শতবর্ষ পূর্বে মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে মাওলানা আকরম খাঁ’র উপলব্ধি

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 1111 বার পঠিত

[১৯৩২ সালের ১০ই ও ১১ই সেপ্টেম্বর (ভাদ্র ১৩৩৯ বাং) শনি ও রবিবার কলিকাতা আলবার্ট হলে মরহূম মাওলানা মুহাম্মাদ আকরম খাঁ সাহেবের সভাপতিত্বে বঙ্গ-আসাম প্রথম আরবী ছাত্র সম্মেলনীর প্রথম অধিবেশন সুসম্পন্ন হয়। তখনকার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অভিভাষণটি রচিত হ’লেও তাতে যে সব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তা আজও অনুধাবনযোগ্য। বিশেষতঃ প্রচলিত আরবী শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন কেন প্রয়োজন, উক্ত শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত এবং মাদরাসায় মাতৃভাষার অনুশীলন কেন আবশ্যক, তিনি তাঁর অনুপম প্রাণবান ভাষায় এবং বৈশিষ্টমন্ডিত যুক্তিতর্কের মাধ্যমে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তা প্রকাশ করেছেন। প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষার সাথে সর্ম্পকিত ছাত্র-শিক্ষক এবং সংশ্লি­ষ্ট কর্তৃপক্ষ তাতে যথেষ্ট চিন্তার খোরাক পাবেন। এই দুষ্প্রাপ্য অভিভাষণটি প্রথমতঃ পুরাতন সাপ্তাহিক আহলে হাদীস (৫ম বর্ষ ৩২শ, ৩৩শ, ৩৪শ ও ৩৫ সংখ্যা) হ’তে মাসিক তর্জুমানুল হাদীছে (১৫/১ সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ১৯৬৮) মুদ্রিত হয়। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় তাওহীদের ডাক পাঠকদের জন্য তা পুনর্মুদ্রিত হ’ল। মৌলিকতা রক্ষার্থে তৎকালীন ভাষারীতি ঈষৎ পরিবর্তন সাপেক্ষে অক্ষুণ্ণ রাখা হ’ল- সহকারী সম্পাদক]

বন্ধুগণ ও বৎসগণ!

এত গুণী, জ্ঞানী ও যোগ্য ব্যক্তি দেশে বর্তমান থাকিতে, আরবী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদিগের এই মহা সম্মেলনে আমার ন্যায় একজন অনাধকারীকে সভাপতির সম্মান দেওয়ার জন্য নির্বাচন করার হেতু কি থাকিতে পারে, তাহার প্রকৃত উত্তর নির্বাচনকারী বন্ধুরাই দিতে পারেন। তবে আমার অনুমান, এই মজলিসের উদ্যোগ আয়োজনে আমার ছাত্র বন্ধুদের প্রভাব যথেষ্ট আছে এবং সম্ভবতঃ সেই হিসাবে একজন বৃদ্ধ ছাত্রের প্রতি কতকটা পক্ষপাত দেখাইতে তাঁহারা সম্ভবতঃ বাধ্য হইয়াছেন। নির্বাচনকারীদের উদ্দেশ্য ও মনোভাব যাহাই থাক না কেন, সকলকে সরল মনে বলিয়া দিতে চাই, সম্মান উপভোগ করার জন্য আমি এখানে আসি নাই, আসিয়াছি আপনাদের আদেশ পালন করার জন্য। আশা করি, আপনারা এই অধম খাদেমকে আপনাদের সহপাঠি, সহকর্মী ও সহযাত্রী জনৈক ছাত্ররূপেই গ্রহণ করিবেন এবং তাহার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলিকে সেই দৃষ্টিতে দর্শন করিবেন। ছাত্রদের আবরণে নিজের অযোগ্যতাকে ঢাকা দেওয়ার জন্য এই শব্দগুলির আশ্রয় লই নাই। আরবী শিক্ষাকে জীবনের চরম সাধনা ও পরম সিদ্ধিরূপে গ্রহণ করার সৌভাগ্য ঘটয়াছে যাহার, বস্ত্তুতই তাহার ছাত্রজীবনের সাধনা পরিসমাপ্ত হয় মরণের পয়গাম আসার পর। এছলামের সাধনার সঙ্গে সঙ্গে এ শিক্ষাও অভেদ্যরূপে শাশ্বত হইয়া আছে আমাদের প্রাণপ্রিয় মহানবীর স্বর্গীয় বাণীতে। তিনি বলিয়া দিয়েছেন- مَنْ جَاءَهُ الْمَوْتُ وَهُوَ يَطْلُبُ الْعِلْمَ لِيُحْيِيَ بِهِ الْإِسْلَامَ، فَبَيْنَهُ وَبَيْنَ النَّبِيِّينَ دَرَجَةٌ وَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ ‘এছলামকে জীবন্ত করিয়া রাখিব এই উদ্দেশ্য লইয়া যে ব্যক্তি শিক্ষায় প্রবৃত্ত হয় এবং সেই অবস্থাতেই তাহার মৃত্যু ঘটে,... জান্নাতে তাহার অবস্থান- নবীগণের একান্তর মাত্র নিম্নে’। আসুন! আরবী শিক্ষার্থী আমরা, সকলে সকল অন্তর দিয়া আল্লাহর হুজুরে প্রার্থনা করি তাঁর প্রিয় হাবীবের নির্দেশ আনুসারে আমাদের শিক্ষা উদ্দেশ্যমুখী হউক, এছলামকে নবজীবন দানের সাধনায় সমাহিত হউক, মৃত্যুর পূবর্ব মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত স্থায়ী হইয়া থাকুক।

আমার বক্তব্যগুলি আপনাদের খেদমতে পেশ করার পূবের্ব সরল অন্তঃকরণে বলিয়া রাখিতেছি- এ সম্মেলনে বিশেষজ্ঞের আসন হইতে কোন মন্তব্য করার অধিকার বা নির্দেশ দেওয়ার অভিমান আমার একটুও নাই। যে অনুভূতির তীব্র জ্বালায় আজ নবীন সৈনিকেরা পথের সন্ধানে ব্যাকুল হইয়াছে, গত ৩৫ বৎসর হইতে সেই একই অনুভূতির একই জ্বালায় আমার মন ও মস্তিষ্কও জর্জরিত হইয়া আছে। আজ আপনাদের খেদমতে সেই অনুভূতিরই দুই একটা অভিব্যক্তি করিব মাত্র। তাহার সঙ্গতি-অসঙ্গতি বিচার আপনারাই করিবেন।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস- আজিকার এই সম্মেলনের একটা গুরুতর বিশিষ্টতা আছে, একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে। আমি জানি, যুগের হুজুগের অন্ধ অনুকরণে একটা সাময়িক প্রমোদ মেলা বসান আপনাদের উদ্দেশ্য কখনই নহে। আল্লাহর মঙ্গল ইঙ্গিতে, এছলামের অভিনব জয়যাত্রার যে সব উপাদান উপকরণ দুনিয়ার দিকে দিকে দুবর্ব্ার গতিতে আত্মপ্রতিষ্ঠা করিয়া চলিয়াছে, আমার মতে সে সমস্তের মধ্যে সর্বপ্রধান হইতেছে মোছলেম জগতের আলেম সমাজে আত্মচিন্তা ও আত্মবিচারের খোদাদাদ তীব্র অনুভূতি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস- এই অনুভূতির প্রেরণাই আজ আপনাদিগকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছে। সেই জয়যাত্রার অগ্রপথিক হিসাবে, জ্ঞানের আলোকে আপনারা নিজেদের যাত্রাপথ নির্ণয় করিয়া লইতে চান, তাই এ অনুষ্ঠান। আশা করি, সম্মেলনের সব বিচারে, সরল আলোচনায় এই প্রেরণাই আমাদের পথ প্রদর্শক হইয়া থাকিবে।

