পথে-প্রান্তরে

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 650 বার পঠিত

(আমীরে জামা‘আত ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের হাজিরার তারিখ হলেই বগুড়া কোর্টের বারান্দায় নিয়মিত দেখা মেলে শীর্ণ শরীরে জীর্ণ আভরণে এই অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষটির। কাছে এগিয়ে যেতেই প্রাণজুড়ানো সহাস্য অভিবাদন তাঁর সহজাত। একটি দাঁতও নেই, কিন্তু কণ্ঠে যথেষ্ট তেজ। কৃত্রিম রাগের স্বরে প্রায়ই বলি, ‘এই বয়সে এতো কষ্ট করে প্রতিদিনই কেন আসেন? মাঝে মাঝে আসবেন।’ ‘মনের টানে বাবা’- প্রতিবারই এই জবাব পেয়ে নিরুত্তর হয়ে যাই। গত ৩০.০৯.২০১০ তারিখে জজকোর্টের তিনতলার বারান্দায় তাঁকে নুব্জ কাঁধ ঝুকিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে মনস্থির করে ফেললাম, আজ সময় করে এই বৃদ্ধের সাক্ষাৎকার নেবই। একটু পর কোর্ট বারান্দাতেই তাঁর সাথে আলাপ শুরু হল- আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব)     

আপনার পুরো নাম কি?

জসীমুদ্দীন মন্ডল।

বয়স কত?

৮৬

বাড়ী কোথায়?

রামেশ্বরপুর, মাছপাড়া, গাবতলী। এখানে বাসে আসতে ১ ঘণ্টা লাগে। সিএনজিতে আধাঘণ্টা।

আহলেহাদীছ কবে হয়েছিলেন মনে আছে?

বাপ-দাদা থেকেই আমরা আহলেহাদীছ। বাপ-দাদারা ঐ সময়ই আমাদের গ্রামে মসজিদ তৈরী করেছিলেন।  তখন মানুষ আমাদের মুহাম্মাদী বলত।

‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর সন্ধান পান কখন?

৮৫-তে আলতাফুন্নেছা খেলার ময়দানে যখন সম্মেলন হল তখনই এ সংগঠনের সাথে আমার পরিচয়। এর আগে সংগঠন সেভাবে বুঝতাম না। তবে আমরা মাওলানা আব্দুল্লাহ ইবনে ফজলের খুব ভক্ত ছিলাম।

৮৫-এর ঐ সম্মেলনের কোন স্মৃতি আপনার মনে পড়ে?

হ্যা, খুব মনে পড়ে। হানাফী সমাজের লোকেরা সভা পন্ডের চেষ্টা করেছিল। সন্ধ্যার দিকে আলতাফুন্নেছার ঐ শেষ গেটটা (আদালতের ৩ তলা থেকে পার্শ্বেই অবস্থিত মাঠের দিকে ইশারা করে) দিয়ে তাদের একদল লোক প্যান্ডেলের পিছন থেকে ভাঙ্গা শুরু করল। ওদের কথা ছিল ‘এ্যাদের সভা করবার দেয়া যাবি না। এ্যারা হামাদের গীবত গাবি।’ তখন সম্ভবত ডিসির কাছে ফোন করা হল। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে সব ঠিক করে দিল। রাত ৮/৯টার দিকে সভা শুরু হল। ড. বারী সাহেব কিছুক্ষণ বক্তৃতা করার পর গালিব সাহেব বক্তৃতা করলেন। উনার স্বাস্থ্য তখন একেবারে হালকা পাতলা। তাঁর বক্তব্য এমনই হল যে হানাফীরা সব স্তব্ধ হয়ে গেল। তাদের কথা ছিল, ইনি কি বলল আর আমাদের বক্তারা কি বলে। আমরা তো তাহলে ভুল পথে আছি! আমি উনাকে তখনও চিনতাম না। কিন্তু ভাষণ শুনে সেদিনই বুঝেছিলাম, ইনি একদিন একটা কিছু হবেন।

আপনি রাজশাহীর তাবলীগী ইজতেমায় প্রথম কখন গিয়েছিলেন?

৯১-এর সম্মেলন থেকে আমি নিয়মিত রাজশাহী যাই। এ পর্যন্ত সব কটা ইজতেমায় গিয়েছি। তখন খাওয়ার সময় সংগঠনের নাম লেখা থালা দেয়া হত। ১০/১২ টাকা ডেলিগেট ফি ছিল। সেই থেকে সংগঠনের কোন সম্মেলন আমি বাদ দেই না। এ পর্যন্ত সব বড় সম্মেলনেই আমি উপস্থিত থেকেছি।

লেখাপড়া জানেন আপনি?

ছোটবেলায় বাপ-মারা যাওয়ায় ক্লাস ওয়ানের বেশি পড়তে পারিনি।

তবে লিখতে পড়তে পারি।

ছেলে-মেয়ে আছে?

৬২ সালে প্রথম বিয়ে করি। ৬৭ সালে আরেকটি। পরে দু’স্ত্রীই মারা গেলে ৮৮ সালে আরেকটি বিয়ে করি। সেও মারা গেছে। মেয়ে রয়েছে একটা। আর কোন সন্তান হয়নি। এই বুড়ো বয়সে জামাইসহ মেয়ে আমার কাছেই থাকে। নাতী-নাতনী নিয়ে একরকম কাটছে ভালই। তবে দুঃখ যে ওরা লেখাপড়া না শিখে কাজে নেমে পড়ছে।

কি করেন বাড়িতে?

আগে মক্তব চালাতাম। এখন মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত আযান দেই। মাঝে মাঝে ইমাম না থাকলে ছালাতও পড়াই। এভাবেই কাটছে বুড়ো বয়সটা।

প্রতি তারিখেই এত কষ্ট করে আপনি আদালতে হাজির হন কেন?

(ছলছল চোখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে) মনের টানে, চোখের দেখা দেখতে। দেহের সামর্থ্য যতদিন আছে আমি আসবই। প্রতিবার মনে হয় যে, পরের বার যদি আর আসতে না পারি। সেই ২০০৫ সালে প্রথম বগুড়া আদালতে আনার পর বহু পুলিশের মধ্য দিয়ে আমীর সাহেবের সাথে জোর করে মুছাফাহা করেছিলাম। সেই থেকে একটা তারিখও বাদ দেইনি। প্রতিদিন এসেছি দেখতে। না আসলে শান্তি পাই না।        

আপনার সময়ের তুলনায় বর্তমান সময়ে আহলেহাদীছদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন মনে হয়?

অনেক অনেক ভাল। আগে মানুষ আমাদের দেখলে বলত, এরা শুধু এলোমেলো করে। সমাজে ফিৎনা-ফ্যাসাদ বাধায়। এখন মানুষ আমাদের বই পড়ে আর বলে, এরাই ঠিক। এরাই ছহীহ কথা বলছে। আমরাই এতদিন ভুল পথে ছিলাম না জেনে।

এর কারণ কি মনে হয়?

বই। বই-পত্রিকা থাকার কারণেই মানুষ সঠিক জিনিস জানছে আর আমল করছে। নিজেদের ভুল বুঝছে।

নাতি-নাতনীদের কি উপদেশ দেন?

বলি তোরা বই পড়। সত্য জানার চেষ্টা কর। ওদের

নিজের ব্যাপার কোন আফসোস আছে?

না কোন দুঃখ, আফসোস আমার নেই। আল্লাহ আমাকে কখনো কষ্টে ফেলেননি। আমি খুব সুখে আছি, ভাল আছি। 



বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও