চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 12255 বার পঠিত
ইতিহাসের
প্রতি সবসময় বিশেষ একটা আকর্ষণহেতু আয়া সোফিয়া নামটির সাথে পরিচয় আশৈশবকালেই। প্রথম কবে আয়া সোফিয়ার চিত্রপট দেখেছিলাম মনে নেই, তবে যেদিন থেকে
দেখেছি, সেদিন থেকে কখনই সেটিকে মসজিদভিন্ন অন্য কিছু ভাবতে পারিনি।
চারকোণে মিনার থাকা সত্ত্বেও যে ওটা মসজিদ নয়; বরং জাদুঘর, সেটা জানা হয়েছে
বেশী দিন হয়নি। এই না জানাটা কেবল আমার ইতিহাস অজ্ঞতা, নাকি বাস্তবতার
দাবী; তা-ই বোধ হয় এখন পরিষ্কার হওয়ার সময় হ’ল। গৌরবময় ওছমানীয় খেলাফতের
প্রাণকেন্দ্রে মসজিদ না থেকে গীর্জা থাকবে, সেটা বোধহয় ইতিহাস মেনে নেয়নি।
তাইতো দীর্ঘ ৮৬ বছর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের অর্গল
ছিন্ন করে ইতিহাস আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। প্রতীক্ষার অন্তহীন প্রহর
পেরিয়ে মর্মভেদী আযানের সূর ফের ভেসে এল আয়া সোফিয়ার সুউচ্চ মিনারচূড়া
থেকে। সুশীতল হৃদয়ে, অশ্রুসজল নেত্রে বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান তাকিয়ে রইল
সেই মিনারের পানে। অবাক বিস্ময়ে শতাব্দীর মিনার বেয়ে ইথারে ভাসমান সেই
তরঙ্গমালা মুহূর্তেই বুভুক্ষ বিশ্বমুসলিমের হৃদয়জগতকে অদ্ভূত আবেশে
আন্দোলিত করে তুলল। আহা, কি মধুর সে অনুভূতি! তাওহীদের এমন বিজয়দৃশ্য দেখার
মত আনন্দময় অভিজ্ঞতা মুমিনের যিন্দেগীতে আর কি হতে পারে!
আজ থেকে দেড় হাযার বছর পূর্বে ৫৩৭ খৃষ্টাব্দে তৎকালীন বিশ্ব পরাশক্তি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজা জাস্টিনিয়ান (৪৮২-৫৬৫ খৃ.) কনস্টান্টিনোপল শহরের গোল্ডেন হর্ণে আয়া সোফিয়া (যার অর্থ পবিত্র জ্ঞান) গীর্জা নির্মাণ করেন, যেটি পরবর্তী কয়েক’শ বছর যাবৎ বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থোডক্স গীর্জা ছিল। ১৪৫৩ সালে ওছমানীয় সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতেহ রোমান সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র কনস্টান্টিনোপল জয় করে শহরটির নাম রাখেন ইসলামবুল বা ইসলামের শহর (মোস্তফা কামাল কর্তৃক পরিবর্তিত নাম ইস্তাম্বুল)। সেই সাথে এই সাম্রাজ্যের ধর্মীয় প্রতীক আয়া সোফিয়া গীর্জাকে ব্যক্তিগত অর্থায়নে খৃষ্টানদের কাছ থেকে ক্রয় করে নেন এবং স্থাপনাটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। ১৪৫৩ সালের ১লা জুন সর্বপ্রথম জুম‘আর ছালাতের মাধ্যমে মসজিদটির উদ্বোধন হয়। সেই থেকে টানা ১৯৩১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ৪৭৮ বছর এটি মসজিদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। অতঃপর ১৯৩৪ সালে তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে পাশ্চাত্যের তল্পীবাহক মোস্তফা কামাল মসজিদটিকে অন্যায়ভাবে জাদুঘরে পরিণত করেন। অবশেষে বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ১০ই জুলাই ২০২০ তুরস্কের সর্বোচ্চ আদালতের রায় মোতাবেক তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোগান আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরের নির্দেশ দেন। অতঃপর ২৪শে জুলাই জুম‘আর ছালাতের মাধ্যমে দীর্ঘ ৮৬ বছর পর আয়া সোফিয়া মসজিদ হিসাবে তার মর্যাদা ফিরে পায়। ইস্তাম্বুল শহরের অলি-গলিতে লক্ষ লক্ষ মুছল্লীর উপস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট এরদোগান সূরা ফাতিহা ও সূরা বাক্বারার ১ম রুকূ পাঠ করেন। অতঃপর জুমআ‘র খুৎবা প্রদানকালে তুর্কী ধর্মমন্ত্রী ড. আলী এরবাশ দৃঢ়তার সাথে বলেন, আজকের পর তুর্কী জাতির অন্তরে ব্যাথা-বেদনায় রূপ নেয়া আয়া সোফিয়ার প্রতি আক্ষেপ দূর হবে।... আয়া সোফিয়া মহান আল্লাহর দাসত্ব ও তার কাছে নিঃশর্ত আনুগত্যের অন্যতম নিদর্শন।... আয়া সোফিয়া কেবল তুর্কী জাতির সম্পদ নয়; বরং গোটা মুসলিম উম্মাহর সম্পদ।... আয়া সোফিয়ায় আযানের সুর ধ্বণিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বায়তুল মুক্বাদ্দাসসহ পৃথিবীর অন্যান্য ‘ব্যথিত’ মসজিদগুলো ও সেখানকার অধিবাসীদের অন্তরাত্মা কিছুটা হ’লেও শান্তি পাবে।
আয়া সোফিয়ার মসজিদে রূপান্তরিত হওয়া কোন সাধারণ ঘটনা নয়। সুদীর্ঘ পাঁচ শতাধিক বছর ইসলামী খেলাফতের গৌরব বহন করার পর তুরস্কের উপর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নামে যে নির্মমতা ও আগ্রাসনের মাধ্যমে ধর্মহীনতাকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, তা বলতে গেলে তুলনারহিত। এই সেই তুরস্ক যেখানে ইসলামের সর্বশেষ চিহ্নটুকুও মুছে দিতে এক সময় আরবীতে আযান নিষিদ্ধ ছিল, আরবী বর্ণমালা নিষিদ্ধ ছিল। নিষিদ্ধ ছিল কুরআন শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, দাড়ি রাখা, শিক্ষাঙ্গনে নারীদের হিজাব পরা এমনকি হিজরী ক্যালেন্ডার পর্যন্ত। সেই সাথে ইসলামে যা যা নিষিদ্ধ তার সবকিছু জোর করে পশ্চিম থেকে আমদানী করা হয়েছিল, ইসলামের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সমূলে মিটিয়ে ফেলার জন্য। পশ্চিমা অপসংস্কৃতির অবাধ প্রচলন ঘটানো হয়েছিল তুরস্কের লোকালয় ও নগরে। এমনকি আরবীতে আযানের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দায়ে তুরস্কের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আদনান মেন্দারিস তুর্কী সেনাবাহিনীর হাতে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন ১৯৬০ সালে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের এই ভয়াল আগ্রাসী রূপ তুরস্কের সমাজব্যবস্থা থেকে ইসলামকে মিটিয়ে ফেলার যে নিপীড়নমূলক আয়োজন করেছিল, তা ছিল গোটা ইসলামী বিশ্বের জন্য অবমাননাকর। ফলে একদিকে ইসলামী খেলাফত হারানো, অপরদিকে খেলাফতের প্রাণকেন্দ্র থেকে ইসলামের সর্বাত্মক উচ্ছেদ কার্যক্রম বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়ে এক গভীর বেদনার শেল বিদ্ধ করে রেখেছে বিগত এক শতাব্দীকাল ব্যাপী। আয়া সোফিয়ায় আযানের জান্নাতী সুর সেই শতবর্ষের বেদনার ক্ষতে এক অনাবিল প্রশান্তির প্রলেপ।
সন্দেহ নেই, আয়া সোফিয়ার মসজিদে প্রত্যাবর্তন আধুনিক তুরষ্কের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এক নবযুগের পূর্বাভাস। এক ইতিবাচক পরিবর্তনের পটভূমিকা। স্বভাবতই সেক্যুলার পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের দোসররা এই সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর হয়েছে। যে গ্রীসে ১০ হাযার মসজিদ গীর্জায় রূপান্তরিত করা হয়েছে, তারাও জোর গলায় এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। স্বয়ং পোপ ফ্রান্সিস এতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সেই সাথে বিস্ময়করভাবে অনেক ইসলামপন্থীও এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের সমালোচনার বিষয়বস্ত্ত মূলতঃ ধর্মতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক; আর সেই সাথে যোগ হয়েছে পক্ষপাতদুষ্টতা। অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, সমালোচনাগুলো অনেকটাই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু কিছু সময় থাকে যখন দ্বিমত করার বিষয়গুলো পিছনে রাখতে হয়। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে অগ্রাধিকারের তারতম্য ঘটে। কেবল তত্ত্ব কথা দিয়ে পৃথিবী চলে না, মাথায় রাখতে হয় বাস্তব প্রেক্ষাপটও। সেই বিচার-বিশ্লেষণের যোগ্যতা ও দূরদর্শিতা না থাকলে আমাদের প্রাপ্তিগুলো সব অপ্রাপ্তিতে পরিণত হবে। মধ্যযুগে তাতারদের হাতে মুসলমানদের বাগদাদ হারানোর ইতিহাস কার না জানা আছে?
সুতরাং আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে যে, সমালোচনার নামে আমাদের জটিলতাগুলো যেন কুটিলতায় রূপ না নেয়, অর্জনগুলো যেন শেষাবধি ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়। বরং আমরা আশাবাদী যে, আয়া সোফিয়ার আযানের ধ্বনি সুদূরপ্রসারী প্রেরণার বাতিঘর হয়ে একসময় তুরস্কের সমাজব্যবস্থাকে পূর্ণাঙ্গ ইসলামের পথে নিয়ে আসবে, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের উর্ধ্বে উঠে ইসলামের সঠিক বার্তা তথা তাওহীদ ও সুন্নাতের আলোকধারা মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র বিকশিত করবে এবং আমাদের তরুণ ও যুবসমাজকে দৃঢ়চিত্ত হয়ে সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের উপর দন্ডায়মান থাকার উৎসাহ যোগাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!