আরবী শিক্ষার্থী! আমাদের জীবনে সাধনার যে বিশিষ্টতা, তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমাদের এই আত্মবিচারের সূত্রপাত- এই ধারণা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে এই বিচারে  প্রবৃত্ত হওয়ার পূর্বে সেই সাধনার আসল লক্ষ্যটা আমাদেরকে   ভালো করিয়া বুঝিয়া লইতে হইবে। কারণ লক্ষ্য প্রথম নির্ণীত হইয়া না গেলে কোন কাজের সফলতা ও বিফলতার পরিমাণ নির্দ্ধারণ করা সম্ভবপর হয় না। আমার মনে হয়, আমাদের গোড়ার গলৎ হইতেছে এইখানে। এই গলতের ফলে সমাজের একদল শিক্ষিত ব্যক্তি মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য প্রকাশ করিতেছেন, এক শ্রেণীর হিতৈষী আরবী ছাত্রদের চাকরী বাকরির সুব্যবস্থা করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিতেছে, সমাজের গলগ্রহ কুপোষ্য ও  ভিক্ষাজীবী বলিয়া কেহ কেহ আমাদিগকে কঠোর ভাষায় অভিসম্পাৎ করিতেছেন। আর এই সব অভিমতের প্রভাবে এবং লক্ষ্য সম্বন্ধে নিজেদের স্পষ্ট দৃষ্টির অভাবে, আরবী শিক্ষিত ও শিক্ষার্থী আমরাও সময় সময় আবিষ্ট ও অবসন্ন হইয়া পড়ি- নিজেদের জীবনকে ব্যর্থ বলিয়া মনে করিয়া থাকি। এ সমস্তের একমাত্র কারণ এই যে, আমরা আরবী শিক্ষিতের জীবনকে বিচার করিতে যাই সে শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্যকে বিস্মরণ করিয়া, সে লক্ষ্যে মূল আদর্শের প্রাণবস্ত্ত হইতে বঞ্চিত থাকিয়া। তাই এই অভিশাপ- তাই এই অপবাদ।

একটু চেষ্টা করিলে আমরা এই আদর্শের সন্ধান পাইতে পারিلَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا ইত্যাদি কোরআনের বাণী হইতে। দীর্ঘ চতুর্দ্দশ শতাব্দী পূবের্ব, দুনিয়া যখন মহাপাতকের সকল অন্ধকারে পূর্ণ ও শয়তানের সকল অভিশাপে কলুষিত- ধর্ম যখন পুরোহিতদের হাতে অত্যাচার অনাচার প্রধান উপকরণে পরিণত- বিশ্ব মানব যখন তাহার সত্যকার রববুল আলামীনকে সম্পূর্ণভাবে বিস্মৃত- ক্ষুব্ধ মানবতার আকুল আর্তনাদে আল্লাহ আরশ যখন বিকম্পিত- আমাদের আদর্শের প্রথম প্রকাশ হয় সেই সময়, হেরার অাঁধার গুহায় রহমতুল্লিল আলামীন মোহাম্মদ মোস্তফারূপে। তিনি আসিয়াছিলেন, তাওহীদের প্রধানতম শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে, আল্লাহর আসনকে গায়রুল্লাহর সব ‘তাগুতের’ সমস্ত কলুষ হইতে পরিশুদ্ধ করিতে; তিনি আসিয়াছিলেন سِرَاجًا مُنِيرًا  রূপে বিশ্ব মানবের মন ও মস্তিষ্কের সব অন্ধকারকে তিরোহিত করিয়া দিতে; তিনি আসিয়াছিলেন أُمَّةً وَسَطًا এর সত্য আদর্শকে লইয়া বিশ্বমানবের বর্ণগত, বংশগত, দেশগত, ধর্মগত সকল সংঘাত-সংঘর্ষের স্বর্গীয় সমাধানকে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠা করিতে; আর তিনি আসিয়াছিলেন, بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ রূপে আত্মনিবেদিত আত্মসমর্পিত বা মোছলেম বান্দাদিগকে লইয়া এক দুর্জয় দুর্বার ও দুর্ভেদ্য সাধক সৈনিক সঙ্ঘ গঠন করিয়া দিতে।

এইসব মহান উদ্দেশ্যকে সফল করিতে জ্ঞানের, কর্মের ও ভাবের দিক দিয়া যেসব উপকরণের দরকার, তাঁহার জীবনে সেগুলি পূর্ণপরিণত হইয়াছিল। কিন্তু সেই উপকরণগুলির দ্বারা হজরত মোহাম্মদ মোস্তফার সেই মিশনকে দুনিয়ার কেন্দ্রে কেন্দ্রে জয়যুক্ত করার সাধনা তখনও সম্পূর্ণ হইতে পারে নাই, তাই দুনিয়া হইতে এন্তেকাল করার পূর্বে তিনি উম্মতকে ডাকিয়া বলিলেন- অন্য সমস্ত আম্বিয়ার ন্যায় আমাকেও দুনিয়া হইতে শীঘ্রই চিরপ্রস্থান করিতে হইবে। কিন্তু আমার আনীত শিক্ষা অমর হইয়া থাকিবে। এজন্য তোমাদের মধ্য হইতে একদল রূহানী ওয়ারেছ আমার চাই, জীবন যৌবনের যথা সর্বস্বকে সানন্দে কোরবান করিয়া আমার এই পতাকাকে দুনিয়ার দিকে দিকে জয়যুক্ত করিবে যাহারা سيد القوم خادمهم এর অনুপম নির্দেশ অনুসারে একই সঙ্গে নেতা ও খাদেমরূপে আমার উম্মতকে সকল শক্তিতে বলীয়ান ও সকল কল্যাণে গরীয়ান করিয়া রাখিবে যাহারা’। মোস্তফা কণ্ঠের সেই আহবান কোরআনের ভাষায় ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হইয়া মোছলেম জগতের প্রান্তে প্রান্তে ঘোষণা করিতেছে।

وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ-

وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ-

يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ-

এই আহবানগুলির সারমর্ম এই যে, বিভিন্ন অবস্থার ফলে উম্মতের সকল ব্যক্তির পক্ষে এছলামের এই খেদমতকে একমাত্র জীবন-ব্রত বলিয়া গ্রহণ করা সম্ভব বা সঙ্গত হইবে না। অতএব তোমাদের মধ্যে এরূপ একদল নির্বাচিত সেবক থাকা চাই, পার্থিব জীবনের বাহ্যিক সুখ সম্পদের সব মোহকে বিসর্জ্জন দিয়া যাহারা বাহির হইয়া পড়িবে আল্লাহর নাম লইয়া। প্রথমে তাহারা এছলামের শিক্ষা ও আদর্শকে নিজেদের জ্ঞানগত করিয়া আত্মগত করিয়া লইবে। তাহার পর তাহারা বাহির হইয়া পড়িবে দুনয়ার সকল দিকে, সকল প্রান্তে সেই শিক্ষা ও আদর্শকে জয়যুক্ত করিতে। একদিকে তাহাদের কর্মক্ষেত্র হইবে মোছলমান সমাজ এছলামের আদর্শ হইতে স্খলিত হইয়া আল্লার পতাকাকে যে তাহারা ধূলায় লুন্ঠিত না করে। অন্যদিকে তাহারা ছুটিয়া যাইবে আল্লাহর এই বিশাল জমীনের প্রান্তে প্রান্তে, বিশ্বমানবকে মুক্তির সন্দেশ বিলাইতে। মহানবী রহমতুল্লিল আলামীনের মধ্যবর্ত্তিতার স্বর্গের যে প্রেম-পীযুষধারা মর্তে নামিয়া আসিয়াছে, বিশ্বমানবের সকল আত্মাকে তাহা দ্বারা স্নিগ্ধ করিতে, শান্ত করিতে, তৃপ্ত করিতে, কিন্তু কোরআন বলিয়া দিতেছে এ পথে কণ্টক আছে, কাঠোর অগ্নি পরীক্ষা আছে। মোহাম্মাদ মোস্তফার রূহানী ওয়ারেছ হওয়ার সঙ্কল্প লইয়া অগ্রসর হইবে যাহারা, তাহাদিগকে এই সব পরীক্ষা অতিক্রম করিতে হইবে অবিচলিত চিত্তে। এই কর্তব্য ও পরীক্ষার কথা বুঝাইয়া দেওয়ার পর বলা হইতেছে-إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ অর্থাৎ সুনির্ধারিত সুসঙ্কল্পিত অপরিহায্য কর্তব্য।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া কর্তব্যের এই আহবান মোছলেম জগতের গগন পবনকে মুখরিত করিয়া রাখিয়াছে। এই দীর্ঘকালের পায়ের তলে লুটাইয়া পড়িয়াছে, কত রাজপাট তাহাদের হাত ছাড়া হইয়া গিয়াছে। কিন্তু এক শ্রেণীর দীন দরিদ্র খাদেম ব্যতীত এ আহবানে সাড়া আর কেহই দেয় নাই। সে যাহা হউক, কোরআনের এই আহবানে সাড়া দিয়া এই গুরুভার কর্তব্যকে স্বেচ্ছায় সানন্দে নিজের মাথায় তুলিয়া লওয়ার যে জীবন মরণ সঙ্কল্প তাহাই হইতেছে আরবী শিক্ষার লক্ষ্য এবং হজরত মোহাম্মম মোস্তফার আরদ্ধ সাধনাকে তাঁহার রূহানী সন্তান হিসাবে জয়যুক্ত করিয়া যাওয়ার আনন্দ হইতেছে এ লক্ষ্য-সাধনার মূল্য প্রেরণা। সুতরাং আরবী শিক্ষার জন্য নির্বাচিত হইয়াছি বলিয়া আমাদের দুঃখিত কি আনন্দিত হওয়া উচিত, এই আদর্শের আলোকে তাহার বিচার করিতে হইবে। আমাকে জিজ্ঞাসা করিলে কবির ভাষায় উত্তর দিব-

قسمت كيا  ہر  چيز كو قسام ازل  نے + جو شخص كو جس  چيز كا قابل نظر ايا

بلبل كو  ديا  رونا  تو  پروانہ كو جلنا + غم ہم كو ديا سب سے  جو مشكل نظر  ايا

আরবী শিক্ষার লক্ষ্য, আদর্শ ও তাহার মূলীভূত প্রেরণা সম্বন্ধে যাহা আরজ করিয়াছি, তাহা সত্য কিনা আপনারা তাহার বিচার করিয়া দেখুন। যদি সত্য না হয়, যদি পার্সিয়ান টিচার ও ম্যারেজ রেজিষ্ট্রার হওয়াই আরবী শিক্ষার লক্ষ্য ও আদর্শ বলিয়া গণ্য হয় তাহা হইলে আমার বক্তব্য এইখানেই শেষ হইয়া যাইতেছে। আমার মতে সেই আরবী শিক্ষা সম্বন্ধে কোন প্রকার মাথা ব্যাথার দরকার আমাদের কাহারও নাই। পক্ষান্তরে ইহাই যদি আরবী শিক্ষার সত্য, সঙ্গত ও শাশ্বত আদর্শ হয়, তাহা হইলে আজ আমাদিগকে আত্মবিচারে প্রবৃত্ত হইতে হইবে এই আদর্শের মাপকাঠি হাতে লইয়া।

সুক্ষ্ম দৃষ্টি, ন্যায়বদ্ধ ও সৎসাহস লইয়া এই বিচারে প্রবৃত্ত হইলে দেখা যাইবে যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া যে আদর্শ সাধনায় আমরা আত্মদান করিয়া আসিয়াছি, তাহা যে পরিমাণে সার্থক হইয়াছে, ব্যর্থ হইয়াছে তাহা অপেক্ষা অনেক বেশী পরিমাণে।

প্রথমে ঘরের অবস্থার হিসাব লইলে দেখা যাইবে হেফাজতে এছলামের দিক দিয়া আমাদের উদাসীনতা কতদূর মারাত্মক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বাঙ্গালা ও আসামের তিন কোটি মোছলমান আজ নানা দুঃখে দুর্দশায় প্রপীড়িত, নানা পাপে নানা অনাচারে জর্জরিত, এছলামের শিক্ষা ও সাধনা হইতে বহু দূরে অবস্থিত। তাহার মধ্যকার কোনটির উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিকার আমরা আজ পর্যন্ত করিয়া উঠিতে পারি নাই। ইংরাজী শিক্ষিত মোছলমানদিগের এক স্তরে আজ সন্দেহ ও অনাস্থার যে মারাত্মক রোগ সংক্রামক হইয়া চলিয়াছে, তাহার সুচিকিৎসার কোন প্রয়াসই আমরা পাই নাই। নানা প্রতিকূল অবস্থার ঘাত প্রতিঘাতের স্বাভাবিক ফলে যে সব সমস্যা মোছলেম বঙ্গের অগ্রগতিকে প্রতি পদবিক্ষেপে বাধা প্রদান করিতেছে, তাহার কোনটির সমাধান আমরা করি নাই। যুগের অলক্ষ্য প্রভাবে জাতির মন ও মস্তিষ্ক আজ যে সব অভিনব জিজ্ঞাসা দ্বারা আলোড়িত হইতেছে, তাহার সন্তোষজনক উত্তর দেওয়া আমরা আবশ্যক মনে করি নাই। অন্যদিকে, গত দুই শতাব্দী ধরিয়া এছলাম ধর্মের এবং মোছলেম শিক্ষা ও সভ্যতার উপর বিধর্মীদের যে অগণিত জঘন্য আক্রমণ চলিয়া আসিতেছে, তাহার বিহিত উত্তর দেওয়ার বিশেষ কোন চেষ্টা আজ পর্যন্ত আমাদের দ্বারা সাধিত হয় নাই।

এইতো গেল হেফাযতে এছলামের কর্তব্য সম্বন্ধে আমাদের উদাসীনতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই সঙ্গে সঙ্গে এশাআতে এছলামের কর্ত্তব্য সম্বন্ধে যদি আমরা নিজেদের কাজের জমা খরচ করিয়া দেখি, তাহা হইলে একটা বড় আকারের এবং অতি শোচনীয় শূন্য ব্যতীত জমার ঘরে আর কিছুই দেখিতে পাওয়া যাইবে না। তওহীদের পূণ্য পীযুষধারা পান করার জন্য আল্লাহর দুনিয়া তৃষিত হইয়া আছে, কিন্তু তাহার সে তৃষ্ণা নিবারণের শক্তি বা প্রবৃত্তি কিছুই আমাদের নাই। অধিক কথা কি বলিব, পঞ্চাশ বৎসর মাত্র পূর্বে, দুর্ভিক্ষের সুযোগ অথবা মুর্খতার ফলে, বাঙ্গালার যে হাজার হাজার মোছলমান খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হইয়া গিয়াছে, মরহুম আঞ্জুমানে ওলামার দুই দিনের সামান্য চেষ্টা ব্যতীত তাহাদিগকে এছলামের পতাকাতলে ফিরাইয়া আনার কোন ব্যবস্থা আমরা করিতে পারি নাই। এ পথে যে সামান্য অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়াছিলাম, তাহা অত্যন্ত মারাত্মক। এক কথায় তাহাদের মোছলমান করার প্রধান অন্তরায় মোছলমান সমাজ নিজেরাই। এক দল মনে করে খৃষ্টান হইয়া একবার যাহাদের জাতি গিয়াছে, মোছলমান তাহারা ইচ্ছা করিলে হইতে পারে কিন্তু জাতে ওঠা তাহাদের পক্ষে আর সম্ভবপর নহে। পক্ষান্তরে সাম্প্রদায়িক কোন্দল কোলাহলের অগ্রনায়করা মনে করেন, মানুষ মোছলমান হইয়া যদি আমাদের গন্ডির মধ্যে প্রবেশ না করে তাহা হইলে তাহার কাফের থাকাই তাহা অপেক্ষা শ্রেয়। ইহা খেয়াল নহে, কল্পনা নহে- আঞ্জুমানে ওলামার সেবাকালে ইহা ছিল আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা।

বন্ধুরা! অনেক সময় জিজ্ঞাসা করেন, বৎসর বৎসর এত মৌলবী পাশ করানোর দরকার বা সার্থকতা কি আছে? শিথিলতা ও উদারতার বর্তমান অবস্থায় এ প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়া বাস্তবিকই দুঃসাধ্য। কিন্তু আজিকার আত্মবিচারের ফলে আলেম সমাজের মধ্যে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের অনুভূতি যদি সামান্য পরিমাণেও জাগ্রত হইয়া উঠে তাহা হইলেও সমাজকে অচিরে বলিতে হইবে শত নয়, সহস্র নয়, এছলামের খেদমতের জন্য বাঙ্গলার আজ দরকার লক্ষ ধর্ম সেবক মৌলবীর। এই যে বাঙ্গলা ও আসামের পর্বত প্রান্তরকে ব্যাপ্ত করিয়া পড়িয়া আছে তোমার বিরাট কর্মক্ষেত্র সেদিকে তাকাইয়া দেখার সুযোগ কখনও পাইয়াছ কি? যদি পাইতে, তাহা হইলে আমার সঙ্গে কন্ঠ মিলাইয়া বলিতে, আজই লক্ষ মৌলবীর দরকার আমাদের এছলামের অভিনব বিষয় অভিযানে। অন্যদিকে আমাদের গুরু-গম্ভীর রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরগুলি যদি সম্পূর্ণরূপে অনর্থক না হইত তাহা হইলেও এই দরকারের গুরুত্ব আমরা কতকটা বুঝিতে পারিতাম।

ان كس ست اہل بشارت كہ اشارت  داند +  نكتہا ہست بسے  محروم اسرار كجاست؟

কর্তব্য সাধনা সম্বন্ধে আমাদের উদাসীনতা এবং তাহার ফলাফলের যে সংক্ষিপ্ত আভাস উপরে দিয়াছি, আপনাদের মতেও মোটের উপর তাহা যদি সঙ্গত বলিয়া বিবেচিত হয়, তাহা হইলে, এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য হইবে এই ব্যর্থতার প্রকৃত কারণগুলির সন্ধান লওয়ার এবং সেগুলির প্রতিকারের উপায় আবিষ্কার করার। এখানে আমাদের দৃষ্টি যতই স্পষ্ট হইবে, প্রতিকারের উপায়গুলির ততই সহজবোধ্য ও সহজসাধ্য হইয়া দাঁড়াইবে। আশাকরি, আপনারা এ সম্বন্ধে ধীর স্থিরভাবে চিন্তা করিয়া দেখিবেন। এই ব্যর্থতার যে কারণগুলি আমার মনকে সততই আঘাত দিয়া থাকে তাহার মধ্যকার প্রধান কারণটি আপনাদের খেদমতে পেশ করিতেছি। আপনারা তাহার সঙ্গতি-অসঙ্গতি সম্বন্ধে বিচার করিয়া দেখিলে সুখী হইব।

প্রথম কারণ :

আমাদের ব্যর্থতার প্রথম ও প্রধান কারণ এই যে, নিজেদের সাধনার গুরুত্ব, নিজেদের লক্ষ্যের মহিমা এবং নিজেদের আদর্শের বিরাট স্বরূপটা আমরা হয় বুঝিতে পারি না, না হয় তাহাকে অতি হীন, অতি সঙ্কীর্ণ আকারে বিকৃত করিয়া দেখিতে শিখি। ফলতঃ মনজিল ভোলা মোছাফেরের মত একটা উদভ্রান্ত গতিমাত্রই আমাদের যাত্রার সার হইয়া দাঁড়ায় অনেক সময় মনে করি, আরবী পড়াটাই আমাদের লক্ষ্য, সুতরাং আরবী পড়ার পর, কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মত সংসারের চারিদিকে অাঁকু বাঁকু করিয়া বেড়াই। কিন্তু আজ এই আত্মবিচারের শুভ সূত্রপাতের দিনে প্রত্যেক আরবী শিক্ষার্থী ছাত্রকে মনে প্রাণে বুঝিয়া লইতে হইবে যে, আরবী পড়া মনজিলে পৌঁছিবার পথ, মনজিল উহাই নহে। লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উপলক্ষ্য মাত্র, উহার লক্ষ্য নহে। সে লক্ষ্য কি, প্রথমেই তাহার আভাষ দিয়াছি। আমার স্পষ্ট অভিমত এই যে, এই লক্ষ্যের প্রেরণা হইতে বঞ্চিত যাহারা, আরবী মাদ্রাসা গুলিতে ভিড় করার কোন দরকার তাঁহাদের নাই। কলিকাতা করপোরেশনের প্রাইমারী মক্তবের শিক্ষক, হাইস্কুলের পার্সিয়ান টিচার বা ম্যারেজ রেজিষ্ট্রারের আবেদন পত্র হাতে লইয়া অনভিপ্রেত লোকদিগের দ্বারে দ্বারে ঘুড়িয়া বেড়াইয়া নিজেদের জীবনকে সার্থক করিয়া লইতে চান যাহারা, তাহাদের পক্ষে প্রথম হইতে অন্য পথের সন্ধান করাই কর্তব্য।

দ্বিতীয় কারণ :

সকলেই জানেন, বাঙ্গলার প্রচলিত মাদ্রাসা প্রথার প্রথম সুত্রপাত হইয়াছিল মোছলেম বঙ্গের ধ্বংস স্ত্তপের উপর। সত্য কথা এই যে, এইগুলির দ্বারা মোছলমানদিগকে ধর্ম শিক্ষা দেওয়ার সামান্য একটু ইচ্ছাও তখন কর্তৃপক্ষের ছিল না এবং সেরূপ দাবীও তাহারা কোন দিন করেন নাই। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অফিস আদালতের কাজ চালাইবার জন্য কতকগুলি আমলা ও কেরানীর দরকার তাহাদের হইয়াছিল এবং সেই জন্য ওয়ারেন হেন্টিং কলিকাতা মাদ্রাসা নামে একটা বিরাট Clerk Founder সৃষ্টি করিয়াছিলেন। এইজন্য এইসব মাদ্রাসার বিশেষ ব্যবস্থা করা হইয়াছিল তাহাদের দরকারী অংশের Mohammadan Law শিক্ষা দেওয়ার জন্য। এছলাম শিখাইবার বিশেষ কোন ব্যবস্থা সেখানে করা হয় নাই। তাই আরবী শিক্ষার মূল প্রাণবস্ত্ত যাহা, মাদ্রাসাগুলি দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত তাহা হইতে সম্পূর্ণ রূপে বঞ্চিত হইয়াছিল এবং এখনও বহু পরিমাণে আছে।

যাহা হউক, সরকারের পুনঃ পুনঃ ঘোষণা সত্বেও অল্পকালের মধ্যে ইংরাজী আসিয়া পার্সিকে নির্বাসিত করিয়া দিল, মাদ্রাসা পাশ করিয়া অফিস আদালতের চাকরী পাওয়া অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইল এবং তাহার নেছাবগুলি পূর্ববৎই রহিয়া গেল। নেছাবের কথা পরে বলিতেছি। এখানে বক্তব্য শুধু এই যে, এই সরকার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলিই মাদ্রাসার ও মাদ্রাসা শিক্ষার আদর্শকে অতি মারাত্মকভাবে বিগড়াইয়া দিয়াছে।

তৃতীয় কারণ : 

আমাদের ব্যর্থতার ৩য় এবং একটা প্রধানতম কারণ হইতেছে মাদ্রাসার নেছাব বা পাঠতালিকা পূর্বেই বলিয়াছি, যে উদ্দেশ্য মাদ্রাসাগুলি প্রথমে স্থাপিত হইয়াছিল, অফিস আদালতের ভাষা ইংরাজী হইয়া যাওয়ার পর সেদিক দিয়া তাহার আর কোন সার্থকতা রহিল না। কিন্তু তত্রাচ তাহার নেছাব ইত্যাদি সমস্তই পূবের্বর ন্যায় বহাল রহিল এবং আজ পর্য্যন্ত তাহা বহাল হইয়া আছে। আরবী শিক্ষার্থীদের বুকের পাঁজরগুলি এই অনর্থক, আদার্শনিক ও অত্যাচারমূলক নিছাবের হাতুড়ী পিটিয়া চূর্ণ বিচূর্ণ করা হইতেছে যুগের পর যুগ ধরিয়া। এছলামের জ্ঞান যেখানে, তাহার আদর্শের আবেহায়াত যেখানে, মাদ্রাসার চৌহদ্দিতে তাহার প্রবেশ নিষেধ।

