আমেরিকায় পড়ি

শাহরিয়ার নির্ঝর 544 বার পঠিত

-শাহরিয়ার নির্ঝর, ভার্জিনিয়া থেকে

সেই তিন বছর বয়সে কাঁধে স্কুলব্যাগ নিয়েছি, এরপর প্রায় দুই যুগ পেরিয়ে গেছে, অথচ এখনও সেটা নামাতে পারিনি। কলাস রুমের সেমি রিভলবিং চেয়ারে বসে এক দৃষ্টিতে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একে একে পেরিয়ে যেতে দেখলাম পল্লীমা সংসদ, গভঃল্যাব, ঢাকা কলেজ, বুয়েটকে। হঠাৎ খেয়াল হল কেমন যেন একটু শীত শীত করছে, নিস্তব্ধ পরিবেশ, সামনে হাসিমুখে এক শেবতাংগ ভদ্রলোক প্রবল আগ্রহে বক বক করছে আর জাত-বিজাতের নানান মানুষ তার কথা খুব মন দিয়ে শুনছে- ‘নট অল ইনফিনিটি ইস দ্য সেইম’! দেয়ার আর মোর রিয়াল নাম্বারস দ্যান র‌্যাশনালস, বাট দেয়ার আর এজ মেনি ইন্টেজারস এজ র‌্যাশনাল নাম্বারস। নাম্বারস দ্যাট আর ইভেন, হ্যাভ দ্য সেইম কার্ডিনালিটি এজ অড ওয়ানস- ইন্টরেস্টিংলি, ইচ অফ হুইচ ইকুয়ালস দ্য টোটাল নাম্বার অফ ইন্টেজারস!- এনি কোয়েসশেন এবাউট দ্যাট?' ভদ্রলোক এই বলে একটু থামলেন। তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল, ‘আমি এখন কোথায়’? ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়া’ দু’চোখ শীতল করে দেবার মত সুন্দর এক ইউনিভার্সিটি। শারলোটসভিল শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জেফারসনের নিজ হাতে গড়া স্বপ্নের ইউনিভার্সিটি হচ্ছে আমাদের ইউভিএ। আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনের কাছাকাছি হওয়াতে এতে যেমন এক দিকে রয়েছে আধুনিকতার স্পর্শ, অন্যদিকে রয়েছে পাহাড়ি প্রকৃতি ও বর্ণিল গাছগাছালির মোহনীয় স্নিগ্ধতা। এর সৌন্দর্য নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য, তবে একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে- কেউ যদি শারলোটসভিল শহরের যে  কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে দু’থেকে তিন মেগাপিক্সেলের মাঝারি মানের একটি ক্যামেরা দিয়ে র‌্যান্ডম এক ডজন ছবি তোলে, তবে সেই ছবিগুলো দিয়েই নতুন সালের জন্য অসাধারণ একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করা যাবে। একটু আগে যার কথা বলছিলাম তিনি প্রফেসর গ্যাব্রিয়াল রবিনস। আমরা তাকে ডাকি ‘গেইব’। এখানে আমেরিকায় এ ব্যাপারটি খুবই অদ্ভুত যে, প্রফেসরদেরকে ছাত্ররা সবাই নাম ধরে ডাকে। যারা উপমহাদেশ থেকে এখানে আসে, প্রথম প্রথম তাদের সবারই এটাতে অভ্যস্ত হতে বেশ সময় লাগে। অবশ্য কিছুদিন পর এটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। গেইব আমাদের অ্যাডভানড থিওরী অফ কম্প্যুটেশন কলাস নেয়। তার বৈশিষ্ট্য- সে সব সময় একটা কালো হাফহাতা টী-শার্ট, কালো প্যান্ট আর কালো স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে কলাসে আসে। আমি তার এই ড্রেসের  কোন ব্যতিক্রম দেখিনি। শুধুমাত্র একদিন