সত্যের আলো

আবু তাহের বর্ধমানী 10175 বার পঠিত

[মাওলানা আবু তাহের বর্ধমানী একজন খ্যাতনামা আহলেহাদীছ আলেমে দ্বীন। ১৯২১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান যেলার মঙ্গলকোট থানাধীন শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি সপরিবারে বাংলাদেশে হিজরত করেন এবং দিনাজপুর শহরের পাটুয়াপাড়া মহল্লায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি প্রথম জীবনে কলিকাতা হতে প্রকাশিত ‘মাসিক তাওহীদ’ (যা পরে মাওলানা আয়নুল বারীর সম্পাদনায় ‘আহলে হাদীস নামে প্রকাশিত হয়েছে) ও দিনাজপুর থেকে প্রকাশিত ‘মাসিক আল-মুজাহিদ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। কলকাতার ‘সাপ্তাহিক পয়গাম’ ও ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মাদী’র সাথে প্রায় এক যুগেরও অধিককাল তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে তিনি সাপ্তাহিক আরাফাত পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং ১৯৯৭ সালে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ২০০১ সালের ২১শে মার্চ  ৮০ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন (লেখকের বিস্তারিত জীবনী জানার জন্য মাসিক আত-তাহরীক মে ২০০১ সংখ্যা দ্রষ্টব্য)। ছোটবেলা থেকেই তাঁর লেখালেখির অভ্যাস ছিল। ১৩৬৪ সালে (১৯৫৮ খৃ:) তাঁর প্রথম প্রকাশিত পুস্তিকা ‘সত্যের আলো’র বিরুদ্ধে মামলা হয় আদালতে এবং মামলা চার বছর চলার পর অবশেষে পুস্তিকাটি বাযেয়াফ্ত করা হয়। তখন উভয়বঙ্গে     পুস্তিকাটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর মাধ্যমে তিনি মুসলমানদেরকে তাদের অতীত ঐতিহ্য স্মরণ করার আহবান জানিয়েছেন। মুসলমানদের মৃতপ্রায় ঈমানী চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছেন। তাঁর লেখনীতে শংকিত হয়েছিল ভারত সরকার। নিম্নে বহুল আলোচিত সেই পুস্তিকাটি থেকে নির্বাচিত কয়েকটি প্রবন্ধ পাঠকদের খেদমতে হুবহু পত্রস্থ করা হল।- নির্বাহী সম্পাদক]  

হে মুছলিম জেগে ওঠো

অমর কবি আল্লামা ইকবাল মুছলমানদের লক্ষ্য করে বলেছেন :

ছবক্ পড়্ ফের ছাদাকাত কা

আদালাত কা শাজাআত্ কা

কাম লিয়া জায়েগা তুঝ্সে

দুনিয়া কি ইমামত কা \

হে মুছলিম তুমি আবার সত্যবাদিতার, ন্যায়পরায়ণতার ও শৌর্য- বীর্যের ছবক পড়। তোমার দ্বারা তাহলে দুনিয়ার নেতৃত্বের কাজ নেওয়া হবে।

সত্যি কথা, মুছলমান যদি মিথ্যা, শঠতা ও প্রতারণাকে পরিহার করে সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে তাহলে নেতৃত্বমন্ডিত আসন আবার ফিরে পেতে পারবে। তারাই আবার খিলাফতে ইলাহিয়ার সুমহান আসনে উপবেশন করবে। কিন্তু মুছলমান আজ ভুলে গেছে তাদের ইতিহাসকে, ভুলে গেছে তাদের ঐতিহ্যকে, ভুলে গেছে তাদের তাহজীব ও তামাদ্দুনকে। যাঁর বাহিনী মদিনা থেকে মার্চ করে পৃথিবীর এক বৃহত্তম অংশকে জয় করে নিয়েছিল এবং যিনি সে যুগের খ্রীষ্টান ও রোমক সম্রাটদের যাবতীয় গর্ব ও অহংকারকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলেন- মুসলমানগণ ভুলেছে আজ সেই মহাপুরুষ ফারুকে আযম ওমরের কথা। তারা ভুলে গেছে আজ আমীর হামজা ও খালেদ বিন ওলিদের শৌর্য বীর্যের কথা, তারা ভুলে গেছে আজ তাদের জাতীয় আদর্শকে।

তাই বলি, হে মুছলিম! তুমি যে সিংহ শাবক, তুমি যে, বীরের বাচ্চা। তোমার আজ এ দুর্দশা কেন? কতদিন তুমি অন্য জাতির বলির পাঁঠা হয়ে থাকবে? হে মুসলিম, উঠ, জাগো। জলদ গম্ভীর স্বরে তুমি হেঁকে বল- আমি মুসলিম। আমি আল্লাহর জন্য সব কিছু দিতে পারি।

হে মুছলিম- তোমার  আজ চতুর্দিকে শত্রু। তলওয়ারের দ্বারা, গোলাগুলির দ্বারা ও লেখনীর দ্বারা তোমার জাতীয় গৌরবের উজ্জ্বল প্রদীপকে নিভিয়ে দিবার জন্য চতুর্দিকে আজ ষড়যন্ত্র চলছে। তোমার সন্তান-সন্ততির মন ও মস্তিষ্কে ঈমানিয়াতের কোন ছোঁয়া যাতে না লাগতে পার তজ্জন্য পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে তাদেরকে আল্লাহ ও আল্লার রাছূলের নামটা পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। তোমার ছেলে কলেজ থেকে ডিগ্রী নিয়ে এসে বলছে, আল্লাহ নাই, নামাজ আবার কি? রোজা আবার কি? হজ্জ করে কি হবে? হে মুসলিম, তুমি ভেবে দেখো তোমার উন্নতি কোথায়? এখনও যদি তুমি সতর্ক না হও তাহলে গজবে এলাহির কঠোর ধাক্কায় তোমার অস্তিত্ব চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে। তুমি স্মরণ কর সেই আল্লামা শহীদ ইসমাঈলের কথা- যিনি ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য বালাকোটের রণাঙ্গনে নিজের তপ্ত কলিজার রাঙ্গা খুন ঢেলে দিয়ে ত্যাগের মহান আদর্শ রেখে গেছেন। স্মরণ কর তুমি মোজাদ্দেদে আলফে ছানী, সৈয়দ আহমাদ সিরহিন্দীর কথা, স্মরণ কর তুমি খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর কথা, মখদুম আব্দুল্লাহ গজনবী ও মখদুম আব্দুল্লাহ গুজরাটির কথা; যাঁরা দীনের জন্য, সত্যের জন্য নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

হে মুছলিম! তোমাকে আজ শহীদ ঈসমাঈলের মত, শাহ অলিউল্লাহর মত, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর মত, মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর মত, মখদুম আব্দুল্লাহ গজনবী ও আব্দুল্লাহ গুজরাটির মত হবে হবে।

হে মুছলিম, তুমি দলাদলি ভুলে যাও। সংহতির বিধ্বস্তিই তোমাকে এত পশ্চাতে রেখেছে। যারা নাস্তিক, যারা আল্লাহকে মানে না, যারা বহু ঈশ্বরবাদী, যারা নদী-নালা, খাল-বিল, খড়-কূটা, কাদা-মাটি সব কিছুরই পূজা করে, যারা ঈমানের স্বাদ কেমন তা জানে না, তারা সকলেই উন্নত হয়ে যাচ্ছে। চির অভিশপ্ত ইহুদী আজ রাজশক্তির অধিকারী। আর তুমিই কেবল পশ্চাতে পড়ে রইলে! হে মুছলিম তুমি যে বড় শক্তির অধিকারী তা কি তুমি ভুলে গেলে? তোমার কাছে যে সব থেকে বড় অস্ত্র আছে, সে আজ হচ্ছে ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মোহাম্মাদুর রাছূলুল্লাহ।’’ ‘লা’ যে তোমার বড় অস্ত্র। ‘লা’-এর দ্বারা তুমি সব ইলাহকে, সব শক্তিকে মিছমার করে দিয়ে ইল্লাল্লাহ, আল্লাহকে বাকী রেখেছ। তুমি যে আল্লাহর দাস। তবে কেন আজ প্রবৃত্তির মোহে, গদীর মোহে, চাকরীর মোহে, রূপের মোহে, অট্রালিকার মোহে, নারীর মোহে, ভূসম্পদের মোহে তোমার জাতীয় গৌরবকে হারিয়ে ফেলছ? হে মুছলিম, আজ ভায়ে ভায়ে মিলে যাও। কবির ভাষায়-

