কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য সম্মেলনে প্রদত্ত কেন্দ্রীয় সভাপতির উদ্বোধনী ভাষণ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
মীযানুর রহমান 11828 বার পঠিত
মদীনা
ইসলামী বিশববিদ্যালয় বিশুদ্ধ ইসলামী শিক্ষার বিস্তারে খ্যাতি অর্জনকারী এক
অনন্যসাধারণ বিশববিদ্যালয়। বিগত অর্ধশত বছর যাবৎ মুসলিম বিশ্বের
যুগশ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠটি পৃথিবীর বুকে আল্লাহর কালিমাকে সমুন্নত করতে ও
জনগণের মাঝে বিশুদ্ধ আক্বীদার প্রচার ও প্রসারে সালাফে ছালেহীনের প্রদর্শিত
পথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কেবলমাত্র সঠিক ইসলামকে উজ্জীবিত
করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ও নিবেদিত এমন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন
বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাদশাহ ফাহাদ যথার্থই
বলেছেন, ‘কেবলমাত্র ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদার প্রচার ও প্রসারের মহৎ
উদ্দেশ্যেই এ বিশববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে’। এজন্য সমসাময়িককালে এটি
সালাফী আন্দোলনের এক গৌরবোজ্জ্বল প্রতীকে পরিণত হয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে অত্র
বিশববিদ্যালয়টির পরিচিতি, প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও মুসলিম বিশ্বে সালাফী
দাওয়াতের প্রতিষ্ঠাদান ও বিকাশ সাধনে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাসমূহ সংক্ষেপে
তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
প্রতিষ্ঠার ইতিহাস :
সঊদী বাদশাহ আব্দুল আযীয (১৮৭৬-১৯৫৩ খৃঃ) ছিলেন ইসলামী শিক্ষা বিস্তার এবং সালাফী আক্বীদা প্রচার ও প্রসারের জন্য অন্তঃপ্রাণ। তিনি ইসলামের শাশবত আক্বীদার সর্বাঙ্গীণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে মুসলিম বিশেবর প্রখ্যাত বিদ্বানগণকে ঐক্যবদ্ধকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাদশাহ আব্দুল আযীয (রহঃ) বলেন, ‘আমার দু’টি মহান দায়িত্ব, যা পালনে আমি কখনও অবহেলা করব না; এক-আল্লাহর কসম, আমার ও আমার সন্তানদের, এমনকি গোটা রাজপরিবারের সদস্যদের রক্ত ‘আল্লাহ ছাড়া কোন হক্ব উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর প্রেরিত রাসূল’-তাওহীদের এ মর্মবাণীকে সমুন্নত করতেই ব্যয়িত হবে ইনশাআল্লাহ’...।
সত্যিই তিনি নির্ভেজাল তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় স্বীয় জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর রাজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন তাঁর সুযোগ্য পুত্র সঊদ বিন আব্দুল আযীয (১৮৯৯-১৯৬৮ খৃঃ)। পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে তিনিও ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ইসলামের শাশবত বাণী গোটা বিশেব পৌঁছে দেওয়ার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ইসলাম শিক্ষার শ্রেষ্ঠতম কেন্দ্র ‘মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার রাজকীয় ফরমান তাঁর হাত দিয়েই জারি হয়। অবশ্য এর পূর্বে বহু ইসলামী চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবি, লেখক ও সাংবাদিক মহল থেকে এ ধরনের একটি বিশববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোর প্রস্তাব আসতে থাকে। লেখনীর মাধ্যমে যাঁরা এ মহান দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ওবাইদ মাদানী, আহমাদ আব্দুল্লাহ আল-ফামী, আমীন মাদানী, মুহাম্মাদ সাঈদ আল-আমূদী, আব্দুস সালাম, হাশেম হাফেয, গালিব হামযা প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
অবশেষে বাদশাহ সঊদ বিন আব্দুল আযীয ইসলামী বিশববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যকরী পদক্ষেপ হিসাবে এক রাজকীয় ফরমানে (২৫.০৩.১৩৮১হিঃ/ ০৬.০৯.১৯৬১খৃঃ, ১১ নং সিদ্ধান্ত) বলেন, ‘শিক্ষার উন্নয়ন, জ্ঞানের প্রসার, কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফে ছালেহীনের নির্দেশিত পথে অবিচল থাকা এবং ইসলামের মর্মবাণী গোটা বিশেব পেঁŠছে দেওয়া আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। তাই আমরা নিম্নোক্ত বিষয়সমূহের উপর নির্দেশনা প্রদান করলাম :
১. ইসলামী বিশববিদ্যালয় নামে মদীনায় একটি বিশববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে।
২. এর আয়ের উৎস আমাদের নিজস্ব সম্পত্তির উপর নির্ভরশীল হবে।
৩. ১৩৮১-১৩৮২ হিঃ/১৯৬১-৬২ খৃঃ শিক্ষাবর্ষে সার্বিক ব্যয়ের জন্য তিন মিলিয়ন রিয়াল বরাদ্দ থাকবে।
৪. সঊদী আরব ও বহির্বিশেবর ছাত্ররা বিশববিদ্যালয়ের মৌলিক নীতিমালায় উল্লেখিত শর্তসাপেক্ষে অধ্যয়নের সুযোগ পাবে’।
এভাবেই বাদশাহ সঊদ বিন আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর তত্ত্বাবধানে মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ সুসম্পন্ন হয়। বাদশাহ সঊদ বলেন, ‘মহান আল্লাহ আমাদেরকে মদীনাতে একটি ইসলামী বিশববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার তাওফীক্ব দান করেছেন। আমরা আশা করি, এটি মুসলমানদের ঐক্য, তাদের হারানো শক্তি পুনরুদ্ধার ও গৌরব অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হবে’।
বিশববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য :
যেসব মহৎ ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যকে সামনে রেখে মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, নিম্নে তার কয়েকটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল :
বিশববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ মন্ত্রণা পরিষদ সদস্যবৃন্দ :
২২.১২.১৩৮১ হিঃ/ ২৩.০৫.১৯৬২ ইং তারিখে ইসলামী বিশববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরামর্শ সভার প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিশববিদ্যালয়ের প্রথম চ্যান্সেলর সঊদী আরবের সাবেক গ্রান্ড মুফতী শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহীম (১৩১১-১৩৮৯ হিঃ) -এর সভাপতিত্বে পরিচালিত উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন :
১. শায়খ আব্দুর রাযযাক আফীফী (মদীনা, সঊদী আরব)।
২. শায়খ হাসনাইন মাখলূফ (কায়রো, মিশর)।
৩. শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (সাবেক চ্যান্সেলর, মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয়)।
৪. শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ (সাবেক চ্যান্সেলর, মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয়)।
৫. শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী (ইন্ডিয়া)।
৬. প্রফেসর আলী আত-ত্বানত্বাভী (দামেশক, সিরিয়া)।
৭. শায়খ মুহাম্মাদ আল-আমীন শানকীত্বী (শিক্ষক, মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয়)।
৮. শায়খ মুহাম্মাদ বাহজাহ আল-বায়ত্বার (সিরিয়া)।
৯. শায়খ মুহাম্মাদ সালেম আল-বায়হানী (এডেন, ইয়েমেন)।
১০. শায়খ মুহাম্মাদ দাঊদ গযনভী (লাহোর, পাকিস্তান)।
১১. শায়খ মুহাম্মাদ বাহজাত আল-আছারী (বাগদাদ)।
১২. শায়খ আবুল আলা মওদূদী (পাকিস্তান)।
১৩. শায়খ মুহাম্মাদ আল-ফাযিল বিন আশূর (তিউনিশিয়া)।
১৪. প্রফেসর মুহাম্মাদ আল-মুবারক (দামেশক)।
১৫. শায়খ মুহাম্মাদ মাহমূদ আছ-ছাওয়াফ (মক্কা)।
১৬. শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (সাবেক শিক্ষক, মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয়)।
১৭. শায়খ আব্দুল্লাহ আল-ক্বালক্বীলী (জর্ডান)।
১৮. শায়খ মুহাম্মাদ ইউনুস (জাকার্তা, ইনেদানেশিয়া)।
বিশববিদ্যালয়ের ভৌগলিক অবস্থান :
ইসলামী শিক্ষার অন্যতম প্রতীক এ বিশববিদ্যালয়টি ইসলামের প্রথম রাজধানী, অহির অবতরণস্থল, রাসূল (ছাঃ)-এর প্রিয় শহর মদীনার নয়নাভিরাম ভূখন্ড, প্রসিদ্ধ আক্বীক্ব উপত্যকার পশ্চিম উপকূলে ঐতিহাসিক সা‘দ ইবনুল আছ প্রাসাদের সন্নিকটে অবস্থিত।
অনুষদ ও ছাত্র সংখ্যা :
২/৬/১৩৮১ হিঃ (১১ নভেম্বর ১৯৬১ খৃঃ) সনে রবিবার একটি মাত্র অনুষদে (শরী‘আহ) মাত্র ৮৫ জন ছাত্র নিয়ে এ বিশববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। উল্লেখ্য যে, বর্তমান মসজিদে নববীর খ্যাতিমান শিক্ষক যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ প্রথম কলাসটি নেন। যাই হোক, সময়ের আবর্তনে আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণী, কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও দক্ষ পরিচালনা এবং সঊদী সরকারের নিবীড় তত্ত্বাবধানের বদেŠলতে বর্তমান পাঁচটি অনুষদে বিশেবর ১৬০টিরও বেশী দেশ থেকে আগত ও স্থানীয় ছাত্রসহ প্রায় পনের হাজার ছাত্র অধ্যয়ন করছেন। ২০১১-২০১২ শিক্ষাবর্ষে নতুন ভর্তি করা হয়েছে ৬৫৭৮ জন শিক্ষার্থীকে। আগামীতে এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বর্তমান অনুষদগুলি হচ্ছে : শরী‘আহ, দাওয়াহ ও উছূলে দ্বীন, কুরআনুল কারীম ও ইসলামিক স্টাডিজ, হাদীছ ও ইসলামিক স্টাডিজ এবং আরবী সাহিত্য।
১. শরী‘আহ অনুষদ : এতে ফিক্বহ, উছূলে ফিক্বহ এবং ইসলামী বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে একটি উচ্চতর ডিপ্লোমা বিভাগ রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় ছাত্রদের জন্য ‘আন-নাযমাহ’ (النظمة) নামে একটি বিশেষ বিভাগ রয়েছে।
২. দাওয়াহ ও উছূলে দ্বীন অনুষদ : এ অনুষদটি ১৩৮৬ হিঃ/১৯৬৬ খৃঃ সনে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে রয়েছে চারটি বিভাগ- আক্বীদা, দাওয়াহ, ইতিহাস ও তারবিয়াহ।
৩. কুরআনূল কারীম ও ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদ : এ অনুষদটি ১৩৯৪ হিঃ/১৯৭৪ খৃঃ সনে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে দু’টি বিভাগ রয়েছে- ইলমুল ক্বিরাআত ও ইলমুত তাফসীর।
৪. হাদীছ ও ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদ : এ অনুষদটি ১৩৯৬ হিঃ/১৯৭৬ খৃঃ সনে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে দু’টি বিভাগ রয়েছে- ফিক্বহুস সুন্নাহ ওয়া মাছাদিরুহা এবং উলূমুল হাদীছ।
৫. আরবী সাহিত্য অনুষদ : এ অনুষদটি ১৩৯৫ হিঃ/১৯৭৫ খৃঃ সনে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতেও রয়েছে দু’টি বিভাগ- ভাষা বিভাগ এবং বালাগাত ও সাহিত্য বিভাগ।
উল্লেখ্য যে, এই অনুষদগুলিতে অনার্স (লিসান্স) এবং বিভাগসমূহে মাস্টার্স ও পিএইচ.ডি ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
