শিরক ও এর ভয়াবহ পরিণতি
মোসা: মানোয়ারা বিনতে মঈনুল ইসলাম
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 2890 বার পঠিত
ইমাম মাহদী (আঃ)-কে নিয়ে জল্পনা-কল্পনার কোন অন্ত নেই। ইদানীংকালে ওয়ায মাহফিলে ইমাম মাহদীকে নিয়ে চমকপ্রদ বক্তৃতা দিয়ে আলোচনায় আসছেন বক্তারা। তাঁদের আলোচনার চটকদার শিরোনাম ফেইসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভেসে বেড়াচ্ছে। কেউ বলছেন ইমাম মাহদী জন্মগ্রহন করেছেন, কেউ বলছেন তাঁর আগমনের সম্ভাব্য সাল ২০২১। কারও দৃষ্টিতে তিনি বর্তমানে ইয়ামনে আছেন, কেউ তাকে তালেবানদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন। কেউ স্বয়ং ইমাম মাহদীকে সঊদী আরবে দেখে এসে বর্ণনা করছেন যে, ইমাম মাহদীর বৈশিষ্ট্যের সাথে সেই মাহদীর ৭৫টি আলামতের মিল খুঁজে পাওয়া গেছে! কেউবা আবার স্বপ্নযোগে ইমাম মাহদীর সাথে সাক্ষাৎ করছেন। এরই মধ্যে মুস্তাক মুহাম্মাদ আরমান খান নামক এক ব্যক্তির নাম ইথারে গুঞ্জরিত হচ্ছে। তিনি আবার স্বয়ং নিজেকেই প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী দাবী করে বসেছেন।
রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে টঙ্গীর বাসিন্দা মুস্তাক মুহাম্মাদ আরমান খানের ডাক নাম মুন্না। তিনি ২০০৬ সালে বুয়েট থেকে অনার্স পাশ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য মালয়েশিয়া গমন করেন। বুয়েট তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন তাবলীগ জামা‘আতের সাথে সম্পৃক্ত হন। দাওয়াতী কাজে ২০১৬ সালে উগান্ডায় ১ মাস অবস্থান করেন। পড়াশোনা শেষে কিছু কাল ঢাকার ‘ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি’ নামক কোন এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। অতঃপর ২০১৮ সালের অক্টোবরে স্বপরিবারে মক্কায় চলে যান। তার লিখিত ও অনূদিত মোট ৯টি বই বাযারে চালু আছে। বইয়ে লিখিত তার আরও একটি পরিচয় হ’ল- টঙ্গীতে অবস্থিত ‘মাদ্রাসাতু তা‘লীমিল ইসলাম’ নামক এক মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও প্রধান শিক্ষিক তিনি। অনেক দিন থেকেই আরমান খান লেখনী ও ইউটিউবে বক্তব্যের মাধ্যমে ইমাম মাহদী, করোনা ভাইরাস ও গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে আসছিলেন। প্রথমত তিনি নিজেকে ইমাম মাহদীর সৈনিক দাবী করে জিহাদের প্রস্ত্ততির জন্য মানুষকে তার দলে যোগদানের আহবান জানান। তার এসব চটকদার কথায় বিভ্রান্ত হয়ে করোনার এই সংকট মুহূর্তেও ঢাকা থেকে মাহদীর সৈন্যদলে যুক্ত হ’তে সঊদী আরব যাওয়ার চেষ্টা করায় গত ৪ই মে ১৭ জনের এক দলকে পুলিশ আটক করে মামলা দায়ের করে।[1]
অবশেষে তথাকথিত এই ইমাম মাহদীর সৈনিক ১৪ই আগষ্ট’২০ ধারণকৃত এক ভিডিও বার্তায় স্বয়ং নিজেকেই ইমাম মাহদী ও রাসূল (ছাঃ)-এর বংশধর দাবী করে তার পক্ষে বায়‘আতের আহবান জানায়। ইউটিউব ও ফেইসবুকে ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর রীতিমত মিডিয়া পাড়ায় হৈ চৈ পড়ে যায়। গত ২২শে আগষ্ট শনিবার পুলিশ বাদী হয়ে ঢাকার রমনা থানায় স্ব-ঘোষিত ইমাম মাহদী বাংলাদেশীর বিরুদ্ধে মামলা করে।[2]
রাসূল (ছাঃ) তাঁর জীবদ্দশায় বেশ কিছু ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। যেগুলোর মধ্যে কিছু ভবিষ্যৎবাণী তিনি জীবিত থাকতেই প্রকাশ পায়, কিছু ছাহাবীদেও যুগে প্রকাশ পায় এবং এখনো কিছু অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। এগুলো কখন কীভাবে প্রকাশ পাবে তার নির্দিষ্ট কোন সন তারিখ তিনি উল্লেখ করেননি। তবে অনেক ক্ষেত্রে আলামত বা নিদর্শন বর্ণনা করেছেন। তেমনই ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে ইমাম মাহদীর আগমন বড় আলামতগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই পৃথিবী যখন অন্যায়-অশ্লীলতায় ডুবে যাবে এবং সর্বত্র যুলুম ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হবে, ঠিক তখনই ইমাম মাহদীর আগমন ঘটবে। তাঁর যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পৃথিবীময় পুনরায় ন্যায়বিচারের সুবাতাস প্রবাহিত হবে। সম্ভবতঃ এই নেতৃত্ব ও সম্মানের মোহে মুসলিম বিশ্বে যুগ যুগ ধরে মস্তিষ্ক বিকৃত কিছু লোকের আর্বিভাব ঘটে আসছে, যারা নিজেদেরকে ইমাম মাহদী দাবী করে মিথ্যা আস্ফালন করছেন। মুস্তাক মুহাম্মাদ আরমান খান সে পরিসংখ্যানে আরও একটি সংখ্যা যোগ করলেন মাত্র। সেই ছাহাবীদের যুগ থেকেই যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে নিত্য-নূতন মাহদী আবির্ভূত হচ্ছেন, যাদের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। তন্মধ্যে আলী বংশের মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুল হাসান হাসানী (৯৩-১৪৫ হিঃ)-কে অনেকেই মাহদী মনে করতেন। ১৪৫ হিজরীতে আববাসী খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় তাকে হত্যা করা হয়। ২৯৬ হিজরীতে মাহদী দাবী করেন কাইরোয়ানের উবাইদুল্লাহ বিন মাইমূন কাদ্দাহ (২৫৯-৩২২ হিঃ)। পরবর্তীতে তাঁর পৌত্র আল-মুঈয ইবনুল মানছূর এবং মরোক্কোর আলেম হিসাবে পরিচিত মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন তাওমারতও (৪৮৫-৫২৪ হিঃ) একই দাবী করেন। মরোক্কোর আরেক ছূফী আবুল আববাস আহমাদ ইবন আব্দুল্লাহ সালজামাসী (৯৬৭-১০২২ হিঃ) মাহদী দাবী করে মরোক্কোর তৎকালীন শাসককে বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত করতঃ সালজামাস শহর দখল করেন। ১০২২ হিজরীতে এক যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। ১২৯৮ হিজরীতে সুদানের সুপ্রসিদ্ধ ছূফী মুহাম্মাদ আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ (১২৫৯-১৩০২ হিঃ), ১৫ শতকে উত্তর ভারতে সাইয়েদ মুহাম্মাদ জৈনপুরী (১৪৪৩-১৫০৫ খ্রি:) এবং বাহাই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা আলী ইবন মিরযা রিদা শীরাযী ইরানে মাহদী দাবী করেন। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। ১৪০০ হিজরীর প্রথম দিন ১৯৭৯ সালে ফজরের সময় মসজিদুল হারাম দখল করে জনৈক মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ কাহতানী নিজেকে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী দাবী করেন। অনেকগুলো লাশের কফিনে অস্ত্র ভরে মসজিদে ঢুকে অবরোধ করে রাখে। সঊদী পুলিশের টানা ১৫ দিনের প্রচেষ্টায় কথিত মাহদী ও তার অনুচররা প্রায় সকলেই নিহত হয়।[3]
উপমহাদেশে কাদিয়ানী মতবাদের আবিষ্কর্তা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (১৮৩৫-১৯০৮) নিজেকে মাহদী, ঈসা মসীহ ও আখেরী নবী দাবী করে। ইংরেজদের ছাপোষা তাবেদার গোলাম আহমাদ ১৮৯১ সালে মাহদী দাবী করে। ইরানের বারো ইমামে বিশ্বাসী শী‘আদের আক্বীদা হ’ল- ইমাম মাহদী ১১তম শী‘আ ইমাম হাসান আসকারীর সন্তান। তিনি জন্মগ্রহণ করে ২৬৫ হিজরীতে ৯ বছর বয়সে লুকিয়ে পড়েন এবং ক্বিয়ামতের পূর্বে আবার বের হবেন। শী‘আদের কিতাবগুলোতে এ ধরণের অন্ধ কুসংস্কারপূর্ণ বর্ণনায় ভরপুর। শামসুদ্দীন ইবনে খাল্লেকান-এর وفيات الأعيان কিতাবের বরাত দিয়ে শী‘আদের এক কিতাবে লেখা হয়েছে; ইবনু খাল্লিকান বলেন, ‘আবুল ক্বাসেম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আল আসকারি ইবনে আলী আলহাদি ইবনে আল জাওয়াদ শী‘আদের ১২তম ইমাম। হুজ্জাত তার প্রসিদ্ধ লক্বব। শী‘আরা সর্বদা তাকে মুন্তাযের (প্রতিক্ষীত) ক্বায়েম (জীবন্ত) এবং মাহদী (হেদায়েত প্রাপ্ত) মনে করে। তিনি ২৫৫ হিজরীর শা‘বান মাসের ১৫ তারিখে জুম‘আর দিন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৫ বছর। তাঁর মায়ের নাম খাম্ত্ব, কেউ কেউ নারজেসও বলে থাকেন।[4]
ইরানীরা যুগ যুগ ধরে এ ধরণের বিচিত্র আক্বীদা পোষণ করায় তাদের দেশেও ক্ষণে ক্ষণে নতুন নতুন মাহদীর আবির্ভাব ঘটে। যেমন- ইরানী শী‘আ দিয়া আব্দুল যাহ্রা কাদীম, যিনি মাহদী দাবী করে ২০০৭ সালে মারা যান। বিশ শতকের আরেক ভন্ড রিয়ায আহমাদ গোহারশাহী একই দাবী করে। পাকিস্তানী নিউজ এজেন্সীর তথ্যমতে ২০০৩ সালে সে মারা যায়।[5]
২০০২ সালে খোদ ঢাকায় ইমাম মাহদী ও ঈসা (আঃ) আবির্ভূত হন। এই মাহদী মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্য প্রচারপত্র বিলি করে। তাতে লেখা হয়- ‘মানবজাতির জ্ঞাতার্থে অবহিত করা যাচ্ছে যে, বর্তমানে বিশ্বের ইমামতের দায়িত্বে যিনি রয়েছেন তিনি হলেন.......হযরত মুহাম্মাদ জুলকিফিল (সঃ)......তিনিই খাযা খিযির।......তিনি ‘আববা আল্লাহ’ তথা ‘হুজ্জাতুল্লাহ’। আবার যিনি বাঘে মহিষে একই ঘাটে পানি পান করাতে বাধ্য করবেন তিনি হলেন..... হযরত মুহাম্মাদ জুলকারনাইন (সঃ) তথা ইমাম মাহদী ঈসা। তিনি ঢাকার গেন্ডারিয়াস্থ কৈলাশপুরীতে অবস্থান করে এ বিশ্বে সৃষ্ট দাজ্জাল ও ইয়াজুজ মা‘জুজকে খতম করে শান্তি আনয়ন করতে ব্যস্ত।’ তার শ্লোগান ছিল ‘আববা আল্লাহ ইমাম মাহদী হুজ্জাতুল্লাহ, এক নেতা এক বিশব, ইমাম মাহদী সর্বশ্রেষ্ঠ, মাহদী খিযির ঈসা- বিশ্ব মানবের দিশা!’[6]
