পথে-প্রান্তরে
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
মুখতারুল ইসলাম 2652 বার পঠিত
২৫ জুন’০৯ তারিখে ৫০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন আমেরিকান পপ সিঙ্গার মাইকেল জ্যাকসন। গিনেস বুক অব রেকর্ডস অনুসারে সর্বকালের সবচেয়ে সফল শিল্পী বিচিত্র চরিত্রের এই গায়ক মৃত্যুর পূর্বে যেমন নানা ঘটন-অঘটনের জন্ম দিয়ে সারা দুনিয়ায় আলোচিত ছিলেন, তেমনি মৃত্যুর পর অদ্যাবধি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই রয়েছেন। ২০০৮ সালের শেষের দিকে প্রথম মিডিয়ায় খবর আসে যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং নতুন নাম গ্রহণ করেছেন ‘মিকাইল’। বাহরাইনে আরবদের সাথে তোলা বিভিন্ন ছবিতে তার আরবীয় পোষাক পরিধান বিষয়টিকে আরো জোরদার করে তুলে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে জ্যাকসন নিজে কখনো এরূপ ঘোষণা দেননি, এমনকি মিডিয়ায় বারবার আলোচনা উঠে আসার পরও পক্ষে-বিপক্ষে তাঁর কোন মন্তব্যও পাওয়া যায়নি। তাঁর মৃত্যুর পর যখন পুনরায় তাঁকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠে, তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন না করেননি তা নিয়ে বহু বিতর্ক হয়। তাঁর মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পর ৭ জুলাই লস্ এঞ্জেলসের স্টাপল সেন্টারে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলাকালীন যখন বিশ্বের প্রায় ৩২ মিলিয়ন টিভি দর্শক অবাক বিস্ময়ে সে দৃশ্য অবলোকন করেছিল, তখনও তার লাশ ইসলামী রীতিতে দাফন হবে কি-না তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা অব্যাহত ছিল। পরিশেষে তার লাশ দাফন করা হয় অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে তার বাসস্থান নেভারল্যান্ডে। সর্বশেষ ৩ সেপ্টেম্বর’ ০৯ ক্যালিফোর্নিয়ার ফরেস্ট লোন মেমোরিয়াল পার্কে পুনরায় কবরস্থ করা হয় অন্যান্য হলিউড লিজেন্ডারীদের সাথে। পরবর্তীতে তদন্ত রিপোর্টে তাঁর মৃত্যুকে একটি হত্যাকান্ড হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এ মর্মে মামলাও করা হয়েছে। যা এখনও আদালতে বিচারাধীন।
তার ইসলাম গ্রহণ নিয়ে এখানেই আলোচনার সমাপ্তি ঘটার কথা থাকলেও মিডিয়ায় আজও এ বিষয়ে সংশয়-বিতর্কে সরব রয়েছে। এমনকি তাঁর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কয়েক ধরনের গুজব পর্যন্ত তৈরী হয়েছে। আমরা এখানে মাইকেল জ্যাকসনের ভাই জারমেইন জ্যাকসন (মুহাম্মাদ আব্দুল কাদের)- যিনি ১৯৮৯ সালে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন- তার সাক্ষাৎকার তুলে ধরে বিষয়টি বিশ্লেষণের প্রয়াস পাব। তার পূর্বে যেটা বলতে হয় যে, এ বিতর্কের পিছনে বেশ অনেকগুলি ঘটনার উপস্থিতি