ব্যক্তিস্বার্থ, পক্ষপাতিত্ব ও স্বজনপ্রীতি
মুহাম্মাদ আব্দুন নূর
উলুবাতলি হাসান 1545 বার পঠিত
১৪৩৯ সালে জার্মানির স্বর্ণকার ইয়োহান গোটেনবার্গ সর্বপ্রথম প্রিন্টিংপ্রেস আবিষ্কার করেন এবং ১৪৫৫ সালে তাঁর প্রেস থেকে প্রথম বাইবেল ছাপা হয়। অন্যদিকে ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল জয় করলে বাইজান্টাইন থেকে অনেক বুদ্ধিজীবী ইউরোপে চলে যান। অর্থাৎ কনস্টান্টিনোপল বিজয় ও প্রিন্টিংপ্রেস আবিষ্কার খুবই সমসাময়িক ঘটনা। কিন্তু ওছমানীয়রা নিজেদের বই-পত্র প্রকাশে দীর্ঘদিন প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার করেনি। বরং তাঁরা লিপিকারদের সনাতন পদ্ধতির উপরই নির্ভরশীল ছিলেন। ফলে প্রাচ্যবিদরা তাদের এই পদক্ষেপকে ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও পশ্চাদপদতার নযীর বলে ব্যাপক সমালোচনা করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওছমানীয়রা প্রিন্টিংপ্রেসের কথা জানত না নাকি ইচ্ছা করেই তারা এটি ব্যবহার করেনি? ওছমানীয় সাম্রাজ্যে কি সত্যিই প্রিন্টিং প্রেস নিষিদ্ধ ছিল? মধ্যযুগে ওছমানীয়দের প্রিন্টিং প্রেস নিয়ে মিথ, প্রিন্টিংপ্রেসের সাথে ওছমানীয়দের পতনের সম্পর্ক, আলেমদের ভূমিকা আর প্রাচ্যবিদদের মিথ্যাচার সম্পর্কে আলোচ্য প্রবন্ধে আলোকপাত করা হ’ল।
পূর্ব ও পশ্চিমের সাংস্কৃতিক কার্যাবলীর প্রতি ওছমানীয় সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতিহের গভীর আগ্রহ ছিল। তিনি ইউরোপিয়ান, পার্সিয়ান ও আরব চিত্রশিল্পীদের নিয়ে রাজকীয় চিত্রশালা প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রীক পান্ডুলিপিকে ওছমানীয় ভাষায় রূপান্তরের অনুমতি দেন ও ভেনিসীয় চিত্রশিল্পী বেল্লিনিকে রাজকীয় চিত্রশালায় স্থান দেন।[1] তিনি এস্ট্রোনমি অধ্যয়নকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা করেন।[2] তাঁর পরবর্তী ওছমানীয় সুলতানরাও কৌশলগত প্রযুক্তি ও শৈল্পিক সৌন্দর্যের প্রতি সমর্থন দেয়া অব্যাহত রাখেন। সুলতান সেলিম যখন ১৫১৪ সালে তাব্রিজ জয় করেন তখন তিনি ১০০০ জন অনুচিত্রশিল্পীদের একটি দলকে রাজকীয় চিত্রশালায় নিয়ে আসেন।[3] সুলতান ফাতিহের রাজত্বের শেষদিকে রাজকীয় পাঠশালায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বই ছিল[4] এবং তিনি নিজেও প্রিন্টিং প্রেসের সাথে পরিচিত ছিলেন। তবে কেন তিনি বা তাঁর পরবর্তী ওছমানীয় সুলতানগণ প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার করেননি? এর বেশ কিছু কারণ ছিল।
প্রথমতঃ ওছমানীয় প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা নির্দিষ্ট অনুরোধ বা অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট ফরমান, ফৎওয়া বা অনুমতি প্রদান করত। যেহেতু প্রত্যেক নির্দিষ্ট কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র নির্দেশ প্রদান করা হ’ত অর্থাৎ একটি ফরমানের শুধুমাত্র একটি কপিই লেখার প্রয়োজন হ’ত, অনেকগুলো কপির দরকার ছিল না। তাই প্রিন্টিং প্রেস থেকে লিপিকারের কার্যকারিতা বেশী ছিল। এক্ষেত্রে প্রত্যেক ফরমানে সুলতানের স্বাক্ষর (তুগরাহ) নকল করতে স্টেনসিল ব্যবহৃত হতো।[5] পাশাপাশি ওছমানীয় বিচারালয় ও রাজকীয় প্রাসাদে অনুলিপিকারদের একটি দল তৈরী হয়েছিল যারা দক্ষতার সাথে ফরমান লিখত ও তথ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের মাধ্যমে রাজকীয় ফরমান, বিচারালয়ের রায় ও রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর তথ্য সংরক্ষণ করা হ’ত এবং জনসাধারণের কাছ থেকে গোপনীয়তা রক্ষা করা হ’ত, যা প্রিন্টিং প্রেসের মাধ্যমে সম্ভব ছিল না।[6] প্রিন্টিং প্রেস যদিও একটি পান্ডুলিপি থেকে দক্ষতার সাথে অনেকগুলো কপি তৈরি করতে পারত; কিন্তু প্রত্যেক স্বতন্ত্র কপির জন্য প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার করা অযৌক্তিক ছিল। সুলতান ফাতিহ থেকে সোলায়মান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট পর্যন্ত প্রায় সকল ওছমানীয় সুলতানরা ইউরোপের শহরগুলোতে অভিযান চালিয়েছেন ও জয়লাভ করেছেন। তারা যদি চাইতেন তাহলে পুরো ওছমানীয় সাম্রাজ্যে প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার শুরু করতে পারতেন। কিন্তু তৎকালীন ওছমানীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে প্রিন্টিং প্রেস নিষ্প্রয়োজন ছিল।
দ্বিতীয়তঃ প্রথম দিকের প্রিন্টিং প্রেসে অক্ষরগুলো আলাদা আলাদা লেখা হতো। এভাবে ইংরেজি শব্দগুলো লেখা সম্ভব হলেও আরবী শব্দগুলো লেখা সম্ভব ছিল না। যেমন আরবী حسن শব্দটি প্রিন্টিং প্রেসে লিখলে ح س ن এই রকম হ’ত। তাই প্রিন্টিং প্রেসে আরবী লিখলে তা একটা বিশৃঙ্খল টেক্সট হ’ত। ফলে ওছমানীয়রা দীর্ঘদিন প্রেস ব্যবহার করেনি। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রিন্টিংপ্রেস ব্যবহারের ফরমান জারি করলেও ধর্মীয়গ্রন্থ ছাপানোর অনুমতি দেওয়া হয় নাই।[7] আরেকটি কারণ হ’ল সুলতান সোলায়মানের পে রোল রেজিস্টার থেকে জানা যায় ১৫২৬-১৫৬৬ সালের মধ্যে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত লেখক ছিল ১৪০-এরও অধিক, যারা টেক্সট লিখত ও ডিজাইন করত।[8] সোলায়মানের শাসনামলে প্রায় দেড় লক্ষাধিক ফরমান জারি করা হয় অর্থাৎ গড়ে প্রতি বছর ৩৪০০ ও প্রতিদিনে ১০টির মতো ফরমান জারি হ’ত। এর বাইরে আরো কয়েক হাযার অনুলেখক লেখা কপি করত। ইস্তাম্বুল ভ্রমণের পর ফার্নান্দো মারসিগ্লি প্রায় আশি হাজার লিপিকার ইস্তাম্বুলে কাজ করেন বলে বর্ণনা দেন।[9] যদি প্রিন্টিং প্রেসের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হ’ত তবে লেখক ও অনুলেখকগণ বেকার হয়ে যেত। এমনকি ১৭২৭ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রিন্টিংপ্রেস ব্যবহারের ঘোষণা দিলেও অনুলেখকগণ বাব-ই-আলী (সাবলাইম পোর্তে)-তে বিক্ষোভ করে।[10]
প্রিন্টিং প্রেসের প্রতি ওছমানীয়দের ঘৃণা?
