মোবাইল আসক্তিতে মায়োপিয়া রোগ
মুহাম্মাদ তোফায়েল আহমাদ
ড. এ.এস.এম. আযীযুল্লাহ 9616 বার পঠিত
নিজস্ব
বৈশিষ্ট্য ছাড়া কোন কিছুরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অকল্পনীয়। পৃথিবীতে এমন কোন
বন্তু নেই যার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম নেই। পানির ধর্ম নিচের দিকে
প্রবাহিত হওয়া, ০০C তাপমাত্রায় বরফ এবং ১০০০C বা তার
চেয়ে অধিক তাপমাত্রায় বাষ্পে পরিণত হওয়া। তাছাড়া পানিতে নিমজ্জিত কোন
বস্ত্ত কর্তৃক অপসারিত পানির ওজন অপেক্ষা বস্ত্তর ওজন কম হলে তাকে ভাসিয়ে
রাখা এবং বস্ত্তর ওজন বেশি হলে তাকে ডুবিয়ে দেওয়া প্রভৃতি পানির সাধারণ
বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম। অনুরূপ আগুনের ধর্ম হচ্ছে প্রজ্জ্বলিত অবস্থায়
ঊর্ধ্বগামী হওয়া, তাতে নিপতিত যেকোন দাহ্য বস্ত্তকে জালিয়ে-পুড়িয়ে ছাইভস্ম
বা নিঃশেষ করে দেওয়া ইত্যাদি। এমনিভাবে জীব-জড়, কঠিন, তরল, বায়বীয়সহ সকল
পদার্থই তার আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বতন্ত্র পরিচয়ে বিরাজমান।
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এ পর্যন্ত ১১১টি মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। যাদের সুনিয়ন্ত্রিত সমন্বয়ে বিশ্বে কোটি কোটি পদার্থ সৃষ্টি হয়েছে। সকল পদার্থই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা ধর্মের অধিকারী। পৃথিবীর সকল বস্ত্তই আপন আপন ধর্ম মেনে নিজ পরিচয়ে অস্তিত্বশীল হয়ে আছে। সমগ্র বিশ্বে এমন একটি বস্ত্তও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে নিজ ধর্ম বিরোধী আচরণ করে বা করতে চায়। সৃষ্টিকর্তা যাকে যেখানে যেরূপ ধর্মগুণে সৃষ্টি করেছেন, সে সেখানে ঠিক সেরূপ আচরণ করে থাকে। এমনকি একই নদীতে বিনা পর্দায় মিঠা ও নোনা পানির স্রোত আবহমানকাল ধরে যার যার মত বয়ে চলে, কেউ কারো সাথে মিশে যেতে চায় না বা যায় না। এমনিতর হাযারও প্রমাণ আছে যে, পৃথিবীর সকল বস্ত্তই আপন ধর্ম মেনে স্বকীয় অস্তিত্বে বিরাজমান। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে যখনি কোন বস্ত্তর মধ্যে আপন ধর্মের বিচ্যুতি ঘটে, তখনই উক্ত বস্ত্ত তার স্বতন্ত্র পরিচয় হারিয়ে ফেলে হয় নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয়, অন্যথা নিঃশেষ হয়ে যায়। যার একমাত্র কারণ ধর্ম বিচ্যুতি। সুতরাং একমাত্র ধর্ম ঠিক থাকলেই সকল বস্ত্ত তার নিজ পরিচয়ে অস্তিত্ববান থাকতে পারে।
মানুষ ব্যতীত পৃথিবীর সকল সৃষ্টি সৃষ্টিকর্তার নির্দেশমত পরিচালিত হয়। অন্যান্য সৃষ্টির চেয়ে মানুষকে আল্লাহ অতিরিক্ত কিছু যেমন বিবেক-বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি, ভাল-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ ইত্যাদি ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ করণেই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। অন্যান্য সৃষ্টির মত মানুষকেও এই পৃথিবীতে চলার জন্য একটা ধর্ম দিয়ে পাঠিয়েছেন। সাথে সাথে স্বতন্ত্র ক্ষমতার কারণে তাকে দেওয়া হয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা। অর্থাৎ মানুষ আপন বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি দিয়ে ভাল-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ করে পৃথিবীতে চলাফেরা করবে। এক্ষেত্রে যে ভাল পথে চলবে, সে কল্যাণ লাভ করবে; আর যে মন্দ পথে চলবে, সে অকল্যাণের অনুগামী হবে।
