অনুভবের অনুরণনে আহলেহাদীছ আন্দোলনের শিক্ষা সফর ২০২০

এ্যাডভোকেট জারজিস আহমাদ 9397 বার পঠিত

কক্সবাজার, মহেশখালী, সোনাদিয়া, সেন্টমার্টিনে আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশের আয়োজনে কেন্দ্রীয় শিক্ষাসফরের গন্তব্য নির্বাচিত হয়েছে এ বছর। সেকথা জানামাত্র সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরি করিনি। সফরের নির্ধারিত দিনের ২দিন পূর্বে ১০ই মার্চ ‘২০ মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১১.২০ মিনিটে ধুমকেতু আন্তনগর ট্রেন রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন থেকে আমাদের অর্ধশতাধিক সফরকারীকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল। অন্ধকার রাত বাইরে কিছু দেখা যায় না। কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। ট্রেন ছেড়ে দিলে সিটে বসে মনে পড়ল সূরা আম্বিয়া ৮৭ আয়াতের কথা। হযরত ইউনূস (আঃ) মাছের পেটে গিয়েছিলেন এবং দো‘আ ইউনুস পাঠ করলে আল্লাহ তাকে মাছের পেট থেকে জীবিত অবস্থায় নদী তিরে নিক্ষিপ্ত করেন। নিঝুম অন্ধকার রাতে এতো গুলো মানুষকে পেটের ভিতরে নিয়ে ট্রেন চলল বাংলাদেশের রাজধানীর উদ্দেশ্যে।

ফজরের পর পর ‘ধুমকেতু’ ট্রেনটি ঢাকা কমলাপুর স্টেশনে এসে থামল। আমরা আস্তে আস্তে ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্ম ত্যাগ করলাম এবং স্টেশনের দক্ষিণ পার্শ্বের মসজিদে ছালাত আদায় করে হালকা নাস্তা সেরে নিয়ে আবার ফিরে আসলাম স্টেশনে। অপেক্ষা করতে থাকলাম চট্টগ্রামগামী মহানগর ট্রেনের। যথাসময়ে ট্রেন আসল। আমরা সবাই ট্রেনে উঠে বসলাম। এবার আর রাতের অন্ধকার নয় বরং দিনের তেজদীপ্ত আলো। শীতকাল শেষ হয়ে বসন্তকাল চলছে। তবুও শীতের হালকা আমেজ রয়েছে বাতাসে। ফজরের ছালাত আদায়ের সময় ভাল শীত ছিল। তবে এই সময়টা বেশ তৃপ্তিকর। রৌদ্রের তাপ আছে। ঠিক শীতও নয়, গরমও নয়। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম। দেখতে দেখতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ যেলার মানচিত্র পার হয়ে বি. বাড়িয়া যেলার মানচিত্রে চলে আসলাম। তার একটু পরেই সাবেক ত্রিপুরা বর্তমান কুমিল্লা যেলার ভূমিতে ট্রেন চলতে থাকে। চলন্ত ট্রেনে বসে বসে কখন গন্তব্যে পৌঁছাব সেই চিন্তা করছি আর তখনই মনে পড়ল এই সেই কুমিল্লা যেলা, যে যেলার বুড়িচং উপযেলার পারুয়ার গ্রামের মুজাহিদ সন্তান মাওলানা আকরাম আলী খাঁন মূল জিহাদ কেন্দ্র ‘আসমাস্ত’ হতে আমীর আব্দুল্লাহর নির্দেশক্রমে রাজশাহী যেলার দুয়ারীতে এসে ১৯০০ খৃষ্টাব্দে জিহাদের অন্যতম কেন্দ্র গড়ে তোলেন (দ্র. আহলেহাদীছ আন্দোলন, ৪২০-৪৫০ পৃ.)। এই যেলারই দেবীদ্বার উপযেলার আরেক কৃতি সন্তান এই শিক্ষা সফরের পরিচালক মাসিক আত-তাহরীক পত্রিকার মাননীয় সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন। এসব বিষয়গুলো ভাবতে ভাবতে ট্রেন কুমিল্লা স্টেশনে এসে দাঁড়াল। জানালার ধারে বসে আছি। স্যারের কনিষ্ঠ পুত্র শাকির বলল, চাচা এক বোতল পানি দিব? বললাম, দাও সময় পাবে তো? সে এক বোতল পানি হাতে দিতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। মুবীনুল ভাই ফোন দিয়ে বললেন, সফরে টিম-২-এর দলনেতা হিসাবে আপনাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মুঠোফোনে কথা শেষ হতে না হতেই লাকসাম স্টেশনে এসে দাঁড়াল। তারপর কয়েক স্টেশন পার হ’তেই চোখে পড়ল চট্টগ্রাম যেলার সিতাকুন্ড উপযেলার উঁচু-উঁচু পাহাড়। আর পাহাড়ের গায়ে লম্বা লম্বা সবুজ গাছপালা কত যে সুন্দর সাজানো-গুছানো সুবিস্তৃত ভুপৃষ্ঠ। নিশ্চিত হলাম যে, চট্টগ্রামের মাটিতে মহান আল্লাহ আমাদের নিয়ে এসেছেন। ফালিল্লাহিল হামদ!

উঁচু উঁচু পাহাড় আর পাহাড়ের পার্শ্বে নীচু ভূমিতে মহান আল্লাহ মানুষের জন্য উত্তম রিযিকের ব্যবস্থা করেছেন। এবিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর পৃথিবীকে আমরা প্রসারিত করেছি এবং তাতে পাহাড় সমূহ স্থাপন করেছি। আর তাতে উৎপন্ন করেছি সকলপ্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদরাজি’ (ক্বফ ৫০/৭)। এই পাহাড়গুলোকে চোখে দেখলে এবং অন্তর দিয়ে সেটা উপলদ্ধি করলে বুঝা যাবে যে এইসব সৃষ্টির একজন পরিচালক এবং প্রতিপালক আছেন। তিনি সবকিছুর ব্যবস্থাপনা করেছেন।

বেলা দু’টার দিকে রাজশাহী থেকে প্রায় সাতশত কি.মি. ট্রেন ভ্রমণ করে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে উপস্থিত হলাম। এবার নামার পালা। আপন আপন লাগেজ নিয়ে  এক সাথে প্লাটফর্ম ত্যাগ করে বাইরে এলাম। এখন যেতে হবে চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা থানাধীন আহলেহাদীছ আন্দোলনের মারকায মসজিদ। বাসে উঠে চট্টগ্রাম মহানগরীর বহুতল ভবনগুলো দেখতে দেখতে পতেঙ্গা এলাকায় এসে বাস থামল। আমরা আস্তে আস্তে বাস থেকে নেমে সমবেত হয়ে একজন দোকানদার ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম আহলেহাদীছ মসজিদের কথা। তিনি রাস্তার পার্শ্বের দিয়ে একটি গলি দেখিয়ে বললেন, ঐ গলিতে আহলেহাদীছ মসজিদ আছে। ঐ দিক-নির্দেশনা মোতাবেক আমরা চলতে থাকলাম। পেয়ে গেলাম মারকায মসজিদ। আজ আপাতত এখানেই যাত্রা বিরতি।

মারকায মসজিদে যোহর ও আসর ছালাত আদায় এবং পার্শ্বের হোটেলে খাবার খেয়ে মসজিদে রেস্ট নিতে থাকলাম। পরে জানতে পারলাম মুহতারাম আমীরে জামা‘আত চট্টগ্রাম মহানগরীর কয়েকটি স্থানে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন। সাথে ছিলেন ড. কাবীরুল ইসলাম ও দুররুল হুদা ভাই। তবে আমরা ঐ আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারিনি, শারীরিকভাবে ক্লান্ত থাকায়। কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আযান হলে জামা‘আতে মাগরিব এবং এশার ছালাত আদায় করা হ’ল। এরপর পার্শ্বের হোটেলে রাতের খাবার শেষ করে মারকায মসজিদে ফিরে এসে জানতে পারলাম রাত ২টায় চট্টগ্রাম হ’তে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়বে। অগত্যা না ঘুমিয়ে আমরা মসজিদে বসে আমি, কেন্দ্রীয় অর্থ সম্মাদক বাহারুল ভাই এবং নাটোরের কয়েকজন দ্বীনী ভাই মিলে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ বিষয়ে আলোচনা শুরু করলাম। নানাবিধ কথা হ’ল। এইভাবে আরও কথা হ’ল এই মারকায মসজিদকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য চরমোনাই পীরের অনুসারীদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে। প্রশাসনের বাধাদানের কারণে তারা ফিরে গেছে। তবে সেই থেকে মসজিদে মাইকে আযান নিষিদ্ধ আছে। বিষয়টি নিয়ে ফৌজদারী আদালতে মামলা বিচারাধীন আছে। এই অবস্থায় দায়িত্বশীল একজন ভাই বললেন, এখন রাত ১.৪৫ মিনিট। বাস রোডের ধারে দাঁড়ানো। আস্তে আস্তে চলে যান। এরপর সবাই বাসে উঠে সিটে বসলাম। বাস ছাড়ল রাত ২.৪০ মিনিটে।

এবার যাত্রা শুরু হ’ল চট্টগ্রাম হতে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের উদ্দেশ্যে। আমি এর আগে কোনদিন কক্সবাজার আসিনি। সুতরাং সফরটি ছিল আমার জন্য খুবই আনন্দের। যাই হোক বাসের মধ্যে বসে আছি আর মনে মনে চিন্তা করছি কক্সবাজার সম্পর্কে। হঠাৎ ফজরের আযানের ধ্বনি কানে এল। বুঝলাম গন্তব্যস্থল সমাগত। কক্সবাজার যেলা শহরে প্রবেশ করে বাস এসে দাঁড়াল হোটেল সি কুইন-এর পাশে। বাস থেকে নেমে হোটেলেই ফজরের ছালাত আদায় করলাম।

মহেশখালী ও সোনাদিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা :



১২ই মার্চ’২০ সকাল থেকে আমাদের সফরের মূল পর্ব শুরু হ’ল। ৪০৭ নং রুমে আমার সীট বরাদ্দ হয়েছে। গোসল সেরে সকাল ৮টায় নাশতা করলাম। অতঃপর সোয়া ৮টায় হোটেল চত্বরে দাঁড়িয়ে সফরকারীদের উদ্দেশ্যে সফর পরিচালক ড. সাখাওয়াত হোসাইন দিক-নির্দেশনামূলক আলোচনা করলেন। সকাল ৯টায় মহেশখালী ও সোনাদিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হ’ল। প্রথমে কক্সবাজার লঞ্চঘাটে যাওয়ার জন্য আমি দলনেতা হিসাবে আমার দলের ২০জনকে নিয়ে নির্দিষ্ট জীপে উঠি। অতঃপর নুনিয়ারছড়া লঞ্চ ঘাট থেকে স্পীড বোটে সোনাদিয়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। বিশাল পানি রাশির উপর দিয়ে ছোট্ট একটি স্পীড বোট ১০জন মানুষ নিয়ে ঝড়ের গাতিতে চলা শুরু করল। দো‘আ পড়তে লাগলাম। দো‘আ ইউনুস কতবার পড়েছি মনে নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে স্পীড বোট সোনাদিয়া দ্বীপের কিনারে এসে থামল।

আমরা আস্তে আস্তে নেমে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। দেখতে দেখতে সবাই এসে হাজির। সোনাদিয়া দ্বীপের পরিচিতি একটু বলে রাখি। মহেশখালী উপযেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীব বৈচিত্র সমৃদ্ধ একটি দ্বীপ ‘সোনাদিয়া’। দ্বীপটির আয়তন ৭ বর্গকিলোমিটার। এই দ্বীপের মত সুউচ্চ বালিয়াড়ির তুলনা বাংলাদেশে নেই। এখানে সামুদ্রিক সবুজ কাছিমও ডিম পাড়তে আসে। স্থানীয় অদিবাসীরা মনে করেন, সোনাদিয়া দ্বীপে মানব বসতির ইতিহাস অনুমানিক দেড়শত বছরের। দ্বীপের মানুষেরা মূলতঃ দুইটি গ্রামে বসবাস করে, সোনাদিয়া পূর্বপাড়া ও সোনাদিয়া পশ্চিম পাড়া। দ্বীপটির বর্তমান লোকসংখ্যা প্রায় ১৭০০। মাছ ধরা, মাছ শুকানো এবং কৃষিকাজই দ্বীপবাসীর মূল পেশা। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকুলীয় প্যারাবনের অবশিষ্টাংশ এখন মূলত শুধু সোনাদিয়া দ্বীপের দেখা যায়। এই দ্বীপে ২টি মসজিদ, ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি সাইক্লোন সেন্টার, অনুমানিক ১২টি গভীর নলকুপ রয়েছে। ভারতের কুট কৌশলী বিরোধিতার কারণে সোনাদিয়ায় চীন ও জাপানের সহায়তায় একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের চুড়ান্ত মহাপরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেছে। সোনাদিয়াকে সরকার ইকোপার্ক হিসাবে ঘোষণা করেছে।

এবার সোনাদিয়া দ্বীপে শুরু হ’ল পদব্রজে ভ্রমণ। বালির উপর দিয়ে হাটতে থাকি। হঠাৎ দেখতে পেলাম লেকের মত জলাধার। পানি একটু হাতে নিয়ে মুখে দিলাম। প্রচন্ড লবণাক্ত। সাথে সাথে ফেলে দিলাম। চারিদিকে কিছু সবুজ গাছ ও বালির স্ত্তপ নজরে পড়ল। কোন মানুষের সাথে আমাদের কথোপকথন হয়নি। যাইহোক ভ্রমণ শেষ করে স্পীড বোটে আমরা এবার মহেশখালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু কলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পীড বোট মহেশখালীর কিনারে এসে থামল। স্পিড বোট থেকে নামার সময় এক উজবুক যুবক ধাক্কা দিলে আমার চশমাটি পানিতে পড়ে যায়। স্মৃতির পাতায় চিরস্থায়ী ধরে রাখতেই বোধহয় অকস্মাৎ ঘটনাটি ঘটে গেল। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি আর মানবীয় দূর্বলতাহেতু রাগে গজ গজ করি, এই সব উবজুক যুবক কেন আসে সফরে! 

ঐ প্রসঙ্গ যাক, মহেশখালীর পরিচিতি হচ্ছে এটি বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড় সমৃদ্ধ দ্বীপ। এই দ্বীপ উপযেলা আরো ৩টি ছোট ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। এগুলি হ’ল সোনাদিয়া, মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা। মহেশখালীর সাথে নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস যুক্ত। এই সম্প্রদায়ের প্রভাবের কারণে মহেশখালীতে আদিনাথ মন্দির নির্মিত হয়। মহেশখালী নৌ ঘাটে স্পীড বোট থেকে নেমে ঐ এলাকায় আমরা কয়েকজন একসাথে সঙ্গে আনা দাওয়াতপত্র বিতরণ করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে কয়েকজন লোক এসে আমাদের অটো গাড়ীর সামনে এসে পথরোধ করল। আমি বললাম, এই দিকে আসেন আমার সাথে কথা বলেন। একজন ব্যক্তি পান চিবাতে চিবাতে আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কে? আমি বললাম, আমি একজন সিনিয়র এডভোকেট। রাজশাহী থেকে আপনার এলাকায় আহলেহাদীছ আন্দোলনের দাওয়াত নিয়ে এসেছি। উনি বললেন, কার হুকুমে দাওয়াত দিচ্ছেন? দাওয়াত দিতে হ’লে এই এলাকায় আমাদের হুকুমে দাওয়াত দিতে হবে। আমি বললাম, কেন আপনার হুকুম নিয়ে দাওয়াত দিতে হবে? কে আপনি? উনি বললেন, আমি এই এলাকার মানুষ। আমি বলি, বাংলাদেশ সরকার কি আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছে? এরপর উনি প্রচারপত্রগুলো নিয়ে টানাটানি শুরু করেন। তখন আমি বললাম, টানাটানি করবেন না। এমনিতেই নিয়ে যান। ছিড়ে ফেলুন, তাতে দুঃখ নেই। এতেই আমাদের বিজয়। আমাদের দাওয়াত এইভাবে কার্যকর হবে ইনশাআল্লাহ। তারপর অটো নিয়ে আমরা অন্য দিকে চলে গেলাম। পরে অটো ড্রাইভার বলল, স্যার ঐ লোক মাদরাসায় চাকুরী করে।

আসার পথে পাশে দেখতে পেলাম লবণের স্ত্তপ। দেখার জন্য অটো ড্রাইভারকে নিয়ে লবণ তৈরীর পদ্ধতি দেখলাম। জিজ্ঞাসা করলাম কিভাবে লবণ তৈরী হয় এবং কিভাবে বাজারজাত করা হয়। যাইহোক, অটোযোগে মহেশখালী লঞ্চঘাট এসে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় মুহতারাম আমীরে জামা‘আত মহেশখালী পৌঁছলেন। বললাম, স্যার আমরা এখন হোটেলে ফিরে যাচ্ছি। উনি বললেন, যান আমি একটু পরেই চলে আসবো। কথোপকথন শেষে আমরা স্পীড বোটে উঠে কক্সবাজার লঞ্চঘাটে নেমে সি কুইন হোটেল চলে আসলাম। যোহর ও আছরের ছালাত আদায়ের পর দুপুরের খাওয়া শেষ করে রুমে রেস্ট নিতে থাকলাম।

হিমছড়ি ভ্রমণ :

বিকাল ৩টায় হিমছড়ি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে সি কুইন হোটেলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জিপে উঠে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। হিমছড়ি কক্সবাজার থেকে ১২ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত একটি পর্যটন স্থল। এর একপাশে রয়েছে সুবিস্তৃত সমুদ্র সৈকত, অন্য পাশে রয়েছে সবুজ পাহাড়ের সারি। হিমছড়িতে একটি জলপ্রপাত রয়েছে যা এখানকার প্রধান আকর্ষণ যদিও বর্ষার সময়ছাড়া অন্য সময় ঝর্ণায় পানি থাকে না। তবুও প্রাকৃতিক পরিবেশ হিসাবে হিমছড়ি পর্যটকদের নিকট অত্যন্ত আকর্ষণীয়। হিমছড়ি পৌঁছানোর আগেই দারিয়ানগর পয়েন্ট ‘প্যারাসেইলিং’ স্পট রয়েছে। ১৫০০ টাকা দিয়ে প্যারাসুটে চড়ে তিন থেকে চার’শ ফুট উপরে উঠে বেড়ানোর দুঃসাহসিক অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। দূর্বল হার্টের মানুষ খবরদার এই অভিজ্ঞতার পিছনে ছুটবেন না। কারণ হিতে বিপরীত হতে পারে। কিছু খেতে চাইলে এখানকার ফল খান। যা দেখতে আমড়ার মত। ভিতরে লাল পেয়ারার বীচি। যা আপেল-নাশপাতির ন্যায় সুগন্ধ। প্রতি পিস ১০টাকা। খেতে বড়ই মজা। হিমছড়ির একপাশে সুবিস্তৃত সমূদ্র সৈকত এবং অন্য পাশে সবুজ পাহাড়ের সারি। মহান আল্লাহ একপাশে সবুজ পাহাড় দাঁড় করিয়েছেন আর অন্য পাশে বিশাল সমূদ্র সৈকত তৈরী করেছেন। শুকরিয়া, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহু আকবার!

আমরা সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুলে যাই। মনে থাকে না। মহান আল্লাহর সৃষ্টির দিকে তাকালে উপলদ্ধি করা যায় কিভাবে তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, ‘ওরা কি আকাশের দিকে তাকায় না? লক্ষ করেনা আমি কিভাবে তা নির্মাণ করেছি। সুশোভিত সুবিন্যাস্ত করেছি, ক্রটিমুক্ত করেছি (ক্বাফ ৬)

ইনানী সমূদ্র সৈকত :

হিমছড়ি ভ্রমণ শেষে রওয়ানা হ’তে হবে ইনানী সমূদ্র সৈকত, যা হিমছড়ি হতে ১৪ কি.মি. দক্ষিণে। আমরা সকলে নিজ নিজ জীপে উঠে রওয়ানা হলাম ইনানী সমূদ্র সৈকতের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ইনানী সমূদ্র সৈকত। আমরা সবাই জীপ থেকে নেমে ইনানী সমুদ্র সৈকতে অবস্থান করে সাগর দেখছি। সূর্য ডোবার পূর্ব মুহূর্তে নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা হয়। আমরা সাগরের পানিতে পা ভিজিয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করি। দেখতে দেখতে লাল সূর্য চোখের আড়াল হয়ে গেল। সূর্য বিদায়ের কালে রক্তিমাকাশের নীচে সমূদ্র ঝিকমিক করতে থাকে। একসময় সেটাও অদৃশ্য হয়ে অন্ধকার নেমে আসে। পাশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য হেলিপ্যাড তৈরী করা হয়েছে, যা সাগরের কিনারে অবস্থিত। এখানেই আমরা মাগরিবের ছালাতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

খুলনার মাওলানা জাহাঙ্গীর ভাই দরাজ কণ্ঠে মাগরিবের আযান দিলেন। আযান শেষ হলে আমরা সবাই হেলিপ্যাডের উপর মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের পিছনে কাতারবন্দী হয়ে ছালাতে দাঁড়ালাম। ছালাত শুরু হ’ল। অতঃপর মাগরিবের সাথে এশাও পড়ে নেয়া হল। অতঃপর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ড.মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব নছীহতমূলক আলোচনা করলেন। সাগরপাড়ে অস্তমান সূর্যের মৃদু আভায় দাড়িয়ে হেলিপ্যাডের উপর এই ছালাত আদায় এবং আমীরে জামাআতের নছীহতের মুহূর্তটি যেন চীরদিনের জন্য স্মৃতির মনিকোঠায় স্থায়ী হয়ে গেল। অতঃপর পরবর্তী দিনের দিক-নির্দেশনা দিলেন ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন ও তাসলীম সরকার ভাই।

এরপর আমরা কক্সবাজারে ফেরার জন্য জীপে রওয়ানা হলাম। চলে আসলাম কক্সবাজার সি. কুইন হোটেলে।

সেন্টমার্টিন যাত্রা  :

পরদিন ১৩ই মার্চ’২০। ফজরের ছালাত আদায় করে তৈরী হলাম বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন যাত্রার উদ্দেশ্যে। ভোর সাড়ে ছয়টায় জীপে কক্সবাজার লঞ্চঘাটে রওয়ানা হলাম। তবে ভাটার কারণে এমভি কর্ণফুলী জাহাজটি সময় মত ছাড়তে পারল না। ফলে সকাল ৭টার জাহাজ ছাড়ল সাড়ে আটটায়। এত চমৎকার সুসজ্জিত জাহাজ যে, প্রথমেই মনটা সতেজ হয়ে উঠল। গত ৩১শে জানুয়ারী’২০ থেকে এই বিলাসবহুল জাহাজটি সরাসরি কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে যাতায়াত শুরু করেছে।  এই রুটে যাতায়াতে প্রায় ১৯৫ কি.মি. রোমাঞ্চকর সমূদ্র ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লাভ করেন পর্যটকরা। 

এই প্রথম আমার তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সাগরের বুকে জাহাজযাত্রা। আধুনিক জাহাজে তেমন ভয় নেই। কিন্তু পূর্বপুরুষরা যখন এভাবে দূরদেশের উদ্দেশ্যে জাহাজে আরোহণ করতেন, তখন আত্মীয়-স্বজন থেকে শেষ বিদায় গ্রহণ করে আসতেন। কত মানুষ যে ঝড়ে কিংবা পথ হারিয়ে বিজন সমুদ্রের বুকে হারিয়ে গেছে তার কোন ইয়ত্ত্বা নেই। জাহাজের আড়াই’শ সীট বিশিষ্ট পূর্ণ একটি কেবিন আমাদের জন্য রিজার্ভ করা ছিল। সেখানে ব্যানার টানিয়ে ও মাইকের ব্যবস্থা করে আলোচনা সভার আয়োজন করা হ’ল। মাওলানা জাহাঙ্গীর আলম, আমানুল্লাহ মাদানী তাদের ওজস্বীনী ভাষণ পেশ করলেন। আমি স্বরচিত একটি জাগরণী পরিবেশন করলাম। আলহামদুলিল্লাহ খুব উপভোগ্য সময় কাটল। ইতিমধ্যে জুম‘আর সময় হয়ে গেলে মুহতারাম আমীরে জামাআ‘ত জাহাজের ক্যাপ্টেনস্ ডেক থেকে খুৎবা দিলেন। পুরো জাহাজের প্রায় সাত শতাধিক পুরুষ-মহিলা তাঁর সেই হৃদয়গ্রাহী খুৎবা শুনে আন্দোলিত হ’ল। তারপর যার যার অবস্থান থেকে কেবল নারীরা বাদে প্রায় সকলেই জামাআ‘তে যোগ দিল।

জুম‘আর পর একটি দল গান-বাজনার আয়োজন করতে চেয়েছিল। কিন্তু ছালাতের পর তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। শুধু তাই নয়, জাহাজের প্রায় প্রতিটি মানুষের কাছে আমাদের বই ও লিফলেট পৌঁছে দিয়েছিলেন আমাদের কর্মীরা। তারা সেগুলো পড়া শুরু করলেন। অনেকেই জানতে চাইলেন আহলেহাদীছ সম্পর্কে। এই সুযোগে কর্মী ভাইরা যার যার মত দাওয়াতী কাজে সময় দিলেন। সাংগঠনিক শিক্ষাসফরে এই যে দাওয়াতের সুন্দর উপলক্ষ্য পাওয়া যায়, তা অন্য কোন সফরে পাওয়া যায় না। এজন্য এই সফর নিঃসন্দেহে অন্য যে কোন শিক্ষাসফরের চেয়ে আলাদা। জাহাজের সহকারী ক্যাপ্টেন বলেই ফেললেন, এই জাহাজে আপনাদের মত দ্বীনদার পর্যটক গ্রুপ অতীতে কখনও উঠেনি আর ভবিষ্যতেও কখনও হয়তো উঠবে না। অথচ দ্বীনদারদের এমন সফর করা বেশী প্রয়োজন যাতে তারা মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত আরও বেশী ছড়িয়ে দিতে পারে।  

উল্লেখ্য যে, যে, জাহাজের ক্যাপ্টেনের বাড়ী ময়মনসিংহে এবং তিনি পূর্ব থেকেই আহলেহাদীছ। আমীরে জামাআ‘তের ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) বইটি তিনি পূর্ব থেকেই মানুষের কাছে বিতরণ করে থাকেন। তিনি স্যারের সাক্ষাৎ করে আবেগী হয়ে পড়লেন। এছাড়া তাঁর একজন সহকারী এবং জাহাজের প্রকৌশলীও স্যারের হাতে হাত রেখে আহলেহাদীছ হয়ে গেলেন। সত্যিই এটা একটা স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল।

সেন্টমার্টিন পৌঁছানোর কিছু পূর্বেই সাগরের বুকে কালো রেখার মত সেন্টমার্টিনের ভুখন্ড ফুটে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেলা আড়াইটার দিকে জাহাজ সেন্টমার্টিন দ্বীপের ঘাটে পৌঁছল। অনেকক্ষণ লাইনে দাঁাড়িয়ে অপেক্ষা করে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পা রাখলাম আলহামদুলিল্লাহ! আবাসনের জন্য নির্ধারিত সেন্টমার্টিন বাজারস্থ স্বপ্নবিলাস হোটেলের ৩ নং রুমে পৌঁছলাম। তৎপূর্বেই ইউরো বাংলা নামক হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। আছরের ছালাতের পর আমরা দাওয়াত দেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলাম। স্থানীয় জনগণের মধ্যে ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)-সহ অন্যান্য বই বিতরণ করলাম কয়েকজন দায়িত্বশীল ভাইকে সাথে নিয়ে। সকলেই আগ্রহভরে গ্রহণ করলেন আলহামদুলিল্লাহ।

সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এটি টেকনাফ হতে প্রায় ৯ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত। প্রচুর নারিকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়ে থাকে। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গকি.মি.। ২০১৫ সালের সরকারী হিসাব অনুযায়ী এর জনসংখ্যা প্রায় ৮ হাযার। দ্বীপের পশ্চিম উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার ব্যাপী প্রবাল প্রাচীর। যা ভাটার সময় দেখা যায়। ভৌগোলিকভাবে এটি তিনটি অংশে বিভক্ত। উত্তর অংশকে বলা হয় নারিকেল জিঞ্জিরা বাতিঘর পাড়া, দক্ষিণ অংশকে বলা হয় দক্ষিণপাড়া এবং এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দক্ষিণ-পূর্বদিকে বিস্তৃত একটি সংকীর্ণ লেজের মতো এলাকা। এর সংকীর্ণতম অংশ গলাচিপা নামে পরিচিত। দ্বীপের দক্ষিণে ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের একটি ছোট্ট দ্বীপ রয়েছে, যাকে ছেড়া দ্বীপ বলা হয়। ভাটার সময় এই দ্বীপে হেটে যাওয়া যায়। তবে জোয়ারের সময় নৌকা প্রয়োজন হয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপটির ভুপ্রকৃতি প্রধানত সমতল। তবে কিছু কিছু বালিয়াড়ি দেখা যায়। এই দ্বীপটির প্রধান গঠন হ’ল চুনাপাথর। চারিদিকে সমুদ্র হ’লেও দ্বীপের ভুখন্ডে ৮-১০ ফুট নীচেই সুপেয় মিঠা পানি পাওয়া যায়। যা দ্বীপবাসীর মিঠাপানির অভাব মিটায়। চারিদিকে লোলাপানির সমূদ্রের মধ্যে এভাবে মিঠা পানির সঞ্চয় সত্যিই আল্লাহর এক অমূল্য নে’মত। দ্বীপে দক্ষিণ দিকে প্রচুর পরিমাণে কেওড়ার ঝোপ ও কিছু ম্যানগ্রোভ গাছ আছে। অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে কেয়া, শ্যাওড়া, সাগরলতা, বাইন গাছ ইত্যাদি। প্রায় ১০০ থেকে ১২৫ বছর আগে এখানে লোক বসতি শুরু হয়। বর্তমানে এখানে আট হাজারের মত লোক বসবাস করে। পর্যটন মৌসুমে গড়ে ১০ হাজার লোক থাকে। এখানকার বাসিন্দাদের প্রধান পেশা মাছ ধরা। পর্যটক ও হোটেল ব্যবসায়ীরাই প্রধানতঃ তাদের কাছ থেকে মাছ কেনেন।

এছাড়া দ্বীপে মসজিদ রয়েছে ১৯টি। এখানে সাক্ষরতার হার ১৫.১৩%। রয়েছে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ১টি বি.এন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের প্রধান হাট-বাজার হ’ল পূর্ব বাজার, যা জেটিঘাট থেকে অনতিদূরে অবস্থিত।

স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে দাওয়াতী কাজ সেরে হোটেল স্বপ্ন বিলাসে ফিরে এলাম এবং মাগরিব ও এশার ছালাত আদায় করলাম। মাগরিবের পর হোটেল লবিতে দ্বীনী আলোচনা বৈঠক শুরু হ’ল। প্রায় ২ঘন্টা যাবৎ আলোচনা চলল। মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সমাপণী ভাষণের মাধ্যমে দ্বীনী আলোচনা শেষ হ’ল। এরপর রাত পৌঁনে নয়টায় রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে রাত্রি যাপন করি। অনেকেই এ সময় সমুদ্র সৈকতে গিয়ে রাতের সমুদ্রের বিপুল সৌন্দর্য উপভোগ করলেন। এরই মাঝে স্থানীয় দু’তিন জন আলেম কিছু সন্ত্রাসী টাইপের লোক নিয়ে হোটেলে উপস্থিত হলেন এবং কেন আমরা শিক্ষাসফরে এসে দাওয়াতী কাজ করছি, সেই প্রশ্ন তুললেন। আমরা শান্তভাবেই জবাব দিলাম এটা আমাদের শিক্ষাসফরের অন্যতম কর্মসূচি। কিন্তু তারা মানতে নারাজ। পরে বুঝতে পারলাম উক্ত আলেমদ্বয় এদেরকে ডেকে এনেছেন আমাদের শাসানোর জন্য, যেন আমরা দাওয়াতী কাজ থেকে বিরত থাকি। আমরা বললাম, আমরা আপনাদের সমাজে কোন অশান্তি করতে আসিনি। আমাদের দাওয়াত গ্রহণ করা আপনাদের জন্য আবশ্যক নয়। আমরা যা বলছি তা মানতেও পারেন, নাও মানতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশ সংবিধান মোতাবেক নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস প্রচারের স্বাধীনতা আমাদের আছে। কেউ যদি শিক্ষাসফরে এসে নাচগানের অনুষ্ঠান করতে পারে, তবে আমরা নিশ্চয়ই দাওয়াতী কাজও করতে পারব। অবশেষে তারা ফিরে গেলেন।

ছেড়াদ্বীপে ভ্রমণ :

১৪ই মার্চ’২০। ফজর ছালাতের পর ছেড়াদ্বীপে যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিলাম। নাশতা সেরে বড় ট্রলারে ছেড়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেও জোয়ারের কারণে ট্রলার ছেড়া দ্বীপে ভিড়তে পারল না। ফলে নৌকা থেকেই ছেড়া দ্বীপ দেখে আমরা ফিরে আসলাম। তারপর নাশতা করে হোটেলে ফিরলাম। সকাল সাড়ে দশটায় মুহতারাম আমীরে জামা‘আত হোটেল স্বপ্ন বিলাসের বারান্দায় আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। স্যার আমাদের নিয়ে উপদেশমূলক আলোচনা করলেন। আন্দোলন বিষয়ে অনেক দিক-নির্দেশনা দিলেন। তাঁর আলোচনা শুনছি আর মনে মনে বলছি, তিনি আহলেহাদীছ আন্দোলনের আমীর। একটি প্লাস্টিক কেদারায় বসে তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন। তাঁর সিংহাসন, মসনদ কিছুই প্রয়োজন হয়না। আল্লাহর যমীনই তাঁর মসনদ, তাঁর সিংহাসন। আমরা ২৮ জনের মত সেখানে ছিলাম। শুনছি আলোচনা। ৬২০ খ্রিস্টাব্দে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাত্রির গভীরে বাহিরাগত বিভিন্ন হজ্জ কাফেলার লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিতেন। একরাতে আবু বকর ও আলীকে সাথে নিয়ে তিনি তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিতে থাকেন। একপর্যায়ে আকাবার গিরিসংকটের আলো-আধারীর মধ্যে কিছু লোকের কথা-বার্তা শুনে তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসার জানতে পারলেন যে ইয়াছরিব থেকে হজ্জ্বে এসেছেন এবং তারা সংখ্যায় ৬জন খাজরায গোত্রের লোক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের মধ্যে বসে পড়লেন। সিংহাসন নেই, মসনদ নেই। বিশ্বনবী, বিশ্বনেতা বসলেন আল্লাহর যমীনেই। তরতাযা তরুণদের মধ্যে বসে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করে শুনালেন। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল এবং তিনিই আখেরী নবী এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তখনই ইসলাম কবুল করল।

এই ঘটনা থেকেই ইসলামের সংঘবদ্ধ আন্দোলন তথা সংগঠন শুরু হয়েছিল। আমরাও সংগঠন করি। আমাদের সংগঠনের নাম আহলেহাদীছ আন্দোলন। অদ্যকার আলোচনা হ’তে আমাদের এই শিক্ষাসফরে এসে এই শিক্ষা গ্রহণ করা উচিৎ যে, আমরা তাওহীদের বাস্তবায়ন করতে চাই সিংহাসন-মসনদের কোন অহংকার ছাড়াই। আমাদের রাসূল (ছাঃ) যে তরীকায় ইসলাম বাস্তবায়ন করে গেছেন, আমাদেরকেও সংঘবদ্ধ হয়ে সেই তরীকায় অর্থাৎ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকেই জীবন গড়তে হবে। যার শেষ ঠিকানা জান্নাত। আলোচনা শেষে হ’লে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে আমি সি. ইন হোটেল পর্যন্ত গেলাম। ফিরে এসে গোসল সেরে ইউরো বাংলা হোটেলে দুপুরের খাওয়া সমাপ্ত করে বেলা আড়াইটায় এমভি কর্ণফুলী জাহাজে সিট গ্রহণ করলাম। এবার ফিরে আসার পালা। জাহাজ কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল। দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা বসে থাকলাম জাহাজে। এর মধ্যে চলন্ত জাহাজ থেকে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করলাম। সন্ধ্যার পর জাহাজে আলোচনা সভা শুরু হ’ল। অনেকে আলোচনা সভার মাঝে মাঝে জাগরণী উপস্থাপনা করল। শেষে কুইজ প্রতিযোগিতা হ’ল। এক সময় কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়াছড়া ঘাটে জাহাজ এসে থামল। আমীরে জামাআতে আমাদের উদ্দেশ্যে বিদায়ী বক্তব্য রাখলেন এবং দোআ করলেন।

রাত তখন ৮টা। আমরা আস্তে আস্তে নেমে যার যার মত বাস স্টান্ডে এলাম। অতঃপর বাস যোগে বিভিন্ন গন্তব্যে রাওয়ানা হলাম। আমরা রাজশাহীর কয়েকজন ঢাকাগামী বাসে চড়লাম। অাঁধার রাতে বাসের বাইরে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। কুমিল্লা যেলার শেষ প্রান্তে এসে ফজরের আযানের সময় বাস দাঁড়ায়। পাশের একটি মসজিদে ছালাত আদায় করলাম। আবার যাত্রা শুরু হ’ল। কুমিল্লা যেলার দেবীদ্বার উপযেলার কৃতি সন্তান ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন নিজ বাড়ীতে যাওয়ার জন্য বাস থেকে নেমে গেলেন। আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে আবার যাত্রা শুরু করে দিলাম। ঢাকায় পৌঁছে কমলাপুর রেলস্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকলাম রাজশাহীগামী ট্রেনের জন্য। সবাই মিলে শিক্ষা সফরের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে কথা বলছিলাম। এসময় ট্রেন প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াল। আমরা নিজ নিজ লাগেজ নিয়ে ট্রেনে উঠে সিটে বসে পড়লাম। ট্রেন চলছে। ট্রেনে বসে আছি। বাইরে দূরের সবুজ গাছপালা দিয়ে সাজানো গ্রাম বাংলার দৃশ্য দেখছি। মহান আল্লাহ তার রহমতে সেগুলোকে সুবিস্তৃত করে রেখেছেন দুনিয়ার মানুষের কল্যাণে। এইভাবে দেখতে দেখতে ট্রেন যমুনা ব্রীজ অতিক্রম করে। আমরা কয়জন ট্রেনে বসে কথা-বার্তা বলছি আর রাজশাহী কখন পৌঁছাবো সেই অপেক্ষা করছি। এর মধ্যে ট্রেনে মাগরিবের ছালাত আদায় করলাম। রাত ১০টায় ট্রেন রাজশাহী রেল স্টেশনে এসে পৌঁছাল। ট্রেন থেকে নেমে আমরা সবাই পরস্পরের জন্য দো‘আ করে আপন আপন বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। শিক্ষা সফর ২০২০ সমাপ্ত হ’ল। এক প্রাতঃস্বরণীয় ঘটনাবহুল দ্বীনী শিক্ষাসফরের যবনিকাপাত ঘটল। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে তার দ্বীনের জন্য কবুল করে নিন। আমীন!

[লেখক : সিনিয়র এ্যাডভোকেট ও উপদেষ্টা, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ, রাজশাহী সদর।




বিষয়সমূহ: ভ্রমণস্মৃতি
আরও