সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)
ইরফানুল ইসলাম
ড. নূরুল ইসলাম 9635 বার পঠিত
লেখকের জীবনী :
ড. আবূ আমিনা বিলাল ফিলিপস ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেশ জ্যামাইকার কিংস্টন নগরীতে
এক খৃষ্টান যাজক পরিবারে ১৯৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে
তাঁর নাম ছিল ডেনিস ব্রেডলি ফিলিপস। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি তাঁর পরিবারের
সাথে কানাডায় চলে আসেন। কানাডা থেকে বিলাল ফিলিপসের পরিবার মালয়েশিয়ায়
স্থানান্তরিত হলে তিনি এই প্রথম মুসলিম সমাজের সংস্পর্শে আসার সুযোগ লাভ
করেন। সেখানে গান-বাদ্যের সাথে জড়িয়ে পড়লে বাবা-মা সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা
করে তাঁকে কানাডার সিমন ফ্রেশিয়ার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করে দেন। এ
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে
পড়েন। সমাজতন্ত্রের পাঁড় সমর্থক হিসেবে এটিকে মানবজাতির মুক্তির উপায়
হিসেবে ভাবতে থাকেন। কিন্তু ক্রমেই তার কল্পনা জগতে আমূল পরিবর্তন সাধিত
হতে লাগল। তাঁর কাছে মনে হল, সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের কোন নৈতিক ভিত্তি
নেই। এরপর ক্রমেই তিনি ইসলাম সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে থাকেন। বিলাল ফিলিপস
বলেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমদের একটি উপাসনালয় পরিদর্শনে যাওয়ার পর তাদের সংগঠন
ও নারীদের পোশাক-পরিচ্ছদ পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে এতই দাগ কাটে যে, আমার
নিকটে আমাদের নিজেদের তথাকথিত আদর্শবাদকে বড়ই ভিত্তিহীন বলে মনে হল’।
চীনের এক কমিউনিস্ট নেত্রী ইসলাম গ্রহণ করলে বিলাল ফিলিপস তাঁর ইসলাম গ্রহণের বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন। তাকে কোন জিনিস এতে উদ্বুদ্ধ করেছিল- তা জানার জন্য তিনি ইসলাম ধর্ম বিষয়ক বই-পত্র অধ্যয়ন করতে মনস্থ করেন। ইত্যবসরে ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং বিলালকে মুহাম্মাদ আসাদ রচিত Islam : The Misunderstood Religion গ্রন্থটি পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এটি এবং Towards Understanding Islam গ্রন্থটি তাঁকে ইসলামের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। প্রথম বইটি পড়ে তিনি অনুধাবন করতে সক্ষম হলেন যে, মানব সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ইসলামই সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান। সে সময় সূরা রা‘দের ১১নং আয়াতটিও তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ততক্ষণ কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে’। অবশেষে তিনি সব দ্বিধাদ্বন্দ্বের চাদর ছুঁড়ে ফেলে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারীতে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এরপর তিনি টরেন্টোতে গিয়ে কুরআন তেলাওয়াত শিখেন।
১৯৭৩ সালে তিনি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। প্রথম দু’বছর তিনি ভাষা ইনস্টিটিউটে আরবী ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিসান্স ডিগ্রি অর্জন করে মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য রিয়াদের কিং সঊদ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। ১৯৮৫ সালে তিনি ইসলামী আক্বীদায় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। সঊদীতে অবস্থানকালীন তিনি মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। উপসাগরীয় যুদ্ধ চলাকালে আমেরিকান সৈন্যদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ দূরীকরণে দাওয়াতী প্রোগ্রাম আঞ্জাম দেন। তাঁর প্রচেষ্টায় তিন হাযারের অধিক আমেরিকান সৈন্য ইসলাম গ্রহণ করেছিল। আমেরিকান সৈন্যবাহিনীর নও মুসলিমদের ছালাত আদায়ের জন্য ইমাম নিয়োগের ব্যাপারে তিনি কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। সঊদী আরব থেকে তিনি ফিলিপাইনে সফর করেন। মিন্দানাও দ্বীপে শিক্ষার ইসলামীকরণ বিষয়ে তাঁর বক্তৃতার ফলশ্রুতিতে Sharif Kabunsuan Islamic University প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে তিনি তিন বছর অধ্যাপনা করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি ওয়েলস ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলামী ধর্মতত্ত্বে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি আরব আমিরাতের কারামা নগরীতে ‘ইসলামিক ইনফরমেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সেন্টারের প্রচেষ্টায় অনেক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। ১৯৯৪ সালে তার বাবা-মাও ইসলাম গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে তিনি অনলাইন ইসলামিক ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ডা. জাকির নায়েকের পীস টিভির অন্যতম আলোচক।
তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- The Foundation of Islamic Culture, The Purpose of Creation, The True Religion of God, Seven Habits of Truly Successful People, The Moral Foundation of Islamic Civilizations. তাঁর রচিত The Fundamentals of Tawheed গ্রন্থটি ‘তাওহীদের মূল সূত্রাবলী’ শিরোনামে সম্প্রতি বাংলা ভাষায় কয়েকটি প্রকাশনী থেকে অনূদিত হয়েছে। নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ এই বইটির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা পেশ করা হল।
ইসলামী জীবনব্যবস্থায় তাওহীদের গুরুত্ব সর্বাধিক। তাওহীদের স্বীকৃতি দান ও তাওহীদের দাবীকে প্রতিষ্ঠাদানের জন্যই আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন অসংখ্য নবী ও রাসূল। আল্লাহকে একক ও সার্বভৌম স্রষ্টা বলে স্বীকার করা এবং ইবাদত ও আমলে একমাত্র তাঁর প্রদত্ত শরী‘আতের অনুসরণ করাই তাওহীদের মূলকথা বা সারনির্যাস। তাওহীদের বিপরীত বিষয়টি হল শিরক; যা থেকে উৎপন্ন হয় আল্লাহকে একক স্রষ্টা হিসাবে স্বীকার না করা বা তাঁর শরী‘আতকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ না করা প্রভৃতি গর্হিত অপরাধ। এজন্য তাওহীদ প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে তাওহীদের প্রতিবন্ধক তথা শিরকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনাও ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য। অথচ শয়তানের খপ্পরে পড়ে ও পারিপার্শ্বিক প্রভাবে খোদ মুসলিমরাই জ্ঞাতসারে বা অবচেতনভাবে শিরকের মতো ভয়াবহ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে অবলীলায়। সেকারণ তাওহীদের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করানোর জন্য আরবীসহ বিভিন্ন ভাষায় বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। আবার যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শিরকের নিত্য-নতুন আকৃতি-প্রকৃতির উদ্ভাবন ঘটায় এ বিষয়ক বইও নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে রচনা করতে হয়েছে। এমনই একটি বই ড. ফিলিপসের The Fundamentals of Tawheed গ্রন্থটি। ইবনু আবিল ইযয হানাফীর ‘শারহুল আক্বীদা আত-তাহাবিয়াহ’ অবলম্বনে রচিত এই গ্রন্থটি ইসলামের সাথে অন্যান্য ধর্মীয়, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মতবাদগুলোর মৌলিক বিরোধস্থল থেকে একটি চমকপ্রদ পর্যবেক্ষণমূলক রচনা। তাওহীদ বিষয়ক এরূপ বিশ্লেষণাত্মক গ্রন্থ ইংরেজী ভাষায়তো বটেই আরবীসহ অন্যান্য ভাষাতেও সুলভ নয়।
১২টি অধ্যায়ে বিভক্ত পুস্তিকাটির ভূমিকায় মু‘তাযিলা সম্প্রদায়, সূফী পন্ডিত ইবনুল আরাবী (১১৬৫-১২৪০ খৃঃ) প্রমুখ ব্যক্তি ও বিভ্রান্ত খারেজী ফেরকাসমূহের উদাহরণ টেনে লেখক খোদ মুসলমানদের মধ্যেই যে তাওহীদের ব্যাপারে সঠিক ধারণার প্রচুর অভাব রয়েছে তা স্পষ্ট করেছেন। তাঁর মতে, পৃথিবীর তাবৎ ঈশ্বরবাদী ধর্ম থেকে ইসলামের তাওহীদী দর্শনের যে পার্থক্য তা-ই ইসলামকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করেছে। যদি তাওহীদ কারো মাঝে সুপ্রতিষ্ঠিত না থাকে তাহলে তার যাবতীয় ইবাদত নিছক পৌত্তলিক ধর্মীয় আচারে পরিণত হয়। আর তাই ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য যারা ষড়যন্ত্র করেছে তারা প্রধানত ইসলামের তাওহীদী তত্ত্বকে নিষ্ক্রিয় করার প্রয়াস চালিয়েছে। যাতে মানুষ নিজের অজান্তে আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো উপাসনা করে এই ভেবে যে, তারা মূলত আল্লাহরই ইবাদত করছে। এসমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে লেখক বইটি রচনায় প্রবৃত্ত হন। তিনি নিজে প্রাক্তন অমুসলিম হওয়ায় তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা যে বইটির পরিপুষ্টি সাধনে বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছে তা বলাই বাহুল্য।
প্রথম অধ্যায়ে তাওহীদের অর্থ ও তিনটি প্রকারের নাতিদীর্ঘ অথচ খুব সহজভাবে বোধগম্য আলোচনা করেছেন। বাইবেল ও শী‘আদের বিভিন্ন গ্রন্থের উদ্ধৃতি তুলে ধরে তিনি তাওহীদ সম্পর্কে বিভ্রান্তির আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণসমূহ উদ্ঘাটনের প্রয়াস চালিয়েছেন। ক্ষেত্র বিশেষে নিজের বক্তব্য তুলে ধরে তাওহীদী দর্শনের সমসাময়িক প্রয়োগে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তাওহীদে ইবাদাত সম্পর্কিত আলোচনাতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘তাওহীদে ইবাদাতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হল শরী‘আহ বাস্তবায়ন। শরী‘আহ্ ভিত্তিক আইনের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ আইন বাস্তবায়ন নিশ্চয়ই আল্লাহর আইনের প্রতি অবিশ্বাস এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করার পর্যায়ে পড়ে। এরূপ বিশ্বাস আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের উপাসনা করার নামান্তর তথা শিরক। যদি শরী‘আহ বাস্তবায়নের ক্ষমতা না থাকে তবে তা বাস্তবায়নের জন্য সোচ্চার কণ্ঠ থাকা উচিৎ। যদি এটাও না সম্ভব হয় তবে কমপক্ষে অনৈসলামিক সরকারকে আন্তরিকভাবে ঘৃণা ও অবজ্ঞা করতে হবে’।
