বিজ্ঞানময় আল-কুরআন : কতিপয় দিক
আ.স.ম. ওয়ালীউল্লাহ
ইসলাম
শুধুমাত্র একটি ধর্ম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ইসলামের মূল দুই
সূত্র পবিত্র কুরআন ও হাদীছকে যতদিন মুসলিমরা আঁকড়ে ধরেছিল, ততদিন তাদের
মর্যাদা পৃথিবীর বুকে সমুজ্জ্বল ছিল। কিন্তু কুরআন ও হাদীছকে ভুলে যাওয়ার
সাথে সাথে তাদের সেই মর্যাদা ও দাপটও ধীরে ধীরে ক্ষীয়মান হয়েছে। আজ তাদের
মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত। অথচ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় ইসলামের মতো উৎসাহ আর কোন
ধর্মই দেয়নি। আল্লাহ বলেন, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি
করেছেন (আলাক্ব ১)। সূরা ইয়াসীনের ২ নং আয়াতে প্রজ্ঞাময় কুরআনের
কসম খাওয়া হয়েছে। এছাড়া কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে কুরআনের বিষয়বস্ত্ত নিয়ে
চিন্তা-গবেষণা, এমনকি সত্যতার যাচাই করতেও বলা হয়েছে। ইসলামে পৃথিবীর নানা
স্থান ভ্রমণ করে আললাহর নিদর্শন দেখার ও তা নিয়ে চিন্তা করার নির্দেশ
এসেছে। এছাড়া আললাহ তা‘আলা জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দো‘আ করতে বলেছেন এভাবে, ‘হে
আমার পালনকর্তা! আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন’ (ত্ব-হা ১১৪)। হাদীছে
প্রত্যেক নর-নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করাকে ফরয বলা হয়েছে। রাসূলুললাহ (ছাঃ)
বলেছেন, ইলম বা জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরয (ইবনু মাজাহ, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/২১৮, সনদ হাসান)। এছাড়া হাদীছে এসেছে, আললাহ যার জন্য কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন (মুত্তাফাক্ব আলাহই, মিশকাত হা/২০০)। এটা আললাহর নেআমত ।
আজ মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা থেকে পিছিয়ে আসার ফলে সে শূন্যস্থান দখল করে সামনে এগিয়ে এসেছে ইহুদী-খৃষ্টানরা। যার বলে তারা বিপুল শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে সারাবিশ্বকে আজ শাসন করছে। অথচ পাশ্চাত্যের এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাগ্রসরতার পিছনে রয়েছে মুসলিম বিজ্ঞানীদের বিশাল অবদান। পরিতাপের বিষয় আমরা মুসলিম হিসাবে দাবী করলেও আমরা আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অতীত ঐতিহ্যকে যেমন হারিয়েছি, তেমনি ঐসকল মুসলিম বিজ্ঞানীদেরও ভুলতে বসেছি যারা ছিলেন আধুনিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতার মূল কারিগর। ফলে দেখা যায়, বীজগণিতের জনক আল-খাওয়ারযিমী, রসায়নের জনক জাবির ইবনে হাইয়্যান, চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ইবনে সীনার মত খ্যাতনামা মুসলিম পন্ডিতদের নাম আমাদের প্রজন্মের মুসলিম সন্তানরা প্রায় জানেই না। নিম্নে গণিতশাস্ত্রে অসাধারণ অবদান রাখা মধ্যএশিয়ার মুসলিম বিজ্ঞানী আল-খাওয়ারযিমীর পরিচয় ও বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতিতে তাঁর অবদান আলোচনা করা হল।
নাম ও পরিচয় : নাম আবু আব্দুললাহ মোহাম্মাদ। পুরো নাম আবু আবদুললাহ মোহাম্মদ ইবনে মূসা আল-খাওয়ারযিমী।
জন্ম : সোভিয়েত রাশিয়ার আরব সাগরে পতিত আমু দরিয়ার নিকটে একটি দ্বীপের নিকটে অবস্থিত খাওয়ারযিম নামক শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এর অবস্থান ছিল পারস্যের অন্তর্গত খিভা প্রদেশে। তাঁর বাল্যকাল ও কৈশোর সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তবে আনুমানিক ৭৮০ খৃষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
জীবন ইতিহাস : খ্যাতনামা মুসলিম বিজ্ঞানী আল-খাওয়ারযিমী ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল অতীতে যে সকল মনীষী মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে অগ্রগণ্য। আববাসীয় খলীফা আল-মামূনের রাজত্বকালে খ্যাতির শীর্ষে আরোহনকারী বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠতম। তিনি খলীফা আল-মামূনের বিখ্যাত গবেষণাগার ‘বায়তুল হিকমাহ’ সংলগ্ন গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক হিসাবে চাকুরী করতেন। তিনি খলীফা আল-মামূনের মৃত্যুর পরও জীবিত ছিলেন এবং পরবর্তী খলীফা আল-ওয়াতহিক-এর শাসনকালের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি পাটীগণিত, বীজগণিত, ভূগোল, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রভৃতি বিষয়ে অবদান রাখেন। তবে মূলতঃ বীজগণিতের জন্যই তিনি সবচেয়ে আলোচিত হন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আত-তাবারী তাঁর নাম দেন মুহাম্মাদ ইবনে মূসা আল-খাওয়ারযিমীআল-কুতরুবুললী। আল-কুতরুবুললী বিশেষণ এটাই নির্দেশ করে যে, তিনি সম্ভবতঃ বাগদাদের নিকটবর্তী ক্ষুদ্র শহর কুতরুবুল হতে এসেছিলেন। আল-তাবারী তাঁকে মাজুসীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এটা থেকে বুঝা যায় যে, তিনি হয়তোবা প্রাচীন জরথ্রুস্ট মতবাদের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু তাঁর আল-জাবর ওয়াল মুকাবিলা বই থেকে জানা যায় যে, তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম। সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে, হয়তোবা তাঁর পূর্বপুরুষ বা সম্ভবতঃ তিনিও কৈশোরে জরথ্রুস্ট মতবাদে বিশবাসী ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেন।
বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ : খলীফা মামূনের বিশাল লাইব্রেরীতে আল-খাওয়ারযিমী চাকুরী গ্রহণ করেন। এখানেই সম্ভবতঃ তিনি বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। অসীম ধৈর্য সহকারে অধ্যয়ন করে তিনি বিজ্ঞানের যাবতীয় বিষয়ের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করেন।
আল-খাওয়ারযিমীর অবদান : তিনি ছিলেন একজন জগতবিখ্যাত গণিতবিদ। তাঁর সময়ের গণিতের জ্ঞানকে তিনি এক অভাবনীয় সমৃদ্ধতর পর্যায়ে নিয়ে তুলেন। একজন গণিতবিদ হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন উলেলখযোগ্য জ্যোতির্বিদ। ভূগোল বিষয়ে তাঁর প্রজ্ঞা ছিল অসাধারণ।
তিনি ছিলেন বীজগণিত তথা এলজাবরার জনক। তিনি প্রথম তার একটি বইয়ে এই এলজাবরার নাম উলেলখ করেন। বইটির নাম হল ‘‘আল-জাবর ওয়া আল-মুকাবিলা’’। তিনি বিজ্ঞান বিষয়ক বহু গ্রিক ও ভারতীয় গ্রন্থও আরবীতে অনুবাদ করেন।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদান নিম্নে উল্লেখ করা হল :
পাটিগণিত-এর ক্ষেত্রে অবদান : পাটিগণিত বিষয়ে তিনি একটি বই রচনা করেন যা পরে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। খৃষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে হিনদুগণিতবিদগণ দশমিক পদ্ধতির উদভাবন করেন। এই পদ্ধতিকে খাওয়ারযিমীই প্রথম ইসলামী জগতে নিয়ে আসেন। তাঁর রচিত The Book of Addition and Substraction According to the Hindu Calculation (যোগ-বিয়োগের ভারতীয় পদ্ধতি) তারই উদাহরণ।
বীজগণিত-এর ক্ষেত্রে অবদান : এ ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে বেশী উৎকর্ষতা লাভ করেন। তার হাতেই গণিতের এই শাখাটি পরবর্তী সময়ে আরও সমৃদ্ধতর হয়। বর্তমান যুগ পর্যন্ত গণিত বিদ্যায় যে উন্নয়ন এবং এর সহায়তায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে উন্নতি ও আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে তার মূলে রয়েছে আল-খাওয়ারযিমী’র উদভাবিত গণিত বিষয়ক নীতিমালারই বেশী অবদান।
তার রচিত বই ‘কিতাব আলজিবন ওয়াল মুকাবিলা’ হতে বীজগণিতের ইংরেজী নাম অ্যালজেবরা (Algebra) উৎপত্তি লাভ করে। Algorithm শব্দটি Alkhwarizmi নামের ল্যাটিন AcŠsk algorismi হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। এলজাবরায় লিনিয়ার বা একঘাত এবং কোয়াড্রেটিক বা দ্বিঘাত সমীকরণ আছে।
আমরা সাধারণত কোন সমীকরণ সমাধান করে যখন x অথবা y-এর একটি করে মান পাই। যেগুলো এক ঘাত সমীকরণ নামে পরিচিত। আবার দ্বিঘাত সমীকরণে দ’ুটি মান পাওয়া যায়। এই দুই ধরনের সমীকরণের বিশেলষণধর্মী ব্যাখা তুলে ধরেন আল-খাওয়ারযিমী।
যেমন এটি একটি একঘাত সমীকরণ যার একটি মান ১। আবার একটি দ্বিঘাত সমীকরণ যেখানে এর মান দু’টি অথবা।
তার এলজাবরা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে গণিত জগতে এর উপযোগিতা অভাবনীয় বেড়ে যায়। মধ্যযুগের আর কোন গণিতবিদই গণিত জগতে তার সমান্তরাল কর্ম উপস্থাপন করে যেতে পারেননি। তিনি গণিতের লগারিদম শাখাটিও তিনি উন্নয়ন করেন।
গণিতে শূণ্যের ব্যবহার : যদিও এটি গণিতের অন্তর্ভুক্ত তবুও এর গুরুত্ব বিবেচনা করে এটি আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হল। গ্রীক ও ভারতীয় হিনদু গণিতবিদদের মধ্যে গণিতের যে অসম্পূর্ণতা ছিল, সে অসম্পূর্ণতা দূর করেছিলেন আল-খাওয়ারযিমী। তাঁর গণিতের উপস্থাপনা ছিল অসাধারণ ও অনন্য। আরবীয়রা ভারতীয়দের নিকট থেকে সংখ্যা লিখন প্রণালী শিক্ষা লাভ করেন। মুসলমান বৈজ্ঞানিকেরা পরে এটিকে সংশোধন করেন এবং শূন্য লিখন প্রণালী উদভাবন করেন। খাওয়ারযিমী এ শূন্য লিখন প্রণালীকে সর্বশেষ রূপদান করেন। ইউরোপীয়রা মুক্তকণ্ঠে এ কথা স্বীকার করেন। এই শূন্য ব্যবহার করার ফলে গণিত এসে দাঁড়াল পরিপূর্ণ প্রেক্ষিতে। এই শূন্য ব্যবহার গণিতে নিয়ে আসল এক অসাধারণ বিপলব।
ভগ্নাংশ পদ্ধতি আবিষ্কার : ভারতীয় পরিসংখ্যান ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করার সময়ে তিনি আবিষ্কার করেন ভগ্নাংশের বিস্ময়কর দিক। তার এই কাজগুলো পরিচিত ছিল আরব্য-কর্ম হিসাবে। শিগগিরই তাঁর কর্ম-অবদানগুলো পৌঁছে গেলো ইউরোপে। ইউরোপীয়রা দ্রুত তার বই ও লেখাগুলো অনুবাদ করে নেয়। সেই সাথে তিনি ইউরোপেও বিখ্যাত হয়ে যান। তিনি দশমিক ব্যবস্থাকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিতে চাইলেন। এক্ষেত্রে তাঁর অবদান প্রশংসনীয়।
ত্রিকোণমিতিতে অবদান : গণিতের আরেকটি শাখা হল ত্রিকোণমিতি। সমকোণী ত্রিভুজের তিন কোণ আর বাহু নিয়ে ত্রিকাণমিতির কারবার। আল-খাওয়ারযিমী উদভাবন করেন ত্রিকোণমিতির বিস্তারিত উপাত্ত। তিনিই কনিক সেকশনের গাণিতিক ধরনের আধুনিকায়ন করেন।
এরপর তিনি হাত বাড়িয়ে দেন ক্যালকুলাসে। তিনি ক্যালকুলাসের উন্নয়ন ঘটি-এর আধুনিকায়ন করেন। ডিফারেনিয়াল ক্যালকুলাস হচেছ এর একটি শাখা। এটি নিয়ে তিনি কাজ করা শুরু করেছিলেন।
জ্যামিতিতে তাঁর অবদান : তিনি প্রথম বীজগণিতের সমীকরণের জ্যামিতিক সমাধান নির্ণয় করেন। জ্যামিতির ক্ষেত্রে আয়ত, বর্গ, ত্রিভুজ প্রভৃতি জ্যামিতিক ক্ষেত্রগুলোর যে ধারণা দিয়েছিলেন তা হুবহু আজও একই রকম রয়েছে। তিনিই কনিক সেকশনের গাণিতিক ধরনের আধুনিকায়ন করেন।
জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর অবদান : জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর অবদান উলেলখযোগ্য এবং দিয়ে গেছেন নতুন ধারণা ও প্রজ্ঞার জগতে। তাঁর আরও কাজের মধ্যে ঘড়ি ও সূর্যঘড়ির ক্ষেত্রে অবদান অন্তর্ভুক্ত। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের একখানা জিজ বা তালিকা প্রণয়ন করেন। তাঁর এই জিজের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, এতে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ঔপপত্তিক উপক্রমণিকা সংযোগ করেন। এ বিষয়ে এ উপক্রমণিকাই তার প্রগাঢ় পান্ডিত্যের স্বাক্ষর। এ সম্পর্কিত তাঁর দুই খানা গ্রন্থ রয়েছে। প্রথম গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক যন্ত্রপাতির নির্মাণ কৌশল আলোচনা করেছেন।
দ্বিতীয় গ্রন্থে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কিরূপে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ নিতে হয় তা সম্পর্কে আলোচনা করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাগুলো অনুবাদ করা হয় ইউরোপীয় ভাষায়। পরবর্তীতে এগুলো চীনা ভাষাতেও অনুবাদ করা হয়।
অনুবাদ কর্মে তাঁর অবদান : এর আগেই উলেলখ করা হয়েছে যে তিনি গ্রীক ও ভারতীয়দের বইগুলো আরবীতে অনুবাদ করেন। তিনি টলেমীর বইগুলো অনুবাদ করেন। এছাড়া তিনি জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর একটি বই অনুবাদ করেন ।
ভূগোল শাস্ত্রে অবদান : তিনি টলেমী সুচিত অনেক ভৌগলিক ধারণার সংশোধন করেন। ইউরোপীয়রা এতে বিস্মিত হয়। টলেমির মানচিত্র পর্যন্ত তিনি সংশোধন করেন এবং তাতে একটি মানচিত্র সংযুক্ত করেন। তিনি টলেমির দ্রাঘিমা ও অক্ষরেখা গ্রহণ করেন, সেই সাথে তাতে মুসলিম দেশগুলোর বিবরণ পেশ করেন। তাঁর উদ্যোগে পৃথিবীর একটি বাস্তবরূপ তৈরী করা হয়, যা পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কনে নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি সর্বপ্রথম পৃথিবীকে সপ্ত ইকলিম বা মন্ডলে ভাগ করেন এবং এই সূত্র ধরে আবহাওয়ার পরিমন্ডল অনুসারে পৃথিবীকে সাতটি মহাদেশে ভাগ করেন। জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর রচিত ভারতীয়দের একটি বই ‘‘সিদ্ধান্ত’’ তিনি আরবীতে অনুবাদ করেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থ :
তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা অনেক। এগুলোর অধিকাংশ ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আবার অনেকগুলোর অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায় না।
আল-জাবর ওয়া আল-মুকাবিলা : এ বইটি তাঁর সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়। এটি সবচেয়ে বেশী বিখ্যাত। এই বইটির নাম অনুসারে এলজেবরা বা বীজগণিত নামকরণ করা হয়। এ বইটি লাতিন ভাষায় অনুবাদ করা হয় দ্বাদশ শতকে। অনুবাদ কর্মের মধ্য দিয়ে এই নতুন বিজ্ঞান পশ্চিমা জগতে প্রবেশের সুযোগ পায়। এর আগে ইউরোপের কাছে বীজগণিত ছিল একটি অচেনা বিষয়। ইউরোপীয়রা এ বিষয়ে ছিল পুরোপুরি অজ্ঞ। এক বইটি পাঁচখন্ডে বিভক্ত। প্রথম অংশে তিনি দ্বিঘাত সমীকরণগুলোকে ছয়ভাগে বিভক্ত করে অত্যন্ত সুশৃঙখলভাবে আলোচনা করেন। দ্বিঘাত সমীকরণে যে দ’ুটো মূল বিষয় তা খারেজমী সর্বপ্রথম উলেলখ করেন এবং এটি সমাধান করেন। দ্বিতীয় অংশে তিনি বীজগণিতের সমীকরণের জ্যামিতিক সমাধান নির্ণয় করেন। চতুর্থ খন্ডে তিনি করণী অপসারণ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। দশম শতাব্দীর ইউসূফ রচিত মাফাতিহুল উলূম গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়।
কিতাবুছ ছুরত আল-আরয : এটি ভূগোল বিষয়ক বই। এটি পৃথিবীর আকার সমন্ধীয় একখান বই। তাঁর এ গ্রন্থখানা মূলতঃ ভূগোল সমন্ধীয় আলোচনায় সমৃদ্ধ। এটি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়। অনুবাদকর্মের সাথে মানচিত্রগুলোও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কিতাব আল-জামা‘ ওয়াত তাফরিক-বিল হিসাব আল-হিনদী : এই বইটি ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কিন্তু এই বইটি আরবীতে আর পাওয়া যায় না।
ইসতিখেরাজ তারিখ আল-ইয়াহুদ : ইহুদী পঞ্জিকা নিয়ে তিনি এই বইটি রচনা করেন।
কিতাব আল-তারিখ : এ মুল্যবান বইটির পান্ডুলিপি আর পাওয়া যায় না। এটি সাধারণ দিনলিপির উপর লিখিত।
কিতাব আল-রুখমাত: এটি সূর্যঘড়ির উপর লিখিত একটি বই। এটিরও হদীস আর পাওয়া যায় না।
মৃত্যু : সম্ভবত এ মহান বৈজ্ঞানিক ৮৪৭ বা ৮৪০ খৃষ্টাব্দের দিকে মৃত্যুমুখে পতিত হন। খলীফা মামূনের মৃত্যুর পরও তিনি এক যুগের অধিক জীবিত ছিলেন।
বিজ্ঞানে মৌলিক অবদানের জন্য আল-খাওয়ারযিমী চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ষোড়শ শতক পর্যন্ত তার অনেক বই ইউরোপীয় বিশববিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। জ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহই তাকে একজন পুরোপুরি বিজ্ঞানীতে পরিণত করে তুলেছিল। তাঁর গবেষণা বিজ্ঞানীদের সমসাময়িক অনেক বাধা দূর করে। আজও তিনি আপন কীর্তিতে সমুজ্জবল। আসুন আমরাও কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুসরণ করার পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্বেষণ করি। আললাহ আমাদের সহায় হৌন!
তথ্যসূত্র :