তিউনিসিয়ার পর মিসর : কি ঘটছে মধ্যপ্রাচ্যে?

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক 9131 বার পঠিত

উপস্থাপনা : মানুষের ভিতর নিজেকে জাহির করার একটা প্রবণতা সর্বদা কাজ করে। সে সবসময় চায় আরেকজনের উপর স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করতে। এখান থেকেই সৃষ্টি হয় নেতৃত্বের লোভ ও ক্ষমতার নেশা। যারা প্রকৃত মুমিন হন তারা এই লোভ ও ক্ষমতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকেন। আল্লাহ চাইলে তারা ক্ষমতা ও নেতৃত্ব লাভ করেন।

অন্যদিকে আরেকদল মানুষ রয়েছে যারা ক্ষমতা ও নেতৃত্বের জন্য লালায়িত। এদের জন্যই পৃথিবীতে সৃষ্টি হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে সবাই সফল হয়না। অনেকেই ব্যর্থ হয়। এই সফলতা ও ব্যর্থতা পরিবেশ ও পরিস্থিতির বিভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের উপর ভিত্তি করে তৈরী হয়। যেমন জনসমর্থন, সমরশক্তি, বৈদেশিক রাষ্ট্রের সমর্থন, উত্তরাধিকার সূত্র ইত্যাদি। তবে এই সবগুলোর চাবিকাঠি সকলের অলক্ষ্যে আল্লাহর হাতে রয়েছে। এদের কেউ ক্ষমতা পেয়ে জনগণের কল্যাণ করতে চেষ্টা করে আবার কেউ স্বীয় স্বার্থ হাসিল করার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে। আপন স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার অভিপ্রায়ে দেশ ও জাতির সার্বভৌমত্ব বিদেশী বেনিয়াদের কাছে বিকিয়ে দিতেও এরা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না।

ইতিহাস সাক্ষী, এরা যতই শক্তিশালী, বিদেশী মদদপ্রাপ্ত ও সমরশক্তিতে সুসজ্জিত হোক না কেন এদের মসনদে একদিন না একদিন কাঁপন ধরবেই। মিসর ও তিউনিসিয়ায় যা হচ্ছে এটা তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিস থেকে ৩০০ কি:মি: দূরে অবস্থিত সিদি বুজিদ শহরের এক সবজি ফেরীওয়ালা ছিলেন মুহাম্মাদ বুয়াজিজি। ১৭ই ডিসেম্বর ২০১০ লাইসেন্সবিহীনভাবে শহরের রাস্তায় মাল বিক্রি করার অপরাধে তার ভ্যান বায়েজাপ্ত করে এক পুলিশ কর্মকর্তা। বিচার চাইতে তিনি সংশ্লিষ্ট দফতরে গেলে তার কথা শোনার সময় হয়নি সংশ্লিষ্টদের। ফলে ক্ষোভে-দুঃখে বাইরে বেরিয়েই তিনি নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে ১৭ দিন হাসপাতালে থাকার পর বুয়াজিজি মারা যান। মিডিয়ায় এই ঘটনা প্রচারিত হলে ক্ষোভের দানা বেঁধে উঠে সারাদেশে। ইতিপূর্বেই কর্মসংস্থানের জন্য অনেকদিন যাবৎ বেকার ছাত্ররা আন্দোলন করে আসছিল। ফলে এই ঘটনা প্রতিবাদ-বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। ক্ষোভে-রোষে উত্তাল হয়ে উঠে তরুণ সমাজসহ সর্বস্তরের জনতা। সরকারীভাবে কঠোরহস্তে এই বিদ্রোহ দমনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। চূড়ান্ত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীও অনাস্থা প্রকাশ করলে ১৪ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট বেন আলী মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হন এবং জরুরী অবস্থা জারী করেন। একই দিনে তিনি দেশ থেকে পলায়ন করে সউদী আরবে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। এভাবেই তার দীর্ঘ ২৩ বছরের শাসনামলের অবসান ঘটে। এ ঘটনারই রেশ যেয়ে পড়ে পাশ্ববর্তী মিসর এবং জর্ডান, ইয়েমেন, আলজেরিয়া, সুদান, আলবেনিয়া, গ্যাবন প্রভৃতি দেশে। যাকে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে ‘ডমিনো ইফেক্ট’ নামে। মাত্র ১৮ দিনের গণবিক্ষোভে মিসরে অহিংস গণআন্দোলনের মাধ্যমে যে বিশাল ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়েছে তা বিশ্ব রাজনীতিতে এক অবিস্মরণীয় ও যুগান্তকারী ব্যাপার। বক্ষ্যমাণ আলোচনায় তিউনিসিয়ার পর মিসরে সংঘটিত অভূতপূর্ব গণবিপ্লবের উপর পর্যবেক্ষণমূলক আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

মিসর : প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি এবং আধুনিক সভ্যতার জন্মদাত্রী মিসর আফ্রিকার একটি সমৃদ্ধশালী মুসলিম রাষ্ট্র। আধুনিক মিসরের আয়তন ৩৮৬১১০ বর্গমাইল। তন্মধ্যে বাসোপযোগী জায়গা মাত্র ১৩৫৭৮ বর্গমাইল। বাকী সব ঊষর মরুভূমি। মিসরের উত্তরে ভূমধ্যসাগর, পশ্চিমে লিবিয়া, পূর্বে লোহিত সাগর ও দক্ষিণে সুদান অবস্থিত। প্রধান দু’টি শহর হচ্ছে কায়রো ও আলেকজান্দ্রিয়া। দেশের অন্যতম প্রধান সম্পদ হল ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরকে সংযুক্তকারী সুয়েজ খাল, যা ১৮৬৯ সালে উদ্বোধন করা হয়। বর্তমান মিসরের জাতীয় আয়ের অধিকাংশ অর্থ এই খালের মধ্য দিয়ে চলাচলকারী জাহাজ থেকে প্রাপ্ত শুল্ক থেকে আসে। মিসরীয় জাতির প্রাণ হচ্ছে নীলনদ। এছাড়াও রয়েছে মিসরের বিখ্যাত পর্যটন শিল্প। যা ভ্রমণপিয়াসীদের আকর্ষণ করে।

মিসরের অতীত ইতিহাস : পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীনভূমি মিসর। পবিত্র কুরআনে ইউসুফ (আঃ) ও তৎপরবর্তী মূসা (আঃ)-এর যুগে মিসরের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বর্ণনা পাওয়া যায়। মিসরের অতীত ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও চমকপ্রদ। আধুনিক ইতিহাসবিদ কলিন মন্তব্য করেছেন, ‘No country in the world has so illustrious, complex and rich history as Egypt.' ইসলামের সাথেও এর রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। ইউসুফ (আঃ) ও মূসা (আঃ)-এর ঘটনাবলীর সাথে মিসর পুরোপুরি জড়িত। পরবর্তীতে ওমর (রাঃ)-এর আমলে আমর বিন আসের নেতৃত্বে মুসলিম সেনাদল মিসর জয় করে। এসময় বাইজান্টাইনীদের শাসনাধীন ছিল মিসর।

৯৬৯ খৃষ্টাব্দে ফাতেমীয়রা আববাসীয়দের নিকট থেকে মিসর দখল করে নেয়। ফাতেমী শাসকদের অধীনেই বিশ্ববিখ্যাত আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে ১১৭১ খৃষ্টাব্দে ক্রসেডের রণ দামামা এবং সেলজুক তুর্কীদের উত্থানের ফলে ফাতেমীয় শাসনের বিলুপ্তি ঘটে। সিরিয়ার শাসক নূরুদ্দীনের ভাতিজা সালাহুদ্দীন আইয়ূবী ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে পরাজিত করে মুসলিম জাতির এক চরম ক্রান্তিলগ্নে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ন হন। অন্যদিকে তিনি শীআ মতবাদের হাত থেকে সুন্নী ইসলামকে রক্ষা করেন। তাঁর এ বীরত্বগাঁথাও রচিত হয়েছে মিসরকে কেন্দ্র করে যা দেশটিকে ইসলামের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান করে দিয়েছে।

১৫১৭ থেকে ১৭৯৮ সাল পর্যন্ত ওসমানীয়দের অধীনে মিসরীয় মামলুকরা স্বায়ত্বশাসন ভোগ করে। ১৭৯৮ সালে ফরাসী সমরনায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মিসরকে করতলগত করেন। ১৮০১ সালে ফরাসীরা মিসর ত্যাগ করলে দেশটি ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৯৩৬ সালে বৃটিশদের হাত থেকে মিসর পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৫২ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্র ও সংসদ দুটোরই বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৪ সালে জামাল আব্দুল নাসের জেনারেল মোহাম্মাদ নাজিবকে সরিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাঈল ছয় দিনের যুদ্ধে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে সিনাই উপত্যকা হারায় তেলআবিরের কাছে। ১৯৭০ সালে জামাল আব্দুন নাসেরের মৃত্যুর পর ভাইস প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত মিসরের প্রেসিডেন্ট হন। সোভিয়েত বলয় থেকে বের হয়ে তিনি মিসরকে মার্কিন বলয়ে প্রবেশ করান। ১৯৭৭ সালে তিনি আকস্মিকভাবে ইসরাঈল সফরে যান। ১৯৭৯ সালে ইসরাঈলের দখল করা সিনাই ফেরত পাওয়ার বিনিময়ে ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তি করে প্রথম আরব দেশ হিসেবে ইহুদী রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃত দেন। এজন্য তাকে নোবেল পুরস্কারও দেয়া হয়। ১৯৮১ সালে এক বিক্ষুদ্ধ আততায়ীর হাতে আনোয়ার সাদাত নিহত হন। এরপর দেশটির প্রেসিডেন্ট হন বিমান বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হোসনি মোবারক। তারপর থেকে দীর্ঘ ৩০ বছর তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছিল মিসরীয় সেনাবাহিনী।

