একজন আদর্শবান ব্যক্তির গুণাবলী (শেষ কিস্তি)
এ. এইচ. এম. রায়হানুল ইসলাম
আব্দুর রহীম 10318 বার পঠিত
ছাহাবায়ে কেরামের (রাঃ)-এর জীবনীতে মূল্যহীন দুনিয়ার অবস্থা :
রাসূল (ছাঃ) যেমন এই মূল্যহীন দুনিয়ার মোহে পড়ে যাননি, তেমনি ছাহাবায়ে কেরামও দুনিয়ার মোহে পড়ে আখেরাতকে ভুলে যাননি। বরং তারা রাসূল (ছাঃ)-এর দেখানো আদর্শকে অাঁকড়ে ধরে জীবন পরিচালনা করেছেন। তারা কখনো দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য অর্থ-সম্পদকে প্রধান অবলম্বন মনে করেননি। তারা কখনো অট্টালিকা নির্মাণের স্বপ্নও দেখেননি। বরং তারা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ আদর্শকে অনুসরণ করে পরকালে জান্নাত লাভের স্বপ্ন দেখেছেন। তাহলে আমরা কেন আজ তাদের আদর্শকে পরিহার করে অন্য স্বপ্ন দেখছি। তাদের জীবনাচার আমাদের কি শিক্ষা দেয়? একটু পরখ করে নেওয়া যাক। হাদীছে এসেছে- আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, كُنْتُ عِنْدَ أبِي بَكْرٍ حِينَ حَضَرَتْهُ الْوَفَاةُ، فَتَمثَّلْتُ بهذَا الْبَيْتِ:مَنْ لا يَزَالُ دَمْعُهُ مُقَنَّعا.. يُوشِكُ أنْ يَكُونَ مَدْفُوقا فَقَالَ: يَا بُنَيَّه لا تَقُولي هكَذَا، وَلكِنْ قُولي {وَجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ذَلِكَ مَا كُنْتَ مِنْهُ تَحِيدُ} [ق: 19]. ثُمَّ قَالَ: فِي كَمْ كُفِّنَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم-؟. فَقُلْتُ فِي ثَلاَثَةِ أَثْوَابٍ، فَقَالَ: كَفِّنُونِي فِي ثَوْبَيَّ هذَيْنِ، وَاشْتَرُوا إلَيْهِمَا ثَوْباً جَدِيداً، فَإنَّ الْحَيَّ أحْوَجُ إِلَى الْجَدِيدِ مِنَ الْمَيِّتِ، وَإنَّمَا هِيَ لِلْمَهْنَةِ، [أوْ لِلْمُهْلَةِ]
‘আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) যখন পীড়িত
ছিলেন, তখন আমি তার নিকটে ছিলাম। আমি নিম্নের কবিতা পাঠ করছিলাম, مَنْ لا
يَزَالُ دَمْعُهُ مُقَنَّعا.. يُوشِكُ أنْ يَكُونَ مَدْفُوقا ‘.....যার
চোখের অশ্রু টলটলায়মান, তা যেন অচিরেই ফেটে পড়বে’। তখন তিনি বললেন, হে বৎস!
এভাবে বল না। বরং বল, ‘আর মৃত্যু যন্ত্রণা আসবেই সুনিশ্চিতভাবে। যা থেকে
তুমি পালিয়ে বেড়াতে’ (ক্বাফ ৫০/১৯)। এরপর তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে
বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কয়টি কাপড়ে কাফন দেওয়া হয়েছিল? আয়েশা (রাঃ)
বলেন, আমি বললাম, তিনটি কাপড়ে। তারপর আবুবকর (রাঃ) তার পরিধানে যে কাপড় ছিল
সেই কাপড়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, আয়েশা! এই দু’টি কাপড়ে আমাকে কাফন
পরাবে এবং আরেকটি নতুন কাপড় কিনে যোগ করবে। কারণ মৃত ব্যক্তি অপেক্ষা জীবিত
লোকেরই নতুন কাপড় প্রয়োজন বেশী, আর এই কাপড় মৃতের পুঁজের জন্য।[1]
অন্য
বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, لَمَّا ثَقُلَ أَبُو
بَكْرٍ قَالَ أَىُّ يَوْمٍ هَذَا قُلْنَا يَوْمُ الاِثْنَيْنِ. قَالَ
فَأَىُّ يَوْمٍ قُبِضَ فِيهِ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ
قُلْنَا قُبِضَ يَوْمَ الاِثْنَيْنِ. قَالَ فَإِنِّى أَرْجُو مَا بَيْنِى
وَبَيْنَ اللَّيْلِ. قَالَتْ وَكَانَ عَلَيْهِ ثَوْبٌ فِيهِ رَدْعٌ مِنْ
مِشْقٍ فَقَالَ إِذَا أَنَا مِتُّ فَاغْسِلُوا ثَوْبِى هَذَا وَضُمُّوا
إِلَيْهِ ثَوْبَيْنِ جَدِيدَيْنِ فَكَفِّنُونِى فِى ثَلاَثَةِ أَثْوَابٍ.
فَقُلْنَا أَفَلاَ نَجْعَلُهَا جُدُداً كُلَّهَا قَالَ فَقَالَ لاَ
إِنَّمَا هُوَ لِلْمُهْلَةِ. قَالَتْ فَمَاتَ لَيْلَةَ الثُّلاَثَاءِ- আবু
বকর (রাঃ) যখন পীড়িত ছিলেন তখন জিজ্ঞেস করলেন, আজ কোন দিন? আমরা বলল,
সোমবার। তিনি বললেন, রাসূল (ছাঃ) কোনদিন মারা যান? আমরা বলল, সোমবারে। তিনি
বললেন, আমি আশা করছি, আমি এখন থেকে রাতের মধ্যেই মারা যাব। আয়েশা (রাঃ)
বলেন, তার দেহে সুগন্ধী যুক্ত কাপড় ছিল। তিনি বললেন, আমি যখন মারা যাব তখন
তোমরা এই কাপড়টি পরিষ্কার করবে এবং এর সাথে আরো দু’টি নতুন কাপড় যোগ করে
আমাকে তিনটি কাপড়ে কাফন পরাবে। আমরা বলল, আমরা কি সবগুলো কাপড় নতুন দিব না?
তিনি বললেন, না। আর এই কাপড় মৃতের পুঁজের জন্য। আয়েশা (রাঃ) বলেন, তিনি
মঙ্গলবার রাতে মারা যান।[2]
ছাহাবায়ে কেরামের নতুন কাপড়ের প্রতি আগ্রহ ও লোভের বিপরীতে অনীহা ছিল। কারণ তারা দুনিয়াকে কখনো স্থায়ী ঠিকানা মনে করেননি। আবার তারা পরকালকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দুনিয়ার সম্পদ উপার্জনের সময় পাননি। তারা খুব সাধারণ কাপড় পরিধান করে জীবন অতিবাহিত করতেন। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ رَأَيْتُ سَبْعِينَ مِنْ أَصْحَابِ الصُّفَّةِ ، مَا مِنْهُمْ رَجُلٌ عَلَيْهِ رِدَاءٌ ، إِمَّا إِزَارٌ وَإِمَّا كِسَاءٌ ، قَدْ رَبَطُوا فِى أَعْنَاقِهِمْ ، فَمِنْهَا مَا يَبْلُغُ نِصْفَ السَّاقَيْنِ ، وَمِنْهَا مَا يَبْلُغُ الْكَعْبَيْنِ ، فَيَجْمَعُهُ بِيَدِهِ ، كَرَاهِيَةَ أَنْ تُرَى عَوْرَتُهُ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি
সত্তর জন আছহাবে ছুফফা দেখেছি, তাঁদের মধ্যে এমন ব্যক্তি কেউ ছিল না যাঁর
পূর্ণ কোন চাদর ছিল। কারো লুঙ্গি কিংবা ছোট চাদর থাকত যেটাকে তাঁরা গলায়
বেঁধে রাখতেন। তার কোনটা কারো হাঁটুর অর্ধেক পর্যন্ত এবং কোনটা গোড়ালী
পর্যন্ত পৌঁছত। আর তিনি হাত দিয়ে সেটি ধরে রাখতেন, পরে তাঁর লজ্জাস্থান
দেখা যায় এই আশঙ্কায়।[3]
অন্য হাদীছে এসেছে,عن أَيْمَنَ قَالَ قَالَ دَخَلْتُ عَلَى عَائِشَةَ رضى الله عنها وَعَلَيْهَا دِرْعُ قِطْرٍ ثَمَنُ خَمْسَةِ دَرَاهِمَ ، فَقَالَتِ ارْفَعْ بَصَرَكَ إِلَى جَارِيَتِى، انْظُرْ إِلَيْهَا فَإِنَّهَا تُزْهَى أَنْ تَلْبَسَهُ فِى الْبَيْتِ، وَقَدْ كَانَ لِى مِنْهُنَّ دِرْعٌ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ، فَمَا كَانَتِ امْرَأَةٌ تُقَيَّنُ بِالْمَدِينَةِ إِلاَّ أَرْسَلَتْ إِلَىَّ تَسْتَعِيرُهُ-আয়মান (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আয়েশা (রাঃ) এর নিকট আমি হাযির হলাম। তার গায়ে তখন পাঁচ দিরহাম মূল্যের মোটা কাপড়ের কামিজ ছিল। তিনি আমাকে বললেন, আমার এ দাসীটার দিকে চোখ তুলে একটু তাকাও, ঘরের ভিতরে এটা পরতে সে অপসন্দ করে। অথচ রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় মদীনায় মেয়েদের মধ্যে আমারই শুধু একটি কামিজ ছিল। মদীনায় কোন মেয়েকে বিয়ের সাজে সাজাতে গেলেই আমার কাছে কাউকে পাঠিয়ে ঐ কামিজটি চেয়ে নিত (সাময়িক ব্যবহারের জন্য)।[4]
অন্য
হাদীছে এসেছে, কাছীর বিন আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন, دَخلتُ عَلى عَائشةَ أمِّ
المُؤمنينَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا فَقالتْ: أَمسِك حَتى أَخيطَ نَقبَتِي.
فَأمسَكتُ فَقلتُ: يَا أُم المؤمنينَ لَو خَرجتُ فَأخبَرتُهمْ لَعدُوهُ
مِنك بُخلاً. قَالت: أَبصِر شَأنَك. إنهُ لَا جَديدَ لِمن لَا يَلبَسُ
الخَلَقَ- ‘আমি উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট গেলাম। তিনি বলেন, একটু
অপেক্ষা কর। আমি আমার নেক্বাবটি একটু সেলাই করে নেই। আমি অপেক্ষা করলাম।
আমি বললাম, হে উম্মুল মুমিনীন! আমি যদি বাইরে গিয়ে লোকজনকে অবহিত করি তবে
তারা এটাকে আপনার কৃপণতা বলবে। তিনি বলেন, তুমি নিজের অবস্থার দিকে তাকাও।
যে ব্যক্তি পুরাতন কাপড় পরিধান করে না তার জন্য নতুন কাপড় নয়।[5]
অন্য
হাদীছে এসেছে, আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, رَأَيْتُ عُمَرَ بْنَ
الْخَطَّابِ وَهُوَ يَوْمَئِذٍ أَمِيرُ الْمَدِينَةِ وَقَدْ رَقَعَ بَيْنَ
كَتِفَيْهِ بِرِقَاعٍ ثَلَاثٍ لَبَّدَ بَعْضَهَا فَوْقَ بَعْضٍ- ‘আমি উমর
(রাঃ)-কে দেখেছি যখন তিনি আমীরুল মু’মিনীন ছিলেন। আর তখন তার জামায় উভয়
স্কন্ধের মধ্যস্থলে পর পর তিনটি তালি লাগানো ছিল।[6]
অন্যত্র
এসেছে, খালিদ ইবনু উমায়র আদাবী (রহঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, উকবা ইবনু
গাযওয়ান (রাঃ) একদা আমাদের মাঝে ভাষণ দিলেন এবং প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা ও
গুণকীর্তন করে বললেন, দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবার সংবাদ দিয়েছে। দুনিয়ার
সামান্য কিছু বাকী রয়েছে, যেমন খানার পর পাত্রে কিছু খাদ্য উচ্ছিষ্ট থাকে,
যা ভক্ষণকারী রেখে দেয়। একদিন এ দুনিয়া ছেড়ে তোমরা অবিনশ্বর জগতের দিকে
রওয়ানা করবে। সুতরাং তোমরা ভবিষ্যতের জন্য কিছু নেকী নিয়ে রওয়ানা কর। কেননা
আমাকে বলা হয়েছে যে, জাহান্নামের এক কোণে একটি পাথর নিক্ষেপ করা হবে,
অতঃপর তা সত্তর বছর পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে যেতে থাকবে, তথাপিও উহা তার তলদেশে
পৌঁছতে পারবে না। আল্লাহর শপথ! জাহান্নাম পূর্ণ হয়ে যাবে। তোমরা কি এতে
বিস্ময় বোধ করছ? এবং আমার নিকট এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, জান্নাতের দুই
পাল্লার মাঝে চল্লিশ বছরের সফরের পথ। অচিরেই একদিন এমন আসবে, যখন উহা
মানুষের ভীড়ে পরিপূর্ণ থাকবে। আমি আমার প্রতি লক্ষ্য করেছি যে, আমি রাসূলের
সাথী সাত ব্যক্তির সপ্তম জন ছিলাম। তখন আমাদের নিকট গাছের পাতা ব্যতীত আর
কোন খাদ্যই ছিল না। ফলে আমাদের চোয়ালে ঘা হয়ে গেল। এ সময় আমি একটি চাঁদর
পেয়েছিলাম। অতঃপর আমার ও সা‘দ ইবনু মালিকের জন্য আমি তাকে দু’টুকরা করে
নেই। এক টুকরা দিয়ে আমি লুঙ্গি বানিয়েছি এবং অপর টুকরা দিয়ে লুঙ্গি
বানিয়েছে সা‘দ ইবনু মালিক (রাঃ)। আজ আমাদের সকলেই কোন না কোন শহরের আমীর।
অতঃপর তিনি বলেন, আমি আমার নিকট বড় এবং আল্লাহর নিকট ছোট হওয়া থেকে আল্লাহর
পানাহ চাই। সমস্ত পয়গাম্বরের নবুঅতই এক পর্যায়ে নির্বাপিত হয়ে পড়েছে।
অবশেষে উহা বাদশাহীর রূপ পরিগ্রহ করেছে। আমাদের পর আগমনকারী আমীর-উমারাদের
সংবাদ তোমরা অচিরেই পাবে এবং তাদেরকে যাচাই করতে পারবে।[7]
অন্য হাদীছে এসেছে খাববাব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
هَاجَرْنَا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم نَلْتَمِسُ وَجْهَ اللَّهِ ، فَوَقَعَ أَجْرُنَا عَلَى اللَّهِ ، فَمِنَّا مَنْ مَاتَ لَمْ يَأْكُلْ مِنْ أَجْرِهِ شَيْئًا مِنْهُمْ مُصْعَبُ بْنُ عُمَيْرٍ، وَمِنَّا مَنْ أَيْنَعَتْ لَهُ ثَمَرَتُهُ فَهُوَ يَهْدِبُهَا. قُتِلَ يَوْمَ أُحُدٍ، فَلَمْ نَجِدْ مَا نُكَفِّنُهُ إِلاَّ بُرْدَةً إِذَا غَطَّيْنَا بِهَا رَأْسَهُ خَرَجَتْ رِجْلاَهُ، وَإِذَا غَطَّيْنَا رِجْلَيْهِ خَرَجَ رَأْسُهُ، فَأَمَرَنَا النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم أَنْ نُغَطِّىَ رَأْسَهُ، وَأَنْ نَجْعَلَ عَلَى رِجْلَيْهِ مِنَ الإِذْخِرِ-
‘আমরা
নবী (ছাঃ)-এর সঙ্গে মদীনায় হিজরত করেছিলাম, এতে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা
করেছিলাম। আমাদের প্রতিদান আল্লাহর নিকটে নির্ধারিত হয়ে আছে। অতঃপর আমাদের
মধ্যে অনেকে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের বিনিময়ের কিছুই ভোগ করে
যাননি। তাঁদেরই একজন মুছ‘আব ইবনু উমায়ের (রাঃ)। আর আমাদের মধ্যে অনেকে এমনও
আছেন যাঁদের প্রতিদানের ফল পরিপক্ক হয়েছে। আর তাঁরা তা ভোগ করছেন। মুছ‘আব
(রাঃ) উহুদের দিন শহীদ হয়েছিলেন। আমরা তাঁকে কাফন দেয়ার জন্য এমন একটি চাদর
ব্যতীত আর কিছুই পেলাম না; যা দিয়ে তাঁর মস্তক আবৃত করলে তাঁর দু’পা বাইরে
থাকে আর তাঁর দু’পা আবৃত করলে তাঁর মস্তক বাইরে থাকে। তখন নবী করীম (ছাঃ)
তাঁর মস্তক আবৃত করতে এবং তাঁর দু’খানা পায়ের উপর ইযখির (ঘাস) দিয়ে দিতে
আমাদের নির্দেশ দিলেন।[8]
ছাহাবায়ে কেরামের যেমন কাপড়ের প্রতি লোভ-লালসা ছিলনা তেমনি বড় বড় প্রাসাদ বা অট্টালিকার প্রতিও ছিলনা কোন লোভ-লালসা। বরং তারা খুব সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। সারাজীবন তারা কুঁড়েঘরে বাস করে জীবন শেষ করেছেন। যেমন হাদীছে এসেছে, হাসান (রহঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, كُنتُ أدخلُ بيوتَ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي خِلافة عُثمان بْنِ عَفانَ، فَأتنَاولُ سَقفَها بِيدي- আমি ওছমান ইবনে আফফান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে নবী (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণের ঘরসমূহে যাতায়াত করতাম। আমি তাদের ঘরসমূহের ছাদসমূহ আমার দুই হাতে নাগাল পেতাম।[9]
অন্যত্র
এসেছে, দাউদ ইবনে কায়েস (রহঃ) বলেন, رَأيتُ الحُجراتِ مِن جَريدِ النَّخلِ
مُغشَّاة مِن خَارجٍ بمسُوح الشَّعرِ وَأظُنُ عَرْضَ البَيتِ مِن بَاب
الحُجرةِ إِلَى بَاب البيتِ نَحْوًا مِن سِتِ أَو سبعِ أَذرعٍ، وأحْزِرُ
البيتِ الدَّاخِلَ عَشرَ أَذرعٍ، وأَظنُ سُمكَهُ بَين الثَّمانِ والسَّبْعِ
نَحو ذَلك، ووقَفتُ عِند بَاب عَائشةَ فَإذا هُو مُستَقبِلَ المَغربَ-
‘খেজুরের ডাল দ্বারা নির্মিত মুমিন জননীদের ঘরসমূহ আমি দেখেছি। এসব ঘরের
বহির্দিকে (দেয়ালে) ছিল ঘাসের পলেস্তারা। আমার মনে হয় ঘরের প্রস্থ ছিল ঘরের
দরজা থেকে বাড়ির ফটক পর্যন্ত প্রায় ছয়-সাত হাত, ভিতরের অংশ দশ হাত এবং
উচ্চতা মনে হয় সাত-আট হাত হবে। আমি আয়েশা (রাঃ)-এর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়েছি।
তা ছিল পশ্চিমমুখী।[10]
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ هِلَالٍ أَنَّهُ رَأَى حُجَرَ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ جَرِيدٍ مَسْتُورَةً بِمُسُوحِ الشَّعْرِ فَسَأَلْتُهُ عَنْ بَيْتِ عَائِشَةَ فَقَالَ: كَانَ بَابُهُ مِنْ وِجْهَةِ الشَّامِ فَقُلْتُ: مِصْرَاعًا كَانَ أَوْ مِصْرَاعَيْنِ؟ قَالَ: كَانَ بَابًا وَاحِدًا، قُلْتُ: مِنْ أَيِّ شَيْءٍ كَانَ؟ قال: من عرعر أو ساج.
মুহাম্মাদ
ইবনে হেলাল (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি দেখেছেন যে, নবী (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণের
হুজরাসমূহে খেজুর পাতার ছাউনি এবং বেড়া শুষ্ক ঘাস বা খড়ের ছিল। আমি
মুহাম্মাদ ইবনে হেলালকে আয়েশা (রাঃ)-এর ঘর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি
বলেন, তার ঘরের দরজা ছিল সিরিয়া অভিমুখী। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, দরজার কপাট
কি একটি ছিল না দু’টি? তিনি বলেন, একটি। আমি বললাম, তা কি কাঠের ছিল? তিনি
বলেন, সাইপ্রাস অথবা সেগুনকাঠের।[11]
আরেকটি হাদীছের মধ্যে এসেছে,
عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ سِيرِينَ، قَالَ: إِنْ كَانَ الرَّجُلُ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْتِي عَلَيْهِ ثَلَاثَةُ أَيَّامٍ لَا يَجِدُ شَيْئًا يَأْكُلَهُ، فَيَأْخُذُ الْجِلْدَةَ فَيَشْوِيهَا فَيَأْكُلَهَا، فَإِذَا لَمْ يَجِدْ شَيْئًا أَخَذَ حَجَرًا فَشَدَّ بِهِ صُلْبَهُ-
মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন বলেন, যখন রাসূল
(ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের জীবনে তিনদিন চলে যেত অথচ কোন খাবার পেতেন না। তখন
তারা ছাগলের চামড়াকে ভুনা করতেন এবং সেগুলো খেতেন। আর যখন কিছুই পেতেন না
তখন পাথর পেটে বাঁধতেন।[12]
যেমন ফাযালা ইবনু ওবাইদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا صَلَّى بِالنَّاسِ خَرَّ رِجَالٌ مِنْ قَامَتِهِمْ فِي الصَّلَاةِ لِمَا بِهِمْ مِنْ الْخَصَاصَةِ وَهُمْ مِنْ أَصْحَابِ الصُّفَّةِ حَتَّى يَقُولَ الْأَعْرَابُ: إِنَّ هَؤُلَاءِ مَجَانِينُ. فَإِذَا قَضَى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الصَلَاةَ انْصَرَفَ إِلَيْهِمْ فَقَالَ لَهُمْ: لَوْ تَعْلَمُونَ مَا لَكُمْ عِنْدَ اللهِ عز وجل لَأَحْبَبْتُمْ أَنْ تَزْدَادُوا فَاقَةً وَحَاجَةً –
‘রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) যখন লোকদের সাথে নিয়ে জামা‘আতে ছালাত আদায় করতেন, তখন কিছু লোক
অসহনীয় ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছালাতের মধ্যেই দাঁড়ানো অবস্থা হতে পড়ে যেতেন।
তারা ছিলেন ছুফ্ফার সদস্য। তাদের এ অবস্থা দেখে বেদুঈনরা বলত, এরা পাগল
নাকি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত শেষ করে তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতেন,
আল্লাহ তা‘আলার নিকট তোমাদের যে কি মর্যাদা রয়েছে তা তোমরা জানলে আরো
ক্ষুধার্ত, আরো অভাব-অনটনে থাকতে পসন্দ করতে’।[13]
অন্য হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ছুফফাবাসী ছাহাবীগণ ছিলেন মুসলিমদের মেহমান। তাদের কোন ঘর-সংসার বা ধন-সম্পদ ছিল না। আল্লাহর কসম, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নাই, ক্ষুধার জ্বালায় আমি আমার পেট মাটিতে চেপে ধরতাম; এমনিভাবে ক্ষুধার তাড়নায় আমার পেটে পাথর বাঁধতাম। ছাহাবীরা যে পথ দিয়ে (মসজিদের উদ্দেশ্যে) বের হতেন তাদের সে পথে একদিন আমি বসে গেলাম। আবুবকর (রাঃ) আমার পাশ দিয়ে গেলেন। আমি তাঁকে আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি তাঁর সঙ্গে (তার ঘরে) আমাকে নিয়ে যাবেন এই আশা নিয়েই কেবল আমি এই আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু তিনি চলে গেলেন। আমাকে সাথে নিয়ে গেলেন না। এরপর ওমর (রাঃ) এই পথ দিয়ে গেলেন। তাঁকেও আমি আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। তিনি যেন আমাকে (তাঁর ঘরে) সঙ্গে নিয়ে যান এই আশা নিয়েই আমি প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি চলে গেলেন কিন্তু আমাকে সাথে নিলেন না। পরে আবুল কাসেম (রাসূল (ছাঃ)-এর উপনাম) এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই মুচকি হেসে বললেন, আবু হুরায়রা! আমি বললাম, লাববাইকা, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, সঙ্গে চল। এরপর তিনি চলতে লাগলেন। আমিও তাঁর পেছনে পেছনে যেতে লাগলাম। তিনি তাঁর ঘরে প্রবেশ করলেন। আমিও প্রবেশ অনুমতি চাইলাম। আমাকেও প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হ’ল। তিনি ঘরে একটি দুধের পেয়ালা পেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের জন্য এই দুধ কোথা থেকে এসেছে? বলা হ’ল অমুক ব্যক্তি আমাদের জন্য হাদিয়া পাঠিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন বললেন, আবু হুরায়রা! আমি বললাম, লাববায়কা। তিনি বললেন, ছুফ্ফাবাসীদের কাছে যাও এবং তাদের ডেকে নিয়ে এস। এরা ছিলেন মুসলিমদের মেহমান। এদের কোন ঘর-সংসার বা ধন-সম্পদ ছিল না। নবীজী (ছাঃ)-এর কাছে কিছু ছাদাকা আসলে তিনি তা তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন, এর থেকে নিজে কিছু গ্রহণ করতেন না। আর যদি তাঁর কাছে কিছু হাদিয়া আসত তবে তিনি তাদের কাছে পাঠাতেন এবং নিজেও তা থেকে কিছু গ্রহণ করতেন এবং এতে তাদেরকেও শরীক করতেন। এতে আমি মনক্ষুন্ন হলাম। মনে মনে বললাম ছুফ্ফাবাসীদের মাঝে এই এক পেয়ালায় কি হবে? আর আমি তাদের মাঝে সংবাদ বাহক হচ্ছি। সুতরাং নাবীজীতো আমাকেই তাদের সামনে তা পরিবেশন করতে হুকুম দিবেন। হয়ত আমার ভাগ্যে কিছু নাও জুটতে পারে। অথচ আমি আশা করেছিলাম যে ক্ষুধা নিবারণের মত অংশ পাব। কিন্তু আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলের আনুগত্য ছাড়া কোন উপায় নেই, তাই আমি তাদের কাছে গেলাম এবং তাদেরকে ডেকে নিয়ে এলাম। তারা এসে নিজ নিজ স্থানে বসে গেল তিনি বললেন, আবু হুরায়রা! পেয়ালাটি নাও এবং তাদের পরিবেশন কর।
আমি
পেয়ালাটি নিলাম এবং এক একজনকে তা পরিবেশন করতে লাগলাম, তিনি তা থেকে
পরিতৃপ্তির সাথে পান করছিলেন এবং আমাকে তা ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি তখন তা
অপরজনকে দিচ্ছিলাম। শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে তা নিয়ে পৌঁছলাম।
ইতিমধ্যে উপস্থিত পুরা সম্প্রদায় পরিতৃপ্ত হয়ে গেছেন। রাসূল (ছাঃ) পেয়ালাটি
নিয়ে হাতে রাখলেন এবং এরপর মাথা তুলে মুচকি হাসলেন। বললেন, আবু হুরায়রা!
পান কর। আমি তা পান করলাম। তিনি পুনরায় বললেন, আরো পান কর। আমি পান করতে
থাকলাম তিনি বলতে থাকলেন, তুমি পান কর। শেষে আমি বললাম, যিনি আপনাকে সত্যসহ
প্রেরণ করেছেন সেই সত্তার কসম, আমি আর এ জন্য কোন পথ পাচ্ছি না। তিনি তখন
পেয়ালাটি নিলেন, আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং বিসমিল্লাহ বলে তা পান করে
নিলেন।[14]
অন্য
হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি উদর পূর্তির
জন্য যা পেতাম তাতে সন্তুষ্ট হয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে সর্বদা লেগে
থাকতাম। সে সময় রুটি খেতে পেতাম না। রেশমী কাপড় পরিধান করতাম না কোন
চাকর-চাকরানীও আমার খেদমতে নিয়োজিত থাকত না। আমি পাথরের সাথে পেট লাগিয়ে
রাখতাম। আয়াত জানা সত্ত্বেও কোন ব্যক্তিকে তা পাঠ করার জন্য বলতাম যাতে সে
আমাকে ঘরে নিয়ে যায় এবং আহার করায়। মিসকীনদের প্রতি অত্যন্ত দরদী ব্যক্তি
ছিলেন জা‘ফর ইবনু আবু তালিব (রাঃ)। তিনি আমাদের নিয়ে খেতেন এবং ঘরে যা
থাকতো তা-ই আমাদের খাওয়াতেন। এমনকি তিনি আমাদের কাঁচের পাত্রটিও বের করে
আনতেন, যাতে ঘি থাকতো না। আমরা সেটাই ফেড়ে ফেলতাম এবং এর গায়ে যা লেগে
থাকত, তা-ই চেটে খেতাম।[15]
অন্য
হাদীছে এসেছে, মুহাম্মদ ইবনে সীরীন (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা
একদিন আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। তখন তাঁর দেহে দু’টি
কাতানের কাপড় (অর্থাৎ একটি কাতানের চাদর ও একটি লুঙ্গি) শোভা পাচ্ছিল। আবু
হুরায়রা (রাঃ) তাঁর একটি দ্বারা নাক পরিস্কার করছিলেন। তখন তিনি বলে উঠলেন-
বাহ, বাহ! আবু হুরায়রা কাতানের কাপড় দ্বারা নাক পরিস্কার করছ! অথচ এক সময়
এমন ছিল যখন আমি নিজে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মিম্বার এবং আয়েশা (রাঃ)-এর
হুজরার পার্শ্বে পেটের জ্বালায় কাতর হয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতাম। প্রায়
আগন্তুকই আমাকে মৃগী রোগী মনে করে গর্দানে পা দ্বারা আঘাত করত। প্রকৃতপক্ষে
আমার মধ্যে উন্মাদনার লেশমাত্র ছিল না, বরং প্রচন্ড ক্ষুধার জ্বালাতেই
আমার এ অবস্থা হতো।[16]
এমনিভাবে
আব্দুল্লাহ ইবনে শাক্বীক্ব বলেন, أَقَمْتُ بِالْمَدِينَةِ مَعَ أَبِى
هُرَيْرَةَ سَنَةً فَقَالَ لِى ذَاتَ يَوْمٍ وَنَحْنُ عِنْدَ حُجْرَةِ
عَائِشَةَ لَقَدْ رَأَيْتُنِى وَمَا لَنَا ثِيَابٌ إِلاَّ الْبِرَادُ
الْمُتَفَتَّقَةُ وَإِنَّهُ لَيَأْتِى عَلَى أَحَدِنَا الأَيَّامُ مَا
يَجِدُ طَعَاماً يُقِيمُ بِهِ صُلْبَهُ حَتَّى إِنْ كَانَ أَحَدُنَا
لَيَأْخُذُ الْحَجَرَ فَيَشُدُّهُ عَلَى أَخْمَصِ بَطْنِهِ ثُمَّ يَشُدُّهُ
بِثَوْبِهِ لِيُقِيمَ بِهِ صُلْبَهُ - ‘আমি আবূ হুরাইরা (রাঃ)-এর সাথে
মদীনায় এক বছর ছিলাম। একদা যখন আমরা আয়েশা (রাঃ)-এর হুজরার কাছে ছিলাম,
তিনি (আবু হুরায়রা) আমাকে বললেন, আমরা এমনও অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি যে,
কয়েকটি ছেঁড়া-ফাটা চাদর ব্যতীত আমাদের কাছে অন্য কোন কাপড়ই থাকত না। আর
আমাদের কারো কারো উপর দিয়ে এমন কয়েক দিন অতিবাহিত হয়ে যেত যে, সে তার পিঠ
সোজা রাখার জন্য কোন খাদ্য পেত না। এমন কি আমাদের কেউ কেউ তার পিঠকে সোজা
রাখার জন্য পাথর নিয়ে কাপড় দিয়ে পেটের নিম্নাংশকে বেঁধে রাখত।[17]
অন্যত্র
এসেছে, বারা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ أَصْحَابُ النَّبِىِّ صلى
الله عليه وسلم إِذَا كَانَ الرَّجُلُ صَائِمًا فَحَضَرَ الإِفْطَارُ
فَنَامَ قَبْلَ أَنْ يُفْطِرَ لَمْ يَأْكُلْ لَيْلَتَهُ وَلاَ يَوْمَهُ
حَتَّى يُمْسِىَ وَإِنَّ قَيْسَ بْنَ صِرْمَةَ الأَنْصَارِىَّ كَانَ
صَائِمًا فَلَمَّا حَضَرَهُ الإِفْطَارُ أَتَى امْرَأَتَهُ فَقَالَ هَلْ
عِنْدَكِ طَعَامٌ قَالَتْ لاَ وَلَكِنْ أَنْطَلِقُ فَأَطْلُبُ لَكَ.
وَكَانَ يَوْمَهُ يَعْمَلُ فَغَلَبَتْهُ عَيْنُهُ وَجَاءَتْهُ امْرَأَتُهُ
فَلَمَّا رَأَتْهُ قَالَتْ خَيْبَةً لَكَ. فَلَمَّا انْتَصَفَ النَّهَارُ
غُشِىَ عَلَيْهِ فَذَكَرَ ذَلِكَ لِلنَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم-
فَنَزَلَتْ هَذِهِ الآيَةُ (أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ
إِلَى نِسَائِكُمْ) فَفَرِحُوا بِهَا فَرَحًا شَدِيدًا (وَكُلُوا
وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ
الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ- ‘মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের
অবস্থা এই ছিল যে, যদি তাঁদের কেউ ছিয়াম পালন করতেন তাহলে ইফতারের সময় হলে
ইফতার না করে নিদ্রা গেলে সে রাত্রে এবং পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছুই
খেতেন না। কায়স ইবনু ছিরমা আনছারী (রাঃ) ছিয়াম করেছিলেন। ইফতারের সময় তিনি
তাঁর স্ত্রীর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে কিছু খাবার আছে কি? তিনি
বললেন, না, তবে আমি যাচ্ছি, দেখি আপনার জন্য কিছু খোঁজ করে আনি। তিনি দিনে
কাজে নিয়োজিত থাকতেন। তাই ঘুমে তাঁর দু’চোখ বুজে গেল। এরপর তাঁর স্ত্রী এসে
যখন তাঁকে দেখলেন, তখন তাঁকে বললেন, হায়, তুমি বঞ্চিত হয়ে গেলে! পরদিন
দুপুর হলে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। এ ঘটনাটি নবী (ছাঃ)-এর নিকট উল্লেখ করা হলে
কুরআনের এ আয়াত অবতীর্ণ হয়-ছিয়ামের রাতে তোমাদের স্ত্রী সম্ভোগ হালাল করা
হয়েছে (বাক্বারাহ ২/১৮৭)। এর হুকুম সম্বন্ধে অবহিত হয়ে ছাহাবীগণ
খুবই খুশী হলেন। এরপর নাযিল হ’ল- আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ না কালো রেখা
থেকে ভোরের সাদা রেখা পরিষ্কার দেখা যায় (বাকারা ২/১৮৭)।[18]
আরেকটি
হাদীছের মধ্যে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘জনৈক (ক্ষুধার্ত)
ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর খেদমতে এল। তিনি খাদ্যদ্রব্য কিছু আছে কিনা তা
জানার জন্য তাঁর সহধর্মিণীদের কাছে লোক পাঠালেন। তাঁরা জানালেন, আমাদের
নিকট পানি ব্যতীত অন্য কিছুই নেই। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-বললেন, কে আছ যে
এই (ক্ষুধার্ত) ব্যক্তিকে মেহমান হিসাবে নিয়ে নিজের সাথে খাওয়াতে পার? তখন
জনৈক আনছারী ছাহাবী (আবু তালহা (রাঃ) বললেন আমি (পারব)। এ বলে তিনি
মেহমানকে নিয়ে (বাড়িতে) গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, রাসূল (ছাঃ)-এর মেহমানকে
সন্মান কর। স্ত্রী বললেন, বাচ্চাদের আহার্য ব্যতীত আমাদের ঘরে অন্য কিছুই
নেই। আনছারী বললেন, তুমি আহার প্রস্ত্তত কর এবং বাতি জ্বালাও। আর বাচ্চারা
খাবার চাইলে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। (স্বামীর কথা অনুযায়ী) সে বাতি
জ্বালাল, বাচ্চাদেরকে ঘুম পড়ালো এবং সামান্য খাবার যা তৈরী ছিল তা উপস্থিত
করল। (তারপর মেহমানসহ তারা খেতে বসলেন) বাতি ঠিক করার বাহানা করে স্ত্রী
উঠে গিয়ে বাতিটি নিভিয়ে দিলেন। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ই অন্ধকারের
মধ্যে আহার করার মত শব্দ করতে লাগলেন এবং মেহমানকে বুঝাতে লাগলেন যে তারাও
সঙ্গে খাচ্ছেন। তাঁরা উভয়েই (বাচ্চারা সহ) সারা রাত অভুক্ত অবস্থায়
কাটালেন। ভোরে যখন তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট গেলেন, তখন তিনি বললেন, আল্লাহ
তোমাদের গতরাতের কার্যকলাপ দেখে হেসে দিয়েছেন বা খুশী হয়েছেন এবং এ আয়াত
নাযিল করেছেন- (আনছারদের অন্যতম গুণ হ’ল এই) তারা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও
নিজেদের উপর অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। আর যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য
থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)।[19]
অপর
একটি ঘটনা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, كُنَّا
جُلُوسًا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذْ جَاءَهُ رَجُلٌ
مِنَ الأَنْصَارِ فَسَلَّمَ عَلَيْهِ ثُمَّ أَدْبَرَ الأَنْصَارِىُّ
فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : يَا أَخَا الأَنْصَارِ
كَيْفَ أَخِى سَعْدُ بْنُ عُبَادَةَ. فَقَالَ صَالِحٌ.فَقَالَ رَسُولُ
اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : مَنْ يَعُودُهُ مِنْكُمْ ؟ فَقَامَ وَقُمْنَا
مَعَهُ وَنَحْنُ بِضْعَةَ عَشَرَ مَا عَلَيْنَا نِعَالٌ وَلاَ خِفَافٌ
وَلاَ قَلاَنِسُ وَلاَ قُمُصٌ نَمْشِى فِى تِلْكَ السِّبَاخِ حَتَّى
جِئْنَاهُ فَاسْتَأْخَرَ قَوْمُهُ مِنْ حَوْلِهِ حَتَّى دَنَا رَسُولُ
اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَأَصْحَابُهُ الَّذِينَ مَعَهُ- ‘আমরা
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম, ইতিমধ্যে এক আনছারী এলেন এবং তাঁকে সালাম
দিলেন। অতঃপর আনছারী ফিরে যেতে লাগলেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে আনছারের
ভাই! আমার ভাই সা‘দ ইবনে উবাদাহ কেমন আছে? তিনি বললেন, ভাল আছে। তারপর
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমাদের মধ্যে কে তাকে (অসুস্থ সা‘দকে) দেখতে
যাবে? সুতরাং তিনি উঠে দাড়ালেন এবং আমরাও উঠে দাঁড়ালাম। আমরা দশের কিছু
বেশী ছিলাম। আমাদের না ছিল জুতা, আর না ছিল মোজা, টুপি কিংবা জামা। আমরা ঐ
পাথুরে যমীনে (খালি) পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, এমনকি শেষ পর্যন্ত আমরা সা‘দ
(রাঃ)-এর নিকট পৌঁছে গেলাম। তার গৃহবাসীরা তাঁর নিকট থেকে সরে গেল, তখন
রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ তাঁর নিকটবর্তী হলেন।[20]
অন্য
হাদীছে এসেছে, সা‘দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
وَرَأَيْتُنَا نَغْزُو وَمَا لَنَا طَعَامٌ إِلَّا وَرَقُ الْحُبْلَةِ
وَهٰذَا السَّمُرُ وَإِنَّ أَحَدَنَا لَيَضَعُ كَمَا تَضَعُ الشَّاةُ ‘আমরা
যখন আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করেছি, তখন অবস্থা এমন ছিল যে, এই হুবলা এবং
বাবলা বৃক্ষের পাতা ব্যতিরেকে আমাদের নিকট খাবার মত কোন কিছুই থাকত না। ফলে
আমাদের এক একজন ছাগলের মত মল ত্যাগ করত।[21]
জাবের
(রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,بَعَثَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه
وسلم وَأَمَّرَ عَلَيْنَا أَبَا عُبَيْدَةَ نَتَلَقَّى عِيرًا لِقُرَيْشٍ
وَزَوَّدَنَا جِرَابًا مِنْ تَمْرٍ لَمْ يَجِدْ لَنَا غَيْرَهُ فَكَانَ
أَبُو عُبَيْدَةَ يُعْطِينَا تَمْرَةً تَمْرَةً قَالَ فَقُلْتُ كَيْفَ
كُنْتُمْ تَصْنَعُونَ بِهَا قَالَ نَمَصُّهَا كَمَا يَمَصُّ الصَّبِىُّ
ثُمَّ نَشْرَبُ عَلَيْهَا مِنَ الْمَاءِ فَتَكْفِينَا يَوْمَنَا إِلَى
اللَّيْلِ وَكُنَّا نَضْرِبُ بِعِصِيِّنَا الْخَبَطَ ثُمَّ نَبُلُّهُ
بِالْمَاءِ فَنَأْكُلُهُ- ‘রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে একটি অভিযানে প্রেরণ করলেন
এবং আবু উবায়দাকে আমাদের আমীর নিযুক্ত করলেন। কুরায়শদের কাফেলার গতিবিধি
