আক্বীদার মানদন্ডে বিচার দিবস

আসাদুল্লাহ আল-গালিব 10534 বার পঠিত

ইয়াউমুল হিসাব বা বিচার দিবস হলো বান্দার প্রাপ্তির জায়গা। ঐদিন সকলেই তার নিজ নিজ হিসাব বুঝে পাবে। কেউ যদি অণু পরিমাণ নেকী করে তবেও সেই পরিমাণ সে পাবে। আর মন্দ আমল করলেও সে তদরূপ বুঝে পাবে।  অত্যাচারিতরাও পাবে তাদের ন্যায় বিচার। সেদিন পশুদেরও বিচার হবে যে পশুগুলো শক্তির বড়াইয়ে দুর্বল পশুদের উপর আঘাত করেছিল। সে সমস্ত দুর্বল পশুরাও আল্লাহর পক্ষ থেকে ন্যায় বিচার পাবে। নিম্নে বিচার দিবস সম্পর্কে কিছু আক্বীদাগত বিষয় আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

কুরআন থেকে দলীল :

বিচার দিবসে বান্দার হিসাব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَإِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللَّهُ- ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর। আর তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে, তা তোমরা প্রকাশ কর বা গোপন কর, তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহ তার হিসাব নিবেন’ (বাক্বারাহ ২/২৮৪)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا حِسَابَهُمْ   ‘অতঃপর আমাদের দায়িত্বে রয়েছে তাদের হিসাব গ্রহণ’ (গাশিয়া ৮৮/২৬)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَإِنْ مَا نُرِيَنَّكَ بَعْضَ الَّذِي نَعِدُهُمْ أَوْ نَتَوَفَّيَنَّكَ فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ وَعَلَيْنَا الْحِسَابُ- ‘আমরা তাদেরকে যে (শাস্তির) ওয়াদা করেছি, তার কিছু যদি তোমাকে দেখিয়ে দেই অথবা (তার আগেই) যদি তোমার মৃত্যু ঘটাই, সর্বাবস্থায় তোমার দায়িত্ব কেবল দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া। আর আমাদের দায়িত্ব হিসাব নেওয়া’ (রা‘দ ১৩/৪০)

হাদীছ থেকে দলীল :

এ বিষয়ে হাদীছে এসেছে,

أَنَّ عَائِشَةَ زَوْجَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم كَانَتْ لاَ تَسْمَعُ شَيْئًا لاَ تَعْرِفُهُ إِلاَّ رَاجَعَتْ فِيهِ حَتَّى تَعْرِفَهُ، وَأَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ حُوسِبَ عُذِّبَ. قَالَتْ عَائِشَةُ فَقُلْتُ أَوَ لَيْسَ يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى (فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا ) قَالَتْ فَقَالَ إِنَّمَا ذَلِكَ الْعَرْضُ، وَلَكِنْ مَنْ نُوقِشَ الْحِسَابَ يَهْلِكْ-

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সহধর্মিণী আয়েশা (রাঃ) কোন কথা শুনে বুঝতে না পারলে বার বার জিজ্ঞাসা করতেন। একবার রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাঃ) বললেন, ‘(ক্বিয়ামতের দিন) যার হিসাব নেওয়া হবে, তাকে আযাব দেওয়া হবে’। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আল্লাহ তা‘আলা কি ইরশাদ করেননি,فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا  ‘তার হিসাব-নিকাশ সহজেই নেওয়া হবে’ (ইনশিক্বাক্ব ৮৪/৮)। তখন তিনি বললেন, তা কেবল হিসাব পেশ করা। কিন্তু যার হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নেওয়া হবে সে ধবংস হবে’।[1] এটি ক্বিয়ামতের মাঠে সংঘঠিত হবে।

বিচার দিবস সম্পর্কে সালাফদের অভিমত :

(১) ইবনু আবী জায়েদ আল-কিরওয়ানী বলেন, ‘এটা হ’ল সেই দিন যেদিন আমলের খাতা দেওয়া হবে। অতঃপর যাকে ডান হাতে আমল দেওয়া হবে তার হিসাব সহজ হবে এবং যার আমল বাম হাতে দেওয়া হবে সে জাহন্নামে যাবে’।[2] 

(২) বারবাহারী বলেন, ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনা ওয়াজিব। সেদিন তারা আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখবে। আর আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা পর্দা ও দোভাষী ছাড়াই বিচার করবেন’।[3]

(৩) আল-লালকাঈ বলেন, জান্নাত ও জাহান্নাম, মৃত্যু পরবর্তী পুনরুত্থান, মীযান, হিসাব ও ক্বিয়ামতের ফায়ছালার উপর ঈমান আনা ওয়াজিব’।[4] 

বিচার দিবস সংগঠিত হওয়ার সময় :

বিচার দিবস সংঘটিত হবে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার পুনর্সৃষ্টির মাধ্যমে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, يَوْمَ يَبْعَثُهُمُ اللَّهُ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوا أَحْصَاهُ اللَّهُ وَنَسُوهُ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ ‘যেদিন আল্লাহ তাদের সবাইকে পুনরুত্থিত করবেন। অতঃপর তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন। আল্লাহ তার কর্মের হিসাব রেখেছেন। আর তারা সেটি ভুলে গেছে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সকল বস্ত্তর উপরে সাক্ষী’ (মুজাদালাহ ৫৮/৬)