মুখেতে কালেমা অন্তর তলে

আকদুল মাওয়াখাত্

পদতলে যত পর্বতগিরি

হয়ে যাক্ ধূলিস্মাৎ।

ইংরেজ জাতি একতার বলেই একদিন পৃথিবীর বুকে তাদের বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে সমর্থ হয়েছিল। ভারতে উত্তর পশ্চিম সীমান্তের পাঠানেরা যখন ইংরেজী মহিলা মিসেস এলিসকে অপহরণ করেছিল তখন মুষ্টিমেয় ইংরেজ ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। ছোট্ট একটি বাচ্চার পর্যন্ত রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল। কিন্তু হে মুসলিম, তোমার মধ্যে সে ভ্রাতৃত্ব নাই। তোমার এক ভাই যদি কষ্ট পায় তাহলে তুমি মুচকি হাসো। কত মুসলিম রমণীর যে ইজ্জত বর্বর অমুসলিমরা নষ্ট করে দিয়েছে তা কি তুমি জানো না? কিন্তু ইংরেজের মত তোমার প্রাণে কি ব্যথা লেগেছিল? তাই বলি হে মুসলিম, অতীতের ইতিহাস থেকে অভিজ্ঞতা লাভ কর। জেগে উঠ, জেগে উঠ। (অর্ধ সাপ্তাহিক পয়গামে ৮ম বর্ষ ৬৯শ সংখ্যায় প্রকাশিত)।

 

আবার তোমরা জাগো

হে মুছলিম-তুমি জেগে উঠো। বেহুঁশ হয়ে, গাফেল হয়ে তুমি তোমার কীর্তিমানকে আর হারিও না। তোমার রাজ্য গেছে, সম্পদ গেছে,  কিন্তু তোমার  ইতিহাসকে কে তো কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। তোমার ব্যক্তিত্ব, তোমার স্বাতন্ত্র্য ও তোমার ঈমানকে তো কেউ অপহরণ করে নিতে পারেনি। হে মুসলিম যাদের ঈমান আছে, যাদের ইতিহাস আছে, তাদের সবই আছে। ইতিহাসই তোমাকে প্ররণা জোগাবে। তুমি জাগো। যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, মিথ্যা বিরুদ্ধে, ছলনার বিরুদ্ধে, প্রতারণার বিরুদ্ধে, কুসংস্কারে বিরুদ্ধে, মিথ্যার প্রহসনের বিরুদ্ধে, কালোবাজারীর বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, অনাচারের বিরুদ্ধে, অত্যাচারে বিরুদ্ধে, ব্যভিচারের বিরুদ্ধে, বর্বরতার বিরুদ্ধে তুমি সংগ্রাম চালাও। দুর্বলতাকে তুমি পরিহার কর। তুমি ভীরু হয়ো না, কাপুরুষ হয়ো না, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ো না।

তুমি জাগো। ওমর (রাঃ)-এর মত ত্যাগ নিয়ে, খালেদ বিন ওলিদের (রাঃ) মত বীরত্ব নিয়ে, আমির হামজার (রাঃ) মত হিম্মত নিয়ে, ইমাম হোসায়েন (রাঃ)-এর মত শৌর্য-বীর্য নিয়ে তুমি জাগো। যার নিষ্কাসিত তরবারী ও ক্ষুরধার লেখনী উনবিংশ শতকের অন্ধকারের মাঝে জাগরণের বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল সেই গাজী আল্লামা ইসমাঈল শহীদের মত তুমি জাগো।

