আমার শ্রেষ্ঠ মা
আব্দুল কাদের
ছায়া
ঢাকা, পাখি ঢাকা নয়নাভিরাম প্রশান্ত এক গ্রাম। সেটির নাম ফুলসারা। চারিদিক
সবুজে ঘেরা। গ্রামের বাইরে ফাঁকা দিগন্তজোড়া বিস্তীর্ণ মাঠ-প্রান্তর।
প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং দেড় কিলোমিটার প্রস্থ এই গ্রামের উত্তরে
মহাসড়ক আর দক্ষিণে এলাকার অতি পরিচিত ঐতিহ্যবাহী বিশাল এ্যাড়লের বিল। কথিত
আছে এই বিলের ৩শ’ ৬০টি মৌজার জমির মালিকানা আছে। কত মাছ ধরা, কত পাখির
বিচরণ, কত ঢেউ খেলানো ধান ক্ষেত, কত রূপকথার গল্প লুকিয়ে আছে এই বিল; এই
এলাকা নিয়ে। এই গ্রামের বিল ও বিশাল ফাঁকা তেপান্তরের মাঠের পাশেই একটি
সরকারী প্রাইমারী স্কুল। গ্রামের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার হাতেখড়ি
এখানে। তাদেরই মধ্যে সোহাগ একটি ছেলে। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা আর
স্কুলে টিফিনের সময় ক্ষেতে জন্মানো চৈত্র মাসের ছোলা হুড়া (পোড়ানো) করে এক
সাথে শিক্ষক-ছাত্রদের খাবার দৃশ্য ছিল তখনকার নিত্যদিনের উপভোগ্য দৃশ্য।
বিকেলে খেলার পর আবার শীতের খেজুরের ‘সন্ধ্যে রস’ খাবারের স্বাদ যেন এখনো
ভোলা যায় না। সেই রস এখন আর পাওয়া যায় না। কথায় বলে ‘যশোরের যশ, খেজুরের
রস’। হ্যাঁ সেই খাঁটি রস, গুড়-পাটালি এখন পাওয়া বড় দুষ্কর। চরকার মত ঘুরে
দু’একজনের কাছে যদিও পাওয়া যায়, তা আবার এক আধ সপ্তাহ আগেই পাড়া-পড়শির
মা-চাচী-ভাবীরা বুকিং দিয়ে রাখেন, ঢাকা অথবা বাইরের ছেলে-মেয়ে বা
আত্মীয়-স্বজনদের জন্য। এক ভাড় (৮/১০ লিটার) রসের দাম ২শ’ টাকা। আর খাঁটি
গুড়ের দাম ১৫০ থেকে ২০০/- টাকা। গ্রামের মানুষ হয়ত উপরে উঠে গাছ কাটাকে
অনেক কষ্ট মনে করেন। তারাও এখন অনেকটা সৌখিন হয়ে গেছে। আর যে কারণে খেজুরের
গাছও তেমন নেই। ইট ভাটায় সব খেয়ে নিচ্ছে। নতুন করে মানুষ আর খেঁজুর গাছও
লাগানো হচ্ছে না। সরকারী কোন উদ্যোগও নেই। এ দুঃখ মাতৃভূমি ও গ্রামীন
মানুষের।
উপযেলার একমাত্র আদর্শ এ গ্রামটি ছিল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধের কবলে পতিত এক ঐতিহাসিক স্থান। হাজী রইচ উদ্দীন দফাদারের বাড়িতে সে সময় যুদ্ধে বিভৎস চিত্রের আংশিক রূপ দেখা যায়। তিনি ছিলেন এলাকার শ্রেষ্ঠ ধনী, জ্ঞানী এবং সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের অধিকারী ব্যক্তিত্ব। এ এলাকায় খান বাহিনী প্রায় বাড়ি-ঘরে হামলা দিত কোন হিন্দু এবং পাকিস্তান বিরোধী কেউ আছে কিনা। পেলে রেহাই নেই। একদিন সোহাগ তার সেজো ভাইয়ের সাথে পাশের