রাসূল (ছাঃ)-এর মহৎ গুণাবলী (শেষ কিস্তি)
ইহসান ইলাহী যহীর
মুহাম্মাদ আবুল কালাম 10627 বার পঠিত
ভূমিকা : নির্ভেজাল ইসলামী সমাজ গঠনের অন্যতম বড় বাধা তাক্বলীদে শাখছী বা অন্ধ ব্যক্তি পূজা। এর ফলে মানুষ অন্য একজন মানুষের এমন অনুসারী হয়ে পড়ে, যে অনুসরণীয় ব্যক্তির ভুল-শুদ্ধ সবকিছুই তার কাছে সঠিক মনে হয়। এমনকি তার যে ভুল হতে পারে এই ধারনাটুকু্ও অনেক সময় ভক্তের মধ্যে লোপ পায়। ইত্তেবায়ে সুন্নাত থেকে পা পিছলে তাক্বলীদের অনুসারী হওয়ার কারণে সমাজে হাজারো বিদ‘আত ও কুসংস্কার চালু হয়। সুতরাং ব্যক্তির অনুসরণ নয় রাসূলের অনুসরণই মানুষের ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির পথ। নিম্নে ইত্তেবায়ে সুন্নাত ও তাক্বলীদ সম্পর্কে আলোচনার প্রয়াস পাব।
তাক্বলীদ ও ইত্তেবায়ে সুন্নাত : তাক্বলীদ
‘ক্বালাদাতুন’ শব্দ থেকে ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে। যার অর্থ কণ্ঠহার বা রশি।
ক্বালাদাহ বা গিরা সে উটের গলায় রশি বেঁধেছে। সেখানে থেকে মুক্বাল্লিদ,
যিনি নিজের গলায় কারো অনুগত্যের রশি বেঁধে নিয়েছেন। মূলত রাসূল (ছাঃ)
ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির কোন শারঈ সিদ্ধান্তকে বিনা দলীলে মেনে নেওয়াকে
তাক্বলীদ বলা হয়। অপরপক্ষে ছহীহ দলীল অনুযায়ী নবীর অনুসরণ করাকে বলা হয়
ইত্তেবা। অন্য কথায় ইত্তেবা হ’ল রেওয়ায়াতের অনুসরণ। ইত্তেবা হ’ল কারো কথা
দলীল সহ কবুল করা। পারিভাষিক অর্থে ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন,التَّقْلِيْدُ
إِنَّمَا هُوَ قُبُوْلُ الرَّأىِ وَالْإِتِّبَاعُ إِنَّمَا هُوَ قُبُوْلُ
الرِّوَايَةِ، فَالْإِتِّبَاَعُ فِى الدَّيْنِ مَسُوْغٌ وَالتَّقْلِيْدُ
مَمْنُوْعٌ - ‘তাক্বলীদ হ’ল রায়ের অনুসরণ এবং ‘ইত্তেবা’ হ’ল রেওয়ায়াতের
অনুসরণ। ইসলামী শরী‘আতে ‘ইত্তেবা’ সিদ্ধ এবং ‘তাক্বলীদ’ নিষিদ্ধ’।[1]
রাসূলের সুন্নাত অনুসরণের আবশ্যকতা : ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত চূড়ান্ত অহির বিধান। মানবজাতিকে সুপথে পরিচালনার লক্ষ্যে মুহাম্মাদ (ছাঃ) মারফত তিনি এই বিধান প্রেরণ করেছেন। তিনি বিশ্ববাসীকে এর বাস্তব প্রয়োগ দেখিয়েছেন। ধর্মীয়, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক তথা মানুষের সার্বিক জীবনকে অহির আলোয় আলোকিত করার পথ ও পদ্ধতি। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণ আবশ্যকীয়। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَاب ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা হ’তে বিরত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা’ ( হাশর ৫৯/৭)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর তার রাসূলের। আর তোমরা তোমাদের আমলগুলিকে বিনষ্ট করো না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)।
রাসূলের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়ে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের। অতঃপর যদি কোন বিষয়ে তোমরা বিতন্ডা কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে সর্বোত্তম’ (নিসা ৪/৫৯)। রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর ভালবাসা এবং তাঁর ক্ষমা পাওয়া যায়। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ - قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ - ‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসো, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন ও তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইমরান ৩/৩১)। রাসূলের আনুগত্য বিষয়ে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,
عن الْعِرْبَاضَ بْنَ سَارِيَةَ يَقُولُ قَامَ فِينَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ يَوْمٍ فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً وَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ وَذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ فَقِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَعَظْتَنَا مَوْعِظَةَ مُوَدِّعٍ فَاعْهَدْ إِلَيْنَا بِعَهْدٍ فَقَالَ- عَلَيْكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا وَسَتَرَوْنَ مِنْ بَعْدِى اخْتِلاَفًا شَدِيدًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ عَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَالأُمُورَ الْمُحْدَثَاتِ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَة-
‘ইবরায ইবনে সারিয়াহ্ (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের ছালাত আদায় করালেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে গেলেন। আমাদের উদ্দেশ্যে এমন মর্মস্পর্শী নছীহত করলেন, যাতে আমাদের চোখ গড়িয়ে পানি বইতে লাগল। অন্তরে ভয় সৃষ্টি হ’ল। মনে হচ্ছিল বুঝি উপদেশ দানকারীর যেন জীবনে এটাই শেষ উপদেশ। এক ব্যক্তি আবেদন করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদের আরো কিছু উপদেশ দিন। তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করার এবং আমীরের আদেশ শুনার ও আনুগত্য করার আদেশ দিচ্ছি। যদিও সে হাবশী (কৃষ্ণাঙ্গ) গোলাম হয়। আমার পরে তোমাদের যে ব্যক্তি বেঁচে থাকবে সে অনেক মতভেদ দেখবে এমতবস্থায় তোমাদের কর্তব্য হবে আমার সুন্নাতকে ও হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়িয়ে ধরা এবং এ পথ ও পন্থার উপর দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান দ্বীনের ভিতরে নতুন কিছু কথার (বিদ‘আত) উদ্ভব ঘটানো হ’তে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রত্যেকটা নতুন কথাই বিদ‘আত এবং প্রত্যেকটা বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।[2] সুতরাং মানুষের মধ্যে মতভেদ ও মতপার্থক্য থাকবে। বিভক্তিও দেখা দিবে। কিন্তু হক পিয়াসী মুমিনের কর্তব্য হবে মতভেদ ও মতপার্থক্যকে পরিত্যাগ করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত ও তাঁর হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়িয়ে ধরা। যে কোন মূল্যে নব-আবিস্কৃত আমল থেকে বিরত থাকতে হবে। মানুষের তৈরি করা আমল ভাল মনে হলেও তা বাতিল, যদিও তা ছালাত হয়, যদিও তা ছিয়াম হয়। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
عن أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ رضى الله عنه يَقُولُ جَاءَ ثَلاَثَةُ رَهْطٍ إِلَى بُيُوتِ أَزْوَاجِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم يَسْأَلُونَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَلَمَّا أُخْبِرُوا كَأَنَّهُمْ تَقَالُّوهَا فَقَالُوا وَأَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَدْ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ. قَالَ أَحَدُهُمْ أَمَّا أَنَا فَإِنِّى أُصَلِّى اللَّيْلَ أَبَدًا. وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَصُومُ الدَّهْرَ وَلاَ أُفْطِرُ. وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلاَ أَتَزَوَّجُ أَبَدًا. فَجَاءَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا أَمَا وَاللَّهِ إِنِّى لأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّى أَصُومُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّى وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِى فَلَيْسَ مِنِّى-
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা তিন ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর ইবাদতের অবস্থা জানার জন্য তাঁর স্ত্রীগণের নিকট এলে। রাসূল (ছাঃ)-এর ইবাদাতের খবর শুনে তারা যেন তার ইবাদতকে কম মনে করলেন এবং পরস্পর আলাপ করলেন। রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে আমাদের তুলনা কোথায়? আল্লাহ তা‘আলা তার আগের পরের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। অতঃপর তাদের একজন বললেন, আমি কিন্তু সারা রাত ছালাত আদায় করব। দ্বিতীয়জন বললেন আমি দিনে ছিয়াম পালন করব আর কখনও তা ত্যাগ করব না। আর তৃতীয়জন বললেন, আমি নারী থেকে দূরে থাকব কখনও বিয়ে করব না, তাদের পারস্পারিক আলাপ আলোচনার সময় রাসূল (ছাঃ) এসে পড়লেন এবং বললেন তোমরা কি ধরণের কথা-বার্তা বলছিলে? আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশী ভয় করি। তোমাদের চেয়ে বেশি পরহেয করি। কিন্তু এরপরও আমি কোন দিন ছিয়াম পালন করি, আবার কোন দিন ছেড়েও দেই। রাতে ছালাত আদায় করি, আবার ঘুমিয়েও থাকি। আমি বিয়েও করি। সুতরাং এটাই আমার সুন্নাত, যে ব্যক্তি আমার প্রদর্শিত পথ থেকে বিমুখ হবে সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য হবে না।[3] আলোচ্য হাদীছে তিন ব্যক্তির নিজের মনমত সারারাত ছালাত, প্রতিদিন নফল ছিয়াম এবং বিবাহ পরিত্যাগ করে সারা জীবন ইবাদতের প্রতিজ্ঞা করলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের উক্ত পদ্ধতিতে আমল করার অনুমতি দিলেন না। সাথে সাথে হুঁশিয়ারী দিলেন এই যে, যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত পরিপন্থী আমল করবে ঐ ব্যক্তি আমার উম্মতের মধ্যে নয়।
প্রিয়
পাঠক! শরী‘আত অনুমোদিত আমল ছালাত, ছিয়াম যদি রাসূলের আমলের পদ্ধতির বিপরীত
হওয়ার কারণে বাতিল হয়, তবে মানুষের তৈরী করা ভুয়া আমল শবেবরাত, শবে মে‘রাজ,
ঈদে মিলাদুন্নবী, কুলখানী, কালেমাখানী, চেহলাম, মিলাদ-ক্বিয়াম যেগুলোর
অস্তিত্ব রাসূলের সুন্নাতে নেই, সেগুলো কিভাবে আমলযোগ্য হয়? নিঃসন্দেহে তা
বাতিল ও পরিত্যাজ্য। ইসলামের নামে বহু পথ ও মত থাকবে। একটি পথ জান্নাতের,
বাকীগুলি শয়তানের। হাদীছে এসেছে, عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ
: خَطَّ لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْماً خَطًّا ثُمَّ
قَالَ هَذَا سَبِيلُ اللَّهِ ثُمَّ خَطَّ خُطُوطاً عَنْ يَمِينِهِ وَعَنْ
شِمَالِهِ ثُمَّ قَالَ هَذِهِ سُبُلٌ، عَلَى كُلِّ سَبِيلٍ مِنْهَا
شَيْطَانٌ يَدْعُو إِلَيْهِ ثُمَّ تَلاَ (وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِى
مُسْتَقِيماً فَاتَّبِعُوهُ وَلاَ تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ
بِكُمْ عَنْ سَبِيلِه-ِ আব্দুল্লাহ ইবনে মাস্‘উদ (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত, তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের বুঝার উদ্দেশ্যে একটি সরল রেখা টানলেন এবং
