নিসর্গের প্রাণোচ্ছলতায়, বৈচিত্রের সমারোহে
আসিফ রেযা
১.
ইসলামাবাদ থেকে চলে এসেছি ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। প্রায় আড়াই বছর গত হল। ইসলামাবাদ শহরের অলি-গলি, ফয়ছাল মসজিদ, হামীদুল্লাহ লাইব্রেরী, মারগালা পাহাড়, আমার বিশ্ববিদ্যালয় (ইসলামিক ইউনিভার্সিটি ইসলামাবাদ) ক্যাম্পাস, হোস্টেল ক্যাম্পাস, আলী (রাঃ) হোস্টেলের ১৩১ নং রুম, কুয়েত হোস্টেল সবকিছুই খুব মনে পড়ে। খুব ইচ্ছা হয় একবার যদি ঘুরে আসতে পারতাম ফেলে আসা স্মৃতির বাগানে! সেই সুযোগটা লুফে নিতে চাইলাম যখন একটা কনফারেন্সের নোটিশ পেলাম বন্ধু হাসান বাযাযো মারফত। ‘৩য় বার্ষিক ইন্টারন্যাশনাল দাওয়াহ কনফারেন্স ২০১৯’ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৩-৪রা এপ্রিল ২০১৯-এ। নোটিশ পেয়ে আর দেরি করিনি। বেশ কয়েকদিন খাটাখাটুনী করে যথাসময়ে বিষয় ও সারবস্ত্ত (এ্যাবস্ট্রাক্ট) পাঠালাম। প্রাথমিকভাবে বিষয় অনুমোদনের পর ৩য় ধাপে প্রবন্ধটি চুড়ান্তভাবে অনুমোদন পেল আলহামদুলিল্লাহ। আরবীতে লেখা প্রবন্ধটির বিষয় ছিল- منهج جمعية تحريك أهل الحديث بنغلاديش في نشر الدعوة الإسلامية: دراسة وتحليل (ইসলাম প্রচারে আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ-এর কর্মপদ্ধতি : পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ)। অপেক্ষা করছি চূড়ান্ত ঘোষণা ও দাওয়াতপত্রের। কিন্তু শেষতক জানানো হ’ল পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কনফারেন্সটি নির্ধারিত সময়ে হচ্ছে না। পরবর্তীতে তারিখ জানানো হবে। এরপর থেকে আর খোঁজখবর নেই। আমিও কনফারেন্সের কথা ভুলে গেলাম। হঠাৎ নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি মেইল চেক করতে গিয়ে এক সপ্তাহ পূর্বে আসা একটি মেইল খুলে দেখি কনফারেন্সের দাওয়াতপত্র। দাওয়াহ একাডেমী ডাইরেক্টর ড. তাহের মাহমূদ স্বাক্ষরিত পত্রে জানানো হয়েছে যে, ২দিন ব্যাপী সম্মেলনটি ডিসেম্বরের ৪-৫ তারিখে অনুষ্ঠিত হ’তে যাচ্ছে এবং ২০ নভেম্বরের মধ্যে জানাতে হবে আমি স্বশরীরে অংশগ্রহণ করছি কি না? হাতে সময় মাত্র কয়েকদিন। কিছুটা দোটানায় পড়ে গেলাম। নতুন বছরের শুরু হতে যাচ্ছে। হাদীছ ফাউন্ডেশন শিক্ষাবোর্ডের অধীনস্ত মাদরাসাগুলোতে যথাসময়ে পাঠ্যক্রম, পাঠপরিকল্পনা এবং সিলেবাসের বই সরবরাহ করতে হবে। এমতাবস্থায় সব ফেলে দেশের বাইরে যাব কিনা। অবশেষে পিতার পরামর্শে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনে গেলাম। কনফারেন্স ভিসার জন্য আবেদনের পরও ভিসা কাউন্সিলর যেভাবে খুঁটিনাটি অপ্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে রীতিমত জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন, তাতে অবাক হলাম। শেষ পর্যন্ত তিনি ভিসা দিতে রাজী হলেন। আর বললেন, যেহেতু বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানীদের ভিসা দিচ্ছে না, তাই পাল্টা পদক্ষেপ হিসাবে আমরাও পারতপক্ষে ভিসা দিচ্ছি না। এজন্যই এতকিছু জিজ্ঞাসা।