পট-শেওলায় ভরা পুকুরে খানদের ভয়ে কোন রকম নাক-চোখ ঢেকে লুকিয়ে ছিল। তখন এর পাশের বাঁশঝাড়ে একটি গুলির শব্দ। পরে সে জানতে পারে একজন হিন্দু ফকিরকে তারা মেরে ফেলেছে। একদিন দেখা গেল তার বাড়িতে অগ্নিকুন্ডের লেলিহান শিখা। হাজী ছাহেবের বিশাল দালান বাড়ির পশ্চিম পাশের মজবুত ১৫ ইঞ্চি ইটের শক্ত দেয়াল ভেদ করে গুলির আঘাতে বিশাল ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ভাগ্যিস সেল বা গুলি কারও গায়ে পড়েনি। সে সময় ঘরে কেউ থাকলে নির্ঘাত মৃত্যু। এসব গুলি এসেছে ইন্ডিয়ান সীমান্ত থেকে। সম্ভবতঃ খান বাহিনীদের লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছিল। মুহূর্তে হাজী ছাহেবের ১ গোলা ধান, ১ গোলা নারিকেল গোলার আঘাতের আগুনে দাউ দাউ করে শেষ হয়ে যায়। শোনা গেল হাজী ছাহেবের ছেলে মমতাজউদ্দীন এবং ওপাড়ার আহমাদ আলীকে খানেরা (মুক্তিযোদ্ধা ভেবে) মোর্চের মধ্যে (কবরাকৃতি) চোখ ও হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখেছে। ওদেরকে গুলি করে মেরে ফেলার অর্ডার হয়ে গেছে। ঠিক সে সময় চৌগাছা এলাকার স্থানীয় কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তির প্রচেষ্টায় আল্লাহ তাদের প্রাণ রক্ষা করলেন। যুদ্ধ শেষ ১৬ ডিসেম্বর।
হ্যাঁ, এরকম একটি গ্রাম, একটি পরিবেশ, একটি পরিবারে জন্ম সোহাগের। বাবা-মায়ের অনেক সন্তানের মধ্যে সবার ছোট। তাই তার বাবা-মা-মামারা নাম রাখেন সোহাগ। সোহাগ তার মায়ের পাশে থেকে মায়ের আদেশে চলাফেরা করত। চারিদিকে ঘন বনে জঙ্গলে আচ্ছাদিত সবুজ তাদের গ্রামটি। গেয়ো মেঠো পথ দিয়ে সে ফুফু বাড়িতে যখন বেড়াতে যেত তখন পরাস্ত খান বাহিনীদের ফেলে রাখা ট্যাংকগুলোর ভিতর প্রবেশ করে ট্যাংক চালকের আসনে বসে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে শুনে তার পিঠাপিঠি ভাইদের সাথে ফুফুবাড়ি বেড়াতে যেত। সবুজে ভরা গ্রাম্য মাঠ-প্রান্তর পেরিয়ে এগুলো খেলনার মত আবার নাড়িয়ে চড়িয়ে দেখত এবং গুলির সেলগুলো ক্ষেত থেকে কুড়িয়ে সে বাড়ি ফিরত। সে বুঝতো না আসলে প্রকৃত রহস্যটা কি? শুধু সে জানে একটি যুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু সে জানে না স্বাধীন দেশে ভাল মানুষগুলো এখনও স্বাধীন কি-না।
