ইতিহাস কথা বলে : পর্ব-১
মেহেদী আরীফ
ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ 12529 বার পঠিত
ভূমিকা :
অষ্টাদশ শতকে ধূমকেতুর মত অনেকটা হঠাৎ করেই আরব বিশ্বে ইসলামী নবজাগরণের আলোকধারা চমকিত হয়। বিশেষত মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ও তাঁর সাথীদের পরিচালিত মুওয়াহ্হিদ আন্দোলন বিদ্যুৎ ঝলকের উদ্ভাসে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। সঊদী আরব, সিরিয়া ও মিসরের সালাফিয়্যাহ আন্দোলন, নাইজেরিয়ার ফালানী আন্দোলন, ইন্দোনেশিয়ায় পাদুরী আন্দোলন, ভারতীয় উপমহাদেশের তরীকায়ে মুহাম্মাদী আন্দোলন যা বালকোটের যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজয় বরণ করে ও পরবর্তীতে ক্ষীণ শক্তি নিয়ে ধিক ধিক করে জ্বলে থাকে। এবং বাংলাদেশে ফারায়েযী আন্দোলন সবই ছিল এই আন্দোলনেরই মহৎ ফলশ্রুতি।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সুদূরাতীতকাল থেকেই বর্ণ, জাতি, গোত্র, ভাষা, ধর্ম, সভ্যতা-সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময়তায় ভারতীয় উপমহাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার নিয়ে বর্তমান। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীসমূহ এ অঞ্চলকে সবসময় তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু করে রেখেছে। ৭১২ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ইসলামের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। তারপর থেকে সহস্রবছরাধিকাল ধরে মুসলিম শাসকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে উপমহাদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাদের শাসনামলের বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে নানাবিধ কথা থাকলেও এটা দ্বিধাহীনভাবে অনস্বীকার্য যে, তাদের আমলে সামগ্রিকভাবে ভারত উপমহাদেশ পূর্বকালের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক অনেক বেশি সুখ-সমৃদ্ধিতে পূর্ণ ছিল। ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপীয় বণিকের দল ভিড় জমাতে শুরু করে উপমহাদেশে। সেই থেকেই আক্ষরিক অর্থে এ অঞ্চলে বিদেশী আগ্রাসনের সূচনা। সর্বশেষ ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে ইংরেজ বণিকরা এ অঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে বৃটিশ রাজদন্ডের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে এবং স্থানীয় অধিবাসীদের উপর এক জোরজবরদস্তিমূলক আধিপত্যবাদী শাসন কায়েম করে। একদিকে এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অন্যদিকে স্বয়ং মুসলিম সমাজের ইসলামী জীবনাচরণে দীর্ঘকাল যাবৎ বিপুল অনৈসলামিক আক্বীদা-বিশ্বাসের শক্ত অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই এ অঞ্চলে এক সর্বব্যাপী সংস্কারমূলক বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করে রেখেছিল। সেই অনাগত বিপ্লবের হাতছানিই যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে সাইয়েদ আহমাদ শহীদের ‘তরীকায়ে মুহাম্মাদিয়া’ আন্দোলনের হাত ধরে উপমহাদেশের শিরক-বিদ‘আতী জঞ্জালের অন্ধকার গহবরে তাওহীদী নবপ্রভাতের সূচনা ঘটায়। এই আন্দোলনেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বে ঘটে যায় বালাকোট যুদ্ধের মর্মান্তিক বিপর্যয়। ১৮৩১ সালের ৬ মে সংঘটিত ঐতিহাসিক এই বালাকোট যুদ্ধ একদিকে যেমন ছিল এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের জন্য চরম বিপর্যয়ের, অপরদিকে বিদেশী বেনিয়াদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য উপমহাদেশের বুকে পরিচালিত সর্বপ্রথম সুসংঘবদ্ধ রণডঙ্কা। নিম্নে এ যুদ্ধের মহানায়ক সাইয়েদ আহমাদ শহীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও বালাকোট যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ঘটনাপ্রবাহ উল্লিখিত হল।
সাইয়েদ আহমাদ শহীদ পরিচিতি :
সাইয়েদ আহমাদ শহীদ জন্মগ্রহণ করেন ২৯ই নভেম্বর ১৭৮৬ খৃষ্টাব্দে ভারতের অযোধ্যা যেলায় একটি সুপ্রসিদ্ধ বংশে। তার বংশতালিকা চতুর্থ খলীফা আলী (আঃ)-এর সাথে মিলিত হয়েছে। বংশীয় রীতি অনুযায়ী চার বৎসর বয়সেই তাকে মক্তবে পাঠানো হয়। কিন্তু বাল্যকাল হতেই তাঁর মধ্যে শিক্ষার চাইতে খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ অত্যধিক মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। তাঁর নিকটে কপাটি তথা সৈনিকদের বীরত্বমূলক খেলা ছিল খুবই প্রিয়। তাঁর খেলাধূলার মধ্যে ব্যায়াম ও শরীরচর্চার বিষয়টি মুখ্য ছিল। সাইয়েদ সাহেবের ভাগিনা নওয়াব ওয়াযীরুদ্দৌলার সেনাপতি সাইয়েদ আব্দুর রহমান বলেন, সূর্যোদয়ের পর এক ঘণ্টা পর্যন্ত সাইয়েদ সাহেব ব্যায়াম-কুস্তিতে কাটাতেন। ফলে তিনি অত্যধিক শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। সাইয়েদ সাহেবের জীবনের প্রারম্ভ থেকেই যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। আল্লাহর দ্বীনের স্বার্থে যুদ্ধ করার প্রবল মানসিকতা তখন থেকেই তাঁর মাঝে বিরাজ করছিল। একদা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। সাইয়েদ সাহেব তাতে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করলে তাঁর ধাত্রী মাতা তাঁকে কোন মতেই যেতে দিলেন না। আর তাঁর মা তখন ছালাতরত ছিলেন। সাইয়েদ সাহেব মাতার সালাম ফেরানোর অপেক্ষায় ছিলেন। মা সালাম ফিরিয়ে ধাত্রীকে বললেন, শোনো বিবি, আহমাদকে তুমি অবশ্যই স্নেহ কর, কিন্তু তা কখনো আমার স্নেহের সমান হতে পারে না। এটা বাঁধা দেয়ার সময় নয়। যাও বৎস, আল্লাহর নাম স্মরণ করে এগিয়ে যাও। কিন্তু সাবধান পৃষ্ঠ প্রদর্শন কর না। অন্যথায় তোমার চেহারা দেখব না। যদি শত্রুরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা ধরে তাহলে তাদের রাস্তা ছেড়ে দিও। সাইয়েদ সাহেব যখন সংঘর্ষস্থলে গিয়ে পৌঁছলেন তখন শত্রুরা বলতে লাগল, আমাদের রাস্তা ছেড়ে দিন আমরা চলে যাব। আপনাদের সাথে কোনো বিবাদ নেই। তখনই তিনি সাথীদের বললেন, এদের যেতে দাও কোন প্রকার বাধা দিও না।
সাইয়েদ আহমাদ শহীদ যৌবনে পদার্পণ করতেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। সংসারের দাবী ছিল যেন তিনি জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করেন। সঙ্গত কারণে কয়েকজন বন্ধুর সাথে তিনি রায়বেরেলী হতে লক্ষ্মৌ যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছে অন্য বন্ধুরা চাকুরী খুঁজলেও তিনি তা থেকে বিরত থাকেন। আসলে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য উদগ্র বাসনা তাঁর চোখের তারায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সেজন্য তিনি দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করতে মনস্থ করেন। কেননা তৎকালীন উপমহাদেশের খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ হিসেবে খ্যাত শাহ আব্দুল আযীয দিল্লীতে বসবাস করতেন। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও বন্ধুর পথ উপেক্ষা করে তিনি সেখানে পৌঁছেন। কেননা তিনি যখন দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেন তখন তাঁর পরনের কাপড় ব্যতীত অন্য কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। দিল্লী পৌঁছে শাহ আব্দুল আযীযের সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটে। তিনি তাঁর নিকটে অবস্থান করে বিভিন্ন বিষয় দীক্ষা নেন ও তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। এরপর তিনি নতুনভাবে জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করেন। এ সময় তাঁর জীবনে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। কিছুদিন পড়াশোনার পর হঠাৎ করে একদা তিনি লক্ষ্য করলেন, তাঁর দৃষ্টি থেকে অক্ষরগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তিনি এটাকে চক্ষুরোগ মনে করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ঘটনাটি শাহ আব্দুল আযীয জানতে পেরে তাঁকে পড়ালেখা ছেড়ে দিতে বলেন। এরপর তাঁর লেখাপড়ার চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। তাকওয়া ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে আরো কিছু সময় দিল্লীতে অবস্থান করে তিনি নিজ জন্মভূমি রায়বেরেলীতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং একাধারে কয়েক বছর বাড়ীতে অবস্থান করেন। এ সময় তিনি স্বীয় বংশীয় সাইয়েদ মুহাম্মাদ রওশন সাহেবের বিদূষী কন্যা বিবি জোহরার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। বিবাহের পর তিনি দ্বিতীয়বার দিল্লী ভ্রমণ করেন এবং নওয়াব আমীর খান (পরবর্তীতে যিনি বিশ্বাঘাতক হিসাবে প্রতিভাত হন)-এর সাহচর্য লাভ করেন। সেখানে তিনি তাঁর সৈন্যদলে যোগদান করেন। উল্লেখ্য যে, নওয়াব আমীর খানের লক্ষ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ হতে ইংরেজদের বিতাড়ন করা। আর এই লক্ষ্যকে স্বাগত জানিয়ে সাইয়েদ আহমাদ তাঁর সৈন্যদলে যোগদান করেন। কিন্তু যখন নওয়াব আমীর সাহেব লক্ষ্যচ্যুত হয়ে ইংরেজদের সাথে আপোষকামিতার মত কাপুরুষোচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন সাইয়েদ আহমাদ তার সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং সন্ধির বিরোধিতা করে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেন। দিল্লী পৌঁছে শাহ আব্দুল আযীযের স্বপ্ন অনুযায়ী তিনি দিল্লীর আকবরাবাদী মসজিদে অবস্থান করতে থাকেন, তখন লোকেরা চতুর্দিক থেকে তাঁর কাছে আসতে থাকে। আসলে শাহ আব্দুল আযীযের স্বপ্ন ছিল সমগ্র মুসলিম ভারতবাসীকে ছিরাতে মুস্তাকীমের উপর পরিচালিত করা। আর সেই কাজটির দায়িত্ব অর্পিত হয় সাইয়েদ আহমাদের উপর। সুতরাং দলে দলে মানুষেরা তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ করতে থাকে। এমনকি ভারতের বিখ্যাত আলিম-ওলামাও তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ থেকে বাদ যাননি। শাহ ইসমাঈল শহীদ ও মাওলানা আব্দুল হাই প্রমুখ বিখ্যাত আলিম তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। তাঁর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন স্থান হতে দাওয়াতপত্র আসতে থাকে, যার প্রেক্ষিতে তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে বায়আত গ্রহণ করতে থাকেন ও দ্বীনী দীক্ষা দিতে থাকেন। মুসলমান ছাড়া হিন্দুরাও সাইয়েদ সাহেবের প্রতি সুধারণা পোষণ করত। এমনকি তারা তাঁকে দাওয়াত দিয়েও আপ্যায়ন করত। একদা তহসিলদার ধকল সিং তাঁকে দাওয়াত দেয় এবং দুইশত কর্মচারীসহ নিজে উপস্থিত হয়ে তাঁকে বাড়ীতে নিয়ে দুপুর ও রাত্রিতে আপ্যায়ন করায়। ধকল সিং-এর অধিকাংশ কর্মচারী ছিল মুসলমান। সেখানে তাঁর সকল মুসলমান কর্মচারীরা সাইয়েদ সাহেবের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন।
নাসিরাবাদে শীআ এবং সুন্নীদের মাঝে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা হাঙ্গামার পুনরাবৃত্তির সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিলে সুন্নী নাসিরাবাদীরা সাইয়েদ সাহেবকে সাহায্যের জন্য আহবান করলে তিনি তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রায় ৭০/৭৫ জন সঙ্গী নিয়ে তথায় উপস্থিত হন। এ অভিযানে শাহ ইসমাঈলের মাতা ২৫ টাকা হাদিয়া দেন। নাসিরাবাদে পৌঁছে শীআ নেতাদের নিকটে খবর পাঠান যে, তোমাদের কোন লোকজন যেন আমাদের কোন লোকের সাথে ঝগড়া করতে না আসে। আর নিজের লোকজনকেও সতর্ক করে দিলেন যাতে তারা তাদের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত না হয়। পরে বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হয়। নাসিরাবাদে চেহলাম উপলক্ষে পুনরায় বিবাদ হওয়ার সমূহ সম্ভবনা দেখা দিলে সাইয়েদ সাহেবকে পুনরায় খবর দেওয়া হয় এবং তিনি সেখানে সদলবলে উপস্থিত হন। পরে নবাব মুতাসিমুদ্দৌলা, যিনি সরকারীভাবে ৫০০ অশ্বারোহীসহ পদাধিক বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন, তিনিসহ একশজন সৈন্য তাঁর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন। এ সময় লোকেরা সাইয়েদ সাহেবের দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, দৃঢ়তা, সংযম এবং সামরিক শৃঙ্খলা ও দক্ষতার স্পষ্ট নমুনা দেখতে পায়। নাসিরাবাদে পৌঁছে তিনি শহরে আত্মরক্ষাব্যুহ রচনা করেন এবং শহরে সামরিক নিয়ম-শৃঙ্খলা কায়েম করেন। যা কেবলমাত্র একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ সামরিক কর্মকর্তাই করতে পারে।
ইতিমধ্যে সাইয়েদ সাহেব হজ্জ করার সংকল্প গ্রহণ করলেন এবং তাঁর সাথে সম্পৃক্ত সকলকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন। তিনি তাঁর বংশের লোকজনসহ ভক্তদেরকে হজ্জের সাথী হওয়ার জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনা দিতে থাকলেন। সারা ভারত থেকে পাথেয়সামগ্রী এবং সঙ্গী সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে ভারতের উল্লেখযোগ্য স্থানসমূহ সফর করেন। ১২৩৬ হিজরীর শাওয়াল মাসের শেষদিন সোমবার ৪০০ লোক সঙ্গে নিয়ে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী (রহঃ) স্বীয় বাসভবন থেকে রওয়ানা হন এবং তাঁর লোকসংখ্যা পালকী বাহক ৮০ জন বেয়ারা বাদ দিয়ে সর্বমোট ৪০৭ জন ছিল। উক্ত হজ্জ কাফেলার সাথে মহিলাগণও ছিলেন। ৩ যিলকাদ বৃহস্পতিবার মাল-সামান ও আসবাব-পত্র জাহাজে তোলা হল। শুক্রবার সকালে সাইয়িদ সাহেব কাফেলার সব লোকদেরকে একত্রিত করে এক এক দল লোকের জন্য একজন করে আমীর, একজন দায়িত্বশীল ও একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করলেন এবং পুরো সফরের জন্য দলের নেতৃত্ব ও শৃংখলা বিধান করলেন।