অধ্যয়নরত ছাত্রদের সুযোগ-সুবিধা :
ছাত্রদের লেখাপড়া ও আনুষঙ্গিক ব্যয়ভার বহন করে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ছাত্রদের মাসিক যে বৃত্তি প্রদান করা হয়, তা তাদের লেখাপড়া, খানাপিনা, পোষাক-পরিচ্ছদসহ যাবতীয় ব্যয়ের পরও উদ্বৃত্ত থেকে যায়। বই-পুস্তক ক্রয় বাবদ বার্ষিক এককালীন অর্থ প্রদান করা হয়। কোন ফি ছাড়াই ছাত্রদের উন্নত আবাসন ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। বহিরাগত ছাত্রদেরকে প্রতি বছর বার্ষিক ছুটির সময় স্বদেশে যাতায়াতের জন্য বিমান টিকেট প্রদান করা হয়। প্রত্যেক দিন মাগরিব ও এশার ছালাত আদায়ের জন্য ছাত্রদেরকে বিশববিদ্যালয়ের বাসে করে মসজিদে নববীতে নিয়ে যাওয়া হয়। মাস্টার্স ও পিএইচ.ডি-তে অধ্যয়নরত বিবাহিত ছাত্রদের পরিবার নিয়ে আসার ভিসা এবং উপযুক্ত আবাসিক সুবিধা প্রদান করা হয়। এছাড়া মুসলিম সংখ্যালঘু দেশসমূহের ছাত্রদের পরিবার নিয়ে আসারও ভিসা প্রদান করা হয়। শিক্ষার্থীদের জন্য এত সুযোগ-সুবিধা বিশ্বের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। সারা বিশ্বে বিশুদ্ধ ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টায় সঊদী সরকার এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর মোটা অংকের আর্থিক বরাদ্দ প্রদান করে আসছে।
উল্লেখযোগ্য শিক্ষকবৃনদ :
মুসলিম বিশ্বের খ্যাতনামা ওলামায়ে কেরাম ও বিদ্বানদের পদধূলিতে গর্বিত হয়েছে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আযীয বিন বায (১৩৩০-১৪২০হিঃ), শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী, শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ, শায়খ মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বিত্বী, শায়খ আব্দুল ক্বাদের আল-হামাদ, শায়খ মুহাম্মাদ তাক্বীউদ্দীন আল-হেলালী, শায়খ হাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আল-আনছারী (১৩৪৩-১৪১৮ হিঃ), শায়খ ওমর ফালাতাহ (১৩৪৫-১৪১৯ হিঃ), ড.মুহাম্মাদ বিন মাতার আয-যাহরানী, রবী বিন হাদী আল-মাদখালী, শাযখ মুহাম্মাদ আরিফা সালেম, শায়খ আকরাম যিয়া উমরী, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আল-হাকীম, বর্তমান চ্যান্সেলর শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম প্রমুখ। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত বিদ্বান,আর-রাহীকুল মাখতুম গ্রন্থের লেখক আল্লামা ছফিউল্লাহ মুবারকপুরী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।
খ্যাতিমান ছাত্রবৃন্দ :
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় লক্ষাধিক ছাত্র অত্র বিশববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন সমাপ্ত করেছে। তন্মধ্যে ৬৬৩ জন ডক্টরেট, ১০৬৪ জন মাস্টার্স এবং বাকীরা অনার্স ডিগ্রী লাভ করেছেন। এ বিশববিদ্যালয় পাকিস্তানের আল্লামা এহসান ইলাহী যহীর (রহঃ)-এর মত অসংখ্য প্রথিতযশা মহাপুরুষের জন্ম দিয়েছে। জর্ডানের বর্তমান প্রধান বিচারপতি, সঊদী আরবে নিযুক্ত বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইনেদানেশিয়ার রাষ্ট্রদূত এ বিশববিদ্যালয়েরই কীর্তিমান ছাত্র। সারা বিশব জুড়ে এখানকার এমন অসংখ্য কীর্তিমান ছাত্র রয়েছেন যারা স্বদেশে-বিদেশে বড় বড় পদ অলংকৃত করেছেন।
বাংলাদেশী ছাত্রবৃন্দ : এখানকার খ্যাতিমান বাংলাদেশী ছাত্রদের মধ্যে ড. মঞ্জুরে ইলাহী (এসোসিয়েট প্রফেসর, জাতীয় বিশববিদ্যালয়, গাজীপুর), ড. যাকারিয়া (চেয়ারম্যান, ফিক্বহ বিভাগ, ইসলামী বিশববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া), ড. মুহাম্মাদ সায়েফ উল্লাহ (প্রফেসর, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম), ড. এ, বি, এম, হিযবুল্লাহ (প্রফেসর, আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
ভর্তির নিয়মাবলী :
ক. শর্তসমূহ :
১. আবেদনকারীকে মুসলিম হতে হবে।
২. সঊদী অথবা অন্য কোন রাষ্ট্র হতে এইচ.এস.সি./আলিম অথবা সমমানের সনদপ্রাপ্ত হতে হবে এবং সনদ অর্জনের পাঁচ বছরের মধ্যে আবেদন করতে হবে।
৩. একাডেমিক অথবা শিষ্টাচার লংঘনজনিত কোন কারণে অন্য কোন বিশববিদ্যালয় হতে বহিষ্কৃত হওয়া যাবে না।
৪. বয়স অনূর্ধ্ব র্পঁচিশ বছর হতে হবে।
৫. প্রার্থীকে সচ্চরিত্রের অধিকারী ও শারীরিকভাবে লেখাপড়ার উপযোগী হতে হবে।
৬. কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরীতে যুক্ত হওয়া যাবে না।
৭. আল-কুরআনুল কারীম অনুষদে ভর্তিচ্ছু ছাত্রকে অবশ্যই কুরআনের হাফেয হতে হবে।
খ. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র :
১. সর্বশেষ অর্জিত শিক্ষাসনদ (এইচ.এস.সি/আলিম/ মু‘আদালাভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে প্রদত্ত সমমানসম্পন্ন সনদ)।
২. সর্বশেষ অর্জিত মার্কস্শীট (নম্বরপত্র)।
৩. সরকারী প্রতিষ্ঠান অথবা ।
৪. নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে চারিত্রিক সনদপত্র।
৫. পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধন সনদ।
৬. পাসপোর্টের ফটোকপি।
৭. নির্ভরযোগ্য ডাক্তার/মেডিকেল প্রদত্ত হেলথ্ (লেখাপড়ার জন্য শারীরিক উপযোগিতা) সার্টিফিকেট।
৮. সাম্প্রতিক তোলা ৬ কপি (৪র্ বাই ৬র্র্) সাইজের ছবি। প্রতিটি ছবির নীচে আরবীতে নিজের নাম লিখতে হবে।
৯. স্বদেশের কোন ইসলামী প্রতিষ্ঠান বা মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয়ের পরিচিত দু’জন মুসলিম ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে দু’টি প্রশংসাপত্র। উক্ত মুসলিম ব্যক্তিদ্বয়ের মোবাইল নম্বরসহ তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি প্রশংসাপত্রের সাথে যুক্ত করতে হবে।
১০. আবেদন ২৩ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০ জানুয়ারীর মধ্যে করতে হবে।
১১. আরবী ব্যতীত অন্য ভাষায় লিখিত কাগজপত্র আরবীতে অনুবাদ করত: নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সত্যায়িত করতে হবে।
গ. আবেদনের নিয়ম :
আবেদনপত্র অনলাইনে পূরণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওবেসাইটে (www.iu.edu.sa) প্রদত্ত অনলাইন ফর্মটি ধাপে ধাপে পূরণ করতে হবে এবং আবেদনকারীর ছবিসহ প্রয়োজনীয় যাবতীয় কাগজপত্র নিম্নোক্ত ওয়েব্এ্যাড্রেসে স্ক্যানিং করে পাঠাতে হবে : http://admission.iu.edu.sa
|
মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয় কর্তৃক কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ‘মুআদালাহ’ বা অনুমোদন প্রদানের নিয়ম :
১. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের পক্ষ থেকে বিশববিদ্যালয়ের এ্যাডমিশন ও রেজিস্ট্রেশন বিভাগের (عمادة القبول والتسجيل) প্রধান বরাবর আবেদনপত্র।
২. শিক্ষার প্রতিটি স্তরে ছাত্রভর্তির শর্তাবলীসহ প্রতিষ্ঠানের বিধিমালার এক কপি।
৩. প্রতিটি শিক্ষাস্তরের কলাস রুটিন।
৪. বার্ষিক পাঠ্য বিষয়সমূহের তালিকা এবং সাপ্তাহিক কলাস সংখ্যার বিবরণ।
৫. পরীক্ষা নীতির বিস্তারিত বর্ণনা।
