আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 9729 বার পঠিত

[‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী-এর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও দারুল ইফতার সম্মানিত সদস্য জনাব আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ গত ১৯ ফেব্রুয়ারী থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ১ মাস যাবৎ মুম্বাইভিত্তিক স্যাটেলাইট চ্যানেল ‘পীস টিভি’র বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে বক্তব্য রেকর্ডের জন্য দুবাই গমন করেন। ইতিপূর্বে ২০০৯ সালে প্রাথমিকভাবে পীস টিভি বাংলার পক্ষ থেকে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি তাদেরকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা ও পরামর্শ দেন এবং মোট ১২ জন বক্তার নাম নির্বাচন করে পাঠান। অত:পর চূড়ান্ত নির্বাচনের পর পীস টিভি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া ও যুক্তরাজ্য থেকে মোট প্রায় ২০ জন আলোচকের নিকট আমন্ত্রণপত্র পাঠায়। ২০১০ সালে পীস টিভি কর্তৃপক্ষ আলোচকদের বেশ কয়েকবার মুম্বাইয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা নিয়ে ব্যর্থ হয়। অত:পর তারা নিজেরাই বাংলাদেশে আসার চেষ্টা নিয়েও ব্যর্থ হন। পরিশেষে এ বছর তারা দুবাইয়ে সার্বিক ব্যবস্থাপনা করতে সক্ষম হন এবং প্রায় এক মাস ধরে তারা আলোচকদের বক্তব্য ধারণ করেন। দীর্ঘ একমাসের দুবাই সফর থেকে ফিরে আসার পর জনাব আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফের এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন ‘তাওহীদের ডাক’-এর পক্ষ থেকে নূরুল ইসলাম ও আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব- নির্বাহী সম্পাদক]  

তাওহীদের ডাক : জনাব, আপনারা গত ১৯শে ফেব্রুয়ারী থেকে ১৭ই মার্চ পর্যন্ত দীর্ঘ এক মাস দুবাইতে অনুষ্ঠিত পীস টিভি বাংলা’র জন্য বক্তব্য রেকর্ডের উদ্দেশ্যে গমন করেছিলেন। তো গোটা সফরটা আপনাদের কেমন লেগেছে?

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ : আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের সফরটা সব মিলিয়ে খুব সুন্দর হয়েছে। আমরা যে উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়েছিলাম, সে উদ্দেশ্য যথাযথভাবে পূরণ করতে পেরেছি বলেই মনে করছি এবং এর একটা সুফল ভোগ করব বলে আশা করছি। আমার মনে হয়েছে এতে করে আমরা পবিত্র কুরআন ও হাদীছের একটা উপযুক্ত খেদমত জাতির সামনে পেশ করতে সক্ষম হয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ।

তাওহীদের ডাক : আমাদের জানা মতে আপনি বা আপনার সাথীদের বেশ অনেকেই ইতিপূর্বে ক্যামেরার সামনে এভাবে দাঁড়াননি। তো নতুন এই অভিজ্ঞতা আপনাদের জন্য কেমন ছিল?

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ : এটাই ঠিক যে আমি ইতিপূর্বে কখনো ক্যামেরার সামনে বক্তব্য রাখিনি। উন্মুক্ত ময়দানে সাধারণ মানুষের সামনে বক্তব্য রাখাই আমাদের অভ্যাস। সেজন্য জনগণহীন পরিবেশে ক্যামেরার সামনে এভাবে বক্তব্য রাখা আমাদের জন্য প্রথমদিকে একটু ভারী মনে হয়েছিল। ক্যামেরার রেকর্ডিং-এর প্রাথমিক নিয়মকানুনগুলো অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বক্তব্য গুটিয়ে নিয়ে আসা, ক্ষণে ক্ষণে সতর্ক সংকেতের মুখে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা ইত্যাদি আমাদেরকে খুব বিব্রত করেছিল। পরবর্তীতে আলহামদুলিল্লাহ এতে অভ্যস্ত হয়ে যাই।

তাওহীদের ডাক : আপনাদের প্রাত্যহিক কর্মসূচি কি ছিল এবং দিনে কতগুলো বক্তব্য রেকর্ড করা হত?

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ : আমরা দুবাইয়ে থাকতাম হোটেল কাসেল্স আল-বারশা’তে। সেখানে আমাদের প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে প্রস্ত্তত থাকতে বলা হত। এরই মধ্যে আমরা গোসল করে প্রস্ততি নিয়ে নীচের রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা সেরে নিতাম। অতঃপর পীস টিভি বাংলা’র গাড়ি এসে আমাদের নিয়ে যেত ৪০/৪৫ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত প্রোগ্রামস্থলে, মিরদীফ নামক একটি এপার্টমেন্টে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা, বা কখনো রাত ৮টা এমনকি রাত ১০টা পর্যন্ত টানা প্রোগ্রাম চলত। ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত টানা ৩ ঘন্টা, অতঃপর যোহরের ছালাত ও দুপুরের খাওয়ার বিরতি এবং সামান্য রেষ্ট নেওয়ার পর আবার টানা প্রোগ্রাম- এই ছিল সারাদিনের কর্মসূচি। প্রতিদিন ২৫ মিনিট সময়সীমার প্রায় ১০/১২টি বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য রেকর্ড করা হত। যেদিন গ্রুপ ডিসকাশন (টক শো) হত সেদিন জীঈ নামক আরেকটি বাসায় নিয়ে যাওয়া হত। এছাড়া শারজাহ শহরে আরব সাগরের উপকূলবর্তী মামযার পার্কে প্রস্ত্তত করা সেটে বক্তব্য প্রদানের জন্য ২দিন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আর একদিন আরব সাগর থেকে কেটে নিয়ে আসা একটি কৃত্রিম ক্যানেলে জাহাজের ছাদে রেডি করা সেটে সারাদিন বক্তব্য রেখেছিলাম।

তাওহীদের ডাক : আপনার বক্তব্য/গ্রুপ ডিসকাশন সংখ্যা কতটি ছিল?

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ : আমি নিজে অংশগ্রহণ করেছি প্রায় ৭০টি গ্রুপ ডিসকাশনে। আর একক বক্তব্য যাকে বলা হচ্ছে ‘টিভি টক’ তার সংখ্যা ছিল মোট ১০৫টি। ‘মৃত্যু পরবর্তী যিন্দেগী’ অর্থাৎ ক্বিয়ামত, কবরের জীবন, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি বিষয়ের উপর প্রায় ৪০/৫০টি, ‘ফাযায়েলে আমল’-এর উপর প্রায় ৩০টি, আর ‘হালাল-হারাম’ ও ‘আদর্শ পরিবার’ ইত্যাদি বিষয়ে বাকিগুলো। আমাদের আর আলোচকদের মধ্যে আমানুল্লাহ ভাই বেশীরভাগই গ্রুপ ডিসকাশনে অংশগ্রহণ করেন, হাফেয আখতার ভাই ‘রিয়াযুছ ছালেহীন-এর ব্যাখ্যা’ অনুষ্ঠানটিতে আলোচনা করেন আর মুযাফ্ফর প্রায় ৯০টি ‘টিভি টক’ এবং ৭২টি গ্রুপ ডিসকাশনে অংশগ্রহণ করেছে।     

তাওহীদের ডাক : ডা: জাকির নায়েকের সাথে কি আপনাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল?

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ : না, আমাদের দীর্ঘ সফরে ডা. জাকির নায়ের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়নি। যদিও এ সময়ের মধ্যেই তাঁর দুবাই আসার কথা ছিল। কোন কারণবশত: শেষ পর্যন্ত তিনি আসতে পারেননি।

তাওহীদের ডাক : আপনাদের সফরসঙ্গী আর কারা ছিলেন? তাদের সাথে কি আপনাদের পারস্পরিক পরিচিতির সুযোগ হয়েছিল?

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ : আমাদের সাথে পারস্পরিক পরিচিতিমূলক কোন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। এর একটা কারণ- আলোচকরা সবাই একসাথে দুবাই পৌঁছেননি। আর দ্বিতীয় কারণ হল, টানা প্রোগ্রাম। আমাদের জানা ছিল না একসাথে এতগুলো বক্তব্য রেকর্ড করা হবে। যাওয়ার পরদিনই এভাবে ঠাসা অনষ্ঠানসূচির কবলে পড়তে হবে- এটা আমাদের ধারণা ছিল না। তাদের টার্গেট ছিল আমাদের কাছ থেকে প্রায় ১৩০০ বক্তব্য রেকর্ড করা। এ কাজে তারা মুম্বাই থেকে প্রায় ৬০/৭০ জন লোক সাথে নিয়ে এসেছিল, যাদের পরিচালক ছিলেন ইযহার ফরীদী। প্রোগ্রামের প্রধান সমন্বয়ক শেখ নূরুল ইসলাম এবং অন্য একজন আব্দুল আলীম ব্যতীত সবাই ছিলেন উর্দূভাষী। প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য সর্বপ্রথম দুবাই উপস্থিত হন ড. মুছলেহুদ্দীন (টাঙ্গাইল), মুহাম্মাদ হারুণ (সিলেট), সাইফুদ্দীন বেলাল (দিনাজপুর), শহীদুল্লাহ খান মাদানী (ঠাকুরগাঁও) এবং হাফেয আখতার মাদানী (নওগাঁ)। আমি, মুযাফ্ফর বিন মুহসিন (যুবসংঘ সভাপতি), আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল (ঢাকা যেলা আন্দোলন সভাপতি), শাহ ওয়ালীউল্লাহ (খত্বীব, সোবহানবাগ মসজিদ, ঢাকা) ও ইউসুফ আব্দুল মজীদ পৌঁছেন তিনদিন পর ১৯ শে মার্চ। আমাদের প্রায় ১ সপ্তাহ পর উপস্থিত হয়েছিলেন লন্ডন প্রবাসী তিন বাঙ্গালী আব্দুর রহমান (বাগেরহাট), আবুল কালাম আযাদ (নোয়াখালী) এবং আব্দুস সালাম (সাতক্ষীরা)। শেষ সপ্তাহে এসে পৌঁছান ড. লোকমান (প্রফেসর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়) এবং আহমাদুল্লাহ ত্রিশালী (ময়মনসিংহ)। এছাড়া শায়খ মতীউর রহমান মাদানী, বাদরুদ্দোজা নদভী প্রমুখ ইন্ডিয়ান বক্তারা ইতিপূর্বেই মুম্বাইতে যেয়ে বক্তব্য রেকর্ড করিয়ে এসেছিলেন। সুতরাং সবার সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে একত্রিত হওয়ার সুযোগ আমাদের হয়নি। তবে ব্যক্তিগতভাবে সবার সাথেই আলাপ-আলোচনা হয়েছে। 

তাওহীদের ডাক : আপনাদের প্রতি আয়োজকদের সহযোগিতা বা আতিথেয়তা কেমন ছিল?

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ : প্রথমে কিছুটা সমস্যা হলেও পরবর্তীতে আদর-আপ্যায়ন, সহযোগিতা-সহানুভূতিতে তারা তেমন ত্রুটি করেননি। থাকার ব্যবস্থা ছিল আরব সাগরের পার্শ্বে চমৎকার পরিবেশে এক ফোর স্টার হোটেল ‘কাসেল্স আল বারশা’তে। আর খানাপিনা ছিল খুব মানসম্মত ও উন্নত। যদিও আমাদের জন্য দেশীয় খাদ্যের ব্যবস্থা না থাকায় বেশ কষ্ট হয়েছে। আমাদের অন্যান্য সকল ব্যাপারেও তাদের যথেষ্ট নজর ছিল। বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে আমরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম, যা তাদের সহযোগিতা না থাকলে উৎরানো কঠিন হয়ে যেত। আলহাম্দুলিল্লাহ এ সকল ব্যাপারে তারা আমাদের প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন।

তাওহীদের ডাক : পীস টিভি বাংলা এ দেশের মানুষের মধ্যে কতটুকু প্রভাব রাখতে পারবে বলে আপনার মনে হয়?

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ : এ দেশের মানুষের মধ্যে পীস টিভি বাংলা আশা করছি যে একটা ভাল প্রভাব রাখবে। এ কারণে যে, এ দেশে ধর্মের নামে বিভিন্ন চ্যানেল চালু রয়েছে । যেসব চ্যানেলের মাধ্যমে জাতি সঠিক দ্বীনী জ্ঞান অনেকাংশেই পাচ্ছে না। এই হিসাবে এই চ্যানেলটি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের যথাযথ আলোচনা পেশ করছে- এ মর্মে জাতি এর দ্বারা বড় ধরনের উপকার পাবে বলে আমরা আশাবাদী। কিছু বিষয়ে আপত্তি থাকা সত্ত্বেও এ কথা বলা যায় যে, এর মাধ্যমে মানুষ কিছু উপকার হয়ত পাবে। যার প্রমাণ দেখছি- অনেক মানুষ আমাদেরকে বলছে যে, আপনার আলোচনা শুনলাম। খুব ভাল লেগেছে। আবার পথে-ঘাটে চলাচলের সময়ও কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছি। যেমন- কিছুদিন পূর্বে একটি টিকিট কাউন্টারের টিকিট নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছি। এমন সময় একজন লোক আমার মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনার নাম কি আব্দুর রায্যাক? বললাম, জ্বী হা। ‘ও হ্যা! আমরা পীস টিভি বাংলায় আপনাকে বক্তব্য দিতে শুনলাম, ভাল লেগেছে।’ এতে মনে হল, যে সব মানুষ সারাদিন টিভির সামনে বসে থাকে তারা মনে হয় ভালো কিছুও দেখে। এতে মনে হচ্ছে এ শ্রেণীর লোকদের কিছু উপকারে আসবে চ্যানেলটি। বিশেষত চ্যানেলটির কারণে এই শ্রেণীর মানুষ হয়ত পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিশুদ্ধ ইসলামী জ্ঞান অর্জনের জন্য নতুনভাবে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। এটা আশার কথা। 

তাওহীদের ডাক : পীস টিভি বাংলা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রচারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, এটা অত্যন্ত আশার কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই নীতির উপর তারা কতটুকু টিকে থাকতে পারবে বলে আপনার মনে হয়?

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ : আয়োজকদেরকে উপস্থিত যতটুকু দেখেছি, তাতে মনে হয় তাদের উপর আস্থা রাখা যায়। আশা করা যায় যে, তারা নীতির উপর টিকে থাকতে পারবে এবং ইনশাআল্লাহ তারা এতে সফল হবে। তাদের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত উন্নতমানের এবং তাদের নীতির উপর টিকে থাকার আত্মবিশ্বাস আলহামদুলিল্লাহ যথেষ্ট পরিমাণ মনে হয়েছে।                 

তাওহীদের ডাক : জনাব, উন্মুক্ত ময়দান এবং মিডিয়া উভয় ক্ষেত্রেই আপনার রয়েছে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা। এখন আমাদের প্রশ্ন, এ দু’টি মাধ্যমের মধ্যে কোনটিকে আপনি সমাজ সংস্কারের জন্য অধিক ফলপ্রসূ মনে করেন?

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ : দু’টি মাধ্যম আসলে দু’ভাবে কাজ করতে পারে। খোলা ময়দানের বক্তব্যে সাধারণ জনগণ, সাধারণ নারী-পুরুষ সবাই উপস্থিত হয়, এ দিক চিন্তা করলে এ মাধ্যমেই দ্বীন প্রচারের সুফল বেশী। কেননা এতে সাধারণ জনগণ সরাসরি উপকার লাভ করতে পারে এবং এতে তাদের মধ্যে প্রভাব বেশী পড়ে। আবার টিভি মিডিয়ার মাধ্যমে এমনও কত লোক আলোচনা শোনে, যারা হয়তবা কখনো উন্মুক্ত ময়দানে দ্বীনী আলোচনা শুনতে যায় না বা যাওয়ার সুযোগ হয় না। এ দিক দিয়ে বলা যেতে পারে টিভি মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষিত মানুষ বা যারা ধর্মকর্ম নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী নয়, তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ হবে এবং তাদেরকে দ্বীনের দিকে ফিরিয়ে আনা সহজ হতে পারে। আর একটা ব্যাপার উন্মুক্ত ময়দানের তুলনায় টিভি মিডিয়ার দর্শক সংখ্যাও অনেক বেশী। সারাবিশ্ব থেকে বাঙ্গালীরা আমাদের আলোচনা শুনতে পারছে। এটা বড় একটা দিক নিশ্চয়।

তাওহীদের ডাক : জনাব, বর্তমানে টিভি মিডিয়ার কুপ্রভাবের দিকে যদি আমরা নজর দেই, তাহলে উন্মুক্ত ময়দানে দাওয়াত প্রদান এবং টিভি মিডিয়ার মাধ্যমে দাওয়াত প্রদান- এ দু’টির মধ্যে কোনটিকে আপনি বেছে নিতে চাইবেন?

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ :  আসলে যদি বিষয়টি এভাবে চিন্তা করা হয়, তাহলে মূলত: টিভি মিডিয়া আশীর্বাদ নয়; বরং অভিশাপই। এর উপকারী দিকটা গ্রহণ করতে যেয়ে এর অনৈতিক, অপকারী দিক থেকে মানুষ স্বীয় আত্মাকে কতটুকু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে বা পারছে তা ভাববার বিষয়। টিভি মিডিয়ার সঠিক ব্যবহার এদিক থেকে খুবই কঠিন। এই বিষয়টি নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিন্তা করি যে, আসলে দ্বীনের ব্যাপারে এখানে কতটুকু সহযোগিতা করছি। ইতিমধ্যে অনেকেই বলছেন, আব্দুর রায্যাক ছাহেব যখন চ্যানেলে কথা বলছেন, তাহলে আমরা বাড়িতে একটা টিভি কিনি বা ডিশ লাইনের ব্যবস্থা নিই। বহু মানুষের মুখে ইতিমধ্যে এটা শুনছি। তখন আমি ভাবছি যে, আল্লাহ তুমি মাফ কর। আমরা ওখানে কল্যাণের আশায়ই গিয়েছি। মানুষ যদি এটা ভুল পথেই বেশী ব্যবহার করে, তবে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। সর্বোপরি আমার একান্ত বিশ্বাস, ওলামায়ে সালাফ অর্থাৎ আমাদের পূর্বসুরী আলেমগণ যে খোলা মাঠে, উন্মুক্ত ময়দানে যেয়ে মানুষকে দ্বীনের কথা শুনিয়েছেন, তাতে খুলূছিয়াত অনেক বেশী আছে। এতেই অনেক পাপ থেকে মুক্তির ব্যাপার আছে, আর এতেই আল্লাহর কুবূলিয়াত বেশী আছে। এটাই আমি বুঝি।  

তাওহীদের ডাক : আপনার বিশেষ কোন অভিজ্ঞতা, সুখকর বা তিক্তকর? 

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ : ওখানে গিয়ে বিশেষ করে আমার জন্য কষ্টকর ব্যাপার ছিল এই যে, পীস টিভিতে এভাবে কথা বলতে হবে এ মর্মে আমাদের কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। যদিও আমরা বিষয়ভিত্তিক প্রস্ত্ততি নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এত বেশী বক্তব্য দিতে হবে তাও ছিল আমাদের চিন্তার বাইরে। আমরা ভাবছিলাম যে, আমাদের প্রতি মনে হয় অত্যাচার করা হচ্ছে। যদি এই আয়োজন আমাদের দেশে হত, বা আমাদের চলে যাওয়ার কোন পথ-ঘাট থাকত, হয়তবা আমরা এ সব ছেড়ে চলে যেতাম। আমরা ভাবছিলাম আমরা ওদের যুলুমের শিকার। আর ওরা ভাবছে যে, তাদেরকে যে কোন মূল্যে ১৩০০ প্রোগ্রাম রেকর্ড করতেই হবে। উপরন্তু অজ্ঞাত কোন বিষয়ে হঠাৎ করে টক শো বা টিভি টক-এ বক্তব্য রাখাটাও আমাদের জন্য ছিল বড়ই অস্বস্তিকর। ফলে সফরের প্রথমদিকে প্রোগ্রামের বিপুল চাপ আমাদের জন্য খুব কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। আর খাবার-দাবার নিয়েও আমরা অসুবিধায় ভুগেছিলাম। অতি উন্নতমানের হলেও সে খাবার আমাদের রুচির সাথে এডজাস্ট হত না। সব মিলিয়ে আমরা প্রথমে ভাবছিলাম আমাদের বুঝি এখানে আর থাকা হবে না। দেশে থাকলে এ সিদ্ধান্ত নিতে আমরা মোটেও দেরী করতাম না। আর মজার অভিজ্ঞতা হল এই যে, ধীরে ধীরে এই জটিল পরিবেশের সাথে আমরা যখন অভ্যস্ত হয়ে গেলাম, তখন তাদেরকে দেখলাম যে, বিশেষ করে আমাদের ৩ জনের (আমি, মুযাফ্ফর ও হাফেয আখতার) প্রতি তারা খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছে। যেসব কাজ তারা আমাদের কাছে চাইছে তা আমাদের কাছে সুচারুভাবে পেয়ে তারা ছিল বেজায় সন্তুষ্ট। এ জন্য সফরের শেষদিনে বিশেষ করে আমাদের সম্মানে তারা দুবাই শহর ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন। সেদিন আমাদের ৩ জনের কাছ থেকে তারা আর কাজ নেননি। তাই এই দিনটি ছিল আমাদের জন্য সদ্য জেলখানা থেকে মুক্তির মত আনন্দের। এদিন আমরা বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন ১৬৩ তলাবিশিষ্ট ২৭১৭ ফুট উচ্চতার ‘বুর্জ খলীফা’ টাওয়ার (ব্যায়বহুল হওয়ায় টাওয়ারে উঠা হয় নি) এবং তার পার্শ্বেই অবস্থিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ শপিং সেন্টার ‘দুবাই মল’ পরিদর্শন করলাম। এখানে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম এ্যাকুরিয়ামটি দেখে আমরা বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

তাওহীদের ডাক : দুবাই শহর কেমন দেখলেন?

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ : দুবাই শহরটা প্রশাসনিক দিক দিয়ে খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ও প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর। রাস্তাঘাটে পায়ে হেঁটে কোন মানুষজন চলাচল করে না। চারিদিকে খুব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। ট্রাফিক সিগন্যাল পড়া মাত্রই গাড়িগুলো সব থেমে যাচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশ নেই। অথচ কারো মাঝে আইন লংঘনের প্রবণতা নেই। কেননা সিগন্যাল অমান্য করলেই মোটা অংকের জরিমানা দিতে হয়। মরুভূমির দেশ। কেবল মাঝারী সাইজের খেঁজুর গাছ ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায় না। আমাদের দেশের রাস্তার পার্শ্বে শিশু, কড়ই বা এ জাতীয় যেসব গাছ লাগানো হয় তার কিছু কিছু সেখানেও লক্ষ্য করলাম। রাস্তার আইল্যান্ডগুলো চমৎকার ফুল ও পাতাবাহার গাছ দিয়ে সাজানো। মরুর দেশে এই সবুজের সমারোহ দেখে আশ্চর্য হতে হয়। পর্যটন শহর বলে বিধর্মী নারী-পুরুষের সংখ্যা দুবাইয়ে প্রচুর। তাদের পোশাক-আশাকে পশ্চিমা ছাপ। আর শহর জুড়ে কেবল হোটেল আর হোটেল। আবাসিক বাড়ির সংখ্যা খুবই কম। সামাজিক পরিবেশ বা মানুষের পারস্পরিক আচরণে কোথাও কোন উচ্ছৃংখলতা, অনিয়মতান্ত্রিকতার চিহ্ন পেলাম না।

দুবাই ছাড়াও আমরা আবুধাবী ও শারজাহ শহরে গিয়েছিলাম। আবুধাবীতে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম মসজিদ ‘শেখ যায়েদ গ্রান্ড মসজিদ’ পরিদর্শনে গেলাম। সেখানে আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠাতা ও ১ম বাদশাহ শেখ যায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের কবর রয়েছে। যার পার্শ্বে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা কুরআন তেলাওয়াত করা হয়। প্রতি ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট পর পর তেলাওয়াতকারী পরিবর্তন হচ্ছে। যাদের প্রত্যেকের মাসিক বেতন ৮ হাজার দিরহাম এবং বখশিশ আরো ৩ হাজার দিরহাম। এ ধরনের বিদ‘আত বিশ্বের আর কোথাও চালু আছে কি না আমার জানা নেই। এ মসজিদের কার্পেটটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্পেট (৬০,৫৭০ বর্গফুট)।

তাওহীদের ডাক : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান মতামত ও অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের পাঠকদের উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করার জন্য। আশা করি আমরা সকলেই এ থেকে উপকৃত হব। জাযাকাল্লাহু খাইরান।

আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ :   শুকরিয়া, বারাকাল্লাহু ফীকুম।



বিষয়সমূহ: সাক্ষাৎকার
আরও