মানব সমাজে শিরক প্রসারের কারণ
ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম 8777 বার পঠিত
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে সমাজ সংস্কারের আন্দোলনই
হচ্ছে আহলেহাদীছ আন্দোলন। ছাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে এ আন্দোলন চলে এসেছে।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শক্তি এ আন্দোলনের উপর খড়গহস্ত চালিয়ে এর
অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। কিন্তু এটা কখনো থেমে থাকেনি। এ আন্দোলনের
আলোকোজ্জ্বল অতীত ও স্বর্ণালী ইতিহাস তারই প্রোজ্জ্বল প্রমাণ। আলোচ্য
নিবন্ধে সুন্নাত দলনের যুগে ও সংকট পরবর্তী যুগে আহলেহাদীছ আন্দোলনের
অবস্থা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
সুন্নাত দলনের যুগ (১৯৮-২৩২হিঃ) :
১৫০ হিজরীর পরে গ্রীক দর্শন উদ্ভূত যুক্তিবাদের প্ররোচনায় কালামশাস্ত্রবিদ একদল বুদ্ধিজীবীর অভ্যুদয় ঘটে। এসব কালাম শাস্ত্রবিদ ও মু‘তাযেলা মতাবলম্বী বুদ্ধিজীবীদের কারণে ইসলামের প্রাথমিক যুগের সহজ-সরল হাদীছভিত্তিক জীবন পরিচালনায় ব্যত্যয় ঘটে। এ সময় বিদ্বানগণ ইসলামের মূল আক্বীদাগত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে কুটতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এতে বহু মুসলমান আক্বীদাগত বিভ্রান্তিতে পতিত হন। এই যুগের দ্বিতীয় পর্বে (১৯৮-২৩২ হিঃ) আববাসীয় খিলাফতকালে আল-মামূন, মু‘তাছিম ও ওয়াছিক বিল্লাহ পরপর খলীফা পদে অধিষ্ঠিত হন। তাঁরা সকলেই মু‘তাযিলী মতবাদ গ্রহণ করেন। তারা এ মতবাদের পক্ষে প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। ফলে আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের উপরে নেমে আসে এক মহা পরীক্ষার যুগ। আহলেহাদীছগণের ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের (১৬৪-২৪১ হিঃ) উপরে নেমে আসে লোমহর্ষক নির্যাতন। তৎকালীন মু‘তাযিলা মতাবলম্বী আববাসীয় খলীফা আবু ইসহাক ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বলকে ‘কুরআন সৃষ্ট’ এটা স্বীকার করতে নির্দেশ দিলে তিনি তা অস্বীকার করেন। এ কারণে তাঁকে গ্রেফতার করে চাবুক মেরে রক্তাক্ত হয়। একাধারে তিন তিনজন খলীফার শাসনামলে তাঁর উপরে এই নির্মম নির্যাতন অব্যাহত থাকে। এত নির্যাতনের পরও তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তাঁকে ঐ কথা স্বীকার করার জন্য নানা ভয়-ভীতি দেখিয়ে বার বার চাপ প্রয়োগ করা হলেও তিনি তাদের এ অন্যায় দাবীর কাছে নতি স্বীকার করেননি। এভাবে অন্যান্য আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের উপরও নির্যাতন চালানো হয়। সেজন্য এই যুগকে ‘সুন্নাত দলনের যুগ’ বলা যায়।
সংকট ও সুন্নাত দলন যুগে (১০০-২৩২ হিঃ) তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ ও অন্যান্য আহলেহাদীছ বিদ্বানগণ ‘প্রচার ও প্রতিরোধ’ উভয়বিধ পন্থায় কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক জীবন গড়ার আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। তারা বিদ‘আতী আলেমদের সাথে বিভিন্ন তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এ যুগে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মুজাদ্দিদ খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয (৯৯-১০১ হিঃ) স্বয়ং এসব বিদ‘আত প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। তিনি ক্বাদারিয়া নেতা গায়লান দামেষ্কী (নিহত ১০৫ হিঃ)-কে দরবারে ডাকিয়ে এনে তার মতবাদের সপক্ষে দলীল পেশ করতে বলেন। গায়লান সূরা দাহর-এর ৩নং আয়াত পেশ করে। খলীফা তাকে আরও সামনে পড়ে যেতে বলেন। অতঃপর উক্ত সূরার সর্বশেষ দু’টি আয়াত পাঠ অন্তে খলীফা তাকে জিজ্ঞেস করেন, এখন বল তোমাদের বক্তব্য কি? সে লা-জওয়াব হয়ে যায়। অবশেষে উপস্থিত সঙ্গী-সাথীসহ সকলে ‘তওবা’ করে চলে যায়। কিন্তু খলীফার মৃত্যুর পরে পুনরায় গায়লান তার পূর্ব মতে ফিরে যায়। পরবর্তী খলীফা হিশাম বিন আবদুল মালেক (১০৫-১২৫ হিঃ) তাকে দরবারে ডাকিয়ে এনে একটি বিতর্কসভার আয়োজন করেন। গায়লান পরাজিত হলে খলীফা তাকে হাত-পা কেটে শূলে চড়িয়ে হত্যা করেন। পরবর্তীতে তিনি আরেকজন ক্বাদারিয়া নেতাকে দরবারে ডাকিয়ে এনে আহলেহাদীছগণের অন্যতম নেতা ইমাম আওযাঈ (৮৮-১৫৭ হিঃ)-এর সঙ্গে বিতর্ক সভা করান। পরাজিত হলে তাকে ও উপরোক্ত ভাগ্য বরণ করতে হয়।
জাহমিয়া মতবাদের প্রবক্তা জাহ্ম বিন ছাফওয়ান উমাইয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধৃত হয়ে ১২৮ হিজরীতে ইসফাহান অথবা মারভে নিহত হন। অন্যতম জাহমিয়া নেতা জা‘আদ বিন দিরহামকে কূফার গভর্ণর খালেদ ইবনু আবদুল্লাহ আল-কাসারী ১২৪ হিজরীতে ঈদুল আযহার দিন খুৎবার পরে মিম্বরের নিকটে নিজ হাতে যবেহ করেন। জা‘আদ এ বিশ্বাস পোষণ করত যে, ‘আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ)-কে খলীল (বন্ধু) রূপে গ্রহণ করেননি’ এবং ‘মূসা (আঃ)ও আল্লাহর সাথে কথা বলেননি’। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত এ দু’টি বিষয়কে অস্বীকার করায় তাকে হত্যা করা হয়।
আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরামের ব্যাপক দাওয়াতী তৎপরতা এবং সাথে সাথে প্রশাসনিক কঠোরতার ফলে এসব বিদ‘আতী ফিৎনা উমাইয়া যুগে (৪০-১৩২/৬৬১-৭৫০ খৃঃ) খুব বেশী প্রসার লাভ করতে পারেনি। আববাসীয় যুগের (১৩২-৬৫৬/৭৫০-১২৫৮ খৃঃ) প্রথমার্ধে (১৯৮-২৩২ হিঃ) মু‘তাযিলা ফিৎনা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খুবই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরামের উপরে চরম নির্যাতন নেমে আসে। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১) এ সময় কঠিনতম পরীক্ষার সম্মুখীন হন। তবুও সকল প্রকার নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেও হাদীছপন্থী বিদ্বানগণ ছাহাবা যুগের আক্বীদা ও আমলকে অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টায় সুদৃঢ় থাকেন।
সংকট পরবর্তী যুগ (২৩২-৪র্থ শতাব্দী হিজরী) :
ওয়াছিক বিল্লাহ (২২৭-২৩২ হিঃ)-এর পরে তার ভাই মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ (২৩২-২৪৭ হিঃ) খলীফা নিযুক্ত হলে মু‘তাযিলা মতবাদ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা হতে বঞ্চিত হয়। ফলে মু‘তাযিলা সংকট দূরীভূত হয় এবং আহলে সুন্নাত বিদ্বানগণ স্বাধীনভাবে কুরআন-হাদীছের প্রচার-প্রসার, পঠন-পাঠন, সংগ্রহ ও সংকলনের দিকে মনোনিবেশ করেন। তৃতীয় শতাব্দী হিজরী ‘হাদীছ সংগ্রহ ও সংকলনের স্বর্ণযুগ’ হিসাবে পরিণত হয়। ছিহাহ সিত্তাহর মুহাদ্দিছগণ এ যুগেই ইসলামের শ্রেষ্ঠ খিদমত হিসাবে ছহীহ হাদীছ সমূহ যাচাই-বাছাই, সংকলন ও লিপিবদ্ধ করে জনগণের সামনে পেশ করেন। ছিহাহ সিত্তাহ বা কুতুবুস সিত্তাহ সংকলকগণ হ’লেন, মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিঃ), মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশাইরী (২০৪-২৬১ হিঃ) আবু দাঊদ সুলায়মান বিন আশ‘আছ আস-সিজিস্তানী (২০২-২৭৫ হিঃ), আবু ঈসা মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা আত-তিরমিযী (২০৯-২৭৯ হিঃ), আহমাদ বিন শু‘আইব আবু আব্দুর রহমান আন-নাসাঈ (২১৫-৩০৩ হিঃ), আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযীদ ইবনে মাজাহ আল-কাযবীনী (২০৯-২৭৩ হিঃ)। এছাড়া অসংখ্য খ্যাতনামা আহলেহাদীছ বিদ্বান এ যুগে মূল্যবান লেখনী পরিচালনা করেন। তাই এ যুগের প্রথমার্ধকে আহলেহাদীছ আন্দোলনের ‘রেনেসাঁ যুগ’ বলে অভিহিত করা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, আহলেহাদীছ আন্দোলনের উপর যত নির্যাতন এসেছে, এ আন্দোলন তত বেগবান ও গতিশীল হয়েছে। জেল-যুলুম, অত্যাচার-নিপীড়নে এ আন্দোলনের অকুতোভয় বীর সেনানীরা মুষড়ে পড়েননি, দমে যাননি, থেমে যায়নি তাদের গতি। বরং সকল প্রতিবন্ধকতা, যাবতীয় প্রতিকূলতাকে পদদলিত করে তাঁরা সামনে এগিয়ে গেছেন। শত নির্যাতনকে হাসিমুখে বরণ করে তাঁদের মিশনকে অব্যাহত রেখেছেন। আমাদেরকেও তাঁদের মতই বুকে হিম্মত নিয়ে, বাহুতে বল নিয়ে, তেজোদ্দীপ্ত ঈমানী শক্তি নিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে হকের পথের এ দুর্জয় কাফেলা তার লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে পারবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন-আমীন!