মানব জীবনে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। বর্তমান বিশ্বে ধর্ম নিয়ে নানারকম মন্তব্য, চিন্তাধারা ও গবেষণা শুরু হয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু নাস্তিক ছাড়া মানব জীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করতে পারেনি। মানব জীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে C. J. Ducasse তাঁর A Philosophical Scrutiny of Religion গ্রন্থে বলেন, ‘ধর্ম-সম্বন্ধীয় বিশ্বাসের সত্যতা বা মিথ্যাত্বের প্রশ্ন, কিংবা ধর্মের পরিণাম প্রায়শই। ভাল না মন্দ, এসব প্রশ্ন উত্থাপন না করেও বলা যেতে পারে যে, ধর্ম মানুষের জীবনের এক অসাধারণ আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দিক’। Thompson তাঁর The Philosophy of Religion গ্রন্থে বলেন, ‘So far as religion has truth accessible to human reason the philosophy of religion is an essential part of any comprehensive view.’ অর্থাৎ ধর্মের যদি এমন সত্য থাকে যা মানুষের বিচারবুদ্ধির অধিগম্য, তাহলে ধর্মদর্শন যেকোন সামগ্রিক দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় অংশ। মোট কথা মানব জীবনে ধর্মের প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা কোনভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।
এখন প্রশ্ন হল ধর্ম কি? তত্ত্বগতভাবে বস্ত্তর অবশ্য প্রয়োজনীয় প্রকৃতিই তার ধর্ম, যা তার অস্তিত্বকে ধারণ করে আছে। ধর্ম শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় ধৃ+মন্=ধর্ম। অর্থাৎ ধৃ ধাতু থেকে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি। ধৃ ধাতুর অর্থ ধারণ করা। সুতরাং যা ধারণ করা হয় তাই ধর্ম।
আদম (আঃ) থেকে শুরু করে শেষনবী (ছাঃু) পর্যন্ত একলক্ষ চবিবশ হাযার নবী-রাসূলের আনীত ধর্মের নাম ‘ইসলাম’। ইসলাম স্বভাবধর্ম। মহান আল্লাহ বলেন, فِطْرَةَ اللهِ الَّتِيْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لاَ تَبْدِيْلَ لِخَلْقِ اللهِ ذَلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّمُ. ‘এটাই আল্লাহর ফিতরাত, যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটিই সরল-সোজা মযবূত দ্বীন।[1] এ আয়াত থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, অন্যান্য সৃষ্টির মত আল্লাহ মানুষকেও সুনির্দিষ্ট ফিতরাত বা স্বভাবের উপর সৃষ্টি করেছেন। কালের বিবর্তনে, পরিবেশ ও পরিস্থিতির শিকারে মানুষ সৃষ্টিগত স্বভাব ভুলে ভিন্ন স্বভাব বা ধর্মের অনুগামী হয়ে পড়ে। ফলে সমাজে নানা রকম বিপর্যয় নেমে আসে। মানুষকে স্বভাবধর্মের উপরে সৃষ্টির বিষয়ে রাসূলdবলেন, مَا مِنْ مَوْلُوْدٍ إِلاَّ يُوْلَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ،ِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ- ‘প্রত্যেক নবজাতকই ফিতরাতের (স্বভাবধর্মের) উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী, খৃষ্টান অথবা অগ্নিপূজক বানায়’।[2] এ হাদীছে থেকেও বুঝা যায় যে, সৃষ্টিগতভাবে প্রত্যেক মানুষই সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত স্বভাবধর্ম তথা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর সমাজ ও পিতা-মাতার ধর্ম তাকে জন্মগত স্বভাবের উপরে বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে আস্তে আস্তে তার ভিতর থেকে সৃষ্টিগত স্বভাবধর্ম নিঃশেষ হয়ে, অন্য ধর্ম আসন গেড়ে বসে।
