আজকের সুশীল মুসলিম যুবসমাজের কর্তব্য

হাশেম আলী 10189 বার পঠিত

আমি আমার এই বক্তব্যে তোমাদের এটা বলছিনা যে, তোমরা সকলেই মুজাহিদ ইমাম ও মুহাক্কিক ফকীহ বনে যাও। যদিও এটা আমার ও তোমাদের জন্য আননেদর বিষয়। যেহেতু বিদ্বানগণের পারস্পরিক সহযোগিতার অভাবে ও বিশেষত্বের বিভিনণতার দরুণ স্বাভাবিকভাবেই এটি অসম্ভব, সেহেতু এ সম্পর্কে আমি এখানে দু’টি বিষয় উপস্থাপনের মনস্থ করেছি :-

প্রথমত : তোমরা সেই বিষয়ে সতর্ক হবে যা অন্যরা ছাড়াও আজকের দিনের অনেক সুশীল মুমিন যুবকের নিকটে অস্পষ্ট। তা হল তারা বর্তমানে কতিপয় মুসলিম লেখক যেমন সাইয়িদ কুতুব, মওদুদী (রহঃ) প্রমুখের লেখনী ও প্রচেষ্টার বদৌলতে অবগত হয়েছে যে, নিশ্চয় বিধান প্রণয়নের অধিকার একমাত্র আল্লাহরই রয়েছে। এক্ষেত্রে তার সাথে কোন মানুষ অথবা সংস্থার কোন অংশীদারিত্ব   নেই। তাঁরা (মাননীয় লেখকগণ) এর দ্বারা ‘শাসন কর্তৃত্ব মহান আল্লাহর’ বুঝিয়েছেন।

আমি বলব, বর্তমান সময়ে এই যুবসমাজের অনেকেই এ ব্যাপারে এখনও সতর্ক হয়নি যে, বিধান প্রণয়নে আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্ব নাকচের বিষয়টি আল্লাহকে ছাড়া আল্লাহর বিধান সমূহের কোন বিধানে ভুলকারী মুসলমানের অনুসারী হওয়া অথবা আল্লাহর সাথে বিধান প্রণেতা হিসেবে আত্মনিয়োগকারী কাফেরের অনুসরণ করা এবং তার আলেম অথবা জাহেল হওয়ার মাঝে কোনই পার্থক্য নেই। এগুলোর প্রত্যেকটি উল্লেখিত মূলনীতির (শাসন কর্তৃত্ব মহান আল্লাহর) বিরোধী। যে মূলনীতির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে যুবসমাজ। ফালিল্লাহিল হামদ।

আমি চাই, তোমরা এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করবে এবং আমি এ বিষয়ে তোমাদেরকে বুঝাতে চাই। কেননা বোঝানো মুমিনদের উপকারে আসে (যারিয়াত ৫৫)

আমি তাদের অনেককে আল্লাহর শাসন কর্তৃত্বের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য প্রশংসনীয় ইসলামী চেতনা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে বক্তব্য দিতে শুনেছি এবং শুনেছি কুফরী শাসনের (অসার) নিয়মনীতির দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে। এটা ভাল। এখন যদিও আমরা তা পরিবর্তন করতে সক্ষম নই। তবে তা করা অবশ্যই সম্ভব।  আমাদের অনেকের মধ্যে উপরোক্ত মূলনীতির বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। সাবধান! জেনে রাখ, এটাই হচ্ছে তাক্বলীদের মাধ্যমে ধর্মকর্ম পালন করা এবং এর দ্বারা কিতাব ও সুন্নাহর দলীলকে প্রত্যাখান করা।

এ ধরনের উদ্যমী বক্তাকে যদি তুমি কোন আয়াত অথবা হাদীছ বিরোধী কর্মকান্ডের ব্যাপারে সতর্ক কর তাহলে সে সতর্ক না হয়ে বরং তৎক্ষণাৎ মাযহাবী যুক্তি-তর্কের আশ্রয় গ্রহণ করবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, সে তার এই ধরনের কর্মকান্ড দ্বারা উক্ত গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিকে লঙ্ঘন করে। যে মূলনীতির দিকে মানুষকে সে আহবান জানায়। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের বক্তব্য কেবল একথাই যখন তাদের মধ্যে ফয়সালা করার জন্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে তাদেরকে আহবান করা হয়, তখন তারা বলেন, আমরা শুনলাম ও আদেশ মান্য করলাম। তারাই সফলকাম’ (নূর ৫১)। সুতরাং তার উচিৎ কুরআন-হাদীছের দলীল শ্রবণের সাথে সাথে দ্রুত তার নিকট আত্মসমর্পণ করা। কেননা এটাই প্রকৃত জ্ঞানের পরিচয়। পক্ষান্তরে তাক্বলীদের আশ্রয় নেওয়া উচিৎ নয়। কেননা তা মূর্খতার পরিচায়ক।

