আত্মহত্যা : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

আসাদ বিন আব্দুল আযীয 10768 বার পঠিত

ইসলাম হতাশাবাদের কোন স্থান নেই। জীবনের প্রতি নিরাশ হওয়া এবং নিজের প্রাণকে সংহার করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এরপরও কিছু মুসলিম নিরাশ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর ২০টি কারণের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হ’ল আত্মহত্যা। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বের কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ আত্মহত্যা করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বছরে প্রায় আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশেষতঃ ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সী যুবক-যুবতীরা বেশি আত্মহত্যা করে বলে জানা গেছে। যা মানবতার জন্য এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।


বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। দক্ষিণ এশিয়ায় দশম। প্রতি বছরই আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে এবং গড়ে প্রতিদিন ৩০ জন করে আত্মহত্যা করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যার পেছনে অন্যতম কারণগুলো হ’ল মানসিক হতাশা ও বিষণনতা, দাম্পত্যজীবনে কলহ কিংবা যেকোনো সম্পর্কে অনৈক্য, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতা ও পারিপার্শ্বিক অসহযোগিতা’।[1]

‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট’ প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী দেশে গত চার বছরে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছে। যাদের বড় অংশের বয়স ২১ থেকে ৩০-এর মধ্যে। পাকিস্তান আমলে ১৯৪৯ হ’তে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ২৫৫৫ জন আত্মহত্যা করত। এখন করছে বছরে গড়ে ১০ হাযারের বেশী। এছাড়াও যারা দেশের বড় বড় হাসপাতালের যরূরী বিভাগে ভর্তি হয়, তাদের শতকরা ২০ ভাগ আত্মহত্যার চেষ্টাকারী।

১০ই সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ উপলক্ষে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’ (WHO)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি ২ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করে এবং প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যায় সফল হয়। উক্ত সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২০১১ সালে আত্মহত্যায় বিশ্বে ভারতের স্থান ছিল ১৬তম এবং বাংলাদেশের ৩৮তম। ২০১৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ১ম ও ১০ম। অর্থাৎ প্রতি বছর এ সংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মুসলিম দেশগুলিতে ধর্মীয় কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে কম। আমাদের সরকারী হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, দেশের উঠতি যুবশক্তির মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশী। যা অত্যন্ত ভয়ংকর। যারা দেশের মেরুদন্ড এবং আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, তারাই যদি আত্মহত্যা করে, তাহ’লে দেশের চালিকাশক্তি কারা হবে? এরপরেও এদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশী। যেটা আরও ভীতিকর। আর্থিক অনটন ও বেকারত্ব এর জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় কারণ। তবে সেটাই একমাত্র কারণ নয়। কেননা উন্নত দেশগুলিতে আত্মহত্যাকারীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশী’।[2]

বাংলাদেশ পুলিশ হেড কোয়ার্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৯৫টি। আর ২০১৬ সালে এর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৬০০, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৫০০টি এবং ২০১৪ সালে তা ছিল ১০ হাজার ২০০টি।

বড়দের সাথে শিশু ও কিশোররাও আত্মহত্যা করছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের মতে, শুধু ২০১৭ সালেই ৭৬ জন আত্মহত্যা করে, যা গত ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছিল ৫৩৪। আরো শঙ্কার বিষয় হ’ল- সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের এক রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে’।[3]

আত্মহত্যার কারণ ও প্রকৃতি :

দৈনন্দিন খবরের কাগজ পড়লেই আত্মহত্যার শিরোনাম চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আগেকার দিনের ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, আত্মহত্যার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। সাংসারিক কলহ-দ্বন্দ্ব, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঝগড়া, অতিরিক্ত রাগ, কাংক্ষিত কোনো কিছু লাভ করতে না পারা, নিরাশা বা বঞ্চনার শিকার হওয়া, লজ্জা ও মানহানিকর কোনো কিছু ঘটে যাওয়া বা অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু প্রকাশ হওয়া, অভাব ও দারিদ্র্যতার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার শারীরিক ও মানসিক অসুখ-বিসুখে জর্জরিত হওয়ার কারণেও আত্মহত্যা হতে পারে। এছাড়াও আরো যে সব কারণে আমাদের সমাজে জঘন্য এই কাজটি ঘটে, তা হ’ল- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য, যেŠতুকের কারণে ঝগড়া বিবাদ, পিতা-মাতা ও ছেলে-মেয়ের মধ্যে মনোমালিন্য ও ধমকি-গালি, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, প্রেম-বিরহ, মিথ্যা অভিনয়ের ফাঁদে পড়া, ব্যবসায় বারে বারে ব্যর্থ হওয়া, অন্যকে হত্যা করে নিজেকে বিচারের হাত থেকে রক্ষা করা, আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারা ইত্যাদি। এছাড়াও ভুল বশতঃ আত্মহত্যাও হয়ে থাকে। এই সময় জ্ঞান-বুদ্ধি-উপলব্ধি-অনুধাবন শক্তি লোপ পায়, নিজেকে অসহায়-ভরসাহীন মনে হয়। আর তখনই মানুষ আত্মহত্যা করে বসে।

আত্মহত্যার পরকালীন শাস্তি :

আত্মহত্যা করা মহাপাপ। ইসলামী শরী‘আত সর্বদাই এই পাপ করার প্রতি নিরুৎসাহিত করে থাকে। কেননা এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِشَيْءٍ فِي الدُّنْيَا عُذِّبَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে যে জিনিস দ্বারা আত্মহত্যা করবে, ক্বিয়ামতের দিন সে জিনিস দিয়েই তাকে আযাব দেওয়া হবে’।[4]

অপর এক হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ رَجُلٌ بِهِ جُرْحٌ فَجَزِعَ فَأَخَذَ سِكِّينًا، فَجَزَّ بِهَا يَدَهُ فَمَا رَقَأَ الدَّمُ حَتَّى مَاتَ قَالَ اللَّهُ تَعَالَى بَادَرَنِي عَبْدِي بِنَفْسِهِ فَحَرَّمْتُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ ‘তোমাদের পূর্ববর্তী যুগে একজন লোক আঘাত পেয়েছিল তাতে কাতর হয়ে পড়েছিল। এরপর সে একটি ছুরি হাতে নিল এবং তা দিয়ে সে তার হাতটি কেটে ফেলল। ফলে রক্ত আর বন্ধ হ’ল না। শেষ পর্যন্ত সে মারা গেল। মহান আল্লাহ বললেন, আমার বান্দাটি নিজেই প্রাণ দেয়ার ব্যাপারে আমার চেয়ে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করল (অর্থাৎ সে আত্মহত্যা করল)। কাজেই, আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিলাম’।[5] নিম্নে কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকে আত্মহত্যার বেশ কিছু মর্মান্তিক পরিণতির উদাহরণ তুরে ধরা হ’ল।

ক. পাহাড় থেকে লাফিয়ে, বিষপান করে বা কোন আঘাতের মাধ্যমে আত্মহত্যা :

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَهُوَ في نَارِ جَهَنَّمَ يَتَرَدَّى فِيهِ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيها أَبَدًا، وَمَنْ تَحَسَّى سُمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَسُمُّهُ في يَدِهِ يَتَحَسَّاهُ في نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فيها أَبَدًا، وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَديدَةٍ فَحَدِيدَتُهُ في يَدِهِ يَجَأُ بِها في بَطْنِهِ في نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيها أَبَدًا ‘যে লোক পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের আগুনে পুড়বে। চিরকাল সে জাহান্নামের ভিতর ঐভাবে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। যে লোক বিষপানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে জাহান্নামের মধ্যে তা পান করতে থাকবে। যে লোক লোহার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের আগুনের ভিতর সে লোহা তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে তা দিয়ে নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে’।[6]

খ. ফাঁস লাগিয়ে ও বর্শা দ্বারা আত্মহত্যা :

হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم الَّذِى يَخْنُقُ نَفْسَهُ يَخْنُقُهَا فِى النَّارِ، وَالَّذِى يَطْعُنُهَا يَطْعُنُهَا فِى النَّارِ আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে (অনুরূপভাবে) নিজেকে ফাঁস লাগাতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি বর্শার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নাম (অনুরূপভাবে বর্শা বিঁধতে থাকবে’।[7]

গ. যুদ্ধের মাঠে আত্মহত্যা :

হাদীছে এসেছে,عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ شَهِدْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ لِرَجُلٍ مِمَّنْ يَدَّعِى الإِسْلاَمَ هَذَا مِنْ أَهْلِ النَّارِ فَلَمَّا حَضَرَ الْقِتَالُ قَاتَلَ الرَّجُلُ قِتَالاً شَدِيدًا فَأَصَابَتْهُ جِرَاحَةٌ فَقِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ، الَّذِى قُلْتَ إِنَّهُ مِنْ أَهْلِ النَّارِ فَإِنَّهُ قَدْ قَاتَلَ الْيَوْمَ قِتَالاً شَدِيدًا وَقَدْ مَاتَ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِلَى النَّارِ قَالَ فَكَادَ بَعْضُ النَّاسِ أَنْ يَرْتَابَ، فَبَيْنَمَا هُمْ عَلَى ذَلِكَ إِذْ قِيلَ إِنَّهُ لَمْ يَمُتْ وَلَكِنَّ بِهِ جِرَاحًا شَدِيدًا فَلَمَّا كَانَ مِنَ اللَّيْلِ لَمْ يَصْبِرْ عَلَى الْجِرَاحِ، فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فَأُخْبِرَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِذَلِكَ فَقَالَ اللَّهُ أَكْبَرُ أَشْهَدُ أَنِّى عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ ثُمَّ أَمَرَ بِلاَلاً فَنَادَى بِالنَّاسِ إِنَّهُ لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلاَّ نَفْسٌ مُسْلِمَةٌ وَإِنَّ اللَّهَ لَيُؤَيِّدُ هَذَا الدِّينَ بِالرَّجُلِ الْفَاجِرِ- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে এক যুদ্ধে উপস্থিত ছিলাম। তখন তিনি ইসলামের দাবিদার এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বললেন, এ ব্যক্তি জাহান্নামী অথচ যখন যুদ্ধ শুরু হ’ল, তখন সে লোকটি ভীষণ যুদ্ধ করল এবং আহত হ’ল। তখন বলা হ’ল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! যে লোকটি সম্পর্কে আপনি বলেছিলেন, সে লোকটি জাহান্নামী। আজ সে ভীষণ যুদ্ধ করেছে এবং মারা গেছে। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, সে জাহান্নামে গেছে। রাবী বলেন, একথার উপর কারো কারো অন্তরে এ বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টির উপক্রম হয় এবং তারা এ সম্পর্কিত কথাবার্তায় থাকাবস্থায় সংবাদ এল যে, লোকটি মরে যায়নি বরং মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। যখন রাত্রি হ’ল, সে আঘাতের কষ্টে ধৈর্যধারণ করতে পারল না এবং আত্মহত্যা করল। তখন নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এ সংবাদ পৌঁছানো হ’ল, তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহ আকবার! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলার বান্দা এবং তাঁর রাসূল। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিলাল (রাঃ)-কে আদেশ করলেন, তখন তিনি লোকদের মধ্যে ঘোষণা দিলেন যে, মুসলমান ব্যতীত কেউ বেহেশতে প্রবেশ করবে না। আর আল্লাহ তা‘আলা (কখনো কখনো) এই দ্বীনকে মন্দ লোকের দ্বারা সাহায্য করেন’।[8]

অপর এক হাদীছে এসেছে, সাহল ইবনু সা‘দ সা‘এদী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুশরিকদের মধ্যে মুকাবিলা হয় এবং উভয়পক্ষ তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ সৈন্যদলের কাছে ফিরে এলেন এবং মুশরিকরাও নিজ সৈন্যদলে ফিরে গেল। সেই যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গীদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি ছিল, যে কোন মুশরিককে দেখলেই তার পশ্চাদ্ধাবন করত এবং তাকে তলোয়ার দিয়ে আক্রমণ করত। বর্ণনাকরী (সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) বলেন, আজ আমাদের কেউ অমুকের মত যুদ্ধ করতে পারেনি। তা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, সে তো জাহান্নামের বাসিন্দা হবে। একজন ছাহাবী বলে উঠলেন, আমি তার সঙ্গী হব। তারপর তিনি তার সাথে বেরিয়ে পড়লেন, সে দাঁড়ালে তিনিও দাঁড়াতেন এবং সে দ্রুত চললে সেও দ্রুত চলতেন। তিনি বললেন, এক সময় সে মারাত্মকভাবে আহত হ’ল এবং সে দ্রুত মৃত্যু কামনা করতে লাগল। এক সময় তলোয়ারের বাট মাটিতে লাগাল এবং এর তীক্ষ্ণ দিক বুকে চেপে ধরে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করল। অনুসরণকারী লোকটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে আসলেন এবং বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কি ব্যাপার? যে লোকটি সম্পর্কে, আপনি কিছুক্ষণ আগেই বলেছিলেন যে, সে জাহান্নামী হবে। তা শুনে ছাহাবীগণ বিষয়টিকে অস্বাভাবিক মনে করলেন। আমি তাদের বললাম যে, আমি লোকটির সম্পর্কে খবর তোমাদের জানাবো। তারপর আমি তার পিছু পিছু বের হলাম এবং সে শীঘ্রই মৃত্যু কামনা করতে থাকল। তারপর তার তলোয়ারের বাট মাটিতে রেখে এর তীক্ষণ ধার বুকে চেপে ধরল এবং তার উপরে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন বললেন, ‘মানুষের বাহ্যিক বিচারে অনেক সময় কোন ব্যক্তি জান্নাতবাসীর মত আমল করতে থাকে, প্রকৃতপক্ষে সে জাহান্নামী হয় এবং অনুরূপভাবে মানুষের বাহ্যিক বিচারে কোন ব্যক্তি জাহান্নামীর মত আমল করলেও প্রকৃতপক্ষে সে জান্নাতবাসী হয়’।[9]

ঘ. অসুস্থ হওয়ার পরে আত্মহত্যা :

হাদীছে এসেছে,حَدَّثَنَا شَيْبَانُ قَالَ سَمِعْتُ الْحَسَنَ يَقُولُ إِنَّ رَجُلاً مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكُمْ خَرَجَتْ بِهِ قَرْحَةٌ فَلَمَّا آذَتْهُ انْتَزَعَ سَهْمًا مِنْ كِنَانَتِهِ فَنَكَأَهَا فَلَمْ يَرْقَإِ الدَّمُ حَتَّى مَاتَ قَالَ رَبُّكُمْ قَدْ حَرَّمْتُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ ثُمَّ مَدَّ يَدَهُ إِلَى الْمَسْجِدِ فَقَالَ إِى وَاللَّهِ لَقَدْ حَدَّثَنِى بِهَذَا الْحَدِيثِ جُنْدَبٌ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِى هَذَا الْمَسْجِدِ ‘শায়বান (রহঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে, আমি হাসান (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তোমাদের আগের যুগের এক ব্যক্তির ফোঁড়া হয়েছিল। ফোঁড়ার যন্ত্রনা অসহ্য হওয়ায় সে তার তূণ থেকে একটি তীর বের করল আর তা দিয়ে আঘাত করে ফোঁড়াটি চিরে ফেলল। তখন সেখান হ’তে সজোরে রক্তক্ষরণ শুরু হ’ল, অবশেষে সে মারা গেল। তোমাদের প্রতিপালক বলেন, আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছি। তারপর হাসান আপন হাত মসজিদের দিকে প্রসারিত করে বললেন, আল্লাহর কসম, জুন্দুব (ইবনু আব্দুল্লাহ বাজালী) এ মসজিদেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে এ হাদীছটি আমার কাছে বর্ণনা করেছেন’।[10]

ঙ. কারো নির্দেশে আত্মহত্যা :

কারো নির্দেশেও আত্মহত্যা করা হারাম। কেননা হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى عَبْدِ الرَّحْمَنِ عَنْ عَلِىٍّ رضى الله عنه قَالَ بَعَثَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم سَرِيَّةً وَأَمَّرَ عَلَيْهِمْ رَجُلاً مِنَ الأَنْصَارِ وَأَمَرَهُمْ أَنْ يُطِيعُوهُ فَغَضِبَ عَلَيْهِمْ وَقَالَ أَلَيْسَ قَدْ أَمَرَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم أَنَّ تُطِيعُونِى قَالُوا بَلَى قَالَ عَزَمْتُ عَلَيْكُمْ لَمَا جَمَعْتُمْ حَطَبًا وَأَوْقَدْتُمْ نَارًا ثُمَّ دَخَلْتُمْ فِيهَا فَجَمَعُوا حَطَبًا فَأَوْقَدُوا فَلَمَّا هَمُّوا بِالدُّخُولِ فَقَامَ يَنْظُرُ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ قَالَ بَعْضُهُمْ إِنَّمَا تَبِعْنَا النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فِرَارًا مِنَ النَّارِ أَفَنَدْخُلُهَا فَبَيْنَمَا هُمْ كَذَلِكَ إِذْ خَمَدَتِ النَّارُ وَسَكَنَ غَضَبُهُ فَذُكِرَ لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ لَوْ دَخَلُوهَا مَا خَرَجُوا مِنْهَا أَبَدًا إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِى الْمَعْرُوفِ- আলী (রাঃ) হ’তে বর্নিত, তিনি বলেন, রাসূলূল্লাহ (ছাঃ) একটি ক্ষুদ্র সৈন্যদল প্রেরণ করলেন এবং আনছারী ব্যক্তিকে তাঁদের আমীর নিযুক্ত করে সেনাবাহিনীকে তার আনুগত্য করার নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি (আমীর) তাদের উপর ক্ষুদ্ধ হলেন এবং বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কি তোমাদেরকে আমার আনুগত্য করার নির্দেশ দেননি? তাঁরা বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদের দৃঢ়ভাবে বলছি যে, তোমরা কাঠ সংগ্রহ করবে এবং তাতে আগুন প্রজ্বলিত করবে। এরপর তোমরা তাতে প্রবেশ করবে। তারা কাঠ সংগ্রহ করল এবং তাতে আগুন প্রজ্বলিত করল। এরপর যখন তারা প্রবেশ করতে ইচ্ছা করল, তখন একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল। তাঁদের কেউ কেউ বলল, আগুন থেকে পরিত্রাণের জন্যই তো আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণ করেছি। তাহ’লে কি আমরা (অবশেষে) আগুনেই প্রবেশ করব? তাঁদের এসব কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ আগুন নিভে যায়। আর তাঁর (আমীরের) ক্রোধও অবদমিত হয়ে পড়ে। এ ঘটনা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর নিকট বর্ণনা করা হলে, তিনি বললেন, যদি তারা তাতে প্রবেশ করতো, তাহ’লে কোন দিন আর এর থেকে বের হতো না। জেনে রেখো! আনুগত্য কেবলমাত্র বিধিসঙ্গত কাজেই হয়ে থাকে’।[11]

চ. অন্যায় বা ধর্ষণ থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা :

কোন ব্যক্তি যদি এটা জানতে পারে যে তাকে দিয়ে অন্যায় কাজ করানো হবে অথবা কোন মহিলা যদি বুঝতে পারে তাকে ধর্ষণ করা হবে; তবুও তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া যাবে না। আর এই অন্যায়ের পাপ তার উপর বর্তাবে না। কেননা সে নিরুপায় হয়ে করতে বাধ্য হয়েছে’।[12]

ছ. আত্মহত্যাকারীর জানাযায় অংশগ্রহণ করা থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরত থাকা :

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ أُتِىَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِرَجُلٍ قَتَلَ نَفْسَهُ بِمَشَاقِصَ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْهِ জাবির ইবনে সামুরা (রাঃ) হ’তে বর্নিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এক ব্যক্তির লাশ হাযির করা হ’ল। সে চ্যাপ্টা তীরের আঘাতে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জানাযা পড়েননি’।[13] অপর এক হাদীছে এসেছে, أَنَّ رَجُلًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ أَصَابَتْهُ جِرَاحَةٌ، فَامْتَدَّتْ بِهِ فَدَبَّ إِلَى قُرْتٍ لَهُ فِي سَيْفِهِ، فَأَخَذَ مِشْقَصًا، فَقَتَلَ بِهِ نَفْسَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘নবী (ছাঃ)-এর এক ছাহাবী আহত হ’ল। এটি তাকে প্রচন্ড যন্ত্রণা দিচ্ছিল। তখন সে হামাগুড়ি দিয়ে একটি শিংয়ের কাছে গেল যা তার এক তরবারির মধ্যে ছিল। এপর সে এর ফলা নিল এবং আত্মহত্যা করল। একারণে রাসূল (ছাঃ) তার জানাযার ছালাত আদায় করেন নি’।[14]

অপর এক হাদীছে এসেছে, ‘জাবির ইবন সামুরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। পরে তার মৃত্যু খবর ছড়িয়ে পড়ে। তখন তার প্রতিবেশী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে বলল, সে ব্যক্তি মারা গেছে। তখন রাসূল (ছাঃ) জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কিরূপে এ খবর জানলে? সে বলল, আমি তাকে দেখে এসেছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, সে মারা যায়নি। রাবী বলেন, তখন সে ব্যক্তি ফিরে যায়। ইত্যবসরে তাঁর জন্য কান্নার রোল শোনা গেলে, সে ব্যক্তি (প্রতিবেশী) আবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে বলল, অমুক ব্যক্তি মারা গেছে। তখন নবী (ছাঃ) বলেন, না, সে মারা যায়নি। রাবী বলেন, তখন সে ব্যক্তি ফিরে যায়। তখন তার জন্য আবার কান্নার রোল শোনা গেল এবং সে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী তাকে (প্রতিবেশী) বলল, আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর কাছে গিয়ে এ খবর দিন। তখন সে ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আপনি এর উপর লা‘নত করুন! রাবী বলেন, তখন সে ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির কাছে হাযির হয়ে দেখতে পেল যে, সে তীরের ফলা দিয়ে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করেছে। তখন সে নবী (ছাঃ)-এর কাছে গিয়ে খবর দিল যে, সে ব্যক্তি মারা গেছে। তিনি (ছাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কিরূপে এ খবর জানলে? সে বলল, আমি দেখে এসেছি যে, সে ব্যক্তি তার নিজের তীরের ফলা দিয়ে গলা কেটে আত্মহত্যা করেছে। তিনি (ছাঃ) বললেন, তুমি কি তাকে এরূপই দেখে এসেছ? তখন সে বলল, হ্যঁা। তিনি (ছাঃ) বললেন, إِذًا لاَ أُصَلِّى عَلَيْهِ তাহ’লে আমি তার জানাযার ছালাত পড়ব না’।[15]

জ. আত্মহত্যাকারীর জানাযায় বর্তমানে ইমামগণ :

হাদীছে এসেছে, عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ، أَنَّ رَجُلًا قَتَلَ نَفْسَهُ، فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ জাবির ইবন সামুরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, জনৈক ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে নবী করীম (ছাঃ) তার জানাযার ছালাত আদায় করেন নি।

অত্র হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু ঈসা (রহঃ) বলেন, এই বিষয়ে আলিমগণের মতবিরোধ রয়েছে। কোন কোন আলিম বলেন, আত্মহত্যাকারীসহ যে কোন কিবলামুখী ব্যক্তির (অর্থাৎ মু’মিনের) ছালাতুল জানাযা আদায় করা হবে। এ হ’ল সুফইয়ান ছাওরী ও ইসহাক (রহঃ)-এর অভিমত। ইমাম আহমদ (রহঃ) বলেন, ইমাম আত্মহত্যাকারীর জানাযার ছালাত আদায় করবেন না, তবে অন্যরা তা আদায় করবে’।[16]

অর্থাৎ সমাজের অনেকে মনে করেন কেউ আত্মহত্যা করলে তার বুঝি জানাযা পড়া যাবে না। কিন্তু আত্মত্যাকারীর জানাযায় রাসূল (ছাঃ)-এর অংশগ্রহণ না করার হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘এ হাদীছকে তাঁরা প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন, মানুষকে সতর্ক করার জন্য যারা আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়া হবে না বলে মত দেন। এটি উমর বিন আব্দুল আযীয ও আওযাঈ (রহঃ)-এর মত। তবে হাসান বছরী, ইবরাহীম নাখঈ, কাতাদা, মালেক, আবূ হানীফা, শাফেঈ ও সকল বিজ্ঞ উলামাদের মতামত হ’ল, তার জানাযা পড়া হবে। উপরোক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় তাঁরা বলেন, নবী করীম (ছাঃ) মূলত অন্যদেরকে এ ধরনের মন্দ কাজ থেকে সতর্ক করার জন্যই আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়ানো থেকে বিরত থেকেছেন। আর ছাহাবীগণ তাঁর স্থলে এমন ব্যক্তির জানাযা পড়েছেন’।[17]

আত্মহত্যায় বিশেষ ক্ষমা :

মদীনায় একজন হিজরতকারীর আত্মহত্যা :

হাদীছে এসেছে, জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, তুফায়ল ইবনু আমর দাওসী (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর খেদমতে হাযির হলেন এবং আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি চান যে, আপনার জন্য একটি মযবুত দূর্গ ও সেনাবাহিনী হোক? রাবী বলেন, দাওসী গোত্রের জাহিলিয়্যাহ যুগের একটি দুর্গ ছিল। (তিনি সেদিকে ইঙ্গিত করেন)। নবী করীম (ছাঃ) তা কবুল করলেন না। কারণ আল্লাহ তা‘আলা আনছারদের জন্য এ সৌভাগ্য নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। যখন নবী করীম (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করলেন, তখন তুফায়ল ইবনু আমর এবং তার গোত্রের একজন লোকও তাঁর সঙ্গে মদীনায় হিজরত করেন। কিন্তু মদীনার আবহাওয়া তাদের অনূকুল হয়নি। তুফায়ল ইবনু আমর (রাঃ)-এর সাথে আগত লোকটি অসুস্থ হয়ে পড়ল। রোগযন্ত্রণা বরদাশত করতে না পেরে তীর নিয়ে তার হাতের আঙ্গুলগুলো কেটে ফেলল। এতে উভয় হাত থেকে রক্ত নির্গত হ’তে থাকে। অবশেষে সে মারা যায়। তুফায়ল ইবনু আমর দাওসী (রাঃ) স্বপ্নে তাকে ভাল অবস্থায় দেখতে পেলেন, কিন্তু তিনি তার উভয় হাত আবৃত দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার রব তোমার সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছেন? সে বলল, আল্লাহ তাঁর নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে হিজরত করার কারণে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তুফায়ল (রাঃ) তাকে জিজ্ঞাস করলেন, তোমার কি হয়েছে যে, আমি তোমার হাত দু’টি আবৃত দেখছি? সে বলল, আমাকে বলা হয়েছে যে, আমি তা দুরস্ত করব না, তুমি স্বেচ্ছায় যা নষ্ট করেছ। তুফায়ল (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করলেন, اللَّهُمَّ وَلِيَدَيْهِ فَاغْفِرْ হে আল্লাহ! আপনি তার হাত দু’টিকেও ক্ষমা করে দিন’।[18]

আত্মহত্যাকারী ব্যক্তি কি কাফের :

আত্মহত্যা করা মহাপাপ। তবে যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করবে সে দ্বীন ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে না। তার জানাযার ছালাত সাধারণ মুসলিমরা পড়বে এবং মুসলিমদের গোরস্থানে তার দাফন করবে’।[19] কেননা রাসূল (ছাঃ) যে ৭টি ধ্বংসাত্মক পাপের কথা বলেছেন তার মধ্যে আত্মহত্যা নেই’।[20]

আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির ক্ষমা :

মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করে। এতদ্ব্যতীত তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে থাকেন’ (নিসা ৪/৪৮)

মওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ইমাম চতুষ্ঠয় কেউই আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিকে কাফের বলেনি। এটা মহাপাপ তবে শিরক নয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিকট সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেনা’।[21]

তবে কোন ব্যক্তি যদি কোন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে তাহ’লে সে কাফের ও জাহান্নামে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি হ’ল জাহান্নাম। সেখানেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাৎ করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্ত্তত রেখেছেন’ (নিসা ৪/৯৩)

একটি যরূরী জ্ঞাতব্য : শায়খ আলবানী, উছায়মীন, আব্দুল্লাহ বিন বায, আব্দুল আযীয আলে শায়খ, ছালেহ বিন ফাওযান, আব্দুল আযীয রাজেহী প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম আত্মঘাতি বোমা হামলার মাধ্যমে নিহত হওয়াকে আত্মহত্যা বলে গণ্য করেছেন’।[22]

আত্মহত্যাকারী ব্যক্তি কি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে :

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَفِى قَلْبِهِ وَزْنُ شَعِيرَةٍ مِنْ خَيْرٍ وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَفِى قَلْبِهِ وَزْنُ بُرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَفِى قَلْبِهِ وَزْنُ ذَرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ যে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাহ্ বলবে আর তার অন্তরে একটি যব পরিমানও নেকী থাকবে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে এবং যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে আর তার অন্তরে একটি অণু পরিমাণও নেকী থাকবে তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে’।[23]

আত্মহত্যা থেকে বাঁচতে করণীয়

ক. আত্মহত্যার ব্যাপারে প্রভুর নিষেধাজ্ঞাগুলি স্বরণে রাখা :

মানুষ জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে নির্ধারিত। এই সময়ের কোন পরিবর্তন হবেনা। মহান আল্লাহ বলেন,وَلِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য একটি সময়সীমা রয়েছে। যখন তাদের সেই মেয়াদ এসে যাবে, তখন সেখান থেকে এক মুহূর্ত পিছাবেও না আগাবেও না’ (আ‘রাফ ৭/৩৪)

এরপরেও আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা নিজের জীবন নিজে কেড়ে নেয়া তথা আত্মহত্যা করতে নিষেধ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا- وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ عُدْوَانًا وَظُلْمًا فَسَوْفَ نُصْلِيهِ نَارًا ‘আর তোমরা একে অপরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াশীল’। ‘যে কেউ সীমালংঘন ও যুলুমের বশবর্তী হয়ে এরূপ করবে, তাকে শীঘ্রই আমরা জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। আর সেটা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ’ (নিসা ৪/২৯)

মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ‘এবং নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। তোমরা সদাচরণ কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সদাচরণকারীদের ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ২/১৯৫)

খ. মৃত্যু কামনা না করা :

কোন ব্যক্তির নিকট যতই কষ্ট পতিত হোক না কেন কখনই আত্মহত্যা তো দূরের কথা মৃত্য কামনাও করা যাবে না। হাদীছে এসেছে, আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) ইরশাদ করেন, لاَ يَتَمَنَّيَنَّ أَحَدُكُمُ الْمَوْتَ مِنْ ضُرٍّ أَصَابَهُ فَإِنْ كَانَ لاَ بُدَّ فَاعِلاً فَلْيَقُلِ اللَّهُمَّ أَحْيِنِى مَا كَانَتِ الْحَيَاةُ خَيْرًا لِى وَتَوَفَّنِى إِذَا كَانَتِ الْوَفَاةُ خَيْرًا لِى তোমাদের কারো কোন বিপদ বা কষ্ট হলে সে যেন মৃত্যু কামনা না করে। যদি কেউ এরূপ করতে চায, সে যেন বলে হে আল্লাহ তুমি আমাকে জীবিত রাখ যতক্ষণ পর্যন্ত জীবিত থাকা আমার জন্য কল্যাণকর এবং যখন আমার জন্য মৃত্যু কল্যাণকর তখন আমাকে মৃত্যু দাও’।[24]

গ. তাক্বদীরে বিশ্বাস করা :

তাক্বদীরে বিশ্বাস করা খুবই যরূরী বিষয়। কেননা তাক্বদীরে যা লেখা আছে তা ঘটবেই। এটা মেনে নিতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ لَنْ يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا ‘তুমি বল, আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন, তা ব্যতীত কিছুই আমাদের নিকট পৌঁছবে না’ (তাওবাহ ৯/৫১)

ঘ. সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা :

আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হন’ (তালাক ৬৫/৩)

ঙ. কষ্টের সময় ধৈর্য ধারণ করা :

মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ ‘নিঃসন্দেহে ধৈর্যশীলগণ তাদের পুরষ্কার পাবে অপরিমিত ভাবে’ (যুমার ৩৯/১০)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ- الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ-أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ- ‘আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও’। ‘যাদের কোন বিপদ আসলে তারা বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁর দিকে ফিরে যাব’। ‘তাদের উপর তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে রয়েছে অফুরন্ত দয়া ও অনুগ্রহ। আর তারাই হ’ল সুপথপ্রাপ্ত’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫-১৫৭)। মহান আল্লাহ বলেন, فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا- إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا ‘অতঃপর নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে’। ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে’ (ইনশারহ ৯৪/৫-৬)

চ. রাগ সংবরণ করা :

রাগ যে কোন মূল্যে সংবরণ করতে হবে। কেননা রাগ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) ইরশাদ করেন, قَالَ لَيْسَ الشَّدِيدُ بِالصُّرَعَةِ إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِى يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ প্রকৃত বীর সে নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়। বরং সে-ই আসল বীর, যে রাগের মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে’।[25]

ছ. নিরাশ না হওয়া :

মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ يَاعِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ ‘বল, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (যুমার ৩৯/৫৩)

মহান আল্লাহ বলেন, أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَاءَ الْأَرْضِ ‘বরং তিনি, যিনি নিরুপায়ের আহবানে সাড়া দেন এবং বিপদ দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে যমীনের প্রতিনিধি বানান’ (নামল ২৭/৬২)

উপসংহার : শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শক্র। সে মানুষের জীবন যুদ্ধে হতাশা ও বিষণ্ণতার সুযোগে ওয়াসওয়াসা দিয়ে প্রাণহরণের আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত হয়। আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভাগ্যে বিশ্বাসী মুমিনের সাথে কখনোই সে পেরে উঠে না। কিন্তু সে বস্ত্তবাদী দুনিয়াদারদেরকে পুরোপুরি কুপোকাত ও ধরাশায়ী করতে সক্ষম হয়। তখন ব্যর্থ মানুষটি আত্মহত্যা ও আত্মহননের মত জঘন্য পথ বেছে নেয়। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে এই অপকর্ম থেকে হেফাযত করুন-আমীন!

[লেখক : শিক্ষক, সালমান ফারসী (রাঃ) মাদরাসা, জান্নাতপাড়া, খড়খড়ি (বাইপাস রোড), পবা, রাজশাহী]

 

[1]. দেশ রুপান্তর : ১৯ জানুয়ারী, ২০২০।

[2]. মাসিকআত-তাহরীক; অক্টোবর : ১৮তম বর্ষ; ১ম সংখ্যা, পৃ. ৩।

[3]. দৈনিক নয়া দিগন্ত ২৭ শে ফেব্রুয়ারী ২০১৯।

[4]. বুখারী হা/৬০৪৭; মুসলিম হা/১১০; মিশকাত হা/৩৪১০।

[5]. বুখারী হা/৩৪৬৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৪৮৫; মিশকাত হা/৩৪৫৫।

[6]. বুখারী হা/৫৭৭৮; মুসলিম হা/১০৯; মিশকাত হা/৩৪৫৩।

[7]. বুখারী হা/১৩৬৫; মিশকাত হা/৩৪৫৪।

[8]. আহমাদ হা/৮০৭৬; বুখারী হা/৩০৬২; মুসলিম হা/১১১।

[9]. বুখারী হা/২৮৯৮; মুসলিম হা/১১২।

[10]. মুসিলম হা/১১৩; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৫৯৮৯।

[11]. তিরমিযী হা/২৪৬৫, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৫৯; মিশকাত হা/৫৩২০।

[12]. ইসলাম ওয়েব ফৎওয়া নং ৩৩৪৭৪৪

[13]. মুসলিম হা/১১৩।

[14]. মু‘জামুল কাবীর হা/১৯৫৬; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা হা/১১৮৬৭।

[15]. আবু দাঊদ হা/৩১৮৫; মুসনাদুল জামে‘ হা/২১০৩।

[16]. তিরমিযী হা/১০৬৪; তুহফাতুল আহওয়াযী ৪/১৫২ পৃ.।

[17]. ইমাম নববী, শারহু মুসলিম ৭/৪৭ পৃ.।

[18]. আদাবুল মুফরাদ হা/৬১৪; মুসলিলম হা/১১৬; মিশকাত হা/৩৪৫৬।

[19]. নিহায়াতুল মুহতাজ ২/৪৪১।

[20]. বুখারী হা/২৭৬৬; মুসিলম হা/৮৯; মিশকাত হা/৫২।

[21]. মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ ৬/২৯১-২৯২।

[22]. সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর ক্রমিক নং ২৭৩; উছায়মীন, শারহ রিয়াযুছ ছালেহীন ১/১৬৫-১৬৬; ফাতাওয়া শার‘ঈয়াহ লিল হাছীন, পৃঃ ১৬৬-১৬৯।

[23]. বুখারী হা/৪৪; মুসলিম হা/১৯১; মিশকাত হা/৫৫৮১২।

[24]. বুখারী হা/৫৬৭১; মুসিলম হা/২৬৮০; মিশকাত হা/১৬০০।

[25]. বুখারী হা/৬১১৪; মুসলিম হা/২৬০৯; মিশকাত হা/ ৫১০৫।



আরও