হজ্জে যাত্রার পথে তিনি বিভিন্ন স্থানে নোঙ্গর করে হাজার হাজার মানুষের বায়আত গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে ওয়ায-নছীহত করেন। আর অসংখ্য মানুষের দাওয়াত গ্রহণ করেন এবং তাদের নযরানা গ্রহণ করেন। অবশেষে কলকাতা থেকে মক্কা মুয়ায্যামা অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁর এ অভিযানে বেশ কয়েকটি জাহাজ ছিল। কাফেলায় সর্বমোট যাত্রী ছিল ছয়শত তিরানববই জন। কলকাতা থেকে জাহাজ বন্দর নগরী আলপ্সী ও কালিকট অতঃপর তথা হতে আদন, অতঃপর ইয়ালামলাম পৌঁছে সেখান হতে জেদ্দায় পৌঁছায়। পথিমধ্যে সাইয়েদ সাহেব হুদায়বিয়ায় যাত্রা বিরতি দিয়ে দোআ করেন ও সাথীদের নিকট হতে জিহাদের বায়‘আত নেন। ২৯ শা‘বান ১২৩৭ হিঃ মক্কা মুয়ায্যামায় পৌঁছান। ওমরা ও হজ্জ আদায়ের পর তিনি তাঁর সফরসঙ্গীদের বিরাট দল নিয়ে মক্কা মুআয্যামায় দীর্ঘ দিন অবস্থান করেন এবং ওয়ায-নছীহত এবং দ্বীনী তা‘লীম-এর মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করেন। অবশেষে ১২৩৮ হিঃ ১৫ শাওয়াল মক্কা হতে প্রত্যাবর্তন করেন ও পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে ভারতে ফিরে আসেন। ১২৩৮ হিজরী রামাযান থেকে ১২৪১ হিজরীর ৭ জমাদিউস ছানী পর্যন্ত পূর্ণ এক বৎসরকাল রায়বেরেলীতে অবস্থান করে নিজ বাড়ী-ঘর ও বেশ কিছু মসজিদ নির্মাণ করেন এবং জিহাদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
সাইয়েদ আহমাদ সাহেব তৎকালীন সময়ে ভারতের অভ্যন্তরে তাঁর যুদ্ধ পরিচালনার কেন্দ্র স্থাপন করেননি, এটা তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতারই পরিচায়ক। বরং তিনি তাঁর জিহাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রচারসহ বিভিন্ন স্থানে সফর করে এবং যুদ্ধকেন্দ্র হিসাবে আফগানিস্তানকে মনোনীত করে অবশেষে তথায় পৌঁছে যান। কান্দাহার, কাবুল অতিক্রম করে খেশগীতে উপস্থিত হন এবং সেখান থেকে ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৮২৬ নওশহরে অবস্থান গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি অত্যাচারী শিখ রাজা বুখ্য সিং-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রথমে কর বা জিজিয়া প্রদানের প্রস্তাব দেন। এরপরই একজন সংবাদবাহক এসে খবর দেয় যে, বুখ্য সিং সৈন্য নিয়ে আকুড়ায় প্রবেশ করেছে। একথা শুনে সকলকে প্রস্ত্ততি গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। মুসলিম বাহিনীর নৈশকালীন অতর্কিত হামলায় সাতশত শিখ সেনা নিহত হয় এবং মুসলমানদের পক্ষে ৩৬ জন ভারতীয় ও ৪৫ জন কান্দাহারী মুজাহিদ নিহত হন এবং আরও ৩০/৪০ জন আহত হন। এই যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়েই মুসলমানদের সাহস, আগ্রহ-উদ্দীপনা শতগুণে বেড়ে যায়। যার পরিণতিতে বালাকোট যুদ্ধের সূচনা হয়।
বালাকোট পরিচিতি :
বালাকোট শহর পাকিস্থানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খাইবার-পাতুনওয়ার হাযারা প্রদেশে অবস্থিত মেনসেরা যেলা থেকে ৩৮ কি: মি: পূর্ব-উত্তরে অবস্থিত। চারিদিকে টিলাঘেরা দূর্গম এই ঐতিহাসিক শহরটি আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল হিসাবে বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। শহরটি কাগান উপত্যকার প্রবেশমুখ। লুলুসার লেক থেকে উৎসারিত কুনহার নদী এই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে ঝিলাম নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। জনৈক বালাপীরের নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় বলে জানা যায়। প্রাচীন বালাকোটে যেখানে ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা ছিল পার্শ্ববর্তী মেটিকোট টিলা ও ঝরণা এলাকায়। উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ৮ই অক্টোবর এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে শহরটি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পরবর্তীতে সঊদী আরব, আরব আমিরাত ও পাকিস্তান সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় শহরটি আবার গড়ে তোলা হচ্ছে।
বালাকোট যুদ্ধের পটভূমি :
