ছূফীদের ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস (২য় কিস্তি)

মুখতারুল ইসলাম 10905 বার পঠিত

ছূফীগণ ইবাদতের ক্ষেত্রে কুরআন-হাদীছকে মাপকাঠি মনে করে না; বরং নিজের মন মত বিধান রচনা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে। রাসূলের পথ ও পদ্ধতির তোয়াক্কা না করেই আল্লাহর নৈকট্য, রেযামন্দী কামনার ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। নিম্নে তার কিছু উদাহরণ দ্রষ্টব্য।


ক. ছালাত :

মুসলমান মাত্রই জানেন যে, আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি পেতে হলে সময়মত পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত এবং নফল ইবাদতসমূহের বিকল্প নেই। কিন্তু ফরয ছালাত কিংবা নফল ইবাদতসমূহের ধারে-কাছে তো নয়ই বরং এর বিরোধী অবস্থানেই তাদেরকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়। অধিকাংশ ছূফীরা মসজিদে জামা‘আতে ছালাত আদায়ে যান না। বরং তারা তাদের খানকায় কয়েক সপ্তাহ, মাস এমনকি বছর পর্যন্ত অবস্থান করেন এবং সেখান থেকে বের হন না। এমনকি তাদের কারও মতে, আধ্যাত্মিকতার নির্দিষ্ট একটি স্তরে পৌঁছালে জামা‘আতে ছালাত বা জুম‘আর ছালাতের প্রয়োজন হয় না। অথচ পবিত্র কুরআনে জামা‘আতে ছালাত আদায়ের তাকিদ দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর এবং রুকূ‘কারীদের সাথে রুকূ‘ কর’।[1] ছালাত সম্পর্কে ছূফীদের অনুসরণীয় কিছু ব্যক্তির আক্বীদা নিম্নরূপ : 

১. ফরীদুদ্দীন আত্বার, যুন নূন মিছরী ছালাত সম্পর্কে বলেন, ‘আল্লাহ আমার জন্য ছালাতের ফরযিয়াত উঠিয়ে নিয়েছেন’।[2]

২. দিমইয়াতী তার উপাদেশাবলীতে উল্লেখ করেন, ‘একাকীত্ব হল সৃষ্টিজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। কোন ভক্ত মরুভূমি, পাহাড়ে (একাকিত্বের ধ্যানে) গেলে তার জন্য জুম‘আ, জামা‘আতে ছালাতের দরকার নেই’।[3] 

৩. তূসী বলেন, ’আবু আব্দুল্লাহ ছাবীহী ত্রিশ বছর ঘর থেকে বের না হয়ে গবেষণা ও ইবাদতে কাটিয়েছেন। যখন তিনি কথা বলতেন, তখন আলেমরা আশ্চর্য হয়ে যেত’।[4]

৪. শা‘রানী বলে, ছূফী সায়্যিদ ইবরাহীম ইবন ঊছায়ফীর মুওযাযযিনের আযান শুনে তালগোল পাকিয়ে ফেলত। সে আন্দাজে বলতে থাকত, হে কুকুর! হে মুসলমানরা! তোমাদেরকে আমরা অস্বীকার করি যতক্ষণ তোমরা আযান দাও’।[5]

৫. তূসী বলে, ‘আমরা ছূফীরা প্রথম কাতারে ছালাত আদায়ে অপসন্দ করি’।[6]

৬. শা‘রানী বলে, ‘ছূফী শায়খরা কখনো জানাযার ছালাতে শরীক হত না’।[7]

পর্যালোচনা ও জবাব :

ছূফীগণের আক্বীদা হ’ল জামা‘আত, জুম‘আ নেই। জানাযার ছালাত, প্রথম কাতার, সমাজের সাথে মিলেমিশে থাকা তাদের আক্বীদার পরিপন্থী। অথচ রাসূল (ছাঃ) জামা‘আতে ছালাত পরিত্যাগকারীদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। ইসলামে কোন অন্ধ ব্যক্তিরও জামা‘আত পরিত্যাগের অনুমতি নেই।[8]

১. মহান আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমাদেরকে জুম‘আর দিন ছালাতের জন্য আযান দেওয়া হয়, তখন আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও এবং ব্যবসা ছেড়ে দাও। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বুঝ’।[9]

২. মহান আল্লাহ বলেন, يَابَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ ‘হে আদম সন্তান! তোমরা প্রত্যেক ছালাতের সময় সুন্দর পোষাক পরিধান কর’।[10]

৩. আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِحَطَبٍ فَيُحْطَبَ ثُمَّ آمُرَ بِالصَّلَاةِ فَيُؤَذَّنَ لَهَا ثُمَّ آمُرَ رَجُلًا فَيَؤُمَّ النَّاسَ ثُمَّ أُخَالِفَ إِلَى رِجَالٍ. وَفِي رِوَايَةٍ: لَا يَشْهَدُونَ الصَّلَاةَ فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوتَهُمْ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ يَعْلَمُ أَحَدُهُمْ أَنَّهُ يَجِدُ عَرْقًا سَمِينًا أَوْ مِرْمَاتَيْنِ حَسَنَتَيْنِ لَشَهِدَ الْعِشَاءَ. ‘আল্লাহর কসম! আমি ইচ্ছা করেছি কিছু লাকড়ি একত্র করার নির্দেশ দিতে এবং তা একত্র করা হবে, অতঃপর আমি ছালাতের আযান দিতে আদেশ করব আর আযান দেওয়া হবে। তৎপর আমি কাউকেও হুকুম দিব লোকের ইমামতি করতে, সে লোকের ইমামতি করবে আর আমি (সে সকল) লোকের বাড়ী বাড়ী যাব। অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে, যারা জামা‘আতে হাযির হয়নি এবং তাদের সহ তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিব। সেই আল্লাহর কসম! যাঁর হাতে আমার জীবন আছে, যদি তাদের কেউ একটা গোশ্তওয়ালা হাড়ের অথবা দুইটা ভাল খুরের খবর পেত, তাহলে নিশ্চয় এশার ছালাতে হাযির হত’।[11]

৪. রাসূল (ছাঃ) সবোর্ত্তম কাজের কথা বলতে গিয়ে বলেন, الصَّلاَةُ لِوَقْتِهَا، وَبِرُّ الْوَالِدَيْنِ، ثُمَّ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ ‘যথাসময়ে ছালাত আদায় করা, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, অতঃপর আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’।[12]

৫. আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم رَجُلٌ أَعْمَى فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّهُ لَيْسَ لِى قَائِدٌ يَقُودُنِى إِلَى الْمَسْجِدِ. فَسَأَلَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ يُرَخِّصَ لَهُ فَيُصَلِّىَ فِى بَيْتِهِ فَرَخَّصَ لَهُ فَلَمَّا وَلَّى دَعَاهُ فَقَالَ هَلْ تَسْمَعُ النِّدَاءَ بِالصَّلاَةِ. فَقَالَ نَعَمْ. قَالَ فَأَجِبْ- ‘এক অন্ধ লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ধরে মসজিদে নিয়ে আসার মত কেউ নেই। অতঃপর তাকে বাড়ীতে ছালাত আদায় করার অনুমতি প্রদান করার জন্য সে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে আবেদন জানাল। তিনি তাকে বাড়িতে ছালাতের অনুমতি দিলেন। কিন্তু যে সময় লোকটি ফিরে যেতে উদ্যত হল, তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ছালাতের আযান শুনতে পাও? সে বলল, হ্যাঁ। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তাহলে তুমি মসজিদে আসবে’।[13]

খ. ছিয়াম :

তারা ছিয়াম সম্পর্কে যেসব আক্বীদা পোষণ করে, তার সাথে ইসলামী শরী‘আতের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। তারা মনে করে ছিয়ামের প্রচলিত নিয়ম তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়, কেননা প্রভুর ধ্যানে আত্মমগ্ন থাকেন বলে তারা প্রতিমুহূর্তেই ছিয়াম তথা উপবাসব্রতের মধ্যে থাকেন। যেমন :

১. সাহরূরদী বলেন, ছূফী মাশায়েখরা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করা পর্যন্ত সফর, মুক্বীম সর্বাবস্থায় ছিয়ামের মধ্যে থাকেন’।[14]

২. তূসী বলে, আমি আবুল হাসান মাক্কীকে দেখেছি, তিনি সারাক্ষণ ছিয়াম রাখতেন। শুধুমাত্র জুম‘আর দিন রাতে একটু-আধটু রুটি খেতেন।[15]

৩. আহমাদ সাত্বীহা সম্পর্কে শা‘রানী বলে, তিনি অন্তরের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতেন এবং সারা বছর ছিয়াম রাখতেন।[16]

পর্যালোচনা ও জবাব :

ছূফীগণ রাসূল (ছাঃ)-এর শিক্ষার বিরোধিতা করে হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের সাদৃশ্যতা গ্রহণ করেছে। তারা মূলতঃ ছিয়ামের ব্যাপারে হিন্দুদের কসরত, উপবাস ও খ্রিস্টানদের অতি-প্রাকৃত ঘটনাসমূহ, বরকত, তাজাল্লী, ক্ষুধামিশ্রিত সন্ন্যাসবাদকে আলিঙ্গন করেছে। তারা মনে করে, ক্ষুধা মানুষকে জ্ঞান, হিকমত, এলাহী আলোর প্রতীক বানায়। এভাবে ছূফীরা নিজেদের জীবনবিধান রচনা করেছে ও তারই অনুসারী হয়েছে।[17]

অথচ ছিয়ামের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) সুস্পষ্টভাবে বলেন, أَلَمْ أُخْبَرْ أَنَّكَ تَصُومُ وَلاَ تُفْطِرُ، وَتُصَلِّى وَلاَ تَنَامُ ، فَصُمْ وَأَفْطِرْ، وَقُمْ وَنَمْ، فَإِنَّ لِعَيْنِكَ عَلَيْكَ حَظًّا، وَإِنَّ لِنَفْسِكَ وَأَهْلِكَ عَلَيْكَ حَظًّا. قَالَ إِنِّى لأَقْوَى لِذَلِكَ. قَالَ فَصُمْ صِيَامَ دَاوُدَعَلَيْهِ السَّلاَمُ. قَالَ وَكَيْفَ قَالَ كَانَ يَصُومُ يَوْمًا وَيُفْطِرُ يَوْمًا، وَلاَ يَفِرُّ إِذَا لاَقَى. قَالَ مَنْ لِى بِهَذِهِ يَا نَبِىَّ اللَّهِ قَالَ عَطَاءٌ لاَ أَدْرِى كَيْفَ ذَكَرَ صِيَامَ الأَبَدِ، قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ صَامَ مَنْ صَامَ الأَبَدَ- ‘আমি কি এ কথা ঠিক শুনিনি যে, তুমি ছিয়াম পালন করতে থাক আর ছাড় না এবং তুমি (রাতভর) ছালাত আদায় করতে থাক আর ঘুমাও না? রাসূল বললেন, তুমি ছিয়াম পালন কর এবং মাঝে মাঝে তা ছেড়ে দাও। রাতে ছালাত আদায় কর এবং নিদ্রাও যাও। কেননা তোমার উপর তোমার চোখের হক রয়েছে এবং তোমার নিজের শরীরের ও তোমার পরিবারের হক তোমার উপর আছে। রাবী বললেন, আমি এর চেয়ে বেশী শক্তি রাখি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তাহলে তুমি দাউদ (আঃ)-এর ছিয়াম পালন কর। রাবী আবার বললেন, তা কিভাবে? তিনি বললেন, দাউদ (আঃ) একদিন ছিয়াম পালন করতেন, একদিন ছেড়ে দিতেন এবং তিনি শক্রর মুখোমুখি হলে পলায়ন করতেন না। রাবী আব্দুল্লাহ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমাকে এ শক্তি কে যোগাবে? বর্ণনাকারী আত্বা (রহঃ) বলেন, আমার মনে নেই কিভাবে তিনি সার্বক্ষণিক ছিয়ামের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছিলেন, তবে (এ কথাটুকু মনে আছে যে,) নবী করীম (ছাঃ) দু’বার একথাটি বলেছিলেন, সার্বক্ষণিক ছিয়াম, কোন ছিয়ামই নয়।[18]

গ. যাকাত :

যাকাত সম্পর্কের তাদের আক্বীদা ঈমান বিধ্বংসী। যাকাতের শরঈ পদ্ধতি তাদের নিকট গুরুত্বহীন। যেমন :

১. ইবন যারূক উল্লেখ করেন, যখন শিবলীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, পাঁচটি উটের যাকাত কয়টি? প্রশ্ন শুনে শিবলী চুপ থাকলেন। ইবন বাশশার একটু বাড়িয়ে বলেছেন, শিবলী তাকে বলেন, শরী‘আতে একটি ছাগী দেওয়া ওয়াজীব। আল্লাহর জন্য অনুরূপভাবে সবকিছুই ওয়াজিব’।[19]

২. হুজায়রী বলেন, ব্যবসা বিষয়ক একটি প্রশ্ন শিবলীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যা ছিল যাকাত সংক্রান্ত। তিনি বলেন, যাকাত দেয়া আবশ্যিক হলে, আর মনে কৃপণতা থাকলে, দুইশত দিরহামে পাঁচ দিরহাম যাকাত দিলেই হবে। আর বিশ দিরহামে অর্ধ দিনার। এটা হল তোমার মাযহাব। আর আমার মাযহাবে কোন কিছুর আবশ্যিকতা নেই’।[20]

ঘ. হজ্জ

তারা হজ্জ নিয়েও হাসিঠাট্টা করে। আবার কখনো কোন পাথেয় ছাড়াই বের হয় এবং মানুষদের কাছে হাত পাতে।[21] যেমন :

১. আবু ইয়াযীদ বুস্তামী থেকে আত্ত্বার বর্ণনা করেন, সে একবার হজ্জের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার গিয়ে আবার বাড়ি ফিরে আসেন। তাকে তার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। সে বলেছিল, রাস্তায় একজন হাবশী গোলামের সাথে দেখা হলে সে আমাকে বলল, আল্লাহর শহর (বুস্তাম) ছেড়ে কোথায় বের হয়েছেন? ফলে আমি ফিরে এসেছি’।[22]

২. হুজায়রী বুস্তামী সম্পর্কে বলেন, আমি মক্কায় পৌঁছালাম এবং ঘরটা একাকী দেখতে পেলাম। আমি বললাম, আমার হজ্জ কবুল হবে না। কারণ এ ধরণের পাথর তো আমি অনেক দেখেছি। আমি আবার হজ্জে গেলাম, দেখলাম আল্লাহর ঘরটি। আমি মনে মনে বললাম, এতে তাওহীদের কোন হাকীকত বাকী নেই। আমি তৃতীয়বার গেলাম, দেখলাম এটা কখনো আল্লাহর ঘর হতে পারে না। এটা তো শুধুই ঘর’।[23]

৩. তারা বলে, কা‘বা ঘরের প্রতিটি পাথর শায়খ ইবরাহীম মাতবূলীকে প্রদক্ষিণ করল। আবার তারা স্ব স্ব স্থানে ফিরে গেল’।[24]

৪. লোকেরা একদিন শিবলীর হাতে একটি আগুনের মশাল দেখল। তাকে তার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, আমি কা‘বা ঘরকে পুড়িয়ে ফেলব। যাতে করে মানুষরা (এই ঘর ছেড়ে) তার প্রভুমুখী হয়’।[25]

পর্যালোচনা ও জবাব

হজ্জ নিয়ে তাদের এই নিকৃষ্ট আক্বীদা সম্পর্কে আর কিছু বলার নেই। মক্কা, মদীনা, বায়তুল্লাহ তাওয়াফ ইত্যাদি নিয়ে তারা যেভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, যা সীমার বাহির। ইসলামের পঞ্চম রুকনের অন্যতম রুকনের সাথে এ ধরণের আক্বীদা নিঃসন্দেহে কুফরী। [26]

৩. শরী‘আত রহিতকরণ :

ছূফীবাদ স্বেচ্ছাচারিতামূলক কুরুচিপূর্ণ গল্প-কেচ্ছা-কাহিনীতে ভরা এক উপাখ্যানের নাম। নারী, মদ এমনকি চতুষ্পদ জন্তুর সাথেও এদের কুকীর্তির গল্প রয়েছে। অথচ তারাই নিজেদেরকে আল্লাহর ওলী বলে জোর দাবী করে। ইবনু আরাবী নিজেই নিজের কুকীর্তির সাফাই গেয়েছেন। তিনি বলেন, মক্কায় তিনি এক যুবতীর প্রেমে পড়েন। মক্কায় তাওয়াফের সময় মেয়েটিকে দেখে তিনি গযল গাইলেন এবং প্রলুব্ধ করলেন। অতঃপর তিনি তাকে বললেন, হে খালার মেয়ে! তোমার নাম কি? মেয়েটি বলল, আমার নাম কুররাতুল আইন। অতঃপর ছূফী সম্রাট নিজের মনের সব কথা তাকে খুলে বললেন। অতঃপর মেয়েটির সাথে তার অনেকবার মেলামেশা হয়। বায়তুল্লাহর নিকট তিনি মেয়েটির প্রেম নিবেদনে কিছু কবিতাও রচনা করেন।[27]

এভাবে তারা শরীআ‘তের কোন ধার ধারে না। হালাল-হারামের কোন তোয়াক্কা করে না। বরং নিজেদেরকে আল্লাহর ওলী ভেবে নিজেদেরকে শরীআ‘তের বিধি-নিষেধের গন্ডিমুক্ত রাখে। যেমন :

১. তারা বলে, যখন কেউ মাকামাল ইয়াকীন তথা নিশ্চিন্ত বিশ্বাসের জায়গায় চলে যায়, তখন তার আর নিয়মিত আমলের প্রয়োজন হয় না। তার বলে, মহান আল্লাহ বলেছেন, وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ ‘আর তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর, যতক্ষণ না নিশ্চিত কথা তোমার নিকট উপস্থিত হয়’।[28][29]

২. শা‘রানী ‘ছাহেবুল কাশফ’ নামে খ্যাত সায়্যিদ শরীফ সম্পর্কে বলেন, সে রামাযানে দিনের বেলায় খেত আর বলত, আমি স্বাধীন, আমার প্রভু আমাকে আযাদ করেছেন’।[30]

পর্যালোচনা ও জবাব

রাসূল (ছাঃ) সকল মানবতার জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরনীয় ব্যক্তিত্ব। তার আনীত বিধান, হালাল-হারামের প্রতি ঈমান আনায়ন ও অনুসরণ প্রতিটি মুসলমানের আবশ্যিক কর্তব্য। আর যদি কোন ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনায়নে ব্যর্থ হয়, তাহলে সে কাফের ও মুনাফিক। ইমাম ইবন তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, প্রতিটি রাসূলের দাওয়াত ছিল এক আল্লাহর ইবাদত ও তাঁদের আনীত দ্বীনের আনুগত্য। রাসূলগণের প্রতি ঈমান ইসলামের অন্যতম রুকন। যদি কেউ আল্লাহ প্রেরিত ও জগদ্বাসীর জন্য প্রেরিত পুরুষ রাসূল (ছাঃ) প্রদত্ত হালাল, হারাম ব্যতীত অন্য দ্বীন তালাশ করে, তাহলে সে কাফের এবং রাসূলের আনুগত্য ও ইসলামী শরী‘আত থেকে বেরিয়ে যাবে। ফলে এ কথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, আল্লাহর ওলী ছূফীগণ বাতিল আক্বীদা-বিশ্বাস ও কর্মকান্ডের কারণে মুহাম্মাদী শরী‘আত থেকে বহিস্কৃত। তারা যতই তথাকথিত ইবাদত গুযার, যাহেদ বা দুনিয়াত্যাগী হওয়ার দাবীদার হৌক না কেন? [31]

৪. হালাল-হারাম প্রসঙ্গ

ছূফীগণ শরীআ‘তের হারামকৃত বিধান হালাল ও হালালকৃত বিধান হারাম গণ্য করে। আল্লাহ তা‘আলা মানবতার কল্যাণে খাদ্য-পানীয়, পোষাক-পরিচ্ছদ সার্বিক বিষয়ে হালাল-হারামের মানদন্ড নির্ধারণ করেছেন, তা তারা অমান্য করে। নিজেকে কষ্ট দেয়া, না খেয়ে থাকার মত অসাধ্য সাধনের ব্যর্থ প্রয়াস চালাতে গিয়ে আল্লাহর বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা করে না। তারা দুনিয়াবী শিষ্টাচার সংক্রান্ত খাওয়া, পানাহার, পোষাক পরিধান, বিশ্রাম, আয়-ইনকাম, ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে রাসূল (ছা.)-এর আদর্শ মানে না।[32] বরং রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শের বাইরে তারা নিজেদের বানানো ধর্মের অনুসরণ করে। যেমন :

১. তারা বলে, ছূফীরা অতিরিক্ত কথাবার্তা বলে না। ক্ষুধা সহ্য করে ও দুনিয়াত্যাগী হয়।[33]

২. রুন্দী বলেন, ক্ষুধা হ’ল ছূফী বিশ্বাসের অন্যতম রুকন। অন্যান্যগুলো হ’ল চুপ থাকা, একাকীত্ব ও রাত্রি জাগরণ। যে ব্যক্তি এই চারটি গুণ অর্জন করতে পারবে, সে সবগুলোই অর্জন করল এবং আওলীয়াদের স্তরে উন্নীত হল।[34]

৩. খার্রায থেকে শা‘রানী বলেন, ক্ষুধা দুনিয়াত্যাগীদের খাবার’।[35]

৪. তারা বলে, আবু উকাল মাগরিবী তার কাজের শুরুতে এক বছর খাওয়া-দাওয়া, পানাহার ও ঘুম থেকে বিরত ছিল’।[36]

৫. আত্ত্বার বলে, চল্লিশ বছর থেকে মনে মধু খাওয়ার তামান্না ছিল, কিন্তু তা পাইনি’।[37]

৬. যখন আবু ইয়াযীদ বুস্তামীকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনাকে তো আয়-উপার্জন করতে দেখি না; আপনার জীবিকা কোত্থেকে আসে? সে বলে, আমার প্রভু আমাকে খাওয়ায় যেভাবে চতুষ্পদ জন্তু কুকুর, শুকরকে তিনি খাওয়ান’।[38]

৭. আতা সুলামীর ব্যাপারে বলা হয়, তিনি রাত্রি গভীর হলে গোরস্তানে যেতেন এবং ফজর পর্যন্ত কবরবাসীদের সাথে গোপনালাপ করতেন।[39]

৮. হুজায়রী বলে, নূরী ছাহেব তিনদিন তিন রাত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেছে এবং চিৎকার করেছে একটুও নড়েনি’।[40]

৯. তারা বলে, আতা সুলামী চল্লিশ বছর হাসেনি’।[41]

১০. মুতাররাফ ইবন আব্দুল্লাহ শিখখীর সম্পর্কে শা‘রানী বলে, সে বলেছে, কাউকে কারামাত যাহির করতে হ’লে খানাপিনা ও মেয়েদের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে’।[42]

১২. সিরাজ তূসী একজন ছূফীর কথা বলতে গিয়ে বলে, সে একজন মেয়েকে বিয়ে করে ত্রিশ বছর ঘরসংসার করলেও সেই মেয়েটির কুমারীত্ব অবশিষ্টই ছিল’।[43]

পর্যালোচনা ও জবাব

ছূফীদের দুনিয়া ত্যাগ, নিজেকে কষ্ট দেয়া, রুযী তালাশে অনীহা, রাত্রি জাগরণ, হাসি বর্জন, দুঃখের মধ্যে ডুবে থাকা, মানুষের সঙ্গ ত্যাগ, বিয়েশাদীতে অনীহাসহ নানা হাস্যকর ও অবাস্তব কর্মকান্ড মহাজ্ঞানী, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে ঠাট্টা-মশকারা ছাড়াই আর কিছুই নয়।

কোন কাজ যতই সুন্দর, মর্যাদাবান ও নিজের পসন্দের হৌক না কেন, তা যদি আল্লাহ প্রদত্ত ও সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক নির্দেশিত না হয়, তবে তা কোন শরী‘আতই নয়; বরং তা প্রত্যাখ্যাত। শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহর সাথে শিরক ও তদীয় রাসূল ও কিতাবকে অস্বীকার করার শামিল। কেননা পরিপূর্ণ দ্বীনে নতুন কিছু সংযোজন অগ্রহণীয় ও বিদ‘আত’।[44]

১. মহান আল্লাহ বলেন, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’।[45]

২. মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাক’।[46]

৩. মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন ও তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’।[47]

৪. হাদীছে এসেছে, وَعَن مَالك بن أنس مُرْسَلًا قَالَ قَالَ رَسُولُ تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ رَسُوْلِهِ. ইমাম মালেক বিন আনাস (রাঃ) মুরসাল সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন যে, ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে গেলাম। তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না, যতদিন তোমরা সে দু’টিকে কঠিনভাবে ধরে থাকবে। সে দু’টি বস্ত্ত হল, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ’।[48]

৫. হাদীছে এসেছে, ইবরায বিন সারিয়াহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন আমাদের নিয়ে ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসলেন। অতঃপর আমাদেরকে এমন মর্মস্পর্শী ভাষায় ওয়ায করলেন যে, চক্ষুসমূহ অশ্রুসজল হয়ে গেল এবং হৃদয়সমূহ ভীত-বিহবল হয়ে গেল। এমন সময় একজন লোক বলে উঠল, হে আল্লাহর রাসূল! মনে হচ্ছে এটা যেন বিদায়ী উপদেশ। অতএব আপনি আমাদেরকে আরও বেশী উপদেশ দিল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির উপদেশ দিচ্ছি এবং তোমাদের আমীরের আদেশ শুনতে ও মান্য করতে উপদেশ দিচ্ছি, যদিও তিনি একজন হাবশী গোলাম হন। কেননা আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে, তারা সত্বর বহু মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরবে। তাকে কঠিনভাবে ধরবে এবং মাড়ির দাঁতসমূহ দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টিসমূহ হতে দূরে থাকবে। কেননা (দ্বীনের ব্যাপারে) যেকোন নতুন সৃষ্টি হ’ল বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আত হল পথভ্রষ্টতা’।[49]

৬. হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ قَالَ كُلُّ أُمَّتِى يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ، إِلاَّ مَنْ أَبَى قِيْلَ وَمَنْ أبَى؟ قَالَ مَنْ أَطَاعَنِى دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ أَبَى. আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন ‘আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে, কেবল ঐ ব্যক্তি ব্যতীত যে অসম্মত। জিজ্ঞেস করা হল, কে অসম্মত? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আমার অবাধ্যতা করবে, সে (জান্নাতে যেতে) অসম্মত’।[50]

৭. হাদীছে এসেছে, আনাস (রাঃ) বলেন, ‘একদিন তিনজন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণের নিকটে এল তাঁর ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য। অতঃপর যখন রাসূলের ইবাদত সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করা হল, তখন তারা সেটাকে কম মনে করল এবং বলল, নবী (ছাঃ) থেকে আমরা কত দূরে! তাঁর আগে-পিছের সকল গুনাহ মাফ। অতঃপর তাদের একজন বলল, ‘আমি এখন থেকে সর্বদা সারা রাত ছালাতে রত থাকব’। অন্যজন বলল, ‘আমি প্রতিদিন ছিয়ামে কাটাব, কখনো ইফতার করব না’। অন্যজন বলল, ‘আমি নারীসঙ্গ থেকে দূরে থাকব, কখনো বিয়ে করব না’। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের মধ্যে ইপস্থিত হলেন এবং বললেন তোমরাই কি সেই লোকেরা, যারা এমন এমন কথা বলছিলে? শুনে রাখ, আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু ও সর্বাধিক পরহেযগার। কিন্তু আমি ছিয়াম রাখি আবার ছেড়েও দেই, ছালাত পড়ি, নিদ্রাও যাই, আমি বিবাহ করেছি। অতএব যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত হতে মুখ ফিরিয়ে নিবে, সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়।[51]

৮. হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ أنَّ رَسُوْلَ اللهِ كَانَ يَقُوْلُ لَا تُشَدِّدُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ فَيُشَدَّدَ عَلَيْكُمْ فَإِنَّ قَوْمًا شَدَّدُوْا عَلَى أَنْفُسِهِمْ فَشَدَّدَ اللهُ عَلَيْهِمْ فَتِلْكَ بَقَايَاهُمْ فِي الصَّوَامِعِ وَالدِّيَارِ وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوْهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ. আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলতেন, তোমরা নিজেদের উপর কঠোরতা আরোপ কর না; আল্লাহ তোমাদের উপর কঠোর বিধান চাপিয়ে দিবেন না। পূর্বে এরূপ অনেক সম্প্রদায় নিজেদের উপর কঠোরতা আরোপ করেছিল; ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর কঠোর বিধান চাপিয়ে দিয়েছিলেন; গির্জা ও পাদ্রীদের ধর্মশালায় যে সমস্ত লোক আছে, এরা তাদের উত্তরসূরী। তারা নিজেরাই নিজেদের জন্য ‘রাহবানিয়াত’কে আবিষ্কার করেছিল, যা আমি তাদের উপর বিধান করিনি’।[52]

৯. হাদীছে এসেছে, عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُا قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللهِ مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ. আয়েশাপবলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[53]

১০. মহান আল্লাহ বলেন, يَابَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ- قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ ‘হে আদম সন্তান! তোমরা প্রত্যেক ছালাতের সময় সুন্দর পোষাক পরিধান কর। তোমরা খাও ও পান কর। কিন্তু অপচয় কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালবাসেন না। বলে দাও, আল্লাহর সাজ-সজ্জা, যা তিনি বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্যসমূহ কে হারাম করেছে? বলে দাও, এসব নে‘মত তো খালেছভাবে কেবল মুমিনদের জন্যই পার্থিব জীবনে এবং ক্বিয়ামতের দিনে। এভাবে আল্লাহ আয়াতসমূহ ব্যাখ্যা করেন বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য’।[54]

১১. মহান আলালহ বলেন, وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللهُ إِلَيْكَ وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ إِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ- ‘আর আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন, তার দ্বারা আখেরাতের গৃহ সন্ধান কর। অবশ্য দুনিয়া থেকে তোমার প্রাপ্য (অপচয়হীন হালাল) অংশ নিতে ভুল না। আর অন্যের প্রতি অনুগ্রহ (ছাদাক্বা) কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের ভালবাসেন না (অর্থাৎ প্রতিশোধ নেবেন)’। [55]

১২. মহান আল্লাহ বলেন, وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ- وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ-وَتَحْمِلُ أَثْقَالَكُمْ إِلَى بَلَدٍ لَمْ تَكُونُوا بَالِغِيهِ إِلَّا بِشِقِّ الْأَنْفُسِ إِنَّ رَبَّكُمْ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ-وَهُوَ الَّذِي سَخَّرَ الْبَحْرَ لِتَأْكُلُوا مِنْهُ لَحْمًا طَرِيًّا وَتَسْتَخْرِجُوا مِنْهُ حِلْيَةً تَلْبَسُونَهَا وَتَرَى الْفُلْكَ مَوَاخِرَ فِيهِ وَلِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ‘তিনি চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন। তাতে তোমাদের জন্য শীত নিবারণের উপকরণ ও অন্য কল্যাণ রয়েছে এবং সেখান থেকে তোমরা ভক্ষণ করে থাক। আর যখন সন্ধ্যাকালে ওদেরকে চারণ ভূমি হতে ঘরে নিয়ে আসো এবং সকালে যখন ওদেরকে চারণ ভূমিতে নিয়ে যাও, তখন তোমরা ওর সৌন্দর্য উপভোগ করে থাক। আর ওরা তোমাদের ভার বহন করে নিয়ে যায় এমন দেশে যেখানে তোমরা প্রাণান্ত ক্লেশ ব্যতীত পৌঁছতে পারবে না। তোমাদের প্রতিপালক অবশ্যই স্নেহশীল ও পরম দয়ালু। তিনিই সমুদ্রকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা সেখান থেকে তাযা মাছ ভক্ষণ করতে পার এবং সেখান থেকে তোমাদের পরিধেয় রত্নালংকার আহরণ করতে পার। তুমি তার বুক চিরে নৌযান চলতে দেখ, যাতে তোমরা সেখান থেকে তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর’।[56]

১৩. নিজের হাতের কামাই সবোর্ত্তম। রাসূল (ছাঃ) এ প্রসঙ্গে বলেন, مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ، وَإِنَّ نَبِىَّ اللَّهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনো কেউ খায় না। আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন’।[57]

১৪. নিজেকে অযথা শরী‘আত বহির্ভূত কষ্ট দেয়া অন্যায়। এ প্রসঙ্গে রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم رَأَى شَيْخًا يُهَادَى بَيْنَ ابْنَيْهِ قَالَ مَا بَالُ هَذَا. قَالُوا نَذَرَ أَنْ يَمْشِىَ. قَالَ إِنَّ اللهَ عَنْ تَعْذِيبِ هَذَا نَفْسَهُ لَغَنِىٌّ. وَأَمَرَهُ أَنْ يَرْكَبَ. নবী করীম (ছাঃ) এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে তার দুই ছেলের উপর ভর করে হেঁটে যেতে দেখে বললেন, তার কি হয়েছে? তারা বললেন, তিনি পায়ে হেঁটে হজ্জ করার মানত করেছেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বললেন, লোকটি নিজেকে কষ্ট দিক আল্লাহ তা‘আলার এর কোন দরকার নেই। অতঃপর তিনি তাকে সওয়ার হয়ে চলার জন্য আদেশ করলেন’।[58]

১৫. না হেসে গোমড়া মুখে থাকাকে ছূফীরা পরহেযগারিতার অন্যতম লক্ষণ বলে মনে করেন। রাসূল (ছাঃ)-এর বিরোধিতা করে বলেন, مَا رَأَيْتُ أَحَدًا أَكْثَرَ تَبَسُّمًا مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم (রাবী বলেন,) আমি রাসূল (ছাঃ)-এর চেয়ে অধিক মুচকি হাসতে আর কাউকে দেখিনি’।[59]

(ক্রমশঃ)

[লেখক : কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রকাশনা সম্পাদক ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’]


[1]. আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ, আয়াত-২/৪৩।

[2]. ইহসান ইলাহী যহীর, দিরাসাত ফিত তাছাওউফ, পৃ. ৯৬; গৃহীত : ফরীদুদ্দীন আত্বার, তাযকিরাতুল আওলিয়া, পৃ. ৭৩।

[3]. তদেব, পৃ. ৯৪; গৃহীত : দিমইয়াতী, কিফাইয়াতুল আতকা ওয়া মিনহাজুল আছফা, পৃ. ৩৫।

[4]. তদেব, পৃ. ৯০।

[5]. তদেব, পৃ. ৯৬।

[6]. তদেব, পৃ. ৯৭।

[7]. তদেব, পৃ. ৯৪।

[8]. তদেব, পৃ. ৯৭।

[9]. আল-কুরআন, সূরা জুম‘আহ, আয়াত-৬২/৯।

[10]. আল-কুরআন, সূরা আ‘রাফ, আয়াত-৭/৩১।

[11]. বুখারী হা/২৪২০,৬৪৪; মুসলিম হা/১৩৬৮, ২৫২; নাসাঈ হা/৮৫৬; আহমাদ হা/৮৩২৪; বায়হাক্বী হা/৪৭০৯; মিশকাত হা/১০৫৩।

[12]. বুখারী হা/৭৫৩৪, ৪৩৬; মুসলিম হা/৮৫; তিরমিযী হা/১৭০; আবুদাঊদ হা/৪২৬।

[13]. মুসলিম হা/১৩৭২, ২৫৫; মিশকাত হা/১০৫৪।

[14]. দিরাসাত ফিত তাছাওউফ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৯; গৃহীত : সাহরূরদী, আওয়ারিফ মা‘আরিফ, পৃ. ৩৩১।

[15]. তদেব, পৃ. ১০০; গৃহীত : তূসী, কিতাবুল লাম‘, পৃ. ২২০।

[16]. তদেব; গৃহীত : ত্বাবাকাতুশ শা‘রানী, ২/১৩৮ পৃ.।

[17]. তদেব, পৃ. ৯৯।

[18]. বুখারী হা/১৯৭৭; মুসলিম হা/২৭৯১, ১১৫৯।

[19]. দিরাসাত ফিত তাছাওউফ, পৃ. ১০১।

[20]. তদেব।

[21]. তদেব, পৃ. ১০২।

[22]. তদেব, পৃ. ১০২।

[23]. তদেব, পৃ. ১০৩।

[24]. তদেব, পৃ. ১০৩।

[25]. তদেব, পৃ. ১০৫।

[26]. তদেব, পৃ. ১০৪।

[27]. তদেব, পৃ. ২৭১; গৃহীত : ইবনু আরাবী, যাখায়েরুল আ‘লাক্ব, পৃ. ৭, ৮।

[28]. সূরা হিজর ১৫/৯৯।

[29]. দিরাসাত ফিত তাছাওউফ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬২; গৃহীত : যুবায়দী, ইতহাফুস সা‘আদা, ৮/২৭৮ পৃ.; ড. ইরফান আব্দুল হামীদ, নাশআতুল ফালসাফাহ আছ-ছূফীয়াহ ওয়া তাতাওউরুহা, পৃ. ৭৪।

[30]. তদেব, গৃহীত : কালাবাজী, ওয়াত তা‘আররুফ, পৃ. ১৬৩।

[31]. তদেব, পৃ. ২৬৬; গৃহীত : ইবনু জাওযী, মাজমূ‘আতুর রাসায়েল, পৃ. ৪৪-৪৫।

[32]. তদেব, পৃ. ৬৬।

[33]. তদেব, পৃ. ২৩।

[34]. তদেব, পৃ. ২৩।

[35]. তদেব, পৃ. ২৩।

[36]. তদেব, পৃ. ২৩।

[37]. তদেব, পৃ. ৩৮।

[38]. তদেব, পৃ. ৪১।

[39]. তদেব, পৃ. ৪৬।

[40]. তদেব।

[41]. তদেব, পৃ. ৫১।

[42]. আত-তাছাওউফ আল-মানশা ওয়াল মাছাদির, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬০।

[43]. তদেব ।

[44]. দিরাসাত ফিত তাছাওউফ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫।

[45]. সূরা মায়েদাহ, আয়াত-৫/৩।

[46]. সূরা হাশর, আয়াত-৫৯/৭।

[47]. সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৩/৩১।

[48]. মুওয়াত্তা হা/১৬২৮; মিশকাত হা/১৮৬।

[49]. আহমাদ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৬৫।

[50]. বুখারী, মিশকাত হা/১৪৩।

[51]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৫।

[52]. আবুদাঊদ হা/৪৯০৪; মিশকাত হা/১৮১।

[53]. বুখারী, মুসলিম, আবুদাউদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৪০।

[54]. সূরা আ‘রাফ ৭/৩১-৩২।

[55]. সূরা ক্বাছাছ, আয়াত-২৮/৭৭।

[56]. সূরা নাহল ১৬/৫,৬,৭,১৪।

[57]. বুখারী হা/২০৭২,৩২৩; বায়হাক্বী হা/ ১১৪৭১।

[58]. বুখারী হা/১৮৬৫,১২৩।

[59]. তিরমিযী হা/৩৬৪১।



আরও