বিচার দিবসে আল্লাহর নূর বা জ্যোতি :

সেই দিনে আল্লাহর নূরের রশ্মিতে পৃথিবী আলোকিত হবে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর বাণী - وَأَشْرَقَتِ الْأَرْضُ بِنُورِ رَبِّهَا وَوُضِعَ الْكِتَابُ وَجِيءَ بِالنَّبِيِّينَ وَالشُّهَدَاءِ وَقُضِيَ بَيْنَهُمْ بِالْحَقِّ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ- وَوُفِّيَتْ كُلُّ نَفْسٍ مَا عَمِلَتْ وَهُوَ أَعْلَمُ بِمَا يَفْعَلُونَ-‘পৃথিবী তার প্রতিপালকের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হবে এবং (বান্দার) আমলনামা পেশ করা হবে। (প্রত্যেক উম্মতের) নবীদের ও সাক্ষ্যদাতাদের (ফেরেশতাদের) আনা হবে। অতঃপর তাদের মধ্যে সঠিক ফায়ছালা করা হবে এবং তারা অত্যাচারিত হবেনা’। ‘প্রত্যেকে তার কৃতকর্মের পূর্ণ ফলাফল পাবে। বস্ত্ততঃ তিনি তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত’ (যুমার ৩৯/৬৯-৭০)

بِنُورِ رَبِّهَا ‘পৃথিবী তার প্রতিপালকের জ্যোতিতে’ বাক্যের অর্থ বলা হয়েছে, أَضَاءَتْ بِعَدْلِ رَبِّهَا بِالْحَقِّ ‘তার প্রতিপালকের ন্যায়বিচারের জ্যোতিতে আলোকিত হবে’।[5] আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الظُّلْمُ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘যুলুম ক্বিয়ামতের দিন ঘন অন্ধকারে পরিণত হবে’।[6]  আর আল্লাহর নূর বা জ্যোতি সম্পর্কে অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,اللهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ مَثَلُ نُورِهِ كَمِشْكَاةٍ فِيهَا مِصْبَاحٌ الْمِصْبَاحُ فِي زُجَاجَةٍ الزُّجَاجَةُ كَأَنَّهَا كَوْكَبٌ دُرِّيٌّ يُوقَدُ مِنْ شَجَرَةٍ مُبَارَكَةٍ زَيْتُونَةٍ لاَ شَرْقِيَّةٍ وَلاَ غَرْبِيَّةٍ يَكَادُ زَيْتُهَا يُضِيءُ وَلَوْ لَمْ تَمْسَسْهُ نَارٌ- نُورٌ عَلَى نُورٍ يَهْدِي اللهُ لِنُورِهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَضْرِبُ اللهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ وَاللهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ- ‘আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের জ্যোতি। তাঁর জ্যোতির উপমা একটি তাক-এর ন্যায়। যাতে রয়েছে একটি প্রদীপ। যা রয়েছে একটি কাঁচ পাত্রের মধ্যে। পাত্রটি একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত। যা প্রজ্জ্বলিত করা হয় বরকতময় যয়তুন বৃক্ষের তৈল দ্বারা। যা পূর্বমুখীও নয় পশ্চিম মুখীও নয়। আগুন স্পর্শ না করলেও ঐ তৈল যেন স্বচ্ছ আলো। জ্যোতির উপর জ্যোতি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা স্বীয় জ্যোতির দিকে পরিচালিত করেন। আল্লাহ মানুষের জন্য উপমাসমূহ বর্ণনা করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সকল বিষয়ে জ্ঞাত’ (নূর ২৪/৩৫)

বিচার দিবসে মহান আল্লাহ তাঁর স্ব মহিমায় আসবেন। যা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, هَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا أَنْ يَأْتِيَهُمُ اللَّهُ فِي ظُلَلٍ مِنَ الْغَمَامِ وَالْمَلَائِكَةُ وَقُضِيَ الْأَمْرُ وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ ‘তারা কি কেবল এ অপেক্ষাই করছে যে, আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ সাদা মেঘমালার ছায়াতলে তাদের নিকট সমাগত হবেন এবং তাদের সমস্ত বিষয় নিষ্পত্তি করা হবে। বস্ত্ততঃ আল্লাহর নিকটেই সকল বিষয় প্রত্যাবর্তিত হয়ে থাকে’ (বাক্বারাহ ২/২১০)

সেই দিন মানুষ তার প্রভুর সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَعُرِضُوا عَلَى رَبِّكَ صَفًّا لَقَدْ جِئْتُمُونَا كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ بَلْ زَعَمْتُمْ أَلَّنْ نَجْعَلَ لَكُمْ مَوْعِدًا- ‘আর তাদেরকে তোমার প্রতিপালকের সম্মুখে হাযির করা হবে সারিবদ্ধভাবে (এবং অবিশ্বাসীদের ধিক্কার দিয়ে বলা হবে) তোমরা আমাদের কাছে এসে গেছ সেভাবে, যেভাবে আমরা তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম। বরং তোমরা ধারণা করেছিলে যে, আমরা তোমাদের জন্য প্রতিশ্রুত (পুনরুত্থানের) দিন নির্ধারণ করব না’ (কাহাফ ১৮/৪৮)