শিশুকাল গ্রামের প্রাইমারী, অতঃপর চৌগাছা শাহাদাত বহুমুখী পাইলট স্কুলে তার বড় ভাই ভর্তি করিয়ে দেন। এটা সোহাগের এক নতুন পরিবেশ। প্রায় ৬/৭শ’ ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে শুরু হয় তার আর নতুন যাত্রা। হানাফী ঘরে জন্ম তার। ইসলামের সবদিক অতকিছু সে বুঝে না। তাই নানা অপসংস্কৃতিতে বেড়ে উঠা শিশুটা। শিশুকালে তার শিক্ষকগণ স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারী, ১লা বৈশাখ, আর অনেক কিছু (সরকারী নিয়মে) কিভাবে পালন করতে হয় তা শিখিয়েছেন। হাইস্কুলে এখন এসব তো মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সোহাগ খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়মিত যোগদান করত। সারা থানার আন্তঃপ্রাইমারী ব্যাটমিন্টন প্রতিযোগিতায় তারা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একবার রানার্সআপ হয়ে ২য় স্থান করেছিল। তবে এখন খেলাধূলার মাতামাতি খুব বেশী। ছেলেরা খেলাধূলা বিশেষ করে ক্রিকেট ও মোবাইল নেশায় মত্ত হয়ে পড়ালেখায় পিছিয়ে যাচ্ছে। সোহাগ ছোটবেলায় মায়ের আদেশে ছাগল পালন করত। মাঝে-মধ্যে একাকী নির্জন দোসামানার মাঠের প্রান্তে এ্যাড়লের বিলের দিগন্তে ছাগলগুলো ছেড়ে দিয়ে সে বলত- যা তোরা এখন স্বাধীন। যা ইচ্ছে তা খেয়ে বেড়া। আর সে সাথে হয়ত কখনও একটি বইকে খেলার সঙ্গী বানাতো অথবা ছাগলের নাম ধরে ডাকাডাকি করত। তবে সাবধান থাকত যাতে অন্যের ক্ষেতের ফসল কোন ছাগলে না খায়। সে এরই ফাঁকে তাদের এবং মানুষের ক্ষেত থেকে পটকা ঘাস উঠাত। কখনও মায়ের জন্য টাটকা ভেতো শাক তুলে নিত। এর মধ্যে থেকে সে সহিষ্ণুতা ও ধৈর্য্যশীলতার কিছু গুণাবলী হয়ত অর্জন করেছিল। তবে এটা সত্য যে, অধিকাংশ নবী-রাসূলগণ মেষ চরিয়েছেন, যা সে পরে জেনেছিল। তাতে করে বুঝা গেল মায়ের আদেশ মেনে চলে ছোটকালে তার লাভ ছাড়া কোন ক্ষতি হয়নি। সে নিয়মিত হাইস্কুলে ক্লাস শুরুর আগে এ্যাসেম্বলিতে অংশ নিত। এতে অংশ নেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। প্রথমে আল্লাহ ও সংবিধানের নামে শপথ নেয়া, অতঃপর রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন। সোহাগ ভাল সঙ্গীত গাইতে পারত। তাই তেজস্বী হেডস্যারের প্রকাশ্যে হাঁক ছিল- সোহাগ কই? আর রেহাই নেই। গান গাওয়ার ভয়ে সে পিছনের সারিতে লুকিয়ে থাকত। কিন্তু দুষ্ট বন্ধুরা ধরে নিয়ে যেত। অতঃপর সোহাগকে গাইতে হ’ত- ‘আমার সোনার বাংলা...’। ভাষা দিবসে ২১শে ফেব্রুয়ারীর গান বা কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে দেশাত্মবোধক সমবেত গান, বড় বড় অনুষ্ঠানে আধুনিক গান শহীদ মিনারে ফুল দিতে হ’ত; তাকে আরও জন্ম বার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান করতে হ’ত। কিন্তু অবুঝ ছেলে সোহাগ ততটা বুঝত না সে কি করছে?
