পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 9729 বার পঠিত

আল-কুরআনুল কারীম :

1- يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ وَإِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوا وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ مِنْهُ مَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ حَرَجٍ وَلَكِنْ يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ-

(১) ‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা ছালাতে দন্ডায়মান হবে, তখন (তার পূর্বে বে-ওযূ থাকলে ওযূ করার জন্য) তোমাদের মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় কনুই সমেত ধৌত কর এবং মাথা মাসাহ কর ও পদযুগল টাখনু সমেত ধৌত কর। আর যদি তোমরা নাপাক হয়ে যাও, তাহলে গোসল কর। আর যদি তোমরা পীড়িত হও অথবা সফরে থাক অথবা টয়লেট থেকে আস কিংবা স্ত্রী স্পর্শ করে থাক, অতঃপর পানি না পাও, তাহ’লে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর এবং এজন্য তোমাদের মুখমন্ডল ও দু’হাত উক্ত মাটি দ্বারা মাসাহ কর। আল্লাহ তোমাদের উপর কোনরূপ সংকীর্ণতা চান না। বরং তিনি চান তোমাদের পবিত্র করতে এবং তোমাদের উপর স্বীয় অনুগ্রহ পূর্ণ করতে। যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর' (মায়েদাহ ৫/৬)

2- يَابَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ-

(২) ‘হে আদম সন্তান! তোমরা প্রত্যেক ছালাতের সময় সুন্দর পোষাক পরিধান কর। তোমরা খাও ও পান কর। কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালবাসেন না’  (আরাফ ৭/২৯-৩১)

3- يَاأَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ-قُمْ فَأَنْذِرْ-وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ- وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ-وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ-فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ--

(৩) ‘হে চাদরাবৃত! উঠুন! ভয় প্রদর্শন করুন আপনার পালনকর্তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন। আপনার পোষাক পবিত্র করুন। অপবিত্রতা হ’তে দূরে থাকুন। অতঃপর যখন তারা ভালভাবে পবিত্র হবে, তখন আল্লাহর নির্দেশ মতে তোমরা তাদের নিকট গমন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদের ভালবাসেন ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১-৫, বাক্বারাহ ২/২২২ )

4- لَا تَقُمْ فِيهِ أَبَدًا لَمَسْجِدٌ أُسِّسَ عَلَى التَّقْوَى مِنْ أَوَّلِ يَوْمٍ أَحَقُّ أَنْ تَقُومَ فِيهِ فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَنْ يَتَطَهَّرُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ-

(৪) ‘তুমি সেখানে কখনো দাঁড়াবে না। অবশ্যই যে মসজিদ প্রথম দিন থেকে তাক্বওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, সেটাই তোমার (ছালাতের জন্য) দাঁড়াবার যথাযোগ্য স্থান। সেখানে এমন সব লোক রয়েছে, যারা উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হওয়াকে ভালবাসে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (তওবা ৯/১০৮)

হাদীছে নববী :

5- عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ قَصُّ الشَّارِبِ وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ وَالسِّوَاكُ وَاسْتِنْشَاقُ الْمَاءِ وَقَصُّ الأَظْفَارِ وَغَسْلُ الْبَرَاجِمِ وَنَتْفُ الإِبْطِ وَحَلْقُ الْعَانَةِ وَانْتِقَاصُ الْمَاءِ. قَالَ زَكَرِيَّاءُ قَالَ مُصْعَبٌ وَنَسِيتُ الْعَاشِرَةَ إِلاَّ أَنْ تَكُونَ الْمَضْمَضَةَ.

(৫) আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘দশটি কাজ ফিতরাতের অন্তর্ভুক্ত। আর তা হ’ল মোচ খাটো করা, দাড়ি লম্বা করা, মিসওয়াক করা, নাকে পানি দিয়ে ঝাড়া, নখ কাটা, আঙ্গুলের গিরাসমূহ ধোয়া (হাত ধোয়া), বগলের পশম উপড়ে ফেলা, নাভীর নীচের পশম মুন্ডন করা এবং পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা। যাকারিয়া বলেন, হাদীছের রাবী মুস‘আব বলেন, দশমটির কথা আমি ভুলে গেয়েছি। সম্ভবতঃ সেটি হবে কুলি করা’।[1]

6-  عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ وَقَّتَ لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِى قَصِّ الشَّارِبِ وَتَقْلِيمِ الأَظْفَارِ وَحَلْقِ الْعَانَةِ وَنَتْفِ الإِبْطِ أَنْ لاَ نَتْرُكَ أَكْثَرَ مِنْ أَرْبَعِينَ يَوْمًا-

(৬)  আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) আমাদের জন্য গোঁফ ছাটা, নখ কাটা, নাভীর নিম্নাংশের লোম কামানো এবং বগলের লোম উপড়িয়ে ফেলার জন্য সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর তা যেন চল্লিশ দিনের বেশী রেখে না দেয়া হয়’।[2]

7-  عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا اسْتَيْقَظَ أَحَدُكُمْ مِنْ نَوْمِهِ فَلاَ يَغْمِسْ يَدَهُ فِى الإِنَاءِ حَتَّى يَغْسِلَهَا ثَلاَثًا فَإِنَّهُ لاَ يَدْرِى أَيْنَ بَاتَتْ يَدُهُ.

(৭) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন ঘুম থেকে জাগে, তখন তিনবার হাত না ধুয়ে যেন পানির পাত্রে তা না ডুবায়; কারণ তোমাদের কেউ জানে না যে, (ঘুমন্ত অবস্থায়) তার হাত কোথায় থাকে’।[3]

8- عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ أَتَانَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَرَأَى رَجُلاً شَعِثًا قَدْ تَفَرَّقَ شَعْرُهُ فَقَالَ أَمَا كَانَ يَجِدُ هَذَا مَا يُسَكِّنُ بِهِ شَعْرَهُ. وَرَأَى رَجُلاً آخَرَ وَعَلَيْهِ ثِيَابٌ وَسِخَةٌ فَقَالَ أَمَا كَانَ هَذَا يَجِدُ مَاءً يَغْسِلُ بِهِ ثَوْبَهُ.

(৮) জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,  ‘একদা রাসূল (ছাঃ) আমাদের এখানে এসে এক বিক্ষিপ্ত চুলওয়ালাকে দেখে বললেন, লোকটি কি তার চুলগুলোকে অাঁচড়ানোর জন্য চিরুনী পায়না? তিনি ময়লা কাপড় পরিহিত অপর এক ব্যক্তিকে দেখে বলেন, লোকটি কি তার কাপড় ধোয়ার জন্য পানি পায় না?’[4]

9- عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَجُلاً أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم وَكَانَ رَجُلاً جَمِيلاً فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّى رَجُلٌ حُبِّبَ إِلَىَّ الْجَمَالُ وَأُعْطِيتُ مِنْهُ مَا تَرَى حَتَّى مَا أُحِبُّ أَنْ يَفُوقَنِى أَحَدٌ إِمَّا قَالَ بِشِرَاكِ نَعْلِى وَإِمَّا قَالَ بِشِسْعِ نَعْلِى أَفَمِنَ الْكِبْرِ ذَلِكَ قَالَ لاَ وَلَكِنَّ الْكِبْرَ مَنْ بَطَرَ الْحَقَّ وَغَمَطَ النَّاسَ.

(৯) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এলো। লোকটি ছিল খুবই সুন্দর। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি সৌন্দর্যকে  ভালবাসি। আপনি তো দেখতে পাচ্ছেন আমাকে সৌন্দর্যমন্ডিত করা হয়েছে। এদিক দিয়ে কেউ আমার উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করুক তা আমি চাই না, এমনকি কেউ যদি বলে, আমার জুতার ফিতার চাইতে তার ফিতাটা ভালো, সেটাও পসন্দ করি না। এরূপ করা কি অহংকার? প্রত্যুত্তরে রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, না, বরং অহংকার হ’ল সত্যকে অবজ্ঞা করা এবং মানুষকে তুচ্ছ মনে করা’।[5]

10- عَنْ أَبِى مَالِكٍ الأَشْعَرِىِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الطُّهُورُ شَطْرُ الإِيمَانِ-

(১০) আবু মালিক আল-আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘পবিত্রতা হ’ল ঈমানের অর্ধেক’।[6]

11- عَنْ أَبِى ذَرٍّ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ  عُرِضَتْ عَلَىَّ أَعْمَالُ أُمَّتِى حَسَنُهَا وَسَيِّئُهَا فَوَجَدْتُ فِى مَحَاسِنِ أَعْمَالِهَا الأَذَى يُمَاطُ عَنِ الطَّرِيقِ وَوَجَدْتُ فِى مَسَاوِى أَعْمَالِهَا النُّخَاعَةَ تَكُونُ فِى الْمَسْجِدِ لاَ تُدْفَنُ.

(১১) আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমার উম্মতের ভাল-মন্দ সমস্ত কাজই আমার সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল। আমি দেখলাম তাদের ভাল কাজ হ’ল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত দূর করা এবং মন্দ কাজ হ’ল মসজিদের মধ্যে কাশি বা থুথু ফেলা এবং তা মিটিয়ে না ফেলা’।[7]

মনীষীদের বক্তব্য :

১. আবু উমামা আল-বাহেলী (রাঃ) বলেন, তুমি যখন যথাযথ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হবে, তখন তুমি প্রকৃত ক্ষমা প্রার্থনাকারী হিসাবে বরিত হবে।[8]

২. আ‘মাশ (রহঃ) বলেন, পরিচ্ছন্নতা হ’ল কৃত পাপ থেকে তওবা করা এবং শিরক থেকে পবিত্র হওয়া।[9]

৩. আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন, সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য পানি দিয়ে পবিত্রতা হাসিল করতে হয়। কিন্তু প্রকৃত পরিচ্ছন্নতা হ’ল পাপ থেকে পরিচ্ছন্ন হওয়া’।[10]

৪. ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযী (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াবী অপরিচ্ছন্নতা থেকে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করে নিল, সে আখেরাতে আল্লাহর সাথে পরিচ্ছন্ন অবস্থায় জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যদি কেউ দুনিয়াতে অপরিচ্ছন্ন থাকে, তবে তার অবস্থা একজন কাফেরের মত, যে কখনো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’।[11]     

সারবস্ত্ত :

১. ইসলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দিয়ে বান্দা মহান প্রভুর ভালবাসা ও সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে।

২. ছালাত, তওয়াফ এবং কুরআর পাঠের মত বিশেষ ইবাদতে মনোনিবেশ করার অন্যতম মাধ্যম হ’ল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা।

৩. পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সমাজ জীবনের সুখ-শান্তির অন্যতম বাহন।

৪. প্রতিটি ইবাদতের প্রাণ হ’ল পরিশুদ্ধ ঈমান। আর তা অর্জিত হয় পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে।

৫. এটি রোগব্যাধি থেকে বাঁচার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার, যা চিকিৎসার চেয়ে অধিক প্রয়োজনীয়।       



[1]. মুসলিম হা/৪৯২;৫৬।

[2]. তিরমিযী হা/২৭৫৯

[3]. মুসলিম হা/৮৭; মিশকাত হা/৩৯১।

[4]. আবুদাউদ হা/৪০৬২

[5]. আবুদাউদ হা/৪০৯২।

[6]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৮১; ছহীহুল জামে‘ হা/১৩১০৮।

[7]. মুসলিম হা/১১২০; মিশকাত হা/৭০৯।

[8]. মাজমাঊল যাওয়ায়েদ ১/২২৩ পৃ.।

[9]. তাফসীর ইবনু কাছীর ২/৩৯১ পৃ.।

[10]. ঐ।

[11]. ইগাছাতুল লাহফান ১/৭১ পৃ.।



আরও