তৎকালীন পেশোয়ারের সুলতান মুহাম্মাদ খাতেনের ষড়যন্ত্রে ইসলামী হুকুমতের ক্বাযী, তহসিলদারসহ বহু কর্মচারীর গণহত্যার ঘটনায় সাইয়েদ আহমাদ অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং তিনি দ্বিতীয় দফা হিজরত করার মানসে কাশ্মীর অভিমুখে যাত্রা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ) যে পাঞ্জতার নামক স্থানে অবস্থানরত মুজাহিদ গোত্র ত্যাগ করেন এবং হাযারা জেলার উচ্চভূমির দিকে গমন করেন, তার উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হয়ে সেখানে কেন্দ্র স্থাপন করে উপমহাদেশকে বিধর্মী ও বিদেশীদের জবর দখল হতে মুক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হবার প্রস্ত্ততি গ্রহণে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান ছিল এই বালাকোট, সেকারণ এখানেই সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। অবশ্য প্রথম দিকে প্রধান সামরিক ঘাঁটি রাওয়ালপিন্ডিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী তাঁর দীর্ঘ চার বছরের পাঞ্জতার ঘাঁটি ছেড়ে কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে যাত্রার সময়টি ছিল ডিসেম্বরের বরফঢাকা শীতকাল। সাইয়িদ আহমাদ কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে যে এলাকাটি ত্যাগ করেছিলেন শিখরা শীঘ্রই সে এলাকাটি দখল করে তথাকার জনগণের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করল। এ সময় কাশ্মীর গমনের পথে বিভিন্ন এলাকার খান ও সামন্তগণ যেমন- মুজাফ্ফরাবাদের শাসনকর্তা যবরদস্ত খান, খুড়া অঞ্চলের সামন্ত নাজা খান, দেরাবা অঞ্চলের সামন্ত মানসুর খান ও গাঢ়ী অঞ্চলের সামন্ত হাবীবুল্লাহ খান প্রমুখ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সাইয়েদ আহমাদ এই আবেদনে সাড়া দিয়ে যবরদস্ত খানের সাহায্যার্থে মৌলবী খায়রুদ্দীন শেরকুটীর নেতৃত্বে একদল মুজাহিদ মুযাফ্ফরবাদে প্রেরণ করলেন। এদিকে শিখ সেনাপতি রনজিৎ সিংহ-এর পুত্র শেরসিংহ বিরাট বাহিনী নিয়ে নখলী নামক স্থানে পৌঁছে যায়। ফলে সাইয়েদ আহমাদ উক্ত বাহিনী কোন দিকে অগ্রসর হয় তার গতিপথ নির্ণয় করে পরবর্তী করণীয় স্থির করাকে সমীচীন মনে করলেন। এ সময় তিনি মূল গন্তব্য কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নিমিত্তে শের সিং-এর বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে এগিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। কারণ হাযারাবেলাতে অবস্থানকারী সাইয়েদ আহমাদ-এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে সম্পৃক্ত খানদের শিখ সেনারা অত্যাচারের শিকার বানাত। তাই তিনি তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত হাযারাতেই থেকে গেলেন। পরে যখন তিনি শুনতে পেলেন যে, শের সিংহ ভূগাড়মুঙ্গ গিরিপথ আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে, তখন তিনি নিজে রাজদারওয়ান নামক স্থান হতে সারচুল নামক স্থানে পৌঁছান এবং শাহ ইসমাঈল শহীদকে বালাকোট পাঠিয়ে দিলেন। তারপর যখন তিনি জানলেন যে, শের সিং বালাকোট আক্রমণ করতে পারে তখন তিনি ভুগাড়মুঙ্গের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে নিজেই বালাকোটে চলে গেলেন। আর সেই সময় শের সিং-এর বাহিনী কুনহার নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত সোহাল নাজাফ খান গ্রামের সম্মুখে ময়দান নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে।
ঘটনাপ্রবাহ :
একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেওয়া আবশ্যক যে, শিখ বাহিনীর অবস্থান থেকে বালাকোটে মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণ করার দু’টি পথ ছিল। প্রথমত : কুনহার নদীর পূর্ব তীর বরাবর উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়ার পর নদী পার হয়ে বালাকোটে পৌঁছনো। দ্বিতীয়ত : ভুগাড়মুঙ্গের গিরিপথের মধ্য দিয়ে বালাকোটে পৌঁছনো। মূলত বালাকোটে পৌঁছনোর জন্য তাদের সোজা কোন পথ ছিল না। কেননা বালাকোটের পূর্ব দিকে কালুখানের উচ্চচূড়া পশ্চিম দিকে মেটিকোট পর্বত শিখর ও উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত কুনহার নদী। বালাকোট মূলত দক্ষিণমুখী একটি উপত্যকার নাম। কুনহার নদীর উৎসমুখ ছাড়া এখানে প্রবেশের কোন পথ নেই। সঙ্গত কারণেই অনেক কষ্টে মুজাহিদ বাহিনীসহ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী ১৮৩১ সালে ১৭ এপ্রিল বালাকোটে প্রবেশ করেন। উপমহাদেশের জিহাদ আন্দোলনের পথিকৃৎ, সমরকুশলী, আল্লাহর পথের নিবেদিতপ্রাণ বীর সিপাহসালার সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী তাঁর সূক্ষ্ম পরিকল্পনা মাফিক বালাকোটে প্রবেশ করা যায় এমন ধরনের কয়েকটি স্থানে প্রতিরক্ষামূলক সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছিলেন। বলা যায়, রাসূল (ছাঃ) উহুদ যুদ্ধের সময় গিরিপথ বন্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যে স্বশস্ত্র সৈন্য মোতায়েন করেন সে পদ্ধতিকেই তিনি অনুসরণ করেছিলেন। কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ায় পর শিখ শিবিরে অগ্রযাত্রার লক্ষণ আঁচ করা গেল। শিখ সৈন্যরা পারাপারের সুবিধার জন্য আগেই নদীর উপর একটি কাঠের সাঁকো নির্মাণ করে রেখেছিল। সেই সাঁকোর উপর দিয়ে নদী পার হয়ে শিখ সৈন্যরা সোহাল নাজাফ খান গ্রামের দক্ষিণ দিক দিয়ে এবং সোহাল গ্রামের পার্বত্যাঞ্চলের পাদদেশে দিয়ে সাইয়েদ আহমাদের মুজাহিদ বাহিনী ঢাকা গ্রামের পশ্চাতে পৌঁছান। আর সেই দিকেই বালাকোটের দক্ষিণাংশে খাড়েয়্যানের কাছে এবং পূর্ব দিকে সাঁকোর কাছে তিনি সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছিলেন। এইভাবে মেটিকোটে ও উহার পাহাড়ী রাস্তায় একেকটি করে সামরিক চৌঁকি বসিয়ে রেখেছিলেন। আর সর্বাগ্রের চৌঁকির নেতা ছিলেন মীর্যা আহমাদ বেগ খান। অকস্মাৎ তার চৌঁকির দিক হতে গুলির শব্দ শোনা গেল। পরক্ষণেই জানা গেল যে, শিখ সৈন্যগণ এদিক দিয়েই বালাকোটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মীর্যা আহমাদ বেগ ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মুজাহিদ বাহিনী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শিখ বাহিনীকে প্রতিরোধ ও গতিরোধ করার চেষ্টা চালালে তাদের একাংশ শাহাদত বরণ করেন এবং বাকী অংশ পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হন।
তারপর মেটিকোটে স্থাপিত চৌকিরত মুজাহিদদেরকে তাদের পথ দিয়ে শিখ বাহিনীর প্রবেশ করার বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হল। এমনকি বালাকোটেও পৌঁছিয়ে দেওয়া হল। তবে শিখ সেনাদের গতিরোধ করা কোনমতেই সম্ভব হল না। বিপুল সংখ্যক সৈন্য মেটিকোটে পৌঁছে গেল। আর মেটিকোট মূলত একটি পাহাড়, যার পাদদেশের সমতল ভূমিই হচ্ছে বালাকোট। বালাকোট অঞ্চলের একটি প্রবাদ আছে যে, মেটিকোট যার অধিকারে আসবে, বালাকোট তারই অধিকারে আসবে’। সুতরাং যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের বিষয়টি আগেই নির্ধারণ হয়ে গেল। ফলে মুজাহিদদের সংখ্যাল্পতা ও রসদ-সমরাস্ত্রে অপ্রতুলতা সত্ত্বেও সাইয়েদ আহমাদের জন্য বালাকোটের পশ্চিমাংশের অবস্থিত প্রান্তরে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর রইল না। এখানে একটি কথা বলে নেওয়া ভাল যে, এমত পরিস্থিতিতে যদি সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী আপাতত যুদ্ধ এড়াবার জন্য পিছন দিকে চলে যেতেন তাহলে শিখ সৈন্যগণ তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করতে পারত না। অথবা তিনি নদী পার হয়ে পূর্ব তীরে পৌঁছেও আক্রমণ করতে পারতেন। আর এ ব্যাপারে যেসব মুসলিম গ্রামবাসী অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাপে পড়ে শিখদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন তারাও গোপনে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু ইতিহাস যে সাক্ষ্যটি এ যাবৎ বহন করে চলছে তা যে আরশে আযীমের অধিপতির পক্ষ হতে বহুকাল পূর্বেই নির্ণিত হয়ে রয়েছে। সুতরাং সর্বদিক ভেবে তিনি শিখদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হবার সিদ্ধান্ত নিলেন। কোনরূপ রণকৌশল নয়; বরং বীরত্ব, সাহসিকতা ও ঈমানী শক্তির যে মূল্যবান সম্পদ মুজাহিদগণের মধ্যে বিদ্যমান ছিল, তাকে সম্বল করেই শিখদের বিপুল সমরশক্তির মুকাবিলা করে যাওয়াকে এবং তার পরিণতিকে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়াকেই স্বীয় কর্তব্য বলে গ্রহণ করলেন।
|
৫ই মে শিখ সৈন্যগণ মেটিকোট পাহাড়ের শিখরে আরোহন করতে সক্ষম হয়েছিল। বিধায় ৬ই মে ১৮৩১ মোতাবেক ২৪ যুলকা’দা ১২৪৬ হিঃ সনে পবিত্র জুম‘আর দিনে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর মুজাহিদ বাহিনী চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নেন। উল্লেখ্য যে, মুজাহিদ বাহিনীতে সর্বমোট যোদ্ধা ছিল ৭০০ জন এবং শিখ সৈন্যদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। শিখ সৈন্যগণ মেটিকোট টিলা হতে বালাকোট ময়দানে অবতরণ করতে আরম্ভ করল। আর সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী এবং অধিকাংশ মুজাহিদ মসজিদে-ই বালা ও তার আশপাশে অবস্থান করছিলেন। উল্লেখ্য যে, ৭০০ জনের মুজাহিদ বাহিনীকে সাতবানে ঝরনা বরাবর বহুদূর পর্যন্ত শিবির স্থাপন করানো হয়েছিল। সায়্যিদ আহমাদ ব্রেলভী হঠাৎ শিখদের আক্রমণ করার জন্য মসজিদ-ই বালা হতে বের হয়ে মসজিদে যেরিনে পৌঁছলেন। অতঃপর তিনি মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে মেটিকোটের পাদদেশের দিকে অগ্রসর হলেন। মেটিকোটের পাদদেশে অবতরণরত শিখসেনাদের অধিকাংশ নিহত হল। কিন্তু ইতিমধ্যে মেটিকোটে টিলার প্রতিটি ইঞ্চি পর্যন্ত সৈন্য দ্বারা পূর্ণ হয়েছিল। তারা প্রত্যেক স্থান দিয়ে নেমে এসে মুজাহিদদের উপর প্রচন্ড হামলা শুরু করে। সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী মুজাহিদ বাহিনীর অগ্রভাগে ছিলেন। তার সাথে ছিলেন একান্ত সহযোগী শাহ ইসমাঈল। হঠাৎ করে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী মেটিকোটের ঝরনার মধ্যে শাহাদত বরণ করেন এবং শাহ ইসমাঈলও শাহাদত বরণ করলেন। মুজাহিদগণের একটি বড় দল সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর শাহাদত বরণের বিষয়টি উপলব্ধি করতে না পারায় তাঁর সন্ধানে ঘুরে ঘুরে শাহাদত বরণ করলেন। এছাড়া মুজাহিদদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত বরণ করেন। এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল কমপক্ষে দুই ঘণ্টা। অতঃপর গোজার গোষ্ঠির লোকজন বিভিন্ন দলে উচ্চৈঃস্বরে প্রচার করতে থাকল যে, সাইয়েদ আহমাদকে পাহাড়ের উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা সকলে পাহাড়ের উপরের দিকে আস। ফলে মুজাহিদগণ উত্তর দিকে অবস্থিত পাহাড়ের দিকে গমন করেন। আর এইভাবে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল। গোজার গোষ্ঠির লোকদের এরূপ করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হয় তারা শিখদের প্ররোচনায় তা করেছিল। কেননা মুজাহিদগণ মেটিকোটে যুদ্ধরত থাকলে আরও বহু শিখ যোদ্ধার প্রাণনাশ হত। অথবা অবশিষ্ট মুজাহিদগণকে হিজরতের উদ্দেশ্যে উক্ত কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। মুজাহিদ বাহিনীর আমীর ও প্রধান সেনাপতি সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর শহীদ হওয়া সম্পর্কে অন্য একটি কথা ছড়িয়ে আছে তা হল তিনি মুজাহিদগণের অগ্রভাগে ছিলেন এবং শিখদের একদল সৈন্যের মধ্যে ঢুকে পড়েন। শিখরা তাঁকে ঘেরাও করে ফেলে যা তাঁর অনুসারীরা লক্ষ্য করেননি। এভাবে তিনি শহীদ হন এবং তাঁর লাশও মুজাহিদগণ শনাক্ত করতে পারেননি। এ কারণে অনেককাল পরেও অবশিষ্ট মুজাহিদগণ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর শাহাদতের বিষয়টি সত্য বলে বিশ্বাস করতে পারেননি।
একটি বর্ণনা মতে, একজন বন্দী প্রত্যক্ষ করেন যে, তাঁর খন্ডিত দেহ পাওয়া গিয়েছিল এবং এক নদীর ধারে তাকে কবরস্থ করা হয়েছিল। অনেকেই সেটাকে তাঁর কবর বলে বিশ্বাস করেন। কিন্তু অপর একটি বর্ণনা মতে, তাঁর মস্তক নদীতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল এবং তা কয়েক মাইল ভাটিতে পাওয়া গিয়েছিল। অতঃপর সেটি সেখানে কবরস্থ করা হয়।
ওদিকে মুজাহিদগণের মধ্য থেকে প্রায় ৩০০ জন শাহাদাত বরণ করেন। আর ৭০০ জন শিখ সৈন্য নিহত হয়। ১০০০ জন শিখ সেনা নিহত হবার কথাও কোন কোন জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। আর অন্য বর্ণনা মতে, ৬০০ মুজাহিদ শহীদ হন। তবে নির্ভরযোগ্য তথ্য হল, সেখানে ৩০০ মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন আর শিখ সৈন্য নিহত হয় ৭০০ জন।
এরপর শিখদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বালাকোটের ঘর-বাড়ীতে আগুন দিয়ে তাদের নিহত সৈন্যদের লাশ তার মধ্যে নিক্ষেপ পূর্বক পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়। শিখদের উক্ত আগুন লাগানোর ফলে মুসলমানদের অপরিমেয় ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। ভস্মীভূত সম্পদের মধ্য হতে উল্লেখযোগ্য যা ছিল তা হল সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী ও শাহ ইসমাইল শহীদের অনেক রচনা, পত্রাবলীর পান্ডুলিপি, পুস্তিকা ও বক্তৃতাবলীর অনুলিপি। সমসাময়িক যুগের অনেক আলিম, সুলতান ও বিশিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তির পত্রাবলীও সেখানে ছিল। এছাড়া সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর সম্পূর্ণ দফতরই বালাকোটে অবস্থিত ছিল। যেখানে রোজনামচাসহ তাঁর জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনায় রচিত ‘নূর-ই আহমদী’ গ্রন্থটিও সংরক্ষিত ছিল।
ঘটনা প্রবাহের শেষ লগ্নে অবশিষ্ট মুজাহিদগণ পালিয়ে উপত্যকার বিপরীতে রাত্রি যাপন করেন। ধীরে ধীরে তারা সেখানে একত্রিত হন এবং আংগ্রাইতে রাত্রিযাপন করেন। দু’জন গুপ্তচর এসে জানালেন যে, সাইয়েদ জীবিত এবং নিরাপদে আছেন। কিছু দূরে তিনি আছেন। মুজাহিদরা পরবর্তী প্রভাত পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করলেন। সূর্যোদয়ের পর যখন তাঁরা গোজারদের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছলেন তখন সাইয়েদের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন না। মুজাহিদরা যখন তাঁদের নেতাকে নিজেদের মধ্যে অবর্তমান দেখলেন তখন তারা শোকাহত হলেও ভেঙ্গে পড়লেন না। আন্দোলনের লক্ষ্য পরিত্যাগের ধারণা তাঁরা তাদের হৃদয়ে স্থান দেননি। এজন্যে তারা সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত অথবা তারা মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চয়তা লাভ না করা পর্যন্ত দায়িত্বভার আরোপের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন নেতা হিসাবে কুলাতের শাইখ ওয়াদী মুহাম্মাদকে নেতা নির্বাচিত করলেন। এভাবে আন্দোলন অব্যাহত থাকলেও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনটি অচিরেই স্তিমিত হয়ে পড়ে।
পরাজয়ের কারণ :
মুজাহিদদের সংখ্যাস্বততা ও রসদপত্রের অপ্রতুলতা যুদ্ধে পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসাবে ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করলেও পরাজয়ের মূল কারণ ছিল মুসলিম নামধারী মুনাফিকদের বিশ্বাসঘাতকতা। তা ছিল- প্রথমত: যেসব সামন্ত ও খানরা শিখবাহিনীর হাত থেকে তাদেরকে রক্ষার জন্য সাইয়েদ আহমাদকে আহবান করেছিল তারা পরবর্তীতে মুসলমানদের সাহায্য না করে গোপনে শিখদের সাথে হাত মিলায়। দ্বিতীয়ত: শিখবাহিনী যখন মেটিকোটে আরোহনের চেষ্টা করছিল তখন সেখানে পাহারায় থাকা মুজাহিদ বাহিনীতে অনুপ্রবেশকারী কিছু মুনাফিক তাদেরকে গোপন পথ বাতলে দেয়। এই চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা না করলে শিখবাহিনী মেটিকোটে প্রবেশ করতে পারত না। তৃতীয়ত: সাইয়েদ আহমাদের সাথে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে হাযারার এক উপজাতীয় প্রধান শিখদেরকে বালাকোটের সাথে সংযুক্ত পাহাড়ের উপরিভাগে উঠার গোপন পথের সন্ধান দিয়ে। এভাবেই ক্ষুদ্র অথচ পর্বতসম ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান মুজাহিদ বাহিনীর চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটে।
পরিস্থিতি বিশ্লেষণান্তে বলা যায় যে, যুলুম-নির্যাতন ও পরাধীনতার শিকল ছিন্ন করে স্বাধীনতা অর্জন ও আল্লাহ প্রদত্ত অভ্রান্ত সত্যের একমাত্র উৎস ওহীর বিধান তথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রচার-প্রসার এবং অপসংস্কৃতির পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে পরিচালিত প্রথম সংঘবদ্ধ প্রয়াস হল ‘জিহাদ আন্দোলন’। যা সম্ভব হয়েছিল সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভীর মত একজন সিংহকেশর, দৃঢ়চিত্ত বিপ্লবী পুরুষ এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন একদল বিশুদ্ধ আত্মার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে। মুজাহিদ নামধারী কিছু মুনাফিক পাহারাদার এবং কিছু মুসলিম জমিদার ও প্রভাবশালী ব্যক্তি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে উপমহাদেশের প্রথম এই জিহাদ আন্দোলন শিখদের দমন ও ব্রিটিশদের বিতাড়নে এত তাড়াতাড়ি ব্যর্থ হত না। তারপরও এটা সুনিশ্চিত যে, বালাকোট যুদ্ধের সূত্র ধরেই উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। তাইতো পরবর্তী যুগ পরিক্রমায় ভাবী পুরুষদের মাধ্যমে এ আন্দোলনের স্মৃতি বার বার মাথাচাড়া দিয়েছে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ বেনিয়া বিরোধী দুঃসাহসী সিপাহী বিদ্রোহ তথা অসহযোগ আন্দোলনসহ উপমহাদেশের পরবর্তী সকল সংস্কারবাদী ও স্বাধীনতাকামী আন্দোলন আমাদের তা-ই স্মরণ করিয়ে দেয়। সত্যি বলতে কি উপমহাদেশের পরবর্তী সকল ইসলামী আন্দোলনগুলোই মূলত এ আন্দোলনেরই পরোক্ষ ফসল। যতদিন এ উপমহাদেশ থেকে শিরক-বিদ‘আতের শিখন্ডিগুলোর মূলোৎপাটন না ঘটবে, যতদিন দ্বীনে ইসলামের শ্বেত-শুভ্র পত্র-পল্লব বাহিত পবিত্র বাতাস এ যমীনের বুকে অপ্রতিহতভাবে প্রবাহমান না হবে, ততদিন পর্যন্ত ইতিহাসের পাদপীঠে ক্ষুদ্র তিলকের মত এ সবিশেষ এই ক্ষণটুকুর মহিমা, এর অন্তস্থ বিপ্লবের অগ্নিশিখা ভাবী প্রজন্মের প্রতিটি মুসলিম মুজাহিদের অন্তরে ক্ষিপ্র প্রেরণাজ্বালা হয়ে জাগরুক থাকবে; প্রকাশ্যে ও সঙ্গোপনে।
গ্রন্থপঞ্জী:
১. আবুল হাসান নাদভী, সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ।
২. ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ (পিএইচ.ডি থিথিস)।
৩. ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
৪. আই, এইচ কুরেশী, উপমহাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজ; (ঢাকা ইসলামিক
ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ : ২০০৫)।
৫. মুহাম্মাদ মিঞা, ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী।
ড. মুহিববুল্ল্যাহ সিদ্দীকী, প্রবন্ধ : বালাকোটের মর্মান্তিক শিক্ষা : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, এপ্রিল-জুন ২০০৭, পৃ: ৩৩।