হে মুছলিম! তোমার শিক্ষা ও সভ্যতার কাছে  সারা দুনিয়া ঋণী। বিংশ শতাব্দীর সভ্যযুগের মানত তোমার সভ্যতার কাছে মাথা নত করেছে। জাবেরের মত, আল-ফাজারীর মত, আল-খারেজমীর মত, আল-হাছিব, আল-কারাজী ও আল-খাইয়ামের মত অঙ্কশাস্ত্রের মহাপন্ডিতদের অভ্যুদয় তোমার মাঝেই ঘটেছিল। হে মুসলিম- তোমার মাঝে আবু মাশা, মাশা আল্লাহ, মোহাম্মদ আলভেন্দী, মোহম্মদ ইবনে ইবরাহীম, ইবনে মুছা, ইয়াকুব ইবনে তরিক, ইয়াকুব ইবনে ইসহাক ও আলী ইবনে ইউনুছের মত জ্যোতির্বিজ্ঞানের আবিষ্কারকগণ আর্বিভাব হয়েছিল। পদার্থ বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠতম আল-হাছানের আর্বিভাব তোমারই মাঝে ঘটেছিল।

হে মুছলিম! রসায়ন শাস্ত্রের স্থপতি তুমি । তোমার মাঝে রসায়ন বিজ্ঞানের জন্মদাতা আবু মুছা জাবের ইবনে হাইয়ানের অভ্যুদয় ঘটেছিল। আর্সেনিক, অ্যান্টমনি, নাইট্রিক, এসিড, সিলভার নাইট্রিক, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, মারকিউরিক ক্লোরাইড, মারকিউরিক অক্সাইড, লিভার অফ্ সালফার ভিট্রিয়ল অ্যালাম, আলমাররী, সাল আমনিক, সল্টপিটার, লীড এসিটেড প্রভৃতি আবিষ্কার করে আবু মুছা রসায়ন শাস্ত্রের প্রভূত উন্নতি সাধন করেছেন।

হে মুছলিম! চিকিৎসা বিজ্ঞানে তোমার অবদান অফুরন্ত। অস্ত্রোপচারের যে পদ্ধতি তুমি আবিষ্কার করেছ, সর্বযুগের সভ্য মানুষ তার কাছে ঋণী থাকবে। হে মুছলিম! স্থাপত্য শিল্পের সাধনায় তুমি জগতের শীর্ষস্থান অধিকার করেছ। আগ্রার তাজমহল, জেরুজালেমের ওমরের মসজিদ, কনষ্টান্টিনোপল বা ইস্তাম্বুলের সেন্টসফিয়া মসজিদ, দিল্লীর কুতুর মিনার, স্পেনের আল-হামরা ও কর্ডোভার মসজিদ তোমার সাধনাকে সাফল্যদান করে দুনিয়াকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।

হে মুছলিম! নারীর অধিকার তুমি দিয়েছে। মানবত্বের দিক দিয়ে, মানুষ্যত্বের দিক দিয়ে নারী যে পুরুষের উর্ধে উঠতে পারে একথা তুমিই বলেছ। চৌদ্দশত বছর পূর্বে তুমি বলেছ কন্যা পিতার সম্পত্তির অংশ পাবে। তুমি বিধবাকে পুনর্বিবাহের অধিকার দিয়েছ।

হে মুছলিম! তুমি উঠ, জাগো। তোমার লুপ্ত শক্তিকে আবার ফিরিয়ে আনো। যে আদর্শে উদ্ধুদ্ধ হয়ে, যে প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে, অল্প সংখ্যক মুছলিম সারা বিশ্বের মাঝে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হযেছিল সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে , তোমার অতীত শক্তিকে আবার ঘুরিয়ে নিয়ে এসো।

হে মুছলিম! তুমি তো দুর্বল নও। তোমার মাঝে দেখতে পাই হামজার মত, ওমররে মত, আলীর মত, তারিকের মত, ইমাম হোসায়েনের মত, মুহাম্মদ বিন কাসিমের মত, আল্লাম ইসমাইলের মত বীর যোদ্ধাদেরকে। তোমার মাঝে দেখেছি একদিন হাসান বছরীর মত, জোনায়েদ বাগদাদীর মত, আব্দুল কাদের জিলানীর মত, শাহ অলিউল্লার মত, আবিল হাওয়ারীর মত, শেখ ইবরাহীমের মত, বায়োজীদ বোস্তামীর মত, আব্দুল্লাহ গজনবীর মত, শাহ জাকেরের মত, যিননুন মিছরীর মত মহা সাধকদেরকে।  হে মুছলিম মাতা ও ভগ্নিগণ- তোমরা জাগো ফাতেমার মত, আয়েশার মত, রাবেয়া বছরীর মত তোমরা জাগো।

হে মুছলিম তুমি জেনে রেখো, ‘‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালাকে বাদ।’’ আসুক আবার চেঙ্গিস, আসুক হালাকু, আসুক ফেরাউন ও শাদ্দাদ, আসুক মিরজাফর ও উমিচাঁদ, তুমি ভীত হয়ো না, তুমি দিশেহার হয়ো না।

হে মুছলিম তুমি জেনে রেখো, ফেরাউনের স্বৈরাচারের কাছে হযরত মুসা মাথা নত করেননি, দোর্দন্ড প্রতাপ সম্রাট নমরুদের অনাচারের কাছে ইবরাহীম নত হননি। লালসা সর্বস্ব এজিদের খেলাফতির কাছে ইমাম হোসায়েন দুর্বলতা প্রকাশ করেননি।

হে মুছলিম মূসার মত, হয়রত ইবরাহীমের মত, ইমাম হোসাইনের মত তুমি অসত্যের বিরুদ্ধে খাড়া হয়ে দাঁড়াও।

হে ভারতের সাড়ে চার কোটি মুছলিম ভাই সকল! তোমরা  তোমাদের অতীত ইতিহাসকে স্মরণ কর। বিভিন্ন ফিরকায়, বিভিন্ন দলে, বিভিন্ন মাযহাবে, বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত না হয়ে তোমরা একতাবদ্ধ হয়ে যাও। বিক্ষিপ্ত ও বিভিনণতাকে পরিহার করে, তোমরা কুরআন ও হাদীছের মর্মকেন্দ্রে সমবেত হযে শিক্ষার দিকে সন্তান সন্ততিদিগকে এগিয়ে দাও। তোমরা চাকুরী পাবে, গদী পাবে, আসন পাবে। ভয়ের কোন কারণ নেই। সাড়ে চার কোটি মুসলমানদের অধিকারকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। যারা সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হত না সেই বৃটিশ সিংহ তোমাদের অধিকারকে অস্বীকার করতে পারেনি।

হে মুছলিম! তুমি ঢেউ দেখে নৌকা ডুবিয়ে দিওনা, কুরআন বলছে- ‘‘আনতুমুল আলাওনা ইন কুনতুম মুমেনীন’’। তোমরা উচ্চ আসন অধিকার করবে যদি তোমরা মুমেন হতে পার। যদি তোমরা আত্নশুদ্ধ হতে পারো।

হে মুছলিম! ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য তুমি আত্মনিয়োগ কর। কুরআন বলেছ- ‘‘জাহেদু ফি সাবিলিল্লাহে বে-আমওয়ালেকুম ওয়া আনফুছেকুম’’। আল্লার জন্য, ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য, শান্তির জন্য তুমি যাবতীয় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর; তোমার জান দিয়ে তোমার মাল দিয়ে। তুমি সর্বশক্তিকে নিয়োজিত রাখো আল্লার মনোনীত দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য।

হে মুছলিম পতিতকে উদ্ধার করবার জন্য,অন্ধকে পথ দেখানো জন্য, আর্তের সেবা করার জন্য, ব্যথিতের ব্যথা মোচনের জন্য, মূর্খকে জ্ঞান দানকরবার জন্য, স্বৈরাচার শাসকের অবসান ঘটবার জন্য তুমি জেগে ওঠো। জাগো নারী, জাগো পুরুষ, জাগো কিশোর, জাগো তরুণ, জাগো জ্ঞানী, জাগো মূর্খ-আবার তোমরা জাগো। (৯ম বর্ষ ৫ম সংখ্যা ‘পয়গামে’ প্রকাশিত)

সাধনায় সিদ্ধি লাভ হইবে নিশ্চয়

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করে জ্ঞান দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, বিবেক দিয়ে, শক্তি দিয়ে, সাহস দিয়ে, মনীষা দিয়ে, চেতনা দিয়ে, শৌর্য দিয়ে, বীর্য দিয়ে, চলৎশক্তি দিয়ে, দর্শন শক্তি দিয়ে, বাকশক্তি দিয়ে ও শ্রবণশক্তি দিয়ে দুনিয়ার বুকে পাঠিয়েছে এবং উন্নতি অবনতির পথও জানিয়ে দিয়েছে। যারা আল্লাহর দেওয়া শক্তিকে কাজে লাগাতে পেরেছে, তারাই দুনিয়াকে করতলগত করে মহীয়সী জীবনের অধিকারী হতে পেরেছে। আর যারা আল্লাহর দেওয়া শক্তিকে ঠিকমত কাজে লাগাতে পারেনি তাদের মানব জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, তার অবনতির নিম্নস্তরে নেমে গেছে।

যখন কোন মানুষ উন্নতির দুর্ণিবার বাসনা নিয়ে জীবনের কর্মক্ষেত্রে পদনিক্ষেপ করে, তখন তার প্রত্যেক পদে পদে বাধা পড়ে। ইহাই হচ্ছে মানবত্ব লাভের পরীক্ষা। কিন্তু শত বাধা, শত ঝঞ্ঝা, শত বিপদ ও সমস্ত দুর্বলতাকে উপেক্ষা করে আল্লাহ তা’য়ালার উপর ভরসা রেখে কর্তব্য পথে অগ্রসর হতে থাকে, তারা সফল মনোরথ হতে পারে। কিন্তু যারা বিপদের মাঝে, বিভীষিকার মাঝে হিম্মত হারিয়ে দুর্বল ও কাপুরুষের মত ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চেয়ে থাকে, তাদের উন্নতির যাবতীয় রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।

জেনে রাখুন! মানুষ যতক্ষণ বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রম করতে পেরেছে ততক্ষণ সে উদ্দেশ্য সিদ্ধির শেষ ধাপে পৌঁছতে পারে না। ইতিহাসের পৃষ্ঠা খুললেই দেখা যায় পৃথিবীর বুকে কেবল ঐ সমস্ত লোক কামিয়াব হতে পেরেছে যারা কখন ভয়-ভীতির পরোয়া করেনি। মানুষের কর্ম জীবনের বিভিন্ন স্তরে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মানুষ নির্ভিকভাবে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েই অমরত্ব লাভ করেছে। পৃথিবীর যারা বীর সৈনিক তাদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, আলেকজান্ডার, খালেদ বিন ওয়ালীদ, আবু ওবাইদা, নেপোলিয়ান, নদিম শাহ প্রভৃতি শত শত বীর পুরুষদের আপনি দেখতে পাবেন যাঁরা শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে দুনিয়ার বুকে বড় হতে পেরেছেন। কখনও তাঁরা দুর্বলতাকে মনের মাঝে স্থান দেননি। বাঁধা যতই বেড়েছে হিম্মতও ততই বেড়েছে। বেশী দূর যাব না, ভারতের বাদশাহ আকবরের কথা চিন্তা করলেই আমরা জানতে পারবো যে কত বাধা ও শত্রুতার মাঝে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। অনুরূপভাবে দরবেশ, ওলি আল্লাহদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন, দেখতে পাবেন তাঁরাও কষ্ট, দুঃখ, ব্যর্থতা ও বাধা-বিপত্তি পরোয়া করেননি। দুনিয়ার প্রসিদ্ধ ধনিক ও ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন, তাঁরা ক্ষতি ও বিপদের আশঙ্কা হতে বেপরোয়া হয়ে কঠোর পরিশ্রমের ফলেই অগাধ ধন সস্পদের অধিকারী হতে পেরেছেন। তাঁদের কোশেশ দেখে ধন সস্পদ তাদের পায়ে লুটিয়ে পড়েছে।

এই বিংশ শতাব্দীর নামজাদা ব্যক্তিদের অবস্থা চিন্তা করলে বুঝতে পারি তাঁরা চতুর্বিধ অশান্তি ও শত্রুতা হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জগতের ইতিহাসে নাম আঁকতে পেরেছেন। দেখুন মুস্তফা কামাল শত ঝঞ্জার মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুরস্ককে নব জীবন দান করেছেন। রেজা শাহ পাহপালভী, যিনি প্রথম জীবনে একজন মামুলী ধরণের লোক ছিলেন, যিনি যাবতীয় প্রতিকুল নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে ইরানের কর্তৃত্ব করবার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। মহাত্না গান্ধী, আবুল কালাম আজাদ ও পন্ডিত জওহরলাল নেহরু শত তকলীফ বরদাশ্ত করে আজাদী হাসিল করতে সক্ষম হয়েছেন। দুনিয়ার কোন মানুষ কোন জাতি কখনো কৃতকার্য হতে পারে না, যতক্ষণ তার ভয়, ভীতি ও দুর্বলতাকে পরিহার করে নিঃশেষে আত্মবলিদান করতে পারে। দুনিয়ার উন্নতিশীল জাতির প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় তাদের মধ্যে আছে সাহস ও বীরত্ব, ধৈর্য্য ও স্বৈর্য-আর তাদের মধ্যে আছে আঘাত প্রতিরোধ করার যোগ্য মনোবল এবং সেই মনোবলের কারণেই তার ক্রমাগতভাবে উন্নত হয়ে চলছে।

অতএর হে মুছলিম ভ্রাতৃবৃন্দ। আপনার যদি বড় হতে চান, নিজেদের উন্নতি করতে চান তাহলে নিঃশেষ আত্মবলিদান করতে শিখুন। হিংসুকের হিংসাকে, গর্বিত জনের তাচ্ছিল্য ও উপহাসকে অগ্রাহ্য করে, শত বিভীষিকা ও বিপদকে উপেক্ষা  করে কর্ম সমুদ্রে ঝঁপিয়ে পড়ুন। আসুক ঝঞ্ঝা, আসুক ঝটিকা। ভয় কি? (৯ম বর্ষ, ১৯শ সংখ্যা ৩০জুলাই ১৯৫৭ অর্ধ সাপ্তাহিক পয়গামে প্রকাশিত)।

এগিয়ে এস

মুছলমান! হে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম রাছূল (ছাঃ)-এর কালেমা পাঠকারী মুছলমান। ইছলামের জন্য, নিজের যথাসর্বস্ব বিসর্জনকারী মুছলমান। জালেম, অত্যাচারী ও স্বৈরাচারীর যাবতীয় ফন্দি-ফিকিরকে চুরমার করে আদালত ও ইনসাফের প্রতিষ্ঠাকারী মুছলমান! আজ তোমার সে অতীত গৌরব কোথায়?

মুছলমান! তুমি যখনই যে পথে ছুটেছ, সে পথেই তোমার সাধনা সফলতা লাভ করছে। জাতীয় গৌরবের বিজয় পতাকা তোমাকে তছলীম জানিয়েছে। তোমার সমুন্নত প্রত্যয় তাকদীরকে ওলট পালট করে ছেড়েছে। তোমার সুমহান ব্যক্তিত্ব অতি বড় আজাজীলেরও প্রাণে কম্পন জাগিয়েছে।

