হজ্জের শিক্ষা : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মানুষ মাত্রই ভুলকারী। ভুল করার প্রবণতা আছে বলেই আমাদেরকে মানুষ বলা হয়। যারা ভুল বা পাপ করার পর সেই পাপ থেকে ফিরে আসে না এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনা, তাদের দেহ-মন পাপের কালিমায় কলুষিত হয় এবং গুনাহের প্রভাবে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। আর তাদের জন্য আখেরাতের শাস্তি তো আছেই। পাপ মানুষের দুনিয়াবী জীবনে কেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এই প্রবন্ধে আমরা সেই বিষয়ে আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ।
পাপের পরিচয় :
পাপ বা গুনাহ শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ হ’ল- অন্যায়, কলুষ, দুষ্কর্ম, দুষ্কৃতি ইত্যাদি।[1] আরবী সমার্থবোধক শব্দ الإثم، الذنب، المعصية প্রভৃতি পাপ বা গুনাহ অর্থে ব্যবহৃত হয়। পারিভাষিক অর্থে, ترك ما أوجب وفُرض من كتابه أو على لسان رسول صلى الله عليه وسلم وارتكاب ما نهى الله عنه أو رسوله صلى الله عليه وسلم من الأقوال والأعمال الظاهرة أو الباطنة ‘পবিত্র কুরআন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর বাণীর মাধ্যমে যা কিছু ওয়াজিব ও ফরয করা হয়েছে, তা পরিত্যাগ করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) যা থেকে নিষেধ করেছেন, তাতে লিপ্ত হওয়া। সেটা কথার মাধ্যমে হোক বা কর্মের মাধ্যমে হোক, প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক’।[2] ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেন- المعصية هي مخالفة الأمر الشرعي ‘শার‘ঈ নির্দেশের বিপরীত কর্মই হ’ল পাপ’।[3] আহমাদ আল-মারাগী (মৃ:১৩৭১হিঃ) বলেন, الذنب: هو التقصير فى المعاملة بين العبد وربه ‘বান্দা ও তার রবের সম্পর্কের মাঝে যা কিছু অন্তরায় সৃষ্টি করে, তাকে পাপ বলা হয়’।[4] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পাপের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, الإِثْمُ مَا حَاكَ فِي نَفْسِكَ وَكَرِهْتَ أَنْ يَطَّلِعَ عَلَيْهِ النَّاسُ ‘পাপ হ’ল যা তোমার অন্তরে সংশয় সৃষ্টি করে এবং সেটা মানুষ জানতে পারুক তা তুমি অপসন্দ কর’।[5] মোটকথা পাপ হ’ল এমন কথা এবং কাজ, যার মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘিত হয়, সেটা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক।
পাপের প্রকারভেদ :
প্রকৃতিগতভাবে পাপ সাধারণত ৪ প্রকার :
ধরণগত
দিক থেকে পাপ দুই প্রকার- বড় পাপ এবং ছোট পাপ। ইবনুল কাইয়িম (রহঃ) বলেন-
والذنوب تنقسم إلى صغائر وكبائر، بنصّ القرآن والسنة، وإجماع السلف،
وبالاعتبار ‘কুরআন, সুন্নাহ এবং সালাফদের ইজমার ভিত্তিতে পাপ দুই প্রকার-
১. কবীরা গুনাহ এবং ২. ছগীরা গুনাহ।[7]
মানব জীবনে পাপের কুপ্রভাব :
মুসলিম বলতেই সবারই এ কথা জানা উচিৎ যে, বিষ যেমন শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, তেমনিভাবে গুনাহও অন্তরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে তাতে ক্ষতির তারতম্য অবশ্যই রয়েছে। এমনকি দুনিয়া ও আখিরাতে যত অকল্যাণ অথবা ব্যাধি রয়েছে তার মূলে রয়েছে গুনাহ ও পাপাচার। এর কারণেই আদম ও হাওয়া (আঃ) একদা জান্নাত থেকে বের হতে বাধ্য হন। এরই কারণে শয়তান ইবলীস আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়। এরই কারণে নূহ (আঃ)-এর যুগে বিশ্বব্যাপী মহা প্লাবন দেখা দেয় এবং কিছু সংখ্যক ব্যক্তি ও বস্ত্ত ছাড়া সবই ধ্বংস হয়ে যায়। এরই কারণে হূদ (আঃ)-এর যুগে ধ্বংসাত্মক বায়ু প্রবাহিত হয় এবং সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যায়। এরই কারণে ছালিহ (আঃ)-এর যুগে ভয়ঙ্কর চিৎকার শুনে সবাই হৃদয় ফেটে অথবা হৃদয় ছিঁড়ে মারা যায়। এরই কারণে লুত্ব (আঃ)-এর কওমকে উল্টিয়ে তাতে পাথর নিক্ষেপ করা হয় এবং শুধু একজন ছাড়া তাঁর পরিবারের সকলকেই রক্ষা করা হয়। আর অন্যরা সবাই দুনিয়া থেকে একেবারেই নির্মূল হয়ে যায়। এরই কারণে শু‘আইব (আঃ)-এর যুগে আকাশ থেকে আগুন বর্ষিত হয়। এরই কারণে ফির‘আউন ও তার বংশধররা লোহিত সাগরে ডুবে মারা যায়। এরই কারণে ক্বারূন তার ঘর, সম্পদ ও পরিবারসহ ভূমিতে ধসে যায়।