সোহাগের স্কুল ছিল কপোতাক্ষ নদের তীরে। এখানে একটি ‘ডাক বাংলা’ যা স্কুলের তত্ত্বাবধানে ছিল। এটা ছিল যশোরের সবচেয়ে উঁচু এবং নামকরা পিকনিক স্পট। সোহাগ কখনও একাকী, কখনও বন্ধুদের সাথে টিফিনে বা ক্লাসের ফাঁকে খেলত অথবা আড্ডা দিত। আর মাইকেল মধুসুধন রচিত সেই ‘কপোতাক্ষ নদে’র স্রোতস্বীনী ধারা প্রত্যক্ষ করত। নদের সুন্দর দৃশ্যগুলো, গ্রামের মানুষের গোসল-সাতার কাটা, মাছ ধরার দৃশ্য মনকে ভরিয়ে দিত। কিন্তু সেদিনের ভরা যৌবনপ্রাপ্ত কপোতাক্ষের সেই চেহারা এখন আর নেই। চৈত্র মাস এলে এপার-ওপার হেঁটে পার হওয়া যায়। তখনকার মত আর বিশালকায় শৈল মাছ, বোয়াল মাছ, রুই-কাতল আর শিং-মাগুর এখন আর পাওয়া যায় না। যাবে কেন? ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা সকল পানির উৎস যে ওরা বন্ধ করে দিয়েছে। হায়রে কপোতাক্ষ, বড় দুঃখ লাগে।
সোহাগ গ্রামের সহপাঠিদের সাথে প্রায় প্রতি বছর বলু দেওয়ানের বাজারে যেত। সেখানে বিশাল মেলা বসে। এ ব্যক্তি নাকি পীর ছিল। তিনি এই কপোতাক্ষ নদের ওপর দিয়ে (নদ সৃষ্টির আগে) এক রাতে ঘোড়া দিয়ে চলতে চলতে পিছন দিকে নদীর সৃষ্টি হয়- যা মানুষের মুখে মুখে শুনা যায়। চলার শেষে চৌগাছার প্রত্যন্ত বলু নারায়ণপুর দেওয়ানপাড়া এলাকায় অবস্থান করে। সেখানে প্রতি বছর ওরশ ও মেলা বসে। সেখানে স্কুল জীবনে সোহাগ দেখত বলুর মাযারে হাঁস-মুরগী, ছাগল, ভেড়া মানত করছে। তারা পীরের নামে মানত করে যার যার মনোষ্কামনা পূরণ করত। তবে সোহাগ এগুলোকে লৌকিকতা মনে করত। সোহাগের বাড়ি এবং আশে পাশে দেখত গরুর গোয়ালে জুতা ঝুলিয়ে রাখতে, যাতে গরুর অসুখ না হয়। লাউ বা মিষ্টি কুমড়ার গাছে মরা গরুর মাথা বাঁশ দিয়ে ঝুলিয়ে রাখত যাতে ফল ভাল হয়। সোহাগের মনে পড়ে তার বাড়ির মাইনদার কেসমত এ্যাড়লের বিলের মাঝে যে সন্ন্যাসীতলা আছে অসুখ সারার নামে সেখানে মাটি দিয়ে কি যেন করত। সোহাগ তার মৃত দাদা এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের খানাতে বা চল্লিশাতে অংশ নিত। পদ্মপাতায় সে কি খাওয়া-দাওয়ার ধুম। অথচ সে পরে বুঝে এগুলো ইসলামে নেই।
এভাবে নানা অপসংস্কৃতি ও শিরক-বিদ‘আতের পরিমন্ডল পেরিয়ে কৃতিত্বের সাথে এস.এস.সি পাশ করে নামী-দামী কলেজে পা বাড়ায়। সে সেখানেও নানা অপসংস্কৃতি এবং অনৈসলামিক শিক্ষার বেড়াজালে পড়ে যায়। যেমন প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসের সামনে যেতে হলে সকল ছেলে-মেয়েকে দূর থেকে হাত তুলে স্যালুট দিতে হ’ত। শিক্ষক আসলে সকলকে দাঁড়াতে হত। ক্যান্টনমেন্ট কলেজটি আর্মি কালচারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিচালনা হত। নবীনবরণ আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে যা হবার তা-ই হ’ত।
এবার তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু। সেখানে আর এক জগত। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এবং শিক্ষা-সংস্কৃতি সোহাগকে মাঝে মধ্যে ভাবিয়ে তুলত। সোহাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে কেবল উচ্চশিক্ষার জন্য। তবে এখানকার শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন কিছু ভাল দিক রয়েছে অন্যদিকে রয়েছে বিপথগামিতা। সেখানে রয়েছে ছেলে-মেয়েদের অবাধ চলাফেরা আর মেলামেশা। স্বাধীনতার নামে অভিভাবকগণ তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন। শিক্ষাঙ্গনে যেন তাদের চিন্তার কোন কারণ নেই (?)। কিন্তু বাস্তবে সেখানকার পরিবেশ যে কত ভয়াবহ তার হিসাব পরিসংখ্যান নাইবা দেয়া হ’ল। শুধু বলা যায়, সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাটা হল অনৈসলামিক। নাটক-সিনেমা, গান-বাজনা, আনন্দ-ফুর্তির নামে বেলেল্লেপনা যেন উন্মুক্ত পথের সঙ্গী। এরই পাশাপাশি চলছে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির হিংস্র ছোঁয়া। সীট দখল, হল দখল, ডাইনিং-এ ফ্রি খাওয়া, মেয়েদেরকে ছেলেদের হলে প্রবেশাধিকারের প্রতিযোগিতা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দলবাজি ভর্তি, নিয়োগ-বাণিজ্য সবগুলো নিয়ে সোহাগ থমকে যায়। সে ভাবে এ কোথায় এলাম! তবে সে ঐ পথগুলোতে না গিয়ে সামাজিক কর্মকান্ডের পথ খুঁজে। একদিন সোহাগ প্রেসক্লাবের মেম্বার হয় ও পাঠক ফোরামের সদস্য হয়। একবার সে পাঠক ফোরামের পক্ষ থেকে বগুড়া নট্রামসে শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রী সহ শিক্ষাসফরে যায়। প্রফেসর সোহরাব স্যার সঙ্গে ছিলেন। ঘুরেফিরে দেখাশোনা, খাওয়া-দাওয়া ভাল হ’ল। তবে এবার শুরু হল স্টেজে ধাড়ি ধাড়ি মেয়েদের নাচ-গানের অনুষ্ঠান। এটাই কি শিক্ষাসফরের উপহার! সোহাগ হল থেকে বেরিয়ে একদিকে চলে যায়। রাত ১২.১ মিনিটে শহীদ দিবস। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস এসেছে। এবার বড় ভাইদের পক্ষ থেকে আদেশ আসত- ফুল দিতে হবে। কি আর করা। যেতে হবেই। সে ভাবত আমি কি কেবল এসব করতেই এসেছি। হলেও সে দেখেছে পড়াশোনার প্রতিকুল পরিবেশ। যাক তবুও সোহাগকে নিয়মিত মসজিদে যেতেই হবে। সেখানেও সমস্যা! দেশে ইসলামের নামে কত শত তরীকা যে আছে কোনটাকে সে মানবে। বিষয়টি তাকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলত। এতদূর এসেও তাকে কোন ছাত্র বা দলের মিছিলে অংশ নিতে হয়নি। এদিকে সে যথেষ্ট নিরাপদে থেকেছে। তাদের হলে একদিকে তাবলীগ জামাআতের পদচারণা, অন্যদিকে ছাত্রশিবিরের দৌরাত্ম, কখনও ছাত্রদল তো কখনওবা লীগ। সকলে তাকে যেন হাতছানি দিয়ে নিজ দলে ভিড়াতে চায়। কিন্তু তা কেউ পারে না। কোথায় গেলে সে সঠিকটা পাবে?