আর সেই দিন প্রত্যেক উম্মতই ভীতবিহবল হয়ে একত্রিত হবে। মহান আল্লাহর বাণী  وَتَرَى كُلَّ أُمَّةٍ جَاثِيَةً كُلُّ أُمَّةٍ تُدْعَى إِلَى كِتَابِهَا الْيَوْمَ تُجْزَوْنَ مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ- ‘যেদিন তুমি প্রত্যেক দলকে দেখবে নতজানু অবস্থায়। আর প্রত্যেক দলকে স্ব স্ব আমলনামার প্রতি আহবান করা হবে (এবং বলা হবে) আজ তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের ফলাফল পাবে’ (জাসিয়া ৪৫/২৮)। আর সেই দিন কাফেরদেরকে মুমিনদের থেকে আলাদা করা হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَامْتَازُوا الْيَوْمَ أَيُّهَا الْمُجْرِمُونَ ‘আর হে অপরাধীরা! তোমরা আজ পৃথক হয়ে যাও’ (ইয়াছীন ৩৬/৫৯)

জীব-জন্তুর বিচার :

বিচার দিবসে সকলেরই বিচার করা হবে। এমনকি জীব-জন্তুুরও বিচার করা হবে। এ বিষয়ে হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لَتُؤَدُّنَّ الْحُقُوقَ إِلَى أَهْلِهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُقَادَ لِلشَّاةِ الْجَلْحَاءِ مِنَ الشَّاةِ الْقَرْنَاءِ- ‘আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক পাওনাদারকে তার পাওনা চুকিয়ে দিতে হবে। এমনকি শিং বিশিষ্ট বকরী থেকে শিং বিহীন বকরীর প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে।[7] অতঃপর বিচার শেষে তারা মাটিতে পরিণত হবে মহান আল্লাহর নির্দেশে। এ বিষয়ে রাসূলের হাদীছ,  عن أبي هريرة، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: "يَقْضِي اللهُ بَينَ خَلْقِهِ الجِنِّ والإنْسِ والبَهائم، وإنَّه لَيَقِيدُ يَوْمَئِذٍ الجَمَّاءَ مِنَ القَرْناءِ، حتى إذَا لَمْ يَبْقَ تَبِعَةٌ عِنْدَ وَاحِدَةٍلأخْرَى، قالَ اللهُ: كُونُوا تُرَابًا، فَعِنْدَ ذلكَ يَقُولُ الكافِرُ: يا لَيْتَنِي كُنْتُ تُرَابًا" . আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তার সৃষ্টি জীন, মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর মাঝে ফায়ছালা করবেন। এমনকি শিংবিহীন ছাগীকেও শিংওয়ালা ছাগীর নিকট থেকে প্রতিশোধ আদায় করিয়ে দিবেন। অতঃপর যখন একে অপরের থেকে প্রতিশোধ নেয়া হয়ে যাবে তখন আল্লাহ বলবেন, তোমরা মাটি হয়ে যাও। তখনই কাফেররা বলবে, হায় আফসোস! আমরাও যদি মাটি হয়ে যেতাম’।[8]

বিচারের প্রকারভেদ :

ক্বিয়ামতের মাঠে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার বিচার হবে দু’ধরনের।

(১) সহজ বিচার : মুমিনের আমল আল্লাহ প্রকাশ করবেন যা আল্লাহ দুনিয়াতে গোপন করেছিলেন। তারই অনুগ্রহে আখিরাতে তাকে ক্ষমা করবেন। এ বিষয়ে আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، مَا الْحِسَابُ الْيَسِيرُ، قَالَ : يَنْظُرُ فِي كِتَابِهِ وَيَتَجَاوَزُ لَهُ عَنْهُ، إِنَّهُ مَنْ نُوقِشَ الْحِسَابَ يَوْمَئِذٍ، يَا عَائِشَةُ، هَلَكَ، وَكُلُّ مَا يُصِيبُ الْمُؤْمِنَ يُكَفِّرُ اللَّهُ بِهِ عَنْهُ، حَتَّى الشَّوْكَةُ  ‘আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বললাম কোন হিসাবটি সহজ হবে। তিনি বললেন, যার আমলনামা দেখে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর যার হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা হবে হে আয়েশা! সেদিন সে ধ্বংস হয়ে যাবে। মুমিনের নিকট যে সকল বিপদ-আপদ আসে এর দ্বারা আল্লাহ তার পাপ ক্ষমা করেন। এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে ফুটে এর দ্বারাও’।[9] 

