দাদীর ভালোবাসা
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
শেখ আব্দুছ ছামাদ 953 বার পঠিত
২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আমীর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব-এর
বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন যেলায় প্রায় ডজন খানেক মিথ্যা মামলা দেখিয়ে তিনজন
সাথীসহ তাঁকে গ্রেফতার করে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার। অবশেষে অধিকাংশ
মামলায় অব্যাহতি নিয়ে তিনি ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে কারামুক্ত হন। ফালিল্লাহিল হামদ্।
জেল থেকে বের হওয়ার পর প্রায় প্রতি মাসেই মুহতারাম আমীরে জামা‘আতকে নওগাঁ ও
বগুড়া কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। কিন্তু তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য আমার
কোনদিন হয়নি। বিগত ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে হঠাৎ আত-তাহরীক সম্পাদক বড়ভাই ড.
মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইনের কল। রিসিভ করার সাথে সাথে অপরপ্রান্ত হতে
নির্দেশ পেলাম ‘আজ মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের বিরুদ্ধে বগুড়ার গাবতলীতে
দায়েরকৃত বিস্ফোরক মামলার রায় হবে, তোমাকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বের হয়ে সাথে
যেতে হবে’। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই তড়িঘড়ি বের হয়ে পড়লাম। সকাল সাড়ে ৮-টায়
গাড়ি বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বেলা সোয়া ১১-টায় আমরা জজ কোর্ট চত্বরে
পৌঁছালাম। বগুড়া যেলা ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘ’র নেতা-কর্মীবৃন্দ পূর্ব থেকেই
সেখানে অপেক্ষমাণ ছিলেন। মামলার রায় বলে উপস্থিতি অন্যান্য দিনের চেয়ে
বেশি। সবাই আমাদের সাথে সালাম ও কুশল বিনিময় করছেন, এমন সময় শতবর্ষী দু’জন
বৃদ্ধের প্রতি আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। সহসাই মনে প্রশ্নের উদ্রেক হল, এই
অচল মুরববী দু’জন কেন কোর্টের বারান্দায়? পাশে দাঁড়ানো সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা
করতেই জানতে পারলাম, উনাদের একজনের নাম জসীমুদ্দীন। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত
সেই ২০০৫ সাল থেকে যতদিন এই আদালতে উপস্থিত হয়েছেন ততদিন তিনি নিয়মিত
হাজির হয়েছেন এবং মহান আল্লাহর দরবারে আমীরে জামা‘আতের মুক্তির জন্য
প্রাণখোলা দু‘আ করেছেন। অপরজন বৃ-কুষ্টিয়ার আব্দুর রহীম। পৌড়ত্বের শেষ
সীমায় দাঁড়িয়েও তার মেরুদন্ড দিব্যি সোজা। মুরববী দু’জনকে নীচ তলায় রেখে
আমরা তৃতীয় তলায় বগুড়ার ‘অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-১’-এর এজলাসে গেলাম।
আমীরে জামা‘আত পার্শ্বের একটি কক্ষে কয়েকজন সঙ্গীসহ অপেক্ষা করতে থাকলেন।
আর আমরা ছিলাম সম্মুখ বারান্দায়। এমন সময় হঠাৎ দেখি মুরববী আব্দুর রহীম
সাহেব তৃতীয় তলায়। তাকে দেখে রীতিমতো আমার চোখ ছানাবড়া। তাকে একটি কথা
জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না-‘চাচাজি! আপনি সিঁড়ি বেয়ে এখানে এলেন কিভাবে’?
তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় উত্তর দিলেন- ‘বাবা! আমীরে জামা‘আত এখানে রায়ের
অপেক্ষায় থাকবেন আর আমি নীচে বসে থাকি কিভাবে? আমি ভালভাবেই উপরে উঠতে
পেরেছি। আমীরে জামা‘আতের মুখখানা এক নজর দেখতে পেলে কোন কষ্টকেই আর কষ্ট
মনে হয় না’। এ কথা শুনে মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ! এমন মানুষ এখনো তোমার
যমীনে বিদ্যমান আছে! সত্যিই এমন ব্যক্তির অশ্রুসিক্ত ও দু‘আর বদৌলতেই হয়ত
এতো ষড়যন্ত্র আর বিপর্যয়ের মুখেও আল্লাহ আমীরে জামা‘আতকে আর আমাদের
প্রাণপ্রিয় সংগঠনকে যমীনের বুকে আজও টিকিয়ে রেখেছেন।
এ কথা ভাবতে ভাবতে দেখি কারাগার হতে একটি প্রিজন ভ্যান নীচে এসে দাঁড়াল। ভিতর থেকে নেমে এল হাতে-পায়ে বেড়ি পরানো দু’জন দাড়ি-টুপি ওয়ালা আসামী। জানতে পারলাম, তাদের একজনের নাম জয়নাল যার বাড়ীতে প্রাপ্ত বিস্ফোরক দ্রব্যকে কেন্দ্র করেই এই মামলার সূত্রপাত। অপরজন শফীকুল্লাহ যাকে জয়নাল সাহেবের বাড়ী থেকে গ্রেফতার করা হয়। কথিত জেএমবির আসামী হওয়ার কারণে তাদেরকে স্পেশালভাবে বিশেষ প্রহরায় আদালতে আনা হয়েছে। তাদেরকেও যথারীতি ‘অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-১’-এর এজলাসে হাযির করে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখা হল। ইতিপূর্বে সেখানে কোন পুলিশ উপস্থিত না থাকলেও তাদেরকে নিয়ে আসার সাথে সাথে এজলাসের ভিতরে ও বাইরে সশস্ত্র পুলিশ প্রহরায় নিয়োজিত হল। বেলা সাড়ে ১১-টা হতে একটানা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার এক পর্যায়ে বেলা পৌনে ৩-টার দিকে আসামী জয়নালকে এজলাসের পার্শ্বে অবস্থিত টয়লেটে নিয়ে যাওয়া হল। বাইরে বের হতে দেখে তার অশীতিপর মা, স্ত্রী ও সন্তানেরা পাশে এসে দাঁড়াল। টয়লেট হতে বের হতেই তার বৃদ্ধা মা তাকে স্নেহের বাহুডোরে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। মাতৃস্নেহের এ চিরন্তন দৃশ্য পৃথিবীর সেরা সন্ত্রাসীর জন্যও নিমিষেই মমত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। এ দৃশ্য দেখে কোন হৃদয়বান মানুষের পক্ষে চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
একই রকম মানবিক দৃশ্যের অবতারণা দেখি পার্শ্ববর্তী কোর্টে। এক মামলার আসামী হয়ে কোর্টে এসেছেন দুই সহোদর। হয়ত কোন এক কারণে দু’ভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটেছিল, যা এক পর্যায়ে পরস্পর বিরোধী মামলায় রূপ নেয়। আজকের রায়ে বিচারক তাদের মধ্যে আপসের নির্দেশনা দিলেন। অতঃপর উভয়ে উভয়ের গলা জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে এজলাসের বাইরে এল। প্রথমে এ দৃশ্য দেখে মনে হল হয়তো বিচারের রায় বিপক্ষে যাওয়ায় তারা এভাবে আহাজারি করছে। কিন্তু যখন আসল ঘটনা জানতে পারলাম তখন মনে পড়ল বহুল প্রচলিত সেই প্রবাদের কথা। ‘ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন, যদিও পৃথক হয় নারীর কারণ’।
যাইহোক আমীরে জামা‘আতের মামলা পরিচালনাকারী মাননীয় জজ শাহিনা নিগারের কথাও একটু না বললেই নয়। ঢাকা থেকে সড়ক পথে জার্নি করে বগুড়া এসে বেলা ১১-টা হতে সাড়ে ৩-টা পর্যন্ত কোনরূপ বিরতি ছাড়াই যেভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করছিলেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর ধৈর্য দেখে প্রথমেই মনে হয়েছিল যে, আজকে হয়তো সঠিক বিচার পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ্। পরবর্তীতে হলও তাই। ন্যায়পরায়ণতার কথা বাদই দিলাম, এভাবে যদি বাংলাদেশের বিচারকগণ শুধুমাত্র তাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয়টুকু দিতেন তাহলেও দেশের আদালতগুলোতে বছরের পর বছর মামলার স্তূপ জমে থাকত না এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আইন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে বর্তমানে দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১১ লাখ ২৫ হাযার ৯০৪টি। আদালতগুলোতে প্রতিদিন যে হারে মামলা নথিভুক্ত হয় তার এক দশমাংশও নিষ্পত্তি হয় না শুধুমাত্র বিচারকদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে। ফলে এদেশের বিচারব্যবস্থা এমন স্তরে পৌঁছেছে যে, এক পর্যায়ে বাদী-বিবাদী উভয়ই মারা যান কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি হয় না।
এদিকে আমীরে জামা‘আতের মামলার রায় হবে জানতে পেরে সকাল থেকেই আদালত চত্বরে বহু সাংবাদিকের ভিড়। সাংবাদিকদের দেখলেই এখন কেমন যেন বিতৃষ্ণা জাগে। গত তিন বছর যে ন্যক্কারজনক অভিজ্ঞতা হয়েছে এ ক্ষেত্রে, তাতে সাংবাদিকতা পেশার প্রতিই দারুণ অশ্রদ্ধা জন্মেছে। তাই যথাসম্ভব তাদের এড়িয়ে চলছিলাম। কিছুটা উৎকণ্ঠায় ছিলাম আজ রায় হবে তো! অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হল। বেলা ৩-টা ২০ মিনিটে উকিল সাহেব এজলাস হতে বের হয়ে বললেন, ‘রায় হয়ে গেছে মামলার সকল আসামী বেকসুর খালাস’। সুদীর্ঘ পাঁচ বছর চার মাস তদন্ত ও শুনানীর জটিল পথ পেরিয়ে পরিশেষে কাঙ্খিত এই রায়। একদিকে একরাশ উৎফুল্লতা হৃদয়জুড়ে ছুটোছুটি করছিল, অন্যদিকে আক্ষেপটা নতুন করে ঝাড়া দিয়ে উঠল। অযথা এই ডাহা মিথ্যা বিষয়ে কত মানুষেরই না বিপুল সময় ও অর্থের শ্রাদ্ধ হল। কেন মিথ্যার পিছনে এত ছুটাছুটি। সভ্য জগতে মিথ্যার এ জয়জয়কারের সামনে ন্যায়বিচারের গল্প বড়ই ব্যঙ্গাত্মক শোনায়। যাইহোক রায় শোনামাত্র মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আমরা দু’রাক‘আত শোকরানা ছালাত আদায় করলাম। পরে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে ছবর ও সত্যের প্রতি অটল থাকার উপর এক হৃদয়গ্রাহী সারগর্ভ বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতার এক পর্যায়ে উপস্থিত সকলে কেঁদে ফেললেন। ‘সত্য সমাগত, মিথ্যা বিতাড়িত, আর মিথ্যা বিতাড়িত হওয়াই বাঞ্ছনীয়’ (বনী ইসরাঈল ৮১)।