নিসর্গের প্রাণোচ্ছলতায়, বৈচিত্রের সমারোহে
আসিফ রেযা
প্রতিবছরের
মত এবারও আয়োজন করা হল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যুবসংঘে’র উদ্যোগে
শিক্ষাসফর। সফরের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল শেরপুরের মধুটিলা ইকোপার্ক এবং
গজনী অবকাশ কেন্দ্র। প্রায় ৬০ সদস্যের সফরসঙ্গী নিয়ে বরাবরের মত আমরা ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর
কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘আল- মারকারযুল ইসলামী আস-সালাফী’ থেকে
যাত্রা শুরু করি। যাত্রার পূর্বমুহূর্তে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড.মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সফরকারীদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ ও দিক-নির্দেশনা মূলক ভাষণ
প্রদান করেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের শিক্ষাসফরের উদ্দেশ্য যেন হয় আদর্শ মানুষ
হওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ। তোমরা সর্বাবস্থায় সত্য-ন্যায়ের আদর্শের উপর অবিচল
থাকবে, আর বাতিলের বিরুদ্ধে থাকবে আপোষহীন।’ গাড়ী ছাড়ার পূর্ব পর্যন্ত
তিনি আমাদের সাথে থেকে বিদায় জানান। আমাদের সফরসঙ্গী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন
‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি জনাব নূরুল ইসলাম ও
সাধারণ সম্পাদক আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব, দফতর সম্পাদক আব্দুর রাকীব ও সাবেক
অর্থ সম্পাদক শেখ আব্দুছ ছামাদ। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়
যুবসংঘের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল, কর্মী ও সাধারণ ছাত্রবৃন্দ।
বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি মুকাররম বিন মুহসিনের দো‘আ পাঠের মাধ্যমে রাত্রি
১১-টা ৩০ মিনিটে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। ভোর ৫টা নাগাদ আমরা শেরপুর পৌঁছে
যাই এবং একটি মসজিদে ফজরে ছালাত আদায়ের জন্য যাত্রাবিরতি করি। আবার যাত্রা
শুরু হয় শেরপুর শহর থেকে ১০/১৫ কিঃ মিঃ উত্তরে সরকারী ইকোপার্ক মধুটিলার
উদ্দেশ্যে। সকাল সাড়ে ৬-টার দিকে আমরা মধুটিলা পৌঁছাই। সেখানে সকালের
নাস্তা সেরে ইকোপার্ক পরিভ্রমণের জন্য আমরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ি।
প্রথমেই উঠলাম পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। যেখান থেকে অত্র অঞ্চলের গারো
পাহাড়গুলো প্রায় পুরোটাই সহজেই নজরে পড়ছে। উঁচু উঁচু টিলা আর গাছপালা ছেয়ে
আছে সমস্ত জায়গা জুড়ে। সকালের হালকা কুয়াশায় আর মিষ্টিরোদে হেসে ওঠা বাহারী
গাছপালা পরিবেষ্টিত গারো পাহাড়ের সারি তার ঝলমলে শোভায় আমাদের মোহিত করে
ফেলল। রঙিন স্বপ্নীল এই দৃশ্যপট এক অদৃশ্য মায়াবী হাতছানিতে পাহাড়কে আপন
করে নেওয়ার প্রবল আমন্ত্রণ জানালো আমাদের। টাওয়ার থেকে নেমে সেই আমন্ত্রণে
সাড়া দেয়ার জন্যই যেন আমরা বিপদ-আপদের আশংকা সব ভুলে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে
বন্ধুর পথ অতিক্রম করে দু’পাহাড়ের মধ্যবর্তী খাঁজে নেমে এলাম। তারপর আবার
একটি উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এলাম, ঝোঁপঝাড়ে ছাওয়া গুহাকৃতি এক সরু টানেল
পেরিয়ে। অসাধারণ সে অনুভূতি। সেখান থেকে সারি সারি পাহাড়ের রাজ্যে ঢুকে
পড়লাম। খাড়া, পিচ্ছিল পথ বেয়ে আবার নীচে নামলাম। আবার অন্য পাহাড়ে উঠলাম।
এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়ার জন্য পার্ক কর্তৃপক্ষ ইটে বিছানো পথ তৈরী
করে রেখেছে। কিন্তু সেসব পথ ছেড়ে আমরা বেছে বেছে বন্ধুর পথগুলো ধরে পাহাড়ী
পথে ঘোরার সাধ উপভোগ করছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি, তবুও যেন
সাধ মেটে না। আশপাশের প্রায় সকল উঁচু পাহাড় পরিভ্রমণ শেষে এক পাহাড়ের
মাথায় অবস্থিত সরকারী রেস্ট হাউজের সামনে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।
অতঃপর ফিরতি পথে মিনি চিড়িয়াখানা, পাহাড়ের মাঝে কৃত্রিম লেক ইত্যাদি
দেখলাম। দীর্ঘ তিন ঘণ্টা সেখানে বেড়ানোর পর আমরা গজনী অবকাশ কেন্দ্রের
উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। প্রায় ১৫/২০ কিঃ মিঃ দূরত্বের এ পর্যটনস্পটে পৌঁছতে
আমাদের বেলা সাড়ে ১১-টা বেজে গেল। সেখানে আবার প্রায় একই ধরনের প্রাকৃতিক
দৃশ্য। চারিদিকে যতদূর দেখা যায় শুদ্ধ সবুজ গারো পাহাড়ের অপরূপ মেলা। একটু
আগের সেই পাহাড়ী পথে ঘোরার নেশা আবার আমাদের পেয়ে বসল। ঠিক পূর্বের মতই দলে
দলে ভাগ হয়ে গেলাম। পরিকল্পনা করলাম পশ্চিম প্রান্তের উঁচু পাহাড় দিয়ে
শুরু করে উত্তর প্রান্ত হয়ে গোটা এলাকা ঘুরে আবার পূর্ব প্রান্ত ফিরে আসব।
শুরু করলাম মিনি ট্রেকিং। লোকালয় থেকে দূরে গিয়ে আমরা ক’জন হারিয়ে গেলাম
বুনো সৌন্দর্যের রাজ্যে। এক টিলা থেকে আরেক টিলা, একচূড়া থেকে আরেক চূড়া
দিশাহীনভাবে। দেখা পেলাম একটি ছোট্ট কিন্তু মনোহারী ঝর্ণার। সেখানে হাত-পা
ভিজিয়ে অনেক্ষণ কাটালাম। আবার এগিয়ে চলা। পথ হারিয়ে ফেলব না তো! নির্জন
এলাকায় সুযোগ পেয়ে কেউ কিছু হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে না তো! দু’একবার
মাথায় এসব দুশ্চিন্তা ঢুকলেও তা ঝেটিয়ে বের করে দিলাম। একবার এক গারো
কিশোরের দেখা পেলাম, কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তেমন সাড়া পেলাম না।
ওদেরকে মনে হল কিছুটি রুক্ষ আচরণের। নিজেদের পরিচয়ে তারা গারো না বলে
খৃষ্টান বা বাংলাদেশী বলতেই তারা বেশী উৎসাহী। বিষয়টি একটু ভিন্ন রকম ঠেকল।
পাহাড়ে খাওয়ার পানির খুব সমস্যা। গভীরভাবে খনন করা একটি কুপ থেকে এক গারো
ব্যক্তির সহযোগিতায় পানি তুলে আমরা তৃষ্ণা মেটালাম। কয়েকটি টিলার মাথায়
গারোদের বাড়ি-ঘর দেখে উপরে উঠলাম। অধিকাংশ বাড়িতেই কেউ নেই। কাজে গেছে হয়ত
কোথাও। ভর দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ভারতীয় বর্ডারের কাছাকাছি পৌঁছলাম।
বর্ডারের পরই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। সেখানে দেখা যায় আরো উঁচু উঁচু পাহাড়।
আর না এগিয়ে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। এ পাহাড়, সে পাহাড় ঘুরতে ঘুরতে
পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের কাছে এসে পৌঁছলাম। অতঃপর মসজিদে ছালাত আদায় করে আমাদের
রান্নাস্থলে পৌঁছে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। অবকাশ কেন্দ্রের মুখেই রয়েছে
বেশ বড় একটি লেক। সেখানে আমরা অনেকেই গোসল করলাম এবং প্যাডেল নৌকায় ঘুরে
বেড়ালাম। বিকেল ৪-টার দিকে আমরা সেখান থেকে টাঙ্গাইলের মধুপুর ভাওয়ালের
গড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। কিন্তু পৌঁছার পূর্বেই সন্ধ্যা নেমে আসায়
সেখানে আর যাওয়া সম্ভব হল না। তাই রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে আধো আলো আধো
অন্ধকারের মাঝে আনারস গাছ থেকে দুধের সাধ ঘোলে মিটানোর চেষ্টা করলাম। এতে
ভাওয়ালের গড় দেখার আফসোস কিছুটা হলেও কমল। এরপর রাজশাহী অভিমুখে আমাদের
ফিরতি যাত্রা শুরু হল। সফরে অংশ গ্রহণকারী সকলের মাঝে বিতরণ করা হল রাবি
যুবসংঘের নামাঙ্কিত প্যাড, কলম এবং রাবি যুবসংঘ স্মরণিকা ২০১০। এছাড়াও
নতুনদের জন্য ক্যালেন্ডার, ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকা হাদিয়া দেয়া হল। সকলের
ভ্রমণক্লান্তির কারণে কুইজ প্রতিযোগিতা আর হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি এই
শিক্ষাসফরে অংশগ্রহণ করার জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানান এবং এর মাধ্যমে
কর্মীদের পারস্পরিক বন্ধনের দৃঢ়তা ও সাংগঠনিক কাজে স্বতঃস্ফূর্ততা আরো
বৃদ্ধি পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। অবশেষে রাত ১২টার দিকে আমরা রাজশাহী
পৌঁছে গেলাম নিরাপদে, ফালিল্লাহিল হাম্দ।