তিনদিন পর ভিসা পেয়ে কনফারেন্স কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিলাম, আসছি। ঢাকা থেকে পাকিস্তানে সরাসরি কোন ফ্লাইট যায় না। অন্য কোন দেশ ঘুরে যেতে হয়। তাই নিকটতম রুট হিসাবে বেছে নিতে হ’ল থাইল্যান্ডের পথ।
কনফারেন্সের ২দিন আগে ২রা ডিসেম্বর ২০১৯ দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে থাই এয়ারের একটি ফ্লাইটে রওনা হলাম ব্যাংককের পথে। অধিকাংশ যাত্রীই বাঙালী। এদের বড় অংশই যাচ্ছে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। তবে এর মধ্যে কয়েকজন পেলাম, যারা আমার মতই পাকিস্তানের যাত্রী। কেউ করাচী, কেউবা লাহোর যাবে। পার্শ্ববর্তী যাত্রী ছিলেন পাকিস্তানী। করাচী যাবেন। বছর খানিক ধরে বাংলাদেশের একটি গার্মেন্টসে কোয়ালিটি ম্যানেজার হিসাবে কাজ করেছেন। এবার দেশে ফিরে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের মানুষের ব্যবহারে তিনি যারপরনেই সন্তুষ্ট। বার বার সে কথা উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। সহকর্মীদের সাথে তোলা ছবিগুলো দেখিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন। আড়াই ঘন্টা চলার পর ব্যাংকক শহরের কাছাকাছি পৌঁছাতে বিমানের জানালা থেকে নীচে তাকাই। অন্তহীন থাই সাগরে তখন শেষ বিকেলের সোনালী রোদ ঝিকিমিকি খেলে। একসময় সূর্য অস্ত যায় সাগরবুকে। ভারী সুন্দর সে দৃশ্য। আলো ঝলমলে ব্যাংকক শহরটাও উপর থেকে দেখে নিলাম। স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে অবতরণ করি। দিনের আলো তখনও অবশিষ্ট আছে। বিমান থেকে বের হতেই গরম বাতাসের ঝটকায় সতেজ অনুভূতি হয়। বাংলাদেশে যখন ঠান্ডা বেশ জেঁকে বসেছে, তখন এখানে ফাগুনের আবহাওয়া। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বৃহদায়তন বিমানবন্দর এটি। কুলকিনারা খুঁজে পেতে যথেষ্ট বেগ পাই। ট্রানজিট টাইম সোয়া ঘন্টা। তারপরও জায়গামত পৌঁছাতে অনেক সময় গেল। ফ্লাইট কিছুটা বিলম্ব থাকায় রক্ষা পেলাম। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ইসলামাবাদের উদ্দেশ্যে বিমান ছাড়ল। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টার যাত্রা। ইসলামাবাদে কাটানো সাড়ে তিন বছরের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি।
স্থানীয় সময় রাত ১০টা ২০ মিনিটে ইসলামাবাদ পৌঁছে যাই আলহামদুলিল্লাহ। ঝা চকচকে নতুন বিমানবন্দর। ইসলামাবাদে যখন ছিলাম তখনই কাজ শুরু হয়েছিল। সম্প্রতি উদ্বোধন হয়েছে। আয়তন অনুপাতে তেমন কোন ভিড় নেই। ইমিগ্রেশন অফিসার বেশ ভদ্র আচরণ করলেন। লাগেজ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ইসলামাবাদে আগেভাগেই শীত পড়ে। হিমেল বাতাসের ঝটকায় শরীরটা কেঁপে উঠে। বাইরে অপেক্ষা করছিলেন দাওয়াহ একাডেমীর শিক্ষক আমার পূর্ব পরিচিত জনাব ড. যহীর বাহরাম ও তাঁর দু’জন সঙ্গী। আমাকে দেখে তাঁরা এগিয়ে আসেন। ড. যহীরকে আমি চিনলেও তিনি আমাকে চিনতেন না। তবে পোশাক দেখে অনুমান করে নিয়েছিলেন। দাওয়াহ একাডেমীর একটি মাইক্রোবাস এসেছে। তাতে আমরা চড়ে বসলাম। ইসলামাবাদ শহর থেকে প্রায় ২৫ কি.মি. দূরে অবস্থিত এই বিমানবন্দর। পরিচিত রাস্তায় যেতে যেতে আমি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। ড. যহীর ও তাঁর সঙ্গী ইমরান খানের নয়া পাকিস্তানের হাওয়াই গপসপের পিন্ডি উদ্ধার করেন আর নওয়াজ শরীফের গুনগান করেন। ড্রাইভার ফয়ছালা টেনে বলেন, জো ভি হো ইসলামাবাদ ওয়াকেঈ বহুত পিয়ারী হ্যাঁয়! হ্যাঁ, ইসলামাবাদ এসে তো এই পেয়ারের আখ্যানই শুনতে চাই। কতদিন বাইক নিয়ে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে এই পিন্ডি-ইসলামাবাদ রোডে চলাফেরা করেছি। কাশ্মীর হাইওয়েতে এসে বাতাসের বেগে বাইক ছুটানোর সেই স্মৃতি জাগরুক হয়ে ওঠে। মনেই হচ্ছিল না যে মাঝখান থেকে কয়েকটা বছর চলে গেছে। যেন সবকিছুই আগের মত। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ফয়ছাল মসজিদ সংলগ্ন দাওয়াহ একাডেমী গেস্ট হাউজে আমার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে পৌঁছাই। ড. যহীর সবকিছু ঠিকঠাক করে দিয়ে বিদায় নেন।
২.
পরদিন সকালে গেস্ট হাউজের নাশতার টেবিলে সাক্ষাৎ হয় কায়রোর জামে‘আতুত তাযামুন আল-ফ্রানসিয়াহ বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ বিভাগের বাংলাদেশী শিক্ষক ড. রফীকুল ইসলাম (বরগুনা), আলজেরিয়ার বুয়াইরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রধান ড. ইয্যুদ্দীন আব্দুদ দায়েম এবং মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ বিভাগে পিএইচডি গবেষণারত পাকিস্থানী মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান (এ্যাবোটাবাদ)-এর সাথে। তাঁরাও গতকাল দিনের বেলা ইসলামাবাদ পৌঁছেছেন। ড. রফীক আগেই আমার সাথে আগেই যোগাযোগ করেছিলেন কনফারেন্সে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় একজন বাংলাদেশী দেখে। আল-আযহারে অনার্স, মাস্টার্স ও পিএইচডি সম্পন্ন করে বর্তমানে তিনি কায়রোয় স্বপরিবারে অবস্থান করছেন। খুব শান্ত ও নম্রভাষী এই ভাই থেমে থেমে চমৎকার সাহিত্যিক আরবীতে কথা বলেন। মিসরের প্রতি তাঁর মুগ্ধতা এতটাই যে নিজেকে ‘মুতামাছ্ছার’ বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাঁর কথা হ’ল মিসরে কখনও নিরাপত্তার অভাব বোধ করি না। কিন্তু দেশে গেলেই ভয় লাগে যে, কখন কি হয়ে যায়। অনেকবার ভেবেছি দেশে ফিরব, কিন্তু সাহস পাই না। সুতরাং অজানা কালের জন্য সেদেশেই যিন্দেগী গুযরান তাঁর ভবিতব্য ধরে নেয়া যায়। মধ্যবয়সী ড. ইয্যুদ্দীন খুব আমুদে ও দিলখোলা মানুষ। খাওয়ার টেবিল বলা যায় মাতিয়ে রাখেন একাই। ইন্টারনেটে তাঁর আরবী ব্যকরণের উপর একটি চমৎকার ভিডিও কোর্স আছে। মুহাম্মাদ ভাই কম কথার মানুষ। তবে যতটুকু বলেন তা খুব জ্ঞানপূর্ণ এবং দায়িত্ববোধসম্পন্ন। প্রথম সাক্ষাতেই এই তিনজনের সাথে ভাল একটা বোঝাপড়া তৈরী হয়ে গেল। যেটা সফরের শেষ পর্যন্তই বজায় থাকল। দেশের বাইরে এই জিনিসটা আমার আগাগোড়া ভাল লাগে। চেনা নেই, জানা নেই অথচ মুহূর্তের ব্যবধানে একজন মানুষের সাথে কত গাঢ় সম্পর্ক তৈরী হয়! লক্ষ্যের একাত্মতা মানুষকে খুব দ্রুতই কাছাকাছি নিয়ে চলে আসে। আবার লক্ষ্যের দূরত্ব সবচেয়ে কাছের মানুষটিকেও কখনও দূরে ঠেলে দেয়। এই তো মানবজনম! আজব এক খেলাঘর!