মুছলমান! তোমার সে হিম্মত ও ব্যক্তিত্ব আজ কোথায়? তুমি আজ চিন্তা কর। অনুধাবন করবার চেষ্টা কর! এখনও সময় আছে, তুমি গাফলতকে পরিহার কর। মুসলমান! তোমাকে আবার তোমার সর্বশক্তি আল্লাহর পথে নিয়োজিত করতে হবে। তুমি এখন নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছো? কবে তোমার এ ঘুমের অবসান ঘটবে? কবে তোমার সম্বিৎ ফিরে আসবে? তুমি আজ সর্বরোগে জর্জরিত। তোমার অর্থ আছে, কিন্তু তা তুমি কাজে লাগাতে জানো না। উপযুক্ত পথে ব্যয় করতে জানো না। সিনেমা হলে তোমাদের সংখ্যা বেশী। জুয়া ও মদের আড্ডাগুলিকে তুমিই গুলজার করে রেখেছ। কোর্ট কাছারীকে তোমরাই সরগরম করে রেখেছ।

যাবতীয় অন্যায় হতে তোমরা ফিরে এসো। আপোসে দলাদলি, কাটাকাটি, হানাহানি, বিবাদ বিসম্বাদ ভুলে যাও। কেবল বড় হওয়ার চেষ্টা কর। যা শিক্ষা কর নাই তা শিক্ষা কর। যা বোঝ না তা বুঝতে শিখো। যা জানো না, তা জানতে শেখো। যারা উন্নতি করতে চায় না তাদের বেঁচে থাকার কোনই প্রয়োজন নাই।

মুছলমান! শিক্ষার দিকে তুমি অগ্রসর হও। বৈজ্ঞানিক হও, দার্শনিক হও, শিল্পী হও, ব্যবসায়ী হও, আলেম হও, পন্ডিত হও, চিকিৎসাবিদ হও, সাহসী হও, বিশ্বাসী হও, যোদ্ধা হও, আদর্শ মানব হও। শরীর ও মনকে নূতনভাবে গড়বার চেষ্টা কর। বিলাসিতা বর্জন কর।

আজ আমাদের সমাজে নীচ চিন্তা, ক্ষুদ্র স্বার্থ ও পরস্পরের মধ্যে দলাদলি দেখা দিয়েছে। আমরা অসত্যকে সত্য মনে করে আসলকে ছেড়ে ছায়ার পশ্চাতে ছুটেছি। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য আমরা সবকিছু করতে লজ্জাবোধ করি না।

মুছলমান! তুমি দুর্বলতাকে পরিহার কর। তোমার দেহে, তোমার মনে, তোমার সংকল্পে ও তোমার কর্ম প্রচেষ্টায় যেন কোন প্রকার দুর্বলতা স্থান না পায়। জেনে রেখো, দুর্বলতাই শয়তানের বাহন। সর্বপ্রকার দুর্বলতাই জীবনের সম্পদকে লুণ্ঠন করে। দুর্বলতার মাঝে নিহিত থাকে মিথ্যা, ভয় ও আত্মপ্রতারণা। মুছলমান-এই দুর্বলতার কারণেই তুমি আজ জগতের কাছে হেয়, তুচ্ছ, অবহেলিত ও অপমানিত। তুমি পাথরের চেয়েও কঠিন হও। হীরকের মত মূল্যবান হও। আর তীক্ষ্ণধার তরবারীর চেয়েও তীক্ষ্ণতম হও। তুমি উন্নত জীবনের সাধনায় ত্যাগ-সুন্দর ও আত্মবিলীন কর্মী হও।

তোমার অতীত গৌরবকে ফিরিয়ে আনবার জন্য আত্মনিয়োগ কর। যার যতটুকু ক্ষমতা তাই নিয়ে অগ্রসর হও। এগিয়ে এস ধনিক, এগিয়ে এস মূর্খ, এগিয়ে এস তরুণ, এগিয়ে এস যুবক, এগিয়ে এস নারী, এগিয়ে এস পুরুষ, ধ্বংসোন্মুখ মুছলিম সমাজকে রক্ষা করবার জন্য এগিয়ে এস। (পয়গামে প্রকাশিত, ৯ম বর্ষ, ২৬ শে কার্তিক, মঙ্গলবার ১৩৬৪)।



বিষয়সমূহ: সুন্নাত
আরও