যেকোন ব্যক্তি বা বস্ত্তর নিকট থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত স্বভাবধর্মের আচরণ পাওয়া যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা সমাজ ও জাতির কল্যাণকর হয়। কিন্তু যখনি তারা স্বভাবধর্ম বিরোধী আচরণ করে, তখনি তা সমাজ ও জাতির জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে।
সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে বর্তমান পৃথিবীতে ধর্মের সংখ্যা কয়েক হাযার হবে। তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ধর্ম সম্পর্কে কমবেশি সকলে অবহিত।
আলোচিত ধর্মগুলোর মধ্যে হিন্দুধর্ম অন্যতম। হিন্দুধর্মের উৎস ও প্রাচীনত্ব নিয়ে নানা রকম মতভেদ রয়েছে। হিন্দুধর্মের উৎপত্তি ও সংঙ্গা দিতে গিয়ে শ্রী গোবিন্দ দাস তাঁর Hinduism গ্রন্থে বলেন, No defination is possible, for the very good reason that Hinduism is absolutety indefinite. ‘হিন্দুধর্মের কোন সংগা দেওয়া সম্ভব নয়; কারণ হিন্দুধর্ম পরিপূর্ণভাবে অনির্দিষ্ট’। তবে ভারতবর্ষই যে হিন্দুধর্মের উৎসভূমি এ বিষয়ে তেমন কোন দ্বিমত নেই। প্রাচীন কালে হিন্দুধর্ম আর্যধর্ম নামে পরিচিত ছিল এবং এর অনুগামীদের আর্য বলা হত।[3] হিন্দু ধর্মের অপর নাম সনাতন ধর্ম। এ ধর্মের মূল গ্রন্থ বেদ বিধায় একে বৈদিক ধর্মও বলা হয়ে থাকে। হিন্দু ধর্মের মূলমন্ত্র হল শান্তি, প্রেম, সহানুভূতি ও সেবা। হিন্দুধর্ম বিশ্বাস মতে ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান।[4] কালের বিবর্তনে হিন্দুধর্মের মধ্যে বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব, গাণপাত প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে। তাছাড়া জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, শৈবধর্ম প্রভৃতি হিন্দুধর্ম থেকেই উদ্ভূত।
একথা কারো অজানা নয় যে, হিন্দুধর্মের
অনুসারীরা বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী। সেই বহু দেবতার মধ্যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও
মহেশ্বর এই তিন দেবতার উদ্দেশ্যে তাদের অসংখ্য ভক্ত পূজা নিবেদন করে থাকে।
কারণ ধর্মমতে উক্ত তিন দেবতা তিনটি স্বতন্ত্র ক্ষমতার অধিকারী। ব্রহ্মা
সৃষ্টিকারক, বিষ্ণু সংরক্ষক এবং মহেশ্বর বা শিব সংহারক। ধর্মের বিধানে বলা
হচ্ছে, আসলে এ তিন দেবতা একই পরমেশ্বরের তিনটি রূপ, তিনটি ভিন্ন দেবতা নয়।
একই পরম সত্তার ভিন্ন ভিন্ন রূপমাত্র। জগতের সব কিছুর মূলে একই চৈতন্য
সত্তার অস্তিত্ব। অর্থাৎ সমস্ত দেবতার সত্তা এক পরম সত্তায় অধিষ্ঠিত। সেই
পরম সত্তা ভিন্ন দেবতাদের স্বতন্ত্র কোন সত্তা নেই।[5]
শুধু ঈশ্বর ধারণায় নয়, হিন্দুধর্ম এক শাশ্বত নৈতিক শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী। শৃঙ্খলার অন্যতম পন্থা হল কর্মফল। ধর্মমতে বলা হয়েছে, মানুষকে তার কৃতকর্মের ফল অবশ্যই ভোগ করতে হবে। যে যেরূপ কর্ম করবে, তাকে সেরূপ ফল ভোগ করতে হবে। সৎ কর্মের ফল পুণ্য ও সুখ, অসৎ কর্মের ফল পাপ এবং দুঃখ। কোন জীবের পক্ষেই কর্মফল এড়ানো সম্ভব নয়।
সংক্ষিপ্ত এ আলোচনা থেকে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, হিন্দুধর্মের বহু ঈশ্বরের মূলে আছে এক পরম সত্তা। আর তিনিই মহান আল্লাহ। তাছাড়া কর্মফলের বিষয়টিও ইসলামী বিশ্বাসের অনুকূলে।
বর্তমান বিশ্বে আলোচিত ধর্মের মধ্যে খৃষ্টান ধর্ম অন্যতম। অনুসারীর দিক দিয়ে এ ধর্ম সবার শীর্ষে। আজকের দিনে প্রতি তিনজনে একজন খৃষ্টান। আল্লাহ প্রেরিত নবী হযরত ঈসা (আঃ)-এর আনীত ও প্রচারিত ধর্মই বর্তমানে খৃষ্টান ধর্ম নামে পরিচিত। খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থের নাম বাইবেল। যদিও আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈসা (আঃ)-এর উপরে যে কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছিল তার নাম ‘ইঞ্জিল’। বর্তমানে বাইবেলের দুটি সংস্করণ আছে, Old Testament এবং New Testament. মৌলিকত্বের বিচারে খৃষ্টানধর্ম ইলাহী ধর্ম। কিন্তু ঈসা (আঃ)-এর জন্ম, অতঃপর তাঁকে উঠিয়ে নেয়াসহ বহু বিষয় নিয়ে কালের বিবর্তনে এ ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে নানা রকম মতভেদ সৃষ্টি হয়। যেমন বর্তমান প্রগতিবাদী খৃষ্টানরা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী। তাদের মতে স্রষ্টার তিনটি রূপ আছে- পিতা (God the Father), পুত্র (God the Son) ও পবিত্র আত্মা (God the Holy spirit)। এ মতবাদ অনুসারে পিতা স্রষ্টা সকল কিছুর আদি উৎস; অতঃপর পুত্র হিসাবে তিনি যীশুর মধ্যে মূর্ত এবং পবিত্র আত্মা হিসাবে তিনি সকল সৃষ্টির মধ্যে বিরাজমান। এই মতের অনুসারীরা যীশুকে স্রষ্টার পুত্র হিসাবে মনে করেন এবং যীশু স্রষ্টার অবতার (Incarnation of God)। অবশ্য এই ত্রিত্ববাদের ধারণাটি বাইবেলের New Testament সৃষ্ট, যা Old Testament-এ নেই। এগুলো তাদের নিছক ভ্রান্ত বিশ্বাস। এ ধরনের নানা ভ্রান্ত ধারণা, মত, চাতুরী, গোঁয়ার্তুমি, স্ববিরোধীতা ইত্যাদির কারণে খোদ চিন্তাশীল খৃষ্টানদের নিকটে বাইবেল সবচেয়ে ধ্বংসকারী ও বিপজ্জনক গ্রন্থ হিসাবে চিহ্নিত। যেমন- বাইবেল সম্পর্কে Alan Watts বলেন, It is a dangerous book, though by no means an evil one. এ প্রসঙ্গে James Harvey তাঁর Of the Bible বলেন, We see nothing work-while in the book. It is most evil, injurious, fallacious, divisive book ever written. It has caused more desaths, tortures and suffering than any other book ever written. It has been the most oft-used instrument for holding back human progress for thousands off years. It has been the cause of more wars than any other book or tyrant of human characteristic. অর্থাৎ এ গ্রন্থে প্রয়োজনীয় কোন কিছু আমরা দেখি না। এ যাবত রচিত গ্রন্থের মাঝে এটা সর্বাধিক মন্দ, অন্যায়সাধক, ভ্রান্তিমূলক, বিভেদ ও বিবাদ সৃষ্টিকারী গ্রন্থ। হাযার হাযার বছর ধরে মানুষের প্রগতিকে আটকিয়ে রাখার জন্য এ গ্রন্থ বারে বারে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ গ্রন্থ যত যুদ্ধ বিগ্রহের কারণ হয়েছে তেমন কোন শাসক, অত্যাচারী মানব চরিত্রে তা হয়ে ওঠেনি।
এমনিভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা যাবে বিশ্বের সকল প্রসিদ্ধ ধর্মের মূল কথার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন,
شَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّيْنِ مَا وَصَّىْ بِهِ نُوْحاً وَّالَّذِيْ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسَى وَعِيْسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّيْنَ وَلَا تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ.