আরবী শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলি সফল করিতে হইলে বিংশ শতাব্দীর আলেমদিগকে জ্ঞানচর্চার যে সব দিকের সহিত সুপরিচিত হওয়ার দরকার, মাদ্রাসার ছাত্রদিগকে তাহা হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখা হইয়াছে। এমনকি জগতের অষ্টম আশ্চর্য্য হিসাবে বলা যাইতে পারে যে, বাঙ্গালার মাদ্রাসাগুলি এক শতাব্দী ধরিয়া এছলামের শিক্ষা না দিয়া আসিতেছে কোরআনকেই বর্জন করিয়া! জাতীয় ইতিহাস এমনকি হজরতের জীবনী পর্য্যন্ত মাদ্রাসার ত্রিসীমায় প্রবেশ করিতে পারে না। অন্যদিকে গ্রীকের গুদাম পচা মন্তেক ও ফলছফা, তামাদীযুগের অকর্মণ্য হেকমত, বর্তমান যুগের সম্পূর্ণ অনুপযোগী কালাম এবং অনাবশ্যক ব্যাকরণ প্রভৃতির দূর্বহ বোঝা আরবী শিক্ষার্থীদিগের মাথার উপর চাপাইয়া দিয়া তাহাদের সহনশীলতার পরীক্ষা করা হইতেছে। এই বোঝাগুলি বহন করিবার সময় জ্ঞানের আনন্দ বা সাহিত্যের রসতো কিছুই পাওয়াই যায় না, পক্ষান্তরে ভাবীজীবন সাধনার কোন স্তরেই ইহার কোনটিই কোন উপকারে আসিতে পারে, এরূপ আশাও কেহ করিতে পারেন না। ছাত্ররা এগুলি আয়ত্ত করিবে শুধু পরীক্ষা পাশ করার জন্য। কাজেই এই বোঝাটা বহন করিয়া চলা ছাত্রদের পক্ষে আর সম্ভবপর হইতেছে না। তাহারা বলিতেছে, ধর্মের নামকরণে আত্মহত্যা করিতে আর আমরা প্রস্ত্তত নহি। আরবী বিভাগের সবর্বসহ ছাত্রদের মধ্যে আজ যে এই বিদ্রোহের সৃষ্টি হইয়াছে তাহা অতি অত্যাচারের শুভ প্রতিক্রিয়া মাত্র। আমিও আজ তাহাদের সঙ্গে কণ্ঠে মিশাইয়া ঘোষণা করিতেছি হয় এই অন্যায়, অনর্থক ও অত্যাচারমূলক নেছাব ধ্বংস হইবে, না হয় ঐ নেছাবের বাহনস্বরূপ মাদ্রাসাগুলি ধ্বংস হইবে। দুইটার অস্তিত্ব একসঙ্গে অধিক দিন থাকিতে পারিবে না। ইহাই হইতেছে বাঙ্গালার সহস্র সহস্র আরবী শিক্ষিত ও শিক্ষার্থীর সুদৃঢ় সঙ্কল্পের সরল ও সংক্ষিপ্ত প্রকাশ। আমরা মাদ্রাসাগুলির সংস্কার চাই এবং সংস্কার অর্থে আমরা বুঝি সকল দিকের সব অনর্থের আমুল পরিবর্ত্তন। তাহার পাঠ্য তালিকা একেবারে নতুন করিয়া নির্বাচন করিতে হইবে, তাহার অধ্যাপনা প্রণালীর পরিবর্তন করিতে হইবে, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাণবস্ত্ত স্বরূপ যে হেফাজৎ ও এশাআতে এছলাম, আরবীর ছাত্রকে তাহার উপযোগী করিয়া গঠন করিতে হইবে এই আমাদের আবেদন, এই আমাদের দাবী, এই আমাদের আলটিমেটম।

চতুর্থ কারণ : 

আরবী শিক্ষিতদের জীবন সাধনা বিফল হইয়া যাওয়ার একটা বড় কারণ এই যে, আরবী শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত যন্ত্রপাতির প্রতিষ্ঠা ও কল কব্জার পরিচালনা ভার যাঁহাদের উপর সম্পূর্ণভাবে ন্যস্ত হইয়া আছে, আরবী শিক্ষার প্রতি স্বাভাবিক সহানুভূতি তাঁহাদের অনেকেরই নাই। এমনকি আরবী শিক্ষার চরম আদর্শের ঘোর পরিপন্থী যাঁহারা, মাদ্রাসাগুলির প্রধান কর্ণধারের পদে অনেক সময় তাঁহারা নিযুক্ত হইয়া থাকেন। বাঙ্গালায় ‘ওল্ডস্কিম’ মাদ্রাসাগুলির যে পরীক্ষা বোর্ড ও পরিচালনা বোর্ড আছে, তাহাতে অনেক মোছলমান সদস্য এরূপ আছেন, আরবী ভাষার সহিত যাঁহাদের কোন সম্বন্ধই নাই, হয়ত কেহ কেহ আরবী বর্ণমালার সঙ্গেও পরিচিত নহেন। আরবী শিক্ষা ও তাহার আদর্শের প্রতি উপেক্ষা বা ঘৃণার ভাব পোষণ করেন, এমন ভদ্রলোকদিগকে মাদ্রাসার হর্ত্তাকর্ত্তা বিধাতা’র আসনে বসাইয়া দিতেও কর্ত্তৃপক্ষ কুন্ঠিত হন না। বাঙ্গালার মাদ্রাসাগুলির পক্ষে বস্ত্ততই ইহা একটি শোচনীয় অভিশাপে পরিণত হইয়াছে। বলা বাহুল্য যে, এইরূপ অঘটন সংঘটনের ফলে মাদ্রাসার সংস্কার একরূপ অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অন্যদিকে সংস্কারের নামে যাহা করা হয় তাহা-যারা কার্য্যতঃ হিতে বিপরীত উৎপত্তি ঘটিয়া দাঁড়ায়। আমি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা হইতে বলিতে পারি, আরবী শিক্ষা সংস্কারের যতগুলি চেষ্টা হইয়াছে তাহার প্রায় প্রত্যেকটিতে আরবী শিক্ষিতদের অদৃষ্টের চূড়ান্ত ফায়ছালা করিয়াছেন তাঁহারই যাঁহারা নিজেরা আরবী সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ এবং হয়ত সহানুভূতিশূন্য।