বললেন, এটা আল্লাহর পথ। এরপর তিনি ডানে এবং বামে আরো কয়েকটি রেখা টানলেন
এবং বললেন এগুলো পথ, এসব পথের উপর শয়তান দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর তিনি তার কথার
প্রমাণ স্বরূপ কুরআনের এই আয়াত পাঠ করলেন- ‘নিশ্চয় এটাই আমার সহজ সরল পথ।
অতএব তোমরা এ পথের অনুসরণ করে চল’।[4]
অতএব
বহু পথ ও মতকে বর্জন করে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রদর্শিত
অভ্রান্ত সত্যের পথে তথা সহজ-সরল পথে চলার মাধ্যমে পরকালের মুক্তির পথ সুগম
হবে। অন্যথায় ডানে বামে আঁকাবাকা পথে শয়তানের অনুসরণের মাধ্যমে জাহান্নামে
যেতে হবে। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ বলেছেন, জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি
বলেন, একদা একদল ফেরেশতা নবী (ছাঃ)-এর কাছে আসলেন। এ সময় তিনি শুয়ে ছিলেন।
ফেরেশতাগণ পরস্পরে বলাবলি করলেন তোমাদের সাথী মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে
একটি উদাহরণ রয়েছে। তাঁর সামনে উদাহরণটি বল। তখন একজন বললেন, তাঁর চোখ
ঘুমালে তার মন সর্বদা জাগ্রত থাকে। তাঁর উদাহরণ হ’ল সে ব্যক্তির ন্যায় যিনি
একটি ঘর বানিয়েছেন। অতঃপর মানুষকে আহার করানোর জন্য দস্তর খানা বিছালেন।
তারপর মানুষকে ডাকবার জন্য আহবায়ক পাঠালেন। যারা আহবানকারীর আহবানে সাড়া
দিল, তারা ঘরে প্রবেশ করলো এবং খাবার খেল। আর যারা আহবানকারীর আহবানে সাড়া
দিল না, তারা ঘরে প্রবেশ করতে পারলো না এবং খাবারও পেলনা না। এসব কথা শুনে
তারা, (ফেরেশতারা) পরস্পর বললেন, এ কথাটার তাৎপর্য বর্ণনা কর, যাতে তিনি
কথাটা বুঝতে পারেন। এবার কেউ বললেন, তিনিতো ঘুমিয়ে আছে। আর কেউ বললেন, তাঁর
চোখ ঘুমিয়ে থাকলে অন্তর জেগে আছে। তারা বলল, ঘরটি হল জান্নাত, আর আহবায়ক
হলেন মুহাম্মাদ (ছাঃ) (ঘর ও মেহমানদারী প্রস্ত্ততকারী হলেন আল্লাহ তা‘আলা)।
সুতরাং যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অবাধ্য হ’ল সে আল্লাহর অবাধ্য হল।
আর মুহাম্মাদ (ছাঃ) হলেন মানুষের মধ্যে (মুসলিম ও কাফিরের) পার্থক্য
নির্ধারণকারী মানদন্ড।[5]
সুতরাং রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণের মাধ্যমে জান্নাত লাভে সফলকাম হওয়া যায়। হাদীছে এসেছে, عَن جَابِرٍأَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَتَى رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِنُسْخَةٍ مِنَ التَّوْرَاةِ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ هَذِهِ نُسْخَةٌ مِنَ التَّوْرَاةِ فَسَكَتَ فَجَعَلَ يقْرَأ وَوجه رَسُول الله يَتَغَيَّرُ فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ ثَكِلَتْكَ الثَّوَاكِلُ مَا تَرَى مَا بِوَجْهِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَنَظَرَ عُمَرُ إِلَى وَجْهِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ أَعُوذُ بِاللَّه من غضب الله وَغَضب رَسُوله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم رَضِينَا بِاللَّهِ رَبًّا وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ نَبِيًّا فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَوْ بَدَا لَكُمْ مُوسَى فَاتَّبَعْتُمُوهُ وَتَرَكْتُمُونِي لَضَلَلْتُمْ عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ وَلَوْ كَانَ حَيًّا وَأَدْرَكَ نُبُوَّتِي لَاتَّبَعَنِي- জাবির (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত, তিনি বলেন, উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে তাওরাত কিতাবের একটি পান্ডুলিপি এনে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এটা হ’ল তাওরাতের একটি পান্ডুলিপি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চুপ থাকলেন, এরপর উমার (রাঃ) তাওরাত পড়তে আরম্ভ করলেন। (এ দিকে রাগে) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চেহারা বিবর্ণ হ’তে লাগল। আবু বকর (রাঃ) বললেন, উমার তোমার সর্বনাশ হোক। তুমি কি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিবর্ণ চেহারা মোবারক দেখছো না? উমার (রাঃ) রাসূলের চেহারার দিকে তাকালেন এবং (চেহারায় ক্রোধান্বিত ভাব লক্ষ্য করে বললেন, আমি আল্লাহর গযব ও তাঁর রাসূলের ক্রোধ হ‘তে পানাহ চাচ্ছি। আমি রব হিসাবে আল্লাহ তা‘আলার উপর এবং দ্বীন হিসাবে ইসলামের উপর ও নবী হিসাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর সন্তুষ্ট আছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমি আল্লাহর কসম যার হাতে আমার জীবন! যদি (তাওরাতের নবী স্বয়ং) মূসা (আঃ) তোমাদের মধ্যে থাকতেন। আর তোমরা তাঁর অনুসরণ করতে আর আমাকে ত্যাগ করতে, তাহ’লে তোমরা সঠিক সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে। মূসা (আঃ) যদি এখন জীবিত থাকতেন এবং আমার নবুঅতের যুগ পেতেন, তাহলে তিনিও নিশ্চয় আমার অনুসরণ করতেন।[6]
উমার
(রাঃ) হ‘তে বর্ণিত, তিনি হাজরে আসওয়াদের কাছে এসে তা চুম্বন করে
বললেন,إِنِّى أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لاَ تَضُرُّ وَلاَ تَنْفَعُ،
وَلَوْلاَ أَنِّى رَأَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يُقَبِّلُكَ مَا
قَبَّلْتُكَ- ‘আমি অবশ্যই জানি যে, তুমি একখানা পাথর মাত্র, তুমি কারো
কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পার না। রাসূল (ছাঃ)-কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখলে
কখনো আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না।[7]
আয়িশাহ্ (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رد- ‘যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনে নতুন কিছু উদ্ভাবন করেছে যা এতে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[8] (চলবে)
[লেখক : কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ ]
[1]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তিনটি মতবাদ, ১ম প্রকাশ: জানুয়ারী ১৯৮৭, যুবসংঘ প্রকাশনী। ২য় সংস্করণ: ফেব্রুয়ারী ২০১০ হা. ফা. বা. প্রকাশনা, ছফর ১৪৩১ হি:, মাঘ-ফাল্গুন ১৪১৬ বাং পৃ. ৬-৭ (আলোচনা দেখুন : শাওকানী, আল-ক্বাওলুল মুফীদ (মিসরী ছাপা ১৩৪০/১৯২১ খৃ.) পৃ. ১৪)।
[2]. আবুদাঊদ হা/৪৬০৭; তিরমিযী হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৪২; আহমাদ হা/১৬৬৯৪; মিশকাত হা/১৬৫।
[3]. বুখারী হা/৫০৬৩; মুসলিম হা/১৪০১; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩১৭; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৯১৮; মিশকাত হা/১৪৫।
[4]. আহমাদ হা/৪১৩১; দারেমী হা/২০২; মিশকাত হা/১৬৬।
[5]. বুখারী হা/৭২৮১; মিশকাত হা/১৪৪।
[6]. মিশকাত হা/ ১৯৪; দারেমী হা/৪৩৫।
[7]. বুখারী হা/১৫৯৭,১৬০৬,১৬১০; মুসলিম হা/১২৭০।
[8]. বুখারী হা/২৬৯৭; মুসলিম হা/১৭১৮; আবু দাউদ হা/৪৬০৬; ইবনু মাজাহ হা/১৪; মিশকাত হা/১৪০।