বর্তমান যা অনেকটা ইঙ্গিত দেয় যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন নতুবা অচিরেই গ্রহণ করতেন। বাহরাইনের একটি বুলেটিনে যার বিবরণ পাওয়া যায় এভাবে- ‘ইতিপূর্বে তিনি মুসলমান হয়েছেন বলে কয়েকবার গুজব উঠলেও ২১ নভেম্বর ২০০৮ বিশ্বমিডিয়ায় সর্বপ্রথম প্রকাশ পায় যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং নতুন নাম মিকাইল রেখেছেন। এমনকি আল-কায়েদা নেতা আইমান আল-জাওয়াহেরী পর্যন্ত তাঁকে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানান। ১৯৮৯ সালে একটি প্রেস কনফারেন্সে মাইকেলের একটি মন্তব্য বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যেখানে তিনি বলছিলেন, ‘আমি ইসলামকে আমার ভাইয়ের মধ্যে দেখেছি। আমি ইসলাম সম্পর্কে বই-পত্রও পড়েছি এবং কোন একদিন ইসলামের এই প্রশান্তি, স্থিরতার মাঝে নিজের অনুভূতিতে একান্তভাবে পেতে ইচ্ছা করি।’ পরবর্তীকালে মাইকেলের জীবনে অনেক ঝড়ঝাপ্টা নেমে আসে। নানা মিথ্যা অভিযোগে তাকে জর্জরিত করা হয়। শিশুর উপর পাশবিক নির্যাতন চালানোর মত হীন অপবাদ একাধিকবার আরোপ করে মিডিয়ায় তাঁর নামে দুর্নাম রটানো হয়। ছোট্ট শিশুর মত চঞ্চলপ্রাণ মাইকেল এতসব চাপ সহ্য করার মত লোক ছিলেন না। ফলে তিনি সঙ্গীত জগৎ থেকে অনেকটা পিছিয়ে এসে সমাজকল্যাণমূলক কর্মকান্ডে আত্মনিয়োগ করেন। সঙ্গীত থেকে আয়কৃত বিপুল সম্পদ এ পথে ব্যয় করতে থাকেন। এসময় কয়েক বছর তিনি ইংল্যান্ডে অবস্থান করেন এবং তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু ক্যাট স্টিভেন্সের (ইউসুফ ইসলাম) সাহচর্যে কিছুদিন সময় কাটান। দক্ষিণ আফ্রিকার আরেক প্রখ্যাত মুসলিম সঙ্গীতশিল্পী জাইন ভিখার সাথেও এ সময় তার বন্ধুত্ব হয়, যিনি Give Thanks to Allah শিরোনামে একটি গান রচনা করেন। জাইন ভিখা চেয়েছিলেন মাইকেল নিজের কণ্ঠে এই গানটি গাইবেন। কিন্তু সে সময় হয়ে উঠেনি। গানটির ভাষা ছিল এরূপ-
Give thanks to Allah/ For the moon and stars
Prays in All day full/ What is end what is was.
Take hold of your Eman/ Oh You who belive. Please give thanks to Allah/ Allah Ghafurun Allah Rahimun/Allah yuhibbul-Muhsineen.
هو خالقنا / هو رازقنا /وهو على كل شئ قدير
He is the Creator / He is the Sustenancer
And he is the one/ who has power over all.
Give Thanks to Allah/ For the moon and stars
Prays in All day full/ What is end what is was.
Don't given to Shaitan/ Oh you belive Please
Give Thanks to Allah/Allah Ghafurun/ Allah Rahimun/ Allah yuhibbul-Muhsineen.
هو خالقنا / هو رازقنا /وهو على كل شئ قدير
He is the Creator / He is the Sustenancer /
And he is the One, who has/ Power Over All.