দীর্ঘকালের পুরাতন কাহিনীগুলি পরিত্যাগ করিয়া বর্তমানের একটা টাটকা নজির দিতেছি। মোছলমানদিগের শিক্ষা সংক্রান্ত অভাব অভিযোগগুলির তদন্ত করার জন্য খান বাহাদুর মৌঃ মোহাম্মদ আবদুল মোমেন ছাহেবের সভাপতিত্বে সম্প্রতি যে তদন্ত কমিটি বসিয়াছিল তাহার কথা আপনারা সকলেই অবগত আছেন। এই কমিটির মেম্বরগণের মধ্যে অনেকেই আমার শ্রদ্ধাভাজন বন্ধু। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাদ্রাসার সংস্কার সংক্রান্ত বক্তব্যগুলি বুঝিতে ও তাহার বিচার করিতে সমর্থ এরূপ একজন সদস্যও তাঁহাদের মধ্যে দেখিতে পাই নাই। সে জন্য সাক্ষ্য দেওয়ার সময় এই অপ্রীতিকর সত্যটির প্রতি আমি কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিলাম। কমিটির উপস্থিত মেম্বরগণ, বিশেষতঃ তাহার সভাপতি মৌঃ আবদুল মোমেন সাহেব এই আবেদনের সম্মতি স্বীকার করেন এবং আমার প্রস্তাব মতে আরবী শিক্ষার বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে তদন্ত করার ও সংস্কার সম্বন্ধ Suggestion দেওয়ার জন্য তাঁহাদের অধীনে একটি সব কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করেন। সব-কমিটি গঠিত হইয়া গেল। কমিটির নোটীশ অনুসারে তাহারা মেম্বরগণ একত্র হইয়া নিজেদের প্রোগ্রামও স্থির করিয়া লইলেন। শিক্ষামন্ত্রী কমিটীর এই প্রস্তাবে মঞ্জুরী দিলেই আরবী সব-কমিটীর মেম্বারগণ জানাইয়া দিয়াছেন, তাঁহারা শুধু মঞ্জুরী চান। গবর্ণমেন্ট যদি মেম্বরদের বারবার দাবীর ব্যয় নাও দেন, তাহা হইলে এ সমস্ত ব্যয় তাঁহারা নিজেরাই বহন করিবেন। কিন্তু এই পর্য্যন্তই শেষ, সব-কমিটি সম্বন্ধে আর কোন উচ্চবাচ্য কেহই করিলেন না। এখন পূর্বোক্ত কমিটির মেম্বারগণ নিজেরাই আরবী শিক্ষার্থীদের কেছমতের ফয়ছালা করিয়া দিতেছেন। এই প্রসঙ্গে সব চাইতে নির্মম সত্য এই যে, আমাদের যে সব বন্ধু আরবী শিক্ষা-প্রণালীর ও আরবী শিক্ষিত সমাজের ব্যর্থতাকে সতত শত কণ্ঠে অভিশাপ দিতে অভ্যস্ত, সংস্কারের প্রত্যেক প্রচেষ্টায় সর্বাপেক্ষা অধিক উপেক্ষা প্রদর্শন বা বাধা প্রদান করিয়া থাকেন তাঁহারাই। ফলতঃ আরবী শিক্ষা সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ এবং তাহার লক্ষ্য সম্বন্ধে সহানভূতিশূন্য ভদ্রলোকেরা মাদ্রাসাগুলির কর্ণধার হইয়া থাকাও আমাদের অধঃপাতের একটা প্রধান কারণ।

পঞ্চম কারণ :

আরবী শিক্ষিতদের জীবন সাধনার চরম ব্যর্থতার একটা প্রধানতম কারণ হইতেছে মাতৃভাষা সম্বন্ধে তাহাদের অজ্ঞতা। পূর্বে দেশে দেশে যুগে যুগে স্বতন্ত্র নবী ও রছুলের আবির্ভাব হইত এবং নিজ নিজ মাতৃভাষায় তাঁহারা স্বদেশ বাসীর মধ্যে আল্লাহর বাণী প্রচার করিতেন। আল্লাহ বলিতেছেন- وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ ‘আমি প্রত্যেক রসূলকেই তাহার জাতির ভাষার মধ্য দিয়াই প্রেরণা দিয়াছি, যেন তাহারা স্বজাতিকে স্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া দিতে পারে। আমাদের হজরত দুনিয়ার শেষ নবী এবং সকল যুগের ও সকল দেশের জন্য একমাত্র নবী। কাজেই প্রত্যেক যুগের ও প্রত্যেক দেশের আলেমদিগের উপর এখন এই  لِيُبَيِّنَ لَهُمْ এর ভার অর্পিত হইয়াছে। কোরআন স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিতেছে, মাতৃভাষার আশ্রয় ব্যতীতتبيين   অসম্ভব। সুতরাং বাঙ্গালার তিন কোটি মোছলমানের জন্য  ورثة الانبياء  রূপে কাজ করিবেন যে ওলামা, এছলামকে প্রকাশ করার জন্য বাঙ্গালা সাহিত্যে যথেষ্ট অধিকার অর্জন করা তাঁহাদের পক্ষে পরোক্ষভাবে ওয়াজেব। এই বাঙ্গালাভাষা শিক্ষা না দিয়া মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ সহস্র সহস্র আরবী শিক্ষিতকে একেবারে বোবা বানাইয়া রাখিয়াছেন। ফলে একদিকে যেমন আরবী শিক্ষিতদের জীবন একমাত্র এই ত্রুটির জন্য বহু পরিমাণে ব্যর্থ হইয়া যাইতেছে, অন্যদিকে অনধিকারী ব্যক্তিরা আসিয়া কর্মক্ষেত্রগুলি দখল করিয়া বসিতেছেন। এমনকি কোরআনকে পর্য্যন্ত লইয়া খেলা করিতেও আজ সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ লোকদিগের মনে কোন প্রকার দ্বিধা বা ভীতির উদ্রেক হইতেছে না।

এই অনাচারের প্রতিকার করার জন্য আরবী শিক্ষিত ও শিক্ষার্থী সমাজ দীর্ঘকাল হইতে সমবেত কণ্ঠে আর্তনাদ করিয়া আসিতেছেন। কিন্তু কর্ত্তৃপক্ষ সে আর্ত্তনাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করার কোন আবশ্যকতা আজ পর্য্যন্ত অনুভব করেন নাই। তাঁহাদের উপেক্ষা ও উদাসীনতা আমাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করিয়া চলিয়াছে, এই সম্মেলনের সভাপতির আসন হইতে এই কথাটা আজ আমি কর্তৃপক্ষকে সসম্ভ্রমে জানাইয়া দিতেছি।

ষষ্ঠ কারণ :

মাদ্রাসা শিক্ষার বর্তমান ব্যর্থতার আর একটা বড় কারণ হইতেছে, সেখানে  مشق ومطالعة সম্বন্ধে ব্যবস্থার অভাব। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদিগকে বর্তমান যুগের অভাব অভিযোগ অনুসারে গড়িয়া তুলিতে হইলে, তাহাদিগকে গভীর গবেষণা ও স্বাধীন আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ দিতে হইবে। এজন্য প্রত্যেক মাদ্রাসায় مذاكره علمية  প্রভৃতির যথেষ্ট সুব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। কেবল যুদ্ধ সংক্রান্ত বহি পুস্তক পড়াইয়া দিলে কেহ সুদক্ষ সৈনিক হইতে পারে না, সেজন্য দরকার হয় প্রতিনিয়ত কুচকাওয়াজ শিক্ষা দেওয়ার। পাটী গণিতের কেতাব কণ্ঠস্থ করাইয়া কাহাকেও অঙ্কশাস্ত্র বিশারদ করা যায় না, সে জন্য আবশ্যক হয় অবিরাম Exercise করিয়া যাওয়ার। ঠিক সেই রূপ research ও debating এর যথেষ্ট মশক না করিলে কেবল কয়েক খানা কেতাব কণ্ঠস্থ করিয়া কেহ এছলামের সেবা ও প্রচার করিতে সমর্থ হয় না। এজন্য প্রত্যেক মাদ্রাসার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের বক্তৃতা ও প্রবন্ধ রচনার প্রতিযোগিতা, মৌলিক গবেষণা এবং স্বাধীনভাবে বিচার আলোচনার সুব্যবস্থা থাকা চাই। স্বতন্ত্র পুরস্কার ও ছাত্রবৃত্তির ব্যবস্থা হওয়া আবশ্যক। এমনকি, আমার মতে শেষ স্তরে এ সম্বন্ধে একটা পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করিতে পারিলে আরও ভাল হয়। বড়ই দুঃখের বিষয়, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আজ পর্য্যন্ত কোন উৎসাহ প্রদান করেন নাই। বরং অনেকে ইহার যথাসাধ্য বাধাই দিয়া আসিয়াছেন।

এই আলোচনার এখানেই উপসংহার করিতেছি। মাদ্রাসাগুলির বর্তমান পরিস্থিতি এবং তাহার ভাবী প্রতিকার সম্বন্ধে আমার চিন্তা ও অনুভূতির একটা স্পষ্ট আভাস ইহা দ্বারা পাওয়া যাইবে বলিয়া আশা করি। ইহা ব্যতীত বলার কথা আরো অনেক আছে। আমার মতে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রণালীর প্রত্যেক দিকটিই নানা দোষে দুষ্ট এবং আশু সংস্কার সাপেক্ষ।

বন্ধুগণ ও বৎসগণ!

আত্মবিচারের সব দিক সম্বন্ধে এতক্ষণ আলোচনা করিয়াছি তাহার অধিকাংশ স্থলে বাহ্যতঃ দোষের বোঝা চাপান হইয়াছে অন্যের উপর। কিন্তু একটু চিন্তা করিয়া দেখিলে জানা যাইবে, এইসব দোষ ক্রটির জন্য প্রধান অপরাধী আমরা নিজেরাই। যে স্পষ্ট দৃষ্টি এবং তীব্র অনুভূতি লইয়া আমাদিগকে এক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল, নিজেদের শক্তি সামর্থের যতটা সদ্ব্যবহার করা এখানে আমাদের কর্তব্য ছিল, নিজেদিগকে আমরা তাহা হইতে ইচ্ছা পূর্বক বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছি। তাই আমাদের অস্ফূট আর্তনাদ আজ পর্য্যন্ত কাহারও করুণ দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে নাই। এজন্য প্রথম দরকার عَزَمْتَ বা অটুট দৃঢ় সঙ্কল্প। সঙ্কল্পের পর فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ আল্লার উপর ভরসা করিয়া কর্মসাধনা।

এ সাধনা ব্যর্থ হওয়ার নহে إِنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ আরবী বিভাগের যুবক ছাত্রদের কাছে আমার আর একটি আবেদন। তারুণ্য আধুনিকতা বা যুগধর্ম ইত্যাদি বলিয়া দেশে যে সব সাময়িক হুজুগের সৃষ্টি হইতেছে, তাহা যেন আপনাদিগকে এছলামের صِرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ হইতে এক বিন্দু বিচলিত করিতে পারেনা। আপনারা আমাকে ভুল বুঝিবেন না। আমি আপনাদিগকে গতিহীন স্থিতিশীল স্থানু হইয়া সঙ্কীর্ণ সীমাবদ্ধ দৃষ্টির কাঠমোল্লা হইয়া থাকিতে বলিতেছিনা। এছলাম মুক্ত ধর্ম, মুক্তির ধর্ম, বন্ধনের স্থান সেখানে নাই। আমি আপনাদিগকে বলিতেছি যুগের হাওয়া অস্থায়ী, কারণ যুগই চির চঞ্চল। অন্তসারশূন্য শুষ্ক তৃণের ন্যায় এই যুগের হাওয়ায় উড়িয়া বেড়াইবার জন্য আমরা আসি নাই। স্মরণ রাখিবেন আমরা আসিয়াছি যুগের হাওয়া পালটাইয়া দিতে, এছলামের আদর্শ অনুসারে নূতন যুগের প্রবর্ত্তন করিতে। এ সময় আপনাদের প্রত্যেককে এছলামের দৃঢ়চেতা সৈনিকের উপযোগীরূপে আদর্শ জীবন যাপন করিতে হইবে। আজ হজরত মোহাম্মাদ মোস্তফার আদেশ ও আদর্শ যখন ‘সাইনবোর্ড’ বলিয়া উপহাসিত হইতেছে, সে সময় যুগের হুজুগের তাড়নায় আমরাও যদি সেই ধৃষ্টতার প্রশ্রয় দিয়া চলি, তাহার হইলে দুঃখ রাখার আর স্থান থাকে না। কোরআনের হামেল আপনারা, হজরত মোহাম্মদ মোস্তফার সাধনার ওয়ারেছ আপনারা, এছলামের খাদেম মোজাহেদ আপনারা, জাতির সত্যকার নায়ক আপনারা, সুতরাং পদে পদে আপনাদিগকে সতর্ক হইয়া চলিতে হইবে। মনে রাখিবেন আধুনিকতা অন্তরের জিনিষ, হুজুগের অন্ধ অনুকরণ তাহা কখনই নহে; স্বাধীনতা মনের সদ্ভাব, স্বেচ্ছাচারের প্রগলভতা তাহা কখনই নহে; আর, বিদ্রোহ জ্ঞানের প্রেরণা মাত্র, অজ্ঞানের দাম্ভিকতা তাহা কখনই নহে। এ সমস্তের আদর্শ আমরা কোরআনের অফুরন্ত ভান্ডার হইতে গ্রহণ করিব, সেজন্য আমাদিগকে আর কতকগুলি অন্ধঅনুকারীর দারস্ত হইতে হইবে না।

আমি জানি, চারিদিকের সমস্ত অবস্থা আপনাদের প্রতিকূল। আমি জানি, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আপনাদের প্রতি সহানূভূতিশূন্য। আমি জানি, নানা গুরুতর বাধা বিঘ্নের সহিত যুদ্ধ করিয়া আপনাদিগকে নিজেদের কর্তব্য পথে অগ্রসর হইতে হইবে। কিন্তু বন্ধুগণ, বৎসগণ! আজ আপনাদিগকে বিশেষরূপে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, অবস্থা প্রতিকূল বলিয়া হতাশ হইয়া অবসন্ন হইয়া পড়া আমাদের ধর্ম নহে। বরং অবস্থা যখন প্রতিকূল, তখন দ্বিগুণ দৃঢ়তা লইয়া, দ্বিগুণ সাহস লইয়া, দ্বিগুণ শক্তি সঞ্চয় করিয়া সকলে সমবেতভাবে কাজে লাগার দরকার হয় সেই সময়। এই প্রতিকূল অবস্থাকে নিজেদের ঈমান ও আমলের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে জয় করিতে হইবে, ইহাই আমাদের সাধনা।




বিষয়সমূহ: শিক্ষা-সংস্কৃতি
আরও