বেলা দশটার দিকে রাওয়ালপিন্ডি থেকে আব্দুর রহমান বাঙ্গালী ভাই তাঁর এক বন্ধু নিয়ে আসলেন। ইসলামাবাদে থাকতে অনেকদিন রান্না করে খাইয়েছেন। আজ তার কিঞ্চিত ঋণ শোধ করতে দেশ থেকে কিছু হাদিয়া নিয়ে এসেছি। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা আমার সঙ্গ দিলেন। তাঁদের সাথে প্রিয় ফয়ছাল মসজিদ প্রাঙ্গন ও মারগালা পাহাড়ের কোলে নিবিড় অরণ্যে ঘেরা কুয়েত হোস্টেল চত্বর ঘুরে ঘুরে দেখি আর বুঁদ হয়ে ফেলে আসা স্মৃতির গন্ধ শুকি। প্রতিটা মুহূর্ত প্রাণভরে উপভোগ করতে ইচ্ছা করে। স্মৃতিরা কি দামামা বাজায়? নতুবা আজ কেন হৃদয়মাঝে এমন দূরাগত দ্রিম আওয়াজ টের পাই! কেন খাঁ খাঁ অন্তর্দেশ এমন চিন চিন করে! রাস্তার ধারে টুলের উপর পাকোড়া খেতে বসি। ছাত্রদের ভিড়ে পরিচিত মুখ খুঁজি। পাই না। নতুনেরা জায়গা দখল করে নিয়েছে পুরোনোদের। বাদরগুলো আগের মতই নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়। এ ছাদ থেকে ও ছাদ। বনের ঝি ঝি পোকাদের ডাক আগের মতই আনমনা করে দেয়। হোস্টেলের সামনে ভলিবল কোর্টে ঠিক মতই নেট ঝুলে আছে। হোস্টেল ক্যান্টিনে আজও ভিড় করে ছাত্ররা চা-কফি খাচ্ছে। সবকিছু তো আগের মতই। পরিবর্তন খালি চরিত্র আর উপলক্ষ্যগুলোর। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে আমার। অতীতে ফেরার আকুতিতে সাড়া দেয় না কেউ।
কুয়েত হোস্টেলে মাগরিবের ছালাত আদায় করে ফয়ছাল মসজিদ প্রাঙ্গনে ফিরে আসি। আব্দুর রহমান ভাইরা বিদায় নেয়। আমি গেস্ট হাউজের পথে হাটা ধরি। গেটের মুখে আসতেই দেখি আমার অন্যতম প্রিয় বন্ধু হাসান বাযাযো তার শিশুকন্যা আয়েশাকে নিয়ে উপস্থিত। হাসান ফিলিস্তীনের গাযার বাসিন্দা। ইসলামাবাদ থেকে আমার ফিরে আসার বছরখানিক পূর্বে সে ‘আক্বীদা ও দর্শন’ বিভাগে পিএইচডির জন্য আসে এবং আমার হোস্টেলের তৃতীয় তলায় সীট পায়। সালাফী আক্বীদার হওয়ায় তার সাথে আমার দ্রুতই আলাদা সম্পর্ক তৈরী হয়। সেই থেকে সে আমার কেবল প্রিয় বন্ধুই নয়, ছায়াসঙ্গী। একসাথেই আমরা প্রতিদিন বিকালে মাসজিদুত তাওহীদে ড. সুহায়েল হাসানের কাছে ছহীহ বুখারী ও মুসলিম পড়তে যেতাম। হোস্টেল থেকে বের হ’লে যেখানেই যাই না কেন, সে ছিল আমার অপরিহার্য সঙ্গী। ওকে কেন্দ্র করে আমাদের একটা চমৎকার মিশ্র সার্কেলও তৈরী হয়ে যায়। এতে ছিলাম আমি বাংলাদেশী, হাসান বাযাযো ফিলিস্তীনী, মুতাওয়াক্কিল মুহাম্মাদ ইয়ামানী এবং আব্দুল্লাহ খাল্লুফ সিরীয়। এরা প্রত্যেকেই একেকজন ইতিহাস ও সংস্কৃতির ভান্ডার। প্রত্যেকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রতিনিধি। এদের মাধ্যমে আরবী ভাষার বিভিন্ন কথ্যরূপের সাথে যেমন আমার পরিচয় ঘটেছে, তেমনি বহু পদের আরবী খাবারের স্বাদ গ্রহণের অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাছাড়া ধর্ম, ইতিহাস, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ক আলোচনায় কত যে চিন্তার খোরাক পেয়েছি, তা বলে শেষ করার মত নয়। এজন্য এদের কাছে আমি অনেক ঋণী। শেষ বছরটা তো আমার প্রায় এদের সাথেই কেটেছে। যখনই আমরা হোস্টেল থেকে একসাথে বাইরে বের হতাম অনেকে অবাক হ’ত যে, চারদেশের চারজনের মধ্যে এমন প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয় কি করে?
যাইহোক হাসানের সাথে দীর্ঘ কোলাকুলির পর রুমে গিয়ে বসলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও বন্ধু-বান্ধবদের সব খোঁজখবর ওর কাছ থেকে নিলাম। মজা পেলাম যে, অশুদ্ধ ভঙ্গিতে এতদিনে সে বেশ ভালই উর্দূ বলা শিখেছে। গত মাসে ওর পরিবারকে মিসর হয়ে পাকিস্তান নিয়ে এসেছে। একটা বাসাও নিয়েছে। রাতে আমরা একসাথেই খেলাম। এসময় নাইজেরীয় বন্ধু আব্দুল্লাহও এল। সে শরী‘আহ বিভাগ থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে দেশে ফেরার প্রস্ত্ততি নিচ্ছে। রাতের খাবারের পূর্বে গেস্ট হাউজে দাওয়াহ একাডেমী পরিচালক ড. তাহের মাহমূদ এলেন এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আগত গবেষকদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হলেন। এসময় ড. হাম্মাদ লাখভীর সাথে পরিচয় হ’ল, যিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ডীন এবং পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ আহলেহাদীছ বংশ লাখভী পরিবারের সন্তান। এছাড়া সবার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখলেন আল্লাহ ইহসান এলাহী যহীরের ভাই ড. ফযলে এলাহী এবং লন্ডনের শরী‘আহ কাউন্সিলের সেক্রেটারী ড. ছুহায়েব হাসান। ড. ফযলে এলাহী বরাবরই থেমে থেমে অত্যন্ত তাক্বওয়াপূর্ণ হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য রাখেন। আজও তার ব্যতিক্রম হ’ল না। বিশেষ করে দাঈদের ইখলাছের প্রয়োজনীয়তার উপর তিনি নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন। ড. ছুহায়েব হাসানের সাথে এর আগেও দেখা হয়েছে। লন্ডনে থাকেন বলে ইংরেজীতেই দাওয়াতী কাজ করে থাকেন। কিন্তু তিনি যে মাশাআল্লাহ এত সাবলীল আরবী জানেন, তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। লন্ডনে দাওয়াতী কাজ করতে গিয়ে সফলতা লাভের কয়েকটি ঘটনা আরবীতে ব্যক্ত করলেন। এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি যে তিনি অনারব। বরং আরবদের চেয়েও বিশুদ্ধ ও বহতা নদীর মত স্বচ্ছন্দ আরবী বললেন। তাঁর ছোটভাই ড. সুহায়েল হাসানের নিয়মিত ছাত্র ছিলাম। ক্লাসে তাঁর সাবলীল আরবীর মুগ্ধ শ্রোতা ছিলাম আমরা। কিন্তু আজ বুঝলাম ড. ছুহায়েব হাসান তাঁকেও বুঝি ছাড়িয়ে গেছেন। খাবার শেষে ড. ফযলে এলাহীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ হ’ল। অনেকদিন পর তাঁর সাথে দেখা। পড়াশোনার খোঁজখবর নিলেন আর বরাবরের মত তাক্বওয়া ও ইখলাছের নছীহত করতে ভুললেন না।
৩.