৬. প্রতিটি শিক্ষাস্তরের নম্বরপত্রের সীলমোহরযুক্ত নমুনা।
৭. ছাত্রদের প্রদেয় সনদপত্রের সীলমোহরযুক্ত নমুনা।
৮. শিক্ষকবৃন্দের নামের তালিকা, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং তাঁদের সনদপত্রের ফটোকপি।
৯. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাজেট সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য, আয়ের উৎস এবং ব্যয়ের খাত।
১০. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অধীনস্থ মাদরাসাসমূহের নাম এবং সেগুলির অবস্থানস্থল (যদি থাকে)।
১১. উল্লেখিত তথ্যাবলী জমা দেওয়ার জন্য নির্ধারিত ফরম পূরণ।
জঙ্গীবাদ দমনে এ বিশববিদ্যালয়ের ভূমিকা :
‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ তত্ত্বের উদ্ভাবক আমেরিকা ও তার তস্যমহল বিশ্বের কোথাও কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সংঘটিত হলে তার সাথে সংশ্লিষ্টদের কেন্দ্র করে প্রায়ই হীন স্বার্থ চরিতার্থ এবং সঠিক দ্বীন চর্চার নাষিমূল মদীনা ইসলামী বিশ্বাবিদ্যালয়ের দিকে অংগুলি নির্দেশ করে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশুদ্ধ ইসলামী আক্বীদাসম্পন্ন ছাত্ররা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিজ নিজ দেশে মানুষের মাঝে ইসলামের সঠিক রূপ তুলে ধরার কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অমুসলিম বিশ্বের শ্যেনদৃষ্টি রয়েছে সবসময়। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে মাঝেমধ্যেই বিপাকে পড়তে হয় এবং মিথ্যা অপবাদের জবাব দিতে গলদঘর্ম হতে হয়। এই সমস্যার নিরসন ও মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া উগ্রবাদ ও চরমপন্থার ব্যাপারে যথাযথ দিকনির্দেশনা ও সামাজিক সচেতনা সৃষ্টির জন্য মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত ৩১.০৩.২০১০ ইং তারিখে ‘দৃষ্টিভঙ্গির উগ্রতা ও উগ্র দৃষ্টিভঙ্গি : প্রেক্ষিত সন্ত্রাস’(الإرهاب بين تطرف الفكر وفكر التطرف) শিরোনামে তিনদিনব্যাপী এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। উক্ত সম্মেলনে সারা বিশব থেকে বহু চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবি আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা প্রত্যেকেই সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদের স্বরূপ, কারণ এবং উহার ক্ষতিকর দিকসমূহ স্ব-স্ব লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপনের মাধ্যমে তুলে ধরেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গোটা বিশেবর গবেষকগণ পাঁচ শতাধিক প্রবন্ধ পেশ করেন। তন্মধ্যে ৮৩টি প্রবন্ধ সম্মেলনের জন্য নির্বাচন করা হয়, যা তিন দিনে মোট ১২টি অধিবেশনে উপস্থাপিত হয়। যেখানে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টির কারণ, উৎস, উহার ক্ষতিকর দিকসমূহ এবং প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। এ সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল কয়েকটি- ক. ইসলাম যে মধ্যমপন্থা, ন্যায়নিষ্ঠা ও উদারতার ধর্ম- তা জাতির সামনে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা। খ. ইসলামের নামে কতিপয় মানুষের বিপথে যাওয়ার পরিণতি স্পষ্ট করা। গ. সন্ত্রাস সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত একটি অপরাধ; নির্দিষ্ট কোন ধর্ম বা জাতির সাথে এর সম্পর্ক নেই, বিশেষত: ইসলামের সাথে এর সামান্যতম সম্পর্ক নেই- তা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা ইত্যাদি।
সালাফী দাওয়াতের প্রসারে মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয়ের ভূমিকা :
মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে বলা যায়, এটি.এমন একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- যা সারা বিশেব মহৎ কিছু লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। ইসলামের এই আলোকস্তম্ভটি সারা বিশেব সালাফী দাওয়াত প্রসারে ও সমাজসেবায় যে খেদমতের আঞ্জাম দিয়ে আসছে, তা সত্যিই তুলনাহীন। ইসলামী জ্ঞানপিপাসুদের সঠিক ইসলামী আক্বীদা-আমল শিক্ষা দান এবং তাদের অন্তরে নির্ভেজাল তাওহীদের বীজ বপন করে তাদেরকে একজন যোগ্য দাঈ ও সমাজ সংস্কারক হিসাবে স্ব-স্ব দেশে প্রেরণের মহান দায়িত্ব নিয়েছে মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয়। এ বিশববিদ্যালয় গোটা বিশেব সালাফী দাওয়াতের প্রসারে যেসব ভূমিকা পালন করে আসছে, তার কিছু নমুনা নীচে তুলে ধরা হল :
১. সঊদী আরবের অভ্যন্তরে দাওয়াতী কাজ : এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দাওয়াতী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে নানা সাংস্কৃতিক ও দাওয়াতী কর্মসূচীর আয়োজন। যেমন :
২. আন্তর্জাতিক পরিসরে দা‘ওয়াতী কাজ : মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয় শুধু সঊদী আরবের অভ্যন্তরেই নয়; বরং আন্তর্জাতিক পরিসরেও মানুষকে ইসলামের পথে আহবান জানায়। মুসলিম যুবকদেরকে সুশিক্ষিত করা এবং তাদেরকে বিশুদ্ধ আক্বীদা শিক্ষাদানেও এ বিশববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নীচে এর কিছু নমুনা উল্লেখ করা হল :
পরিশেষে বলা যায়, গোটা বিশেব সালাফী আনেদালনে মদীনা ইসলামী বিশববিদ্যালয়ের ভূমিকা প্রকৃতার্থে বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন এই প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে মোটেও সম্ভব নয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্বে সালাফী আন্দোলন তথা ইসলামের আদিরূপ প্রতিষ্ঠায় যে কতবড় পথিকৃৎ-এ পরিণত হয়েছে, তা বর্তমান বিশ্বে যারা প্রকৃতার্থে ইসলামের খেদমত করছেন এবং পলিনেশীয়, ল্যাটিন, ক্যারিবিয়ান বা অনুরূপ মুসলিম সংখ্যালঘু অঞ্চলসমূহে এ দাওয়াতের নিশান বহন করে চলেছেন তাদের প্রতি লক্ষ্য করলেই অনুধাবন করা যায়। বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহ যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা বিরলপ্রায়, সেসব দেশ থেকে ছাত্র এনে তাদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে আবার স্বদেশে ইসলাম প্রচারের কাজে প্রেরণের এই মহৎ দায়িত্ব অহির প্রাণকেন্দ্রভূমির এই বিশ্ববিদ্যালয়টিই কেবল পালন করে যাচ্ছে। তাই কেবল একটি গতানুগতিক উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী বিশুদ্ধ ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে এক অনন্য আন্দোলন এ বিশ্ববিদ্যালয়। সঊদী বাদশাহ ফায়ছাল (রহঃ) ঠিকই বলেছেন, ‘আমি এই বিশববিদ্যালয়ে ইসলামী রেনেসাঁর এমন ইঙ্গিত পাই, যা অন্তর্জগতকে পুলকিত করে এবং চিন্তা-চেতনাকে নাড়া দেয়। আমি এই প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক সফলতা কামনা করি এবং বিশবজুড়ে (কিতাব ও ছহীহ সুন্নাহর) বরকতময় দাওয়াতী অঙ্গনে তা ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করুক- এই প্রার্থনা করি।’
তথ্যসূত্র :