন্নমূল লাখো দুস্থ-দুর্গত-নির্যাতিত-নিগৃহীত মুসলিম ভাইয়ের ক্রমাগত আর্তনাদ। শোন ঐ ক্ষুধার্ত বুভুক্ষ মা-বোনদের আর্তচিৎকার। ওরা যাবে কোথায়? খাবে কি? ওদের অশ্রুসিক্ত নয়ন তো তোমাদের পানে চেয়ে আছে। বল কী করবে?
আশ্রয়হীন ক্রন্দনরত নারী-শিশুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ত-মাংস, অস্থি-মজ্জা একাকার করে দেওয়ার পর শাসকদের এই যখন অবস্থা। এইভাবে এক গালে চড় মারার পর আরেক গাল পেতে দেওয়ার দৃশ্যে মহা গদগদ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবার কেবল চড়-থাপ্পড় নয়, জোড়া পায়ে লাথি মারতে শুরু করেছে। এই সুযোগে কেবল গাজা-পশ্চিম তীর নয়, ইরাক-আফগানকে এক সাথে ধূলায় মিশিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসীরা। মানবতার অধিকার ও স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং শান্তি, নিরাপত্তা ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি নিয়ে যে বিশ্বসংস্থার জন্ম, সেই জাতিসংঘে মুসলিম শাসকদের মহামান্য গুরু আমেরিকা ইসরাঈলের নৃশংসতার বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাবও যখন পাশ করাতে পারে না, তবুও কেন আমেরিকার কদমবুসি করে চলতে হবে? ১শ’ ৫৫ কোটি মুসলমান আর কতকাল এভাবে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে অসহায় হয়ে চেয়ে থাকবে? কতকাল আর হাত পা গুটিয়ে শীর নুইয়ে অশ্রুপাত করবে?
সমাধান কোন পথে?
ফিলিস্তীন ইসরাঈল সমস্যার সমাধান হতে পারে দুইভাবে- শান্তিপূর্ণ সমাধান অথবা রক্তক্ষয়ী সমাধান।
শান্তিপূর্ণ সমাধান : শান্তিপূর্ণ সমাধানের নামে ফিলিস্তীনীরাও বাধ্য হয়ে আমেরিকার দেয়া রোডম্যাপ অনুযায়ী যে প্রস্তাব মেনে নিয়েছে তা হল দ্বি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ। কিন্তু এই সমাধানেও কয়েকটি বাধা রয়েছে। যথা- জেরুজালেমকে রাজধানী বানানো নিয়ে। ইসরাঈল ও ফিলিস্তীন উভয়েই চায় জেরুজালেমকে রাজধানী বানাতে এবং বায়তুল আকছাকে নিজেদের অধীনে রাখতে। এছাড়া আরেকটি বড় বাধা সৃষ্টি করছে ইসরাঈল। তারা প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৬৭ সালের সীমানায় ফিরে যাওয়া দূরে থাক বরং দখলকৃত স্থানে আরো বসতি স্থাপন করছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা আমেরিকা-ইউরোপ যদি ইসরাঈলের প্রতি এতই দরদী হয় তাহলে নিজের ঘরে জায়গা দিচ্ছে না কেন? কেন অপরের জমি অন্যায়ভাবে রক্তগঙ্গা বইয়ে দখল করে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে শান্তির বাণী প্রচারকদের? ফিলিস্তীনে সত্যিই কি শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্বেগ তাদের রয়েছে?
রক্তক্ষয়ী সমাধান : এই পৃথিবীর প্রতিটি সচেতন মানুষ জানে যে, ফিলিস্তীন ফিলিস্তীনীদেরই। ইসরাঈল ও বর্তমান ফিলিস্তীন পুরোটাই দশ সহস্রাধিক বছরের ঐতিহাসিক জাতি ফিলিস্তীনীদের। সুতরাং এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ইসরাঈলের অধিকৃত জমি পুরোটাই ফিলিস্তিনীদের। এটা পুনরায় উদ্ধার করা তাদের কর্তব্য। এই অধিকার আদায়ের স্বার্থে যদি ফিলিস্তিনীরা প্রতিনিয়ত ইসরাঈলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যায় এতে আপত্তির কোন সুযোগ নেই। স্বাধীনতা যদি মানুষের জন্মগত অধিকার হয় তাহলে সদ্য জন্ম নেয়া ফিলিস্তীনী শিশুটিরও এ অধিকার রয়েছে। অতএব এই পথে স্বাধীনতা অর্জন যতই রক্তক্ষয়ী হোক না কেন এ ছাড়া আর কোন বাস্তব সম্মত পথ নেই।
ইসরাঈলের ধ্বংস সুনিশ্চিত :
সূরা আ‘রাফের ১৬৮ নং আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইহুদীরা কোনদিন ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপন করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি তারা ইসরাঈল নামে একটি নিজস্ব রাষ্ট্র সৃষ্টি করে প্রায় ৬০ বছর ধরে সমবেত হচ্ছে। মূলত ইসরাঈল কখনোই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়। বরং মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের সৃষ্ট একটি সামরিক কলোনী মাত্র। এই বশংবাদ কলোনীটিকে রাষ্ট্র নাম দেওয়াটাও বৃহৎ শক্তিবর্গের রাজনৈতিক খেলা। তাছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে বর্তমান ইসরাঈলে তাদের জমা হওয়াটা চূড়ান্ত ধ্বংসের আলামত হতে পারে এবং এই আলামত ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। ইসরাঈল সত্যিকারের বিপদ, আসল হুমকি তার ঘরের মধ্যেই মাথা চাড়া দিচ্ছে। ইসরাঈলের মোট জনসংখ্যা ৭.