লক্ষ্য রাখা এবং তাদের প্রতিরোধ করার দায়িত্ব ছিল আমাদের। তিনি পাথেয়
স্বরূপ আমাদেরকে এক থলে খেজুর সাথে দেন। এছাড়া অন্য কিছু আমাদের জন্য তিনি
পাননি। আবূ উবায়দা (রাঃ) আমাদেরকে দৈনিক একটা করে খেজুর দিতেন। রাবী বলেন,
আমি তখন বললাম, তা দিয়ে আপনারা কিভাবে কি করতেন? আমি বললাম, আমরা তা চুষতাম
যেভাবে শিশুরা চুষে থাকে। তারপর এর উপর পানি পান করে নিতাম এবং তা আমাদের
দিবারাত্রের জন্য যথেষ্ট হত। এছাড়া আমরা আমাদের লাঠি দিয়ে (বাবলা) গাছের
পাতা পেড়ে পানিতে তা ভিজিয়ে (নিয়ে তারপর তা খেয়ে) নিতাম।[22]
অন্য
হাদীছে এসেছে, আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
لَقَدْ أُخِفْتُ فِي اللَّهِ وَمَا يَخَافُ أَحَدٌ ، وَلَقَدْ أُوذِيتُ فِي
اللَّهِ، وَمَا يُؤْذَى أَحَدٌ، وَلَقَدْ أَتَتْ عَلَيَّ ثَلاثُونَ مِنْ
بَيْنِ لَيْلَةٍ وَيَوْمٍ وَمَا لِي وَلِبِلالٍ طَعَامٌ يَأْكُلُهُ ذُو
كَبِدٍ، إِلا شَيْءٌ يُوَارِيهِ إِبْطُ بِلالٍ- ‘আল্লাহর পথে আমাকে এত ভয়
প্রদর্শন করা হয়েছে যে, আল্লাহর জন্য আমাকে এত যাতনা দেওয়া হয়েছে যে, আর
কাউকে এত যাতনা দেওয়া হয় নি। এক নাগাড়ে ত্রিশটি দিন ও রাত্র এমনও অতিবাহিত
হয়েছে যে বিলালের বগলের তলে রক্ষিত সামান্য খাদ্য ছাড়া আমার ও বিলালের জন্য
এতটুকু খাদ্যও ছিল না যা কোন প্রাণী খেতে পারে’।[23]
সম্মানিত পাঠক! একটু খেয়াল করুন, ছাহাবায়ে কেরামের জীবন কীভাবে অতিবাহিত হয়েছে। এরপরেও তারা কখনো রিযিক অন্বেষণের ক্ষেত্রে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করেননি। তাদের জীবনে এত অভাব-অনটন ছিল যে খাদ্যের অভাবে তারা বেহুশ হয়ে যেতেন। মাঝে মধ্যে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছালাত থেকে পড়ে যেতেন, যা আমরা উপরোক্ত হাদীছ সমূহে লক্ষ্য করেছি। আবার আমরা নিজেরা অনেকে বলে থাকি ছাহাবায়ে কেরাম এমন ছিলেন, কিন্তু কখনো কি তাদের জীবন যাপনকে অনুধাবন করে আমাদের বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগ করেছি? অনেকে তাদের জীবনী নিয়েও বই-পত্র লিখেছেন ও পড়েছেন, কিন্তু কয়জনের জীবনে পরিবর্তন এসেছে? আল্লাহ আমাদেরকে এই মূল্যহীন দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা থেকে মুক্ত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!
(চলবে)
[লেখক : গবেষণা সহকারী, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ]
[1]. ইবনু হিববান হা/৩০৩৬; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/৪০৬২, সনদ ছহীহ।
[2]. আহমাদ হা/২৪২৩২; বায়হাকী, সুনানুল কুবরা হা/৬৪৬৫, সনদ ছহীহ।
[3]. বুখারী হা/৪৪২; মিশকাত হা/৫২৪১; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩১৫।
[4]. বুখারী হা/২৬২৮; মিশকাত হা/৪৩৭৬।
[5]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪৭১, সনদ হাসান।
[6]. মুয়াত্তা মালেক হা/৩৪০০; ছহীহুত তারগীব হা/২০৮২।
[7]. মুসলিম হা/২৯৬৭; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩১২।
[8]. বুখারী হা/১২৭৬; মিশকাত হা/৬১৯৬।
[9]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪৪৯-৫০; শু‘আবুল ঈমান হা/১০২৪৯।
[10]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪৫১; শু‘আবুল ঈমান হা/১০২৫০, সনদ ছহীহ।
[11]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭৭৬, সনদ ছহীহ।
[12]. ছহীহুত তারগীব হা/৩৩১০।
[13]. তিরমিযী হা/২৩৬৮; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩০৬; ছহীহাহ হা/২১৬৯।
[14]. বুখারী হা/৬৪৫২; তিরমিযী হা/২৪৭৭; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩০৩।
[15]. বুখারী হা/৩৭০৮; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩০৪।
[16]. বুখারী হা/৭৩২৪; তিরমিযী হা/২৩৬৭; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩০৫।
[17]. আহমাদ হা/৮২৮৪; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩০৭।
[18]. বুখারী হা/১৯১৫; হাকেম হা/৬৮৭৫; তিরমিযী হা/২৯৬৮, সনদ ছহীহ।
[19]. বুখারী হা/৩৭৯৮; আল-অদাবুল মুফরাদ হা/৭৪০।
[20]. মুসলিম হা/৯২৫; শু‘আবুল ঈমান হা/৯১৮৩।
[21]. বুখারী হা/৫৪১২; মুসলিম হা/২৯৬৬; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩১১।
[22]. মুসলিম হা/১৯৩৫; আবুদাউদ হা/৩৮৪০; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩০৯।
[23]. তিরমিযী হা/২৪৭২; মিশকাত হা/৫২৫৩; ছহীহুত তারগীব হা/৩২৮১।