আহলেহাদীছ আন্দোলন : সংকট ও সংস্কার যুগে

ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম 9464 বার পঠিত

দুনিয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাসে মুসলিম জাতি নানা ধরনের ফিৎনার সম্মুখীন হয়েছে এবং ইসলামের মধ্যে বিভিন্ন রকম বিদ‘আত ও কুসংস্কার ঢুকে পড়েছে ধর্মীয় কর্মকান্ডের নামে। কুরআন মাজীদকে পরিবর্তন করার কিংবা তাতে সন্দেহবাদ আরোপ করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। রাসূলের ছহীহ সুন্নাতকে এড়িয়ে গিয়ে নতুন নতুন আমল চালু করার চেষ্টা করা হয়েছে। কখনো সুন্নাতকে প্রত্যাখ্যান বা বাতিল করার প্রয়াস চালানো হয়েছে। এসবের যে কোন একটিই দ্বীনের চিহ্নসমূহ মুছে দেওয়ার এবং তার মূলনীতি সমূহ বিনষ্ট ও ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আল্লাহ এ দ্বীনকে হেফাযত করেছেন এবং বিরোধীদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছেন। এজন্য তিনি যুগে যুগে যোগ্য বান্দা সৃষ্টি করে তাঁর দ্বীনকে পৃথিবীর বুকে অবিকৃত রেখেছেন। অন্যথা ইহুদী-নাছারাদের ন্যায় ইসলামও পৃথিবীর বুকে তার আসল চেহারা হারিয়ে ফেলতো। দ্বীনের হেফাযত তথা ইসলামের আদিরূপ বজায় রাখার আন্দোলনই আহলেহাদীছ। এ আন্দোলন ইসলামের মৌলিকত্বকে অক্ষণ্ণ রাখতে সদা সচেষ্ট। এজন্য তারা সকল বিদ‘আতকে ছাটাই করার চেষ্টা করে, সকল ভ্রান্তি দূর করে দ্বীনকে হেফাযত করাই তদের সতত সাধনা। তাঁরা এ দ্বীনের অতন্দ্র পহরী হিসাবে বাতিল পন্থীদের বিরুদ্ধে খাঁটি দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হন। ছাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে চলে আসা এ আন্দোলনের উত্তরসূরীরা এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে আসছেন।

উল্লেখ্য যে, ৩৭ হিজরীর পর থেকে মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হতে শুরু করে। যার অশুভ পরিণতি আজো মুসলিম বিশ্ব ভোগ করছে। দলবিভক্তির সাথে সাথে শুরু হয় ইসলামের নামে বিভিন্ন মতবাদের উত্থান। এসব মতবাদের অধিকাংশ ছিল মানুষের আক্বীদা-বিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট। যার কবলে পড়ে মানুষ তাদের ঈমান-আক্বীদা হারিয়ে শিরক ও কুফরের মত জঘন্য পাপাচারে লিপ্ত হয়। এ কারণে এটা ছিল মানুষের আক্বীদা বিধ্বংসী এক মারাত্মক যুগ। তাই এ যুগকে আমরা সংকট ও সংস্কার যুগ বলে অভিহিত করেছি। এ যুগের সময়কাল ছিল ১০০ থেকে ১৩২ হিজরী পর্যন্ত। মূলত এ যুগে আল্লাহর যাত ও ছিফাত তথা তাঁর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভিন্ন ভ্রান্ত আক্বীদা সৃষ্টি হয়। এ যুগে প্রধানত চারজন বিদ্বানের দ্বারা চার ধরনের বিদ‘আত প্রসার লাভ করে। সেগুলো নিম্নরূপ :

  • সমরকন্দী (মৃত্যু ১২৮ হিঃ) কর্তৃক প্রচারিত ‘জাহমিয়া’ মতবাদ। এ মতবাদে আল্লাহ এক নির্গুণ সত্তা। কেবল আল্লাহকে জানার নাম হচ্ছে ঈমান। কুরআন সৃষ্টবস্ত্ত, আল্লাহর কালাম নয়। মানুষের নিজস্ব কোন ইচ্ছাশক্তি নেই; বরং মানুষের দ্বারা আল্লাহ তাঁর কর্ম পরিচালনা করে থাকেন। অর্থাৎ বান্দার মাঝে আল্লাহর ইচ্ছার প্রয়োগ ঘটে এবং বান্দার সকল কাজই আল্লাহর ইচ্ছার অনুকূলেই হয়ে থাকে। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছুই করার ক্ষমতা কারো নেই। মূলত সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়- এ কথার অপব্যাখ্যা করে তারা মানুষকে একটি দায়িত্বমুক্ত জড় পদার্থের ন্যায় কল্পনা করে। ফলে আল্লাহর অনুগত বান্দা ও অবাধ্য বান্দার মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। ক্বাদারিয়া মতবাদের বিপরীত অদৃষ্টবাদী এ মতবাদটি ‘জাবারিয়া’ নামেও সমধিক পরিচিত।
  • জা‘আদ বিন দিরহাম খুরাসানী (মৃত্যু ১২৪ হিঃ)ও জাহম বিন ছাফওয়ানের মত একই মতবাদের ঘোর সমর্থক ও অতীব সক্রিয় প্রচারক। তিনি আল্লাহর ছিফাত তথা গুণাবলীকে অস্বীকার করেন। তাদের ধারণায় আল্লাহর সত্তার সাথে কোন গুণ যুক্ত করার অর্থ তাঁকে ‘সাকার’ (তাজসীম) ও বান্দার সাথে (তাশবীহ) সাদৃশ্য করা। তাদের মতে, আল্লাহকে গুণহীন সাব্যস্ত না করা অবধি তাওহীদে বিশ্বাস পূর্ণাঙ্গ হয় না। সাথে সাথে তিনি আল্লাহর আরশে অবস্থানের বিষয়টিও তিনি অস্বীকার করেন। তারা মনে করেন যে, আরশের উপরে আল্লাহর অধিষ্ঠান, আকাশের উপরে আরশের অবস্থান প্রভৃতিকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত কারো তাওহীদে বিশ্বাস পূর্ণতা লাভ করতে পারে না।
  • ওয়াছিল বিন আতা বছরী (৮০-১৩১হিঃ) ছিলেন মু‘তাযিলা মতবাদের উদ্ভাবক। জাহমিয়াদের মত এই মতবাদও (ক) আল্লাহকে গুণহীন নামীয় সত্তা মনে করে। তাদের মতে আল্লাহর সত্তা যেমন সনাতন (ক্বদীম), তেমনি তাঁর গুণাবলীকেও সনাতন মনে করলে শিরক করা হবে। সেকারণে তারা বলেন, আল্লাহ ইলম (জ্ঞান) ছাড়াই ‘আলীম’ (সর্বজ্ঞ), কুদরত (শক্তি) ছাড়াই ‘ক্বাদীর’ (সর্বশক্তিমান), হায়াত (জীবন) ছাড়াই ‘হাই’ (চিরঞ্জীব) ইত্যাদি। (খ) কুরআনকে সৃষ্টবস্ত্ত বলে বিশ্বাস করে। (গ) এ মতবাদে কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি মুমিনও নয়, কাফিরও নয়; বরং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী। তারা তওবা না করে মৃত্যুবরণ করলে চিরস্থায় জাহান্নামী হবে। (ঘ) মানুষের লৌকিক জ্ঞানই তার ভাল-মন্দের মাপকাঠি এবং মানুষ নিজেই তার ভালমন্দের স্রষ্টা। (ঙ) ওছমান, আলী, তালহা, যুবায়ের ও তাঁদের পক্ষে-বিপক্ষে যারা পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন, তাদের একটি পক্ষ নিশ্চিতভাবে ‘ফাসেক’ হওয়ার কারণে জাহান্নামী এবং তাদের কারও সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। জাহমিয়া, মু‘তাযিলা প্রভৃতি মতবাদ মূলত গ্রীক দর্শন থেকেই অনুপ্রবেশ করেছে।
  • মুক্বাতিল বিন সুলায়মান বলখী (মৃত্যু ১৫০ হিঃ) ছিলেন নির্গুণবাদী জাহমিয়া ও মু‘তাযিলা মতবাদের বিপরীতে ‘মুশাবিবহাহ’ বা সাদৃশ্যবাদী মতবাদের কথিত প্রবক্তা। তাঁর সম্পর্কে কোন কোন বিদ্বান ভিন্নমত পোষণ করেন। তাদের মতে আল্লাহর গুণাবলী বান্দার গুণাবলীর সদৃশ। পরবর্তীতে মুহাম্মাদ বিন কাররাম (মৃত্যু ২৫৫ হিঃ) এ মতবাদের প্রচারে অত্যধিক বাড়াবাড়ি করেন। তিনি আল্লাহকে সাধারণ প্রাণীদেহের সাথে তুলনা করেন।

এসব ক্ষেত্রে সঠিক আক্বীদা হচ্ছে আল্লাহর নাম ও গুণাবলী এক ও অবিভাজ্য এবং তাঁর সত্তার সাথে তাঁর গুণাবলীকে অবিচ্ছিন্ন ও ক্বাদীম (সনাতন) বলে বিশ্বাস করা। কুরআন মাজীদ আল্লাহর কালাম, সৃষ্ট নয়; তাক্বদীরের ভাল-মন্দ; কবীরা গোনাহগার মুমিন, কাফির নয়; বান্দার ভাল-মন্দ সকল কর্মের মূল স্রষ্টা আল্লাহ, বান্দা আল্লাহ প্রদত্ত কর্মশক্তি প্রয়োগে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী প্রভৃতির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।

এই সঠিক আক্বীদা-বিশ্বাসকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্বীনকে হেফাযত করার জন্য আল্লাহ তাঁর এক শ্রেণীর বান্দাদের মনোনীত করেছেন। তারা একদিকে যেমন আল্লাহ ও তাঁর প্রতি যথার্থভাবে ঈমান এনেছেন, তেমনি কিতাব ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরেছেন। আর দ্বীন বিরোধীদের যাবতীয় ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সর্বাত্মক সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। দ্বীনের হেফাযতের দায়িত্বে নিয়োজিত আল্লাহর সেই বান্দারাই হচ্ছেন পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাতের নিঃশর্ত অনুসারী আহলেহাদীছগণ।

বর্তমান যুগসন্ধিক্ষণে দ্বীনের উপর হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত এ শতাব্দীতে ইসলাম বৈরী শক্তি ইসলামকে প্রতিহত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। তারা মুসলিম উম্মাহর ইযযত-আব্রু রক্ষা ও বিজয়ের মূল সূত্র কিতাব ও সুন্নাতের প্রতি মুসলমানদের উদাসীনতা লক্ষ্য করেছে। ফলে তারা মুসলিম  সন্তানদেরকেই দ্বীনের মধ্যে ফাসাদ সৃষ্টির কাজে লাগিয়েছে। প্রথমে তারা নিজেদের সন্তানদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। অতঃপর মুসলিম ছেলেদেরকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে কাছে টেনে তাদের মগজ ধোলাই করেছে। ফলে এখন মুসলিম     সন্তানরাই ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় এবং কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কথা বলে। মুসলমান এখন ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রু হয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদেরকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকেই ফিরে আসতে হবে এবং তার সিদ্ধান্তকে সবকিছুর উপরে স্থান দিয়ে তাকে অবনত মস্তকে মেনে নিতে হবে। তাহলে মুসলিম তাদের হারানো গৌরব ফিরে পাবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!



আরও