১ মিলিয়ন। তন্মধ্যে ইহুদী ৫.৫ মিলিয়ন। আর বাকী ১.৬ মিলিয়ন মুসলমান। আর গাজা ও পশ্চিম তীরে বসবাসকারী সব মুসলমান মিলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫.৫ মিলিয়ন। এখনই মুসলমানরা ইহুদীদের থেকে ১ লাখ বেশী। ২০২০ সালের মধ্যে ২১ লাখ বেশী হবে (Can Israel Survive? টিম ম্যাকগাক, দি টাইম ম্যাগাজিন, ১৯ জানুয়ারী বঙ্গানুবাদ : ইফতেখার আমিন, নয়া দিগন্ত, ২৯ জানুয়ারী’০৯, পৃঃ ৬)। তখন এমনিতেই দৃশ্যপট পাল্টে যাবে। তাইতো অনেক বুদ্ধিজীবী মনে করেন ফিলিস্তীনীদের উচিৎ দ্বৈত-রাষ্ট্র সমাধানের আশা বাদ দিয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা করা। তাতে যদিও কয়েক দশক লেগে যাবে কিন্তু এতে ইসরাঈলীদের বিপদ ঘটবে।
এছাড়া এটাও ঐতিহাসিক সত্য যে, অত্যাচার করে কেউ কোনদিন টিকে থাকেনি। বরং অসত্যের পতন অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং ইসরাঈলও একদিন ধ্বংস হবে। কেননা শত সহস্র শহীদের পথ থেকে ফিলিস্তীনীরা এক চুল সরে দাঁড়ায়নি। পুরনো প্রজন্মের ফিলিস্তীনীরা মুক্তিযুদ্ধের সাথে সামান্যতম আপোষকামী দেখায়নি। শহীদের রক্ত, বোমায় ঝাঁঝরা হওয়া শরীর কথা বলতে শুরু করেছে। শরণার্থী শিবিরে সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটাও মুক্তির স্বপ্নে বিভোর। শহীদ হওয়ার মাঝে যে জাতি আনন্দ পায় তাদেরকে হত্যা করা যায়, ধ্বংস করা যায় না। অবরুদ্ধ করা যায় কিন্তু স্বাধীনতার আকাশছোঁয়া স্বপ্নচ্যুত করা যায় না। তাই আজ মুসলিম বিশ্বের উচিৎ তুরস্কের রেসিপ তাইয়েপ এরদোগান ও ইরানের আহমাদিনেজাদের ন্যায় সাহসী ভূমিকা পালন করার মাধ্যমে ফিলিস্তীনের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। সেক্যুলার রাষ্ট্র তুরস্কের রাজনীতির পালে নতুন হাওয়া লেগেছে। এখন তারা ফিলিস্তীনের স্বাধীনতা অর্জন করার ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। ২০০৯ সাল দাভোসের অর্থনৈতিক সম্মেলনে তুর্কী প্রেসিডেন্ট ইসরাঈলী প্রধানমন্ত্রীর সাথে মুখোমুখি বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হন। তিনি আঙ্গুল উচিয়ে গাজার হামলাকে গণহত্যা বলে সম্মেলন কক্ষ ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে এ বছর ৩১ মে তুরস্কের সহযোগিতায় গাজা অধিবাসীদের জন্য একটি ত্রাণবাহী জাহাজ ‘মাভি মারমারা’ গাজার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। উক্ত জাহাজে ইসরাঈলী সেনাবাহিনী নির্বিচার হামলা চালিয়ে ২০ জন মানবাধিকার কর্মীকে হত্যা করে তন্মধ্যে ৮ জনই তুর্কী। এতে করে তুরস্কের সাথে ইসরাঈলের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। অন্যদিকে তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের আপামর জনতার সমর্থন কুড়াতে সক্ষম হয়। এ ঘটনা ইসরাঈলের বিরুদ্ধে নতুন করে ঘৃণার সাগর বইয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী। হয়তো অচিরেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটবে এই সন্ত্রাসী রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে। আল্লাহর নবীও বলে দিয়েছেন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না মুসলমানেরা ইহুদীদের সাথে লড়াই করবে। তারা ইহুদীদের হত্যা করবে। ইহুদীরা পাথর খন্ড ও গাছের আড়ালে লুকাবে। তখন পাথর ও গাছগুলি বলবে হে মুসলিম! এই যে ইহুদী আমার পিছনে। এস, ওকে হত্যা কর (মুসলিম হা/৮২, কিতাদুল ফিতান, মিশকাত হা/৫১৪৪)। তাই হতে পারে ফিলিস্তীনে তাদের জমা হওয়াটা চূড়ান্ত ধ্বংসের পূর্ব আলামত।
পরিশেষে বলব ফিলিস্তীন মুসলমানদেরই। বায়তুল আকছা মুসলমানদেরই। পৃথিবীর কোন শক্তি তাদেরকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। আর সত্যিই মুসলিম শাসকদের যদি কখনো সুমতি হয় তবে প্রতিটি বিবেকবান মুসলিম আত্মা চলমান অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিজেদের ঈমানী দায়িত্বে সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। আল্লাহ মুসলিম বিশ্বের পাঞ্জেরীদের সঠিক চেতনা দান করুন। আমীন!!