ডা. ইদরীস আলী

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 10018 বার পঠিত

[‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর রাজশাহী যেলার সম্মানিত সভাপতি, সর্বজনশ্রদ্ধেয় ডা. ইদরীস আলী (৯৩) একাধারে প্রাক্তন থানা শিক্ষা অফিসার, প্রবীণ হোমিও ডাক্তার, বর্ষীয়ান সংগঠক ও একজন বোদ্ধা পাঠক। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ডামাডোলের চাক্ষুষ সাক্ষী, আহলেহাদীছ আন্দোলনের মর্দে মুজাহিদ এবং সত্যের পথে একজন লড়াকু ব্যক্তিত্ব। শরীর বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়লেও কর্মচঞ্চলতায় ও মনের উদ্যমতায় যৌবন তাঁর অদ্যবধি অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে। ‘বার্ধক্যকে সবসময় বয়সের ফ্রেমে বেঁধে রাখা যায় না। বহু যুবককে দেখিয়াছি যাহাদের যৌবনের উর্দির নিচে বার্ধক্যের কঙ্কাল মূর্তি। আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি, যাঁহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন। যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, মৃত্যুকে আঁকড়াইয়া পড়িয়া থাকে তাহাই বার্ধক্য’- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধে যৌবন এবং বার্ধক্যকে যে ভাষায় সংজ্ঞায়িত করেছেন ডা. ইদরীস আলী যেন তারই এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। কালে কালে আহলেহাদীছ বীরপুরুষদের সাথে অন্তরঙ্গ সখ্যতায় অবিচল আস্থার সাথে তিনি বিশুদ্ধ দ্বীন প্রচারের বহতা স্রোতে জীবনতরী ভাসিয়েছেন। তাঁর সারাক্ষণ একটাই ধ্যান ও জ্ঞান- ‘এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার! কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত’। এমন একজন তাহাজ্জুদগুযার, কর্মচঞ্চল, জনসেবক ও বয়োবৃদ্ধ সংগঠকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক মুখতারুল ইসলাম। নিম্নে পাঠকদের করকমলে সাক্ষাৎকারটি পত্রস্থ করা হল]

তাওহীদের ডাক : আপনি কেমন আছেন? এই বয়সে দিনকাল কেমন যাচ্ছে?

ডা. ইদরীস আলী : আল্লাহর অশেষ রহমতে ও তোমাদের দো‘আয় আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছি। বয়স হয়েছ তো এখন অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছি। মনে রাখতে পারছিনা।

তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম কত সালে এবং বর্তমানে কত বছরে পর্দাপন করেছেন?

ডা. ইদরীস আলী : আমার পিতামাতার দেয়া তথ্যানুযায়ী আমার জন্মসাল বাংলা ১৩৩৪ সালের ২৬শে মাঘ, ইংরেজী ১৯২৭ সালের দিকে। আর সার্টিফিকেট অনুযায়ী ১৯৩২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী। জন্মসাল অনুযায়ী আমার বর্তমান বয়স ৯৩ বছর।

তাওহীদের ডাক : আপনার পরিবার ও জন্মস্থান সম্পর্কে পাঠকদের যদি কিছু বলতেন?

ডা. ইদরীস আলী : আমার পিতার নাম কিসমুতুল্লাহ মুনশী ও মা মুরজান। আমার আববা বড় ফ্যামিলির সদস্য ছিলেন। তারা ১০ ভাই, ১ বোন। তিনি কৃষিকাজের পাশাপাশি চাউলের ব্যাবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আর আমার পরিবার বলতে আমার দুই ছেলে দুই মেয়ে। বড় ছেলে দুই সন্তান রেখে মারা গেছে। তারা সবাই ঢাকাতে থাকে। সবাই মাস্টার্স শেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। আর আমি ছোট ছেলে নিয়ে বাড়িতেই থাকি। আর মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। বড় জামাইয়ের নাম আব্দুল খালেক, তিনিও থানা শিক্ষা অফিসার ছিলেন। নাটোরের ডিপিইও থাকাকালীন রিটায়ার করেন।

আমার জন্মস্থান রাজশাহী যেলার চারঘাট থানার ইউসুফপুর সিপাইপাড়া গ্রামে। নানার নাম ইউসুফ সিপাহী। তাঁর নামেই গ্রামের নামকরণ করা হয়।

তাওহীদের ডাক : আপনার পিতার পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলুন।

ডা. ইদরীস আলী : আমার আববা সমাজ সচেতন, শিক্ষানুরাগী ও জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছাত্রজীবনে একবার পড়াশোনার জন্য জামতৈল, সিরাজগঞ্জ চলে গিয়েছিলেন। সেখানে বেশ কিছুদিন ছিলেন। তবে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা শেষ করেননি। তিনি স্থানীয় আলেমদের নিকট পড়তেন আর বাড়ীতে এসে আম্মাকে পড়াতেন। আমরা আম্মাকে গুলিস্তা, বুস্তা সহ ফার্সী ভাষার বিভিন্ন বই বাড়ীতে পড়তে দেখেছি। আববা ৪টি ভাষা জানতেন। তিনি আলেম-ওলামাদের খুবই সম্মান করতেন। মাদরাসা শিক্ষার প্রতি অগাধ অনুরাগ ছিল। আমার মনে পড়ে একবার আমার শ্রদ্ধেয় নানা মামা সুলায়মানকে আরবী পড়াতে রাযী ছিলেন না। কিন্তু বাবা বললেন, তুমি পড়তে যাও, আমি তোমার খরচ দিব। এতে মামা পড়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৩২ সালে দিল্লী থেকে দাওরা ফারেগ হন। তিনি পরবর্তীতে দুয়ারী মাদরাসার মৌলবী শিক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন।

তিনি তদান্তীনকালে দুনিয়াবী ব্যস্ততার পাশাপাশি রাতে দ্বীনদারী ও পরহেযগারীতার তা‘লীম নিতেন। আমার জানামতে তিনি জামিরার মাওলানা মুহাম্মাদ আলীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। উস্তাদ-শাগরিদের সম্পর্ক খুবই ভাল ছিল। তিনি সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে রাতে উস্তাদের কাছে কুরআন-সুন্নাহ চর্চা করতেন। বিশেষকরে তিনি জামিরা মাদরাসায় রাত্রিকালীন সময়ে মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ও রফাতুল্লাহ ছাহেবের নিকট নিজ উদ্যোগে পড়তে যেতেন। মাওলানা রফাতুল্লাহ ৬০ বছর হাদীছের কিতাব পড়িয়েছিলেন। তার আরবী গ্রামার ও হাদীছের গ্রন্থ প্রায় মুখস্থই ছিল। আমার বাবা জামিরা জামা‘আতের আমীর মাওলানা মুহাম্মাদ আলীর হাতে প্রথম বায়‘আত করেন। তাঁর মৃত্যুর পর যাকারিয়ার হাতে। সর্বশেষ ইয়াহইয়া ছাহেবের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন। ঐ অঞ্চলে আমার বাবার মত কেউ পরহেযগার মানুষ ছিলনা। আববা খুব জিহাদী ব্যক্তি ছিলেন। আহলেহাদীছ হওয়ার জন্য গোটা গ্রামের লোক তাঁর বিপক্ষে ছিল।

তাওহীদের ডাক : আপনার পড়াশোনার হাতেখড়ি কিভাবে হয়?

ডা. ইদরীস আলী : প্রথমে বাড়িতেই আববা-আম্মার কাছে আমার এবং আমার বড় ভাই আব্দুল গফুরের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়। তারপর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের গ্রামে প্রাইমারী স্কুল থাকলেও পড়াশুনা শুরু হয় বাদুড়িয়া প্রাইমারীতে। সেখানে আববার এক বন্ধু ঐ স্কুলে শিক্ষক ছিলেন। অতঃপর ইউসুফপুর জুনিয়র এগ্রিকালচার হাইস্কুলে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করি। এরপর সারদা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় (বর্তমানে সারদা পাইলট স্কুল এন্ড কলেজ) থেকে এসএসসি পাশ করি। নাইট শিফটে রাজশাহী সিটি কলেজে ১৯৬৮ সালে এইচএসসিও পাশ করি। ১৯৭২ সালে বিএ পাশ করে পড়শোনার ইতি টানি। আমার বড় ভাই আব্দুল গফুর রাজশাহী সরকারী হাই মাদরাসায় পড়েছেন ১৯৪২ সাল। তিনিও পরবর্তীতে জয়পুর প্রাইমারী স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন।

তাওহীদের ডাক : আমরা শুনেছি আপনি নাকি দাওরায়ে হাদীছও ফারেগ হয়েছিলেন?

ডা. ইদরীস আলী : আমি যখন এসএসসি পাশ করি এবং পাশাপাশি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি, তখন আমার আববার শিক্ষক মাওলানা রফাতুল্লাহ আববাকে বললেন, তোমার ছেলেকে স্কুলে যাওয়ার পূর্বে আমার কাছে পড়তে আসতে বলবে। আববার নির্দেশে তাঁর কাছে পড়তে যেতাম। আর ১০টার আগে আমার কর্মস্থলে চলে আসতাম। মজার ব্যাপার হ’ল আমি আমার বাবার কাছে বাড়ীতে আরবী, উর্দূ ও ফার্সী পড়া শিখেছিলাম। আর হাইস্কুলে আরবী গ্রামারও পড়েছি। পরবর্তীতে ইন্টার ও ডিগ্রীতে আমার আরবী ছিল। ফলে খুব দ্রুত দাওরায়ে হাদীছের সমস্ত বই পড়ে শেষ করে ফেলি। তবে দাওরা হাদীছের কোন সার্টিফিকেট আমার নেই। আমার বাড়ীতে এখনও মিশকাতসহ বেশ কিছু আরবী বইয়ের মূল কপি রয়েছে।

তাওহীদের ডাক : আপনার পেশাজীবন সম্পর্কে বলুন।

ডা. ইদরীস আলী : এসএসসি পাশ করেই আমি বাদুড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করি। এক বছর পিটিআই প্রশিক্ষণ নেই। এরপর ১৯৬২ সালে দেশের স্বনামধন্য স্কুলগুলোকে আইয়ুব সরকার একটা স্কীমের আওতায় পাইলট স্কুল চালু করে। সেই স্কীমের আওতায় শিক্ষক (ইংরেজী) হিসাবে সারদা পাইলট হাইস্কুলে চাকুরীতে যোগ দিই। আমার ইংরেজী ভাষার উপর স্পেশাল ট্রেনিং ছিল বিধায় সেই সুযোগটি আমার হয়েছিল। পরবর্তীতে রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড শেষ করি। এরপর ১৯৬৪ সালে সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার (এএসআই) হিসাবে দিনাজপুরে পোস্টিং হয়। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে পুঠিয়া থানা শিক্ষা অফিসার থাকাবস্থায় রিটায়ার করি।

তাওহীদের ডাক : কখন বৈবাহিক জীবন শুরু করেছিলেন?

ডা. ইদরীস আলী : আমার শিক্ষক মাওলানা রফাতুল্লাহর (শ্যামপুর) সাথে আমাদের বেশ ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল। তাঁর ছোট ভাই হাজী মকছেদ আলী যখন হজ্জে যাবেন তার পূর্বে তাঁর একমাত্র ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। তখন মাওলানা রফাতুল্লাহ ও আমার আববা দু’জনে মিলে আমার সাথে বিয়ে ঠিক করেন। এভাবে আমার না দেখাতেই ১৯৫৪ সালে স্ত্রী ছালেহা খাতুনের সাথে আমার বিবাহ সম্পন্ন হয়।

তাওহীদের ডাক : পেশাজীবনের উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতি আছে কি?

ডা. ইদরীস আলী : আমি জীবনে কখনো দুর্নীতি করিনি এবং তা সহ্যও করিনি। যত বাধাই আসুক, সত্যের পথে অটল থেকেছি। হ্যাঁ আমার জীবনের বাস্তব কিছু স্মৃতি আছে।

(১) পুঠিয়া থাকাকালীন একবার শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা হবে।  প্রশ্নপত্র প্রস্ত্তত করার দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত হয়। এদিকে চাকরীপ্রার্থীর কাছ থেকে উপযেলা চেয়ারম্যান প্রচুর টাকা ঘুষ নিয়েছে। পরীক্ষার আগের দিন আমাকে ডেকে নিয়ে টিএনও ছাহেবের সাথে আলাপ করিয়ে বললেন যে, এই এই প্রশ্ন করবেন। যদি আমার নিজ থানার টিএনও আর উপযেলা চেয়্যারম্যান আমাকে একটা কথা বলেন, তাহ’লে কি সেটা অমান্য করা সম্ভব? টিএনও-এর দেশের বাড়ী প্রেসিডেন্ট এরশাদ ছাহেবের রংপুরে এবং তিনি আবার মুক্তিযোদ্ধা। এরশাদ ছাহেবের পিরিয়ডের গল্প বলছি। এককথায় খুবই শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। পরের দিন দশটায় পরীক্ষা। এবার আমি আর আমার জামাই দু’জনে মিলে তাদের দেওয়া প্রশ্ন সব বাদ দিয়ে নতুন প্রশ্ন তৈরী করলাম। আল্লাহ ভরসা। পরীক্ষার দিন যারা টাকা দিয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছিল তারা কিছুই পারলনা। আমিই খাতা দেখলাম আর রেজাল্ট দিলাম। এতে শুধুমাত্র যারা যোগ্য ছিল তারাই চান্স পেল এবং সরকারী চাকরি পেল।

পরের দিন টিএনও ছাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং গোপনে বললেন, চেয়্যারম্যান রাতে ঘুমাতে পারেননি আর ভাতও খাননি। খুব মন খারাপ করে আছেন। আমি তাকে বুঝালাম, যে অফিসার ঘুষ খায় না, সত্যিকারের কাজ করে, এদের সুনামেই আপনার সুনাম। যারা দুর্নীতি করে, তাদের দ্বারা আপনার কোন উপকার হবেনা। পরবর্তীতে টিএনও ছাহেবই উপযেলা চেয়ারম্যানকে ছাফ জানিয়ে দেন যে, যে লোক ঘুষ খায় না তাকে কি আমি সাহায্য করব না? এভাবে আল্লাহর রহমতে তিনি আমাদেরকে সমর্থনে থাকেন এবং সত্যের পক্ষাবলম্বন করেন।

পরে তাকে আল্লাহ এমনভাবে হেদায়াত দান করেন যে, তিনি আমাদের বিরুদ্ধে ঘুষখোর শিক্ষক ও অফিসারের দায়ের করা অভিযোগপত্র দেখান এবং বলেন, আমি বারবার দেখেছি আপনারা সব সময় সত্যের পথে আছেন, যা আমার নিকট পরীক্ষিত। অতএব আমার জীবন থাকা পর্যন্ত আমি আপনাদেরকে সাহায্য করব ইনশাআল্লাহ।

(২) নাটোরের লালপুর থানা থেকে পুঠিয়া এরপর চারঘাট থানায় বদলি হয়ে আসলাম। আমি আসার আগে সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি থানাতে ৩০-৩২ জন্য শিক্ষক নেয়ার কথা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট এরশাদের পিএ চারঘাটের মিলিটারী অফিসার আনিছুর রহমান খুব ভাল মানুষ ছিলেন। তার আত্মীয়-স্বজনদের পীড়াপীড়িতে তার অজান্তেই স্থানীয় অফিসারদের মাধ্যমে কিছুটা স্বজনপ্রীতি হয়ে যায়। স্থানীয় অফিসাররা তার সুনামকে পুঁজি করে চাকুরী দেওয়ার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। চাকরী প্রার্থী অনেকেই ভাল করলেও তাদের চাকুরী মিলেনি। দুর্নীতিবাজ অফিসারেরা যারা টাকা দিয়েছে তাদেরকে চাকুরী দিয়েছে। সত্য বলতে কি, টিএনও স্যারই টাকা খেয়ে এগুলো করেছেন। এদের মধ্যে দু’জন মেয়েকে চাকুরী দিয়েছে যাদের বয়স ১৬ বছর। এমনকি এদের একজন মিলিটারী অফিসার আনিছুর রহমানের নিজের বোন। অথচ সরকারী বিধি হ’ল ১৮ বছরের কমে সরকারী চাকুরী করতে পারবে না।

তাদেরকে নিয়েছে; কিন্তু পোস্টিং দেয়নি। কেননা ঐ সময় দায়িত্বরত শিক্ষা অফিসার বদলি হয়ে যান। দায়িত্ব এসে পড়ল আমার ঘাড়ে। ঐ অফিসার আমাকে পুঠিয়ায় আমার বাড়িতে গিয়ে আমাকে শিক্ষকদের পোস্টিং দেয়ার কথা বলে। তাদের দুর্নীতির বিষয়টি আগেই আমার কানে এসেছিল। এর পরের দিন টিএনও বদলি অফিসার হিসাবে আমাকে বললেন, এদেরকে পোস্টিং দিয়ে দিন। আমি বললাম, সব পেপারস আমার নিকট সাবমিট করুন। তিনি উল্টো আমাকে পেপার না দিয়ে বললেন, যে তালিকা আছে, তা দেখে দিয়ে দিন। আমি চিন্তা করলাম, আমি এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিব আর আমার কাছে কোন ডকুমেন্টারী কাগজ থাকবে না, এ কেমন কথা? টিএনওর সাথে আমার দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল। আমি সত্যের উপরই অবিচল থাকলাম।  এর পরের দিনেই ইউনিয়ন কাউন্সিলের ভোট। শিক্ষা অফিসার হওয়ার কারণে থানা রিটার্নিং অফিসার হতে হবে। আমি এক স্কুলে ভিজিট করতে গেছি। টিএনও সেখানে তার গাড়ি নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত। তিনি আমাকে সেই দিন রাতে অফিসে নিয়ে গিয়ে বিশেষভাবে বললেন, এখনই এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিন। এদিকে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজশাহীতে কেস হয়ে গেছে। এটা আমার জানা ছিলনা। পরের দিন জানতে পেরেছি। এবার আমি কোমর শক্ত করে বললাম, আপনি পেপারগুলো দেন। আমি জানতাম তারা দুর্নীতি করেছে। তিনি সব পেপার দিলেন। আমি সমস্ত পেপার দেখে যারা অযোগ্য সবাইকে বাদ দিয়ে দিলাম। হকের পথে দৃঢ় থাকলাম। তারা বহু চেষ্টা করেও কোন কূল পেলনা। পরে এই ঘটনার কারণে ঐ টিএনও আমাকে অত্যাধিক সম্মান করতেন। আমি যদি চাকুরী জীবনে ঘুষ খেতাম তাহলে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করতে পারতাম। কিন্তু আমি সবসময় নিজের প্রাপ্ত বেতনের উপরই সন্তুষ্ট থেকেছি আলহামদুলিল্লাহ। ঐ সময় আমি আর আমার জামাই এই দুইজন শিক্ষা বিভাগে কোন দুর্নীতি করিনি। ফলে সবসময় কোন না কোন ভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য পেয়েছি।

তাওহীদের ডাক : আমরা শুনেছি আল্লামা কাফী আল-কুরায়েশী ছাহেবের সাথে আপনার সম্পর্ক ছিল। এ বিষয়ে কিছু বলুন।

ডা. ইদরীস আলী : সম্ভবতঃ ১৯৪৯ সালের দিকে আল্লামা কাফী ছাহেবকে আমার শ্বশুরবাড়ীর এলাকা শ্যামপুরবাসীরা প্রথমে দাওয়াত করে নিয়ে এসেছিল। এরপর জামিরা, চারঘাটসহ বিভিন্ন সভায় তিনি প্রায়শঃই আসতেন। আর তিনি আসলে আমি সাধারণত তাঁর মনোমুগ্ধকর বক্তব্য কখনো ছাড়তাম না। তিনি সুশ্রী ফর্সা টকটকে গড়নের মানুষ ছিলেন। তিনি অবলীলাক্রমে একটানা বাংলা, ইংরেজী, আরবী, উর্দূ ও ফার্সী বলে যেতেন। শ্রোতারা চাতক পাখির মত তাঁর বক্তব্যের জাদু বানে পাগলপারা হয়ে যেত। আমার মনে হত তিনি সারাদিন বললেও যেন অতৃপ্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। এভাবে তাঁর সাথে পরিচয়, আন্তরিকতা ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে।

এখনকার মত সেসময় সাংগঠনিক স্তর ছিলনা। তবুও তাঁর মৃত্যু অবধি তাঁর সাথে খুব ভালই সম্পর্ক ছিল। তাঁর সব লেখাই খুবই ভাল লাগত। আমি তাঁর প্রতিটি লেখা খুঁটে খুঁটে পড়তাম। আর তখন থেকেই তাঁর লেখা ‘তর্জুমানুল হাদীছ’ পত্রিকা নিয়মিত সংরক্ষণ করতাম।

তাওহীদের ডাক : আল্লামা কাফী ছাহেবের মৃত্যুর পর ড. আব্দুল বারী ছাহেবের সাথে আপনার পরিচয় কিভাবে হয়?

ডা. ইদরীস আলী : কাফী সাহেবের মৃত্যুর পর ড. আব্দুল বারী ছাহেবের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল। কেননা তিনি রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ভিসি হওয়ায় রাজশাহীতেই থাকতেন। তারপর তাঁর জামাই ড. এরশাদুল বারী ছাহেবের সাথে রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজে একসাথে পড়ার সুবাদে ড. বারী ছাহেবের সাথে আমার খুবই আন্তরিক সম্পর্ক শুরু হয়। ১৯৭১ সালে ড. বারী ছাহেব ভার্সিটিতে থাকাবস্থাতেই দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতেউশুর পাক বাহিনী ইউনিভার্সিটি দখলে নিয়ে নেয়। আমাদের জামিরা এলাকা আহলেহাদীছ অধ্যুষিত হওয়ায় তিনি সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আবার অবস্থা স্থিতিশীল হলে তিনি পুনরায় তার কর্মস্থল রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে ফিরে গিয়েছিলেন।

তাওহীদের ডাক : এ্যাডভোকেট আয়েনুদ্দীন তো অত্র এলাকারই অধিবাসী ছিলেন, তাই না?

ডা. ইদরীস আলী : আয়েনুদ্দীন ছিলেন মাওলানা রফাতুল্লাহ ছাহেবের আপন ভাতিজা আর আমার চাচা শ্বশুরের ছেলে। উনি পাকিস্তানী আমলে এমপি ও সেক্রেটারী ছিলেন। উনি ওকালতি পাশ করে সুপ্রিম কোর্টের উকীল হলেন। তিনি জমঈয়তে আহলেহাদীছের সহ-সভাপতি ছিলেন।

তাওহীদের ডাক : আপনি কি কখনো অন্য কোন ইসলামী দলের সাথে জড়িত ছিলেন? আয়েনুদ্দীন ছাহেব কি জমঈয়ত ব্যতীত অন্য কোন রাজনৈতিক দল করতেন?

ডা. ইদরীস আলী : আমি জীবনে বহু রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, পীর-মাশায়েখ বিভিন্ন ঘরানার বহু ইসলামী দল দেখেছি। আনুমানিক ১৯৮০ সালে জামিরা মাদরাসায় একজন শিক্ষক মাওলানা বছীরুদ্দীন এসেছিলেন। তিনি জামিরার ইয়াহইয়া ছাহেবকে তথাকথিত একটি রাজনৈতিক ইসলামী দলে বুঝিয়ে-শুঝিয়ে যোগদান করান। এমনকি ঐ দলটি ড. বারী ছাহেবেরও পূর্ণ সমর্থন পায়। একদিন ইয়াহইয়া ছাহেব আমাদের সকলকে জামিরাতে ডাকলেন এবং মতবিনিময় করলেন। অতঃপর আমাকে সেই রাজনৈতিক দলটির পুঠিয়া থানা আমীর করা হয় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার কাজ শুরু করতে বলা হয়। আমি বছর খানেক থাকার পর আর তাদের সাথে থাকতে পারলাম না। কারণ তারা হক কথা বলতে দেয় না। শিরক-বিদআ‘ত ও মাযহাবী সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে কিছু বলা নিষেধ। শুধু ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতাসীনদের নিয়ে চিন্তা-ভাবনাই তাদের কাজ। কিছু বললে তারা বলে সব ক্ষমতায় গিয়ে ঠিক করে দেব। 

আমাদের আহলেহাদীছ অনেক নেতৃবৃন্দই এই রাজনৈতিক দলটির ধোঁকায় পড়ে আহলেহাদীছ জামা‘আতের বড় ক্ষতি করে দিয়েছিল। আল্লামা কাফী ছাহেবের মৃত্যুর পর জমঈয়তে আহলেহাদীছও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাববোধ করেছে। আমি তার জ্বলন্ত সাক্ষী। আমি তদান্তীনকালে আল্লামা কাফী ছাহেবের ‘তর্জুমানুল হাদীছ’-এ প্রকাশিত সূরা ফাতিহার তাফসীর গ্রন্থাকারে প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষকে অনেকবার অনুরোধ করেছি; কিন্তু কে শুনে কার কথা? এই দুর্বলতার কারণে আহলেহাদীছ আন্দোলনের যে অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লাহ আমাদের সকলকে মাফ করুন।

আর আয়েনুদ্দীন ছাহেব জমঈয়তের পাশাপাশি মুসলিম লীগ করতেন। তবে তিনি সমাজহিতৈষী মানুষ ছিলেন। তিনি আরব- বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির জেনারেল সেক্রেটারী ছিলেন। সেই সুবাদে তিনি এলাকায় অনেক মসজিদ তৈরী করেছিলেন।

তাওহীদের ডাক : ‘জামায়াতে ইসলাম পার্টীতে আমার যোগ দেওয়া অসম্ভব’ মর্মে কোন বক্তব্য কি আল্লামা কাফী আল-কুরায়েশীর ছিল বলে আপনি জানেন?

ডা. ইদরীস আলী : হ্যাঁ, ‘জামায়াতে ইসলাম পার্টীতে যোগ দেওয়া অসম্ভব’ মর্মে আল্লামা কাফী সাহেব ‘তর্জুমানুল হাদীছ’ (মাসিক তর্জুমানুল হাদীছ, ফেব্রুয়ারী ১৯৫৭ সংখ্যা, ১৪৩-১৪৮ পৃ.) পত্রিকায় পরিষ্কারভাবে বলে গিয়েছিলেন। পরে সেটি হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ‘একটি পত্রের জওয়াব’ শিরোনামে প্রকাশ করে (১৯৯৩ইং)। তাঁর প্রকাশিত এই পত্রিকাটির ১৯৪৯ সালের প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা থেকে সবগুলো কপি আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। ৪টি বাইন্ডিং কপিতে সবগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছি। আমি সেগুলো নিয়মিত পড়তাম। তাঁর লেখা আমার ভিতরে খুব প্রভাব ফেলত।

তাওহীদের ডাক :  আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের সাথে আপনার কবে প্রথম পরিচয় হয়?

ডা. ইদরীস আলী : আমি ১৯৯৫ সালে ফারুক ছাহেব (দূর্গাপুর)-এর দাওয়াতে আন্দোলনের সাথে যোগ দেই এবং আমীরে জামা‘আতের সাথে পরিচিত হই। আমীরে জামা‘আতের কথামত সাংগঠনিকভাবে কর্মকান্ড শুরু করলাম। কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম যে, আমি আমার প্রাণের সংগঠন পেয়ে গেছি। অতঃপর আমাকে আমীরে জামা‘আত রাজশাহী যেলার সহ-সভাপতি করলেন। তখন আমার সভাপতি ছিলেন আবুল কালাম আযাদ। অতঃপর মুজীবর রহমান। তাঁরা চলে যাওয়ার পর আমাকে যেলা সভাপতি করা হয়। তারপর থেকে প্রায় ১০ বছর যাবৎ আমি সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি।

তাওহীদের ডাক : আল্লামা কাফী ছাহেব ও আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের দাওয়াতী মানহাজ ও পদ্ধতি সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?

ডা. ইদরীস আলী : তাঁদের উভয়ের দাওয়াতী মানহাজ একই। তবে দাওয়াতের পদ্ধতি ভিন্ন। আল্লামা কাফী ছাহেব আসলে প্রথম জীবনে রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। শেষ জীবনে তিনি সময় খুবই কম পেয়েছিলেন। মাত্র ১০ বছরের মত। এর মধ্যে শক্ত সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করানোর সুযোগ পাননি। তিনি ৪জন আলেমকে অঞ্চলভেদে ভাগ করে দিয়েছিলেন দাওয়াতী কাজের জন্য, যারা সবসময় সমাজের মধ্যেই থাকতেন এবং জমঈয়তে আহলেহাদীছের দাওয়াত দিতেন। আল্লামা কাফীনছাহেব নিজেও সবসময় দাওয়াতের উপরই থাকতেন। সাথে সাথে তিনি ‘তর্জুমানুল হাদীছ’ ছাপানোসহ সাংগঠনিক ও দ্বীনী কাজ পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সেই কর্মতৎপরতার ধারাবাহিকতা আর বুঝতে পারিনি।

আর আমীরে জামা‘আত ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব বাংলাদেশে আহলেহাদীছ জামাআ‘তকে একটি সুশৃংখল ও নিয়মতান্ত্রিক সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসেছেন। কথা, কলম এবং সংগঠন নিয়ে তিনি যেভাবে মাঠে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন, আমাদের অন্য কোন আলেম-ওলামাদের মধ্যে সেভাবে দেখা যায়নি। এমনকি খোদ আল্লামা কাফী ছাহেবের রেখা যাওয়া আমানত জমঈয়তে আহলেহাদীছ সাংগঠনিকভাবে তেমন মজবুত নয়, বরং ভঙগুরপ্রায়। বরং সত্য বলতে কি, আমীরে জামা‘আত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আহলেহাদীছ মানহাজের এক ও অদ্বিতীয় নেতৃত্ব, কেউ মুখে স্বীকার করুক বা না করুক। ময়দানে অন্যান্য আহলেহাদীছ সংগঠনগুলি প্রায় নামসর্বস্ব। তাদের মাঝে দাওয়াতী জাযবা এবং সমাজ সংস্কারের আকুতি ও দৃঢ়চিত্ততা তেমন দেখা যায় না। আবার কিছু কিছু আলেম আছেন, যারা সংগঠন করা, না করা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন এবং অযথা নিজেদের মেধা ও শক্তিমত্তাকে ক্ষয় করে চলেছেন। আবার কেউ ঐক্যের মরীচিকাসম মহাসড়ক বানাতে ব্যস্ত আছেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দিন এবং হেদায়াতপ্রাপ্তদের অর্ন্তভুক্ত করে নিন। আমরা যেন তথাকথিত ঐক্যের বাণীর বলি না হয়ে যাই।

তাওহীদের ডাক : একজন সচেতন পাঠক হিসাবে আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের লেখনীর খেদমতকে কিভাবে দেখেন?

ডা. ইদরীস আলী : তাঁর প্রত্যেকটি-দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য ও লেখাই ভাল লাগে। তাঁর লিখিত কিছু পড়তে বসলে কোনদিকে চোখ ফেরাতে পারিনা। তাঁর ভাষা চয়ন এত সাবলীল যে, চুম্বকের মত আকর্ষণ করে। মাসিক আত-তাহরীক কখন বের হবে, সেদিকে পথ চেয়ে থাকি। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?’ বইটা আগেও পড়েছি। গত কয়েকদিন আগে আবারও পড়লাম। পড়ে এত ভাল লাগল যে, বইয়ের কিছু কপি আবার আনিয়ে নিলাম। এই বই সবসময় মানুষের মাঝে বিলি করি। আহলেহাদীছদের সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে এই বইটির বিকল্প নেই। আমি যেখানে যাই বলি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই মানের একজন আলেমও আর আসেননি। আমীরে জামা‘আতের মত এমন একজন সৎ, দূরদর্শী ও প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বকে নেতা হিসাবে পাওয়া আমাদের জন্য বড় সৌভাগ্যের। শুধু তাই নয় বর্তমান সময়ে তাঁর মত একজন সব্যসাচী লেখক ও আলেমের দৃষ্টান্ত বিরল। তাঁর লেখনী নিয়ে কি আর বলব, সেগুলো নিয়েই বেঁচে আছি।

তাওহীদের ডাক : শিক্ষকতার পাশাপাশি ডাক্তারী পেশা কবে থেকে শুরু করেন?

ডা. ইদরীস আলী : ১৯৪৫-৫১ সালে আমি যখন সারদা স্কুলে লেখাপড়া করি, তখন আব্দুল মুত্তালিব নামে আমাদের একজন ধর্মীয় শিক্ষক ছিলেন যিনি আরবী, উর্দূ ও ফার্সী পড়তেন। উনি আবার সকাল-বিকাল হোমিও প্র্যাক্টিস করতেন। আমি ম্যাট্রিক পাস করার পর যে প্রাইমারীতে পড়েছি, সেখানেই চাকুরী পাই। এর কিছু দিন পর সারদা বাযারে গিয়েছিলাম। তখন আমার সেই ধর্মীয় শিক্ষক তাঁর ডিসপেনসারী থেকে আমার নাম ধরে ডাক দিলেন। স্যারের কাছে গিয়ে সালাম-মুছাফাহা করলাম। তারপর স্যার বললেন, কি করছ? আমি বললাম, আপনি যা করছেন তাই-ই (শিক্ষকতা)। তখন স্যার হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকা নামে একটা বই ফ্রি দিয়ে বললেন, যাও বাড়ীতে গিয়ে পড়বে। স্যার মানুষ, বইটা দিলেন যেহেতু কিছু বলতেও পারলাম না। এভাবে আমার ডাক্তারী জীবনের শুরু। বইটা বাড়ীতে নিয়ে এসে পড়ার পর আশ্চর্য হলাম যে, এত চমৎকার বই! এই বই পড়লে আমাকে হোমিও ডাক্তার হতেই হবে। এরপর সেই ১৯৫২ সাল থেকে প্রায় ৬৮ বছর ধরে শিক্ষকতা ও চাকুরীর পাশাপাশি হোমিও ডাক্তারী চলছে।

তাওহীদের ডাক : আপনি কখন বানেশ্বর এলাকায় আসলেন? এখানকার মানুষগুলো কি আগে থেকে আহলেহাদীছ ছিল? আর দাওয়াতী কাজে কখনো কি বাধার শিকার হয়েছেন?

ডা. ইদরীস আলী : আমার চাকুরীকালে ১৯৮০ সালের দিকে আমি বানেশ্বর বাযার এলাকায় চলে আসি। কেননা এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া খুব সহজ ছিল। আর তখনকার সময় চাকুরীজীবীদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল এটি। সাথে সাথে এটি অত্র অঞ্চলের মানুষের ব্যবসা-বানিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। উল্লেখ্য যে, এটি আহলেহাদীছ এলাকা এবং জামিরা আহলেহাদীছ সমাজের দ্বারা পরিচালিত হত। তবে বানেশ্বর ব্যবসায়িক এলাকা হওয়ার কারণে বিভিন্ন মতের মানুষ এখানে বসবাস শুরু করে। ফলে মানুষজন আস্তে আস্তে তাদের নীতি-নৈতিকতা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। পরবর্তীতে আমীর জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের মাধ্যমে তাওহীদ ট্রাস্টের দেওয়া এখানে একটি মসজিদ স্থাপিত হয়। বর্তমানে এই মসজিদকে কেন্দ্র করে অত্র অঞ্চলে দাওয়াতী কার্যক্রম চালু আছে। ফালিল্লাহিল হামদ! আর দাওয়াতের ক্ষেত্রে তেমন কোন বাধাপ্রাপ্ত হয়নি আলহামদুলিল্লাহ। তবে মাঝে-মধ্যে রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা ঝামেলা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সামনা-সামনি আসার সাহস পায়নি।

তাওহীদের ডাক : আমরা শুনেছি আপনি এখনও নাকি প্রচুর পড়াশুনা করেন, আপনার প্রাত্যহিক জীবনের রুটিন যদি বলতেন?

ডা. ইদরীস আলী : হ্যাঁ, আমি পড়াশুনার মধ্য দিয়েই আমার অবসর সময় অতিবাহিত করি। পড়াশুনা ছাড়া আমি থাকতে পারিনা। প্রত্যেকদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা পড়ি। এর মাঝে হোমিও ডাক্তারীর বই পড়ি। তবে সবচেয়ে বেশী পড়ি আমীরে জামা‘আত লিখিত বইগুলো। আর আমাদের বংশের একটি বিশেষ গুণ হ’ল সময় সচেতনতা। আমার আববা খুবই নিয়ম মাফিক চলতেন। আমরাও সে শিক্ষা পেয়েছি। পড়ালেখা, খাওয়া, ঘুমসহ সবকিছুই রুটিনমাফিক। যেমন রাত ৩টার দিকে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ি, তারপর ফজরের ছালাত পড়ে একটু ঘুমাই। ঘুম থেকে উঠে কমপক্ষে ৫টি হাদীছ অনুবাদসহ পড়ি। এরপর সংগঠনের বই ১০/২০/৩০ পৃষ্ঠা পড়ি। এর মাঝে কোন রোগী আসলে দেখি। অবসর থাকলে বই পড়ি।

তাওহীদের ডাক : আপনি ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে এত সুন্দরভাবে জুম‘আর খুৎবা দেন কিভাবে?

ডা. ইদরীস আলী : আমার মনে আছে বৃটিশ আমলে আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন ক্লাস ফাইভে শুক্রবারের ছুটি থাকত না। টিফিনের আগে এক ঘণ্টা ছুটি দিত। তখন পাশের গ্রামে জুম‘আ পড়তে যেতাম। আমার আববা কিসমতুল্লাহ মুনশীকে এলাকার সবাই চিনত। তারা ভাবত আমিও বোধহয় আরবী জানি। তাই আমি গেলে কেউ আর খুৎবা দিতে উঠত না। আর এভাবে খুৎবা দিতে দিতে ছোটবেলা থেকেই আমার খুৎবা দেয়ার অভ্যাস তৈরী হয়েছিল।

তাওহীদের ডাক : যদি আপনার জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য স্মৃতি তুলে ধরতেন?

ডা. ইদরীস আলী :  (১) আমি যখন নাটোর যেলার লালপুর থানার উপযেলা শিক্ষা অফিসার ছিলাম। সেই সময় সরকার থেকে একটি ঘোষণা এসেছিল যে, প্রতিটা থানায় ২টা করে বেসরকারী প্রাইমারী স্কুল সরকারীকরণ করা হবে। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করতে হবে তার একটা ক্যাটাগরী দিল যে, এই ক্যাটাগরীতে সিলেক্ট করতে হবে। সেই ক্যাটাগরীতে আমি নয়টি প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা তৈরী করলাম। কিন্তু বিষয়টি উপযেলা চেয়ারম্যানের এখতিয়ারে থাকায় তিনি আমার উপস্থিতিতে ক্রমিক নং ১ ও ৯টি নিল। বাকীগুলো বাদ দিয়ে দিল। বিশেষ করে আমাদের আহলেহাদীছ ভাইয়ের স্কুলটি তালিকা (২নং) থেকে বাদ দিল। অথচ নিয়মানুযায়ী ১নং ও ২নং অবশ্যই হওয়ার কথা। অন্যায়ভাবে ক্রমিকের ৯নং প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থের বিনিময়ে পাশ করিয়ে নেয়। আমি উপযেলা চেয়ারম্যান ফযলু সাহেবকে বললাম, বড় অন্যায় হয়ে গেল। তিনি বললেন, কি করবেন? তখন বললাম, আমি এ অন্যায়ের ব্যাপারে কিছু করতে চাই। তিনি গায়ের জোরে বললেন, পারলে করেন! তখন আমি ডিস্ট্রিক্ট অফিসে চলে গেলাম। তখন দায়িত্বে ছিলেন বাগমারার কাসেম আলী ছাহেব। স্যারকে সব খুলে বললাম। তিনি বললেন, বাদ দেন। আমি বললাম, এতবড় অন্যায় হবে আর আমি মেনে নিব? আমি আবার ভেরিফিকেশনে যাব, যদি তারা আবার আপীল করে। আর আপনি শুধু যেলা মিটিংয়ে লালপুর থানার নাম আসলে শুধু বলবেন শিক্ষা অফিসার কি বলে একটু দেখবেন। যেলা মিটিংয়ের দিন লালপুর থানার নাম আসলে তিনি তা-ই করলেন। আমার মন্তব্যের পর তিনি বললেন, এত বড় অন্যায় হয়েছে, কাটো এটা। অমনি কেটে দিয়ে আবার ২নং বসিয়ে দিলেন। আমার অন্তরে লেগেছিল এই জন্য যে, তারা যেটা বাদ দিয়েছিল সেটা আহলেহাদীছ গ্রাম ছিল। আলহামদুলিল্লাহ পরে আমার দেয়া সিরিয়াল অনুযায়ী ঢাকা থেকে বিল পাশ হয়ে আসল। পরে আর কোন সমস্যা হয়নি।

(২) মজার কিছু স্মৃতি আছে যেমন- আমি যখন রাজশাহী সিটি কলেজে প্রাইভেটে পড়ি তখন সিটি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল আব্দুল লতীফ ছিল আমার ক্লাসমেট। সে আমার ক্লাসমেট আবার ভাগ্যচক্রে আমার প্রিন্সিপ্যাল। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যায়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষকও হয়েছিলেন। আমরা এক সাথে সারদা হাইস্কুলে পড়েছি। আরেকটি বিষয় হ’ল পড়তে পড়তে চাকুরী, সেটি আবার আমার নিজের পড়া প্রতিষ্ঠানেই। এর ফাঁকে মহান আল্লাহ আমাকে দাওরার কিতাবগুলোও পড়ার তাওফীক দিয়েছিলেন।

তাওহীদের ডাক : এবার যুবসমাজের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ সাংগঠনিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বলতেন? 

ডা. ইদরীছ আলী : একটি সংগঠনের সবচেয়ে বড় নিয়ামক হ’ল নিবেদিত প্রাণ একদল কর্মী বাহিনী। আপনারা তো দেখতেই পাচ্ছেন, সংগঠনে আমার একটাই কাজ ভাল কর্মী তৈরী করা। আসলে ভাল কর্মী তৈরী করতে গেলে নিজেকে আগে ভাল হ’তে হয় এবং আদর্শ কর্মী হ’তে হয়। তবেই ভাল কর্মী তৈরী করা যায়। তা না হ’লে তো ভাল কর্মী তৈরী করা যায় না। আমার এখন তেমন মনে থাকে না। কি করে মনে রাখব বুঝতে পারছি না। বিগত দিনে কিছু করতে পেরেছি। কিন্তু ইদানিং আর তেমন কিছু হচ্ছে না। বেশ কয়েক বছর আগে আমীর সাহেব আমাকে গোটা বাংলাদেশের ‘শ্রেষ্ঠ যেলা সভাপতি’ হিসাবে মনোনীত করেছিলেন। কিন্তু কেন করলেন, তিনি আমাকে বলেননি। আমি কোনদিন জিজ্ঞাসা করিনি। প্রত্যেক কর্মীকে মনে রাখতে হবে, আহলেহাদীছ আন্দোলন নির্ভেজাল তাওহীদের ঝান্ডাবাহী আন্দোলন। ইসলামের নামে যেসব আন্দোলন চলছে তার অধিকাংশই ভুল বা ভেজাল। এগুলো বুঝতে পারাটাই হ’ল আসল কর্মীর কাজ। সাথে সাথে এটা যে নির্ভেজাল তাওহীদের আন্দোলন এটা কাজে প্রমাণ করতে হবে। খালি মুখে বললে তো হবে না। আহলেহাদীছ আন্দোলন জাহান্নাম থেকে বাঁচার আন্দোলন, জান্নাতে যাওয়ার আন্দোলন, মানবতার চিরন্তন মুক্তির আন্দোলন। এই আন্দোলনের কাছে আত্মসমর্পণ করার মানে হ’ল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে আত্মসমর্পণ করা। এভাবেই একজন কর্মী সম্পূর্ণরূপে নিজেকে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। আল্লাহ আমাদের ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করে দিন।

তাওহীদের ডাক : তাওহীদের ডাক পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

ডা. ইদরীস আলী : তাওহীদের ডাক খুবই ভাল একটা পত্রিকা। এতে যুবকদের যথেষ্ট খোরাক আছে। আমি নিজেও এর কপি সংগ্রহ করি। আন্দোলন করতে গেলে আগে যুবসংঘকে বুঝতে হবে। আর তা বুঝতে যুবসংঘে’র মুখপত্র তাওহীদের ডাক নিয়মিত পড়তে হবে। শুধু যুবসংঘ নয়, সংগঠনের সকল স্তরের কর্মীদের নিয়মিত এটা পড়া উচিৎ বলে আমি করি।

তাওহীদের ডাক : জীবন সায়াহ্নে এসে আপনার অনুভূতি কি? জীবনের শেষ ইচ্ছা কি আপনার?

ডা. ইদরীস আলী : আহলেহাদীছ আন্দোলন করতে করতেই যেন কবরে যেতে পারি ইনশাআল্লাহ! সবার কাছে দাবী থাকল আপনারা আমার জন্য আন্তরিকভাবে দো‘আ করবেন যেন ঈমানের সাথে মৃত্যু হয়। যদি দুনিয়া থেকে চলে যাই, সম্ভব হ’লে আমার জানাযায় আসবেন। যদি না আসতে পারেন, তাহলে অন্তত আমার জন্য এবং পরবর্তী বংশধরদের জন্য প্রাণখোলা দো‘আ করবেন। এটাই আমার একমাত্র কামনা শুভাকাঙ্খীদের কাছে।

তাওহীদের ডাক : আপনার জীবনের শেষ ইচ্ছা মহান আল্লাহ পূরণ করুন। আমরা সকলে আপনার জন্য সে দো‘আই করি, আল্লাহ আপনাকে ভাল রাখুন, সুস্থ রাখুন। অসুস্থতার মাঝেও আমাদেরকে আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও মুবারকবাদ।

ডা. ইদরীছ আলী : তোমাদেরকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। আবার আসবে। দো‘আ রাখবে।



আরও