রামাযান ও ছিয়ামের কতিপয় ভুল-ভ্রান্তি
আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মিনারুল ইসলাম 2501 বার পঠিত
ভূমিকা : জান্নাত পিয়াসী মুমিনের চাই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর তা অর্জিত হ’তে পারে নেক আমল অনুশীলনের মাধ্যমে। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাকে নৈকট্যের চাদরের জড়িয়ে নেন, যখন সে নিজেকে তাঁর প্রদত্ত প্রিয়তর আমল দ্বারা নিজেকে প্রমাণ করতে পারে। কোন কোন ব্যক্তি মহান আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয় তা নিম্নে পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হ’ল।
১. মুহসিন বা সৎকর্মশীল :
হাসানাহ, ইহসান এবং মুহসিন শব্দত্রয় একে অপরে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইহসান শব্দের শাব্দিক অর্থ হ’ল দৃঢ়তা, একনিষ্ঠতা, সততা ইত্যাদি। ইহসান হ’ল আবশ্যিক বিষয়গুলো আদায় করা এবং নিষেধকৃত বস্ত্ত পরিত্যাগ করা, কল্যাণকর কাজে প্রচেষ্টা চালানো, গরীবদের বেশী বেশী দান করা, দুঃখীদের পাশে দাঁড়ানো, রোগীর শুশ্রুষা করা, যালেমকে প্রতিহত করা এবং মাযলূমকে সাহায্য করা, হাঁচির জবাব দেয়া, সালামের জবাব দেয়া, ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের প্রতিরোধ, আল্লাহর পথে দাওয়াত এবং মানুষকে দ্বীন শিক্ষা দেয়া। সর্বোপরি মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা।
ইহসান হ’ল প্রতিটি কর্মে রবকে হাযির-নাযির জানা এবং সবকিছু তার দৃষ্টিগোচরে আছে বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস রেখে কর্মে লেগে থাকা। রাসূল (ছাঃ) ইহসানের ব্যাখ্যায় বলেন, أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত কর যেন তুমি তাকে দেখছ। যদি দেখতে না পাও, তাহ’লে বিশ্বাস কর যে, তিনি তোমাকে দেখছেন’।[1]
আল্লাহ ও তদীয় রাসূল আমাদেরকে ইহসান করতে আদেশ করেছেন। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও নৈকট্য হাসিলের জন্য পরস্পরে হাসানাহ বা কল্যাণময় কাজের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা করা উচিৎ। একজন মুমিন আল্লাহর প্রিয়তর বান্দাতে পরিণত হ’তে এবং তার ভালবাসা পেতে মুহসিন হওয়ার বিকল্প নেই। আর মুহসিন হ’তে গেলে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য ইবাদতে মনোনিবেশ করা, তার শাস্তিকে ভয় করা, তাক্বওয়া অবলম্বন করা এবং একনিষ্ঠভাবে তাঁকে ডাকা প্রয়োজন।
বস্ত্ততঃ যাবতীয় শ্রুতি ও রিয়া তথা লোক দেখানো ও সুনাম কুড়ানো আমল থেকে মুখ ফিরিয়ে একনিষ্ঠভাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে প্রতিটি ক্ষণই হওয়া চাই মুমিন-মুহিসীনদের একমাত্র কাম্য।
যে সৎকর্ম করে, সে নিজের ভালোর জন্যেই তা করে। আর যে অপকর্ম করে, তার প্রতিফলও সে-ই ভোগ করবে। কেউ যদি গোপনে দান-খয়রাত, মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি দূর করে শান্তি স্থাপনের পরামর্শ দেয়, তবেই তা সৎকাজ। এই জীবনে যারা সৎকর্মশীল তাদেরকে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সেরা ঘোষণা করেছেন। কুরআনে মুহসিনদের সৎকর্ম সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
‘প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে পৃথক ক্বিবলা, যেদিকে তারা উপাসনাকালে মুখ করে থাকে। কাজেই দ্রুত সৎকর্ম সমূহের দিকে এগিয়ে যাও (অর্থাৎ কা‘বামুখী হও)। যেখানেই তোমরা থাক না কেন, আল্লাহ তোমাদের সকলকে সমবেত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান’ (বাক্বারাহ ২/১৪৮)।
তিনি আরো বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় কর এবং নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। তোমরা সৎকর্ম কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’(বাক্বারাহ ২/১৯৫)।
‘অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়ায় পুরস্কার দান করলেন ও সেই সাথে রয়েছে আখেরাতের সুন্দর পুরস্কার। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৪৮)।
‘তাদের অধিকাংশ শলা-পরামর্শে কোন মঙ্গল নেই। কিন্তু যে পরামর্শে তারা মানুষকে ছাদাক্বা করার বা সৎকর্ম করার কিংবা লোকদের মধ্যে পরস্পরে সন্ধি করার উৎসাহ দেয় সেটা ব্যতীত। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সেটা করে, সত্বর আমরা তাকে মহা পুরস্কার দান করব’ (নিসা ৪/১১৪)।
‘কোন জনপদ ধ্বংস করার আগে আমি সেখানকার বিত্তবান ও প্রভাবশালী লোকদের সৎকর্ম করার নির্দেশ দেই। কিন্তু ওরা আমার আদেশের অবাধ্য হয়ে অন্যায় ও যুলুমে লিপ্ত হয়। তখন ন্যায়সঙ্গতভাবেই আযাবের ফয়ছালা হয়ে যায় এবং তারা ধ্বংস হয়’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/১৬)।
‘যারা সৎপথে চলে আল্লাহ তাদের হেদায়াত বৃদ্ধি করে দেন। আর স্থায়ী সৎকর্ম সমূহ তোমার পালনকর্তার নিকটে পুরস্কারের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ এবং প্রতিদান হিসাবেও শ্রেষ্ঠ’ (মারিয়াম ১৯/৭৬)।
‘যে ব্যক্তি সৎকর্ম করে, সে তার নিজের জন্যই সেটা করে। আর যে অসৎ কর্ম করে তার প্রতিফল তার উপরেই বর্তাবে। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক তার বান্দাদের প্রতি যুলুমকারী নন’ (হা-মীম-সাজদাহ ৪১/৪৬)।
‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তারাই হ’ল সৃষ্টির সেরা’ (বাইয়েনাহ ৯৮/৭)।
মহান আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন (বাক্বারাহ ২/১৯৫)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, إن الله مُحسن يحبُ الإحسان ‘আল্লাহ মুহসিন বা দয়ালু, তিনি ইহসান করাকে ভালবাসেন’।[2]
সৎকর্মশীলদের বৈশিষ্ট্য :
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে। তারা সৎকাজের আদেশ দেয় ও মন্দকাজে নিষেধ করে এবং কল্যাণকর্ম সমূহের প্রতি দ্রুত ধাবিত হয়। আর তারা হ’ল সৎকর্মশীলগণের অন্তর্ভুক্ত’ (আলে-ইমরান ৩/১১৪)।
এ প্রসঙ্গে রাসূল (ছাঃ) বলেন, عَنْ أَبِى شُرَيْحٍ الْخُزَاعِىِّ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُحْسِنْ إِلَى جَارِهِ وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَسْكُتْ. আবু শুরাইহ আল-খুযাঈ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের দিনের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীর প্রতি দয়াপরবশ হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের দিনের প্রতি ঈমান রাখে সে সেন তার মেহমানের সমাদর করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের দিনের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন উত্তম কথা বলে অন্যথায় নীরব থাকে’।[3]
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা তাদের পালনকর্তার ভয়ে সন্ত্রস্ত। যারা তাদের পালনকর্তার আয়াত সমূহে বিশ্বাস স্থাপন করে। যারা তাদের প্রতিপালকের সাথে কাউকে শরীক করে না। আর যারা তাদেরকে যা দেওয়া হয়েছে সেখান থেকে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে (আল্লাহর পথে) দান করে এজন্য যে, তারা তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে। এরাই দ্রুত কল্যাণ কাজে ধাবিত হয় এবং তারা তার প্রতি অগ্রগামী হয়’ (মুমিনূন ২১/৫৭-৬১)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘এগুলি প্রজ্ঞাপূর্ণ কিতাবের আয়াত। সৎকর্মশীলদের জন্য পথ নির্দেশক ও রহমত স্বরূপ। যারা ছালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আখেরাত সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে। এরাই তাদের প্রতিপালকের প্রদর্শিত পথে আছে এবং এরাই সফলকাম’ (লোকমান ৩১/২-৫)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللَّهَ كَتَبَ الإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذِّبْحَةَ وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ وَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ. ‘আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের উপর ইহসান (যথাসাধ্য সুন্দর রূপে সম্পাদন করা) অত্যাবশ্যক করেছেন। সুতরাং তোমরা যখন (কোন প্রাণীকে) হত্যা করবে, তখন উত্তম পন্থায় হত্যা করবে; আর যখন যবেহ করবে তখন উত্তম পন্থায় যবেহ করবে। তোমাদের প্রত্যেকে যেন তার ছুরি ধার করে নেয় এবং তার যবেহকৃত জন্তুকে শাস্তি প্রদান না করে (অহেতুক কষ্ট না দেয়)’।[4]
আল্লাহ আমাদেরকে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সুস্থতা ও অর্থ দিয়েছেন। যদি এগুলোকে সৎকর্মে বিনিয়োগ করি, তবে আল্লাহর পুরস্কার অবধারিত।
সৎকর্মশীলদের পুরষ্কার :
মহান আল্লাহ বলেন, ‘পক্ষান্তরে যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে, তাদেরকে তুমি জান্নাতের সুসংবাদ দাও। যার তলদেশ দিয়ে নদী সমূহ প্রবাহিত হয়। যখন তাদেরকে সেখানে খাদ্য হিসাবে কোন ফল প্রদান করা হবে, তখন বলবে, এটা তো সেইরূপ খাদ্য, যা আমাদেরকে ইতিপূর্বে দেওয়া হয়েছিল। এভাবে তাদেরকে দেওয়া হবে সামঞ্জস্যশীল খাদ্য। এছাড়া তাদের জন্য সেখানে থাকবে পবিত্রা স্ত্রীগণ এবং সেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল’ (বাক্বারাহ ২/২৫)।
তিনি আরো বলেন, ‘পক্ষান্তরে যারা বিশ্বাসী হয়েছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে, তাদের প্রাপ্য পূর্ণভাবে দেওয়া হবে। আর আল্লাহ অত্যাচারীদের ভালবাসেন না’ (আলে-ইমরান ৩/৫৭)।
‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে, আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের ওয়াদা করেছেন’ (মায়েদাহ ৫/৯)।
‘আর আমরা তাকে (ইবরাহীমকে) দান করেছিলাম (সন্তান হিসাবে) ইসহাক ও ইয়াকূবকে। তাদের প্রত্যেককে আমরা হেদায়াত দান করেছিলাম। ইতিপূর্বে নূহকেও আমরা হেদায়াত দিয়েছিলাম। (একইভাবে সরল পথ প্রদর্শন করেছি) তার (অর্থাৎ ইবরাহীমের) সন্তানদের মধ্যে দাঊদ, সুলায়মান, আইয়ূব, ইউসুফ, মূসা ও হারূনকে। আর এভাবেই আমরা সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি’ (আন‘আম ৬/৮৪)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, إِنَّ رَحْمَتَ اللَّهِ قَرِيبٌ مِنَ الْمُحْسِنِينَ-‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীলদের অতীব নিকটবর্তী’
রাসূল (ছাঃ) বলেন, أتى النبيَّ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ رجلٌ يشكو قسوةَ قلبِه قال : أَتُحبُّ أن يلينَ قلبُك وتدركَ حاجتَك؟ ارحَمِ اليتيمَ وامسحْ رأسَه وأطعِمْه من طعامِك يلِنْ قلبُك وتدركْ حاجتَك ‘একজন ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট তার অন্তরের কঠোরতার ব্যাপারে অভিযোগ করল। তিনি বললেন, তুমি কি নরম অন্তর ও তোমার প্রয়োজন মিটাতে পসন্দ কর? তাহলে ইয়াতীমের প্রতি দয়া প্রদর্শন কর; তার মাথায় হাত বুলায়; তোমার খাবার থেকে তাকে খাওয়াও। তবেই তোমার অন্তর নরম হবে এবং তোমার প্রয়োজন মিটবে’।[5]
২. মুত্তাক্বী বা পরহেযগার :
একজন প্রেমার্থীর মূল লক্ষ্য থাকে তার প্রেমাষ্পদের মন জয় করা। স্বভাবগতভাবেই মানুষ তার প্রিয় ব্যক্তির পসন্দ-অপসন্দ জেনে সে অনুযায়ী তার মন জয় করার চেষ্টা করে। প্রতিটি মুমিনেরও লক্ষ্য তাঁর স্রষ্টা মহান রাববুল ‘আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জন করা। একজন মুমিনের সার্থকতা তার প্রভুর সন্তুষ্টির মধ্যেই নিহিত থাকে। মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার সবচেয়ে বড় কাজ হল তাক্বওয়া অর্জন তথা মুত্তাক্বী হওয়া। মুত্তাক্বী শব্দটি তাক্বওয়া থেকে নির্গত যার অর্থ হ’ল বাঁচা বা বেঁচে থাকা। শাব্দিক অর্থে ভয়। তাক্বওয়াল্লাহ হ’ল আল্লাহ ভীতি বা ভয়। আল্লাহর আদেশসমূহ মান্য করা এবং তার যাবতীয় নিষেধসমূহ থেকে নিজেকে পরহেয করা। এজন্য তাক্বওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তিকে মুত্তক্বী বা পরহেযগার বলা হয়। তাক্বওয়া ব্যাখ্যায় সালাফরা বলেন, إن عمر بن الخطاب رضي الله عنه، سأل أبيّ بن كعب عن التقوى، فقال له: أما سلكت طريقًا ذا شوك؟ قال: بلى قال: فما عملت؟ قال: شمرت واجتهدت، قال: فذلك التقوى-‘ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) একবার হযরত কা‘ব (রাঃ)-কে তাক্বওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে কা‘ব (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি কখনও কণ্টকময় পথে হেঁটেছেন? ইবনে ওমর (রাঃ) বললেন হ্যাঁ, তিনি বললেন, তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি সেই পথ কিভাবে পার হন? ইবনে ওমর (রাঃ) উত্তরে বললেন, যে তিনি খুব সন্তর্পনে নিজের কাপড় গুটিয়ে সেই রাস্তা পার হন যেন কোনভাবেই কাঁটার আঘাতে কাপড় ছিঁড়ে না যায় অথবা শরীরে না বিঁধে। কা‘ব (রাঃ) উত্তরে বললেন যে, এটাই হ’ল তাক্বওয়া’।[6]
মুত্তাক্বীদের বৈশিষ্ট্য :
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-
‘এই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই। যা আল্লাহভীরুদের জন্য পথ প্রদর্শক। যারা গায়েবে বিশ্বাস করে ও ছালাত কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রূযী দান করেছি, তা থেকে ব্যয় করে। যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ঐ বিষয়ে, যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যা তোমার পূর্ববর্তীগণের প্রতি নাযিল করা হয়েছিল। আর পরকালীন জীবনের প্রতি যারা নিশ্চিত বিশ্বাস পোষণ করে। ঐসকল মানুষ তাদের প্রতিপালকের দেখানো পথের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারাই হ’ল সফলকাম’ (বাক্বারাহ ২/১-৫)।
‘অতঃপর আমরা এ ঘটনাকে সমসাময়িক ও পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত এবং আল্লাহভীরুদের জন্য উপদেশ হিসাবে সাব্যস্ত’ (বাক্বারাহ ২/৬৬)।
‘হে মানুষ! আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও নারী থেকে। অতঃপর তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হ’তে পার। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত ঐ ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু। অবশ্যই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও তোমাদের ভিতর-বাহির সবকিছু অবগত’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)।
‘(ইবাদত কালে) পূর্ব ও পশ্চিমে মুখ ফেরানোটাই কেবল সৎকর্ম নয়, বরং প্রকৃত সৎকর্মশীল ঐ ব্যক্তি, যে বিশ্বাস স্থাপন করে আল্লাহ, বিচার দিবস, ফেরেশতামন্ডলী, আল্লাহর কিতাব ও নবীগণের উপর এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সম্পদ ব্যয় করে নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, মুসাফির, প্রার্থী ও দাসমুক্তির জন্য। আর যে ব্যক্তি ছালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, অঙ্গীকার করলে তা পূর্ণ করে এবং অভাবে, রোগ-পীড়ায় ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যের সাথে দৃঢ় থাকে। তারাই হ’ল সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই হ’ল প্রকৃত আল্লাহভীরু’ (বাক্বারাহ ২/১৭৭)।
‘আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও। যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যপ্ত। যা প্রস্ত্তত করা হয়েছে আল্লাহভীরুদের জন্য। যারা সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা সর্বাবস্থায় (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় করে, যারা ক্রোধ দমন করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন। যারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করলে কিংবা নিজের উপর কোন যুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে। অতঃপর স্বীয় পাপসমূহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ব্যতীত পাপসমূহ ক্ষমা করার কে আছে? আর যারা জেনেশুনে স্বীয় কৃতকর্মের উপর হঠকারিতা প্রদর্শন করে না। ঐসব লোকদের জন্য প্রতিদান হ’ল তাদের পালনকর্তার পক্ষ হতে ক্ষমা ও জান্নাত। যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। সৎকর্মশীলদের জন্য কতইনা সুন্দর প্রতিদান! (আলে ইমরান ৩/১৩৩-১৩৬)।
তাক্বওয়া হ‘ল মানুষের মনের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা আল্লাহ ভীতি। মহান আল্লাহ ক্বিয়ামতে মুমিন, মুত্তাক্বীগণকে পুরুস্কৃত করবেন। সেখানে মহান আল্লাহ তার অন্তরের সেই তাক্বাওয়ানুযায়ী জান্নাতের স্তর নির্ধারণ করবেন। আল্লাহ মুত্তাক্বীগণকে ভালবাসেন (তাওবাহ ৯/৪)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللَّهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى أَجْسَادِكُمْ وَلاَ إِلَى صُوَرِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ. ‘আল্লাহ তোমাদের শরীর, চেহারা দেখবেন না। বরং তিনি দেখবেন তোমাদের অন্তর’।[7]
(চলবে)
[লেখক : শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী ]
[1]. মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২।
[2]. ছহীহুল জামে‘ হা/১৮২৪।
[3]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪২৪৩।
[4]. মুসলিম, তিরমিযী মিশকাত হা/৪০৭৩।
[5]. ছহীহুল জামে’ হা/৮০।
[6]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/১৬৪ পৃ. (দ্র. বাক্বারাহ ২/৩)।
[7]. মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৫৩১৪।