৪ই ফেব্রুয়ারী ২০১৯ বুধবার ফজর ছালাত পড়লাম ফয়ছাল মসজিদে। ফিরে এসে প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য কিছু প্রস্ত্ততি নিলাম। তারপর নাশতা সেরে মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমানের সাথে রওয়ানা হলাম প্রোগ্রামস্থল তথা ফয়ছাল মসজিদ কমপ্লেক্সের আল্লামা ইকবাল অডিটোরিয়ামের পথে। সকাল ৯টা থেকে কনফারেন্স শুরু হবে। তার পূর্বে ব্যাগসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র ধরিয়ে দেয়া হ’ল। পাকিস্তানসহ ১২টি দেশের মোট ৭২জন গবেষক এসেছেন। ফলে একই সাথে তিনটি অডিটোরিয়ামে কনফারেন্স চলছে। ২ দিন ব্যাপী মোট আটটি অধিবেশন হবে প্রতিটি অডিটোরিয়ামে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কী-নোট স্পিকার হিসাবে বক্তব্য রাখলেন ড. হাম্মাদ লাখভী। আল্লাহর পথে দাওয়াত ও আল্লাহর দাসত্বের মাঝে চমৎকার সমন্বয় টেনে তিনি বক্তব্য রাখলেন। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি ইসলামাবাদের সম্মানিত প্রেসিডেন্ট ড. আহমাদ ইউসুফ আদ-দুরাইভিশের সভাপতিত্বে উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন লন্ডনের ড. ছুহায়েব হাসান। তিনি দাওয়াতের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করলেন।
উদ্বোধনের পর মিটিং কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের সাথে বিদেশী ডেলিগেটদের পরিচিতি পর্ব হল। এখানে আরও একজন আলজেরীয় গবেষক প্রফেসর ফাতহী বুদফালাহর সাথে পরিচয় হল। তিনি আলজিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সাইন্স ফ্যাকাল্টির প্রফেসর এবং কুরআনের পান্ডুলিপি ও কিরাআত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। মধ্যএশিয়া ও আরবের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি কুরআনের প্রাচীন পান্ডুলিপির অনুসন্ধান করেন। এ বিষয়ে তাঁর বেশ কিছু গবেষণা প্রবন্ধ আছে। এই সম্মেলনে এসেছেন কারাগারে দাওয়াত প্রদানের গুরুত্ব ও পদ্ধতি সম্পর্কে চমৎকার একটি প্রবন্ধ নিয়ে। পরহেযগার ও হাসিখুশী এই মানুষটির সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভাল লাগল। পরিচয় পর্বের পর জানতে চাইলেন বাংলাদেশে কুরআনের প্রাচীন পান্ডুলিপি কিংবা ‘ইলমুল কিরাআত নিয়ে কোন গবেষণা হয় কি-না। কিংবা আমার সন্ধানে কুরআনের এমন পান্ডুলিপি আছে কি-না। বিশেষজ্ঞ গবেষক তো এমনই হওয়া চাই, যিনি সর্বত্র নিজ বিষয়ে মণি-মুক্তা কুড়ানোর সন্ধানে থাকবেন।
দুপুরে লাঞ্চ শেষে তৃতীয় অধিবেশনে ছিল আমার প্রবন্ধ উপস্থাপন। মজার ব্যাপার হ’ল, কাকতালীয়ভাবে এই অধিবেশনেরই সভাপতি ছিলেন আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ শিক্ষক ও দাওয়াহ একাডেমীর সাবেক পরিচালক ড. সুহায়েল হাসান। আবার প্রধান অতিথি ছিলেন পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ আহলেহাদীছ ক্বারী জনাব ছুহায়েব আহমাদ মীর মুহাম্মাদী। সুতরাং তাদের সাথে মঞ্চ শেয়ার করার অভিজ্ঞতাটা স্মরণীয় ছিল। বাংলাদেশের ড. মুহাম্মাদ রফীকুল ইসলাম ও নাইজেরিয়ার উছমান বিন ফাওদা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ঈসা মুহাম্মাদ মিশানুর পর আমার পালা আসল। মাত্র ১০ মিনিটে প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ উল্লেখ করতে হবে। প্রজেক্টরে পাওয়ার পয়েন্ট সলাইড উপস্থাপন করে প্রায় যথাসময়েই শেষ করতে পারলাম আলহামদুলিল্লাহ। কিছুটা ভয়ে ছিলাম এজন্য যে, আমার শিক্ষক ও এমএস-এর সুপারভাইজার প্রফেসর ড. ফাতহুর রহমান কুরেশী শ্রোতাদের কাতারে বসে বক্তব্য শ্রবণ করছিলেন। উছূলে হাদীছের উপর তাঁর অগাধ জ্ঞান। হাদীছ বিভাগের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। সুদানী এই উসতাযকে আমরা সবসময়ই খুব ভয় পেয়ে এসেছি। উনার সামনে কোন ভুল করার অবকাশ নেই। প্রতিটি জিনিস খুব সুক্ষ্মভাবে দেখেন। সামান্য উনিশ-বিশ হলে আর রেহাই নেই। তবে আমার প্রতি তাঁর একটা আস্থা ছিল বলে এমএস থিসিসটা নিয়ে বড় কোন পরীক্ষায় পড়তে হয়নি আলহামদুলিল্লাহ। এমনও রেকর্ড আছে যে, তাঁর মনঃপুত না হওয়ায় অনেক ছাত্রের থিসিস বছরের পর বছর আটকে রেখেছেন। মঞ্চে থাকা ক্বারী ছুহায়েব আহমাদ আহলেহাদীছ মানুষ। তাই বাংলাদেশের আহলেহাদীছদের সম্পর্কে তাঁর বিশেষ আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। বক্তব্য শেষে চেয়ারে বসতে কানের কাছে এসে ধন্যবাদ দিয়ে দো‘আ করলেন। পরে অনেকেই মূল প্রবন্ধটির কপি চাইলেন এবং বাংলাদেশে সালাফী আন্দোলনের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলেন। অনেকে বাংলাদেশে এত সালাফী আছে জেনে খুশী প্রকাশ করলেন। আহলেহাদীছ আন্দোলনকে এমন একটি আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে উপস্থাপন করতে পেরে সত্যিই তৃপ্তি বোধ করলাম। আজীবনের জন্য একটা স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হ’ল আলহামদুলিল্লাহ।
সেদিন বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত কনফারেন্স চলল। দাওয়াতের উপর নানামুখী গবেষণাধর্মী চিন্তাধারায় ঋদ্ধ হলাম। বিশেষ করে আধুনিক ইসলামী সংগঠনগুলোর দাওয়াতী পদ্ধতিসমূহ ও তার কার্যকারিতা এবং বিবিধ সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে গবেষকগণ যেসব পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করলেন তা যথেষ্ট ভাবনার খোরাক যুগিয়েছে। কনফারেন্সের ফাঁকে ফাঁকে অনেক পরিচিতজনের সাথে সাক্ষাৎ হ’ল। অনেকেই ভেবেছেন আমি বোধহয় এখনো ইসলামাবাদে আছি। এতদিন কোথায় ছিলাম, এই প্রশ্নে যখন জানলেন যে দেশে ফিরে গিয়েছি, তখন চা-নাশতার তোড়জোড় শুরু করলেন। ইসলামিক ইউনিভার্সিটির হাদীছ বিভাগের শিক্ষক ড. আব্দুস সামাদ ভাই ও রিফাহ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক বন্ধুবর ড. মুহাম্মাদ তাহির ভাই তাঁর বাসায় দাওয়াত দিলেন। একসময় দেখে আসলাম কনফারেন্স হলের ২য় তলায় ইসলামাবাদে আমার প্রিয়তম স্থান হামীদুল্লাহ লাইব্রেরীতে। যে চেয়ার-টেবিলে নিয়মিত বসতাম সেখানে গিয়ে ক্ষণিকের জন্য স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম। লাইব্রেরীর পরিচালক ড. সাজিদ মির্জাসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাক্ষাৎ হল। তাঁরা অনেকদিন পর আমাকে দেখে খুব খুশী হলেন। কনফারেন্স শেষে সে রাতটি গেষ্ট হাউজেই কাটালাম।
(চলবে)