পুনরায় আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার পর আদালতে মাইকেলের বিরুদ্ধে কথিত শিশু নির্যাতনের অভিযোগে বিচারকার্য শুরু হয়। ফলে তার বন্ধু বাহরাইনের বাদশাহর পুত্র শেখ আব্দুল্লাহ বিন হামাদ আল-খলীফা-এর আমন্ত্রণে তিনি বাহরাইনে চলে আসেন। সেখানে তিনি প্রায় তিন বছর অবস্থান করেন এবং ইসলাম সম্পর্কে আরো পড়াশোনা করেন। এমনকি ছালাতের নিয়ম-কানুন ও পবিত্র কুরআন পাঠ পর্যন্ত শিক্ষা করেন বলে জানা যায়। অতঃপর ২১ নভেম্বর’০৮ লস এঞ্জেলসে এক বন্ধুর বাসায় অনাড়ম্বরভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন। গত বছর মার্চ মাসে জীবনের শেষ প্রেস কনফারেন্সে যখন তিনি পুনরায় সঙ্গীত জগতে প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা দেন তখন তিনি বলেন, ‘এটাই হবে আমার জীবনের সর্বশেষ কনসার্ট। আসছে জুলাইয়ে সবার সাথে দেখা হবে’...। তাঁর পরিকল্পনা ছিল এই কনসার্ট থেকে ঘোষণা করবেন যে, তিনি সঙ্গীতজগত থেকে স্থায়ীভাবে বিদায় গ্রহণ করছেন। আর সম্ভবত এটাই তাঁর অভিপ্রায় ছিল যে, এখানেই তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করবেন। কেননা তিনি রিহার্সেলের সময় জাইন ভিখার উপরোক্ত গানটিও গেয়েছিলেন যা তাঁর অসম্পূর্ণ স্টুডিও রেকর্ডে পাওয়া গেছে। ২৫ জুন রাতে কাজ শেষ হওয়ার পর তার প্রডাকশন ম্যানেজারের সাথে কোলাকুলি করার সময় তিনি বলেন, ‘দুই মাসের রিহার্সেলের পর আমি এখন কনসার্টের জন্য পুরো প্রস্ত্তত। শুভরাত্রি। কাল তোমাদের সাথে আবার দেখা হবে।’ অতঃপর কিছুক্ষণবাদে রাত ১২-টার দিকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর ঘণ্টাখানিক পরে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হলে রাত ২.২৬ মিনিটে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। হাসপাতাল থেকে বলা হয় ঘুমের ঔষধের মাত্রা বেশী হওয়ার কারণে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর পরিবার সেটা মেনে নেয়নি। তাঁর মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান নিয়েও চলে দীর্ঘ নাটকীয়তা। তাঁর পরিবার ও ভক্তদের পক্ষ থেকে দাবী করা হয় যে, এ মৃত্যুর পিছনে কোন মহলের অশুভ হাত রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন চাউর হয়। ফলে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পূর্বেই তাঁর মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর সিএনএনের সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জনগণকে শান্ত করার জন্য বলতে বাধ্য হন, ‘তাঁর মৃত্যুতে কোন ষড়যন্ত্রের সংযোগ নেই।’ একজন প্রেসিডেন্টের এই আগ বাড়ানো মন্তব্য তখন অনেকের কাছেই সন্দেহজনক ঠেকেছিল। যাইহোক রহস্যে ভরপুর এ সঙ্গীতজ্ঞের জীবিতাবস্থার মত মৃত্যু এমনকি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও ছিল রহস্যাবৃত। বলা হচ্ছে, সে অনুষ্ঠানে যে কফিনটি আনা হয় তা ছিল স্রেফ ‘শো’। তাতে কোন মৃতদেহ ছিল না। মূলত তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়েছিল দিনকয়েক পূর্বেই। আর যেহেতু তা ইসলামী কায়দায় ছিল এজন্য সিআইএ-এর নির্দেশে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে তাঁর বসতস্থল নেভারল্যান্ডে কবর দেওয়া হয়। মোটকথা বাহরাইনের উক্ত বুলেটিনে দীর্ঘ আলোচনায় এটাই প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলেই তাঁর উপর সরকারী মহল থেকে নানা নির্যাতন নেমে আসে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের ষড়যন্ত্রেই তাঁকে অকাল মৃত্যুবরণ করতে হয়।’
মাইকেল জ্যাকসনকে নিয়ে এসব বিতর্কের হয়ত কোনদিনই অবসান হবে না। কেননা কার্যকারণ বিবেচনায় অনেক কিছুই মেলানো সম্ভব হয় না বলে এসব বিষয় সাধারণত চিরদিনই অমীমাংসিত রয়ে যায়।
আমরা এখানে তাঁর ভাই জারমেইন জ্যাকসন যিনি মাইকেলের ৩য় ভাই এবং জ্যাকসন ফাইভ ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন (১৯৮৯ সালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন) তার ইসলাম গ্রহণের প্রেক্ষিতে গৃহীত একটি সাক্ষাৎকার এবং অতি সম্প্রতি বিবিসিতে প্রচারিত আরেকটি সাক্ষাৎকার তুলে ধরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করব।
আল-মাজাল্লাহ (আরবী), লন্ডন কর্তৃক গৃহীত সাক্ষাৎকার :
প্রশ্ন : সর্বপ্রথম কখন ও কিভাবে আপনি ইসলামের সংস্পর্শে আসেন?