[8] এরই কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা বনী ইস্রাঈল তথা ইহুদীদের উপর এমন শক্র পাঠিয়ে দেন, যারা তাদের এলাকায় ঢুকে তাদের ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে দেয়, তাদের পুরুষদেরকে হত্যা করে, তাদের মহিলা ও বাচ্চাদেরকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের সকল সম্পদ লুটে নেয়। এভাবে একবার নয়। বরং দু’ দু’ বার ঘটে। পরিশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে কসম করে বলেন, وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكَ لَيَبْعَثَنَّ عَلَيْهِمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَنْ يَسُومُهُمْ سُوءَ الْعَذَابِ ‘(হে নবী!) তুমি স্মরণ করো সে সময়ের কথা যখন তোমার প্রভু ঘোষণা করলেন, তিনি অবশ্যই কিয়ামত পর্যন্ত ইহুদীদের প্রতি এমন লোক পাঠাবেন যারা ওদেরকে কঠিন শাস্তি দিতে থাকবে’ (আ’রাফ ৭/১৬৭)।
সুতরাং পাপের কুপ্রভাব ও ভয়াবহতা সহজেই অনুমেয়। মুমিন বান্দাকে পাপের এই কুপ্রভাব সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকে। সে কখনো প্রবৃত্তির অনুসরণ করে পাপ ও দুনিয়াবী বাহ্যিক চাকচিক্যের অতল গহবরে নিজেকে বিলীন করতে পারে না। যেমন হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, كَانَ النَّاسُ يَسْأَلُونَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الخَيْرِ، وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنِ الشَّرِّ مَخَافَةَ أَنْ يُدْرِكَنِي ‘লোকেরা রাসূল (ছাঃ)-কে কল্যাণ বা নেকী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত। আমি তাঁকে অকল্যাণ ও পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতাম। যেন সেটা আমাকে পেয়ে না বসে’।[9] নিমেণ মানব জীবনে পাপের কুপ্রভাব বিস্তারের কিছু নমুনা আলোচনা করা হ’ল।
১. পাপের কারণে রিযিক সংকুচিত হয় ও জীবন বরকত শূণ্য হয়ে পড়ে :
পাপের কারণে আল্লাহ তার বান্দার জীবন থেকে বরকত উঠিয়ে নেন এবং তার রিযিক সংকুচিত করে দেন। আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে খাদ্যাভাব, অভাব-অনটন ও দারিদ্রতার মূল কারণ আমাদের পাপ। কিন্তু এই ব্যাপারে আমরা সতর্ক নই। ছাওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, لَا يَزِيدُ فِي الْعُمْرِ إِلَّا الْبِرُّ، وَلَا يَرُدُّ الْقَدَرَ إِلَّا الدُّعَاءُ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيُحْرَمُ الرِّزْقَ بِالذَّنْبِ يُصِيبُهُ ‘সৎকর্ম ব্যতীত অন্য কিছু আয়ুস্কাল বাড়াতে পারে না এবং দো‘আ ব্যতীত অন্য কিছুতে তাকদীর রদ হয় না। মানুষ তার পাপকাজের দরুন তার প্রাপ্য রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়’।[10] আলোচ্য হাদীছের দ্বিতীয় অংশের সনদ যঈফ হলেও তার মর্মার্থ ছহীহ। কারণ পবিত্র কুরআনের আয়াত এর সত্যতা স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَوْ أَنَّهُمْ أَقَامُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِمْ مِنْ رَبِّهِمْ لَأَكَلُوا مِنْ فَوْقِهِمْ وَمِنْ تَحْتِ أَرْجُلِهِمْ ‘যদি তার তাওরাত, ইঞ্জিল এবং তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাদের উপর নাযিলকৃত বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠিত করত। তাহলে তারা তাদের উপর থেকে এবং তাদের পায়ের নীচ থেকে আহার করত’ ( মায়েদা ৫/৬৬)। প্রখ্যাত ছাহাবী হযরত আলী (রাঃ) বলেন,
إِذا كُنتَ في نِعمَةٍ فَاِرعَها * فَإِنَّ الـمَعاصي تُزيلُ النِعَم.
وَحافِظ عَلَيها بِتَقوى الإِلَهِ * فَإِنَّ الإِلَهَ سَريعُ النِّقَم.
‘যখন তুমি আল্লাহ নি‘মতের মধ্যে থাক, তখন এর যত্ন নাও। কারণ, গুনাহ নি‘মাতকে দূর করে দেয়। আর তুমি আল্লাহভীতির মাধ্যমে সেই নি‘মতকে সংরক্ষণ কর। কেননা, নিশ্চয় ইলাহ/ আল্লাহ দ্রুত প্রতিশোধ গ্রহণকারী’।[11] আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, إن للحسنة نورا في القلب، وزينا في الوجه، وقوة في البدن، وسعة في الرزق، ومحبة في قلوب الخلق . وإن للسيئة ظلمة في القلب، وشينا في الوجه، ووهنا في البدن، ونقصا في الرزق، وبغضة في قلوب الخلق ‘নিশ্চয় নেক আমলের প্রভাব হ’ল- অন্তরের আলো, চেহারার উজ্জ্বলতা, শরীরের শক্তিমত্তা, রিযিকের প্রশস্তি এবং সৃষ্টিকূলের আন্তরিক ভালোবাসা। আর গুনাহের প্রভাব হ’ল- অন্তরের অন্ধকার, চেহারার কলুষতা, শরীরের দুর্বলতা, রিযিকের সংকট এবং সৃষ্টিকূলের অন্তরসমূহের ঘৃণা ও অপসন্দনীয়তা’।[12] আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ، أَوْ يُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ، فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ ‘যে ব্যক্তি পসন্দ করে যে, তার রিযিক বৃদ্ধি হোক অথবা তার হায়াত বৃদ্ধি হোক, সে যেন আত্মীয়তাদের সাথে সদাচরণ করে’।[13] সুতরাং বোঝা গেল, নেকীর কারণে বান্দার রিযিক বরকতমন্ডিত ও প্রশস্থ হয় এবং পাপের কারণে রিযিক সংকুচিত হয়।
২. পাপ জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত করে :
জ্ঞানের আলো বান্দার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এক অনন্য নে‘মত। কোন পাপী বান্দা জ্ঞানের আলো লাভ করতে পারে না এবং লাভ করলেও সেই আলো দ্বারা উপকৃত হ’তে পারে না। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘একবার ইমাম মালেক (রহঃ) ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)-এর প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন এবং তাকে উপদেশ দিয়ে বলেন, إني أرى أن الله قد ألقى على قلبك نورا فلا تطفئه بظلمة المعصية ‘আমি দেখতে পাচ্ছি, আল্লাহ তোমার হৃদয়ে জ্ঞানের আলো দান করেছেন। সুতরাং পাপের অন্ধকার দিয়ে এটাকে নিভিয়ে দিওনা’। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন,
شكوت إلى وكيع سوء حفظي ** فأرشدني إلى ترك المعاصي
وأخبرني بأن العلم نور ** ونور الله لا يهدى لعاصي.
‘আমি আমার ওস্তাদ ওয়াকী‘র কাছে আমার মুখস্থ শক্তির দুর্বলতা নিয়ে অভিযোগ করলাম। তখন তিনি আমাকে পাপ ত্যাগ করার দিক্ষা দিলেন। আর আমাকে জানালেন যে, জ্ঞান হ’ল আলো। কোন পাপী বান্দাকে আল্লাহর এই আলো দান করা হয় না’।[14] স্বাভাবিকভাবেই মানের মাঝে একটা প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে যে, একজন পাপিষ্ট ব্যক্তি তো কখনো কখনো মুমিন বান্দার চেয়ে জ্ঞান ও মেধাশক্তিতে এগিয়ে থাকে। এর কারণ কি? উত্তর মহান আল্লাহ সুন্দরভাবে দিয়েছেন। তিনি বলেন,
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ * وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلَكِنَّهُ أَخْلَدَ إِلَى الْأَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ الْكَلْبِ إِنْ تَحْمِلْ عَلَيْهِ يَلْهَثْ أَوْ تَتْرُكْهُ يَلْهَثْ ذَلِكَ مَثَلُ الْقَوْمِ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا فَاقْصُصِ الْقَصَصَ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ.
‘তাদেরকে ঐ লোকের সংবাদ পড়ে শোনাও যাকে আমি আমার নিদর্শনসমূহ প্রদান করেছিলাম। কিন্তু সে সেগুলোকে এড়িয়ে যায়। অতঃপর শয়তান তাকে অনুসরণ করে, ফলে সে পথভ্রষ্টদের দলে শামিল হয়ে যায়।
আমি ইচ্ছে করলে আমার নিদর্শনের মাধ্যমে তাকে অবশ্যই উচ্চতর মর্যাদা দিতাম। কিন্তু সে দুনিয়ার প্রতিই ঝুঁকে পড়ল আর তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। তাই তার দৃষ্টান্ত হল কুকুরের দৃষ্টান্তের মত। যদি তুমি তার উপর বোঝা চাপাও তাহলে জিভ বের করে হাঁপাতে থাকে এবং তাকে ছেড়ে দিলেও জিভ বের করে হাঁপাতে থাকে। এটাই হল ঐ সম্প্রদায়ের উদাহরণ যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যে মনে করে অমান্য করে। তুমি এ কাহিনী শুনিয়ে দাও যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে’ (আ‘রাফ ৭/১৭৫-১৭৬)।
৩. পাপ মানব হৃদয়কে মেরে ফেলে :
পাপ বান্দার অন্তরে তার সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতার বীজ বপন করে। বান্দা ও তাঁর রবের মধ্যকার নির্মল ভালোবাসার অন্তরায় সৃষ্টি করে। আর এই পাপের পরিমাণ যখন বেড়ে যায়, তখন অন্তর রোগাক্রান্ত হয়ে মরে যায়। ইমাম ইবনুল মুবারাক (রহঃ) বলেন,
رَأَيْتُ الذُّنُوبَ تُمِيتُ الْقُلُوبَ ... وَقَدْ يُورِثُ الذُّلَّ إِدْمَانُهَا
وَتَرْكُ الذُّنُوبِ حَيَاةُ الْقُلُوبِ ... وَخَيْرٌ لِنَفْسِكَ عِصْيَانُهَا
‘আমি দেখেছি যে, পাপ অন্তরকে মেরে ফেলে এবং পাপে লিপ্ত থাকা অপমান কুড়িয়ে আনে। পক্ষান্তরে পাপ পরিহার করা অন্তরকে জীবিত রাখে এবং পাপ থেকে বেঁচে থাকার মাঝেই আত্মার কল্যাণ নিহিত’।[15] হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,
تُعْرَضُ الْفِتَنُ عَلَى الْقُلُوبِ كَالْحَصِيرِ عُودًا عُودًا، فَأَيُّ قَلْبٍ أُشْرِبَهَا، نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ، وَأَيُّ قَلْبٍ أَنْكَرَهَا، نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ بَيْضَاءُ، حَتَّى تَصِيرَ عَلَى قَلْبَيْنِ، عَلَى أَبْيَضَ مِثْلِ الصَّفَا فَلَا تَضُرُّهُ فِتْنَةٌ مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ، وَالْآخَرُ أَسْوَدُ مُرْبَادًّا كَالْكُوزِ، مُجَخِّيًا لَا يَعْرِفُ مَعْرُوفًا، وَلَا يُنْكِرُ مُنْكَرًا، إِلَّا مَا أُشْرِبَ مِنْ هَوَاهُ
‘চাটাই বুননের মত এক এক করে ফিতনা মানুষের অন্তরে আসতে থাকে। যে অন্তরে তা গেঁথে যায় তাতে একটি করে কালো দাগ পড়ে। আর যে অন্তর তা প্রত্যাখ্যান করবে তাতে একটি উজ্জ্বল দাগ পড়বে। এমনি করে দু’টি অন্তর দু’ধরনের হয়ে যায়। এটি সাদা পাথরের ন্যায়; আসমান ও যমীন যতদিন থাকবে ততদিন কোন ফিৎনা তার কোন ক্ষতি করতে পারে না। আর অপরটি হয়ে যায় উল্টানো সাদা মিশ্রিত কালো কলসির ন্যায়, তার প্রবৃত্তির মধ্যে যা গেছে তা ছাড়া ভাল-মন্দ বলতে সে কিছুই চিনে না’।[16] অর্থাৎ, ফিৎনার কারণে পাপিষ্ট অন্তর ভাল-মন্দের খেই হারিয়ে ফেলে। কারণ পাপের দরুন তার হৃদয় মরে যায়। তবে এই মৃত অন্তরকে তাওবাহ ও ইসতিগফারের মাধ্যমে জীবিত করা যায়। আবু হুরায়রন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
إِنَّ العَبْدَ إِذَا أَخْطَأَ خَطِيئَةً نُكِتَتْ فِي قَلْبِهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ، فَإِذَا هُوَ نَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ وَتَابَ سُقِلَ قَلْبُهُ، وَإِنْ عَادَ زِيدَ فِيهَا حَتَّى تَعْلُوَ قَلْبَهُ، وَهُوَ الرَّانُ الَّذِي ذَكَرَ اللَّهُ-كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ-
‘বান্দা যখন একটি গুনাহ করে
তখন তার অন্তরের মধ্যে একটি কালো চিহ্ন পড়ে। অতঃপর যখন সে গুনাহর কাজ
পরিহার করে, ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তাওবাহ করে, তখন তার অন্তর পরিষ্কার ও
দাগমুক্ত হয়ে যায়। সে আবার পাপ করলে তার অন্তরে দাগ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং
তার পুরো অন্তর এভাবে কালো দাগে ঢেকে যায়। এটাই সেই মরিচা আল্লাহ তা‘আলা
যার বর্ণনা করেছেন, ‘কখনো নয়, বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের মনে জং (মরিচা)
ধরিয়েছে’ (মুত্বাফফিফীন ১৪)।[17]
এ ব্যাপারে মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, ‘কোন ব্যক্তি যখন কোন পাপ করে, তখন পাপ তার অন্তরে একটি গিঁট দিয়ে দেয়। তারপর আবার পাপ করলে আরো একটি গিঁট দেয়। অবশেষে পাপ তার অন্তরকে বেষ্টন করে ফেলে’।[18] ফলে তার অন্তর সেই পাপাচারের ঘোর অমানিষা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না।
৪. পাপের কারণে যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি হয় :
নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যত বিপর্যয় সৃষ্টি হয়, তার সবগুলো আমাদের পাপের ফসল। খরা, অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্প, প্লাবন, মহামারি প্রভৃতি বিস্মৃতির মূল কারণ হ’ল আমাদের কৃত পাপ ও গুনাহ। মহান আল্লাহ বলেন,
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে জলে-স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যাতে তিনি তাদেরকে তাদের কিছু কর্মের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে’ (রূম ৩০/৪১)। অত্র আয়াতে ‘কিছু কর্মের’ (بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا) অর্থ হ’ল কিছু পাপের শাস্তি মানুষ দুনিয়ায় ভোগ করবে। আর সব বাকী থাকবে আখেরাতের জন্য। অর্থাৎ পাপ আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। এখানে আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্যশীল একটি হাদীছ উল্লেখ করা যায়। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন,
يَا مَعْشَرَ الْمُهَاجِرِينَ خَمْسٌ إِذَا ابْتُلِيتُمْ بِهِنَّ، وَأَعُوذُ بِاللَّهِ أَنْ تُدْرِكُوهُنَّ: لَمْ تَظْهَرِ الْفَاحِشَةُ فِي قَوْمٍ قَطُّ، حَتَّى يُعْلِنُوا بِهَا، إِلَّا فَشَا فِيهِمُ الطَّاعُونُ، وَالْأَوْجَاعُ الَّتِي لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِي أَسْلَافِهِمُ الَّذِينَ مَضَوْا، وَلَمْ يَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ، إِلَّا أُخِذُوا بِالسِّنِينَ، وَشِدَّةِ الْمَئُونَةِ، وَجَوْرِ السُّلْطَانِ عَلَيْهِمْ، وَلَمْ يَمْنَعُوا زَكَاةَ أَمْوَالِهِمْ، إِلَّا مُنِعُوا الْقَطْرَ مِنَ السَّمَاءِ، وَلَوْلَا الْبَهَائِمُ لَمْ يُمْطَرُوا، وَلَمْ يَنْقُضُوا عَهْدَ اللَّهِ، وَعَهْدَ رَسُولِهِ، إِلَّا سَلَّطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ غَيْرِهِمْ، فَأَخَذُوا بَعْضَ مَا فِي أَيْدِيهِمْ، وَمَا لَمْ تَحْكُمْ أَئِمَّتُهُمْ بِكِتَابِ اللَّهِ، وَيَتَخَيَّرُوا مِمَّا أَنْزَلَ اللَّهُ، إِلَّا جَعَلَ اللَّهُ بَأْسَهُمْ بَيْنَهُمْ
‘হে মুহাজিরগণ! তোমরা পাঁচটি
বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তবে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি
যেন তোমরা তার সম্মুখীন না হও। (১) যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা
ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া
এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকেদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। (২)
যখন কোন জাতি ওযন ও পরিমাপে কারচুপি করে, তখন তাদের উপর নেমে আসে
দুর্ভিক্ষ, কঠিন বিপদ-মুসীবত এবং রাষ্ট্রীয় নির্যাতন। (৩) যখন তার যাকাত
আদায় করে না, তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে
চতুস্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকতো তাহলে আর কখনো বৃষ্টিপাত হতো না।
(৪) যখন কোন জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ
তাদের উপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাশীন করেন এবং সে তাদের সহায়-সম্পদ
সবকিছু কেড়ে নেয়। (৫) যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা
করে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে গ্রহণ করে না, তখন আল্লাহ তাদের
পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেন’।[19]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে বৈশ্বিক জীবনে যত মহামারি, সংকট, বিপদাপদ ও কষ্টের প্রাদুর্ভাব ধটে, তা কেবল আমাদের পাপ ও অবাধ্যতার কারণে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে এহেন কর্ম থেকে রক্ষা করুন।
৫. পাপ লজ্জা-শরম কমিয়ে দেয় :
পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে বান্দার লজ্জা শরম অবশিষ্ট থাকে না। ফলে সে যা ইচ্ছা তাই করতে থাকে। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلاَمِ النُّبُوَّةِ، إِذَا لَمْ تَسْتَحْيِ فَافْعَلْ مَا شِئْتَ ‘নবীদের কালাম থেকে মানবজাতি যা কিছু লাভ করেছে, তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল, যখন তোমার লজ্জ-শরম থাকবে না, তখন তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে’।[20] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, الْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الْإِيمَانِ ‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ’।[21] সুতরাং পাপের ফলে যখন বান্দা লজ্জাহীন হয়ে যায়, তখন তার ঈমানটাও পঙ্গু হয়ে যায়।
৬. পাপীর পার্থিব অবস্থা দারিদ্র পীড়িত ও সংকটাপন্ন হয় :
শয়তানের
পদাঙ্ক অনুসরণ করে যারা পাপে লিপ্ত হয়, দারিদ্রতা তাদেরকে গ্রাস করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُمْ
بِالْفَحْشَاءِ ‘শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রতার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তোমাদেরকে
অশ্লীলতার নির্দেশ দেয়’ (বাক্বারাহ ২/২৬৮)। মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَوْ أَنَّهُمْ أَقَامُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ وَمَا أُنْزِلَ
إِلَيْهِمْ مِنْ رَبِّهِمْ لَأَكَلُوا مِنْ فَوْقِهِمْ وَمِنْ تَحْتِ
أَرْجُلِهِمْ ‘যদি তার তাওরাত, ইঞ্জিল এবং তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে
তাদের উপর নাযিলকৃত বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠিত করত। তাহলে তারা তাদের উপর থেকে
এবং তাদের পায়ের নীচ থেকে আহার করত’ (মায়েদা ৫/৬৬)। আর যারা
আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে প্রবৃত্তি পূজায় লিপ্ত হয়, দারিদ্রতা তাদের চির সাথী
হয়। বাহ্যিকভাবে সে ধনাঢ্য হলেও, তার ভিতরটা নিঃস্বতায় ভরপুর হয়ে যায়। আবূ
হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, হাদীছে কুদসীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا ابْنَ آدَمَ تَفَرَّغْ لِعِبَادَتِي أَمْلَأْ
صَدْرَكَ غِنًى وَأَسُدَّ فَقْرَكَ، وَإِلَّا تَفْعَلْ مَلَأْتُ يَدَيْكَ
شُغْلًا وَلَمْ أَسُدَّ فَقْرَكَ ‘হে আদম সন্তান! তুমি তোমার অন্তরকে আমার
ইবাদতের জন্য খালি করে নাও, আমি তোমার অন্তরকে সচ্ছলতা দ্বারা ভরে দেব এবং
তোমার অভাবের পথ বন্ধ করে দেব। অন্যথায় আমি তোমার হাতকে ব্যস্ততা দ্বা ভরে
দেব এবং তোমার অভাবের পথ কখনো বন্ধ করবো না’।[22]
৭. পাপীদের জীবন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে :
মহান
আল্লাহ পাপীকে মনে রাখেন না। সেকারণ পাপিষ্ট ব্যক্তির জীবন নিরাপত্তাহীন
হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ صَلَّى الصُّبْحَ فَهُوَ فِي
ذِمَّةِ اللَّهِ، فَلَا تُخْفِرُوا اللَّهَ فِي عَهْدِهِ، فَمَنْ قَتَلَهُ
طَلَبَهُ اللَّهُ حَتَّى يَكُبَّهُ فِي النَّارِ، عَلَى وَجْهِهِ ‘যে
ব্যক্তি ফজরের ছালাত আদায় করল, সে আল্লাহর নিরাপত্তায় চলে গেল। সুতরাং
তোমরা আল্লাহর যিম্মাদারিকে নষ্ট করো না। কেননা যে ব্যক্তি তা নষ্ট করবে,
আল্লাহ তাকে তলব করে এনে উল্টেমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’।[23]
মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। ফলে আললাহও তাদেরকে ভুলে গেছেন। তারাই হ’ল পাপিষ্ট’ (হাশর ৫৯/১৯)।
৮. পাপী ব্যক্তি আল্লাহ, ফেরেশতামন্ডলী ও মানুষের কাছে ঘৃণিত হয় :
আল্লাহ পাপী ব্যক্তির উপর মানুষের ঘৃণা সৃষ্টি করে দেন। ফলে সবাই তাকে অপসন্দ করে। এমনকি তার পাপ সম্পর্কে অবগত না থাকলেও তার প্রতি মানুষে খারাপ ধারণা তৈরী হয়। তার অর্থ-সম্পদ ও সমাজিক গ্রহনযোগ্যতা থাকলেও কেউ তাকে মন থেকে ভালোবাসে না। এর কারণ হ’ল পাপের কারণে আল্লাহ তাকে অপসন্দ করেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,
إِنَّ اللهَ إِذَا أَحَبَّ عَبْدًا دَعَا جِبْرِيلَ فَقَالَ: إِنِّي أُحِبُّ فُلَانًا فَأَحِبَّهُ، قَالَ: فَيُحِبُّهُ جِبْرِيلُ، ثُمَّ يُنَادِي فِي السَّمَاءِ فَيَقُولُ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ فُلَانًا فَأَحِبُّوهُ، فَيُحِبُّهُ أَهْلُ السَّمَاءِ، قَالَ ثُمَّ يُوضَعُ لَهُ الْقَبُولُ فِي الْأَرْضِ، وَإِذَا أَبْغَضَ عَبْدًا دَعَا جِبْرِيلَ فَيَقُولُ إِنِّي أُبْغِضُ فُلَانًا فَأَبْغِضْهُ، قَالَ فَيُبْغِضُهُ جِبْرِيلُ، ثُمَّ يُنَادِي فِي أَهْلِ السَّمَاءِ إِنَّ اللهَ يُبْغِضُ فُلَانًا فَأَبْغِضُوهُ، قَالَ: فَيُبْغِضُونَهُ، ثُمَّ تُوضَعُ لَهُ الْبَغْضَاءُ فِي الْأَرْضِ.
‘আল্লাহ
তা‘আলা যদি কোন বান্দাকে পসন্দ করেন তখন জিবরীল (আঃ)-কে ডাক দেন এবং বলেন,
নিশ্চয়ই আমি অমুক লোককে পসন্দ করি, তুমিও তাকে পসন্দ কর। তিনি বলেন, তখন
জিবরীল (আঃ) তাকে পসন্দ করেন। অতঃপর তিনি আকাশমন্ডলীতে ঘোষণা দিয়ে বলেন,
নিশ্চয়ই আল্লাহ অমুক লোককে পসন্দ করেন, সুতরাং আপনারাও তাকে পসন্দ করুন।
তখন আকাশবাসীরা তাকে পসন্দ করে। তিনি বলেন, এরপর দুনিয়াতে তাকে নন্দিত,
সমাদৃত করা হয়। আর আল্লাহ যদি কোন লোকের উপর রাগ করেন তখন জিবরীল (আঃ)-কে
ডাক দেন এবং বলেন, আমি অমুক বান্দার উপর রাগ করেছি, তুমিও তার প্রতি নারায
হও। তিনি (ছাঃ) বলেন, তখন জিবরীল (আঃ) তার উপর রাগাম্বিত হন। তারপর তিনি
আকাশবাসীদেরকে ডাক দিয়ে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা অমুকের উপর রাগান্বিত।
কাজেই আপনারাও তার উপর ক্রোধাম্বিত হোন। তিনি বলেন, তখন লোকেরা তার উপর
দুশমনি পোষণ করে। তারপর তার জন্য পৃথিবীতে শক্র বানিয়ে দেয়া হয়’।[24]
সুতরাং কোন বান্দা যদি গোপনেও আল্লাহর অবাধ্যতা করে এবং পাপে লিপ্ত হয়,
তার প্রতি মানুষের অন্তরে ঘৃণা সৃষ্টি হয়। আর যে যদি গোপনেও আল্লাহর
আনুগত্য করে এবং তাঁকে ভয় করে, মানুষের হৃদয়ে তার প্রতি মহাববত পয়দা হয়।
যায়েদ ইবনু আসলাম (রাঃ) বলেন, مَنِ اتَّقَى اللهَ حَبَّهُ النَّاسُ وَإِنْ
كَرِهُوا ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, মানুষ তাকে গোপনে ভালোবাসে, যদিও প্রকাশ্যে
তাকে অপসন্দ করে’।[25] আবূদ্দারদা (রাঃ) বলেন, إن
العبد ليخلو بمعصية الله تعالى، فيلقي الله بغضه في قلوب المؤمنين من حيث
لا يشعر ‘মানুষ যখন নির্জনে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতা অব্যাহত রাখে, তখন
আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের অন্তর সমূহে তার প্রতি অপসন্দনীয়তা এমনভাবে স্থাপন
করেন যে, সে বুঝতেই পারে না’।[26]
৯. পাপ আল্লাহ ও বান্দার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে :
পাপের কারণে আল্লাহ ও তার বান্দার মাঝে দূরত্ব তৈরী হয়। অনেক সময় মনে প্রশ্ন আসতে পারে, আমি মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করি, কিন্তু মানুষ আমার সাথে ভালো ব্যবহার করে না কেন? আমি আমার সন্তানদের জন্য এত কষ্ট করি, তাদেরকে এতো ব্যয় করি, তবুও তারা আমার অবাধ্য কেন? স্ত্রীকে এতো ভালোবাসি, কিন্তু সে আমার আনুগত্য করছেনা কেন? তাহলে জেনে রাখা দরকার যে, আমাদের প্রকাশ্য ও গোপন পাপগুলোই এর মূল কারণ। আমাদের পাপের কারণে মহান আল্লাহ আমাদের প্রতি রাগান্বিত হন, তাই সৃষ্টিকুলও আমাদের অবাধ্য হয়। কোন এক সালাফী বিদ্বান বলেছেন, لأعصي الله سبحانه، فأرى ذلك في خلق دابتي وامرأتي ‘আমি যখন আল্লাহ অবাধ্যতা করি, তখন আমি এর কুপ্রভাব আমার বাহন ও আমার স্ত্রীর আচার-আচরণের মাঝে দেখতে পাই’।
১০. পাপ ভাল-মন্দের পার্থক্য করার যোগ্যতা নষ্ট করে দেয় :
অনবরত গুনাহ করার ফলে পাপী ব্যক্তির হৃদয় ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, হালাল-হারামের মাঝে পার্থক্য করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। ফলে ঘোর অন্ধকারে তার জীবন ছেয়ে যায়। তবে সে যদি আল্লাহকে ভয় করে পাপ থেকে তাওবাহ করে ফিরে আসে। তাহলে তাকে আবার সেই যোগ্যতা প্রদান করেন। আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَتَّقُوا اللَّهَ يَجْعَلْ لَكُمْ فُرْقَانًا وَيُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ ‘হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাহলে তিনি তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দিবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর মহাকল্যাণের অধিকারী’ (আনফাল ৮/২৯)।
উপসংহার :
আলোচ্য নিবন্ধে পাপের কতিপয় দুনিয়াবী প্রভাব আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর আখেরাতে এর ভয়ানক প্রতিফল তো আছেই। সুতরাং জান্নাত পিয়াসী মুমিন বান্দার কর্তব্য হ’ল যাবতীয় ছোট-বড়, গোপন-প্রকাশ্য সকল পাপ থেকে বিরত থাকা এবং শয়তানের প্ররোচনায় কখনো পাপ করে ফেললে সাথে সাথে তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করা। তা না হ’লে আমরা দুনিয়াতে যেমন লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হব, তেমনি আখেরাতেও মহা আযাবের সম্মুখীন হব। মহান আল্লাহ আমাদেরকে পাপ থেকে বিরত থাকার এবং তাওবা করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মুজাহিদুল
ইসলাম
[লেখক : কুল্লিয়া ১ম বর্ষ, নওদাপাড়া মাদরাসা, রাজশাহী, ও সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রাজশাহী সদর]
[1]. বাংলা একাডেমী, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃ:৭৪৬।
[2]. হামিদ মুছলেহ, আল-মা‘আছী ও আছারুহা, পৃ:৩০।
[3]. মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ৮/২৬৯।
[4]. তাফসীরে মারাগী ৪/ ১৬১
[5]. মুসলিম হা/২৫৫৩; তিরমিযী হা/২৩৮৯; মিশকাত হা/৫০৭৩।
[6]. আল-মা‘আছী ও আছারুহা, পৃ:৩৯।
[7]. মাদারিজুস সালেকীন ১/৩৪২।
[8]. ইবনুল কাইয়ুম, আল-জাওয়াবুল কাফী (আদ্দা-উ ওয়াদ্দাওয়া) পৃ: ৪২-৪৩।
[9]. বুখারী হা/৩৬০৬; মুসলিম হা/১৮৪৭।
[10]. ইবনে মাজাহ হা/৪০২২; সনদ হাসান। তবে ‘মানুষ তার পাপকাজের দরুন তার প্রাপ্য রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়’ অংশটুকু যঈফ।
[11]. দীওয়ানে ইমাম আলী, পৃ: ২১৫।
[12]. রাওযাতুল মুহিববীন, পৃ: ৪৪১।
[13]. বুখারী হা/২০৬৭; মুসলিম হা/৬৬৮৭; আবু দাঊদ হা/১৬৯৩।
[14]. ইবনুল কাইয়িম, আল-জাওয়াবুল কাফী, পৃ: ৫৮।
[15]. শারহুত ত্বাহাবিয়্যাহ, পৃ: ২০৪; হিলয়াতুল আওলিয়া ৮/২৭৯; আল-মুজালাসা ওয় জাওয়াহিরিল ইলম ২/৩০।
[16]. ছহীহ মুসলিম হা/১৪৪।
[17]. তিরমিযী হা/৩৩৩৪; ইবনু মাজাহ হা/৪২৪৪; সনদ হাসান।
[18]. তাফসীরে কুরতুবী ১৯/২৫৯।
[19]. ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯; ছহীহাহ্ হা/১০৬; সনদ হাসান।
[20]. বুখারী হা/৩৪৮৩; মিশকাত হা/৫০৭২।
[21]. নাসাঈ হা/৫০০৬; ইবনু মাজাহ হা/৫৮; সনদ ছহীহ ।
[22]. তিরমিযী হা/২৪৬৬; ইবনু মাজাহ হা/৪১০৭; মিশকাত হা/৫১৭২; সনদ ছহীহ।
[23]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯৪৫; মিশকাত হা/৬২৭; ছহীহ হাদীছ।
[24]. মুসলিম হা/২৬৩৭; মিশকাত হা/৫০০৫; ছহীহ হাদীছ।
[25]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৩/২২২।
[26]. ইবনুল জাওযী, ছায়দুল খাত্বের, ১৮৬ পৃ: