মাওলানা আব্দুল্লাহ সালাফী

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 13224 বার পঠিত

[জমঈয়তে আহলেহাদীছ পশ্চিমবঙ্গ-এর আমীর, ‘সরল পথ’ ট্রাস্ট্রের চেয়ারম্যান, প্রবীণ আলেমে দ্বীন, আহলেহাদীছ আন্দোলনের একজন মুখলিছ সিপাহসালার মাওলানা আব্দুললাহ সালাফী (জন্ম : ১৯৬০)। যিনি ভারত উপমহাদেশে বালাকোট, বাঁশের কেল্লা, মুলকা, সিত্তানা, চামারকান্দ, আসমাস্ত ও আন্দামানের স্মৃতি বিজড়িত রক্তাক্ত ইতিহাসে গড়া সন্তান। জেল-যুলুমসহ শত বাধাবিপত্তিকে তিনি হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে আখেরাত লক্ষ্যপানে স্থির থেকে জীবনকে করেছেন ধন্য। এই ঈমানী তেজোদ্দীপ্ত, আল্লাহর পথের লড়াকু সৈনিক আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশে-এর ত্রিশতম বার্ষিক জাতীয় তাবলীগী ইজতেমা-২০২০-এ মেহমান হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। অনাড়ম্বর জীবন-যাপন, স্বহস্তে রূযী উপার্জনে অভ্যস্ত, সদা হাস্যোজ্জ্বল, তদানীন্তনকালে ভারতীয় মাদরাসা বোর্ডে স্ট্যান্ডকারী ছাত্রের স্মৃতিধন্য জীবনযুদ্ধ সামনে আনার লক্ষ্যে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার তাওহীদের ডাক পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হ’ল। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন তাওহীদের ডাক সহকারী সম্পাদক মুখতারুল ইসলাম]

তাওহীদের ডাক : দীর্ঘ সফর শেষে আপনি ইজতেমায় আসলেন। এখন কেমন বোধ করছেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : আলহামদুলিল্লাহ, সফরটি অভাবনীয়ভাবে খুব সহজ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। এখন অসম্ভব ভাল লাগছে। সাথে তাজাম্মুল হক ও গোলাম রববানী সফরসঙ্গী হিসাবে এসেছে সুতরাং কোন কষ্ট হয়নি। তাজাম্মুল হক ‘সরল পথ’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক এবং গোলাম রাববানী আমাদের সংগঠনের একজন দায়িত্বশীল।

তাওহীদের ডাক : আপনি কি পিতৃসূত্রেই আহলেহাদীছ ছিলেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : হ্যাঁ, বংশীয়ভাবেই আমরা আহলেহাদীছ। প্রথমেই আমার বংশীয় সমাচার কিছু বলে নেওয়া ভাল। আমার দাদা আব্দুল ক্বাইয়িম বীরভুম জেলার ছাতিনা গ্রামের একজন বড় মাপের আহলেহাদীছ আলেম ছিলেন। আমার দাদা হাদীছেও খুব ভালো পন্ডিত ছিলেন। আমার দাদার হাতের লেখা দেখেছি। একদম টাইপের মত। শুধু তাই নয়, তার বিদ্যাবত্তা ও দাওয়াতী কর্মকান্ড খুবই ঈর্ষণীয় ছিল। তাঁর দাওয়াতে অনন্তপুর, কানাইপুরসহ বেশকিছু হানাফী গ্রাম আহলেহাদীছ হয়ে যায়।

তাওহীদের ডাক : আপনার দাদা কোথায় পড়ালেখা করেছিলেন এবং দাওয়াতের তা‘লীম কোথা থেকে পেয়েছিলেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : কোথায়, কতটুকু পড়াশোনা করেছেন তা জানা নেই, তবে ছোটবেলায় আমার আববার মুখে দাদার অনেক গল্প শুনেছি। তিনি ছোট থেকে ছহীহ পদ্ধতিতে ছালাত পড়তে অভ্যস্ত ছিলেন। একবার আব্দুল ওয়াহহাব দেহলভী ছাদরী তার ছালাত আদায় দেখে দাদাকে স্নেহভরে বলেছিল, তুমি আমার কাছ থেকে হাদীছ শিখেছ আর আমি তোমার থেকে ছালাত শিখলাম। সেখান থেকেই বোধহয় তিনি দাওয়াতী মেজাযটা পেয়েছিলেন।

তাওহীদের ডাক : আপনি যে আব্দুল ওয়াহহাব দেহলভী ছাদরীর কথা বলছেন, তিনি কি আমীরে জামা‘আতের থিসিসে (৩৯৬ পৃ.) উল্লেখিত দিল্লীর সেই মোর্দা সুন্নাত যিন্দাকারী বিখ্যাত আহলেহাদীছ বিদ্বান?

আব্দুল্লাহ সালাফী : হ্যাঁ, আমি যতদূর জানি, তিনি ইতিহাস খ্যাত প্রখ্যাত আহলেহাদীছ বিদ্বান শায়খুল কুল মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভী (রহঃ)-এর স্বনামধন্য ছাত্র মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব ছাদরী। যিনি সর্বপ্রথম দিল্লীতে ১২ তাকবীর ও পুরুষ-মহিলা পর্দাসহ একই মাঠে ঈদের জামা‘আত, মাতৃভাষায় খুৎবা প্রদান, জুম‘আতে এক আযান, কালেমায়ে তাওহীদ ও কালামায়ে শাহাদাতের পার্থক্যকরণ, মুসলমানের জীবন বাঁচাতে চরম মূহূর্তে কুফুরী কালাম উচ্চারণ জায়েয, স্ত্রীদের দুষ্ট স্বামীদের হাত থেকে বাঁচাতে খোলা তালাকের বিধানসহ তৎকালীন প্রেক্ষিতে দুঃসাহসিক সব ফতোয়া প্রদান করেন।

উল্লেখ্য যে, ভারতের মাটিতে তথাকথিত হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের নামে গরু কুরবানী প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার যুগান্তকারী সংস্কার হ’ল তিনিই সর্বপ্রথম ঈদুল আযহায় গরু কুরবানী করে মুসলমানদের হারানো সুন্নাতকে পুর্নবহাল করেন; ইংরেজ রচিত আইনতঃ দন্ডনীয় অপরাধ হওয়াকে রুখে দেন এবং পরবর্তীতে তার গরু কুরবানীর ফলে সে আইন রদ হয়ে গিয়েছিল। দিল্লীতে তার প্রতিষ্ঠিত ‘দারুল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ’ মাদরাসাটি আজও তার সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে অক্ষত রয়েছে।

তাওহীদের ডাক : আপনার দাদার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।

আব্দুল্লাহ সালাফী : ১৯৩০ সালে ইংরেজ আমলে আমার দাদার দাওয়াতের ফলে অনেক লোক আহলেহাদীছ হয়ে যাওয়ায় বিরোধী পক্ষ খুবই মর্মাহত হয় এবং তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা দাদার দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ বন্ধ করার জন্য মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম থেকে ইসমাঈল পালোয়ান নামে একজন ব্যক্তিকে ৫০০ টাকার বিনিময়ে ভাড়া করে আনে। তিনি ছিলেন খুবই শক্তিশালী মানুষ। শোনা যায়, তিনি নাকি একাই একটি জ্যান্ত বাঘকে গাছের সাথে ধরে মেরে ফেলেছিলেন।

যাইহোক, মজার ব্যাপার হ’ল যে, ইসমাঈল পালোয়ানই পরে আমার আববার নানুভাইয়ে পরিণত হন। ঘটনাচক্রে তিনি দাদাকে মারতে গিয়ে তাঁর বক্তব্য শুনেন এবং দাদার দিল খোলা বক্তব্য তাকে খুবই প্রভাবিত করে। তিনি ভাবেন যে, এমন একজন সুশ্রী এবং আল্লাহওয়ালাকে মানুষকে আমি কেন মারব? উল্টো তিনি আহলেহাদীছ আক্বীদা গ্রহণ করেন। তিনি আসলে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তিনি তার মেয়ের সাথে আমার দাদার বিয়ের প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, আমার সাথে আপনার যেমন আক্বীদার সম্পর্ক হয়ে গেল, তেমন রক্তের সম্পর্ক গড়তে হবে। আমার মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। অবশেষে দাদা তার পিড়াপিড়িতে প্রথম পক্ষ থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিবাহ করেন। আমার বাবা ছিলেন এই দ্বিতীয় পক্ষেরই সন্তান।

তাওহীদের ডাক : আপনার দাদার ছেলেমেয়ে মোট কয়জন ছিল?

আব্দুল্লাহ সালাফী :  ১ম পক্ষে ৩ ছেলে এক মেয়ে এবং ২য় পক্ষে আমার আববারা ৩ ছেলে। তারা হ’ল আব্দুর রহমান, ইসমাঈল, ইসহাক। আর আমার বাবা মেজো। আমার ছোট চাচা  এখনও বেঁচে আছেন। আমার আববা ইসমাঈল শমসের (১৯৩৬-২০১৪)-এর বয়স যখন আট, তখন আমার দাদা মারা যান।

তাওহীদের ডাক : আপনার আববার কর্মস্থল কোথায় ছিল? তিনি কোথায় পড়াশোনা করেছিলেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : বাবার বাসস্থান বীরভুম হলেও দাদার মৃত্যুর পর তিনি বর্তমান মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। কারণ আমার বাবার ১৮ বছরের বড় চাচা আব্দুর রহমান পরিবারের অভিভাবক হন। সেই সুবাধে চাচার কর্মস্থল (ইমামতি) মুর্শিদাবাদ হওয়ায় সপরিবারে তাদেরকে সেখানেই যেতে হয়। তিনি প্রখর মেধাবী ছিলেন। মুর্শিদাবাদে এসেও তিনি পড়াশুনা অব্যাহত রাখেন। ঐ সময় বাবা ঐতিহাসিক বেলালপুর মাদরাসায় পড়তে চেয়েছিলেন। সে সময় মাদরাসায় কেরোসিন তেল কেনা বাবদ এক টাকা লাগত। সে টাকা দিতে না পেরে বাধ্য হয়ে সাগরদিঘী থানার অন্তর্গত হলদি গ্রামে জায়গীর থাকতেন। সেখান থেকে ২ কি.মি. দূরে যুগোর দারুল হুদা মাদরাসায় পড়াশোনা করেন। বাবার বয়স যখন ১৮, তখন চাচা লেখাপড়ার খরচ চালাতে অপারগতা প্রকাশ করে বাবাকে বিয়ে করতে বাধ্য করেন। এক গরীব পরিবারে বাবাকে বিয়ে দিয়ে দেন। অবশেষে তিনি অনেক কষ্ট করে দাওরায়ে হাদীছ শেষ করেছিলেন।

বিয়ের সময় নানার সাথে আমার বাবার কথা ছিল যে, তুমি যতদিন পড়বে ততদিন আমার বাড়ীতে থাকবে। কিন্তু কয়েক মাস পর নানা বললেন, হয় আমার মেয়েকে তালাক দাও, না হয় মেয়েকে সাথে নিয়ে যাও। বাবা তো ইয়াতীম ছিলেন। তার তো জায়গা-জমি ছিল না। কোথায় নিয়ে যাবেন? তাই পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আম্মাকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এদিকে আম্মার কান্নাকাটির কথা গ্রামের লোকজন জানতে পারল। তখন বলল, আমরাই তোমাকে জায়গা দিব। মজার ব্যাপার হ’ল ঐ সময়ের বিত্তশালী ব্যক্তিরা কেউ জায়গা দেয়নি। বরং একজন ভিক্ষুক তার দু’টি ঘরের একটি বাবাকে ছেড়ে দেয়।

তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম কোথায় ও কত সালে? আপনারা কয় ভাই-বোন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : ১৯৬০ সালের ১৭ই রামাযানে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘী থানাধীন হলদি গ্রামে আমার জন্ম। আমরা ৬ ভাই ও ৪ বোন। সকলেই এখনও বেঁচে আছে। আলহামদুলিল্লাহ আমার সকল ভাই-ই আলেম। আর আমি সবার বড়।

তাওহীদের ডাক : আপনার পড়াশোনা কিভাবে শুরু হলো?

আব্দুল্লাহ সালাফী : প্রাইমারী স্কুলের পরে আমার ছোট চাচা মাওলানা ইসকারের কাছে মক্তবে কুরআন মাজীদ শিখি। ১২ বছর বয়সে বাবা বীরভুমের ‘রিয়াযুল ঊলুম মহিশাডহরী’ মাদরাসায় হিফয করতে পাঠালেন। সেখানে অন্ধ হাফেয উস্তাদ সাইদুর রহমান অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ ছিলেন। মজার ব্যাপার ছাত্ররাও সবাই অন্ধ ছিল। একমাত্র আমি চক্ষুষ্মান ছিলাম। সে সময় গ্রামের লোকজন আমাকে খুবই বিভ্রান্ত করেছিল যে, তুমিও হিফয করে অন্ধ হয়ে যাবে। তখন সমাজের মানুষের বিশ^াস ছিল অন্ধরা ছাড়া কেউ হিফয করে না। সাত পারা মুখস্থ করার পর আর হিফয করা হ’ল না।

এরপর বীরভুমের শুক্রাবাদ মাদরাসায় আববার পরিচয়ে ভর্তি হলাম। সেখানে একবছর উর্দু-ফার্সী শিখলাম। এরপর লালগোলায় বুলুগুল মারামের অনুবাদক মাওলানা মমতাযুদ্দীন ছাহেবের মাদরাসায় গেলাম। কিন্তু সেখানে বেশী দিন পড়ালেখা করতে পারিনি। কেননা মাদরাসা থেকে ছয় মাইল দূরে আমার জায়গীর থাকা খুবই কষ্টকর ছিল। বিধায় এখান থেকে বীরভুমের লোহাপুর মাদরাসায় গেলাম, যেখান থেকে আমার আববা দাওরায়ে হাদীছ শেষ করেছেন। এই মাদরাসায় উত্তর প্রদেশের এক বড় আলেম ওমর গৌরনভী ছিলেন। এখানে আমি দু’বছর প্রথম হওয়ায় আমার এক উস্তাদ তাযীরউদ্দীন ছাহেব আমাকে উত্তর প্রদেশের মিশকাতের ভাষ্যকার মাওলানা ওবাইদুল্লাহ মোবারকপুরীর ‘দারুত তা‘লীম মোবারকপুর’ মাদরাসা পাঠিয়ে দিলেন। শুনেছি রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনী গ্রন্থ ‘আর-রাহীকুল মাখতুম’-এর লেখক মাওলানা ছফীউর রহমান মোবারকপুরীও এই মাদরাসার প্রাথমিক ছাত্র ছিলেন।

এখানে ভর্তি পরীক্ষা আমার উস্তাদ শায়খ আব্দুর রব বললেন, তুমি কি কি পড়েছ? আমি বললাম, বুলূগুল মারাম। তিনি বললেন, বই খুলে পড়। আমি পড়লাম ‘বাবু সুতরাতিল মুছাল্লী’। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, মুছাল্লী পড়ছ, মুছাল্লা কেন নয়? সে সময় মুছাল্লী ও মুছাল্লা পার্থক্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। উস্তাদ আমাকে বললেন, তুমি গ্রামারে কাঁচা আছ। তাই আমাকে দু’ক্লাস নিচে ছানিয়াতে নামিয়ে দিলেন। এখানে এক বছর পড়ার পর আমি মানসিকভাবে এমন আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম যে, দুনিয়ার আর কিছু আমাকে আটকাতে পারবে না। এখানে প্রথম পরীক্ষায় দ্বিতীয় হলাম এবং বার্ষিকে প্রথম হলাম। তারপর আলহামদুলিল্লাহ জীবনে আর কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

তাওহীদের ডাক : দারুত তা‘লীম মোবারকপুর মাদরাসায় আপনি কতদিন ছিলেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : উক্ত ঘটনার পর মাদরাসায় এক গুরুতর সমস্যা দেখা দিল। সকাল থেকে ১২টা পর্যন্ত ও যোহর পর থেকে আছর পর্যন্ত দু’বেলা ক্লাস হতো। দুপুর পর পড়া ছাত্রদের জন্য কষ্টকর হলো। এতে ছাত্ররা আন্দোলন করল। যখন ছাত্ররা বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত চলে আসল, তখন উস্তাদ নূরুল আল-আযমী সকলকে ডেকে পাঠালেন। এতে সব ছাত্ররা মাদরাসায় ফিরে গেল। কিন্তু আমি আর ফিরে গেলাম না। কারণ আমি যেখান থেকে ফিরে এসেছি আর সেখানে যাব না।

বাড়ী ফিরে এসে জামে‘আ সালাফিয়া বেনারস মাদরাসায় ভর্তির জন্য ‘মির‘আতুল মাফাতীহ’ থেকে পড়া শুরু করলাম। ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলাম। ৭২জন ছাত্র পাস করল। আর সিরিয়ালে আমি প্রথম স্থান অর্জন করলাম। ভর্তি হওয়ার সময় সমস্যা হ’ল টিসির। কারণ আমি কোথা থেকে এসেছি? ট্রান্সফার সার্টিফিকেট আমার ছিলনা। আমি তো মাদরাসায় বছর শেষ না করে চলে এসেছি। পরে উস্তায নূরুল আল-আযমী বেনারসে এসে সুফারিশ করে গেলেন যে, আব্দুল্লাহকে কিছু বলবেন না। সে আমার কাছে পড়েছে। পরবর্তীতে মাদরাসার সেক্রেটারী এসে আফসোস করলেন। কিন্তু তিনি সুফারিশ করে গেলেন। ফলে আলহামদুলিল্লাহ আমার সমস্যা মিটে গেল। অতঃপর আমি ১৯৮৬ সালে সেখান থেকে ফারেগ হই এবং পরবর্তীতে আমি ১৯৯১ সালে টাইটেল পরীক্ষা দিয়ে ওয়েস্ট বেঙ্গলের ফাস্ট বোর্ড স্টার্ডধারী ছাত্র হিসাবে সম্মানজনক সাফল্যের সাথে পাশ করি।

তাওহীদের ডাক : আমাদের জানামতে জামে‘আ সালাফিয়া বানারসের সাথে সঊদী আরবের মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মু‘আদালাহ রয়েছে। তাহলে আপনি মদীনায় কেন গেলেন না? এটা নিয়ে আপনার আফসোস হয় কি?

আব্দুল্লাহ সালাফী : আমাদের ব্যাচ থেকে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পদ্ধতি পরিবর্তন হওয়ায় আর যাওয়ার সুযোগ হয়নি। আগে ফযীলত শেষ করে যাওয়া যেত। কিন্তু পরে সেটা আলিমিয়াত শেষে যাওয়ার সুযোগ হয়। বড় কথা হ’ল তাকদীরে ছিল না। তাছাড়া আমি মনে করি, মদীনায় না যাওয়াটা আমার জীবনে কল্যাণকরই ছিল। কারণ দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, এ পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি বেশীরভাগ মদীনা ফারেগ ছাত্ররা ইখলাছশূন্য এবং আত্মঅহমিকায় ভরপুর ইল্লা মাশাআল্লাহ। তবুও দো‘আ করি আল্লাহ আমাদের মাদানী ভাইদের প্রকৃত খাদেমুল উম্মাহ হিসাবে কবুল করুন। কেননা শিরক-বিদআতে পরিপূর্ণ সমাজকে সংস্কারের জন্য তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তাওহীদের ডাক : আপনি চাকুরি-বাকরী, পরিবার-পরিজন সম্পর্কে দয়া করে যদি বলতেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : মাওলানা আলীমুদ্দীন নদিয়াভী ছাহেব, যিনি পরে হিজরত করে বাংলাদেশের মেহেরপুরে গমণ করেন, তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা নিজ গ্রাম ছোট পলাশীতে আমি সেকেন্ড মুহাদ্দিছ হিসাবে চাকুরী জীবন শুরু করি। সেখানে ছহীহ মুসলিম সহ অন্যান্য কিতাবাদি এক বছর পড়াই। এরপর হাফেয আইনুল বারী আলীয়াবী তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আহলেহাদীছ এডুকেশন সেন্টার’ বেলডাঙ্গা, মুর্শিদাবাদে আমাকে ডেকে নেন। প্রথমত তিনি আমাদের পীর সাহেবের মত ছিলেন। যদিও পরে আমাদের বিরোধী হয়ে যান। এখানে এসে আড়াই বছর পড়াই। এরপর সেখান থেকে মুর্শিদাবাদের শংকরপুর গ্রামে যাই। এখানে দু’বছর প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজ করি। সব জায়গাতে সংস্কারের কাজ করি। কিন্তু সত্য বলায় কমিটির সাথে বিরোধ হয়। সত্যবাদী হওয়ার ফলে চাকুরী-বাকরীর প্রতি আমার এক প্রকার হতাশা এবং বিতৃষ্ণার জন্ম দেয়। আর এভাবেই চাকুরী-বাকরী থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিই।

আর পরিবার-পরিজন সম্পর্কে বলতে গেলে, আমি জামে‘আ সালাফিয়া থেকে ১৯৮৬ সালে ফারেগ হওয়ার এক বছর পূর্বেই অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে বিবাহ করি। আমার শ্বশুর-শাশুড়ীর বাড়ী গ্রামেই হওয়ায় তাদের সম্পর্কে আমার জানা ছিল যে, তারা যৌবনকাল থেকে তাহাজ্জুদ ছালাত আদায়ে অভ্যস্ত। ফলে আমার বিশ্বাস ছিল যে, তাহাজ্জুদগুজারী ব্যক্তির মেয়ে কখনো খারাপ হতে পারে না। সেকারণ আমার  ২৫ বছর এবং স্ত্রীর ১৩ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। এজন্য আমাকে খুবই ধৈর্য ধরতে হয়েছে। তবে আলহামদুলিল্লাহ স্ত্রী আমার খুবই আনুগতা। আমার ছেলেমেয়েরাও মাশাআল্লাহ। আমার ৪ মেয়ের বিয়ে-শাদী সম্পন্ন হয়েছে এবং দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে এবার মাধ্যমিক পড়ছে এবং ২য় ছেলে আমাদের নিজেদের স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ছে।

তাওহীদের ডাক : আপনি কি এখন কোন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : দাওয়াতী কাজে আঞ্জাম দেওয়ায় কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত নেই। বর্তমানে ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পশ্চিম বাংলা’ সংগঠনের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি। এই সংগঠনটি পশ্চিমবাংলাকেন্দ্রিক। মালদা যেলার সাঈদুর রহমান মাদানী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। 

তাওহীদের ডাক : পশ্চিম বাংলায় আহলেহাদীছদের আর কোন সংগঠন আছে কি?

আব্দুল্লাহ সালাফী : পশ্চিম বাংলায় ‘মারকাযে জমঈতে আহলেহাদীছ’ নামে সংগঠন আছে। এর ইমারতের দায়িত্বে আছেন জামি‘আ সালাফিয়া বেনারসে পড়ুয়া আমাদের এক বছরের সিনিয়র ভাই আসগর আলী। এই সংগঠনটি কাগজে-কলমে আছে। বছরে দু’একটি জালসা করে। এ পর্যন্তই তাদের কার্যক্রম। আর পুরো ভারতে আমাদের পুরাতন সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া জমঈতে আহলেহাদীছ হিন্দ’ আছে। তাদের দাওয়াতী তৎপরতাও গতিশীল নয়। ফলে তাদের সাথে মতবিরোধ হলো। আইনুল বারী সাহেবের সাথেও মতবিরোধ হলো। উনারা আমাদের বাদ দিয়ে দিলেন। তবে এই দাওয়াতী কাজ যেহেতু আল্লাহর নির্দেশ, তাই আমরা কাজ করতেই থাকলাম। গোটা পশ্চিম বাংলাতে আমাদের আন্দোলন বিস্তৃত। পশ্চিমবঙ্গে ২৩টি যেলার মধ্যে প্রায় ১৮টিতে আমাদের কার্যক্রম বিদ্যমান আছে।

তাওহীদের ডাক : আপনাদের সাংগঠনিক কাঠামো কি আমাদের মতই?

আব্দুল্লাহ সালাফী : না, একটু ভিন্নতা রয়েছে। আমাদের সংগঠনে আপনাদের মতই আমীর পদ রয়েছে; তবে নায়েবে আমীর পদ নেই। কাযিউল কুযাত পদে একজন আমীরের অবর্তমানে নায়েব হিসাবে কাজ করে থাকেন। এছাড়াও একজন সেক্রেটারী এবং সহযোগী সেক্রেটারী একাধিক আছেন। তবে আপনাদের সাংগঠনিক স্তর যেমন শাখা, এলাকা, উপযেলা, যেলা এবং কেন্দ্র এবং তাবলীগ, তানযীম, তারবিয়াত এবং তাজদীদে মিল্লাত নামে সুশৃংখল কর্মসূচী রয়েছে, আমাদের তেমনটি নেই।

তাওহীদের ডাক : আপনি ‘সরলপথ ট্রাস্ট’-এর কথা বলছিলেন। যদি এর কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের কিছু জানাতেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : আমি ‘সরলপথ ট্রাস্ট’-এর চেয়ারম্যান হিসাবে এর সরাসরি দেখভাল করি। আগে বলে নেই ছিরাতে মুস্তাকিমের বাংলা হ’ল ‘সরল পথ’। ভারতীয়রা আরবী নাম শুনলে ভাবে এতে কোন জঙ্গী কার্যক্রম হচ্ছে কি না? তাই বাধ্য হয়েই এই নাম দিয়েছি। এই ট্রাস্টের অধীনে ২০১৩ সালে মুর্শিদাবাদের ওমরপুরে ‘সরল পথ স্কুল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছি। এখানে ছাত্রসংখ্যা প্রায় ৩৫০ এবং শিক্ষক সংখ্যা ২৬ জন। এর লক্ষ্য হাদীছশাস্ত্রে তাখাচ্ছুছ পর্যন্ত পড়ানো। এবার ছাত্ররা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল। এরপর উচ্চ মাধ্যমিক খুলেছি। নেযামী বিভাগে ক্লাস নাইন পর্যন্ত খুলেছি। হিফয বিভাগে তিনজন শিক্ষক রেখেছি। বালিকাদের জন্যও বেলডাঙ্গা মুর্শিদাবাদে ‘সরল পথ গার্লস একাডেমী’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। আমি তাদের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে আছি। শুধুমাত্র সহযোগিতা করে থাকি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন আমরা করিনা।

এতদ্ব্যতীত এ ট্রাস্টের অধীনে কোন ভুর্তুকি ছাড়াই ‘সরলপথ’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করি। এর প্রচারসংখ্যা সাড়ে ছয় হাজার। আমার সফরসঙ্গী তাজাম্মুল হক সালাফীর সম্পাদনায় প্রায় ধারাবাহিকভাবে ১২/১৩ বছর থেকে পত্রিকাটি চালু আছে।

তাওহীদের ডাক : দাওয়াতের মাঠে আপনারা কি বাধার সম্মুখীন হন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দাওয়াতী ময়দানে সব চাইতে বাধা পেতে হয় বড় বড় আলেমদের মাধ্যমে। যদিও তাদের সাথে অনেকবার বসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনদিন আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি।

তাওহীদের ডাক : আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের সাথে আপনার পরিচয় হয় কিভাবে?

আব্দুল্লাহ সালাফী : আমীরে মুহতারাম ড. গালিব ভাইয়ের সাথে আমার সর্বপ্রথম পরিচয় হয়, যখন তিনি থিসিস লেখার সময় ভারতে গিয়েছিলেন। ভারতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন। এর ধারাবাহিকতায় তিনি কিষাণগঞ্জ যান। তিনি মুর্শিদাবাদে কারা আহলেহাদীছদের প্রাণপুরুষ আছেন, তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। তখনই তাঁর সাথে আমার পরিচয়। পরবর্তীতে তাঁরই দাওয়াতে ১৯৯৮ সালে তাবলীগী ইজতেমায় যোগদান করেছিলাম। এরপরও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে নিয়মিত আসা-যাওয়াতে ড. গালিব ভাইয়ের সাথে আমার অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি পায় এবং তা ঘনিষ্ট বন্ধুত্বে পরিণত হয়। ফালিল্লাহিল হামদ।

তাওহীদের ডাক : ২০০৫ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী সন্ত্রাসবাদের তকমা দিয়ে আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারকে গ্রেফতারের সংবাদটি আপনারা ইন্ডিয়াতে কিভাবে পেয়েছিলেন এবং আপনাদের প্রতিক্রিয়া কি ছিল?

আব্দুল্লাহ সালাফী : ইন্ডিয়াতে তখন এ রিপোর্টটি পত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে হাইলাইট করে ছেপেছিল। কিছুই তো করার নেই। আমরা খুব দুঃখবোধ করছিলাম যে, আলেমদের উপর বাংলাদেশ সরকার কেন অহেতুক নির্যাতন চালাচ্ছে? যারা সমাজ থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধের চেষ্টা চালাচ্ছে আর তাদেরকেই সরকার সন্ত্রাসীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে? এটাতো অন্যায়। কি বলা যাবে। এটা আল্লাহ তা‘আলার পরীক্ষা। যার দ্বীনদারী যত বেশী, তার উপর তত মুছীবত আসে। তার প্রেক্ষিতে এই মুছীবত আসে। এছাড়া এর ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। আল্লাহ তা‘আলা এ দেশের সরকারকে হেদায়াত করুন। আর যেন এভাবে কোন নিরাপরাধ ব্যক্তিকে কষ্ট পেতে না হয়। এটা অন্যায়।

তাওহীদের ডাক : আপনার বিরুদ্ধেও অনুরূপ একটা কেস হয়েছিল শুনেছিলাম, যেটা আপনাকে চরম ভোগান্তিতে ফেলেছিল। সেটার কি অবস্থা?

আব্দুল্লাহ সালাফী : হ্যাঁ, দুইবার এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রথমবার ১৯৯৮ সালে ইজতেমা শেষে ভারত যাওয়ার পর ১৯৯৯ সালে আমাকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে প্রশাসন অ্যারেস্ট করে। সে সময় ড. গালিব ভাইকে জড়িয়ে ভারতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও বের হয়েছিল। ফলে বিষয়টি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার অবস্থা সৃষ্টি করে। অথচ এ ব্যাপারে গালিব ভাই কিছু জানেন না; আমিও কিছু জানিনা। কোন কিছুই জানিনা। তারপরও মিথ্যা প্রচার করা হয়। আমি একদম নিরীহ মানুষ। সাধারণ জীবন যাপন করি। মুসলিম- অমুসলিম নির্বিশেষে কারো সাথে কোন বিবাদ-বিসম্বাদ করিনা। আর কোন পলিটিক্যাল পার্টির সাথেও জড়িত নই। আবার যারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে তাদেরও সমর্থন করি না। সালাফী মানহাযের প্রচারে কাজ করছি। অথচ আমাকে তারা অ্যারেস্ট করল। মানসিক ও শারীরিক টর্চার করল। বিশেষ করে মানসিক টর্চারটা বেশী করেছে। প্রায় ৯৫ দিন জেলে ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ এরপর জামিনে মুক্ত হই। পরে দীর্ঘ ১৯ বছর যাবৎ কেসটা চলেছে। এই ১৯ বছরে মুর্শিদাবাদ থেকে কোলকাতা প্রায় ২৫০কি.মি যাতায়াত করতে হয়েছিল। সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল ছিল না। গাড়িঘোড়া তেমন উন্নত ছিলনা। খুবই কষ্ট করে যাতায়াত করতে হত। ১৫ দিন অন্তর অথবা কখনও ১ সপ্তাহ পরপর ডেট পড়ত। ফলে খুবই ভোগান্তির শিকার হয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বেকসুর খালাস পাই। দুঃখ হয় ২০১৪ সালে আমার আববা মারা যান। তিনি তার জীবদ্দশায় আমার জন্য খুবই কষ্ট করেছেন। অনেক দৌঁড়ঝাপ করেছেন। আমার কেসের রেজাল্টটা দেখে যেতে পারলে খুবই ভালো লাগত এবং তিনি অত্যন্ত খুশী হতেন। 

দ্বিতীয়বার যখন ভারত সরকার ২০০২ সালে ইসলামিক স্টুডেন্ট মুভমেন্ট নামক একটি সংগঠনকে ব্যান্ড করে, তখন অহেতুক আমাকে নামের বিভ্রাটে গ্রেফতার করে ও এজন্য ৬২ দিন আমাকে জেল খাটতে হয়। তারপরে জামিনে মুক্তি পাই। চার্জশীটে আমার নাম না আসায় এমনিতেই কেস থেকে রেহাই পেয়ে যাই।

তবে আমার তখন ভাল লেগেছিল এজন্য যে. যখন সমস্ত আবোল-তাবোল, মিথ্যা প্রচারকারী পত্রিকাগুলো ফলাও করে আমার বেকসুর খালাসের কথা প্রচার করেছিল। যদিও তারা কোন ইসলামী ব্যক্তিত্বের কথা প্রচারে খুবই কৃপণ। আলহামদুলিল্লাহ আমার ক্ষেত্রে তাদের ভিন্ন চরিত্রই দেখেছি।

তাওহীদের ডাক : আপনার সংগ্রামী জীবন ও দাওয়াতী ময়দানে সরব পদচারণার ক্ষেত্রে বিশেষ কোন আলেমের প্রভাব রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : আমি যার প্রেরণায় অনুপ্রাণিত, তিনি আমার নানা শ্বশুর মাওলানা ওমর আলী ছাহেব। তিনি বড় আলেম ও সুবক্তা ছিলেন। কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ ছাড়া কোন কথা বলতেন না। এই পরহেযগার মানুষটি কোন মজলিসে বক্তব্য রাখলে সবাই কাঁদতেন। তবে আমারও সেই ধরনের ইচ্ছা ছিল যে, সবসময় কুরআন-হাদীছ অনুযায়ী বক্তব্য রাখতে হবে। এজন্য ছাত্র জীবনে প্রচুর কুরআন-হাদীছ মুখস্থ করেছিলাম। পরবর্তীতে তাঁর সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কেই জড়িয়ে পড়ি।

আর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে যাকে আমার খুবই ভাল লেগেছিল, তিনি হলেন আমার বুখারীর উস্তাদ ও ‘আর রাহীকুল মাখতুম’ এর খ্যাতনামা লেখক মাওলানা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী। আমি তার দ্বারা দাওয়াতের ক্ষেত্রে খুবই অনুপ্রাণিত হই এবং চাকুরীই ছেড়ে দিয়েছিলাম। তিনি আমাকে একদিন বলেছিলেন, আমি জানি তোমাকে দিয়ে হবে না। তুমি অন্য কিছু কর। এরপর তিনি আমাকে ‘আর-রাহীকুল মাখতুম’ বিক্রয়ের জন্য দোকানঘর তৈরী, অনুবাদ ও বই ছাপানোর জন্য আড়াই লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। আমি পরবর্তীতে সম্পূর্ণ টাকা ফেরৎ দিয়ে দিয়েছি। মুদারাবা সিস্টেমে যদিও তাকে খুব বেশী লভ্যাংশ দিতে পারিনি। আল-হেলাল বুক হাউজ, সাগরদিঘী বাজার, মুর্শিদাবাদের দোকানটি এখনও আছে। দ্বীনী দাওয়াতে সব সময় বাহিরে থাকার কারণে দোকানেও ঠিকমত বসা হয় না। ফলে উল্লেখযোগ্য কোন মুনাফা পাওয়া যায়না। শুধু দ্বীনী দাওয়াত ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে দোকানটি এখনো আমি ধরে রেখেছি।

তাওহীদের ডাক : যথেষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আপনি সরকারী চাকুরীর চেষ্টা করেননি কেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : আমি ছেলেদের অছিয়ত করে দিয়েছি সরকারী চাকুরী পেলেও করবে না। আমি নিজেও সরকারী চাকুরী পেয়েও করিনি। আমি ১৯৯১ সালে যখন টাইটেল পরীক্ষা দেই তখন আমি পশ্চিমবঙ্গে প্রথম স্থান অধিকারকারী ছিলাম। মুর্শিদাবাদ যেলায় আমার থেকে বেশী কারো নাম্বার ছিল না। তবুও সরকারী চাকুরীতে ঢুকিনি। কেননা সরকারী চাকুরি করলে দাওয়াতী যিন্দেগীতে নানা রকম বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। সেটা একজন দ্বীনদার মানুষের জন্য খুব ক্ষতিকর। আপনারা দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি সরকারী চাকুরী হারাম বলছি না। তবে মহান আল্লাহ মানুষের জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা নেওয়ার জন্য এবং তিনি দেখতে চান তোমাদের মধ্যে সবোর্ত্তম আমলকারী কে? আমি মনে করি, এই ছোট্ট যিন্দেগীতে এটা সবোর্ত্তম আমল ও উত্তম কাজের বিরোধী। আমি হালাল রূযী উপার্জন করব উত্তম পন্থায়। রূযীর মালিক তো আল্লাহ। তিনি আমার তাকদীরে যা বরাদ্দ করেছেন, তা তো পাবই।

তাই আমি কোন সময় অলস বসে থাকি না। অবসরে আমি অনুবাদ ও সম্পাদনার কাজ করি। শুধু তাই নয়, সময় পেলে এখনও আমি মাঠে কাজ করি। আমার যেটুকু জমিজমা আছে, এ বয়সে সেখানে চাষবাসের আমি এখনও পরিশ্রম করি। আমার লক্ষ্য একটাই যে হালাল রূযী খেতে হবে। এছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। আলহামদুলিল্লাহ পশ্চিমবাংলায় আমার যে অবস্থান আছে, তাতে আমি চাইলে বসে বসে খেতে পারব। কিন্তু আমি হযরত দাউদ (আঃ)-এর মত নিজে খেটে খেতে পসন্দ করি।

আর আমি এই দু’টো কাজের মধ্যে এভাবে পার্থক্য করি যে, জামা‘আতবদ্ধ ছালাত পড়লে একাকী ছালাত পড়ার চেয়ে ২৭গুণ বেশী ছওয়াব পাওয়া যায়। সুতরাং কেউ যদি একাকী ৪ রাকা‘আত ছালাত পড়ে তাহলে সে শুধু ৪ রাকা‘আতেরই নেকী পাবে। আর যে জামা‘আতে ছালাত পড়বে সে ১০৮ রাকা‘আতের নেকী পাবে। আমাদেরকে হিসাব করতে হবে নেকীর। আমাকে মানুষে বলত, তুমি সরকারী চাকুরী করলে না কেন? আমি বলি, আমি তো স্বসম্মানে বেঁচে আছি। আমার বিল্ডিং না থাকতে পারে। আমার টাকা না থাকতে পারে। কিন্তু আমি কি না খেয়ে মরেছি, নাকি সম্মানের দিক দিয়ে আমার কমতি আছে? আলহামদুলিল্লাহ কোন অসুবিধা নেই।

তাওহীদের ডাক : ভারতে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে আপনাদের কোন সাংগঠনিক কর্মসূচী ছিল কি?

আব্দুল্লাহ সালাফী : এই বিল নিয়ে সারা ভারতে উত্তাল মিছিল-মিটিং হচ্ছে, বিরোধিতা হচ্ছে। কিন্তু আমরা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাই না। সাংগঠনিকভাবে এসব বিষয় নিয়ে অবস্থান নেই না। এজন্যই নেই না যে, এসব করে কিছু হবে না। সূরা রাদের ১১নং আয়াতে আল্লাহ পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ‘কোন জাতির উপর মন্দ ইচ্ছা করলে তাকে খন্ডন করার কেউ নেই’। দুনিয়ার সকল পাপ করবো আর আল্লাহ আযাব পাঠাবেন না, এমনটা কি হয়? এসব আন্দোলন-সংগ্রামের চাইতে ইসলামের জন্য কাজ করলে অনেক বেশী কাজ হতো। মানুষ অহেতুক সময় নষ্ট করছে, শক্তি ক্ষয় করছে, রক্ত ঝরছে। কিন্তু যা হবার তা-ই হচ্ছে। সুতরাং আমরা রাজনীতি নিয়ে সময় নষ্ট করতে রাজি না।

তাওহীদের ডাক : কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে আপনাদের সংগঠনের উপর রাজনৈতিক কোন চাপ সৃষ্টি হয়েছিল কি?

আব্দুল্লাহ সালাফী : আমাদের উপর কোন চাপ নেই। কেননা আমরা এসব নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি করি না। আমরা বক্তব্যে যা বলার বলেছি এবং আমাদের পত্রিকায় লিখিত প্রতিবাদ করেছি।

তাওহীদের ডাক : নির্যাতনের শিকার হলে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করা বা প্রতিবাদ করা জায়েয নয় মনে করেন কি?

আব্দুল্লাহ সালাফী : কথা হচ্ছে মুসলিম বিশ্বে  ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম বুখারী, ইমাম ইবনু তাইমিয়ার মত জগদ্বিখ্যাত সালাফদের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিল। তবুও তারা চরম নির্যাতনের শিকার হয়েও কোন প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে বিক্ষোভ করেননি। বর্তমানে তথাকথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো জিহাদের যে ব্যাখ্যা করছে, তাহলে তারা কি তা জানতেন না?  প্রকৃতপক্ষে তাদের বুঝটাই ছিল প্রকৃত বুঝ। সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করা সালাফদের মানহাজ নয়। বরং তারা আমাদেরকে ছবরের শিক্ষা দিয়েছেন। কুরআন-হাদীছের ভাষ্যানুযায়ী ধৈর্য ও নমনীয়তা দিয়ে যা অর্জিত হওয়া সম্ভব, কঠোরতা ও জবরদস্তি দিয়ে কখনো তা অর্জন করা সম্ভব নয়। 

তাওহীদের ডাক : জঙ্গীবাদ ও চরমপন্থা থেকে বাঁচতে যুবসমাজকে আমাদের কী নছীহত করা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : তাদেরকে ইসলামের প্রকৃত দাওয়াত দিতে হবে। সালাফদের ত্বরীকা তাদের বুঝাতে হবে। চরমপন্থীরা রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের বিকৃতি ঘটাচ্ছে। এর মূলে তো ইহুদীবাদীরা রয়েছে। দূর থেকে তারা নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এরা বুঝতে পারছে না। যুবকরা বুঝতে পারছে না; এমনকি আলেমরাও বুঝতে পারছেন না। তারা কুরআন মাজীদের অপব্যাখ্যা শুনে জিহাদ জিহাদ বলে চিৎকার করছে এবং দলে দলে জান্নাতে যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিচ্ছে। অথচ তারা জানেই না যে, এগুলো কাফের-মুশরিকদের চক্রান্ত যা কুরআন ছহীহ সুন্নাহ সাপোর্ট করেনা। মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ-‘তুমি বল এটাই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ পবিত্র। আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (ইউসুফ ১২/১০৮)

সুতরাং যুবকদের প্রতি আমার পরামর্শ হ’ল- প্রথমতঃ দ্বীনের বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেই কথা বলতে হবে। যুবকদের নিশ্চিত হতে হবে যে, কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর ভিত্তিতে তাওহীদের পথের উপর সে প্রতিষ্ঠিত আছে কি না। এটা নিশ্চিত হয়েই সে মানুষকে দাওয়াত দিবে। না জেনে মানুষকে কোন কথা বলা উচিত নয়। আর এ জন্য যুবদের প্রচুর লেখাপড়া করতে হবে। আর এখন তো আলহামদুলিল্লাহ তাওহীদের পথ খোঁজার জন্য কোন অসুবিধা নেই। ইন্টারনেটের মাধ্যমে জ্ঞান এখন অনেক বেশী সহজলভ্য। আমি আবারো বলছি, একটি বিষয়ের উপর পূর্ণ জ্ঞান অর্জন না করে হালকা বা স্থুল জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষকে ভুল পথে পরিচালনা করা যাবে না। কোন মানুষের দ্বারা কোন মানুষের আক্বীদা বা আমলের ত্রুটি ঘটে, তাহলে তা তারই উপর বর্তাবে। সুতরাং প্রথমে নিজেকে নিশ্চিত হতে হবে যে, আমি যে মানহাজের উপর আছি, এটাই পবিত্র কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক খাঁটি তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত মানহাজ। মনে রাখতে হবে যে, দাওয়াত যুক্তির ভিত্তিতে নয়, উত্তম উপদেশের মাধ্যমে দিতে হবে। কারণ যু্ক্তির দাম ইসলামে নেই।

দ্বিতীয়তঃ রাসূলের অনুসারীদের কাজ হচ্ছে আল্লাহর পথে দিকে আহবান জানানো পূর্ণ ইখলাছ সহকারে। কেননা এই কাজের জন্য ইখলাছ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ- ‘অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং ছালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে। আর এটাই হ’ল সরল দ্বীন’ (বাইয়েনাহ ৯৮/৫)

বর্তমান সময়ে দাওয়াতের ময়দানের ইখলাছের বড় অভাব। সর্বত্র শুধু আত্মপ্রচারের আড্ডা। আজকাল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে খেয়াল করলেই দেখা যায়, আমি এই করলাম, সভা করলাম, বক্তব্য দিলাম ইত্যাদি। এগুলো মানুষের ইখলাছের ঘাটতি ঘটায়। আমার দায়িত্ব হ’ল প্রচার করা। কতজন মানুষ হেদায়াত হ’ল বা না হ’ল সেটা আল্লাহর কাছে। হেদায়াতের মালিক তিনি। কিছু মানুষ কিছু কাজ করলে নিজেকে খুব বড় মনে করে। অথচ আমি যতই কাজ করি, আল্লাহর কাছে সেটা তুচ্ছ। কাকে আল্লাহ ছওয়াব বেশী দেন সেটা আলাদা। আম্বিয়ায়ে কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বীন যে সমস্ত কাজগুলো করছেন, সালাফরা যেভাবে মেহনত করেছেন, তার ১০০০ ভাগের একভাগও আমরা করতে পারব না। সে যোগ্যতা আল্লাহ আমাদেরকে দেয়নি। সে দক্ষতা নেই, পরিস্থিতিও নাই, পরিবেশও নাই। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যতটুকু দিয়েছেন, ততটুকুতেই আলহামদুলিল্লাহ। যুবকদের মাঝে ইখলাছ সৃষ্টি করতে হবে। ইখলাছপূর্ণ কাজ না হ’লে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য আমাদের উপর নেমে আসবে না। আর যদি ইখলাছপূর্ণ কাজ হয়ে, তবে সব কাজ আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

আলোচনার সারমর্ম হ’ল, নিজের অবস্থান স্পষ্ট করা জ্ঞান সহকারে। আমি যখন কোন জিনিসকে সত্য ও তাওহীদ ভিত্তিক বুঝলাম, তখন সেটাকে অন্যের কাছে প্রচার করা। এটা না বোঝার আগে দাওয়াত নয়। আবেগে ভাসলে হবে না। আর কোন বিষয় সম্পর্কে যতক্ষণ পর্যন্ত সুষ্পষ্ট ধারণা না তৈরী হবে এবং আক্বীদার উপর ইস্তিকামাত যতক্ষণ পর্যন্ত না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত দ্বীনের কাজ করতেও ভালো লাগবে না। বরং কাজ করতে বিরক্ত লাগবে। কেননা আপনার ইখলাছের গন্ডগোল আছে। আপনি লাভের অংশটি বুঝতে পারেননি। কোন ব্যক্তি যখন কোন জিনিসের লাভ বুঝতে পাওে, তখন সে জান দিয়ে কাজটি করে। এজন্য পুরাটা বোঝা যরূরী।

তৃতীয়তঃ আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলটা অত্যন্ত যরূরী। কেননা আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল না থাকলে আমি কার জন্য কাজ করছি? আল্লাহ যে সবার উপরে পাওয়ারফুল, সেটা বিশ^াস করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا نَقَمُوا مِنْهُمْ إِلَّا أَنْ يُؤْمِنُوا بِاللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ- ‘তারা তাদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছিল কেবল এ কারণে যে, তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছিল মহাপরাক্রান্ত ও মহাপ্রশংসিত আল্লাহর উপরে’ (বুরূজ ৮৫/৮)

বিরোধীদের রাগের কারণ তো একটাই আমি ঈমান এনেছি। এটা তো ইতিহাস। সুতরাং কাজ করতে হবে। আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল করতে হবে। কোন প্রকার হঠকারিতা করা যাবে না।

তিনি আরো বলেন, فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ ‘অতএব তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছ, তা প্রকাশ্যে ব্যক্ত কর এবং মুশরিকদের উপেক্ষা কর’ (হিজর ১৫/৯৪)

তাই ভালো কাজের আদেশ দিতে হবে এবং যারা ঝামেলা করবে তাদেরকে এড়িয়ে চলতে হবে। কাউকে বিবাদে জড়ানো উচিত নয়। আমাদের বুঝতে হবে যে, আমরা তাওহীদে বিশ্বাসী এবং এই বিশ্বাস প্রকাশের যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে। সুতরাং অকারণ বিবাদে জড়ানোর কিছু নেই। অনেকে ঝামেলায় জড়িয়ে যায়। ঘন্টার পর ঘন্টা বিতর্ক করছে। এটা ভালো কাজ না। এতে লাভের লাভ কিছুই হয় না। সত্য বলতে কি, আমি যদি আল্লাহর জন্য কাজ করি, তাহ’লে আমাকে দেখার জন্য দায়িত্ব কি আল্লাহর নেই? অবশ্যই আছে। সুতরাং পুরো বিশ^াস রেখে কাজ করতে হবে। দেখার দায়িত্ব যখন আল্লাহর আছে, তখন আল্লাহ আমাকে রূযী দিবেন। আমাকে শক্র থেকে রক্ষা করবেন। সমস্যা তো আসবেই। জেলে যাওয়া, জেল থেকে মুক্তি পাওয়া- এসব শুধু আলেমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিদিন কত লোক ঢুকছে, কত লোক বের হচ্ছে। তারা কি দ্বীনের কাজ করে ঢুকেছে? তাহলে তারা যদি অপরাধ করে জেলে ঢোকে আর আমি যদি দ্বীনের কাজ করে ঢুকি, তাহলে এটা কি আমার জন্য বাড়তি পাওয়া নয়? এটি একটি গর্বের বিষয় নিঃসন্দেহে। আমি তো চুরি করে ঢুকিনি। আমি তো বেঈমানী করে ঢুকিনি। কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর কথা বলতে গিয়ে ঢুকেছি আলহামদুলিল্লাহ। 

তাওহীদের ডাক : ডা. যাকির নায়েকের দাওয়াত সম্পর্কে আপনার মতামত কি?

আব্দুল্লাহ সালাফী : ডা. যাকির নায়েকের কাজের ফলাফল সকলেই জানে। কিন্তু ডা. যাকির নায়েক যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন, সে পদ্ধতিটা আমার মনে হয় খুব ভালো ছিল না। আসলে কোন জিনিসের হাইলাইটস যখন বেশী হয়ে যায়, তখন তার বরকত কমে যায়। সেটাই বোধহয় তার ক্ষেত্রে ঘটেছে। অথচ দক্ষিণ ভারতে ও উত্তর ভারতে কিছু আলেম আছে, তাদের দ্বারা প্রতিদিনই বহু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছে। অথচ কেউ তাদেরকে চেনেনা। তাদের সে রকম কোন হাইলাইটস নেই।

তাওহীদের ডাক : এধরনের দু’একজন আলেমের নাম যদি বলতেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : কালীম ছিদ্দীকী নামে হানাফীদের একজন আলেম আছে। তাঁর হাতে প্রচুর লোক ইসলাম গ্রহণ করছে এবং আহলেহাদীছ আলেমদের মধ্যে রিয়ায মুসা বারী ছাহেব আছেন দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের। দক্ষিণ ভারতের দারুস সালাম উমরাবাদ দাওয়াতী কেন্দ্র আছে। তাদেরও মানহাজ একই। তবে তাদের দাওয়াত অমুসলিমদের মাঝে বেশী। তারা নিরবে কাজ করে যাচ্ছে। তারা পরহেযগারও খুব। এভাবে দক্ষিণ ভারতে নিরবে আহলেহাদীছদের প্রচুর দাওয়াতী কাজ হচ্ছে।

তাওহীদের ডাক : ভারতকে আপনি দারুদ দাওয়াহ নাকি দারুল কুফর বা দারুল জিহাদ মনে করেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : ভারত হ’ল দারুদ দাওয়াহ। একজন দাঈর জন্য দাওয়াতের উন্মুক্ত ময়দান। চারিদিকে শুধু সুযোগের হাতছানি। ভারত অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক ভাল একটি দেশ। বাকি সব দেশেই যুলুম আছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান সব জায়গাতেই যুলুম আছে। ক্ষমতা যেখানে আছে, সেখানে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থাকবেই। ক্ষমতায় যারা থাকবে তারা ক্ষমতার জন্য একটু-আধটু শয়তানী তো করবেই। আমাদের কাজ দাওয়াত দিয়ে যাওয়া। সরকারে কে গেল কে আসল তা নিয়ে মাথা ব্যাথার দরকার নেই। অনেকে বলছেন, ভারতে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসায় মুসলমানদের উপর যুলুমের স্টীম রুলার চলছে। কুরআন-হাদীছের ভাষ্যানুযায়ী আমি এটা বিশ্বাস করিনা।

একটি জিনিস হচ্ছে রাসূল (ছাঃ) ছহীহুল বুখারীর হাদীছে বলছেন, এমন একটি সময় আসবে যখন আজকের দিনের চেয়ে কালকের দিন বেশী খারাপ হবে। তো আমরা চাইলেই এ সময়টা সুন্দর করতে পারব না। তাই আমরা যতটা পারি নিজেরা ভালো হয়ে চলব। ফিৎনার সময় সম্পর্কেই আবু হুযাইফা আল ইয়ামানীর হাদীছে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। যখন চারিদিক ফিৎনা। আমি মেরেধরে আমার মত সবকিছু ঠিক করে ফেলব, এ এক ভ্রান্ত ধারণা। এই দাবীটাই ভ্রান্ত। তথাকথিত আরব বসন্তের পরিণতি কি আমরা দেখিনি? আল্লাহর রাসূলের ছাহাবীরাও এমন ছিলেন না। ছাহাবীদের মধ্যে স্তর ছিল। সব ছাহাবী এক রকম ছিলেন না। সুতরাং নিজে ভালো থেকে মানুষের জন্য কতটা কল্যাণ করা যায়, সে চেষ্টা করতে হবে। কবুল হওয়া আল্লাহর হাতে।

তাছাড়া পরিস্থিতি বা সময়কে গালি দেওয়ার ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, পরিস্থিতিকে গালি দিওনা। পরিস্থিতিকে আমি সৃষ্টি করেছি। রাত ও দিন আমার দ্বারাই আবর্তিত হয়। রাত একটা যায়। নতুন রাত আসে। পুরাতন দিন চলে যায়। নতুন দিন আসে। শুধু তাই নয়, একটা রাজার পর অন্য রাজাকে আমি নিয়ে আসি। এগুলো সব আল্লাহর হাতে। সুতরাং শাসককে গালি দেওয়া যাবে না। এটা হাদীছের নির্দেশ। তাকে কেন গালি দিব? আমাদের আমলের কারণেই অত্যাচারী শাসক ক্ষমতায় এসেছে। সুতরাং আমাদের আমলের পরিবর্তন আগে ঘটাতে হবে। আমরা এটা বিশ্বাস করি যে, কেউ যদি মানুষের প্রতি যুলুম করে তাহলে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। দেশ কুফরী শাসনে থাকুক। কিন্তু যুলুম না করলে দেশ টিকে থাকবে। কিন্তু যুলুম করলে মুসলিম শাসক ক্ষমতায় থাকলেও টিকে থাকতে পারবে না। এজন্য আমরা সরকারকে আহবান জানিয়েছি যে, আপনার যুলুম বন্ধ করুন।

তাওহীদের ডাক : আপনার ঘটনাবহুল জীবনের বিশেষ স্মৃতিকথা যদি আমাদের শুনাতেন?

আব্দুল্লাহ সালাফী : রাবে‘আ জামা‘আতের একটি ঘটনা আমার খুব মনে পড়ে। ঢাকা যাত্রাবাড়ীর শায়খুল হাদীছ মাওলানা আহমাদুল্লাহ জামে‘আ সালাফিয়া বেনারসে এক বছর দাওরা পড়িয়েছিলেন। তাঁর প্রথম ব্যাচের ছাত্র আমার উস্তাদ মউনাথভঞ্জনের ‘মাদরাসা ফাতেমাতুয যাহরা’-এর প্রিন্সিপাল শায়খ নূরুল আল-আযমী খুবই কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন। তাঁর ক্লাসে ছাত্ররা ভয়ে বই ছাড়া অন্য দিকে তাকানোর সাহস পেত না। আর কেউ বই ছাড়া অন্য দিকে তাকালেও ধরে ফেলতেন ও বাম হাত দিয়ে পিটাতেন। একদিন তিনি একটু বাইরে গেছেন আর টেবিলে একটা বড় বই আছে। কি বই আমি খুলে দেখেছি। সেখানে লেখা আছে ছহীহুল বুখারী। উনি কিন্তু বাইরে থেকে এটা দেখে ফেলেছেন। এসেই বলছেন, তুমি কিতাব দেখলে কি কিতাব? আমি বললাম ‘ছহীহুল বুখারী’ তারপর তিনি বললেন, তুমি এটা পড়তে পারবে? আমি বললাম, আপনি যদি পড়ান তাহলে পড়তে পারব। তিনি বললেন, তুমি কি জান এটি কোন বই? তিনি এবার নরম হয়ে বললেন, তুমি কি জান বইটি কার কিতাব? যার সম্বন্ধে ইবনু খালদুন বলেছেন, ‘শারহুল বুখারী দাঈনুন আলাল উম্মাহ’ ‘বুখারী ব্যাখ্যা করা উম্মতের উপর ঋণ থেকে গেল’। আর যখন ইবনু হাযার আসক্বালানী বুখারীর শারাহ গ্রন্থ ফাৎহুল বারী লিখলেন। তখন তিনি বললেন, কিছুটা ঋণ শোধ হলো’। সেই বইটি তোমাকে পড়ালে তুমি পড়বা? আমি আবার বললাম, হ্যাঁ, আপনি পড়ালে আমি পড়ে নিব। অথচ একাজটি যে কতবড় দুঃসাহসের, সেটা আমি পরে বাইরে এসে অনুধাবন করেছিলাম।

তাওহীদের ডাক : জাযাকুমুল্লাহু খাইর। সফরের কষ্ট সত্ত্বেও আপনি আমাদের আহবানে সাড়া দিয়েছেন। আগামী প্রজন্মের জন্য আপনার দেয়া মূল্যবান তথ্যগুলো অনেক অজানা দুয়ার খুলে দিবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আপনাকে হায়াতে তাইয়েবা দান করুন এবং ভারতে ইসলামী দাওয়াতের ঝান্ডাকে উড্ডীন করুন। আমীন!

আব্দুল্লাহ সালাফী : যাজাকুমুল্লাহু আহসানাল জাযা। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে সৎ পথে পরিচালিত করুন এবং দুনিয়া ও আখিরাতের ফিৎনা থেকে রক্ষা করুন-আমীন!



বিষয়সমূহ: সাক্ষাৎকার
আরও