জনৈক পীর লুৎফর রহমান ২০১১ সালের দিকে কখনো মাহদী ও কখনো মাহদীর সৈনিক হিসাবে নিজেকে দাবী করেন। ২০১৩ সালে রাজধানীর গোপীবাগের একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে নিজ ছেলে ও কতক মুরীদ সমেত দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ হারান। তাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়।[7] ২০১৬ সালে মিসরের মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল নাছের ফেইসবুকে মাহদী দাবী করে।
এভাবে যুগের আবর্তে ভন্ডরা যেন অমাবশ্যার নিকষ কালো রজনীতে কালো পিঁপড়ার ন্যায় আবির্ভূত হয়েছে, আবার কালো মাটির অভ্যন্তরেই সমাধিস্থ হয়েছে। কাঙ্খিত মাহদী আসার পূর্বে এ রকম আগাছাদের আবির্ভাব ঘটা অস্বাভাবিক নয়। কেননা রাসূল (ছাঃ) এরূপ মিথ্যুক দাজ্জালদের আবির্ভাবের ভবিষ্যতবাণী করেছেন। সুতরাং যুগে যুগে এমন ভন্ড ইমাম মাহদীদের আবির্ভাব ঘটবে এবং তাদের লাঞ্চনাকর পতন হবে-এটাই সত্য। তাইতো ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) বলেন, ‘মাহদী হবেন ন্যায় ও ইনছাফের চূড়ান্ত; যেমন দাজ্জাল হবে অন্যায় ও অত্যাচারের চূড়ান্ত। তবে প্রধান মাহদী ও প্রধান দাজ্জাল আগমনের পূর্বে অনেক দাজ্জাল, অনেক মাহদীর আগমন ঘটবে।[8]
সম্প্রতি আবির্ভূত ইমাম মাহদী দাবীদার মুস্তাক মুহাম্মাদ আরমান খানের দাবীর পাল্টা জবাব দেওয়া নিছক কালক্ষেপন ছাড়া কিছুই নয়। ইসলামের একজন সাধারণ পাঠকও খুব সহজেই বুঝতে সক্ষম হবে যে, তিনি গোমরাহীর চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছেন। তিনি স্বীয় দাবীকে প্রমাণের জন্য কপোলকল্পিত ব্যাখ্যা দিয়ে মাহদী বিষয়ক হাদীছগুলোর ব্যবচ্ছেদ করেছেন। সেই সাথে দলীল সাব্যস্ত করার জন্য কৌশলে আরবী আবজাদী হরফ বা সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্য নিয়েছেন, যা বড়ই হাস্যকর। সেজন্য তাকে বিশিষ্ট গণিতবিদ মাহদী ডাকলে হয়ত অত্যুক্তি হবে না। বস্ত্ততঃ একজন কমজানা মুমিনও জানেন যে, ইসলামী শরী‘আতের কোন কিছু প্রমাণের জন্য কুরআন ও হাদীছের অকাট্য দলীল প্রয়োজন। সেখানে আরবী সংখ্যাতত্ত্ব ব্যবহার চরম মূর্খতা বৈকি! কথিত এই মাহদীর বক্তব্য শুনে ও বই পড়ে বোঝা যায় সে কল্পনার জগতে হারিয়ে নিজ মস্কিষ্ক বিকৃত করার পর স্বপ্নে ইমাম মাহদী হওয়ার অহী (?) পেয়েছেন। আর এতে আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই কারণ তিনি যে জামা‘আতের সাথে চলাফেরা করতেন তাদের কিতাবসমূহ এরকম স্বপ্ন, কাশফ-কারামত ও বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনীতে ভরপুর। হতে পারে সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। অথবা মাহদী বিষয়ে জমহূর আলেমদের আক্বীদা বর্জন করে নিজেকে মাহদী দাবী করবেন, তাই পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসাবে রাস্তা পরিস্কার করছিলেন।
কেননা ‘অপরিচিত ইসলাম ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক তার এক বইয়ে ইমাম মাহদী বিষয়ে তিনি লিখছেন যে, ‘ইমাম মাহদী মদীনার পূর্ব দিক থেকে আসবেন বলে হাদীছে যা বর্ণিত হয়েছে তাতে পূর্ব দিক বলতে বাংলাদেশ এবং মদীনা অর্থাৎ কোন এক শহরকে বোঝানো হয়েছে। হতে পারে মাহদী ইন্ডিয়া বা বাংলাদেশের কোন এক শহরে আছেন।[9] আরও লিখেছেন, ‘ইংরেজী ২০৮৬-৮৭ সালে সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হবে। ১৪৮৭, ১৪৯০ অথবা ১৫০১ হিজরীতে ঈসা (আঃ) দুনিয়া থেকে চলে যাবেন এবং ১৫১০ হিজরীতে কুরআন উঠিয়ে নেওয়া হবে। এরপর টিকায় লিখেছেন, ‘আল্লাহ প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তন করতে সক্ষম। ব্যাপক গবেষণা ও মহান আল্লাহর ইশারাতে (?) বলা হ‘ল’।[10] একই বইয়ের ৫৮ ও ৫৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘ইমাম মাহদী ১৪৪১ হিজরীতে (জুলাই ২০২০) আসবেন। অতঃপর টিকায় লিখেছেন, ‘এক সময় লেখক ইমাম মাহদীর আত্মপ্রকাশের দিনক্ষণ নিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন ও এস্তেখারার আমল করে যে সংকেত পেয়েছেন তাই উল্লেখ করা হয়েছে।’
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে নিজেকে ইমাম মাহদী হিসাবে উপস্থাপনের জন্য আগে থেকেই তিনি দিন তারিখ নির্ধারণ করে ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করে রেখেছিলেন। সে মতেই ১৪৪১ হিজরীর শেষাংশে (১৫ই আগষ্ট ২০২০) স্বয়ং মাহদী হয়ে আবির্ভূত হন। সুতরাং তার বাতুলতাপূর্ণ বক্তব্য ও লেখনীর আসার দাবী খন্ডন করা একেবারেই নিষ্প্রয়োজন।
সুধী পাঠক! হাদীছের ভাষ্যমতে ক্বিয়ামতের পূর্বে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী আসবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর আসার পূর্বে ক্বিয়ামতের বড় আলামত প্রকাশ পাবে। যেমন- ফোরাত নদীতে সোনার পাহাড় জেগে উঠবে, যার মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বে একশ জনে ৯৯ জন মারা যাবে। একজন খলীফার মৃত্যুর পর তাঁর তিন পুত্র ধন ভান্ডারের দখল নিয়ে আপোষে লড়াই করবে, কিন্তু কেউ সে ধনের মালিকানা পাবে না।[11]
পৃথিবী থেকে ন্যায় ইনছাফ উঠে যাবে। অত্যাচার-অনাচারের কালো মেঘ পৃথিবীর আকাশকে গ্রাস করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘দুনিয়ার মাত্র একদিন বাকী থাকলেও আল্লাহ তা‘আলা সে দিনটিকে লম্বা করবেন এবং আমার পরিবার থেকে একজনকে প্রেরণ করবেন। তাঁর নাম হবে আমার নাম এবং তাঁর পিতার নাম হবে আমার পিতার নাম অর্থাৎ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ। তিনি ফাতেমা (রাঃ)- এর বংশধর হবেন। তাঁর নাক লম্বা ও কপাল হবে উজ্জ্বল অর্থাৎ প্রশস্ত কপালের সম্মুখভাগে কোন চুল থাকবে না।[12]
তিনি মদীনার পূর্ব দিক থেকে এসে মক্কায় আশ্রয় নিবেন। রুকনে ইয়ামানী ও মাক্বামে ইবরাহীমের মাঝখানে লোকেরা তাকে চিনতে পেরে তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বায়‘আত করবে। অতঃপর এই খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁর বিরুদ্ধে সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রেরণ করা হবে। সৈন্যরা মক্কা ও মদীনার মাঝামাঝি ‘বায়দা’ নামক স্থানে আসলে আল্লাহ তাদের ভূমিতে ধ্বসিয়ে দিবেন। কিন্তু ধ্বংসপ্রাপ্ত লোকেদের খবর অন্যদের কাছে পৌঁছানোর জন্য শুধুমাত্র একজন জীবিত থাকবে। ক্বিয়ামতের মাঠে ধ্বংসপ্রাপ্তদের যার যার নিয়ত অনুসারে আল্লাহ তাদের বিচার করেবেন।[13]
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আখেরী যামানায় আমার উম্মতের মধ্যে ইমাম মাহদীর আর্বিভাব ঘটবে। তাঁর শাসনকালে আকাশ থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে। জমিন প্রচুর ফসল উৎপন্ন করবে। তিনি মানুষের মাঝে সমানভাবে প্রচুর সম্পদ বিতরণ করবেন। গৃহপালিত পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং উম্মতে মুহাম্মাদীর সম্মান বৃদ্ধি পাবে। তিনি সাত কিংবা আট বছর জীবিত থাকবেন।’[14]
অতঃপর এই সুখ-সমৃদ্ধি ধ্বংস করার জন্য দাজ্জাল আসবে। ঈসা (আঃ) দুই ফেরেশতার ডানায় ভর করে সিরিয়ার দামেশকের শ্বেত মিনার বিশিষ্ট কোন এক মসজিদের ছাদে ফজরের সময় অবতরণ করবেন। তাকে ছালাতের ইমামতির সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি ইমাম মাহদীর পিছনে ছালাত আদায় করবেন। ঈসা (আঃ) দাজ্জালকে খুঁজে বের করে হত্যা করবেন। ফলে পৃথিবী থেকে হিংসা-বিদ্বেষ, জুলুম নিপীড়ন মিটে গিয়ে শান্তির ফাল্গুধারা বইবে।[15]
এহেন মুহূর্তে ইয়াজুজ মা‘জুজ সম্প্রদায় আসবে। তাদেরও পতন হবে, ইমাম মাহদী ও ঈসা (আঃ) মারা যাবেন। পর্যায়ক্রমে শান্তির পৃথিবী থেকে নেককারদের মৃত্যু হবে। পরিশেষে আল্লাহ বদকারদের উপর ক্বিয়ামত কায়েম করবেন।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমান পৃথিবীতে অশান্তির দাবানল জ্বলজ্বল করলেও এখনো ইমাম মাহদী আসার সময় হয়নি। কেননা তাঁর আগমনের পূর্বের বড় আলামতগুলো এখনো অপ্রকাশিত। তিনি আসলে তাঁর শারিরীক বৈশিষ্ট্য দেখে সে যুগের গুণীজনেরা তাকে চিনতে পেরে জোরপূর্বক বায়‘আত নিবেন। না তিনি কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালাবেন আর না তাঁর স্বপ্নে রাসূল (ছাঃ) দেখা দিয়ে তাকে মাহদী ঘোষণা করবে। তাই তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে কেউ নিজেকে রাসূলের বংশধর মাহদী দাবী করলে সে নিশ্চিতভাবে মিথ্যাবাদী ও নিরেট ভন্ড ছাড়া কিছুই নয়।
অপরদিকে ক্বিয়ামত বা ইমাম মাহদী সংক্রান্ত বিষয়টি ইলমে গায়েবের অন্তর্ভূক্ত যা আল্লাহ স্বয়ং রাসূল (ছাঃ) কেউ স্পষ্ট করে জানাননি। এ জ্ঞানের চাবিকাঠি তিনি নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন। কুরআন ও হাদীছে যেভাবে যতটুকু বর্ণনায় এসেছে ততটুকু বর্ণনা করাই সালাফী আলেমদের নীতি। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জানা নাই তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয় চোখ, কান ও অন্তকরণ- এদের প্রতিটির ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনূ ইস্রাঈল ১৭/৩৬)।
তাই জাতির বিবেক আলেম সমাজের প্রতি প্রত্যাশা থাকবে, তারা যেন গায়েবের বিষয়গুলো নিয়ে অপ্রয়োজনীয় নাড়াচাড়া করে সাধারণ মানুষকে পথভ্রষ্ট না করেন। বর্তমানে কতিপয় আলেম যে ধারণার বশবর্তী হয়ে বক্তব্যে কিংবা গবেষণার নামে পৃথিবীর বয়স নির্ণয়, ক্বিয়ামতের সময় ও ইমাম মাহদীর আগমনের সময় নির্ধারণ করছেন, তা কতটুকু যৌক্তিক? এমন নয়া মাহদীতত্ত্বের চোরাবালিতে আমাদের দেশ, সমাজ, বিশেষতঃ যুবসমাজকে যেন হারিয়ে না ফেলি। সালাফে ছালেহীনের আক্বীদা পরিপন্থী এমন কোন গবেষণা মানসিক দুর্বলতা বা হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ, যা কালজয়ী মুসলিম আদর্শকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এরকম দিবা স্বপ্নে বিভোর না হয়ে নিজের আমলের পরিশুদ্ধতা ও জাহান্নাম থেকে মু্ক্তির জন্য সুন্নাতের পাবন্দী হয়ে সালাফে ছালেহীনের পরিচ্ছন্ন পথে চলাই হৌক আমাদের জীবনের একমাত্র ব্রত। কেননা প্রকৃত ইমাম মাহদীর আগমন ঘটলে কেবল ঈমানদাররাই তাঁকে চিনতে পারবে, যদি তিনি কোন সুদূর পাহাড়ের গুহায় থাকুন না কেন। আর বেঈমান, ভন্ড ও মুনাফিকরা তাঁকে কখনই চিনতে পারবে না, যদিও তিনি তাদের চক্ষুসম্মুখে অবস্থান করুন না কেন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য হবে নিজ নিজ ঈমানের পরিচর্যা করা এবং আমলের মাধ্যমে তা পোক্ত করা। এতেই আমাদের মুক্তি নিহিত রয়েছে।
[লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]
[1]. ৪ মে ২০২০, দৈনিক যুগান্তর।
[2]. ২৩ আগস্ট ২০২০, দৈনিক যুগান্তর।
[3]. আল-ফিকহুল আকবার: বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা, ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর পৃ: ৫১৪-১৮।
[4]. তারীখু ইবনু খাল্লেকান, মিসর ছাপা, ৩/৩১৬পৃ; খোরশেদে মাগরেব (ফার্সী), মুহাম্মাদ রেযা হাকিমী- ১৯ পৃ.।
[5]. https://en.wikipedia.org
[6]. আত-তাহরীক, ৬ষ্ঠ বর্ষ ৫ম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী ২০০৩, পৃঃ ২৯।
[7]. ২৩ ডিসেম্বর ২০১৩, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
[8]. অধ্যাপক আব্দুল মুহসিন বিন হামাদ আল-আববাদ এর এই গ্রন্থ থেকে গৃহীত- الرد علي من كذب بالأحاديث الصحيحة والواردة في المهدي ويليه عقيدة أهل السنة والآثر في المهدي المنتظر
[9]. অপরিচিত ইসলাম ও আমাদের করণীয় পৃঃ ৪৫।
[10]. অপরিচিত ইসলাম ও আমাদের করণীয় পৃঃ ৫৯।
[11]. রিয়াযুস সালেহীন (অনু: তাওহীদ পাবলিকেশন্স), হা/১৮১১; ইবনু মাজাহ ২য় খন্ড হা/ ১৩৬৭।
[12]. আবু দাঊদ হা/৪২৮৪, ৪২৮৫।
[13]. আল-ফিকহুল আকবার পৃঃ ৫১১; আবু দাঊদ হা/৪২৮৯।
[14]. মুসতাদারেক হাকেম ৪/৬০১ পৃঃ।
[15]. মুসলিম হা/২৯৩৭, ২৯৪০।