অপর এক হাদীছে এসেছে, إِنَّ اللَّهَ يُدْنِى الْمُؤْمِنَ فَيَضَعُ عَلَيْهِ كَنَفَهُ، وَيَسْتُرُهُ فَيَقُولُ أَتَعْرِفُ ذَنْبَ كَذَا أَتَعْرِفُ ذَنْبَ كَذَا فَيَقُولُ نَعَمْ أَىْ رَبِّ. حَتَّى إِذَا قَرَّرَهُ بِذُنُوبِهِ وَرَأَى فِى نَفْسِهِ أَنَّهُ هَلَكَ قَالَ سَتَرْتُهَا عَلَيْكَ فِى الدُّنْيَا، وَأَنَا أَغْفِرُهَا لَكَ الْيَوْمَ. فَيُعْطَى كِتَابَ حَسَنَاتِهِ، وَأَمَّا الْكَافِرُ وَالْمُنَافِقُونَ فَيَقُولُ الأَشْهَادُ هَؤُلاَءِ الَّذِينَ كَذَبُوا عَلَى رَبِّهِمْ، أَلاَ لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ- আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তা‘আলা মুমিন ব্যক্তিকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন এবং তার উপর স্বীয় আবরণ দ্বারা তাকে ঢেকে নিবেন। তারপর বলবেন, অমুক পাপের কথা কি তুমি জান? তখন সে বলবে, হ্যাঁ, হে আমার প্রতিপালক! এভাবে তিনি তার কাছ থেকে তার পাপগুলো স্বীকার করিয়ে নিবেন। আর সে মনে করবে যে, তার ধ্বংস অনিবার্য। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, আমি পৃথিবীতে তোমার পাপ গোপন করে রেখেছিলাম। আর আজ আমি তা মাফ করে দিব। তারপর তার নেক আমলনামা তাকে দেওয়া হবে। কিন্তু কাফির ও মুনাফিকদের সম্পর্কে স্বাক্ষীরা বলবে, এরাই তাদের প্রতিপালক সম্পর্কে মিথ্যা বলেছিল। সাবধান, জালিমদের উপর আল্লাহর লা‘নত’।[10]

(২) পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার :

ক্বিয়ামতের মাঠে বান্দার আমল খতিয়ে দেখা হবে। আর এটা কাফেরদের সাথে সংগঠিত হবে।  তাদের বিচার দীর্ঘায়িত ও কষ্টকর হবে তাদের পাপের কারণে। এ সমস্ত অবিশ্বাসীরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।

মহান আল্লাহ বলেন, الْمُلْكُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ لِلرَّحْمَنِ وَكَانَ يَوْمًا عَلَى الْكَافِرِينَ عَسِيرًا ‘সেদিন সত্যিকারের রাজত্ব হবে দয়াময় আল্লাহর এবং অবিশ্বাসীদের জন্য দিনটি হবে বড়ই ক©র্ঠন’ (ফুরকান ২৫/২৬)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا- ‘অতঃপর পেশ করা হবে আমলনামা। তখন তাতে যা আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতংকগ্রস্ত। তারা বলবে, হায় আফসোস! এটা কেমন আমলনামা যে, ছোট-বড় কোন কিছুই ছাড়েনি, সবকিছুই গণনা করেছে? আর তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক কাউকে যুলুম করেন না‘ (ক্বাহাফ ১৮/৪৯)

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ছাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ক্বিয়ামতের দিন আমরা কি আমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাব? উত্তরে বললেন, আকাশে মেঘ না থাকা অবস্থায় দ্বিপ্রহরের সময় সূর্য দেখতে তোমাদের কোন কষ্ট হয় কি? ছাহাবীগণ বললেন, জী, না। অতঃপর তিনি বললেন, আকাশে মেঘ না থাকা অবস্থায় পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে তোমাদের কোন কষ্ট হয় কি? ছাহাবীগণ বললেন, জী, না। এরপর তিনি বললেন, সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ! চন্দ্র বা সূর্যের কোন একটি দেখতে তোমাদের যেরূপ কষ্ট হয় তোমাদের প্রতিপালককেও দেখতে তোমাদের ঠিক তদ্রুপ কষ্ট হবে। আল্লাহর সাথে বান্দার মিলন হবে। তখন তিনি বললেন, হে অমুক! আমি কি তোমাকে ইযযত দান করিনি, নেতৃত্ব দান করিনি, জোড়া মিলিয়ে দেইনি, ঘোড়া, উট তোমার অনুগত করে দেইনি এবং প্রাচুর্য্যের মাঝে তোমার পানাহারের ব্যবস্থা করিনি? জবাবে বান্দা বলবে, হ্যাঁ, হে আমার প্রতিপালক! অতঃপর তিনি বলবেন, তুমি কি মনে করতে যে, তুমি আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে? সে বলবে, না। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি যেমনিভাবে আমাকে ভুলে গিয়েছিলে অনুরূপভাবে আমিও তোমাকে ভুলে যাচ্ছি। অতঃপর দ্বিতীয় অপর এক ব্যক্তি আল্লাহর সাথে মিলন হবে। তখন তিনি তাকেও বলবেন, হে অমুক! আমি কি তোমাকে সম্মান দান করিনি, নেতৃত্ব দেই নি, তোমার জোড়া মিলিয়ে দেইনি, উট-ঘোড়া তোমার অনুগত করে দেইনি এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে পানাহারের জন্য তোমাকে কি সুযোগ করে দেই নি-! সে বলবে, হ্যাঁ করেছেন, হে আমার প্রতিপালক! অতঃপর তিনি বলবেন, আমার সাথে তোমার সাক্ষাৎ হবে এ কথা তুমি মনে করতে? সে বলবে, না। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি যেমন আমাকে ভুলে গিয়েছিলে অনুরূপভাবে আমিও তোমাদের সম্পর্কে বিস্মৃত হব। অতঃপর অপর এক ব্যক্তির আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ হবে। অতঃপর পূর্বের অনুরূপ বলবেন। তখন লোকটি বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি আপনার প্রতি এবং কিতাব ও রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনয়ন করেছি। আমি ছালাত আদায় করেছি, ছিয়াম পালন করেছি এবং ছাদাক্বাহ করেছি। এমনিভাবে সে যথাসম্ভব নিজের প্রশংসা করবে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, এখনই তোমার মিথ্যা প্রকাশিত হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, এরপর তাকে বলা হবে, এখনই আমি তোমার উপর আমার সাক্ষী কায়েম করব। তখন বান্দা মনে মনে চিন্তা করতে থাকবে যে, কে তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবে? তখন তার মুখে মোহর দেয়া হবে। এবং তার উরু, গোশত ও হাড়কে বলা হবে, তোমরা কথা বল। ফলে তার উরু, গোশত ও হাড় তার আমল সম্পর্কে বলতে থাকবে। এ ব্যবস্থা এ জন্য করা হবে যেন, আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোন অবকাশ তার আর বাকী না থাকে। এই ব্যক্তি হচ্ছে মুনাফিক। তার প্রতি আল্লাহ তা‘আলা অসন্তুষ্ট হবেন’।[11]