বোধহয় তার গায়ে একটা কালো চাদর ছিল। তার স্বভাব হল কলাসে এসেই সে সবাইকে কার্টুন আঁকা একটা করে পেইজ দেবে। এরপর ট্রানপারেন্ট শিটে প্রিন্ট করা স্লাইডগুলো প্রজেক্টরে ঢুকিয়ে অতি উচ্চমার্গের থিওরেটিকাল কথাবার্তা শুরু করবে। লোকটা থিওরীতে এত বেশি স্ট্রং যে, আমরা যারা বাংলাদেশের ছাত্র তাদেরও মাঝে মাঝে ভ্রু কুচকে তাকাতে হয় সে কি বলল  সেটা বোঝার জন্য। এখানে প্রসংগত উল্লেখ্য যে, এখানকার চায়নীজ, ইন্ডিয়ান এমনকি আমেরিকান ছাত্রদের দেখে আমার মনে হয়েছে- থিওরেটিক্যাল কম্পিউটার সায়েন্সে আমরা বাংলাদেশের ছাত্ররা অন্যান্য দেশের ছাত্রদের তুলনায় বেশ স্ট্রং। আমাদের দেশের আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলের পড়াশোনার মান যে আসলেই অন্যান্য দেশের চেয়ে ভালো এটা এখানে এসে আমরা প্রতিনিয়ত বুঝতে পারছি এবং মনে মনে নিজেদেরকে ধন্য মনে করছি। গেইব অবশ্য কিছু কিছু জিনিস আলোচনা করতে করতে মাঝে মাঝে এত গভীরে চলে যায় যে, কি নিয়ে যে কথা হচ্ছিল সেটা সেও ভুলে গেছে, আমরাও ভুলে  গেছি। সবাই বলে গেইব একটা পাগল, এর মাথা পুরো খারাপ হয়ে গেছে। আমার কাছে কিন্তু তাকে বেশ ভালো লাগে। প্রফেসরদের নাম ধরে ডাকার মতই আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে যে, এখানে কলাসে ছাত্ররা অনেকটা যা খুশি তাই করতে পারে। যেমন, কেউ ট্রে ভর্তি করে বার্গার, স্যান্ডুইচ, কফি নিয়ে এসে খাচ্ছে, কেউ বেঞ্চের ওপর পা তুলে বসে আছে, কেউ মনোযোগ সহকারে তার ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত- অথচ প্রফেসররা তাদের কাউকে একটা কিছুও বলবে না। এখানে লজিক হচ্ছে, কেউ কলাস ফলো না করলে সেটা তার নিজের ব্যাপার, প্রফেসরের সেটাতে কোন কিছু যায় আসে না। আমি কল্পনা করার চেষ্টা করছি, বুয়েটের একটা কলাসরুমে কোন এক ছাত্র ঠোঙ্গাভর্তি সিঙ্গারা খেতে খেতে সাইদুর রহমান স্যারের কলাস করছে, স্যারকে দেখে নাম ধরে ডেকে বলছে- ‘হেই, হোয়াটস আপ’?- তাহলে কি ঘটনা ঘটতে পারে? এটা কল্পনাতে আনতে কষ্ট হলেও আমেরিকায় এটা খুবই স্বাভাবিক। এমনকি এটা যে অস্বাভাবিক কিছু হতে পারে সেটাই এখানকার কাউকে রাতদিন চেষ্টা করেও বোঝানো যাবে না। এখানকার পড়াশোনায় যে বিষয়টি আমার কাছে চোখে পড়েছে তা হচ্ছে- ‘ফ্লেক্সিবিলিটি’। যেমন, আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে এখানে ছাত্রদের কোন নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্ট নেই। যার যে কোর্স নিতে ইচ্ছে করে সে সেটাই নিতে পারে। কোন একজন ছাত্রের কোর্স লিস্টে একই সাথে সাহিত্য, ইলেকট্রনিক্স, জাভা প্রোগ্রামিং, বাণিজ্য সবকিছুই থাকতে পারে। অবশ্য পড়াশোনার একটা পর্যায়ে গিয়ে তাকে কোন একটা ‘মেজর’ বেছে নিতে হয়। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে, এখানে একজন ছাত্র দেখে-শুনে-বুঝে নিজের বুদ্ধিতে নিজের ভবিষ্যতকে গড়তে পারে। আমাদের দেশের মত ভাবগম্ভীর পরিবেশে এ্যাডমিশন টেস্ট নিয়ে, ছাত্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে, জোর করে তাকে কোন এক ডিপার্টমেন্টে বসিয়ে দেয়া হয় না। শিক্ষকতা করতে গিয়ে আমি বুয়েটে এমনটা অনেক শুনেছি- ‘স্যার, ইলেক্ট্রিক্যাল পড়ছি, কিন্তু আমার তো প্রোগ্রামিং করতেই বেশী ভালো লাগে’। আবার আমার ডিপার্টমেন্টের খুব মেধাবী স্টুডেন্টকেও অভিযোগ করতে শুনেছি- ‘আমি কম্পিউটার পড়তেই চাইনি, আর্কিটেকচারের মেরিট লিস্টে অষ্টম ছিলাম, আমাকে জোর করে বাসা থেকে কম্পিউটার পড়তে দিয়েছে’। এই ছোট্ট একটা জিনিস যদি আমাদের দেশের ইউনিভার্সিটিগুলো অনুকরণ করে, তাহলেই কিন্তু আমাদের ছাত্রদের মাঝের হতাশা একদম কেটে যাবে। চার-পাঁচ বছর আগে না বুঝে নেয়া একটা দুর্বল সিদ্ধান্তের জন্য আজীবন আর কাউকে আফসোস করতে হবে না। এই পরিবর্তন যারা করতে সক্ষম, তাদের কেউ কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছে? আমেরিকানদের কাছে সবকিছুর মত পড়াশোনাটাও একটা আনন্দের বিষয়, ওদের ভাষায়- ‘ফান’। এই ফানি ছাত্রদের ‘ফান’ আমাকে প্রতিদিনই খুব কাছে থেকে দেখতে হচ্ছে। আমার পিএইচ.ডির পুরো খরচ ইউনিভার্সিটি বহন করলেও বিনিময়ে আমাকে কোন একজন প্রফেসরকে আন্ডারগ্রাজুয়েট কোর্সে কিছুটা সাহায্য করতে হয়। এই সেমিস্টারে আমার দায়িত্বের মাঝে পড়েছে আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্রদের জাভা এবং কম্পিউটার আর্কিটেকচার ল্যাবগুলো নেয়া। ‘বুয়েটের শত শত ছাত্রের কত কোর্স নিয়েছি, এসব ল্যাব তো ডাল-ভাত’- প্রথমে এটা মনে করলেও পরে বুঝতে পেরেছি এখানকার ডাল এবং ভাত দু’টোই ভিন্ন। প্রথমদিন কলাসে ঢুকে ছাত্র-ছাত্রীদের দেখেই আমার বিচিত্র এক অনুভূতি হল। পোশাক-আশাক দেখে দু’একজনকে মনে হল বাথরুম থেকে বের হয়ে প্যান্ট-শার্ট না পরেই কলাসে চলে এসেছে। দু’একটা ছেলে জিন্সের প্যান্ট এত নিচু করে পরা, মনে হলো একটু অসাবধান হলেই বোধহয় সেটা খুলে পড়ে যাবে। কানে দুল দেয়া ছাত্র আমি বাংলাদেশেও দেখেছি, কিন্তু ঠোঁট ফুটা করে সেখানে দুল পরতে আমি সেদিন প্রথম কাউকে দেখলাম। পরবর্তী ধাক্কাটা খেলাম যখন একজন ছাত্র আমাকে দেখে বলল- ‘হেই, হাউ ইউ ডুইং’। আমি বিস্ময় চেপে, অমায়িকভাবে একটু হেসে স্পষ্ট বাংলায় তাকে বললাম- ‘কেমন ডুইং এটা তোরে আমি গ্রেড দেয়ার সময় বুঝিয়ে দিব’। ছেলেটা কিছু না বুঝেই খুব শব্দ করে হাসতে লাগল। কলাসের মাঝে এদের হাসি, আনন্দ, একে অন্যের সাথে লাফিয়ে উঠে হাই-ফাইভ করা- এসব দেখে মাঝে মাঝে কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারি না। বুয়েটের মত ভাবগম্ভীর পরিবেশ থেকে এমন খুব বেশী খোলামেলা পরিবেশে এসে নিজেকে মাঝে মাঝে বোকা মনে হয়। কম্পিউটার আর্কিটেকচার ল্যাবে আমার সাথে আরেকজন টিএ হচ্ছে- এনামুল। ব্যাপারটা কাকতালীয় যে, এরা আমাদের মত আনকোরা দু’জন বাংলাদেশী গ্রাজুয়েটকে আশি জন আমেরিকান ছাত্র-ছাত্রীকে পড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছে এবং ঘটনাক্রমে আমরা দ’ুজনই বুয়েটে শিক্ষকতা করেছি একসাথে। একবার আমি আর এনামুল এই ল্যাব কলাসে বসে বসে আলাপ করছি। সেদিন একটা ছাত্র মাথার চুল সম্পূর্ণ কমলা রঙ করে কলাসে এসেছে। অনেকদিন হয়ে যাওয়াতে এসব এখন আমরা দেখেও না দেখার ভান করি। হঠাৎ দেখলাম ছেলেটা আমাদের বেশ কাছাকাছি (আনুমানিক তিন ফিট দূরে) এসে দাঁড়াল। এরপর আমাদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নাচতে শুরু করল। ছেলেটা কোন একটা নাচের স্টেপ প্রাক্টিস করছে যেটাতে কিছুক্ষণ বাতাসে দুই পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে, জায়গায় দাঁড়িয়ে ভার্টিকাল এক্সিস বরাবর কয়েক চক্কর ঘুরতে হয়। পুরো ব্যাপারটা প্রায় মিনিট দুয়েকের বেশি সময় ধরে নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত সে করতে লাগল এবং আমরা দু’জন হতবাক হয়ে পুরো সময়টা তাকে দেখলাম। ছেলেটা আবার তার সিটে চলে গেলে আমি আর এনামুল একে অন্যের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। এনামুল শেষ পর্যন্ত নীরবতা ভেঙ্গে বলল, ‘কি করবেন ভাইয়া’? পড়াশোনার মত এদেশে গ্রেডিং পদ্ধতিও বেশ ফ্লেক্সিবল। আমাদের মতো ছকবাঁধা নিয়মে গ্রেডিং করা হয় না। পরীক্ষার খাতা দেখার পর, সবার পরীক্ষার নম্বরকে সর্ট করে, সেই নম্বরগুলোর কার্ভ এঁকে দেখা হয় কত পারসেন্টকে এ+, কত পারসেন্টকে বি+ ইত্যাদি ধরা হবে। পুরো সেমিস্টারে পরীক্ষাও মাত্র দু’টো- একটা মিডটার্ম ও একটা ফাইনাল এবং দু’টোর সিলেবাসও আলাদা। এছাড়া মিডটার্মে কেউ খারাপ করলে সে ইচ্ছে করলে সেই কোর্স ড্রপ করতে পারে এবং এতে তাকে কোন পেনাল্টিও দিতে হবে না। এখানে কলাসটেস্টেরও কোন বালাই নেই, তবে এর বদলে বেশ কঠিন কঠিন কিছু হোমওয়ার্ক করতে হয়। এছাড়া প্রায় প্রতিটি কোর্সের সাথেই একটি করে ল্যাবকলাস থাকে এবং এই ল্যাবগুলোতে সচরাচর আলাদা করে গ্রেডিং করা হয় না। ল্যাবে ছাত্ররা আসে থিওরীতে যা শেখে সেটাকেই একবার হাতে কলমে করে দেখার জন্য। কিছু কিছু কোর্সে ছাত্রদের প্রজেক্টও করতে হয়। কিন্তু সেটার জন্যও তারা ল্যাবে আসে এবং টিচারের উপস্থিতিতেই পুরো কাজটা করে। মোটকথা, স্কুলের পড়াশোনা স্কুলে শিখে, স্কুলেই হাতে কলমে প্রাকটিস করে বাড়িতে গিয়ে হৈচৈ করো- এটাই হচ্ছে এখানকার পড়াশোনার মূলনীতি। এখানকার পড়াশোনার পদ্ধতি, সুযোগ-সুবিধা, অবকাঠামো- সবকিছু কাছে থেকে দেখে আমার মনে হয়েছে, আমাদের দেশের যেসকল মেধাবী শিক্ষার্থীরা চরম বৈরী পরিবেশেও শুধু মনের জোরে টিকে আছে (এবং এমনকি ভালোও করছে), তাদেরকে যদি এর সিকি অংশ সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হত তবে আমাদের ছেলে-মেয়েরা আরও অনেক বেশি ভালো করত।



বিষয়সমূহ: গল্প
আরও