ভারত উপমহাদেশে হাদীছের ধারক ও বাহকগণ
ড. নূরুল ইসলাম
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 10818 বার পঠিত
৩১শে ডিসেম্বর ২০১৯।
চীনের উহানে আবির্ভূত হওয়া এক ভাইরাসের অপ্রতিরোধ্য যাত্রা শুরু হওয়ার পর
কেটে গেল একে একে চারটি মাস। নানা জল্পনা-কল্পনার এক ঘোরলাগা প্রহর
অতিক্রান্ত হ’তে না হ’তেই বিশ্ববাসী দেখতে পেল এক অদৃশ্য মহাশত্রুর হাতে
কিভাবে একে একে পর্যুদস্ত হচ্ছে বিশ্বের বাঘা বাঘা শক্তিধর দেশগুলো। এ এক
অকল্পনীয় দৃশ্য। অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা কোনকিছুই এই শত্রুর মোকাবিলায় কাজে
আসছে না। পারমানবিক অস্ত্রেরও ক্ষমতা নেই এই সুক্ষ্ম, চোখে না দেখা শত্রুকে
ঠেকাবার। ক্ষমতার গর্বে, বিত্তের অহংকারে স্ফীত হয়ে যেসব দেশ বিশ্বব্যাপী
অন্যায়ভাবে ছড়ি ঘোরাতো, তারা আজ অসহায় হয়ে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ছুটছে
একটুখানি আশ্রয়ের আশায়। এ এমন এক শত্রু যার ভয়ে ভীত হয়ে সারাবিশ্বের
দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ আজ গৃহবন্দী। আসমানে বিমান উড়ে না, যমীনে গাড়ি-ঘোড়া চলে
না। রাস্তার মোড়ে জটলা নেই। খেলার মাঠে শিশু-কিশোরদের কোলাহল নেই।
হাসপাতাল রোগীশূন্য। আদালত আসামীশূন্য। রাস্তাঘাট জনশূন্য। হাট-বাজার
ক্রেতা-বিক্রেতাশূন্য। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা শিক্ষক-
শিক্ষার্থীশূন্য। স্টেশন-বিমানবন্দর যাত্রীশূন্য। কল-কারখানা শ্রমিকশূন্য।
মসজিদ মুছাল্লীশূন্য। হারামাইন হাজীশূন্য। সিনেমা হল, রেস্তোরা, পার্ক,
স্টেডিয়াম, পর্যটনকেন্দ্র কোথাও কেউ নেই। ভারত, কাশ্মীর, মিয়ানমার,
ফিলিস্তীন, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, আফগানিস্তানে প্রতিনিয়ত যারা নিত্যনতুন
অস্ত্রের পরীক্ষায় ব্যস্ত ছিল, লাখো-কোটি নিরীহ আদম সন্তানের প্রাণ সংহার
করে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি ঠেকানোর দায়িত্ব নিয়েছিল, তারা আজ কোথায় যেন
আত্মগোপনে গেছে।
এ এমন এক ভয়ংকর গোপন আততায়ী যার হিম আতংকে অসুস্থ রোগীর যত্নে কেউ এগিয়ে আসে না। একান্ত আপন স্বজনরাও বাড়িতে জায়গা দিতে চায় না। হাসপাতালে নিলেও খোঁজ নেয় না। মৃত্যু হলেও দাফন করে না। জানাযা হলেও উপস্থিত থাকে না। এ যেন কেয়ামত দিবসের সেই ভয়ংকর গা শিহরানো দৃশ্যপট মঞ্চায়িত হচ্ছে পৃথিবীতে, যেদিন মানুষ তার সহোদর ভাই থেকে পলায়ন করবে, মা-বাপ থেকে পলায়ন করবে, স্ত্রী-সন্তান থেকে পলায়ন করবে। প্রতিটি মানুষ সেদিন থাকবে স্ব স্ব বিপদ নিয়ে ব্যস্ত। সুবহানাল্লাহ! পবিত্র রামাযান মাস জুড়ে মুসলিম দেশগুলোতে চিরাচরিত সেই পারস্পারিক সৌহার্দের পবিত্র দৃশ্যগুলো অনুপস্থিত। নেই ইফতারের কোন উৎসবমুখর আয়োজন, নেই তারাবীতে মুছাল্লীদের সারি। দেখা হলে নেই সহজাত করমর্দন কিংবা কোলাকুলির দৃশ্য। কি ডাক্তার, কি সাধারণ মানুষ; কি নারী কি পুরুষ; কি মধ্যযুগীয় পশ্চাদপদ, কি আধুনিক; সবার মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস।
যে হিজাব আর নেকাব পরার জন্য মুসলিম নারীদের হেনস্থার শিকার হ’তে হ’ত, আজ তা পরিধান না করলেই হয় জরিমানা। পারিবারিক মিলনমেলা বন্ধ। বিবাহ-শাদী, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশ সবকিছু বন্ধ। অজানা আতংকে জগতজুড়ে কর্মচঞ্চল মানুষগুলো আজ স্রেফ ঘরবন্দী। কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন আর লকডাউনের ঘেরাটোপে গোটা মানব সমাজ নিমজ্জিত এক সীমাহীন স্থবিরতায়। এই দৃশ্যপটে ধনী-গরীব, আমীর- ফকীর কোন বাছ-বিচার নেই। সমগ্র বনু আদম আজ এক কাতারে।
প্রিয় পাঠক! ২০২০ সালের প্রথম সূর্য যেদিন উদিত হয়েছিল, সেদিন কারো মনে ঘুণাক্ষরেও এমন চিন্তুার উদ্রেক হয়েছিল? সেদিন কেউ যেমন কল্পনা করেনি পৃথিবীর এমনরূপ কখনও দেখতে হবে, ঠিক তার বিপরীতে এখন কল্পনাও করতে পারছে না যে আগামীর পৃথিবীর রূপ কেমন হবে। পৃথিবী কি আবার আগের রূপে ফিরে যাবে, নাকি নতুন রূপে নিজেকে সাজিয়ে নেবে? বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি কোন দিকে মোড় নেবে? এক অন্তহীন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাড়িয়ে গোটা মানবসমাজ।