বিনা হিসাবে বিচার :

এমন কতক ব্যক্তি আছেন যারা বিনা বিচারেই জান্নাতে প্রবেশ করবেন। এ বিষয়ে হাদীছে এসেছে, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘নবীদের উম্মতদের আমার সামনে উপস্থিত করা হ’ল। আমি এমনও নবী দেখেছি, তাঁর উম্মত ছিল ছোট্ট একটি দল। আর এমন নবীও দেখেছি, তাঁর সাথে একজন লোকও নেই। অতঃপর হঠাৎ আমার সম্মুখে তুলে ধরা হ’ল বিরাট এক জনতা। তা দেখে আমার ধারণা হ’ল, এরা আমার উম্মত। তখন আমাকে বলা হ’ল, এটা হচ্ছে মূসা (আঃ) ও তাঁর উম্মাত। বরং তুমি দিগন্তের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ কর। আমি সে দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলাম বিরাট এক জনতা। এরপর আমাকে পুনরায় বলা হলো, অন্য দিগন্তের দিকে দৃষ্টিপাত কর। আমি সে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলাম, বিরাট একজন সমুদ্র। অতঃপর আমাকে বলা হলো, এরা সবাই তোমার উম্মত। তাদের সাথে সত্তর হাযার এমন লোক রয়েছে যারা বিনা হিসাবে ও বিনা শাস্তিতে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।

ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, অতঃপর নবী করীম (ছাঃ) সেখান থেকে উঠে নিজের গৃহে প্রবেশ করলেন। আর যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে ছাহাবীগণ তা নিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হলেন। কেউ বলল, সম্ভবতঃ তাঁরা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ। আবার কেউ বলল, তারা এ সমস্ত লোক যারা ইসলামের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করেছে এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেনি। কেউ কেউ ভিন্ন মত প্রকাশ করল।

ঠিক এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পুনরায় তাদের কাছে এসে বললেন, তোমরা কি নিয়ে আলোচনা করছ? তারা নিজেদের মধ্যকার আলোচনার কথা বলল। তিনি বললেন, তারা সেই সমস্ত লোক যারা ঝাড়-ফুঁক কওে না, ঝাড়-ফুঁক করায় না এবং যারা কুলক্ষণ মানে না। বরং তারা সব কাজে তাদের রবের ওপর তাওয়াক্কুল করে। এমন সময় উক্কাশা ইবনে মিহ্সান (রাঃ) দাঁড়িয়ে বলল, আল্লাহর কাছে দু‘আ করুন তিনি যেন আমাকে তাঁদের অর্ন্তভুক্ত করেন। জবাবে নবী (ছাঃ) বললেন, তুমিও তাদের অর্ন্তভুক্ত। অতঃপর আর এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললো, আল্লাহর কাছে দোয়া করুন তিনি আমাকেও যেন তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। নবী (ছাঃ) বললেন, উক্কাশা পূর্বেই তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।[12]

বিচারের কাঠগড়ায় উম্মতে মুহাম্মাদী :

বিচারের কাঠগড়ায় আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা সর্বপ্রথম উম্মতে মুহাম্মাদীর বিচার করবেন। এ সম্পর্কে আবু হুরায়রা, রিবঈ ইবনে হিরাশ ও হুযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَضَلَّ اللَّهُ عَنِ الْجُمُعَةِ مَنْ كَانَ قَبْلَنَا فَكَانَ لِلْيَهُودِ يَوْمُ السَّبْتِ وَكَانَ لِلنَّصَارَى يَوْمُ الأَحَدِ فَجَاءَ اللَّهُ بِنَا فَهَدَانَا اللَّهُ لِيَوْمِ الْجُمُعَةِ فَجَعَلَ الْجُمُعَةَ وَالسَّبْتَ وَالأَحَدَ وَكَذَلِكَ هُمْ تَبَعٌ لَنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ نَحْنُ الآخِرُونَ مِنْ أَهْلِ الدُّنْيَا وَالأَوَّلُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمَقْضِىُّ لَهُمْ قَبْلَ الْخَلاَئِقِ. وَفِى رِوَايَةِ وَاصِلٍ الْمَقْضِىُّ بَيْنَهُمْ- ‘আল্লাহ আমাদের পূর্ববর্তীদেরকে জুমু‘আর দিন সম্পর্কে সঠিক পথের সন্ধান দেননি। তাই ইহুদীর জন্য শনিবার এবং খৃস্টানদের জন্য রোববার। আল্লাহ আমাদেরকে (পৃথিবীতে) আনলেন এবং আমাদেরকে জুমু‘আর দিনের সঠিক সন্ধান দিলেন। অতএব তিনি জুমু‘আর দিন, শনিবার ও রোববার এভাবে (বিন্যাস) করলেন, এভাবে তারা ক্বিয়ামতের দিন আমাদের পশ্চাদবর্তী হবে। আমরা পৃথিবীবাসীর মধ্যে শেষে আগমনকারী উম্মত এবং ক্বিয়ামতের দিন হব সর্বপ্রথম। সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে সর্বপ্রথম আমাদের বিচার অনুষ্ঠিত হবে। অধঃস্তন রাবী ওয়াছিল (রহঃ)-এর বর্ণনায় আছে ‘সকলের মধ্যে’।[13] অপর এক হাদীছে এসেছে,عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مِنْ أُمَّتِي سَبْعُونَ أَلْفًا بِغَيْرِ حِسَابٍ، هُمُ الَّذِينَ لَا يَسْتَرْقُونَ وَلَا يَتَطَيَّرُونَ، وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ ‘ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্য থেকে সত্তর হাযার লোক বিনা হিসাবেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারা হবে এমন লোক, যারা ঝাঁড়ফুঁকের শরণাপন্ন হয় না, কুযাত্রা মানে না এবং নিজের প্রতিপালকের উপরই ভরসা রাখে’।[14]

কাফেরদের বিচার :

কাফেররা বিচারে কাঠগড়ায় উঠবে কি না এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামদের মাঝে মতনৈক্য রয়েছে।

প্রথম মত : কাফেরদের বিচার হবে :

আবু আব্দুল্লাহ কুরতুবী, আবু হাফস বারমেকী, আবু তালেব প্রমুখ বিদ্বানগণের দাবী যে, ক্বিয়ামতের মাঠে কাফেরদের বিচার হবে।

তাঁদের দলীল নিম্নরূপ : মহান আল্লাহ বলেন, وَهُوَ اللَّهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَفِي الْأَرْضِ يَعْلَمُ سِرَّكُمْ وَجَهْرَكُمْ وَيَعْلَمُ مَا تَكْسِبُونَ ‘তিনিই আল্লাহ (একমাত্র মা‘বূদ) নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে। তিনি জানেন তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় সমূহ এবং জানেন যা কিছু তোমরা করে থাক’ (আন‘আম ৬/৩)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ إِلَيْنَا إِيَابَهُمْ- ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا حِسَابَهُمْ নিশ্চয় আমাদের কাছেই তাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর আমাদের দায়িত্বে রয়েছে তাদের হিসাব গ্রহণ’ (গাশিয়াহ ৮৮/২৫-২৬)

মহান আল্লাহ বলেন, وَلَيَحْمِلُنَّ أَثْقَالَهُمْ وَأَثْقَالًا مَعَ أَثْقَالِهِمْ وَلَيُسْأَلُنَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَمَّا كَانُوا يَفْتَرُونَ- وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَلَبِثَ فِيهِمْ أَلْفَ سَنَةٍ إِلَّا خَمْسِينَ عَامًا فَأَخَذَهُمُ الطُّوفَانُ وَهُمْ ظَالِمُونَ- فَأَنْجَيْنَاهُ وَأَصْحَابَ السَّفِينَةِ وَجَعَلْنَاهَا آيَةً لِلْعَالَمِينَ- وَإِبْرَاهِيمَ إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاتَّقُوهُ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘তারা অবশ্যই নিজেদের পাপভার বহন করবে এবং সেই সাথে অন্যদের পাপভার। আর তারা যেসব মিথ্যারোপ করেছে, সে বিষয়ে কিয়ামতের দিন অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে’। ‘আর আমরা নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। অতঃপর মহাপ্লাবন তাদেরকে গ্রাস করে। এমতাবস্থায় যে তারা ছিল সীমালংঘনকারী’। ‘অতঃপর আমরা তাকে এবং (তার অনুসারী) যারা নৌকায় আরোহণ করেছিল তাদেরকে রক্ষা করলাম। আর বিশ্ববাসীর জন্য এটিকে একটি নিদর্শনে পরিণত করলাম’। ‘আর (স্মরণ কর) ইবরাহীমের কথা। যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর ও তাঁকে ভয় কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বুঝ’ (আনকাবুত ২৯/১৩-১৬)

দ্বিতীয় মত : কাফেরদের বিচার হবে না :

আবু হাসান তামিমী, কাযী আবু ইয়ালা আল-লালকাঈ-এর মত।[15]

তাঁদের দলীল : মহান আল্লাহ বলেন, كَلَّا إِنَّهُمْ عَنْ رَبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَمَحْجُوبُونَ  কখনই না। তারা সেদিন তাদের প্রতিপালকের দর্শন হ’তে বঞ্চিত থাকবে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/১৫)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ أَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهِ مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَأَكْثَرُ جَمْعًا وَلَا يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَ ‘সে বলল, এই সম্পদ আমি আমার নিজস্ব জ্ঞানের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ সে কি জানে না যে, আল্লাহ তার পূর্বে বহু সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছেন। যারা তার চাইতে শক্তিতে ছিল প্রবল এবং ধন-সম্পদে ছিল অধিক প্রাচুর্যময়? বস্ত্ততঃ অপরাধীদের তাদের পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৮)

তিনি আরো বলেন,  إِنَّ الَّذِينَ يَشْتَرُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَأَيْمَانِهِمْ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَئِكَ لَا خَلَاقَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ  ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গিকার ও তাদের শপথ স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে, আখেরাতে তাদের কোন অংশ নেই। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকিয়েও দেখবেন না ও তাদের পরিশুদ্ধ করবেন না। আর তাদের জন্য থাকবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (আলে ইমরান ৩/৭৭)

উভয় মতের সমন্বয় :

ক্বিয়ামতের মাঠ হবে বিশাল বাসস্থান। আর সেখানে কোথাও প্রশ্নোত্তর হবে আবার কোথাও প্রশ্নোত্তর হবে না। আর কুরআন হাদীছে এর বৈপরীত্য নেই’।[16] ইকরিমা বলেন, ক্বিয়ামতের মাঠ হবে এক বৃহৎ জায়গা। যার কোথাও জিজ্ঞাসা করা হবে আবার কোথাও বিজ্ঞাসা করা হবে না’।[17] 

সতুরাং এটাই অধিক গ্রহণযোগ্য যে, কাফেরদের বিচার হবে। সেই দিন তাদের আমল উপস্থাপন করে ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, وَلَوْ تَرَى إِذْ وُقِفُوا عَلَى رَبِّهِمْ قَالَ أَلَيْسَ هَذَا بِالْحَقِّ قَالُوا بَلَى وَرَبِّنَا قَالَ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ ‘যদি তুমি দেখতে যখন তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে দাঁড় করানো হবে; আর তিনি তাদেরকে বলবেন, এটা (ক্বিয়ামত) কি সত্য নয়? তখন তারা বলবে, হ্যাঁ, আমাদের প্রতিপালকের কসম! তখন তিনি বলবেন, অতএব এখন তোমরা তোমাদের অবিশ্বাসের শাস্তি আস্বাদন কর’ (আন‘আম ৬/৩০)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, إِلَى رَبِّكَ يَوْمَئِذٍ الْمَسَاقُ  ‘আজ তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে যাওয়ার দিন’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/৩০)

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তাদের সহজ ও সাবলীলভাবে প্রশ্ন করা হবে না; বরং তাদেরকে নিন্দা ও ভৎর্সনার সাথে প্রশ্ন করা হবে। কেন তোমরা এটা এটা করেছ’?[18] 

আর ক্বিয়ামতের মাঠে কাফেরদের কোন ভাল আমল থাকবে না। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُورًا  ‘আর আমরা সেদিন তাদের কৃতকর্মসমূহের দিকে মনোনিবেশ করব। অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরকান ২৫/২৩)

আর হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللَّهَ لاَ يَظْلِمُ مُؤْمِنًا حَسَنَةً يُعْطَى بِهَا فِى الدُّنْيَا وَيُجْزَى بِهَا فِى الآخِرَةِ وَأَمَّا الْكَافِرُ فَيُطْعَمُ بِحَسَنَاتِ مَا عَمِلَ بِهَا لِلَّهِ فِى الدُّنْيَا حَتَّى إِذَا أَفْضَى إِلَى الآخِرَةِ لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَةٌ يُجْزَى بِهَا- আনাস ইবন মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘একটি নেকীর ক্ষেত্রেও আল্লাহ তা‘আলা কোন মুমিন বান্দার প্রতি যুলুম করবেন না। বরং তিনি এর বিনিময় দুনিয়াতে প্রদান করবেন এবং আখিরাতেও প্রদান করবেন। আর কাফির ব্যক্তি পার্থিব জগতে আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে নেক আমল করে এর বিনিময়ে তিনি তাকে জীবনোপকরণ প্রদান করেন। অবশেষে আখিরাতে প্রতিদান দেয়ার মত তার নিকট কোন নেকীই থাকবে না’।[19]

