আরাফার দিনে ছিয়াম পালন করা
আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শেখ আব্দুছ ছামাদ 9336 বার পঠিত
একটি
বিশাল ভূ-ভাগের সম্মিলিত নাম মধ্যপ্রাচ্য। বিশ্ব সভ্যতার এক সুপ্রাচীন
গৌরবোজ্জ্বল কেন্দ্রভূমি এই মধ্যপ্রাচ্য। এ অঞ্চলের প্রায় সকল রাষ্ট্রেই
রাজতন্ত্র প্রচলিত। ফলে আর যাই হোক এ রাজতন্ত্র অন্ততঃ বিগত কয়েক দশক যাবৎ এ
অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল রেখেছিল। ব্যতিক্রম ছিল
শুধুমাত্র ফিলিস্তীন। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের ন্যায় হঠাৎ করে গত ১৪
জানুয়ারী’১১ তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলীর পতনের মধ্য দিয়ে গোটা
মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল গণআন্দোলনের বহ্নিশিখা। তিউনিসিয়া,
মিশর, জর্ডান, লেবানন, মরক্কো, আলজেরিয়া ও সিরিয়া হয়ে এ গণবিক্ষোভের
অগ্নিস্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকা মহাদেশের ৯৭% মুসলমানের দেশ লিবিয়ায়।
প্রতিটি রাষ্ট্রের বিক্ষোভকারীদের একটাই দাবী- সরকার পতন। এতদ্ভিন্ন
অন্যকোন দাবী তাদের নিকটে একেবারেই গৌণ ছিল। জনরোষে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট
যায়নুল আবেদীন বিন আলীর (বেন আলী) ক্ষমতা ছেড়ে পলায়নের কারণে মধ্যপ্রাচ্য
তথা মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিক্ষোভকরীরা আরো বিপুল উৎসাহে গোটা
মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক সরকার বিরোধী বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মিশরে
গণআন্দোলনে দীর্ঘ ৩০ বছর ক্ষমতার মসনদ অাঁকড়ে থাকা প্রেসিডেন্ট হোসনী
মোবারকের পতনের পরপরই সুদীর্ঘ চার দশক ব্যাপী ক্ষমতায় থাকা লিবিয়ার
একচ্ছত্র অধিপতি কর্নেল মুআম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে শুরু হয় আন্দোলন। যা
অদ্যাবধি অব্যাহত আছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা এসমস্ত
রাষ্ট্রনায়কদের বিরুদ্ধে হঠাৎ করে কেনইবা জনগণের এই বিক্ষোভ? এর
উদ্দেশ্যইবা কি? বিশ্বের অন্যান্য দেশের পরিবর্তে শুধুমাত্র মুসলিম
দেশগুলোতে এই আন্দোলন কেন? আন্দোলনের উৎস কি? আর এ আন্দোলনকারীদের খুঁটির
জোরইবা কোথায়? এ সমস্ত বিষয়সহ সংঘাতময় লিবিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি বক্ষ্যমাণ
প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়।
লিবিয়া পরিচিতি : আফ্রিকা মহাদেশের ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত উত্তর আফ্রিকার একটি দেশ লিবিয়া। এর উত্তরে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে মিশর, দক্ষিণ-পূর্বে সুদান, দক্ষিণে শাদ ও নাইজার এবং পশ্চিমে আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া। রাজধানী : ত্রিপোলী। আয়তন : ১৭,৫৯,৫৪০ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্য : ৫৫ লক্ষাধিক। এ জনসংখ্যার ৯৭% সুন্নী মুসলমান এবং শিক্ষার হার ৭৯.১%। প্রধান ভাষা : আরবী, ইতালীয় ও ইংরেজী। মাথাপিছু জিডিপি : ৬,৫১০ ডলার। দেশটিতে প্রায় ১৪০টি উপজাতি-গোত্র রয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত লিবিয়া তিনটি (ত্রিপোলী, সাইরেনিকা ও ফেজান) পৃথক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি অঞ্চলেরই ভিন্ন ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে কার্থেজিয়ানরা উত্তর-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যবসায়িক কেন্দ্র স্থাপন করে এবং এ অঞ্চলটিকে ‘ত্রিপোলিটানিয়া’ নামকরণ করে। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে গ্রিকরা উত্তর-পূর্ব উপকূলীয় এলাকায় উপনিবেশ স্থাপন করে এবং এ অঞ্চলটিকে একটি প্রদেশে পরিণত করে। যার নামকরণ করা হয় ‘সাইরেনিকা’। আর দক্ষিণ-পশ্চিম মরুভূমি অঞ্চলে বসবাস করত নোমাশরা। যে অঞ্চলটি পরিচিত ছিল ‘ফেজান’ নামে। ৬৪০ ও ৬৪২ খৃষ্টাব্দে যথাক্রমে ত্রিপোলী ও সাইরেনিকা দখল করে নেয় আরবরা। পরবর্তীতে ১৫০০ খৃষ্টাব্দে অটোম্যান সাম্রাজ্য ত্রিপোলী, সাইরেনিকা ও ফেজান তিনটি অঞ্চলই নিজেদের দখলে নেয় এবং ১৯১২ খৃষ্টাব্দে ইতালী কর্তৃক এ অঞ্চল তিনটি দখলের পূর্ব পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ত্রিপোলী এবং সাইরেনিকা ব্রিটিশদের অধীনে এবং ফেজান প্রদেশ ফরাসীদের অধীনে চলে যায়। ১৯৪৯ খৃষ্টাব্দে ব্রিটেন সেনোসি উপজাতীয় শাসক আমির মুহাম্মাদ ইদ্রীস আল সেনুসিকে সাইরেনিকার আমির হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫০ খৃষ্টাব্দে জাতিসংঘের অনুমোদনের ভিত্তিতে এবং সাইরেনিকার আমিরের নেতৃত্বে লিবিয়া একটি ফেডারেল সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৫১ খৃষ্টাব্দে লিবিয়া ইতালীর কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ঐ বছরেই ২৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘ লিবিয়াকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করে।
গাদ্দাফির পরিচয় ও শাসনকাল : তাঁর পূর্ণ নাম মুআম্মার আল- গাদ্দাফী। জন্ম : ৭ জুন ১৯৪২ খৃষ্টাব্দে ইতালীয়ান লিবিয়ার সির্ট (Sirt) অঞ্চলে।
১৯৫১ খৃষ্টাব্দে ইতালীর কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে লিবিয়া শাসন করে চলেছিলেন বাদশাহ মুহাম্মাদ ইদ্রীস। কিন্তু বাদশাকে মোটেও পসন্দ হয়নি কর্নেল মুআম্মার গাদ্দাফির। ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর শারীরিক অসুস্থতার কারণে বাদশাহ ইদ্রীস তখন দেশের বাইরে। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে মোটেও ভুল করেননি গাদ্দাফী। তাঁর অনুসারী সেনাবাহিনীর তরুণ কিছু কর্মকর্তাকে নিয়ে লিবিয়াতে এক রক্তপাতহীন সফল সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তিনি মাত্র ২৭ বছর বয়সে লিবিয়ার ক্ষমতা দখল করেন। মুহূর্তেই পাল্টে যায় লিবিয়ার প্রেক্ষাপট। নিজেকে রেভ্যুলেশনারী কমান্ড কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে জন্ম দেন ‘রিপাবলিক অব লিবিয়া’ নামে একটি রাজনৈতিক দলের। ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারী ১২ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রীসভা গঠন করে তিনি নিজেকে লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঘোষণা করেন। এর দুই বছর পর তিনি লিবিয়ার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে ‘নেতা’ উপাধি গ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র ত্রিপোলীতে বিমান হামলা চালায়। ১৯৮৮ সালে স্কটল্যান্ডের লকারবির আকাশে আমেরিকার বিমান হামলার পর লিবিয়া আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন পশ্চিমা অবরোধে থাকার পর ২০০৩ সালে পশ্চিমাদের সাথে পুনরায় তাঁর সুসম্পর্ক তৈরী হয়।
গাদ্দাফী বিরোধী আন্দোলন : তীব্র গণআন্দোলনের মুখে তিউনিসিয়া ও মিশরের প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর লিবিয়ার জনগণ উৎসাহিত হয়ে দীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ একচেটিয়াভাবে ক্ষমতায় থাকা গাদ্দাফীকে উৎখাত করতে ১৫ ফেব্রুয়ারী হতে আন্দোলন শুরু করে। রাজধানী ত্রিপোলীর কেন্দ্রে অবস্থিত গ্রিন স্কয়ার (স্বাধীনতা স্কয়ার) হল এ আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু। আন্দোলনের মাধ্যমে গোটা লিবিয়া দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। গাদ্দাফী বিরোধীরা পূর্বাঞ্চলে গাদ্দাফীর কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে সেখানে একটি ‘মুক্তাঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা করে। অন্যদিকে রাজধানীসহ পঞ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ ত্রিপোলী ও তার আশপাশের এলাকা থাকে গাদ্দাফীর নিয়ন্ত্রণে। সেনাবাহিনীর ও মন্ত্রী পরিষদের কিছু সদস্য এবং প্রধান প্রধান কিছু গোত্র বিরোধী পক্ষে যোগ দেয়ার ফলে দেশটি কার্যত গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। সরকারী এবং বিরোধী উভয় পক্ষের গোলাগুলিতে অসংখ্য নিরস্ত্র সাধারণ জনগণ প্রাণ হারায়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে বিরোধীপক্ষ দুর্বল হয়ে পিছু হটতে থাকে এবং পশ্চিমাদের নিকট সাহায্যের আবেদন জানায়। ফলে গৃহযুদ্ধ রূপ নেয় সর্বাত্মক যুদ্ধের।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব : বিরোধীদের আহবানে সাড়া দিয়ে লিবিয়ার সাধারণ জনগণকে সাহায্য ও মুক্ত করার নামে জাতিসংঘের ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদ এক বৈঠকে বসে। বৈঠকে ১৯৭৩নং প্রস্তাবের ভিত্তিতে লিবিয়ায় গাদ্দাফীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানানো হয় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও লেবাননের পক্ষ থেকে। ১৫ সদস্যের মধ্যে ১০টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট প্রদান করে। অন্যদিকে বাকী পাঁচ সদস্য দেশ রাশিয়া, চীন, জার্মানী, ব্রাজিল ও ভারত ভোট প্রদানে বিরত থাকে।
নো ফ্লাই জোন ঘোষণা ও পশ্চিমা যৌথ বাহিনীর বিমান হামলা : লিবিয়ার কথিত গণতন্ত্রকামী এবং নীরিহ-নিরস্ত্র জনগণকে রক্ষার অজুহাতে নিরাপত্ত পরিষদের অধিকাংশ সদস্য দেশের ভোট পেয়ে প্রস্তাব অনুযায়ী লিবিয়াকে ‘নো ফ্লাই জোন’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সাথে সাথে প্রস্তাবটি কার্যকর করার জন্য যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও লেবাননের যৌথ বাহিনী ১৯ মার্চ হতে লিবিয়ায় শুরু করে সামরিক অভিযান ‘অপারেশন ওডিসি ডন’। যৌথ বাহিনী আকাশ থেকে বোমা বর্ষণ করে প্রতিদিন নৃশংসভাবে হত্যা করছে শত শত অসহায় শিশু ও নিরস্ত্র-নিরপরাধ নারী-পুরুষকে। ধ্বংস করা হচ্ছে বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা। এদিকে মুআম্মার গাদ্দাফীর পক্ষ থেকে একাধিকবার যুদ্ধ বিরতি ও শান্তি প্রস্তাব পেশ করা হলেও তা প্রত্যাখ্যান করে যৌথ বাহিনী তাদের যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। ফলে দেশটি যে অদূর ভবিষ্যতে ইরাক ও আফগানিস্তানে পরিণত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আন্দোলনের উৎস : গোটা মুসলিম বিশ্বজুড়ে যে গণআন্দোলন চলছে তার উৎস আসলে কি? জনগণ কি আসলেই দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা রাজতন্ত্রের পরিবর্তে পাশ্চাত্য থেকে আমদানীকৃত বস্তাপঁচা গণতন্ত্র চায়? নাকি এর পিছনে অন্যকোন স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র আছে? যদি প্রথমোক্ত কারণটিই মুখ্য হয়ে থাকে তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা এ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এতদিন কেউ মুখ খোলেনি কেন? হঠাৎ করে কেন মুসলিম বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের জনগণ একের পর এক সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করল? এ বিক্ষোভ ও আন্দোলনের কারণগুলোও সাধারণতঃ সবদেশে এক ও অভিন্ন। আর শুধুমাত্র রাজতন্ত্র পরিবর্তনের এই একটি ইস্যু এভাবে এত বড় বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে আদৌ কি সক্ষম? এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ও রহস্যের উৎস খুঁজতে প্রথমেই আমাদের সামনে আসে আন্তর্জাতিক ইসলাম বিরোধী মহল। যারা সবসময় সুযোগ মত ইসলামের সর্বনাশ সাধনে তৎপর। এদের লক্ষ্য সর্বদা মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের সর্বনাশ করা এবং মুসলিম দেশের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করা। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা প্রবাহে এমনটিই অনুমিত হচ্ছে।
এটা স্পষ্টতঃই অনুভূত হচ্ছে যে, ইসলামবিদ্বেষী একটি মহল সুচতুরভাবে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে তাদের স্বার্থ হাছিলের জন্য। আমরা যদি একটু পিছনের দিকে ফিরে তাকিয়ে সাতশত বছর পূর্বের স্পেনীয় মুসলিম শাসনের পতনের ইতিহাস মন্থন করে দেখি, তাহলে এখনকার ঘটনা এবং তখনকার ঘটনার মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। তৎকালীন স্পেনের মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের সর্বনাশ করেছিল ইসলাম বিরোধী শক্তি। স্পেনে মুসলিম শাসনাবসানের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও রাণী ইসাবেলা সৈন্যসহ গ্রানাডা নগরী ঘিরে ফেলে। বাদশাহ আবু আব্দুল্লাহ তখন তাঁর মন্ত্রীদের নিয়ে রাজদরবারে বসেছেন কর্তব্য-করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করতে। বাদশাহ সবার কাছে জানতে চাইলেন এ মুহূর্তে আমাদের করণীয় কি? তখন তরুণ সেনাপতি মূসা বিন আবী গাস্সান দাঁড়িয়ে বললেন ‘হে বাদশাহ! আমরা মুসলিম জাতি। আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংগ্রাম ও সাহসিকতার। আমাদের শরীরে সেই বীরদের রক্ত প্রবাহিত যারা নিজেদের রক্তকে ইসলামের জন্য ঢেলে দিয়েছিলেন। মুসলিম জাতি চির অজেয়। তাই আমার পরামর্শ হল জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ইসলামের জন্য যুদ্ধ করব। আসুন, আমরা আমাদের সৈন্যবাহিনী নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি...’। কিন্তু গাদ্দারে ভরা রাজদরবারে তার এই তেজোদ্দীপ্ত ভাষণ শ্রবণের কেউ ছিল না। ফলে শত্রুবাহিনীর সাথে সন্ধির পক্ষেই সবাই মত দিল। যা চিরকালের জন্য স্পেনের ভাগ্যাকাশে লিখে দিল গোলামীর কালিমা। স্পেন থেকে চির বিদায় নিল ইসলামী শাসন। বর্তমানেও ঠিক ঐ একই মহল যে, মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তা আর বলার অবকাশ রাখে না।
ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য : এ গণআন্দোলনে পাশ্চাত্যের স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের গন্ধ সুস্পষ্টভাবে অনুভূত হচ্ছে। তারা জনগণকে গণতন্ত্রের সুড়সুড়ি দিয়ে নষ্ট করছে ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের শান্তি ও স্থিতিশীলতা। যার অনিবার্য ভবিষ্যত হতে পারে মুসলিম বিশ্বের ভাঙ্গন। মুসলিম বিশ্বকে কব্জা করার এটিই অন্যতম একটি কৌশল পশ্চিমা বিশ্বের। কারণ তারা ভালভাবেই জানে যে, একখানা আস্ত রুটি একত্রে গিলে খাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং ‘Devide and Rule ‘পৃথক কর এবং শাসন কর’ এ নীতিকে সামনে রেখেই তারা এগিয়ে চলেছে তাদের লক্ষ্যপানে।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ তেল সমৃদ্ধ। আফ্রিকায় তেলনির্ভর দেশগুলোর মধ্যে লিবিয়া অন্যতম। এদিক দিয়ে নাইজেরিয়া ও আলজেরিয়া থেকেও এগিয়ে আছে দেশটি। লিবিয়ায় প্রমাণিত তেলের মজুদ ৪৬.৫ বিলিয়ন ব্যারেল, যা মিশরের ১০ গুণ এবং বিশ্ব মজুদের ৩.৫ শতাংশ। দৈনিক ১৪ থেকে ১৭ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলিত হয় এখানে। এখানকার ৮৫ শতাংশেরও বেশী তেল রপ্তানি হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে। এ তেল সম্পদের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের শ্যেনদৃষ্টি বহুকাল পূর্ব থেকেই। সুতরাং পশ্চিমারা গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তাদের পসন্দের ‘কাকতাড়ুয়া’ সরকার প্রতিষ্ঠা করে এ বিপুল তেল সম্পদ হাতিয়ে নেয়াও যে এ ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য তা আজ সূর্যালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট।
পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলমানেরা এক সময় বিশ্ব শাসন করলেও এখন মুসলিম বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। প্রবল পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধরাশায়ী করার পর মুসলিম বিশ্বকেই তারা তাদের একমাত্র প্রতিপক্ষ মনে করছে। তাই মুসলমানদের ঐক্য, সংহতি ও পুনর্জাগরণকে তারা ভাল চোখে দেখছে না। এজন্য নানা কৌশলে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রাখছে। উপরন্তু কোন মুসলিম দেশ অর্থনৈতিক বা সমরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করলে, কিভাবে সে দেশকে পরাভূত করা যায় সে চেষ্টায় তারা আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। নিজেরা পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কোন মুসলিম দেশ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হোক তা তারা কখনো চায় না। এজন্য প্রয়োজনে ঐ মুসলিম দেশের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করতেও তারা পিছপা হয় না। কোন মুসলিম দেশে হামলা করার সময় অন্য কোন মুসলিম দেশ যাতে প্রতিবাদ না করতে পারে সেজন্য তারা আগে থেকেই নানা অজুহাতে তাদের মুখে কুলুপ এঁটে দেয়। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে ইঙ্গ-মার্কিন হামলা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সুতরাং হে মুসলিম উম্মাহ! নিজেদের মাঝে অপ্রয়োজনীয় লড়াই বন্ধ করে নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করুন! পাশ্চাত্য থেকে আমদানীকৃত বস্তাপঁচা গণতন্ত্রকে পরিহার করে পরামর্শ ও সমঝোতার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করে মুসলিম ঐক্যকে সুদৃঢ় করুন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন!