কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রান্তিক মানুষ

আব্দুল হক্ব 781 বার পঠিত

ফজর আলী নবতিপর বৃদ্ধ। ছিপছিপে দেহ। পরনে সফেদ পাঞ্জাবি। আবক্ষ সাদা দাড়ি। আদ্যন্ত সাদা জীবন। কিন্তু এ জীবন তিনি আর যাপন করতে চান না। চান না সতেরো বছর ধরে। তবু বেঁচে আছেন। দীর্ঘশবাস আর অশ্রুর সঙ্গে বেঁচে আছেন। না, তিনি ভিখিরি নন। জীবন অবাঞ্ছিত হয়ে ওঠার কারণ দৈন্য নয়। ঢের জমিজমা আছে। পাঁচ ছেলের একজন মালয়েশিয়ায়। বাকিরাও রোজগেরে। সবাই   পিতাঅন্তপ্রাণ। তবু ফজর আলি কাঁদেন। তবু চোখ তাঁর শুকোয় না। তিনি ছেলেদের ভালোবাসেন। নাতি-নাতনিদেরও। শুধু নিজের জীবনকে বাসেন না। কারণ প্রেম। কারণ বিরহ। কারণ চল্লিশ বছর আগে একজন তাঁকে ভালোবেসেছিলেন। একজন তাপস। মনফর উদ্দীন। দূরাগত। পন্ডিত দরবেশ। তিনি তাঁকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। ভালোবেসেছিলেন। সেই বাসা কেমন, আমরা দেখি নি। তবে তার ছায়া দেখেছি। ফজর আলির অশ্রুধারায় দেখেছি। ফজর আলির গানের সুরের আকুলতায় দেখেছি। ফজর আলির চল্লিশ বছর ধরে কলাপাতায় ভাত খাওয়ার নিষ্ঠার নেপথ্যে দেখেছি। চল্লিশ বছর আগে ধোপদুরস্ত ফজর আলীকে তাঁর পীর থালার বদলে পাতায় খেতে বলেছিলেন। সেই বলা আর রদ করে যান নি। তাই তিনি পাতায় খান। হতে পারে আদেশ তুলে নেবার খেয়াল ছিল না। অথবা ছিল, কিন্তু মুমূর্ষু সময় ফুরসত দেয় নি। ফজর আলী ওসব ভাবেন না। এ নিয়ে তাঁর খেদ নেই। তিনি চল্লিশ বছর ধরে তৃপ্তির সঙ্গেই পাতায় খান। এ ভক্তির তৃপ্তি। গল্পপট ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা। কলুংকা থেকে শুনই...মাইলের পর মাইল। চীনামাটির টিলা কোনখানে, কোথায় কুমিরের খামার..দেখা হয় নি। হেঁটেছি কেবল, সোনালি খড়ের মেঠোপথে, ধুলো-কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে। কেবল মানুষ দেখেছি। ছুটেছি বাড়ি বাড়ি। শুনতে চেয়েছি এইসব ফজর আলীদের হৃদয়ের কথা। আত্মার আরতি। রাঁধা-খাওয়ার বাইরে এদের একটাই আত্মিক অনুষঙ্গ : ধর্ম। ইসলাম। কিন্তু গ্রন্থগত ইসলাম নয়, ঐতিহ্যগত সূফীবাদ। কেতাবি চোখে তাতে ঢের বিভ্রম। শিতের ঠমক যেটুক দেখলাম, তাও ঐ ধর্মচর্চার ভেতরেই। আল্লাহর আরাধনা, পীরের ভক্তি..সবই গানে। সন্ধ্যেয় সবাই ঢোল-তবলা নিয়ে পাক-পাঞ্জাতনের মোমবাতি জ্বেলে গোল হয়ে বসে, অতঃপর গানের পর গান, পিতা-পুত্র একসাথে, সমস্বরে। বুড়ো লাল মিয়া বয়সের ভারে সিধে হয়ে হাঁটতে পারেন না, কিন্তু আসরে তাঁর গানের গলা শুনে মুগ্ধ হয়ে যাই। টের পাই, গান এদের স্রেফ বিনোদনমাধ্যম নয়। এদের আসরে অন্য আবহ, মুখে মুখে কী এক গায়া, চোখে জল। কেতাবি মন তবু উসখুস করে, কী উদ্ভট! কীসের পাক-পাঞ্জাতন! কোথাকার পীর! কবিমন বলে, রাখো তোমার কেতাব! হৃদয়ের রং দেখো, এর চে’ বড় তো কিছু নেই। এই দ্বনেদ্ব বন্ধ হয়ে থাকি। ভাবি। এরা ভুলে ডুবে আছে। কিন্তু শান্তিতে আছে। শুদ্ধতা তো শান্তির জন্যে।

কিন্তু শুদ্ধতা শুধুই কি শান্তির জন্যে? না। সত্যের উদ্বোধন, আত্মার জাগৃতি, ইনছাফের প্রতিষ্ঠার জন্যেও। কম পীরই সার্থক, বেশি তো সার্থক। স্বার্থপীরের চাতুর্যের কাছে ভক্তের সারল্য শোষিত হয় সহজে, নিরাপদে। ভক্তকে বিশবাস করানো হয়, পীরের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা প্রবল। তিনি সবই জানতে পারেন, ভক্তের মনের খবর তো বটেই। তাই পীর যখন অলৌকিক কারণ দেখিয়ে নযরানা চান, মুরিদ এর ফাঁকিটা ধরতে চেষ্টা করে না। ভাবে, পীর বুঝে ফেলবেন, সে সন্দিহান। কী সর্বনাশ! তওবা, তওবা! এভাবেই মূর্খ-চতুর পীরদের ব্যবসা চলে অবাধে। ভক্ত এদের হাতে সাধ্যমতো সব তুলে দিয়ে ভাবে, তার ইহজন্ম সার্থক হল। ভেবে শান্তি পায়। ভ্রান্তির শান্তি! শান্তি কাঙ্খিত, কিন্তু ভ্রান্তি স্বীকার্য নয়। দ্রোহী তারুণ্যের তর সয় না। সে তার সত্যবাদ নিয়ে ভুল ভাঙতে উদ্যত হয়। প্রাজ্ঞ সহজন থামিয়ে দেন। দিশে পাই...সত্য কোনো হাতুড়ি নয়, যার ঘায়ে তুমি মানুষের আবেগকে আহত করবে। َহিকমা, সুন্দর বক্তৃতা, গঠনমূলক বিতর্ক। সত্য প্রচারের এ তিনটে পথ, মহাসত্যেরই দেখানো পথ। এখানে প্রথম পর্যায়ে প্রথমটা নিতে হবে। আঘাত করে ভাঙা যায়, জাগানো যায় না। এদের জাগাতে হবে। জাগাতে হবে প্রেম দিয়ে। মমতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে হৃদয়ের কাছে। বোঝাতে হবে- আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য নেই। আমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করি। তাঁর কাছেই সাহায্য চাই। তাই শুধু তাঁরই ধ্যান করব। তাঁকেই জ্ঞান করব রক্ষাকর্তা বলে। তিনি অন্তর্যামী, তাঁকে ঘিরে কেন্দ্রিত হোক আমাদের মন। ইনীণ ওয়াজ্জাতু বিশবকর্তার উদ্দেশ্যে।

‘পীর’ ইসলামী পরিভাষা নয়। শব্দটির অর্থ- ‘যে দৃশ্য ধারণ করে’, তা-ও ইসলামসম্মত নয়। এটি আর্য ঋষির পারসিক মূর্তি। পীর ও ঋষিদের কথা আমরা যেমন শুনি, তাতে বৈরাগ্য আছে। আছে সংসারবিমুখতা। ইসলাম তা শেখায় না। কুরআনের দর্শন বিরাগী নয়, অনুরাগী। ইসলামের সবচে’ বড় প্রচারক মহানবী মুহাম্মদ (ছাঃ) নবুওতের দায়িত্ব নেবার পর একদিনও সমাজবিচ্ছিন্ন ছিলেন না। ধর্ম তো মানুষের জন্যে, কাজেই মানুষকে বাদ দিয়ে যে সাধনা, তা অমানুষিক সাধনা। ইসলাম বলে কল্যাণ সাধনের কথা। দেহ-মনের কল্যাণ, সমাজ-রাষ্ট্রের কল্যাণ। ইসলামী চিন্তা ও কাজ মানেই মানবকল্যাণমূলক চিন্তা ও কাজ। যে চিন্তায় মানুষ নেই, তা শয়তানী চিন্তা। যে কর্মে জীবনের স্বার্থ নেই, তা নিছকই অপকর্ম। মুসলমানরা ইলমে কালাম ও তাসাউফের নামে কয়েকটি শতাব্দী এই অপকর্মের সাধনায় নষ্ট করেছে। এরই বিষফল পণ্যায়নের পৃথিবীতে তারা আজ ভোক্তা-ক্রেতা-শোষিত। এরই পরিণামে ফেরকা-তরীকার দ্বনেদ্ব সরল-সঠিক ইসলাম আড়াল হয়ে পড়েছে। নষ্ট করার সময় আর নেই। মানুষের কথা ভাবতে হবে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। এ লেখার প্রেক্ষাপট খুব দুর্গত অজ্ঞ সেই সব মানুষ যাদের জীবনমান নিচু। এদের শুদ্ধ তাওহীদ ও জীবনবোধ শিক্ষা দিতে হবে। যুবকদের সৃজনশীল ও উৎপাদনমুখী কাজ দিতে হবে। এই একুশ শতকে, যখন জীবন ছড়িয়ে গেছে বহুদূর, ছুঁয়েছে বিশবজনীন মাত্রা। তখন আর সাবেকী পীরপ্রথার জপতপের অবকাশ নেই। সময় যত এগিয়েছে, তার দাবিও বেড়েছে ততটা। আজকের দাঈ ইলাল্লাহ হবেন মানবতাবাদী, অভিজ্ঞ ও তৎপর সমাজকর্মী। হিদায়াতের আলো পৌঁছে দেয়ার কাজে তিনি হিকমা প্রয়োগ করবেন। সেজন্য সবার আগে চাই মানুষের জন্য মমতা। পান্ডিত্যে দু’টি জিনিসের একটি নিশ্চিত থাকবে- হয় প্রেম, নয় অহঙ্কার। প্রেমহীন পান্ডিত্য সেই রসহীন মাটি, যাতে প্রাণের অঙ্কুর উদ্গত হয় না। আমাদের এ উপলব্ধিটা আরো প্রকৃষ্ট হয়ে ওঠে, যখন বক্ষ্যমাণ জনপদের জন্যে যথার্থ কর্মনীতি অবধারণ ও অংশগ্রহণের আহবান নিয়ে একদল আলখাল্লাধারীর দ্বারগত হই। তাদের পান্ডিত্য বিমুখ হয়। বিমুখ হয় শুধু আমাদের থেকে নয়, আমাদের রবের সেই বাণী থেকেও, যা বিমুখ হতে স্পষ্টত বারণ করে বলে ‘তুমি অহংকারমত তোমার মুখ মানুষের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেয়ো না’ (লোকমান ১৮)। চোখে দেমাগের ঠুলি আঁটা বলে তারা তা দেখে না। মানুষকে সত্য ও সুন্দরের দিকে আহবানের জীবনমুখী চেতনা নেই বলেই তারা বলে, এসব গোমরাহ লোকের পেছনে মেহনত করে লাভ হবে না। আল্লাহ না চাইলে কাউকে হিদায়াত করা যায় না। শুনে স্তব্ধ হয়ে থাকি। কিছুই বলি না। শুধু হিদায়াতদাতার কাছে কায়মনোবাক্যে বলি, আল্লাহ তুমি আমাদের বুযুর্গদের মানুষ হবার তাওফীক দাও আর আমাদের ভিতর থেকে একদল লোককে জাগিয়ে দাও যারা তোমার দ্বীনকে দিক-দিগন্তের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারে। আমীন



আরও