সেই উত্তর হয়ত আমরা অচিরেই পাব, কিংবা দেরিতে। কিন্তু সময় এখন গভীরভাবে আত্মোপলব্ধির। জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাববার। ২০০১ সালের নাইন ইলেভেন যেমন বিশ্বব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সূচিত করেছিল, ২০২০ সালের করোনা ভাইরাস হয়ত তার চেয়ে বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে যাচ্ছে। এর কিছু নেতিবাচক দিক যেমন থাকবে, তেমনি কিছু থাকবে ইতিবাচক। নেতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম হ’ল- মানুষ হয়ত দিনে দিনে আরো অসামাজিক, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত, প্রযুক্তিনির্ভর জীব হয়ে পড়বে। আর রাষ্ট্রগুলো হয়ে পড়বে আরও বেশী জাতীয়তাবাদী ও আত্মকেন্দ্রিক। ফলে মানুষে মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্কগুলো হয়ে পড়বে শিথিল, উষ্ণতাহীন এবং নিরেট স্বার্থপ্রণোদিত। অপরদিকে ইতিবাচক দিকগুলো হ’ল, মানুষ হয়ত অর্থ আর ক্ষমতার মোহের পিছনে ছোটা থেকে কিছুটা হলেও পিছপা হবে। কেননা বিপদ যখন ঘনিয়ে আসে, তখন অর্থ আর ক্ষমতা যে কোনই কাজে আসে না, তা আমাদের চোখে আঙগুল দিয়ে দেখিয়েছে করোনা। ফলে অন্যায়, পাপাচার, হিংস্রতা, অর্থ ও ক্ষমতার প্রতি লোলুপতা, অন্যের বিনাশকামিতার মত ধ্বংসাত্মক চিন্তুা থেকে মানুষ বেরিয়ে এসে আরও মানবিক হওয়ার কথা ভাববে। সেই সাথে জীবন-জীবিকার ইঁদুর দৌঁড়ে পরিবার-পরিজনকে ভুলতে বসা মানুষ নিজেকে নিয়ে, পরিবার ও সমাজকে নিয়ে ভাবার সুযোগ পাবে। আর এভাবেই হয়ত জন্ম নেবে আগামীর পৃথিবীকে নতুন ভাবে গড়ে তোলার জন্য পরিচ্ছন্ন ও ইতিবাচক চিন্তাধারার। মানবসভ্যতার পুনর্বিনিমাণে যার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী যে যুগান্তকারী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তা আমাদের নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, এই পৃথিবীতে আমরা সামান্য একটি সৃষ্টি ব্যতীত কিছুই নই। পৃথিবীর পরিচালনায় একজন মহান সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন, যার সামান্য ইশারায় সবকিছু নিমিষে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। আসমান-যমীনের যিনি একচ্ছত্র মালিক, ফিরে যেতে হবে কেবল তাঁরই কাছে। করোনা আমাদের শিখিয়েছে, আমরা যতই নিজেদের বড় মনে করি, ক্ষমতাধর মনে করি, আইনের উর্ধ্বে মনে করি, আসল ক্ষমতার মালিক আল্লাহ। করোনা আমাদের শিখিয়েছে বস্ত্তগত উপকরণে আমরা যতই সমৃদ্ধ হই না কেন, কোন কিছুই আমাদেরকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়, কোনকিছু দিয়েই মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না, একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত।
অতএব সেই মহাশক্তিধর সত্তার কাছে ফিরে যাওয়ার প্রস্ত্ততি গ্রহণই আমাদের জীবনের পরমার্থ। বস্ত্ততঃ পৃথিবী ভাঙ্গা-গড়ার এই পরীক্ষা আল্লাহ এজন্যই নিয়ে থাকেন, যেন মানুষ তাঁর দিকে ফিরে আসে এবং তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ করে। অতএব করোনার এই বিপর্যয়কালে আসুন আমরা ধৈর্য ধারণ করি ও তওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ফিরে আসি। তাঁরই কাছে পূর্ণাঙ্গভাবে আত্মসমার্পণ করি। তবেই আমরা দুনিয়া ও আখেরাতে সফলদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হতে পারব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ বলেন, (হে মুহাম্মাদ!) তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও, যারা তাদের উপর কোন বিপদ এলে বলে, নিশ্চয়ই আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই আমরা ফিরে যাব’ (বাক্বারাহ ২/১৫৬)।