২য় অধ্যায়ে তাওহীদের বিপরীত তথা শিরক সম্পর্কে এক মনোজ্ঞ আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে। তাঁর মতে, শিরক জঘন্যতম পাপ হওয়ার কারণ হল, শিরক মানব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যকেই অস্বীকার করে। পুরো অধ্যায়ে শিরকের নানা খুঁটিনাটি বিষয় প্রাচীন ও চলমান বিশ্বের নানা ঈশ্বরবাদী, নিরীশ্বরবাদীদের ধর্ম-দর্শন এবং উপজাতীয়দের নানা আচার-বিশ্বাসের আয়নায় উপস্থাপন করে তিনি এক তথ্যবহুল আলোচনার সমাবেশ ঘটিয়েছেন। স্পষ্টভাবে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সূফী ও শী‘আ মতাবলম্বীরা ইসলামের দাবী নিয়েও শিরকের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেখিয়েছেন কীভাবে মেইনল্যান্ডার, নিট্শে, জ্য পল সার্ত্রের মত বিখ্যাত দার্শনিকরা, ডারউইন, আইনস্টাইনের মত বৈজ্ঞানিকরা যুক্তি ও পান্ডিত্যের বাতাবরণে মানুষকে শিরকের আবর্জনায় প্রতিনিয়ত নিক্ষেপ করে চলেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘আইনস্টাইনের বহুল পঠিত আপেক্ষিক তত্ত্ব (E=mc2, শক্তি সমান ভর গুণন আলোর গতির বর্গফল) প্রকৃতপক্ষে তাওহীদে আসমা ওয়াস সিফাতের অন্তর্ভুক্ত শিরকের অভিব্যক্তি। কেননা এ তত্ত্ব মতে, পদার্থ ও শক্তি চিরন্তন। এর কোন আদি ও অন্ত নেই। অথচ এ গুণটি কেবলমাত্র আল্লাহর।
৩য় অধ্যায়ে বারযাখ, প্রাকসৃষ্টি, ফিতরাত, মানুষের কাছে আল্লাহর অঙ্গীকার প্রভৃতি বিষয়ে সঠিক তাওহীদী আক্বীদা উল্লেখ করত এসকল বিষয়ে যেসব শিরকী কুসংস্কার ও বিশ্বাসের প্রচলন রয়েছে তার বিবরণ দিয়েছেন। যে সকল মুসলমান না জেনে না বুঝে নিতান্ত মূর্খের মত শিরকী কাজকে ভাল কাজ বলে মনে করে তাদের প্রতি সক্ষেদে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে ড. ফিলিপস বলেন, ‘তারা কি শুধু ঘটনাচক্রে মুসলমান নাকি পছন্দের দ্বারা মুসলমান? ইসলাম কি তাই যা তাদের পিতামাতা, গোষ্ঠী, দেশ অথবা জাতি যা করেছিল? নাকি ইসলাম তাই যা কোরআন শিক্ষা দেয় এবং রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবাগণ যা করেছিলেন?’।
৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম অধ্যায়ে
যাদু, যাদুমন্ত্র, শুভ-অশুভ আলামত, ভাগ্য গণনা, জ্যোতিষশাস্ত্র, রাশিচক্র
এবং এসবের প্রাচীন-আধুনিক সব সংস্করণ ইত্যাদি হাজারো কল্পনাপ্রসূত
ধ্যান-ধারণা, কুসংস্কার ও জাহেলী চিন্তাধারা সম্পর্কে লেখক বিস্তারিত
আলোচনা করেছেন যা একজন মুসলিমের জন্য জানা অপরিহার্য। তিনি বলেন, এ সকল
চিন্তা শিরকযুক্ত হওয়ার কারণ হল এগুলো তাওহীদে আসমা ওয়াস সিফাত (আল্লাহর
গুণাবলীতে একত্ববাদ)-এর ভিত্তি গুড়িয়ে দেয়। কেননা এসব প্রথা- (১) ইবাদতের
প্রক্রিয়া অর্থাৎ যাকে তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর নির্ভরতা) বলা হয় তা আল্লাহ
ব্যতীত অন্য কারো দিকে পরিচালিত করে এবং (২) ভালো-মন্দ আগমনের
ভবিষ্যদ্বাণী করা এবং আল্লাহ প্রদত্ত তাক্বদীর এড়ানোর ক্ষমতা মানুষের বা
অন্য কোন সৃষ্টিজীবের উপর অর্পণ করে। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এসব প্রথার
নানাবিধ আকৃতি-প্রকৃতি দেখা গেলেও সবগুলোর উৎপত্তিস্থল একই গোড়ায় মূলীভূত
যার নাম শিরক। বিশ্বাসের গভীরতম প্রদেশে যখন শিরকের এই শিকড় গজিয়ে ওঠে তখন
আল্লাহর এককত্বে বিশ্বাস ক্রমান্বয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। শয়তানী ও পাশবিক
শক্তির তান্ডবে সেখান থেকে ঈমানের আলো হয়ে পড়ে অপসৃত। এজন্য যে কোন মূল্যে
শিরকের যাবতীয় উপলক্ষ্য থেকে আত্মরক্ষা করা একজন প্রকৃত মুসলিমের জন্য
অপরিহার্য
কর্তব্য
৮ম অধ্যায়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাববুল আলামীনের পরিচয় সম্পর্কে মানব সমাজে বিদ্যমান কতিপয় বিভ্রান্তি নিয়ে লেখক এক দলীলসমৃদ্ধ ও যুক্তিপূর্ণ আলোচনার অবতারণা করেছেন। মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি ভ্রান্ত ধারণা হল- ‘আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান’ (ওয়াহদাতুল উজূদ)। যা মূলত ব্রহ্মা সর্বত্র বিরাজমান- এই হিন্দু মতবাদ থেকে শুরু হয়। পরে তা খৃষ্টীয় বিশ্বাসে আশ্রয় লাভ করে ভারতবর্ষ, পারস্য ও গ্রীক অঞ্চল পর্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। যা পরবর্তীতে সূফী মরমীগোষ্ঠীর মাধ্যমে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করে। তাওহীদে আসমা ওয়াস সিফাতকে ক্ষুণ্ণকারী এই বিশ্বাসের মাধ্যমে আকাশ-যমীনের যাবতীয় কিছুকে আল্লাহর অংশ কল্পনা করে জঘন্যতম শিরকে লিপ্ত হয়েছে পথহারা মানুষ। আল্লাহর অসীমত্ব সাব্যস্ত করতে যেয়ে আকারহীন, নির্গুণ, নিশ্চল সত্তায় পরিণত করে সৃষ্টির মাঝেই তাঁর বহিঃপ্রকাশ সাব্যস্ত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। লেখক এ ব্যাপারে বিস্তারিত দলীলাদি পেশ করার পর উপসংহার টেনেছেন এই বলে- আল্লাহর সঠিক পরিচয় হল তিনি (১) তাঁর সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। (২) কোন সৃষ্টি তাঁকে বেষ্টন করে নেই বা তাঁর ঊর্ধেব বিরাজমান নেই। (৩) আল্লাহ সকল বস্ত্তর ঊর্ধেব।
৯ম অধ্যায়ে আল্লাহর দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহকে কোন দৃশ্যমান আকৃতিতে এই পার্থিব জীবনে দেখা সম্ভব নয়। তাই বিভিন্ন ধর্মে স্রষ্টার প্রতিকৃতি নির্মাণের প্রথা নিতান্তই জাহেলিয়াত। পরকালীন জীবনেই কেবল মুমিন বান্দাদের পক্ষে আল্লাহর সাক্ষাৎলাভ সম্ভব- এটাই এই অধ্যায়ের মূল প্রতিপাদ্য। এর কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পৃথিবীতেই যদি আল্লাহকে দেখা সম্ভব হত তাহলে এই জীবনের পরীক্ষা অর্থহীন হয়ে যেত। আল্লাহর মানবদৃষ্টির অন্তরালে থেকে কেবল তার বিশ্বাসের মাঝেই অবস্থান করে তার পরীক্ষা নিতে চান। সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিরাজের রজনীতেও স্বচক্ষে আল্লাহকে দেখতে সক্ষম হননি।
১০ম ও ১১শ’ অধ্যায়ে ওলী-আওলিয়া, পীরবাদ ও কবরপূজা সম্পর্কে এক মনোজ্ঞ আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিটি প্রসঙ্গে সূক্ষ্ম, যুক্তিপূর্ণ ও তথ্যবহুল আলোচনার মধ্য দিয়ে পাঠককে তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য করেছেন যে, এগুলো এমন সব শিরকী মতবাদ ও ধর্মাচার, যা গ্রীক ও পৌরাণিক মরমী সাধকদের দ্বারা তৈরী হয়ে সূফীবাদী গোষ্ঠীর মাধ্যমে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে। ইসলামে এসব দর্শন চরমভাবে অগ্রহণযোগ্য ও ভিত্তিহীন। গাউছ, কুতুব, আবদাল প্রভৃতি পরিভাষা খৃষ্ট ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী থেকে গৃহীত হয়েছে। তাসবীহ জপ করা খৃষ্টীয় জপমালা থেকে এবং মীলাদুন্নবী খৃষ্টানদের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘ক্রিসমাস’ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের ‘নির্বাণ’ থেকে ফানা ফিল্লাহ দর্শনের উৎপত্তি। খৃষ্টসমাজের নিওপ্লাটনিক দর্শন থেকে সংসারবিরাগী পীরবাদের উৎপত্তি। সূফীদের খানকাগুলোর সাদৃশ্য পাওয়া যায় খৃষ্টান সাধুদের আশ্রম থেকে। পীর, সাধু, গুরু ও তাদের অলৌকিক ক্ষমতা- এ সবই একই দর্শনের অনুসারী বৈরাগী মানুষের মুসলিম, খৃষ্টান ও হিন্দু নাম। মাযার, তীর্থস্থান ও সেখানে প্রার্থনা করার পদ্ধতি সবকিছুতেই রয়েছে অভিন্ন মিল। যদিও ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন। এভাবেই শিরকে একাকার হয়ে গেছে অন্যান্য ধর্মের লোকদের সাথে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বড় একটা অংশও। যারা নামে মুসলিম হলেও পরিস্কাররূপে মুশরিক।
উপসংহারে তিনি মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য যে আল্লাহর ইবাদত তথা তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা- সে সম্পর্কে আলোকপাত করে তাওহীদের জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য আবশ্যক বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, এজন্য আমাদের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা, পরিবার ও সমাজের সাথে আবেগপূর্ণ বন্ধনকে একপাশে রেখে নির্ভেজাল তাওহীদ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন করতে হবে আর মৌলিক দু’টি শর্ত পূরণ করতে হবে-(১) একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই সকল কাজ করা ও (২) রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত মোতাবেক তা পালন করা। আম্বিয়ায়ে কেরাম যে ইসলাম প্রচার করেছিলেন তা কোন আবেগতাড়িত তত্ত্ব ছিল না; বরং তা ছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে নিরংকুশ আত্মসমর্পণের এক নিরবচ্ছিন্ন পরিকল্পনা। নিছক আবেগীয় নিষ্ক্রমণ আর আপেক্ষিক কিছু উপমায় নির্ভর করে কোন প্রকৃত মুমিন এই পরিকল্পনার বিপরীত কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যদি কেউ নেয় তবে সে যত বড় ঈমানের ঘোষণাদাতা হোক না কেন প্রকৃতপক্ষে তার এবং একজন মূর্তিপূজকের মাঝে মৌলিক কোন ফারাক নেই।
তাওহীদ ও শিরকের খুঁটিনাটি দিকগুলো ভিন্ন আঙ্গিকে জানার জন্য বইটি পাঠকের জন্য খুব উপযোগী হতে পারে। বিশেষত লেখক জনাব বিলাল ফিলিপ্স নিজে অমুসলিম পরিমন্ডল থেকে আসায় এবং নানা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়ায় বইটিতে তাঁর বিশ্লেষণ অনেক ধারালো হয়েছে। ফলে আধুনিক প্রেক্ষাপটে শিরকের কারণ ও উপলক্ষগুলো চিহ্নিত করা পাঠকের জন্য অনেকটা সহজ হবে। সাথে সাথে তাওহীদের মূল দিকটি স্বচ্ছ-সরলভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। ড. মানে আল-জুহানী বইটি সম্পর্কে বলেন, ‘আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে এ বইটি একটি বিশেষ গবেষণামূলক উপস্থাপনা এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদানও বটে। ফলত, মানব জীবনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বিষয়াদি সম্পর্কে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে আমি প্রতিটি মুসলিমের জন্য এ বইটি অবশ্য পাঠ্য বলে মনে করি। উপরন্তু, যে সব অমুসলিম পাঠক ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহর একত্ববাদকে জানতে আগ্রহী তাদেরও প্রয়োজন পূরণ করবে বলে আশা রাখি’। সর্বোপরি অনুবাদক আবু হেনা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন লেখকের উপস্থাপনা ধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে।