নিসর্গের প্রাণোচ্ছলতায়, বৈচিত্রের সমারোহে

আসিফ রেযা 9014 বার পঠিত

মানসিক প্রস্ত্ততি চলছিল বেশ কয়েকমাস পূর্ব থেকেই। আর সময় যতই ঘনিয়ে আসছিল পাল্লা দিয়ে জল্পনা-কল্পনার ঝাঁপি ততই সমৃদ্ধ হচ্ছিল। আর কেনই বা হবে না! এবারের শিক্ষাসফর যে বাংলাদেশে ইসলামের প্রবেশদ্বার খ্যাত, বিপুল সৌন্দর্যের রাণী, দেশের একমাত্র শিল্পনগরী চট্রগ্রামে! প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘আল মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী’ থেকে গত বছর আয়োজিত শিক্ষাসফরে স্বপ্নভূমি সিলেট ভ্রমণের পর সকলেরই সুপ্ত বাসনা ছিল কল্পনারাজ্য চট্টগ্রাম ভ্রমণের। ফলে এবারের শিক্ষাসফরের স্থান হিসাবে চট্রগ্রাম নির্বাচিত হওয়ার সাথে সাথে ভ্রমণেচ্ছুদের গহীন মন বৃক্ষে যেন বসন্তের নব পল্লবের আলোড়ন শুরু হল।

যাত্রা : প্রতীক্ষার প্রহর পেরিয়ে যাবতীয় প্রস্ত্ততির পর্ব সেরে অবশেষে ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০১১ রোজ বৃহস্পতিবার রাত্রি ৮-টায় মারকায প্রাঙ্গন থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হল; গন্তব্য- চট্রগ্রাম, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার ও স্বপ্নের সেন্টমার্টিন। যাত্রার পূর্বক্ষণে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ বাণী ও দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। সফরে আমীর হিসেবে ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হাফেয লুৎফর রহমান ও তাঁর সহযোগী ছিলেন সহকারী শিক্ষক ইমামুদ্দীন। ৪৯ জন ছাত্রসহ মোট ৫৫ জনের একটি দল রওনা হলাম ভিন্ন রকম এক শিক্ষার্জনের নেশায়।

দৃষ্টিভ্রম : বেলা ৮-টার দিকে চট্রগ্রামে প্রবেশ করলাম। এর আগে কুমিল্লায় যাত্রা বিরতি হয়েছিল ফজরে ছালাতের জন্য। চারিদিকে ঊষার আগমনবার্তা যেন কুয়াশার চাদর থেকে বেরিয়ে কর্মচাঞ্চল্যের প্রস্ত্ততি নিচ্ছে। প্রভাত রবির মিষ্টি ছটায় শিশিরবিন্দু বর্ণিল রঙে উল্লসিত হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ পর এই খেলা আর থাকবে না। কর্তব্যপ্রাণ সূর্যিমামার কর্মমুখর দিন যতই অগ্রসর হবে শিশিরবিন্দুর খেলা ততই শেষ হয়ে আসবে। একমনে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে হঠাৎ দৃষ্টিভ্রম। পূর্ব দিগন্তে সারি সারি ওগুলো কি? দিগন্ত বিস্তৃত কালো মেঘ? রৌদ্রোজ্জ্বল শীতের সকালে হঠাৎ এমন মেঘের ঘনঘটা? তাহলে কি খানিক বাদে এক পসলা বৃষ্টি নামবে? কিছুটা এগিয়ে দৃষ্টির সামনে থেকে গাছপালা সরে যেতে ভ্রমদৃষ্টির অবসান হল। ওগুলো কি মেঘ না পাহাড়! অস্ফূট কণ্ঠে..ঐ যে পাহাড়! বলার সাথে সাথে সবার চোখে মুখে আনন্দের দ্যুতি খেলে গেল। চৈত্রের খরতাপ-দগ্ধ শস্য বৈশাখের প্রথম বৃষ্টির ছোয়ায় ভেজা শীতল সমীরণে যেমন মুখর হয়ে দোলে, তেমনি সবার মন হর্ষোল্লাসে নেচে উঠল। গাড়ি চলছে আপন গতিতে, সেদিকে কারো কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। কখনো পাহাড় সম্পর্কে পাশের জনের সাথে মত বিনিময়, কখনো এক নিমেষে চেয়ে থাকা। এরূপ করতে করতে প্রায় আধা ঘণ্টা যাবৎ চলল পাহাড় দর্শন। অবশেষে সবাই একে একে আপন সিটে বসে পড়ল। সীতাকুন্ডের ২/৩ শত ফুট উচ্চতার এই পর্বতমালা দৈর্ঘ্যে ২০ কিলোমিটারের কম হবে না।

পতেঙ্গা সৈকতে কিছুক্ষণ : চট্টগ্রাম বিভাগে প্রবেশের পর সবার কামনা একটাই- সমুদ্র সৈকত। ফলে কারো আর তর সইছিল না। চট্টগ্রাম শহরে ঢুকে চলন্ত বাসেই নাস্তা সেরে নিলাম। দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহরশেষে যখন পতেঙ্গা সৈকতে গাড়ি পৌঁছল, তখন বেলা ১১-টা। এর আগে চট্টগ্রাম যেলা আন্দোলনের সভাপতি জনাব শামীম আহমাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি পথিমধ্যে আমাদের সঙ্গী হন। গাড়ি থামার পর আমাদের শিক্ষক জনাব ইমামুদ্দীন ছাত্রদেরকে সাগরে গোসল করার নিয়ম বলে দিলেন এবং সকলকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিলেন। সৈকতপানে ছুটলাম সবাই। পতেঙ্গা সৈকতে আমাদের পদ্মা নদীর পাড়ের মতই বড় বড় কংক্রিটের ব্লক ফেলে রাখা হয়েছে। এলোমেলো এসব কংক্রিট, পাথর পেরিয়ে সমুদ্রে নামা বেশ কষ্টকর। তখন ছিল জোয়ারের সময়। বেশ বাতাস। তর সইছিল না। গা ভাসালাম অথৈই জলধির বুকে বিসমিল্লাহ বলে। জোয়ারের সময় হওয়ায় পানি ছিল ঘোলাটে। তবে শীতের মধ্যে এই ঠান্ডাপানিতে বেশিক্ষণ গোসল করা সম্ভব হল না। গোসল সেরে ফিরে এলাম গাড়ির কাছে। জুম‘আর দিন। সৈকতের পাশেই দুপুরের রান্না হল। কিন্তু দেরী হয়ে যাওয়ায় খাবার সাথে নিয়ে আমরা ঝাউতলার খুলশী আহলেহাদীছ জামে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। চট্টগ্রাম শহরের এই একমাত্র আহলেহাদীছ মসজিদটি বেশ পুরানো মনে হল। স্থানীয় কিছু আহলেহাদীছ এ মসজিদ তৈরী করেছিলেন। সেখানে পৌঁছে দেখি জামা‘আত শেষ হয়ে গেছে। স্থানীয় মুছল্লীদের সাথে শামীম ভাই আমাদের পরিচয় করে দিলেন। পরিচয়পর্ব শেষে তিনিসহ সকলে দ্বিতল মসজিদ প্রাঙ্গনের ছায়াবীথিকার নীচে দুপুরের খাবার সারলাম। অতঃপর সেখানে যোহর ও আছরের ছালাত জমা করে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বায়েজিদ বোস্তামীর মাযারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

শিরকের অভায়শ্রম!! : বাংলাদেশের মানুষ অগণিত ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ। বিশেষতঃ চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ শিরক-বিদ‘আতের সাথে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। এ দেশের প্রতিটি মাযারই শিরকের আড্ডাখানা। চট্টগ্রামের এই তথাকথিত বায়েজিদ বোস্তামীর মাযার, যার অন্যতম। আমরা যখন মাযার গেইটে পেঁŠছলাম, তখন প্রায় ৪-টা বাজে। মাযার প্রাঙ্গনে প্রবেশ করলাম। প্রবেশপথের বাম পাশে মাঝারী আয়তনের পুকুর, ডান পাশে মাযার। মূল মাযার তথা বায়েজিদ বোস্তামীর কথিত কবর সমতল ভূমি থেকে ৩০-৩৫ ফুট উঁচু টিলায় অবস্থিত। সেখানে ওঠা-নামার জন্য মাত্র দু’হাত প্রশস্ত একটি সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উঠে কয়েক ধাপ গেলেই মাযার কক্ষ। সে কক্ষের মধ্যে রয়েছে কবর। তার পার্শ্বে আরেকটি কক্ষ রয়েছে মহিলাদের জন্য এবং সেখান থেকে কবর দেখার জন্য একটি বড় জানালা আছে। কবর তো নয়, যেন ছোট খাটো একটা গম্বুজ! নকশা করা দামী কালো কাপড় দিয়ে কবর ঢাকা। সেখানে কারুকার্য ও আলোকসজ্জার কোন কমতি নেই। স্টেইনলেস স্টীল পাইপের নকশা করা রেলিং দিয়ে কবর ঘেরা ও তার এক পাশে বহু কুরআন মাজীদ রাখা। অনেকে কবরের আশে পাশে কুরআন তেলাওয়াত করছে অধিক নেকীর আশায়। কেউ হাত তুলে নীরবে মুনাজাত করছে। কেউ আবার ছালাত আদায় করছে (নাঊযুবিল্লাহ্)। মনে মনে ভাবলাম। হায় কুরআন!! এরা না বুঝে পাঠ করে যাচ্ছে কবিতা পাঠের মত। আর কুরআনের সরাসরি বিপরীত কাজই তারা করে যাচ্ছে। কুরআন পাঠ করাই সার তাদের জন্য; এর মর্মবাণী তাদের কণ্ঠনালীও অতিক্রম করছে না। আফসোস! শত আফসোস!! কে বোঝাবে এই নির্বোধ, অজ্ঞ, পথভ্রষ্ট মানুষগুলোকে! কবরের সামনে অসংখ্য মালাধারী এক বৃদ্ধ ভক্তি ভরে আগত দো‘আপ্রার্থীদের মাথায় হিন্দু ঠাকুরদের ভক্তের মাথায় হাত রেখে আর্শীবাদ করার মত করে ময়ূর পালকের ঝাড়ু দিয়ে ঝেড়ে দিচ্ছে। তাতেই অজ্ঞ মানুষের দল তৃপ্ত অন্তরে ফিরে যাচ্ছে। কবর কক্ষের বা পাশে বেশ কয়েকটি বাঁধাই করা কবর এবং তার পার্শ্বে পাতাহীন ডালবিশিষ্ট তিনটি মরা গাছ। সেই বৃক্ষত্রয়ে কিছু নারী পুরুষ আপন আপন আশা-আকাঙ্খা পূরণার্থে লাল সুতা বাঁধছে। তনমধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশী। কি উদ্ভট তাদের বিশ্বাস! সেই গাছগুলোর পাশ দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে রয়েছে আরো পীর-দরবেশের কবর। কেউ কেউ তাদের নিকট থেকে দোআ নিচ্ছে এবং বিনিময় হিসাবে তাদেরকে টাকা-পয়সা প্রদান করছে। রাস্তার শেষপ্রান্তে দেখলাম আরেক কান্ড। ৭/৮টি প্রাচীর ঘেরা কবর। সেখানে ভক্তরা আতর গোলাপজল ছিটাচ্ছে, আগরবাতি-মোমবাতি জ্বালাচেছ, কবরের উপর টাকা-পয়সা ফেলছে, মুনাজাত করছে ইত্যাদি। সবচেয়ে কষ্টদায়ক যে বিষয়টি দেখলাম তা হল  কয়েকজন মহিলা রেলিং-এ কপাল ঠুকছে। সেখানে এক খাদেম কে জিজ্ঞাসা করলাম ভাই এই স্থানের ফায়দা কি? তার উত্তর ছিল- ‘এখানে যদি কিছু ফায়দাই না থাকতো তাহলে এত মানুষ আসত না। এটা অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রের মতই হত। আর এখানে যত কচ্ছপ আছে অন্য কোথাও এত কচ্ছপ দেখতে পাবে না।’ অপ্রাসঙ্গিক উত্তর পেয়ে তার সাথে তর্কে গেলাম না। ব্যথিত হৃদয় নিয়ে ওখান থেকে পুকুরের দিকে আসলাম। সিড়িবাঁধা ঘাটে শত শত নারী-পুরুষ পর্দা-পুশিদার কোন বালাই নেই। এ যেন এক মেলা। পুকুরে অনেক কচ্ছপ আছে, যেগুলোকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে মনে করা হয়। কচ্ছপকে খাওয়ানোর জন্য অনেকেই কলা, পাউরুটি, বিস্কুট, গোশতের টুকরা পানিতে ফেলছে। সেগুলো খাওয়ার জন্য পানির কিনারে আসলে ভক্তরা অনেক ভক্তির সাথে সেগুলোর গায়ে হাত বুলাচ্ছে, পরিস্কার করে দিচ্ছে। পুকুরের নোংরা পানিতে অনেকে ওযু করছে, কেউ আবার রোগমুক্তির আশায় পানও করছে। বিস্মিত হলাম এই দেখে যে, হিন্দুরাও এসব করছে। ভাবতে শরীর শিউরে ওঠে, তাদের এই কর্মকান্ড সবই যে শিরকের পর্যায়ভুক্ত! মনটা আবার ভিজে উঠল- হে আল্লাহ! তুমি এসব পথভ্রষ্টদের সঠিক পথের দিশা দাও- আমীন!!

চট্টগ্রাম থেকে বিদায় : বিকেল পেঁঁŠনে পাঁচটার দিকে মাযার থেকে বেরিয়ে চললাম শহীদ জিয়া স্মৃতি কমপ্লেক্স দেখতে। কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারণে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে রাত্রিযাপনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম চট্টগ্রামের দক্ষিণের থানা সাতকানিয়ার পানে। পথিমধ্যে কর্ণফুলি নদী এবং তার উপর পাঁচ খুটি বিশিষ্ট অনন্য প্রকৌশল শৈলীতে নির্মিত ‘শাহ আমানত’ সেতুর পশ্চিম পার্শ্বে ১০০ মিটার দূরে আরেকটি রেলসেতু। তখন ছিল পড়ন্ত বিকেলের শেষ প্রহর। প্রভাকর তার খরোজ্জ্বল্য হারিয়ে আবীর রাঙা পোষাকে আসন্ন অাঁধারের আগমনবার্তার জানান দিচ্ছিল। পরিবেশ জনমুখর হলে উপভোগ্যই ছিল। হেঁটেই সেতু পার হলাম। শত শত মানুষ আমাদের মত ভ্রমণে এসেছে। সবাই চলছে আপন গন্তব্যে। ধীরে ধীরে রবি পশ্চিম দিকে মুখ লুকালো। ব্রীজ পার হওয়ার পর শামীম ছাহেব আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। আমরা যাত্রা শুরু করি সাতকানিয়ার উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছলাম রাত্রি আটটায়। সেখানে আমাদের স্বাগত জানান সাতকানিয়া এলাকা আহলেহাদীছ আন্দোলনের সভাপতি মাওলানা মোর্তুযা ছাহেব। আমরা ঢেমসা নামক এলাকায় এ অঞ্চলের একমাত্র আহলেহাদীছ মসজিদে যাত্রি যাপন করি। সকাল সকাল নাস্তা সারার পর আমরা মোর্তজা ছাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রাস্তার ধারে ছোট-বড় টিলা, সারিসারি গাছ সর্বোপরি চারিদিকে সবুজের অপূর্ব সমারোহ। কখনো রাস্তার ধার ঘেঁষে কাটা পাহাড়ের মেটে হলুদ গাত্রে অপলক দৃষ্টি, কখনো দু’পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে এঁকে বেঁকে চলা শস্যখেতে হারিয়ে যাওয়া, কখনোবা দিকচক্রবালে ভেসে উঠা দূরের গাঢ় নীলবর্ণ সারি সারি পাহাড়ের সৌন্দর্যে রুদ্ধশ্বাস মুগ্ধতায় জমে যাওয়া- এ সবের মাঝেই সাড়ে নয়টার দিকে রামুর সাফারী পার্কে পৌঁছলাম। বিশাল এলাকা জুড়ে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসাবে সরকারীভাবে গড়ে তোলা হয়েছে এই সাফারী পার্ক। প্রবেশ করে দেখা যাবে কৃত্রিম কিছু প্রাণী। ভেতরে রয়েছে বণ্য প্রাণীর জাদুঘর এবং সেখানে আছে বিভিন্ন প্রাণীর কঙ্কাল ও দেহাবশেষ। পার্কের মূল অংশে আছে খাঁচাবদ্ধ পাখি ও জীবজমুত। আর গহীন অংশে আছে বাঘ, সিংহ, সাপ-বিচ্ছু ইত্যাদি। সেখানে সবচেয়ে উপভোগ্য বিষয়টি ছিল পর্যবেক্ষণ চূঁড়ায় (watch tower) আরোহণ করা। আটতলা উচ্চতার এই টাওয়ারের চূঁড়া থেকে পার্কের প্রায় পুরো এলাকা দেখা যায়। অসাধারণ সে দৃশ্য! দেড় ঘণ্টা পর বেলা ১১-টায় সেখান থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতে : পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত, যার মায়াবী আর্কষণে দেশ-বিদেশের বহু সৌন্দর্যপিয়াসী এখানে ছুটে আসে। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে পর্যটন এলাকায় যখন আমাদের গাড়ি পেঁŠছল তখন বেলা সাড়ে ১২-টা। গাড়ি পার্কিং করতে না করতেই সবাই একযোগে নেমে পড়লাম। বহুল আকাংখিত সমুদ্র সৈকত এই আমার চোখের সামনেই! শিহরীত বিস্ময় নিয়ে সৈকতের দিকে পা বাড়ালাম। চক্ষু স্থির হয়ে গেল। মধ্যদুপুরের তীব্র রৌদ্রচ্ছটা দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় মাথায় যেন মুক্তোর টুপি পরিয়ে দিয়েছে! অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে চোখ ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের গুরুগম্ভীর মেঘের মত আওয়াজ সমুদ্রের বিশালতার প্রতি নিমিষেই শ্রদ্ধার ভাবাবেগ জাগিয়ে তোলে। কিঞ্চিৎ পা ডুবিয়ে হতবিহবল নেত্রে হারিয়ে গেলাম সাগরের বিশালতায়। ছোট-বড় অসংখ্য ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে অবিরাম, প্রতিনিয়ত জানান দিচ্ছে স্রষ্টার অস্তিত্বের সীমাহীন অনুকম্পা। যে স্রষ্টা এত বিশাল করে এই সমুদ্রকে সৃজন করেছে তিনি কত মহান! অন্তর জগৎ নিংড়ে শ্রদ্ধা-কৃতজ্ঞতার বান ডাকল, মস্তক অবনত হল স্রষ্টার প্রতি। সৈকতে হাজার হাজার মানুষ। বালক-তরুণ-প্রেŠঢ় সকলেই যেন বয়সের বাঁধ ছাপিয়ে সমুদ্রবক্ষে গা ভাসিয়েছে। কারো প্রতি কারো লক্ষ্য নেই। টানা প্রায় তিন ঘণ্টা সেখানে আমরা ঢেউয়ের সাথে দাপাদাপি করলাম, প্রথম সমুদ্রদর্শনের স্মৃতি চিরজাগরূক রাখতে। এক ফাঁকে সাথে নিয়ে যাওয়া ফুটবল নিয়ে খেলাধূলায় মত্ত হলাম, এঁকে দিলাম সৈকতের বালুকাবেলায় আমাদের স্মৃতির পদচিহ্ন। অতঃপর বিকাল ৪-টা নাগাদ কক্সবাজারে আমাদের ৩দিনের জন্য ভাড়া করা নতুন ডেরায় ফিরলাম। দুপুরের খাবার গ্রহণ করেই আবার বিকাল পাঁচটায় আমরা হিমছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই।

হিমছড়ির পাহাড়ে : হিমছড়ি কক্সবাজার পর্যটন এলাকা থেকে ৮-১০ কিঃমিঃ দূরত্বে অবস্থিত। জনবসতিহীন শুনশান রাস্তার একদিকে গাছ-গাছালী ছাওয়া, লতা-গুল্ম ঢাকা, ছোট-মাঝারী-বড়,  খাড়া-ঢালু হরেক কিসিমের পাহাড়, অন্যদিকে ২০০ মিটার দূরত্বে বিশাল সমুদ্র। রাস্তার ধারে কিছু কিছু পাহাড় এতটা খাড়া যে মনে হয় এই বুঝি ধ্বসে পড়ল। মনে পড়ে গেল, বনী ইসরাঈল সম্প্রদায় আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণে ছলছাতুরী করায় আল্লাহ্ তাদের মাথার উপর তূর পর্বত উঠিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তারা পর্বতপিষ্ট হয়ে মরার ভয়ে ঈমান এনেছিল। মাথার উপর পর্বত ঝুলন্ত থাকলে তখন অবস্থা কেমন হবে মানবমন কি তা কল্পনা করতে পারে, যতক্ষণ না এরূপ দৃশ্য দেখে? নিঃসন্দেহে তা কল্পনার ঊর্ধ্বে।  সূর্য তখন প্রায় অস্তগামী, এমন সময় আমরা হিমছড়ি পর্যটন এলাকায় পেঁŠছলাম। গাড়ী থেকে নেমে পাহাড়ে ওঠার জন্য দল বেঁধে ছুটলাম। সকল বাধা পেরিয়ে ভয়কে জয় করে দক্ষ পর্বতারোহীর মত সারিবদ্ধভাবে উঁচু উঁচু পাহাড়ের একটি চূড়ায় উঠে গেলাম। পর্বত চূড়ায় দাঁড়িয়ে আরো একবার বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে গেলাম প্র্রকৃতি অপরূপ সৌন্দর্যে। সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার ছিল, সাগরের মাঝে যে বর্ণিল সূর্যাস্ত দেখার জন্য মানুষ সৈকতে অধির অপেক্ষায় থাকে, তা দর্শনের সৌভাগ্য হল আমাদের আরো অসাধারণ এক লোকেশন থেকে। সহস্র মুখের মুগ্ধ চাহনীর প্রতি বিদায়ী সম্ভাষণ জানিয়ে রক্তিম বেশে সাগরগর্ভে সূর্য যখন মুখ লুকাচ্ছে, প্রকৃতিতে তখন অবিরলধারায় চলছে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের আলোড়ন। ক্রমশঃ আঁধার ঘনিয়ে আসছিল, এই মুহূর্তে পাহাড় থেকে নামা ভয়ানক আনন্দের। অবশেষে পাহাড় থেকে নেমে সোয়া ছ’টার দিকে রওনা হলাম এবং কক্সবাজার এসে নির্ধারিত হোটেলে রাত্রিযাপন করলাম।

সেন্টমার্টিনে কিছুক্ষণ : ভোর ছ’টায় রওনা হয়ে বেলা পৌনে ন’টায় আমরা পৌঁছালাম টেকনাফের দমদমিয়ায়। এখান থেকেই লঞ্চ ছেড়ে যায়। কক্সবাজার থেকে টেকনাফের দূরত্ব ৮০ কি:মি: হলেও রাস্তা সরু ও অাঁকাবাঁকা, যার কারণে সময় একটু বেশি লাগে। লঞ্চঘাট নাফ নদীতে। আর এই নদীকে কেন্দ্র করে এলাকার নাম হয়েছে টেকনাফ। বাংলাদেশ ও বার্মাকে বিভক্তকারী সীমানা রচনা করেছে এই নাফ নদী। ‘কেয়ারী সিন্দাবাদ’ নামের সুন্দর এই লঞ্চটি আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করল ঠিক বেলা সাড়ে ন’টায়। নদীর বুক চিরে মৃদু-মন্দ গতিতে চলছে আমাদের লঞ্চ। বামে অনেক দূরে বার্মার উঁচু উঁচু পাহাড় আর ডানে বাংলাদেশের ছোট-বড় সবুজ পাহাড় ও বাড়ীঘর, পাহাড় কেটে নির্মিত সরু রাস্তাও দেখা যায়। লঞ্চ ছাড়ার সাথে সাথে একঝাঁক সমুদ্র খেচর এ্যালবেট্রস কোথা থেকে এল তা ঠিক অনুধাবন করতে পারিনি। দৃষ্টিনন্দন তার রং, আকৃতি আর অনুসরণের ভঙ্গি। কি নিখুঁত নিখিল অধিপতির সৃষ্টি! ঘণ্টাখানিক বা তারও বেশকিছু পর নদী শেষ হয়ে আসল। আমরা পৌঁছলাম সমুদ্রের সীমানায়। সেখানে জনশূন্য বালুকাময় শাহপরীর দ্বীপ সমুদ্রের বুকে লম্বা জিহবা টেনে বসে আছে। সমুদ্র ও নদীর মিলনস্থলে সে-ই আল্লাহর সৃষ্টির অসাধারণ এক নিদর্শন দৃষ্টিগোচর হল, যা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন (ফুরক্বান ৫৩, রহমান ১৯)। দুই জলাধারের পানির মাঝে এক লম্বা সুস্পষ্ট ব্যবধানরেখা আমাদের দৃষ্টিতে পড়ল। বিস্ময়ে আরো একবার সুবহানাল্লাহ পড়লাম। কিছুক্ষণ পর দূর সমুদ্রে একটি অস্পষ্ট রেখা ফুটে উঠল। লঞ্চ সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। ক্রমেই স্পষ্ট হতে লাগল রেখাটি। হ্যাঁ, অনুমান ঠিক, এটাই আমাদের স্বপ্নের সেন্টমার্টিন। বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন মাত্র ৬ কি:মি: আয়তনবিশিষ্ট এই সেন্টমার্টিনে যখন পা রাখছি, তখন দিনমণি মধ্যগগনে বসে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছিল। তখন প্রায় বেলা ১২টা বেজে গেছে। চারিদিকে নীল সমুদ্রের মায়াবী আহবান। স্বচ্ছ ঢেউয়ের ভদ্র আস্ফালনে সমুদ্রতীর মুখর হয়ে উঠেছে। কালো কালো খরখরে ধারালো প্রবালে ঢাকা সৈকত। তা পেরিয়ে পানিতে নামাই বেশ কষ্টকর। প্রবালের গঠন সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের দুটি মত আছে। কেউ বলেন, শামুক ও সামুদ্রিক কীট মরে এক সাথে জমাট বেঁধে এরূপ পাথরের সৃষ্টি হয়েছে, আর কেউ বলেন, শামুক ও সমুদ্রকীটের মল জমাট বেধে এগুলোর সৃষ্টি। যেভাবেই সৃষ্টি হোক না কেন, তা একটি আশ্চর্য সৃষ্টি। পাথরের ন্যায় নিশ্চল অথচ তা বড় হয় ধীরে ধীরে। প্রবাল আর প্রবাল! একটু এগিয়ে দেখলাম জঙ্গি বিমান আকৃতির কিছু একটা বালির উপর পড়ে আছে। কাছে যেতেই বুঝতে পারলাম তা সামুদ্রিক কোন প্রাণী। তীর থেকে কিছুটা ভিতরে সারি সারি নারিকেল গাছ। বৃত্তাকার এই দ্বীপের সর্বত্রই এরূপ নারিকেল গাছের প্রাচুর্য দেখা যায়, যে কারণে এর আরেকটি নাম হয়েছে নারিকেল জিঞ্জিরা। আর এর ফাঁকে ফাঁকে দ্বীপবাসীরা পর্যটকদের জন্য কোথাও কোথাও বাঁশ ও খুঁটি দিয়ে তৈরী করেছে অস্থায়ী দোকান। বিস্মিত হলাম শুটকির দোকান দেখে। ৪-৫ ফুট লম্বা মাছ শুটকি করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এক স্থানে এসে বিস্মিত হয়ে থমকে দাঁড়ালাম নারিকেল গাছের সদৃশ সুন্দরবনের সেই গোলপাতা গাছ দেখে। গোটা দ্বীপ জুড়েই বালুকাময় ভূমি। এর মাঝেই নারিকেল আর গোলপাতা গাছে ভরা সবুজের সমরোহ। ছবির চেয়েও যেন সুন্দর! এখান থেকে আরো দক্ষিণে জোয়ারের সময় সেন্টমার্টিন থেকে বিচ্ছিন্ন ভূখন্ড ছেড়াদ্বীপ, যা দেশের সর্বশেষ স্থলভাগ। পর্যটকদের থাকার জন্য দ্বীপে বেশ কিছু রিসোর্ট ও কটেজ রয়েছে। পর্যটকদের আর্কষণের জন্য কটেজগুলো প্রাকৃতিক ও কৃত্রিমতার মিশেলে সাজানো হয়েছে। গোটা দ্বীপে পাকা বাড়ী বলতে একটি মাত্র তিনতলা সরকারী ভবন আর হাতেগণা কয়েকটি ইটের ঘর রয়েছে। কটেজে পানি পান করতে গিয়ে শুনলাম এক আশ্চর্য কথা। ভূমি তথা বালুর ১৫ ফিটের মধ্য থেকে ওঠে মিঠা পানি, আর তার নিচ থেকে ওঠে লোনা পানি, কয়েক ফিট ব্যবধানে পানির এই তারতম্য! কতই না রহস্যময় আল্লাহ সৃষ্টি সুবহানাল্লাহ..!! আল্লাহ তাআলার এক অপূর্ব নিদর্শন এই সেন্টমার্টিন। এখানকার অধিবাসীরা অত্যন্ত আল্লাহভীরু। ছোট্ট সোনামণিরা কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। স্থানীয় মহিলারা খুব পর্দানশীন। তাদেরকে বের হতে দেখা যায় না। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জেনেছিলাম দ্বীপে একটা নির্দিষ্ট স্তর আছে যার উপর সাগর উত্তাল হলেও পানি ওঠেনা। এমনকি সিডর, নার্গিস, আইলাতেও পানি ওঠেনি। অথচ সমুদ্র থেকে এর উচ্চতা সামান্যই। সত্যিই আল্লাহ ইচ্ছা করলে অনেক কিছু করতে পারেন যা বান্দা কল্পনাও করতে পারে না। মনে হল ধর্মপ্রাণ এই দ্বীপবাসীর উপর আল্লাহর অনেক রহমত আছে। বেলা তিনটাতেই আবার ফিরতি যাত্রা। সমুদ্রের দুলুনী আর নাফ নদীতে পড়ন্ত বিকেলের রূপোলী ম্লানিমা, অাঁধার ঢাকা পাহাড়ী জঙ্গলের অদ্ভূত নৈঃশব্দ আর সিঁদুর রাঙা আবিরের রূপসুধা আকণ্ঠ অবগাহন করতে করতে টেকনাফ ফিরে এলাম। সেখান থেকে রাত্রি প্রায় ১০টার দিকে আবার কক্সবাজার ফিরলাম।

রাতের সমুদ্র : কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের প্রতিটি মুহূর্তই যেন মনোমুগ্ধকর। সকালে তার এক রূপ, দুপুরে এক রূপ, বিকালে এক রূপ আর রাতে আরেক রূপ। কোন রূপটা বেশী আকর্ষণীয়? এ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। তবে অনেকের মতে, আসল সৌন্দয মূলতঃ রাতেই। তাই সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে কয়েকজন বন্ধু মিলে রাত্রি ১১টার দিকে সৈকতের দিকে রওনা হলাম। সৈকত একেবারে জনশূন্য! চারিদিকে অমাবশ্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না, কেবলই ভয়ংকর হৃদয় কাঁপানো গর্জন। প্রচন্ড বাতাস আর সাথে সাথে ঢেউয়ের উত্তাল নাচন। ভয়ানক গর্জন করে এসে তটে আছড়ে পড়ছে একেকটা ঢেউ। মাঝে মাঝে এত জোরে ঢেউ আসছিল যে মনে হয় সবাইকে টেনে নিয়ে যাবে। জোয়ারের সময় হওয়ায় সমুদ্র এত উত্তাল। তবে বড় ভাইয়েরা বললেন, চাঁদনী রাতেই আসল সৌন্দর্য টের পাওয়া যায়।  

রাঙ্গামাটির পাহাড়ে : কক্সবাজারে পরদিন শেষ বেলা পর্যন্ত সৈকতেই কাটালাম। অতঃপর বিকাল পাঁচটার দিকে কক্সবাজারকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম সাতকানিয়ার উদ্দেশ্যে। রাতটুকু সেখানে কাটিয়ে পরদিন সকালে রওনা হলাম রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে। রাঙ্গামাটি যেলায় প্রবেশের পর শুরু হল অাঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ। রাস্তায় চড়াই-উৎরাইয়ের কোন শেষ নেই। এখানে উঁচু তো ওখানে নিচু। একপাশে উঁচূ পাহাড় তো অন্য পাশে হাজার মিটার গভীর খাঁদ। পাহাড়ের ঢাল কেটে নির্মিত রাস্তা। ভয়ংকর কিন্তু অতি চমৎকার সব পাহাড়ী বাঁক পেরিয়ে রাঙ্গামাটি পর্যটন কেন্দ্রে যখন পৌঁছলাম, তখন পৌনে ১০-টা বেজে গেছে। শহরে ঢুকতেই মনে হল পুরো শহরটাই পানি দ্বারা আবৃত। চারিদিকে কাপ্তাই হরদ ঘিরে আছে রাঙ্গামাটিকে। পর্যটন কেন্দ্র দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম সবাই। প্রবেশ করেই দেখলাম সেই বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রীজ। দু’টি উঁচু থামের সাথে সংযুক্ত অনেকগুলো লম্বা তারের সাথে ব্রীজটি ঝুলন্ত রয়েছে বলে একে ঝুলন্ত ব্রীজ বলা হয়। খুব মনোরম লোকেশনে ব্রীজটির অবস্থান। এখানে যে দিকেই তাকাই চোখ জুড়িয়ে যায়। ব্রীজ পার হলেই বড় বড় টিলা যেগুলো কিছু কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন। সেখানে চাকমারা কোন রকম মাথা গোঁজার ঠাই করে নিয়েছে। সেখানে মূলত পাহাড়ী চাকমা উপজাতি ও বাঙ্গালীদের বসবাস। তারা শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত মনে হল তাদের। তাদের শিক্ষাগার বলতে পুরাতন দোতলা ভবনে একটিমাত্র বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অজয় চাকমার মাথে আলাপ করে জানতে পারলাম, এখন এই বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে এবং ভাল ফলাফলও করছে। তবে শিক্ষকদের বেতন একেবারে নগণ্য। স্থানীয়ভাবে চাঁদা উঠিয়ে শিক্ষকদের বেতনভাতা প্রদান করা হয়, শিক্ষার্থী সংখ্যা মোটামুটি ভাল। কম বেশী প্রকৃতির সাথে লড়াই করেই তারা এখানে জীবনযাপন করছে। পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে এ স্থান গড়ে না উঠলে হয়ত তাদের জীবনযাত্রার মান আরো নিম্ন হত। একটি ঢিলার উপরে তাদের উপাসনালয় ‘ধর্মঙ্কুর বিহার’ দেখলাম। আশেপাশের টিলাগুলো খাড়া ঢাল বিশিষ্ট। সেখানে উঠতে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছিল। অথচ স্থানীয়রা অনায়াসে তরতর করে উঠানামা করেছে। অসংখ্য পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে নীল সৌন্দর্যের আরেক লীলাভূমি এই কাপ্তাই হরদ। সুগভীর এই হরদের আয়তন ১৬৫ বর্গ কিঃমিঃ। হরদের পানিতে গোসল করতে নামলাম, তবে পরিবেশ শুনশান হওয়ার কারণে ভয় ভয় করছিল। বোটযোগে হরদ দিয়ে অনেকটা ভেতরে গেলে দেখা যেত শুভলং ও অন্যান্য ঝর্ণা। কিন্তু সময়ের অভাবে আমরা সেখানে যেতে পারিনি। অতঃপর দুপুরের খাওয়া সারলাম বিকাল পৌনে চারটার দিকে। তারপর আমরা রওনা হলাম আপন ঠিকানা রাজশাহীর উদ্দেশ্যে।

বাড়ী ফেরা : বহু পথ ভ্রমণ করে অনেক সুখস্মৃতি, অনেক অভিজ্ঞতার ডালি নিয়ে অবশেষে ১০ই ফের্রুয়ারী দুপুরে মারকায প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছলাম। আলহামদুলিল্লাহ। ঠিক দশ মিনিট পরই মসজিদের মাইক থেকে মুয়াযিযনের সুললিত কন্ঠে ধ্বনিত হল যোহরের আযান। বাকী জীবন প্রথম সমুদ্র দর্শনের এই স্মৃতি আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যাবে অনুক্ষণ-এ কথা নিশ্চয় করে বলা যায়।

  • লেখক: আলিম ২য় বর্ষ, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী।


আরও