আমি ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
মেহেদী আরীফ 1133 বার পঠিত
[স্পিনোজা রোমো নামের সদ্য কৈশরোত্তীর্ণ এই কলম্বিয়ান স্কুলছাত্রী ইসলাম গ্রহণ করেছেন গত ২৭ই জুন ২০০১। ইসলাম গ্রহণের অপরাধে তাকে বাড়ি-ঘর ছাড়া হতে হয়। কিছুদিন চাচার বাড়িতে অবস্থানের পর এ বছর জানুয়ারী মাসে অসুস্থ হয়ে পড়লে তার পরিবার তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। নিম্নে তার লিখিত ইসলাম গ্রহণের কাহিনী সংক্ষেপায়িতভাবে অনূদিত হল]
১. কলম্বিয়ার কালি শহরের এক ক্যাথলিক খৃষ্টান পরিবারে আমার জন্ম। ধার্মিক পরিবেশে বেড়ে উঠা সত্ত্বেও ক্যাথলিকদের পৌত্তলিক ধাঁচের পূজা-অর্চনা আমাকে সবসময়ই অপ্রতিভ করে রাখত। সবসময় আমার ভাবনায় এটা ছিল যে, উপাসনার এ পদ্ধতিতে কোথাও ভুল রয়েছে। অতঃপর একদিন আমি প্রটেস্ট্যান্ট খৃষ্টানদের এক গীর্জায় গেলাম। সেখানে আমি বেশ স্বস্তি বোধ করলাম। কেননা তারা ছবির পূজা করে না। ছবির ব্যাপারে পূর্ব থেকেই আমার এ সংশয় অক্ষুণ্ণ ছিল যে, ‘এরা তো কিছুই শোনে না বোঝে না’। যা হোক আমি প্রটেস্ট্যান্ট উপাসনারীতিতে সন্তুষ্ট হলাম। যদিও আমি তাদের হাতে ব্যাপটাইজ্ড হইনি। আমি তাদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখতাম। সেজন্য আমার প্রটেস্ট্যান্ট বন্ধুরা আমার বাড়িতে আসত এবং অনুযোগ করত যে, আমি যিশুর চার্চ থেকে দূরে থাকি কেন? আমি তাদের সাথে না যাওয়ার জন্য বিভিন্ন ওজর-আপত্তি দেখাতাম। কেননা আমি তাদের বিশ্বাসের যথার্থতা নিয়ে সন্দিগ্ধ ছিলাম। কেননা তারা বারবার ‘হলি স্পিরিট’ (পবিত্র আত্মা)-এর নাম করত যা নাকি খৃষ্টবিশ্বাসী আত্মায় মিশে থাকে। এ বিশ্বাসটি আমার কাছে অলৌকিক মনে হল। তাই তাদের কাছ থেকে দূরে থাকাটাই ভাল মনে করলাম। অন্যদিকে আমার প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় রীতির অনুসারী হওয়াকে আমার পরিবার মোটেও গ্রহণ করেনি। তাই আমি যখন তাদেরকে পরিত্যাগ করলাম তখন আমার পরিবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
২. অতঃপর আমি আবার গভীরভাবে ভাবা শুরু করলাম ঐ বিষয়ে যা আমি ইতিপূর্বে খুঁজে ফিরছিলাম। কেননা আমি সারাজীবনই ক্যাথলিক গীর্জার কর্মকান্ডে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি, তারপর একটি বছর প্রটেস্ট্যান্ট রীতিতে এসে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পেলাম; কিন্তুু অচিরেই আবার অপূর্ণতার মুখোমুখি দাঁড়ালাম। আমি বুঝতে পারি না কেন যেই মাত্র আমি আমার প্রটেস্ট্যান্ট বন্ধুদের সাথে খুব সুখী বোধ করছিলাম, তখনই হঠাৎ একই অনুভূতি হাজির হল যা আমার ক্যাথলিক পরিবেশে থাকা অবস্থায় বর্তমান ছিল। কেন এরূপ হচ্ছে যদি সবই ঠিক থাকে? আমি যেন নিঃশেষিত হয়ে গেলাম। তারপরও ঈশ্বরের আরাধনা ও বিশ্বাসের মৌলিক বিষয় জানা ব্যতিরিকেই আমি নিজের ভিতরে তাঁকে বিশ্বাসের বাধ্যবাধকতা অনুভব করলাম।
৩. আমি একদিন ইন্টারনেটের এক সামাজিক সাইটে একটি এ্যাকাউন্ট খুললাম। সেখানে আমার অবস্থান লিখলাম ‘চীন’। ফলে শীঘ্রই চীনারা আমাকে এ্যাড করা শুরু করল। তারা ছিল সুন্দর মনের মানুষ। কিন্তু তারা অধিকাংশই ছিল বৌদ্ধ। পূর্বেই আমার জানা ছিল যে তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, কাজেই তারা সবকিছু আরও দুর্বোধ্য করে তুলল। হা-হা-হা...। বিরক্ত হয়ে আমি এ্যাকাউন্ট চেক করা বন্ধ করে দিলাম। একদিন কি মনে করে এ্যাকাউন্ট চেক করতে যেয়ে এক মেয়ের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখলাম। যার নাম ছিল ‘হালা’ যা কাকতালীয়ভাবে আমার নামের (আউরা) আরবী অনুবাদ। সে ছিল ১৪ বছরের এক মুসলিম বালিকা। আমি ততদিন ১৫ পার করেছি। আমি ভাবলাম, হোক না সে মুসলিম, সে তো কমপক্ষে একজন মানুষ (যেহেতু মিডিয়ায় আমি ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে সবসময়ই খারাপ সংবাদ পেতাম। তাতে ইসলামের সঠিক তথ্যও প্রকাশিত হত না। তাই মুসলমানদের সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখতাম না)। যা হোক তার রিকুয়েস্ট কনফার্ম করলাম। অতঃপর সে আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা দিল। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। পরে তার বোন সারাও আমাকে এ্যাড করে নিল এবং আরো ভালভাবে ইসলাম সম্পর্কে বুঝাল। কিন্তু তাতেও আমার ভিতর থেকে সন্দেহ দূর হল না। আমার মনে হল এটা খৃষ্টান ধর্ম থেকে পৃথক তেমন কিছু নয়। কেননা খৃষ্টানরাও বিশ্বাস করে যীশুখৃষ্টই পরকালীন মুক্তি লাভের একমাত্র পথ।
৪. আমি মুসলিমদের সাথে আরও কথা বলতে চাইলাম। যাতে জ্ঞানের উৎসসমূহের কাছাকাছি হতে পারি। তিউনিসিয়ার ফাতিমা নাম্নী এক মেয়ে আমাকে এ্যাড করেছিল। সে ছিল ফেসবুকে ইসলাম বিষয়ক একটি ফ্যান পেজের এডমিন। তার সাথে পরিচয় ইসলাম সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে আমার জন্য খুব সহায়ক হয়েছিল। আমার একবছর লেগেছিল পূর্ণভাবে জানতে যে, যীশুখৃষ্ট ক্রসবিদ্ধ হয়ে মারা যাননি। এটা নিশ্চিত হওয়ার পর আমি বিষয়টি আরো যুক্তি দিয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম। যেমন-
মোটা দাগে আমি বলতে চাই, আমরা এ্যান্টি ক্রাইস্ট বা যীশুবিরোধী নই বরং আমরা তারাই যারা যীশুর প্রকৃত পরিচয় জানে।
অবশেষে মুসলিম বন্ধুদের সাথে কথা বলে আমি লক্ষ্য করেছিলাম, একজন নারী ইসলামে কত গুরুত্বপূর্ণ। আমি এ ব্যাপারে আগে যা শুনেছিলাম সবই মিথ্যা গাল-গল্প। যেমন- মুসলিম নারীদের কোন অধিকার নেই, মুসলিম পুরুষরা বহু স্ত্রী রাখে, তারা স্ত্রীকে মারধর করার অধিকার রাখে, মুসলিম নারী কথা বলতে পারে না, স্বামীর কাছে ডিভোর্স চাইতে পারে না...ইত্যাদি। যে সব লোক এসব প্রচার করে তারা প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ও মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সুন্নাতের ব্যাপারে ১% ধারণাও রাখে না। অতঃপর আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম সচেতনভাবেই, প্রায় দুই বছর যাবৎ এ সুন্দর ধর্ম সম্পর্কে অধ্যয়নের পর।
৫. ইতিপূর্বে আমার পরিবার আমার উপর বিরক্ত ছিল প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় রীতি গ্রহণ করার কারণে। আর এখন তারা ক্রোধের সমুদ্রে ভাসছে আমি ইসলাম গ্রহণ করায়...হাহা। এর কারণ হল ইসলাম সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের স্বততা। আমি আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই যে, তিনি আমার প্রতি দয়া প্রদর্শন করেছেন এবং তাকে আরাধনার সঠিক পথ দেখিয়েছেন। তিনি জন্মিত নন বা কেউ তাকে জন্ম দেয়নি। তিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং সর্বজ্ঞ। তার কোন ত্রয়ীর প্রয়োজন নেই। কেননা তিনি তার আপন অস্তিত্বে অদ্বিতীয়। আমাদের প্রত্যক্ষ, অপ্রত্যক্ষ সকল কিছুকেই তিনি সৃষ্টি করেছেন। আমি দুই বছর আগে যখন ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করি, তখন আমার পরিবার ও আমার বন্ধুরা এটাকে নিতান্তই ছেলেমানুষী কৌতুহল বলে মনে করত। তারা কৌতুক করে আমাকে জিজ্ঞাসা করত- বলত কিভাবে বোমা তৈরী করতে হয়? ইত্যাদি নানা বাজে মন্তব্য। অতঃপর যখন আমি সত্যিই ইসলাম গ্রহণ করলাম তখন তারা আমার উপর চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তারা বুঝতেই চাইল না আমার এ কাজ মোটেও কৌতুক নয় এটা বাস্তব। অতঃপর আমি সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম যখন ডিসেম্বর মাসে আমার পিতা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন এবং আমাকে চাচার বাড়িতে যেয়ে আশ্রয় নিতে হল। এ বছর ৩১ জানুয়ারী আমি আবার বাড়ি ফিরতে পেরেছি আমার অসুস্থতার কারণে। আলহামদুলিল্লাহ।
এবার খৃষ্টধর্ম সম্পর্কে আমার কিছু বক্তব্য : খৃষ্টানরা বিশ্বাস করে যে, প্রাণীরা সবসময় একইরূপ ছিল। এ সকল প্রাণী ছাড়া আর কোন প্রাণের অস্তিত্ব কোথাও নেই। এখন ডাইনোসর, এলিয়েনদের ব্যাখ্যা তারা কি দেবে? অপরদিকে এ ব্যাপারে কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য যে, আল্লাহর এমনও জিনিস সৃষ্টি করেছেন যেসব সম্পর্কে আমাদের সামান্যতম জ্ঞানও নেই। আর তিনি দৃশ্যমান, অদৃশ্য সকল কিছুরই স্রষ্টা। সুতরাং খৃষ্টানদের মৌলিক বিষয়ের দিকে নজর দিয়ে অযথা ধারণা করা থেকে বিরত থাকা উচিৎ। আর সত্যের মোকাবিলা করা উচিৎ যেভাবে আমি করেছি। এটা আক্রমণ নয়। হ্যা মানুষ হিসাবে আমরা ত্রুটিহীন নই। কিন্তু আমরা অনেক উঁচুতে উত্তীর্ণ হই যখন আমরা সত্যের মোকাবিলা করি।
খৃষ্টান অর্থ যীশুখৃষ্টের অনুসারী। এটা একটা মতবাদ যা মানুষের নিজেদের সুবিধা মত তৈরী করে নেয়া। কিন্তু মুসলিম অর্থ ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণকারী এবং ইসলাম অর্থ ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ। আমরা সঠিক পথেই ঈশ্বরের উপাসনা করি। ঈসা (আঃ) যেমন এসেছিলেন তাওরাতের ব্যাখ্যা করার জন্য, মুহাম্মাদ (ছাঃ)ও ঠিক তেমনি এসেছিলেন গসপেলসহ সমগ্র বাইবেলের ব্যাখ্যা করার জন্য। এর মাঝে কোন বৈপরিত্য নেই। ইসলামে আমরা নির্দেশিত হয়েছি সকল নবীদেরকে সমানভাবে বিশ্বাস করতে। যদি তা না করি তাহলে আমাদের বিশ্বাস থাকবে অপূর্ণ; বরং তা হবে পূর্ণাঙ্গ অবিশ্বাসীর পরিচায়ক।
নিম্নে বাইবেলের কিছু বৈপরিত্য উল্লেখ করে আমার কথা শেষ করব।
এভাবেই বাইবেল শত-সহস্র বিচ্যুতি, বৈপরিত্যে ভরপুর যা কখনো ত্রুটিমুক্ত হিসাবে আখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। তাই এটা সুনিশ্চিত যে, বাইবেল একটি বিকৃত গ্রন্থ। এর অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা আর নেই। ইসলামের আগমনের পর আর কোন ধর্ম ঈশ্বরের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। আমি ঘোষণা করছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) তার নবী ও রাসূল।