শেকড়ের টানে, স্মৃতির নায়ে

ফারহান দাউদ 1043 বার পঠিত

গ্রামের বাড়িতে গেলাম। ২ বছর পর। পেট্রোল পোড়া গন্ধের বাসে চড়ে, সিটের মাঝে ‘দ’ হয়ে বসে, অনেকদিন পর। যাওয়া হত না, দাদা অসুস্থ, দাদীও। যেতে হল বাবাকে নিয়ে। এক পূর্বপুরুষকে নিয়ে আরেক পুরুষের সাক্ষাতে। গৌরিপুর বাসস্ট্যান্ডটা বদলে গেছে। জনাকীর্ণ বাজার ছেড়ে বেশ দূরে সরে গেছে। রাস্তা দিয়ে আসার পথে গন্ধ পেলাম। গ্রামের গন্ধ, মাটির সোঁদা গন্ধ। বাজারের দিকে বাড়িঘর উঠে গেছে। আছে কিছু পাকা বাড়ি, পয়সাওয়ালা লোকজনের কাজ। একটা ৩ তলা হোটেলও দেখলাম, কোন এক কোটিপতি দারোগার মহল, বাবা জানালেন। তাও গন্ধটা যায়নি, মাটির গন্ধ, শেকড়ের। বাজারের দিন, শনিবার, সকালে তেমন কেউ নেই। দুই জায়গায় হাঁক দিয়ে বাবাকে ডাকল, রিকশা থেকে বাবা ইশারায় দেখিয়ে জোর গলায় বললেন, ‘ভাইস্তা তোমাগো..’ হাত নাড়ল না চেনা চাচারা। সালাম দেয়ার সময় হল না, চলন্ত রিকশায় ছুটন্ত আমরা।

ব্রীজটা পার হতেই খেপা গরু একটা রাস্তার মাঝখান দিয়ে তেড়ে এসে শিং নেড়ে গেল। রিকশাওয়ালা গরুর মালিককে কি একটা বলতেই মালিক দ্বিগুণ তেজে তেড়ে এলো। বাবা হাসে- ‘আবেদ আলী, কাঠগোঁয়ার, এক স্কুলে পড়ত, রোজ ২-৪ টা মারামারি করতই, গরু আর মালিক একরকমই।’ আমিও হাসি, গরু দেখে অথবা মাটির গন্ধে, খোলা হাওয়ায়। রাস্তাটা হাসপাতালের পরেও পাকা হয়েছে অনেকদূর। বাড়িতেও বিদ্যুৎ গেছে, দেখলাম। রিকশা থেকে নেমে আইল ধরে হাঁটি, বাবা হাত তুলে দেখায়, ঐ ক্ষেতটা আমার, আর এই ডানদিকেরটা। বাকিগুলি? ভাগ হয়ে গেছে। ভাল লাগে না। ভাগ কেন হবে? হবেই, সম্পর্ক ভাগ হয়, মানুষ হয়, আর জমি! বাড়িতে ঢোকার আগে পাশের বাড়ির দুই চাচাকে সালাম করতে হয়। ‘ভাইসাব, ছেড়া কত বড় হইসে, ঐদিন দেখসি আবুডা!’ ‘ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ দিসে এইবার’-বাবার জবাবে বিস্ময় আরেকটু বাড়ে, নাগালের বাইরেই চলে গেল কিনা, ভাবে হয়ত।

বাড়িতে ঢুকি। শুনশান বাড়ি। অনেক ছোট লাগে আগের চেয়ে। এসব কারণে মোড়লবাড়ির সীমানা ছোট হয়ে এসেছে, ভাগ, বিক্রি, বিবাদ, দখল। আমিও হয়ে গেছি অনেকটা বড়, হাঁটিহাঁটি পা পা কালের বিশাল উঠানটা খুব ছোট লাগে, চেপে আসে। দাদীর জ্বর, চলাফেরা কম, দাদা শয্যায়, চিনতে পারেন অবশ্য। লোকজন নেই, বুড়োবুড়ি, শুনশান। চারপাশের গাছপালা কমে এসেছে, বাঁশঝাড় খালি প্রায়, চুরি হয় অনেক। পাশের বাড়ির লোকজন জানাল, জলপাই গাছটা বিক্রি হয়ে গেছে, শেকড় ডালপাতা সহ। লিচু গাছটা আছে এখনো। জলপাই পাড়ার বাঁশের কোঠারিটার কোন সন্ধান পাই না, গাছের সাথে কি সবই নিয়ে গেছে মিনিমাগনায়? যে কোদালটা ছোটবেলায় কাঁধে নিয়ে ঘুরতাম, সেটা কোথায়? ইজিচেয়ারটা কে নিলো? উঠানের বেলিফুলের গাছটা শুকনো, মরা। পানি পায় না কতদিন কে জানে? ফুল ধওে না অনেকদিনই। মৃত আর অর্ধমৃত গাছের ছায়া নিয়ে ছেলেবেলার বিশাল উঠানে দাঁড়িয়ে থাকি, মোড়লবাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী, অধোমুখে। নিস্তব্ধতায়। পাখিগুলো কোথায়? মরা গাছেও তো ২-৪ টা পাতা আছে, ২-১টা কাক এলেও তো পারে। বেড়ার রান্নাঘরটায় উঁকি দিই, ছোট্ট রাজন একদিন তার উলের টুপিটা এখানকার একটা চুলাতেই বিসর্জন দিয়েছিল। লাকড়ির চুলায় অল অল তুষ দিয়ে ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে চোখ লাল করে ফেলতো যে শিশু, সে কি এখনো বসে আছে চুলাটার পাশে, লাল সোয়েটার গায়ে? শূন্য চুলা ধাক্কা দেয় চোখে, শুধু পাশে বসা বিড়ালটার থাবা চাটা দেখে মনে পড়ে এমনি কোন সকালে ছুঁড়ে দেয়া মাছের কাঁটা  খেয়ে অলস হাই তোলা বিড়ালগুলোর কথা। আচ্ছা, বাবার না একটা পোষা কুকুর ছিল! বাবা এলেই দাওয়ায় শুয়ে থাকত? গেল কই সেটা? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে যাই। সবকিছুর মতই নিশ্চয়ই চলে গেছে, কি হবে আর টেনে? উঠানে ফিরে আসি। মরা গাছ, আর একটা চুলা। ঘুম থেকে উঠেই দাদীর পাশে বসে যেতাম চুলার আগুন নিতে। নেভানো চুলা, জ্বলে না মনে হয় আর। পুকুর পাড়ে দাঁড়াই, পানি কম, শীতকাল। পাড়ের কাঁঠালগাছটাও মরা মরা, কাঁঠাল কি হয়? পাশে দাঁড়ানো বাবা জানালো- হয়তো হয়, নেবার আগেই কেউ নিয়ে যায়। অনেক গাছ ছিল পুকুরপাড়ে, নেই একটাও, দেখার লোক নেই। পুকুরপাড়ের সামনে খড়ের গাদাটা কই? জমিই করানো হয় না, খড় আসবে কোত্থেকে? পাশের জমিটা চলে গেছে, তার পাশেরটা, তার পাশেরটাও, বিক্রি-বাট্টা, ভাগ। যা আছে, তাও তো খালি। শুনে বাবার উত্তর- ‘বর্গা দেয়া যায় মরা গাছগুলো সাফ করে, কিন্তু আসা তো হয় না।’

সীমানায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকি, দূরে, কু-ঝিক-ঝিক রেলের ধোঁয়ার দিকে, লাল সোয়েটারের পরিপাটি চুলের ছোট্ট ছেলেটা ছোট্ট হাত-পা নিয়ে যেভাবে তাকাতো, ধানকাটা মাঠের দিগন্তে। রান্নাঘরের পিঠার ধোঁয়া নাকে আসে, পায়েসের গন্ধ, টিউবওয়েল চাপার শব্দ, কাঠ চেড়ার আওয়াজ, গরুর ডাক, উঠানে ছড়িয়ে পড়া মুরগির বাচ্চাগুলোর চিঁ চিঁ, ফুফুদের হাসাহাসি, ৩-৪টা অলস বিড়াল, আর সবার মাঝে ঘুরে বেড়ানো লাল সোয়েটারের ছোট্ট ছেলে।

বাবার ডাকে চটকা ভাঙে, লাল সোয়েটার না, জিন্স আর জাম্পারের শহুরে আমার। দিগন্তের ধানক্ষেত থেকে আবারো নিঝুম বাড়ির দিকে চোখ ফেরাই। সীমানা তো অনেক ছোট হয়ে গেছে। আর জমিগুলি না বেচলেও তো চলে। বাবার আশাবাদী কণ্ঠ- ‘তুই না চাইলে বেচব কেন? ধর গাছপালা খানিকটা সাফ করে, আর বর্গা দিয়ে....’

বাবা সোৎসাহে বলে চলেন, আমি আনমনে মাথা নাড়ি, না বেচলেও চলে। একদিন তো ফিরতেই হবে উত্তরাধিকার চাইতে, একা, পূর্বপুরুষের পাশে, সাড়ে তিন হাতের ভাগ নিতে, আজ বা কাল, অথবা কয়েকদিন পর। না বেচলেও চলে...।



বিষয়সমূহ: গল্প
আরও