আর তাদের কুফুরীর কারণে তাদেরকে আযাব দ্বিগুণ করা হবে। মহান আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ زِدْنَاهُمْ عَذَابًا فَوْقَ الْعَذَابِ بِمَا كَانُوا يُفْسِدُونَ ‘যারা কুফরী করেছিল এবং আল্লাহর পথে বাধা দান করেছিল, আমরা তাদের শাস্তির উপর শাস্তি বাড়িয়ে দেব। কারণ তারা (পৃথিবীতে) অশান্তি সৃষ্টি করত’ (নাহল ১৬/৮৮)

আর মুনাফিকদের সম্পর্ক আল্লাহ বলেন, إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা থাকবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। আর তুমি কখনো তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী পাবে না’ (নিসা ৪/১৪৫)

কোন বিচার আগে হবে?

মানুষের মাঝে প্রথম আমলের হিসাব গ্রহণ করা হবে। আর তা হলো ছালাত। আর প্রথম ফায়সালা করা হবে রক্তের। ছালাত হ’ল বান্দা ও আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত। আর রক্ত হ’ল বান্দার অধিকার। দু’টি বিষয়কেই রাসূল (ছাঃ) এক হাদীছে বর্ণনা করেছেন, أَوَّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ الصَّلاَةُ وَأَوَّلُ مَا يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ فِى الدِّمَاءِ- ‘বান্দার সর্বপ্রথম হিসাব নেয়া হবে ছালাতের। আর বিচার হবে সর্বাগ্রে মানুষের হত্যার’।[20]

রক্তের ফায়ছালা সম্পর্কে ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, রক্ত সম্পর্কিত বিষয়টি কঠিন আদেশ। এজন্য ক্বিয়ামতের দিন প্রথম রক্তের ফায়সালা করা হবে। এজন্যই যে আদেশটি পালন করা মহৎ কাজ আর অমান্য করা মারাত্মক অপরাধ।

সুতরাং أَوَّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ صَلَاتُهُ ‘ক্বিয়ামতের দিন বান্দার থেকে সর্বপ্রথম ছালাতের হিসাব নেয়া হবে’- এই হাদীছটি সুনান গ্রন্থগুলির বিপরীত নয়। কেননা দ্বিতীয় হাদীছটি বান্দা ও আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত আর প্রথমটি শুধুমাত্র বান্দার  মাঝে’।[21]

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, উলামাগণ বলেছেন, বিচার সংগঠিত হবে আমলের ওজনের পর। কেননা ওজন করার প্রতিদান বান্দাকে দেওয়া হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَى بِنَا حَاسِبِينَ ‘আর ক্বিয়ামতের দিন আমরা ন্যায়বিচারের মানদন্ড সমূহ স্থাপন করব। অতএব কারু প্রতি সামান্যতম অবিচার করা হবে না’ (আম্বিয়া ২১/৪৭)

উপসংহার : বিচার দিবসে যার হিসাব-নিকাশ নেওয়া হবে তার অবস্থা করুণ হবে। সুতরাং আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা আমাদের সকলকে বিচার দিবসে সহজ হিসাব গ্রহণ করুন এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশকারীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তাওফীক দান করুন-আমীন!

[লেখক :  মাস্টার্স, দাওয়া এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া ও সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, ইবি, কুষ্টিয়া ]


[1]. বুখারী হা/১০৩।

[2]. মুকাদ্দামা ইবনু জায়েদ আর রিসালাহ পৃ.৫৯।

[3]. শারহুস সুন্নাহ পৃ.৬৪।

[4]. শারহু উসুলুস আক্বীদাহ আহলিস সুন্নাহ ৬/১২৩০।

[5]. বাহরুল উলুম ৩য় খন্ড ১৮৬ পৃ.।

[6]. বুখারী হা/২৪৪৭; মুসলিম হা/২৫৭৯; মিশকাত হা/৫১২৩।

[7]. মুসলিম হা/২৫৮২; মিশকাত হা/৫১২৮।

[8]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৬৬।

[9]. আহমাদ হা/২৪২১৪; ইবনু খুজাইমাহ হা/৮৪৯।

[10]. বুখারী হা/২৪৪১।

[11]. মুসলিম হা/২৯৬৮।

[12].  বুখারী হা/৫৭০৫; মুসলিম হা/২২০।

[13]. মুসলিম হা/৮৫৬।

[14]. মুসলিম হা/২১৮।

[15]. মাজমু‘ ফাতওয়া ৪/৩০৫; শারহ উছূলু ইতিকাদি আহলিস সুন্নাহ ২/১২৪৬।

[16]. তাযকিরাতু বি আহওয়ালিল মাওত ওয়া উমুরিল আখিরাহ পৃ. ২/৬৭৬।

[17]. তাফসীরে বাগাবী ৭/৪৫০।

[18]. তাফসীরে বাগাবী ৭/৪৫০।

[19]. মুসলিম হা/২৮০৮।

[20]. নাসাঈ হা/৩৯৯১।

[21]. আল-মিনহাজ শরহু মুসলিম ১১/১৬৭ পৃ.।



বিষয়সমূহ: আক্বীদা
আরও