কলেজ লাইফে (১৯৮৬-৮৭) একবার তার গ্রামের মসজিদে তাবলীগ জামাআতের লোক শোনাচ্ছিল কেউ যদি আল্লাহর রাস্তায় দু’রাকাআত নফল ছালাত পড়ে তাহ’লে ৪৯ কোটি রাকাআতের নেকী পাবে এবং আল্লাহর রাস্তায় ১ টাকা ব্যয় করলে ৭ লক্ষ নেকী হবে। সোহাগের কথাগুলো মনে গেঁথে যায়। তাই তো পরদিন থেকেই তাদের সাথে গ্রামে দাওয়াতের কাজ শুরু করে। সেভাবে এত সহজ এবং সস্তায় এত নেকী? একদিন মসজিদে চরমোনাই পীর ছাহেবের মুরীদদের যিকির হবে। পাড়া-পড়শিরা তাকে থাকতে বললেন এবং তারা বলেন, ঐ যিকিরে অংশ নিলে তোমার কলব পরিস্কার হয়ে যাবে এবং তখন আল্লাহ তোমার উপর খুশী হয়ে জান্নাতে দিবে। মাগরিব পর সকলের মাঝে সে বসল। দু’একজন তাকে শিখিয়ে দিল- বাম হাত ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির মাথা এবং ডান হাত দিয়ে বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির মাথা শক্ত করে চেপে ধরে যিকির করতে হবে। যিকিরের ভাষা আল্লাহ আল্লাহ...ইল্লাল্লাহ, ইল্লাল্লাহ। হিল্লাল্লাহ হিল্লাল্লাহ অতঃপর হু হু শব্দ উচ্চারণ এবং এক পর্যায়ে অনেকে লাফ-ঝাপ শুরু করে পাগল হয়ে গেল। সোহাগ যিকির শেষে মুরীদদের বলে এ আবার কেমন সিস্টেম তোমাদের? এটাও তার ভাল লাগল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একবার তাবলীগের বড় ভাইয়েরা বলেন, চল চিল্লাতে যাই। তার আগে মারকাযে যেতে হবে তিন দিনের জন্য। এরই মধ্যে হঠাৎ সোহাগ বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘের দাওয়াত পায়। তাদের কথা সোহাড়ের বেশ ভালই লাগে। তবে সোহাগ ভাবে, ‘এ আবার কোন দল? আমি কোন দিকে যাই’। আল্লাহর কাছে সে সাহায্য চাই আর বলে হে আল্লাহ! তুমি আমাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দাও। সে সময় ড. গালিব এবং অন্যান্য কয়েকজন লেখকের কয়েকটি বই পড়ে তার মাথা আরও ঘুরে গেল। কিন্তু না, সে এখানে কিছু পেয়েছে মনে করে। শুরু হলো সোহাগের জীবনের আরেক সংগ্রামের ইতিহাস। সে ইতিহাস ছিল সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাইয়ের ইতিহাস। অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসার ইতিহাস। পরকালে মুক্তিলাভের জন্য সরল-সঠিক রাস্তা পাবার দুর্গম পথ পাড়ির ইতিহাস। দীর্ঘদিন পড়ালেখা ও জানা বুঝার পর সোহাগ বুঝল, ‘যুবসংঘ’ যে দাওয়াতী মিশন চালিয়ে যাচ্ছে এটাই সত্যের নিকটবর্তী। তবে ইতিপূর্বে সোহাগের ভীষণ ইচ্ছে ছিল ‘টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা’ দেখার। ছোট কাল হ’তে অনেকে বলে আসছে, কিন্তু সোহাগের তা হয়ে উঠেনি।