জা: জ্যা : এটা ছিল ১৯৮৯ সালের কথা যখন আমি আমার বোনের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। এসময় বাহরাইনে অবস্থানকালে আমরা উষ্ণ অভ্যর্থনা পাই। আমরা সেখানকার শিশুদের সাথে কৌতুকচ্ছলে কথা বলছিলাম। তারাও সরল-সহজভাবে প্রশ্ন করছিল। তারা জিজ্ঞেস করে বসল আমার ধর্ম সম্পর্কে। আমি বললাম, আমি একজন খৃষ্টান। আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের ধর্ম কি? তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমস্বরে বলল, ইসলাম। তাদের এ উদ্দীপক উত্তর আমার হৃদয় কন্দরে যেন ধাক্কা দিল। অতঃপর তারা আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলতে লাগল। যাতে তাদের বয়সের তুলনায় অধিকতর পরিপক্কতার ছাপ রাখছিল। তাদের স্বরগ্রাম স্পষ্ট করে দিচ্ছিল যে, ইসলাম ধর্ম নিয়ে তারা কত গর্বিত। এটাই ছিল ইসলামের দিকে আমার প্রথম পদক্ষেপ।
এই ছোট্ট শিশুদের সাথে আমার সামান্য বাক্যালাপ আমাকে মুসলিম পন্ডিতদের সাথে ইসলামের ব্যাপারে আলোচনার দুয়ার খুলে দিল। চিন্তাজগতে যেন এক অপার্থিব ঢেউ উথাল-পাথাল করতে লাগল। নিজেকে প্রশান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম যে কিছুই ঘটেনি। কিন্তু তবুও ব্যাপারটা আমি গোপন করতে পারছিলাম না যে, অন্তর থেকে ইসলামকে গ্রহণ করে ফেলেছি। প্রথমে ব্যাপারটা আমি প্রকাশ করে ফেললাম আমাদের পারিবারিক বন্ধু কুরবান আলীর কাছে। এই কুরবান আলীই আমাকে সঊদী আরবের রাজধানী রিয়াদে নিয়ে এলেন। তখনও পর্যন্ত ইসলাম সম্পর্কে আমি বেশী কিছু জানতাম না। তারপর আমি এক সঊদী পরিবারের সাথে ওমরা পালনের জন্য মক্কায় গেলাম। এখানেই আমি জনসম্মুখে প্রথম আত্মপ্রকাশ করলাম যে, আমি এখন থেকে একজন মুসলিম।
প্রশ্ন : ইসলাম গ্রহণের পর আপনার প্রাথমিক অনুভূতি কি ছিল?
জা: জ্যা : ইসলাম গ্রহণের পর আমার অনুভূতি ছিল এমন যেন আমি পুনর্জন্ম লাভ করেছি। ইসলামের মাঝে আমি খুঁজে পেয়েছি এমন সব প্রশ্নের উত্তর যা আমি খৃষ্টধর্মে পাইনি। বিশেষত যিশুর জন্ম সংক্রান্ত প্রশ্নে। এই প্রথমবারের মত ধর্মকেই আমি বুঝতে শিখলাম। আমি প্রার্থনা করেছিলাম যে, আমার পরিবার যেন বিষয়গুলিকে স্বীকৃতি দেন। আমার পরিবার খৃষ্টান ধর্মের একটি শাখার (জেহোভার সাক্ষ্য) অনুসারী ছিল। সঊদীতে অবস্থানকালে আমি প্রাক্তন বৃটিশ পপ-সিঙ্গার ক্যাট স্টিভেন্সের (ইউসুফ ইসলাম) একটি ক্যাসেট সংগ্রহ করি যেখান থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।
প্রশ্ন : ইসলাম গ্রহণের পর আপনি আমেরিকায় ফিরলে কি ঘটেছিল?
জা: জ্যা : যখন আমি আমেরিকায় ফিরলাম তখন মিডিয়াতে ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে অপপ্রচারণা চালানো হচ্ছিল। আমার ব্যাপারেও অনেক গল্প-গুজব ছড়ানো হল যা আমাকে মানসিক অশান্তিতে নিক্ষেপ করেছিল। আর হলিউড তো ছিল ইসলামের দুর্নাম করতে সিদ্ধহস্ত। অথচ খৃষ্টধর্ম ও ইসলামের মাঝে সামঞ্জস্যপূর্ণ অনেক স্থান রয়েছে। যেমন কুরআনে যিশুকে একজন মহান নবী হিসাবে দেখানো হয়েছে। সেজন্য আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম যে, আমেরিকান খৃষ্টানরা ইসলামের বিরুদ্ধে এত সব অপবাদ কেন ছড়ায়?
ইসলাম আমাকে অনেক জটিলতা থেকে উদ্ধার করেছে। এর ফলে আমি নিজেকে আক্ষরিক অর্থে একজন পূর্ণ মানুষ হিসাবে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। নিজের মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তনের ছোঁয়ায় আমি অভিভূত। ইসলামের নিষিদ্ধ যাবতীয় বিষয় আমি পরিত্যাগ করেছি। এসব কারণে আমার পারিবারিক জীবনে কিছুটা সমস্যারও শিকার হয়েছি। এককথায় পুরো জ্যাকসন পরিবার অকস্মাৎ এক ধাক্কার শিকার হয়েছে। এমনকি হুমকিমূলক চিঠি-পত্রও আমাদের নিকট পাঠানো হয়েছে, যা আমার পরিবারকে বেশ বিড়ম্বনায় ফেলেছিল।
প্রশ্ন : আপনার ভাই মাইকেল জ্যাকসনের প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
জা: জ্যা : আমেরিকায় ফেরার পথে সঊদী থেকে আমি বেশ কিছু বই নিয়ে এসেছিলাম। মাইকেল সেসব বই থেকে কয়েকটি পড়ার জন্য নিয়েছিল। ইতিপূর্বে ইসলাম সম্পর্কে তার মন্তব্য ছিল পশ্চিমা মিডিয়ার প্রপাগান্ডা প্রভাবিত। যদিও সে মুসলমানদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করত না, তবে তাদের প্রতি সমর্থনসূচক কিছুও বলত না। কিন্তু এই বইগুলো পড়ার পর থেকে সে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কিছু বলা থেকে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল। আমার ধারণা ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করার ফলেই সে তার ব্যবসায়িক পার্টনার হিসাবে মুসলিমদের প্রতি আগ্রহ বোধ করে। আর এখন তো সঊদী ধনকুবের প্রিন্স ওয়ালিদ বিন তালালের সাথে তার ব্যবসায়িক পার্টনারশীপ হয়েছে।
প্রশ্ন : ইতিপূর্বে বলা হয়েছিল যে, মাইকেল জ্যাকসন মুসলমানদের বিরুদ্ধে। অতঃপর আবার গুজব উঠেছিল যে, তিনি মুসলমান হয়েছেন। ব্যাপারটা আসলে কি?
জা: জ্যা : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি অন্তত আমার যতদূর জানা রয়েছে মাইকেল কখনো ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অশ্রদ্ধাপূর্ণ বা নিন্দাসূচক কথা বলেনি। তার গানগুলোও মানুষের প্রতি ভালবাসারই বার্তা পাঠায়। পিতা-মাতাদের কাছ থেকেও আমরা অন্যকে ভালবাসার দীক্ষাই পেয়েছি। কেবলমাত্র হঠকারী লোকই তার উপর এই অপবাদ চাপাতে পারে যে, সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। যদি মুসলমান হওয়ার কারণে আমার উপর পর্যন্ত বাজে অপবাদ চাপানো হয়ে থাকে তবে কেন একই ঘটনা মাইকেলের উপর ঘটতে পারে না? তবে যতদূর দেখেছি ধর্মের বিরুদ্ধে সমালোচনার কারণে মিডিয়ায় তাকে কোনদিন শিরোনাম হতে হয়নি। যদিও ইসলামের প্রতি আগ্রহী হওয়ার কারণে তাকে হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। আর কেইবা জানে এটা কেমন দেখাবে যখন এমন হবে যে মাইকেল ইসলাম গ্রহণ করেছে!
প্রশ্ন : আপনার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে আপনার পরিবারের অন্যদের প্রতিক্রিয়া কি?
জা: জ্যা : আমি যখন আমেরিকায় ফিরলাম তার পূর্বেই আমার মা আমার ইসলাম গ্রহণের খবর পেয়ে গেছেন। আমার মা একজন ধার্মিক ও সুশীল মহিলা ছিলেন। যখন আমি বাড়ি পৌঁছলাম তিনি কেবল একটি প্রশ্নই করলেন, তুমি কি হঠাৎ করেই এমন একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছ, না এটা তোমার দীর্ঘদিন যাবৎ গভীর চিন্তা-ভাবনার ফসল? জবাবে বললাম, বহু চিন্তা-ভাবনা করেই আমি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। বলা বাহুল্য, পূর্ব থেকেই আমরা ধার্মিক পরিবার ছিলাম। এজন্য আমরা বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায় সক্রিয় ছিলাম। আমরা আফ্রিকায় ত্রাণবাহী বিমান পাঠিয়েছিলাম। বসনিয়ান যুদ্ধের সময় যুদ্ধাহতদের জন্য ত্রাণ পাঠিয়েছিলাম। এসব বিষয়ে সবসময়ই আমরা খুব সংবেদনশীল। কেননা আমাদেরকেও একসময় দারিদ্রে্যর ভয়াবহ রূপ দেখতে হয়েছে। সে সময় আমরা বড়জোর মাত্র কয়েক বর্গমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট একটি বাড়িতে থাকতাম।
প্রশ্ন : আপনি কি ইসলামের ব্যাপারে আপনার বোন জ্যানেট জ্যাকসনের সাথে কখনো কথা বলেছেন?
জা: জ্যা : আমার হঠাৎ ইসলাম গ্রহণে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মত সেও খুব অবাক হয়েছিল। প্রথমে সে খুব চিন্তিতও ছিল। তার মাথায় একটা বিষয়ই ঘুরপাক খাচ্ছিল যে, মুসলমানরা পলিগেমাস (একসাথে একাধিক বিবাহের সমর্থক)। তারা একসাথে চারটি বিবাহ করে। যখন আমি আমেরিকার বর্তমান অবস্থা উল্লেখ করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বললাম, তখন সে সন্তুষ্ট হল। ব্যাপারটি এই যে, পশ্চিমা সমাজে ‘ফ্রি সেক্স’ অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। ফলে যদিও তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবুও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপনে কোন বাধা নেই। ফলে সমাজে চরম নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়। ইসলাম সমাজকে এই ধ্বংসাত্মক পরিণতি থেকে রক্ষা করেছে।
প্রশ্ন : মুসলিম সমাজের দিকে যখন তাকান তখন আপনার স্বতঃস্ফূর্ত কী অনুভূতি হয়?
জা: জ্যা : মানবতার সর্বোচ্চ স্বার্থের দিকে তাকালে ইসলামী সমাজ এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ একটি স্থান। উদাহরণত নারীদের কথাই ধরুন। আমেরিকান নারীদের পোশাক-পরিচ্ছদ এমনই যা পুরুষকে অন্যায়ে প্রলুব্ধ করে। অথচ ইসলামী সমাজে এটা অচিন্তনীয়। তাছাড়া সর্বব্যাপী পাপ, অশালীন আচরণ পশ্চিমা সমাজের নৈতিক দিকটা ফোকলা করে ফেলেছে। তাই আমি সততই বিশ্বাস করি, যদি এমন কোন স্থান থেকে থাকে যেখানে মানবতার অবস্থান আজ সমুন্নত রয়েছে, তবে সেটা ইসলামী সমাজ ছাড়া আর কোথাও নয়। একটা সময় দ্রুতই আসবে যখন বিশ্ব এই বাস্তবতা স্বীকার করতে বাধ্য হবে।
প্রশ্ন : আমেরিকান মিডিয়া সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
জা: জ্যা : আমেরিকান মিডিয়া স্ববিরোধিতায় ভুগছে। হলিউডের উদাহরণ দেখুন একজন শিল্পীর স্ট্যাটাস সেখানে বিবেচনা করা হয় তার কারের মডেল অথবা কোন মাপের রেস্টুরেন্টে সে যায় ইত্যাদি দেখে। একবার তাকান সিএনএন-এর দিকে। তারা এমন অতিরঞ্জিত রিপোর্ট করে যেন মনে হয় তাদের রিপোর্টকৃত ঘটনাটি ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছু ঘটেনি। ফ্লোরিডার বনাঞ্চলে আগুন লাগার খবরকে এতটাই কভারেজ দেয়া হয় যে, মনে হয় যেন সারাবিশ্বেই আগুন ধরে গেছে। অথচ ছোট্ট একটি এলাকায় সেটি ঘটেছিল।
আমি তখন আফ্রিকায় ছিলাম। ওকলাহোমায় একটি নাশকতামূলক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। মিডিয়ায় কোন প্রমাণ ছাড়াই মুসলমানদের জড়িয়ে খবর আসতে শুরু করল। পরে দেখা গেল বিস্ফোরণকারী একজন খৃষ্টান। আমেরিকান মিডিয়ার এরূপ আচরণকে আমরা অভিহিত করতে পারি ‘ইচ্ছাকৃত অজ্ঞতা’ হিসাবে।
প্রশ্ন : আপনার স্ত্রী ও সন্তানরাও কি মুসলমান হয়েছেন?
জা: জ্যা : আমার ছয়টি ছেলে এবং একটি মেয়ে রয়েছে। যারা আমার মতই মুসলমান। তবে আমার স্ত্রী এখনো ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করছে। সে সঊদী আরব যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছে। আমার বিশ্বাস খুব শিগগিরই সে ইসলাম গ্রহণ করতে যাচ্ছে। আল্লাহ আমাদেরকে এই সত্য দ্বীনের উপর টিকে থাকার জন্য সাহস ও ধৈর্য দান করুন। আমীন!
এই সাক্ষাৎকারটি মাইকেলের মৃত্যুর বেশ আগে প্রকাশিত হয়েছিল। এ বছর ২৫ জুন অর্থাৎ মাইকেলের মৃত্যুর ঠিক এক বছর পর বিবিসিতে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে জারমেইন জ্যাকসন বলেন, ‘আমি অনুভব করি যে যদি মাইকেল ইসলাম গ্রহণ করত, তবে আজ সে আমাদের মাঝেই থাকত। কেননা যখন আপনি অন্তর থেকে একশ ভাগ নিশ্চিত থাকবেন যে, আপনি এবং আপনার পার্শ্বের লোকেরা কে এবং কীভাবে ও কেন তাদের এই জীবন, তখন আপনার সবকিছুই পরিবর্তিত হয়ে যাবে এমনভাবে যা আপনার জন্য কল্যাণকর হবে। এটা কেবল এক শক্তির আঁধার। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশক্তিমান। মাইকেল ইসলাম সম্পর্কে অনেক পড়াশোনা করেছিল। আমি তাকে সঊদী ও বাহরাইন থেকে বই-পত্র এনে দিয়েছিলাম। আর আমিই মূলত তাকে বাহরাইনে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কেননা আমি চাচ্ছিলাম তাকে আমেরিকার বাইরে রাখতে, যাতে আমার ভাই একটু নিশ্চিন্ত পরিবেশে বসবাসের সুযোগ পায়।’
বিবিসি জিজ্ঞাসা করে যে, ‘তিনি তো ইসলাম গ্রহণে ইচ্ছুক ছিলেন না তাই না?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘না, মাইকেল ইসলাম গ্রহণ করতে চাইছিল না- তা নয়। বরং তার সকল সিকিউরিটি স্টাফ ছিল মুসলমান। কেননা ইসলামের প্রতি তার আস্থা ছিল। কারণ এরা হল এমন ব্যক্তি যারা প্রয়োজনে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পারে এবং সর্বোত্তম মানুষ হওয়ার চেষ্টায় নিরত থাকে, সেটা মাইকেলের জন্য নয় বরং আল্লাহর জন্য। সুতরাং এমন ব্যক্তিদের পাশে পাওয়ার অর্থ যে আপনি নিরাপদ, কেননা এটা যেন আল্লাহরই নিরাপত্তা’।
জারমেইন জ্যাকসনের এই সাক্ষাৎকারদ্বয় থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মাইকেল জ্যাকসন ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা অর্থাৎ ইসলামের সাথে তার যথেষ্ট সংযোগ ঘটলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি কিংবা ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ পাননি। তৎপূর্বেই তার মৃত্যু ঘটে যায়। সুতরাং এ নিয়ে অহেতুক বিতর্কের অবকাশ নেই এবং তার প্রয়োজনও নেই।
পরিশেষে বলব, ইসলাম মানবতার জন্য রহমত স্বরূপ। সেটি যে কতবড় রহমত তা একজন জন্মসূত্রের মুসলমানের চেয়ে একজন নতুন মুসলমানের নিকট অধিকতর উপলব্ধিযোগ্য। আমেরিকা, ইউরোপে সভ্যতার নামে মানবতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য হরণের যে নির্মম অনুশীলন চলছে, তা থেকে মুক্তির আশায় সেখানকার হাজারো মানুষ আজ ইসলামের প্রাকৃতিক আবেদনের কাছে প্রশান্তির আশ্রয় গ্রহণ করছে। বিশ্বের প্রতিটি স্থানেই ইসলাম গ্রহণের হার পূর্বের তুলনায় অধিকমাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবেই ক্বিয়ামতের পূর্বে পৃথিবীতে এমন একটি সময় চলে আসবে যখন পৃথিবীর সর্বপ্রান্তে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে যাবে। মানুষ ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হবে। (আহমাদ; মিশকাত হা/৪২ ‘ঈমান’ অধ্যায়) । কল্যাণ ও ন্যায়ের সুশাসনে পৃথিবী হয়ে উঠবে ভরপুর (আবূ দাঊদ; মিশকাত হা/৫৪৫৪, সনদ হাসান)। অত:পর মহাপ্রলয় তথা ক্বিয়ামতের মাধ্যমে ভবজগতের লীলাখেলা সাঙ্গ হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে ঈমানের উপর অটল রেখে ইহজীবনে কল্যাণ অর্জন ও পারলৌকিক জীবনে মুক্তি লাভ করে জান্নাতুল ফেরদাউস হাছিলের তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!!