‘তিনি
তোমাদের জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারণ করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন
নূহকে; যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম
ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে
অনৈক্য সৃষ্টি কর না’।[6]
এ প্রসঙ্গে রাসূল (ছাঃ) নিজেও বলেন, ‘নবীগণ পরস্পরে বৈমাত্রেয় ভাই। তাঁদের মায়েরা পৃথক। কিন্তু তাঁদের সকলের দ্বীন এক’।[7] তাছাড়া পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে প্রসিদ্ধ নবী ও রাসূলগণ যাঁদেরকে ঐসব বিকৃত অনুসারীগণ আপন আপন নবী বা রাসূল বলে গর্ববোধ করে থাকেন তাঁরা অকপটে নিজেদের মুসলিম পরিচয় প্রকাশ করেছেন। যেমন ইবরাহীম (আঃ) ও ইয়াকুব (আঃ) তাদের সন্তানদের উদ্দেশ্যে পৃথক পৃথকভাবে ওছিয়াত করেন যে, হে আমার সন্তানগণ! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের জন্য এ ধর্মকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ কর না (বাকারা ১৩২)। ঈসা (আঃ)ও নিজে ও তাঁর সাথীদের কে মুসলমান বলে পরিচয় দিয়েছেন (আলে ইমরান ৫২)। অর্থাৎ মানব সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ নবী পর্যন্ত যুগে যুগে সৃষ্টিকর্তার মনোনীত যে সকল ধর্ম প্রচারকের আবির্ভাব ঘটেছে, তাদের আনীত ধর্মের মৌলিকত্বে কোন প্রভেদ নেই। মূলত সকল ধর্ম প্রচারকের মূল দাওয়াত ছিল একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং অন্য কাউকে তাঁর সঙ্গে শরীক করবে না। এক কথায় তাওহীদ।
পরিশেষে বিশ্বের প্রসিদ্ধ ধর্মসমূহের মধ্য হতে দু’একটি ধর্মের বিধানের বিশ্লেষণে এবং মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের শাশ্বত ঘোষণার মাধ্যমে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, আদম (আঃ) থেকে শুরু করে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকলের আনীত ধর্ম এক ও অভিন্ন এবং তা ইসলাম। ইসলাম ভিন্ন আর যেসব ধর্ম রয়েছে তা মূলত নিছক কুসংস্কার, মিথ্যা ও বাস্তবতা বিবর্জিত অলীক কল্পনার সমষ্টি।
[1]. সূরা আর-রূম, আয়াত ৩০।
[2]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত, হাদীছ নং ৯০।
[3]. প্রমোদবন্ধ সেনগুপ্ত, ধর্মদর্শন, ব্যানার্জী পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৯৭৪, পৃ. ৪৪২।
[4]. তদেব, পৃ. ৪৪৩।
[5]. তদেব, পৃ. ৪৫৪।
[6]. সূরা আশ-শূরা, আয়াত ১৩।
[7]. বুখারী, মুসলিম, হাদীছ নং ২৩৬৫; মিশকাত-আলবানী, হাদীছ নং ৫৭২২।