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় লাইফের পূর্বের তাবলীগী ভাইদের কথা এখানেও সে শুনতে পায় যে দু’রাকা‘আত নফল ছালাতের বিনিময়ে ৪৯ কোটি রাকাআতের ছালাত এবং এক লক্ষের বিনিময়ে ৭ লক্ষ টাকা ছওয়াবের কথা। তাবলীগের বড় ভাইদের কথা অনুযায়ী সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হলে প্রফেসর (প্রয়াত) ড. মশফিকুর রহমানের নিকট উক্ত প্রশ্নের উত্তর চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এর উত্তর দিতে পারব না’। রাজশাহী তাবলীগের মারকাযে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে সোহাগ ৩ দিন কাটালো। ভরা মজলিসে সোহাগ প্রশ্ন করল এবং এর সঠিক দলীল জানতে চাইল। রাজশাহী কলেজের সেই প্রফেসর বললেন, এর উত্তর নিতে হলে ঢাকার কাকরাইলে যেতে হবে। সোহাগ নাছোড়বান্দা। একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুজিব হলে কিছুদিন এক বন্ধুর রুমে ছিল। সেখানে মতিউর রহমান নামে আইনের এক ছাত্রের সাথে তাবলীগের কেন্দ্রীয় মারকায কাকরাইলে যায়। সেখানে সে তিন দিন সময় লাগায়। সোহাগ তার সেই প্রশ্নটির উত্তর মারকাযে বড় মুরুববীর কাছে জানতে চায়। সেভাবে এবার হয়ত সঠিক দলীল সহ উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু না, তিনি বললেন, ভারতের বড় মুরববী ছাড়া এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমরা দিতে পারব না। সোহাগ বলে, হায়রে কপাল! এ প্রশ্নের উত্তর জানতে আর কত বছর? কত দূর আমাকে যেতে হবে? তাহলে শেষমেষ আমাকে কি দিল্লী যেতে হবে? এভাবে তার যেন অন্ধকার আর কাটে না। কখন সে আলোর সন্ধান পাবে। এর মধ্যে এক বন্ধু আব্দুর রবের সাথে সে রাজশাহীর নওদাপাড়ায় আহলেহাদীছের এক ইজতেমায় অংশ নেয়। সোহাগের খুব ভাল লাগে ঐ ইজতেমা এবং অনেক প্রশ্নের জবাব সে পেয়ে যায়। সে বলে, ভাগ্য ভাল! আমাকে আর টঙ্গীর ইজতেমায় যাওয়া লাগল না। তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এখন সে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারীর শেষ দিকে ঐ তাবলীগী ইজতেমায় যায়। সে আল্লাহর কাছে তওবা করে।
আলহামদুলিল্লাহ! সোহাগ প্রকৃত দ্বীনের সন্ধান পেয়ে যায়। তার জীবন চলার সঠিক রাস্তা পেয়ে যায়। সে পেয়ে যায় অন্ধকার থেকে আলোর পথ। এখন সোহাগ ভাবে এ দেশে আমার মত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বত্র ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে? কীভাবে তাদের মাথা-মগজ-মন ধোলাই করা হচ্ছে! কীভাবে তাদের ইহকাল-পরকালকে ধ্বংস করা হচ্ছে! যে শিক্ষা সমাজেরও কোন উপকারে আসছে না; আবার শিরক-বিদ‘আতী এই অনৈসলামী শিক্ষা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলমান দেশে অন্তত কখনও মানায় না। এর পরিবর্তন হওয়া খুব যরূরী। সে দেশের সকল ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণ-যুবকদেরকে এই প্লাটফর্মে আনার এবং জীবনকে ইসলামের নির্ভেজাল তাওহীদের পথে ঢেলে সাজানোর আহবান জানায়। সোহাগ নিজেকে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণের এই পথকে জান্নাত পাওয়ার রাস্তা মনে করে। সোহাগের এখন দিবানিশি স্বপ্ন কিভাবে সে পরকালে জান্নাতে যাবে, আর কিভাবে সে তার চারিপাশের মানুষগুলো জান্নাতের পথে পরিচালিত করবে।