অপর বিষয়টি হচ্ছে, প্রত্যেক মুমিনের জন্য যতটুকু সম্ভব ততটুকু তাহকীক করা উচিত। যদিও তা ইজতিহাদ ও সূক্ষ্ম তাহকীকের পর্যায়ে উন্নীত না হয়। কেননা এটা শুধু বিশেষজ্ঞদের কাজ। তোমাদের প্রত্যেকেই সাধ্যমত এককভাবে শুধু তারই অনুসরণ করবে। তোমরা যেমন তোমাদের ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে এক জেনে তার ইবাদত কর, ঠিক তেমনি তোমরা তোমাদের অনুসরণের ক্ষেত্রে এককভাবে শুধু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এরই ইত্তেবা বা অনুসরণ করবে। অতএব তোমাদের উপাস্য এক এবং তোমাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিও এক। এর দ্বারাই তোমাদের ‘আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত ইলাহ নাই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল‘-এর সাক্ষ্যদানকে বাস্তবায়িত করবে।

অতএব হে ভ্রাতৃমন্ডলী! তোমরা নিজেদেরকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে প্রমাণিত  হয়েছে এমন প্রতিটি হাদীছের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে অভ্যস্থ করো। চাই তা আক্বীদাহগত বিষয়ে হোক কিংবা হুকুম-আহকাম বিষয়ে। আর চাই তা তোমার মাযহাবী ইমাম বা অন্য কোন ইমামও বলুন না কেন। কতিপয় ব্যক্তির রায় ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে রচিত নীতির আলোকে কোন নীতি গ্রহণ করবে না। কারণ তারা প্রকৃত মুজতাহিদ নন। ফলে উহা রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। আর তোমরা কোন মানুষের তাক্বলীদ করবে না তিনি যত বড় লোকই হন না কেন। তোমাদের নিকটে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী পৌঁছার পরেও কি তোমরা তার উপরে তাঁর (অনুসরণীয় ইমামের) বাণীকে প্রাধান্য দিবে?

 জেনে রেখ, তোমরা শুধু রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ দ্বারাই উক্ত মূলনীতিকে তথা ‘আললাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নাই জীবনের নীতি’ এবং ‘শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহর’ ইলম ও আমলে বাস্তবায়য়িত করবে। উহা [ইত্তেবায়ে রাসূল (ছাঃ)] ছাড়া আমাদের পক্ষে এমন কোন অনন্য কুরআনী প্রজন্ম সৃষ্টি করা বা গড়ে তোলা সম্ভব নয়, যে প্রজন্ম একাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত মুসলিম সমাজ ও  রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। এ কথাই বলেছেন একজন বিশিষ্ট মুসলিম দাঈ, তোমরা তোমাদের অন্তরে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম কর তাহলে তা তোমাদের জন্য তোমাদের যমীনে প্রতিষ্ঠিত হবে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই তা হয়ে যাবে।

আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য কর, যখন তোমাদের সে কাজের প্রতি আহবান করা হয়, যাতে রয়েছে তোমাদের জীবন। জেনে রাখো, আল্লাহ মানুষের এবং তার অন্তরের মাঝে অন্তরায় হয়ে যান। বস্ত্তত তোমরা সবাই তাঁরই নিকটে সমবেত হবে’ (আনফাল ২৪)(আল হাদীছু হুজ্জিয়াতুন,পৃঃ ৯০-৯৩)।


পুত্রের প্রতি বাদশাহ মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ-এর উপদেশ

(৭ম উছমানীয় খলীফা দ্বিতীয় মুহাম্মাদ ৮৩৩ হিজরী/১৪২৮ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার মৃত্যুর পর ৮৫৫ হিজরীর ১৬ই মুহাররম মোতাবেক ১৮ই ফেব্রুয়ারী ১৪৫১ খৃষ্টাব্দে তিনি মাত্র ২২ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইতিহাসের পাতায় তাঁর শাসনামল উজ্জ্বৃল হয়ে আছে। বিশেষ করে কনস্টান্টিনোপল বিজয় তার অনন্য কীর্তি। এতদুদ্দেশ্যে তিনি আড়াই লক্ষের এক বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রস্ত্তত করেন। তিনি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ৮৫৭ হিজরীর ২৬শে রবীউল আউয়াল বৃহস্পতিবার মোতাবেক ৬ই এপ্রিল ১৪৫৩ খৃষ্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল আক্রমণ করেন। ৫৩ দিন অবরোধের পর ২৯ মে ১৪৫৩ খৃষ্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল বিজয় করে ইতিহাসে মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ বা দিগ্বিজয়ী মুহাম্মাদ রূপে বরিত হন। তাঁর শাসনামলে সমাজে আদল ও ইনছাফ বিরাজমান ছিল। ১৪৮২ খৃষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি তাঁর সন্তানকে নিম্নোক্ত উপদেশ দেন- অনুবাদক)

এখন আমি মৃত্যুপথ যাত্রী। কিন্তু আমার কোন আফসোস নেই। কেননা আমি তোমার মত একজনকে উত্তরাধিকারী হিসেবে রেখে যাচ্ছি। তুমি ন্যায়নিষ্ঠ, সৎ ও দয়ার্দ্র হবে এবং কোন প্রকার বৈষম্য ছাড়াই প্রজাদের উপর তোমার সহায়তার হাত প্রসারিত করবে। তুমি দ্বীন ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করবে। কেননা পৃথিবীতে এটাই মূলত বাদশাহের উপরে ওয়াজিব। সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুমি দ্বীনী বিষয়কে প্রাধান্য দিবে। নিরবচ্ছিন্নভাবে দ্বীন প্রচারে ক্লান্তি বোধ করবে না। তুমি ঐ সকল ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে নিযুক্ত করবে না যারা দ্বীনের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয় না, কাবীরা গুনাহ হতে বিরত থাকে না; বরং অন্যায়-অশ্লীলতায় আরো নিমগ্ন থাকে।

তুমি ধ্বংসাত্মক বিদ‘আত পরিহার করে চলবে এবং এর প্রতি যারা তোমাকে উৎসাহিত করবে তাদের থেকে দূরে থাকবে। জিহাদের মাধ্যমে তুমি দেশের ভূখন্ড বিস্তৃত করবে এবং বায়তুল মালের (রাষ্ট্রীয় কোষাগার) সম্পদ অপচয় না হয় সে দিকে খিয়াল রাখবে। সাবধান! একমাত্র ইসলামের অধিকার ছাড়া প্রজাদের কারো সম্পদের দিকে তোমার হস্ত প্রসারিত করবে না। তুমি অভাবগ্রস্তদের খাদ্যের ব্যবস্থা করবে এবং যোগ্য ব্যক্তিদেরকে সাহায্য করবে।

যেহেতু আলেমগণই রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোয় বিক্ষিপ্ত শক্তির উৎস, সেহেতু তুমি তাদের যথাযথ মর্যাদা দিবে এবং তাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে। যখন তুমি অন্য কোন রাষ্ট্রে তাদের যোগ্য কারো সম্পর্কে অবগত হবে তখন তাকে তোমার নিকটে আহবান করবে এবং অর্থ-সম্পদ দিয়ে তাকে সাহায্য করবে। সাবধান! সাবধান!! সম্পদ ও সৈন্য (শক্তি) তোমাকে যেন প্রতারিত না করে। সাবধান! তুমি তোমার দরজা থেকে দ্বীনের অনুসারীদেরকে দূরে সরিয়ে দিবে না এবং দ্বীনী বিধি-বিধানের বিপরীত কোন কাজ করবে না। কারণ দ্বীনই আমাদের লক্ষ্য, হেদায়েতই আমাদের পথ এবং এর মাধ্যমেই আমরা বিজয় লাভ করব।

(হে বৎস!) তুমি আমার নিকট থেকে এই উপদেশটুকু গ্রহণ কর। এই দেশে আমি উপস্থিত হয়েছি (আগমন করেছি) ছোট্ট একটি পিপীলিকার ন্যায়। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এতসব বড় বড় নিয়ামত দান করেছেন। অতএব তুমি আমার নীতি অবলম্বন করো এবং আমার পদাঙ্ক অনুসরণ কর। এই দ্বীনকে শক্তিশালী করতে ও এর অনুসারীদের সম্মান করতে তুমি নিজেকে আত্মনিয়োগ কর। খেল-তামাশায়, বিলাসিতায় অথবা প্রয়োজনাতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয় করো না। কেননা এটাই ধ্বংসের অন্যতম কারণ।

(ড. আলী মুহাম্মাদ আছ-ছাল্লাবী, আদ-দাওয়াতুল উছমানিয়্যাহ, পৃঃ ১৩৫)



আরও