কায়রোতে এক পক্ষকালের বিভীষিকা : মিসর মধ্যপ্রাচ্যের প্রেক্ষাপটে এক উন্নত দেশই বলা চলে। নিরাপত্তার দিক দিয়ে মিসরের সুনাম বরাবরই ছিল। কিন্তু ২৫ জানুয়ারী অপরিকল্পিত, অসংগঠিতভাবে ডাক দেয়া বিপ্লবের আহবানে আকস্মিকভাবে মিসরে যা ঘটে গেল তা       অচিন্তনীয়। যারা টিভি চ্যানেলে নজর রাখছিলেন তারা পরিস্থিতি কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছেন। তারপরও মিসরে অবস্থানরত সাংবাদিকদের লেখা ও সাক্ষাৎকার থেকে যা ফুটে উঠেছিল তা হল- সারা কায়রোয় যেন যুদ্ধাবস্থার ন্যায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। গুলি ও আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানী যেন নিত্য পরিচিত হয়ে পড়েছে। রাস্তা ফাঁকা। কোন যানবাহন নেই। চারদিকে পিন-পতন-নীরবতা। জনজীবনের নিত্য কোলাহল হারিয়ে কায়রো যেন আর্তনাদ করে মরছে। হোটেলগুলো অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকছে। পকেটে টাকা থাকলেও কিছু কেনা যাচ্ছে না। যারা আন্দোলন করছেন তারা অনেকেই ছিয়াম রাখছেন। অনেকে আবার একটাই রুটি ভাগাভাগি করে ৫/৭ জন মিলে খাচ্ছে। তারা বলছে আমরা জানি আমরা যদি ঘরে ফিরে যাই তাহলে মোবারকের অনুগত বাহিনী আমাদের শেষ টিকিটা দেখে ছাড়বে। তাই মরতে হলে এখানেই মরব, তবু ঘরে ফিরে যাব না। এই রকম পণ নিয়ে ইতিমধ্যেই সরকারী হিসাব মতে ৩০০ এবং বেসরকারী হিসাব মতে ৫০০ জন মারা গেছে। এদের গণ গায়েবানা জানাযা হয়েছে তাহরীর স্কয়ারে। আহতও হয়েছে কয়েক হাজার। দেশের অনেক জায়গায় পানি, বিদ্যুৎ-এর সংকট। মোবাইল, ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বিদ্রোহীরা ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলায় দূরপাল্লার ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে। দেশের বিমান বন্দরগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে বিশ্ববিখ্যাত আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রয়েছে এবং সেখানে পাঠরত ১২০টি দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য নেয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রাস্তা-ঘাটে চুরি-ডাকাতি ও রাহাজানি হু হু করে বাড়ছে। যখন-তখন যে কেউ লুটপাট, ছিনতাই ও ডাকাতির শিকার হতে পারে এই ভয়ে কেউ বাড়ী থেকে বের হচ্ছে না। সেনাবাহিনী সদস্যরা রাস্তায় রাস্তায় টহল দিলেও তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। মাঝে মাঝে রাস্তায় নেমে আসছে ট্যাংকবহর। সাজোয়া যান এবং আকাশে টহল দিচ্ছে জেট বিমান। এত কিছুর পরও জনগণ বিন্দুমাত্র টলছেনা। তারা এ মর্মে একাট্টা যে, মোবারকের পতন না হওয়া পর্যন্ত তারা তাহরীর স্কয়ার ছাড়বে না। খেয়ে না খেয়ে হাজার হাজার লোক রাত-দিন সেখানেই অবস্থান করছে। সেখানে তাদের রাত্রি যাপন ও ছালাত আদায়ের দৃশ্য মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। অধীর আগ্রহে তারা অপেক্ষায় রয়েছে কখন মোবারক ক্ষমতা ছাড়বে আর নতুন কোন জনমতের সরকার ক্ষমতায় এসে তাদের আশা-আকাংখা পূরণ করবে- এ দৃশ্যই বাস্তব ছিল গত ১৭ দিন সারা মিসরে। এরূপ অগ্নিমুখর পরিবেশে ১০ ফেব্রুয়ারী রাতে প্রেসিডেন্ট হোসনী মুবারক জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন এবং সেখানেই ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দিতে পারেন বলে জোর গুজব উঠে। কিন্তু সকলকে হতাশ করে তিনি ক্ষমতা না ছাড়ার কথা জোরালোভাবে পুনর্ব্যক্ত করলে আবার ক্ষোভে ফেটে পড়ে মিসরবাসী। নতুন করে ডাক দেয়া হয় ২ কোটি লোক জমায়েতের। বিদ্রোহের প্রস্ত্ততি নতুনভাবে শুরু হলে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পরদিনই ১১ই ফেব্রয়ারী রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন থেকে ঘোষণা আসে হোসনী মোবারক সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করে পদত্যাগ করেছেন। এভাবেই মিসরের ৩০ বছরের শাসনকর্তা ক্ষমতাধর এক স্বৈর শাসকের পতনঘণ্টা বেজে যায়।

কেন এই গণবিদ্রোহ : গণঅসন্তোষ থেকেই উৎপত্তি হয় গণবিদ্রোহের। মানুষ স্বভাবতই বৈষম্য সহ্য করে না। কেউ থাকবে পাঁচতলায়, কেউ থাকবে গাছতলায়, কেউ খাবার নষ্ট করবে আর কেউ খেতে পাবে না-এতো হতে পারে না। তিউনিসিয়ার মত মিসরের গণঅসন্তোষেরও সূত্রপাত হয় ধনী-গরীবের এই বৈষম্য ও শিক্ষিত যুবশ্রেণীর বেকারত্ব থেকে। মিসরের মাথা পিছু আয় ২২২০ ডলার যার বড় অংশই আসে তেল, গ্যাস, তুলা, সুয়েজ খাল ও পর্যটন থেকে। বস্ত্রখাতের উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি টেলিযোগাযোগের মত সেবা খাতেরও অবদান রয়েছে মিসরে। অর্থনীতির এই আয়ের উৎসগুলো ক্ষমতাবান রাজনৈতিক এলিটদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ায় দেশটির জনগোষ্ঠির মাঝে দরিদ্রতার ব্যাপকতা লক্ষ্যণীয়। কায়রোর ব্যাপক অংশজুড়েই রয়েছে ডেডসিটি বা মৃতদের শহর। মৃতদের জন্য তৈরী করা এই শহরের কবরগুলোতে বাস করেন হাজার হাজার মিসরী। যাদের এখানে থাকার বিনিময়ে কোন ভাড়া দেয়া লাগেনা। কিন্তু এদের একবেলা খাবার সংগ্রহ করাই কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ এদের অদূরে নীলনদের জলরাশির উপর প্রতিদিন রিভারক্রুজে আয়োজন থাকে ব্যালে নৃত্য অনুষ্ঠানের। দারিদ্র আর বিলাসিতা এভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ায় মিসরে শ্রেণীবৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। এদেশের সরকারী রিপোর্ট অনুযায়ী দারিদ্রতার হার ২০ শতাংশ এবং প্রতি ৩ জনে ১ জন বেকার। যে সব যুবকদের গড় বয়স ১৫- ২৯ বছর, ২০০৯ সালে তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ৩২ শতাংশ। এদের মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক বেশী। অন্যদিকে দীর্ঘদিন একই সরকার ক্ষমতায় থাকায় প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টর দুর্নীতির অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে।

দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত, দুর্নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ ও বেকারত্বের অভিশাপে পিষ্ট তরুণ সমাজের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। তাই এবার তারা গা ঝাড়া দিয়ে আহত ব্যাঘ্রের ন্যায় ক্ষমতাবান শাসকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের এই বিদ্রোহই পরিশেষে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতামঞ্চকে এক চরম ভূমিকম্পে ধূলিস্মাৎ করে দিয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড, আতঙ্কে ইসরাইল : Muslim Brotherhood যার মূল নাম হচ্ছে اخوان المسلمين। আরব ও আফ্রিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল। হোসনি মোবারকের পতনের জন্য যে ২৯টি সংগঠন মিলে `Rainbow coalition’ বা রংধনু কোয়ালিশন গঠন করা হয় তার অন্যতম হচ্ছে Muslem brotherhoad। ১৯২৮ সালে হাসান আল-বান্না দলটির প্রতিষ্ঠাদান করেন। তিনি স্বতন্ত্রভাবে ইসলামের মূল দাওয়াতী কর্মসূচীর পাশাপাশি জনকল্যাণমূলক কর্মসূচীর মাধ্যমে দলটিকে আরব বিশ্বে জনপ্রিয় শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এই দলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দলের দাওয়াত ও জিহাদের বিপ্লবী মন্ত্রে মিসরে যে তুমুল জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তাতে ভীত হয়ে তৎকালীন সরকার ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী হাসান আল-বান্নাকে ফাঁসিতে ঝুলায়। উল্লেখ্য যে, ঠিক সেদিনই রাজশাহীর নওদাপাড়ায় আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কোরায়শী ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণে সেইদিন ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলন্ত বান্নার কণ্ঠই প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। এ যেন এক বান্নার মৃত্যুতে শত বান্নার উত্থান। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালে দলটির পরবর্তী আপোষহীন নেতা সাইয়েদ কুতুবসহ মোট ৬ জনকে ফাঁসি দেয়া হয় এবং দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপরেও দলটির বিপ্লবী কর্মকান্ডে কোন ভাটা পড়েনি যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে। এই যুদ্ধে ইখওয়ানের স্বেচ্ছাসেবকরা প্রশিক্ষিত সৈনিকদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দৃঢ়তা ও বীরত্ব দেখিয়েছে। যা সারা আরবে বাহবা কুড়াতে সক্ষম হয়েছিল। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ১৯৮০ সালের দিকে নেতৃত্বের পরিবর্তনের কারণে দলটি তার প্যান-ইসলামিক আদর্শ থেকে পিছু হটে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দলের সাথে আপোষ করে। দলটির এই আপোষকামী মনোভার এর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। অনমনীয় দৃঢ়তা ও অটল আদর্শ দ্বারা দলটি যে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল সারা আরবে, আপোষকামী হওয়াতে সে জনপ্রিয়তায় অনেক ভাটা পড়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে দলটি তার নিজ আদর্শে অটল থাকলে মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্য একক রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হত। জনগণই তাদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিত।

যাইহোক দলটির জনসমর্থন কমলেও বর্তমান মিসরে এই দলটির চেয়ে সুসংগঠিত কোন দল নেই। গণবিপ্লব শুরু হওয়ার পর দলটি পুনরায় ব্যাপক আলোচনায় এসেছে। বিশেষত চলমান বিদ্রোহকে সুসংগঠিত লক্ষ্যে পরিচালনায় তাদের অবদানই সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নে ইখওয়ানের নামই সবার আগে আসছে। রংধনু কোয়ালিশনের নেতা এল বারাদী যুক্তরাষ্ট্রের এবিসি টিভিতে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইখওয়ানের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বারাদিকে সামনে রেখে ইখওয়ান এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। অন্যদিকে তিউনিসিয়ায় বিদ্রোহে ‘আল-নাহাদ’ নামে যে দলটি নেতৃত্বে ছিল তার আদর্শ ও ইখওয়ানের আদর্শ অভিন্ন। দলটির নেতা রশিদ ঘানৌচা এক সময় ইখওয়ানের সাথে জড়িত ছিলেন।

জর্ডানের প্রধান বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুড সে দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে। জর্ডানের বাদশাহ তার মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিয়েছেন এবং নতুন প্রধানমন্ত্রীকে সংস্কার আনার নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও ব্রাদারহুডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী সংস্কারের উপযুক্ত নন। সুদানের মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা ড: হাসান তুরাবী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দিলে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশীর তাকে আবারও গ্রেফতার করেন।

এদিকে মিসরে মোবারক সরকারের পতনে এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের নবতর উত্থানে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ইসরায়েল। কারণ মিসরের সাথে রয়েছে ইসরায়েলের দীর্ঘ সীমান্ত সংযোগ, রয়েছে মিসরের সাথে গাজার স্থল যোগাযোগের বিখ্যাত রাফা ক্রসিং। এই ক্রসিং দিয়েই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য যা যায়, গাজার ফিলিস্তিনিরা তাই খেয়ে জীবন ধারণ করে। আর যেহেতু মোবারক মার্কা দালাল সরকারের গাদ্দারীতেই মিসর ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইলের সাথে প্রথম মুসলিম দেশ হিসেবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে এজন্য এ রকম সরকার ইসরাঈলের অস্তিত্ব রক্ষার্থে খুবই প্রয়োজন। এসব কারণে ব্রাদারহুড বা তার সমমনা কোন দলের ক্ষমতাগ্রহণ ইসরায়েলের জন্য হবে বড় দুঃসংবাদ। কেননা ইসরায়েলের সাথে যদি সম্পর্কও রাখে তবুও তারা মোবারক সরকারের মত এতটা আনুগত্য হয়ত দেখাবে না।

মিসরের ভবিষ্যৎ : হোসনী মোবারক এই ব্রাদারহুড জুজু দেখিয়েই আমেরিকা-ইসরাঈলসহ অন্যান্য দেশের সমর্থন পেতে চাইছিলেন। তাই গত ৩ ফেব্রয়ারী এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, তিনি পদত্যাগ করলে ইসলামপন্থীরাই লাভবান হবে। একই সাক্ষাৎকারে ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সোলায়মানও বলেন যে, ‘মিসরের জনগণ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সাথে পরিচিত নয়। কিছু ইসলামপন্থী মিসরবাসীকে উস্কানী দিয়ে বিদ্রোহে নামিয়েছে।’ এসব নানা বিবেচনা ও হিসাব কষাকষি করে বিদ্রোহের প্রথমদিকে সঊদী আরব ও আমেরিকা প্রকাশ্যে মোবারকের পক্ষাবলম্বন করে। কিন্তু মিসরের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণকালের ভয়াবহতম এই বিদ্রোহের তীব্রতা দেখার পর তারা সুর পাল্টাতে শুরু করে। মিসরীয় সেনাবাহিনীও শুরু থেকেই জনগণের বিদ্রোহে মৌন সম্মতি জ্ঞাপন করে। এমনকি মিডিয়াতে সৈন্যদের ট্যাংকে চড়ে জনতাকে উল্লাস করতে দেখা গিয়েছিল। ফলে সঠিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মোবারকের পতন ছাড়া আর গত্যন্তর ছিল না। তবে মোবারকের পতনের পর বর্তমানে এই প্রশ্নই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, মোবারকের পতনের পর এখন ক্ষমতার মসনদ কার করতলগত হবে? এখনি কোন আমেরিকা-ইসরাঈল সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, নাকি তিউনিসিয়ার মত রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দিবে? এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে কোন কিছুই বলার উপায় নেই। তবে আমেরিকা ও মিসরীয় সেনাবাহিনী চেয়েছিল মোবারককে সম্মানজনকভাবে বিদায় করতে। এজন্য তারা মোবারককে আরো কিছুদিন সময় দিয়ে আগামী সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের মাধ্যমে বিদায় দিতে চাচ্ছিল। তাদের এই দীর্ঘসূত্রিতার কারণ হচ্ছে এই সময়ের মধ্যে তারা মিডিয়ার মাধ্যমে এমন একজনকে সামনে আনবে যে মোবারকের মত তাদের অনুগত থাকবে। আর এই অঞ্চলে কেউ যদি ক্ষমতায় থাকতে চায় তাহলে তাকে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনীদের সাথে গাঁটছাড়া বেঁধেই থাকতে হয়। এক্ষেত্রেও এমনটি ঘটার সম্ভাবনাই বেশি।

তারপরও অবশ্য বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে যা হচ্ছে এতে আমেরিকার চেয়ে ইরান-তুরস্ক জোনের প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইরান সমর্থিত হিযবুল্লাহ একক চেষ্টায় লেবাননের পশ্চিম সমর্থিত সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন সরকার গঠনের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছে। এক্ষেত্রে আমেরিকার দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া কোন উপায় নেই। মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বিশাল এক আঞ্চলিক পরিমন্ডলে ক্রমবর্ধিঞ্চু গণবিক্ষোভে নিছক বিবৃতিদাতা ও দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে আমেরিকা।

অন্যদিকে সমস্যা হচ্ছে আকস্মিক সংঘটিত এই বিপ্লবের এখন পর্যন্ত কোন নেতাকে পাওয়া যায়নি যার প্রভাব অধিকাংশ জনগণের উপরে রয়েছে বা এমন কোন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলও নেই যারা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেবে। সংগঠিত দল বলতে রয়েছে ঐ ব্রাদারহুডই। তবে ব্রাদারহুডকে যতটা সক্রিয় ও প্রভাবশালী ভাবা হচ্ছে বাস্তবে ততটা না। মিসরের মাত্র ২০ শতাংশ তাদের সমর্থন করে। তাই ব্রিটিশ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক ব্রাদারহুডের ক্ষমতা গ্রহণের সম্ভবনাকে অমূলক বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি এটাকে হোসনী মোবারকের দুর্নীতি ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ, ধনী-গরীব, ধর্মভীরু, ধর্মহীন সকলের সম্মিলিত বিপ্লব হিসেবে দেখছেন। কায়রোর তাহরীর স্কয়ারে সমাবেত জনতার সামনে জুম‘আর ছালাতের ইমাম যে খুৎবা দিয়েছেন তাতেও ইসলামী শাসনতন্ত্র নয় বরং সাধারণ গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথাই স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেছেন। এ থেকে বোঝা যায় মোবারকের স্থলে যিনি ক্ষমতায় আসছেন তিনিও মোবারকের চেয়ে তেমন ভিন্নতর কিছু হবেন না। ফলে গতানুগতিক শাসক পরিবর্তনের দৃশ্যই হয়ত আবার দেখা যাবে আর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নতুন কোন তাজা রক্তের দালাল আসবে দৃশ্যপটে। বিপ্লবীরা আবার ফিরে যাবে নৈমিত্তিক জীবনে, নিপীড়িত জনতার কাতারে।

সবমিলিয়ে যেটি বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ তা হল, মিসরের ঘটনা প্রবাহ দ্রুত একটি পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। রঙ্গমঞ্চে মোবারক, আল-বারাদি, ওমর সোলায়মান, ব্রাদারহুড, মিসরীয় সেনাবাহিনী ও বিপ্লবী জনতা ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র। কিন্তু সকলেই দুর্নিবার এক টানে অজানা কোন এক ক্লাইম্যাক্সের পানে ছুটে চলেছে। শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনাপূর্ণ পট পরিবর্তন দৃশ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে; সমঝোতা না সংঘাত, ব্রাদারহুডের উত্থান না মার্কিনী প্রভাবভুক্ত বলয়ের পুনরাবির্ভাব- আগামী কিছুদিন সারাবিশ্ব তাকিয়ে থাকবে সেদিকেই।

আমেরিকার চেহারা আরেকবার উন্মোচন : মধ্যপ্রাচ্যের এই বিপুল ডামাডোলে বরাবরের মত আমেরিকা সাধুর বেশে বহুল কথিত গণতন্ত্রের বোল নিয়ে হাজির। সারা বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সোল এজেন্ট তারা। কেননা জনগণের মতামতকে নাকি তারাই সবচেয়ে শ্রদ্ধা করে। কথা মিথ্যা নয়। ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্ব তিমুরকে পৃথক করার সময় তাদের কাছে কতিপয় খৃষ্টান অধিবাসীর মতামত ১০নং মহাবিপদ সংকেতের ন্যায় গুরুত্ব পায়। সম্প্রতি খৃষ্টান অধ্যুষিত দক্ষিণ সুদানের জনমত তাদের কাছে বিরাট মূল্য বহন করেছে। কিন্তু হায়! পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের বহু পূর্বকাল থেকে কাশ্মীর, ফিলিস্তীন, মিন্দানাও, ইরিত্রিয়া, ককেশাশ, চেচনিয়া প্রভৃতি স্বাধীনতাকামী মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে একটি গণভোট পর্যন্ত তারা আয়োজন করতে পারেনি। সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ তো বহু দুরস্ত। তাই তো রবার্ট ফিস্ককে বলতে শুনি, ‘আমরা গণতন্ত্রে পরিণত করতে চাই, অথচ করছি উল্টাটা। আমরাই এই সমস্ত স্বৈর শাসকদেরকে টিকিয়ে রেখেছি’।

আসলে আমেরিকার মূল লক্ষ্য, যে কোন মূল্যে নিজের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখা। এই স্বার্থের জন্যই তারা কখনও গণতন্ত্রের বুলি কপচায় আবার সময়ে সুর পাল্টিয়ে নানা কথায় বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। এই সেই গণতন্ত্রপন্থী আমেরিকা যে দেশটি ফিলিস্তিনী নির্বাচনে হামাস বিজয়ী হলেও তাদেরকে সরকার পরিচালনা করতে দেয়নি। আলজেরিয়াতে ইসলামিক স্যালভ্যাশন ফ্রন্ট বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেও পশ্চিমা দেশগুলো সামরিক শাসক আব্দুল আযীয বুতেফলিকাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। তুরস্কেও তারা একই চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয়নি। সম্প্রতি ইরানের বিদ্রোহে ইন্ধন যুগিয়েছে। এভাবেই বিশ্ব মোড়লের ধ্বজাধারী আমেরিকা তার আসল চেহারা নিয়মিত উন্মোচন করে চলেছে।

ফিরে দেখা ও ইতিহাসের শিক্ষা : আজ যে মিসরে মোবারকের গদিতে বিদ্রোহের আগুনে জ্বলেছে এই মিসরেরই এক সময় শাসনকর্তা ছিলেন হযরত ইউসুফ (আঃ)। এখানেই দাপটের সাথে দীর্ঘদিন রাজত্ব পরিচালনা করেছে নিজেকে প্রভূু বলে দাবীকারী ফেরাউন। তারই রাজপ্রাসাদে ও মিসরের আলো-বাতাসে বড় হয়েছেন ঈসা (আঃ)। ফেরাউন কর্তৃক নিহত হাজারো শিশুর রক্ত মিসরের মাটিতে মিশে আছে। এখানেই আছে আছিয়ার ন্যায় ঈমানী পর্বতের শাহাদাত কবুলের স্থান, নদীতে ডুবন্ত ফেরাউন ও বিজিত বনী ইসরাঈল মিসরের ইতিহাসের এক অনবদ্য চিত্রনাট্য। এই মাটিতেই রোমক বাহিনীকে পরাজিত করে ইসলামের বিজয় নিশান উড্ডীন করেন ওমর (রাঃ)-এর সেনাপতি আমর ইবনুল আস (রাঃ)। এই মিসরের মাটি থেকেই পরিচালিত হয়েছিল স্মরণকালের ভয়াবহ যুদ্ধ, ক্রসেডারদের বিরুদ্ধে সালাহুদ্দীনের বজ্র নিনাদ। কিন্তু তারা আজ কেউ বেঁচে নেই। সবাই শুধু কালের সাক্ষী, পৃথিবীর শুরু থেকে মহাকালের যে যাত্রা শুরু হয়েছে তার গর্ভে হারিয়ে গেছে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার দাপট, বিজয়ের উল্লাস ও পরাজয়ের বেদনা। আজকেও যারা ক্ষমতার মোহে মদমত্ত তারাও একদিন হারিয়ে যাবে মহাকালের গর্ভে। এই দুনিয়াতে রাজত্ব এবং ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে- মানবজাতিকে এই শিক্ষাটি দেওয়ার জন্যই আল্লাহ মিসরের বুকে আজও অক্ষত রেখেছেন সাড়ে তিন হাজার বছর আগের ফেরাউনের লাশ। অথচ এই মিসরের শাসকরা পর্যন্ত এখান থেকে শিক্ষা নিল না। আল্লাহ তা‘আলা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন সূরা ইমরানের ২৪ নং আয়াতে-قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘হে নবী আপনি বলে দিন আল্লাহই হচ্ছেন সকল রাজ্যের রাজা। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দাও, যার থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নাও। তুমি যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করো এবং যাকে ইচ্ছা অপমাণিত কর। তোমার হাতেই রয়েছে কল্যাণের চাবিকাঠি। তুমি সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান’। সুতরাং এটাই বাস্তব যিনি জেলখানা থেকে নবীকে মন্ত্রী বানাতে পারেন, যেই আল্লাহ প্রভুত্বের দাবীদার ফেরাউনকে পানিতে ডুবাতে পারেন, তিনি চাইলে মোবারককের স্থলে ব্রাদারহুডকে আনতে পারেন। এখানে জনগণ, সেনাবাহিনী, মার্কিনীরা উপলক্ষ্য মাত্র। আরও এটি কথা না বললেই নয়, তিউনিসিয়া বা মিসরের অভূতপূর্ব, অপ্রত্যাশিত এই ঘটনার ফলাফল আর যাই হোক না কেন, তা আরব জাহানের অন্যান্য বাদশাহদের টনক নড়িয়ে দিয়েছে। আলজেরিয়া ও ইয়েমেনেও একই আকারের বিদ্রোহ শুরু হতে আর দেরী নেই। এসব দেশে বিপ্লবীদের মূল দাবী দারিদ্র্যমুক্তি, বেকারত্ব, সুশাসন-শৃংখলা যদি নাও ফিরে আসে তবুও এই বিপ্লব আরব বাদশাহদের কাছে এক কঠিন সতর্কবার্তা ইতিমধ্যেই পোঁছে দিয়েছে যে, যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় ক্ষমতা অাঁকড়ে থাকা ও নিজ আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশকে শুষে খাওয়ার দিন শেষ হয়ে আসছে। স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ আগের মত আর অবারিত থাকছে না। বিপ্লবের সাফল্য যদি এতটুকুতেই থেমে যায় তবুও তা কম কিসে! সত্যি সত্যিই আরব বাদশাহদের মাঝে এই বোধোদয়ের জন্ম হলে হয়ত মধ্যপ্রাচ্যে আবার এক নতুন যুগের সূচনা ঘটবে। তবে নতুন এক আশংকার কথাও অবশ্য উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতি বিনির্মাণে সহায়তাকারী এক ওয়েবসাইটে সম্প্রতি বলা হয়েছে, আগামী কিছুদিনের মাঝেই আরব বিশ্ব ৪০টি দেশে বিভক্ত হবে। যার শুরু হয়েছে সুদানকে বিভক্তির মাধ্যমে। তাই এসব ঘটনার আড়ালে আমেরিকা-ইসরাঈল আবার নতুন কোন চাল খেলছে না তো! আপাতত সে উত্তর আমাদের জানা নেই। আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে হেফাযত করুন এবং মুসলিম শাসকদেরকে এত্থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও আত্মোপলব্ধির তাওফীক দান করুন। আমীন!!



বিষয়সমূহ: দেশ পরিচিতি
আরও