আলেম সমাজের প্রতি প্রত্যাশা

জগলুল আসাদ 10053 বার পঠিত

ফেসবুক ও ইউটিউবের বাইরে থাকা আলেমগণকে আমরা চিনি না। বাংলাদেশে অবশ্যই বড় ফকীহ ও মুহাদ্দিছ আছেন। তাঁদেরকে প্রাসঙ্গিক রাখা এবং তাঁদের ছোহবতে থাকা তালেবে ইলমদের অবশ্য কর্তব্য বলেই মনে করি। দীর্ঘদিন ইলমচর্চায় ও গবেষণায় নিয়োজিত আছেন, হয়তো কিতাব লিখেছেন, যা বাজারের বিজ্ঞাপনী ডামাডোলে আমাদের অগোচরে রয়ে গেছে, অনুপ্রাণিত করছেন অপরকে গভীর ইলম অর্জনে, এমন আলেমকে আলোয় আনা, তাঁদের বক্তব্য ও লেখনীকে সামনে আনা, তাদের নছীহতকে জনগণের সম্মুখে হাযির রাখা যরূরী প্রয়োজন। আর ইলম যে উঠে যাচ্ছে, চারপাশের শোরগোলে তা কিন্তু লুকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

আমাদের প্রতিভাবান তরুণ আলেম আছে অনেক, কিন্তু বয়স ও চিত্তচাঞ্চল্যে তাঁদের গুটিকয়েক এমন বাহাছে নিয়োজিত হয় প্রায়শই, যেগুলোতে উম্মাহর কোন পারলৌকিক কল্যাণ বা জাগতিক লাভ আছে কিনা বোঝা দুরূহ। তাদের ইলমী পরিসরে এটা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ। তবে অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বুঝি, বয়স ও জীবনাভিজ্ঞতার একটা পর্যায়ে না এলে মননে ধৈর্য ও ইলমে পরিপক্কতা আসে না। সমকালের জন্যে প্রয়োজনীয় বয়ান হাযির করা আসলেই কঠিন, যা শুধু নির্দিষ্ট কিছু কেতাবী বুঝ দিয়ে সম্ভব না। যদিও বিপরীত উদাহরণও ইতিহাসে আছে জানি। কিন্তু আমাদের কালটা বড্ড চঞ্চল, বড্ড জটিলতায় ভরা, নানা মতাদর্শ ও ফ্যাসাদে পূর্ণ। কারো ভেতরে হয়তো ইলমের গভীরতা আছে। কিন্তু কীভাবে অপরকে উম্মাহ থেকে খারিজ করা যায় এই আবেগের চপলতাও আছে সাথে। মনের ভেতরে না থাকলেও অন্তত বাক্যপ্রয়োগে ও কথার ভঙ্গিতে ধারণা হয় যে, যত কম লোক নিয়ে বেহেশতে থাকা যায় তা তার বা তাদের জন্যে তত ভাল।

অনেকেরই মনে হয়, এই লোকের যা লেখা, আর ঐ লোকের যা বক্তব্য তাতে তাঁদের কাছে গেলেই মনে হয় কাফের ফতওয়া দিবে, না হয় কমপক্ষে বিদ‘আতী লক্বব তো জুটবেই। চাইলেও শুধু তাওহীদ, রিসালাত আর আখেরাতে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে একতার অনুভব গড়া প্রায় অসম্ভব। মূল বিষয় নয়, শুধু শাখাগত মাসআলায় কোন দলের সাথে একমত হলেই আপনি কেবল মুমিন বা সম্পর্ক রাখার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। আপনার মুখে ঈমানের স্বীকৃতি তাঁদের দিল ভরাবে না, আততায়ী হয়ে আঁতের খবর বের করার আগ পর্যন্ত অনেকের সাধ মিটবে না। ফেসবুক পরিসরে বিভিন্ন দ্বীনী লেখায় বা বক্তব্যে কী পরিমাণ তর্ক-বিতর্ক ও কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি হয়, তা দেখলে যে কোন নিরীহ ঈমানদারের ঈমানহারা হওয়ার সমূহ সম্ভবনা। আর কোন অমুসলিমের যদি ঐ বাহাছ-বিতর্ক চোখে পড়ে, তাহলে তার কাছে ইসলামের যে রূপ প্রকটিত হবে, তাতে ইসলামের অনুসারী হওয়া তো দূরের কথা, তফাতে থাকতে পেরে সে নিজেকে ধন্যবাদ জানাবে। ভাষার যে ব্যবহার ও আলোচনার যে বিষয় থাকে, তাতে সাধারণ শিক্ষিতমহল তাঁদের সাহচর্যের ফয়েয লাভের কথা ভুলেও চিন্তা করবে না।

সাধারণ মানুষ আলেমদের কাছে যাবে, খুব খেয়াল করে দেখবেন, সে সুযোগও খুব কম। আলেমগণও সাধারণ মানুষের কাছে যে যাবেন জান্নাতের পথ দেখাতে সেটাও বিরল ঘটনা! সবাই জান্নাতুল ফেরদাউস নিয়ে ব্যস্ত, জান্নাতের অপরাপর স্তরেও যে কেউ যেতে পারে বা যাবে, সেটা তাঁদের মাথায় থাকে না আর। সামান্য ত্রুটিতেই কারো সব কিছুকে ব্যর্থ করে দিতে পারলেই যেন নিজের ঈমানের জাযবায় সন্তুষ্ট থাকা যায়। ব্যাখ্যা করতে করতে এমন সব বিষয়কে আমরা ঈমানের বিষয় বানিয়ে ফেলি, যা নবী করীম (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবাগণ করেননি। ছাহাবীদের মুবারক জা‘মাআত আমাদের চোখের সামনে থাকেনা। থাকে নিজের ইলমের প্রতি সন্তুষ্টি, অন্যের ত্রুুটির প্রতি কঠোরতা আর নিজেকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা।

নবীজীর আগমন ঘটেছিল সুসংবাদ দিতে ও সতর্ক করতে। আর অনেককে দেখে মনে হয় তাঁর বা তাঁদের আগমন ঘটেছে অভিসম্পাত করতে। অধিক সংখ্যক লোকের জন্যে জাহান্নামের সুবন্দোবস্ত করতে। কাউকে আপনি পূর্ণ অনুসরণীয় ভাবতে পারবেন না একালে। কারো ভেতরে পাবেন অপূর্ব আখলাক কিন্তু ইলমের স্বল্পতা; কেউবা প্রবল ইলমসম্পন্ন কিন্তু উম্মাহ চেতনা শূন্য; কেউবা কঠোর কেতাবী কিন্তু ইনসানের প্রতি দরদবিরহিত; কেউ বা প্রবল উম্মাহ-চেতনাসম্পন্ন কিন্তু ইলমের কমতি; কেউ বা তর্কে প্রবল পারঙ্গম কিন্তু তাক্বওয়ায় ঘাটতি; কেউ বা অপরের প্রতি কঠোর, দ্বীনকে কঠিন করাই তার কাছে তাক্বওয়া;  কেউবা নিজের প্রতি কঠোর কিন্তু অপরের প্রতি কোমল। আসলে নবীর ছিফাত ছড়িয়ে আছে নানা জায়গায়, নবীর পর একক কারো মধ্যে তা আর ঘনীভূত নেই।

সেই আলেমগণই সামনের প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন যারা অস্থির বাহাছ নয়, স্থির একাডেমিক এপ্রোচে আগ্রহী। উম্মাহর সামষ্টিক কল্যাণ নিয়ে ভাববেন, ইসলামকে সভ্যতা আকারে বুঝবেন, শরী‘আতের উদ্দেশ্যের দিকেও তাকাবেন, মানুষকে বুঝবেন, শুধু কথা বা লেখা নয়, মানুষের প্রতি ও মুমিনের প্রতি দরদবোধ রাখবেন ও মুমিনকে এক দেহ ভাববেন। যেসব বিষয়ে আসলেই প্রকৃত ইখতেলাফ আছে সেসব বিষয়ে সবার মধ্যে একটিই মত প্রতিষ্ঠা করবার উচ্চাভিলাষ না দেখিয়ে নিজের কাছে যেটা ছহীহ মনে হয় সেটা নিজে আমল করবেন, অনুসারীদেরকে ভিন্নমত সম্বন্ধেও জানাবেন। নিজ ভূখন্ডের রাহবার হওয়া কঠিন কাজ, আর উম্মাহর কাস্টোডিয়ানশিপ নেওয়া তো আরো কঠিনতর। নবী করীম (ছাঃ) ছাহাবাদের কাছে প্রিয় হয়েছিলেন কেন? কারণ আল্লাহ তাঁকে বানিয়েছিলেন আল-আমীন, ছাদিক, দরদী, অন্যের প্রতি সাহায্যপ্রবণ, মুমিনের মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠাকারী, বিধানকে সহজকারী, মিষ্টভাষী, আর হুসনে খুলুকের অধিকারী। এই হুসনে খুলুক একাই শত তর্ক-বিতর্কের চেয়ে ইসলামের সৌন্দর্যটুকু তীব্রভাবেই উন্মোচনে সক্ষম। তা হোক অনলাইন পরিসর বা অফলাইনে।

একালে যারা আমাদেরকে দ্বীনী ক্ষেত্রে দিশা দিবেন, তাঁদের বহুমুখী যোগ্যতার অধিকারী হওয়ার দরকার হবে বলে মনে করি। ইসলামের অন্তত কোন একটি ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞতার পাশাপাশি ইসলামের সামগ্রিক জ্ঞানব্যবস্থা, অনুভূতিকাঠামো, প্রচলিত প্রতিটি মতাদর্শ সম্পর্কে যথাবিহিত জ্ঞান, ধৈর্য, মানুষের প্রতি দরদ, আল্লাহভীতি, হুসনে খুলুক, মানুষের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া দরকার। তাঁদের কাছেই মানুষ শুধু যাবে এমন যেন না হয় শুধু, তারাও মানুষের কাছে যাবেন। সবাই যাতে জান্নাতে যেতে পারে সেই দিশা দেখাবেন কোমলতায়, দরদে।

ফেসবুক কিন্তু একটা বাজার, একটা বহু বর্ণিল গণজমায়েত, এখানে সব কথা ও আলাপ করতে নেই। এখানে আলাপ হওয়া উচিত তা-ই নিয়ে যা আমার দৈনন্দিন জীবনকে আল্লাহমুখী করবে, হালাল খেতে ও পরতে উৎসাহিত করবে, মানুষের মধ্যে আদল প্রতিষ্ঠা করতে উদ্দীপিত করবে, যা কিছু অনৈসলামী ও বাতিল মত, সেগুলোকে এ্যাকাডেমিকভাবে খন্ডন করবে, ইসলামের বিধিবিধানের ব্যাপারে মুমিনের মনে সন্তুষ্টি যোগাবে। নিজেদের ভেতরে তর্ক করে দুর্বল হয় শুধুমাত্র হতভাগারা। অন্ধকার নিয়ে কথা বলবো, কিন্তু আলোও যেন জ্বালাই।

আর একাডেমিক এপ্রোচে আলোচনা ও লেখা, নিজের মতকে দুয়েকজন বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে নেয়া বা জেনে নেয়ার চর্চা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে যদি ইসলাম বিষয়ে পিয়ার-রিভিউড জার্নাল বের হতো, বিরাট কাজ হতো। শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বা ভক্তকুলের প্রতাপে নয়, অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও ইলমের সঠিকতার জোরে টিকে থাকার শর্ত তৈরী যরূরী।

আর আমরা যারা সাধারণ মুসলমান, তাদের উচিৎ ফেসবুকীয় যেকোন বিতর্ক থেকে নিজেদের হেফাজতে রাখা। যদিও আমরা কেউই নিজেদের সাধারণ মুসলমান ভাবতে চাইনা। দশ-বিশটা কিতাব পড়ে সবাই আমরা অসাধারণ মুসলমান আজ! নিজের জীবন ও বলয়ে ইসলাম আনার চেয়ে অপরের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, নিজের বুঝকে একমাত্র বুঝ ভেবে অপরের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে চুলকানির মতোই আরামপ্রদ। সাধারণ মুমিনের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি যেন পাই, এই চেষ্টাই ভাল। নানা মত, তর্ক ও বাহাছের প্রচার-প্রসারের অবাধ সুযোগের এই কালে নির্জনবাস, মানে দ্বীনের যতটুকু জানি সে অনুসারে আমল করা, কাঙ্ক্ষিত মনে হয়। আর নিজের অধীনস্তদের মধ্যে ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত করা ও আমলে উদ্দীপিত করা, অনেক বড় কাজ। শুধুমাত্র কুরআন, কুরআনের তাফসীর, হাদীছগ্রন্থ, বিশেষত সেইসব অংশ যা নিজের জীবনে বা সমাজের প্রয়োজন ও পালনীয়, নবী-জীবনী ও সাধারণ মাসআলা-মাসায়েল অধ্যয়নই যথেষ্ট। আর প্রয়োজন প্রচুর তওবা করা এবং আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা। কারণ সত্যিকার ‘ওয়ারাছাতুল আম্বিয়া’র অভাবে আমাদের আমলে, ইলমে ও ঈমানে অনেক ঘাটতি। আমাদের সাধারণদেরই দায় বেশী কান্নার, ইস্তিগফার করার। আমাদের কান্না কেউ কেঁদে দিবেনা, আমাদেরকে জান্নাতের পথ কেউ আর দরদ ভরা কণ্ঠে দেখাবে বলে মনে হয়না। সমাজে ছহীহ বুঝ যারা দিবেন তারা আন্তঃকলহে লিপ্ত, অপ্রয়োজনীয় তৎপরতায় নিমগ্ন, ইলমের তাজাল্লিতে ও নিজ পথকেই একমাত্র ছহীহ ভেবে প্রয়োজন আর অপ্রয়োজনের পার্থক্য ঘুচিয়ে ফেলেন। অগ্রাধিকারের প্রশ্নটিকে বিদায় করে নিজেদের অজান্তেই এক ভয়বহ কূপে ডুবন্ত। তাই আসুন, নিজেরা অধ্যয়নে মনোযোগী হই, আর আরবী ভাষাটা সাধ্যমত শিখে নেই। যেটুকু সম্বল রয়েছে সেটুকু নিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে পথচলা শুরু করি। ইনশাআল্লাহ সামনে সুদিন আসবেই। আল্লাহুম্মা আমীন।

[লেখক : প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, সরকারী হরগঙ্গা কলেজ, মুন্সিগঞ্জ ও সম্পাদক, ষাণ্মাসিক চিন্তাযান]।



আরও