অনেক প্রাচ্যবিদরা প্রিন্টিং প্রেসের প্রতি ওছমানীয়দের ঘৃণার বিবরণ দিয়েছেন, যা নির্জলা মিথ্যাচার। ওছমানীয়রা প্রিন্টিং প্রেসকে ঘৃণা করেনি ঠিক; তবে তারা এর প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিল।
১৪৯২ সালে খিস্টানদের স্পেনিশ রিকনকুইস্তার পর অনেক মুসলিম ও ইহুদী (সেফারদিক ইহুদী) ওছমানীয় সাম্রাজ্যে চলে আসে। ১৪৯৩ সালে সেফারদিক ইহুদীরা স্পেন ও পর্তুগাল থেকে কিনে আনা প্রিন্টিং প্রেস সর্বপ্রথম ইস্তাম্বুলে স্থাপন করে।[11] ১৫০৪ সালে ডন ইয়াহুদা গিদালয়া নামের লিসবনের এক শরণার্থী ইস্তাম্বুলের প্রিন্টিং প্রেস থেকে তাওরাত প্রকাশ করে।[12] ১৫২৭ সালে ইহুদী প্রকাশক সঞ্চিনো ইতালি থেকে ইস্তাম্বুলে চলে আসে ও ১৫৪৬ সালে আরবী টেক্সট হিব্রু অক্ষরে প্রকাশ করে।[13] ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে ইস্তাম্বুলের হিব্রু প্রকাশনা শিল্প ভেনিস ও আমস্টারডামের সাথে পাল্লা দেয়া শুরু করে[14] এবং সতেরশো শতাব্দীর মধ্যভাগে কায়রো ও ফেজের মত ওছমানীয় শহরে হিব্রু প্রেস সফলভাবে পরিচালিত হয়।[15] অন্যদিকে ১৫৬৭ সালে আর্মেনীয়রা ইস্তাম্বুলে প্রিন্টিং প্রেস চালু করে ও ডোমিনিকানদের সাথে তাঁদের প্রেস শেয়ার করে, যারা পরবর্তীতে তাদের প্রকাশনার জন্য ভেনিস থেকে ল্যাটিন ফন্ট আমদানী করে।[16] ১৫৮৮ সালে সুলতান আহমদ একটি ফরমান জারি করে ওছমানীয় সাম্রাজ্যে ইতালীয় ব্যবসায়ীদেরকে বই বিক্রির অনুমতি দেন।
উপরের ইতিহাস থেকে বুঝা যায় প্রিন্টিং প্রেসের প্রতি ওছমানীয়দের ঘৃণা ছিল না। ওছমানীয় সুলতানগণ রাষ্ট্রীয় কাজে প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার না করলেও এটি ব্যবহারে বাধা দেননি অর্থাৎ এ ব্যাপারে তাদের অবস্থান নিরপেক্ষ ছিল। প্রিন্টিং প্রেসের প্রতি ওছমানীয়দের যদি ঘৃণাই থাকত, তবে তারা তাদের সাম্রাজ্যে কোন প্রেস স্থাপন করতে দিত না। তবে প্রিন্টিং প্রেসের প্রতি ওছমানীয়দের বীতশ্রদ্ধার বেশ কিছু যৌক্তিক কারণ ছিল।
প্রথমতঃ ১৪৫৫ সালে বিখ্যাত গোটেনবার্গ বাইবেল প্রকাশেরও প্রায় এক বছর পূর্বে গোটেনবার্গ প্রেস Eine Mahnung der Christenheit wider die Türken (A warning for Christendom against the Turks) নামে একটি বই প্রকাশ করে।[17] যেখানে ‘ওছমানীয় দখলদারিত্বের’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ও সাইপ্রাসকে রক্ষা করতে খ্রিস্টান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে আহবান জানানো হয় অর্থাৎ প্রথম থেকেই ইউরোপীয়রা প্রিন্টিং প্রেসকে ওছমানীয় অগ্রযাত্রা রুখতে ও খ্রিস্টান জাতিকে নতুন ক্রুসেডে উদ্বুদ্ধ করে।[18] ফলে অনেক ওছমানীয় প্রিন্টিং প্রেসকে ‘ওছমানীয় খিলাফত বিরোধী’ হিসাবে দেখতে থাকে।
দ্বিতীয়তঃ নতুন ক্রসেডের উক্ত ঘটনাটি ওছমানীয়দেরকে প্রিন্টিং প্রেসের প্রতি চূড়ান্তভাবে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। ১৫১৪ সালে পোপ জুলিয়াসের সহায়তায় ইতালিতে প্রথম আরবী বই Kitab Salat al-Sawa’i প্রকাশিত হয়।[19] এর প্রায় ৩০ বছর পর ১৫৩৭ বা ১৫৩৮ সালের দিকে ভেনিসের আলেসান্দ্রো পাগানিনো সর্বপ্রথম প্রিন্টিং প্রেসে কুরআন প্রকাশ করেন। পুরো কুরআন কোন ব্যাখ্যা বা অনুবাদ ছাড়াই শুধুমাত্র টেক্সট আকারে প্রকাশিত করা ইঙ্গিত করে যে, কুরআনগুলো এক্সপোর্ট করার জন্য প্রকাশিত হয়েছে (অনেকটা মার্টিন লুথারের গণহারে বাইবেল প্রকাশের মত)।[20] ভেনিসে ছাপানো সেই কুরআনে যবরের জায়গায় যের, পেশের জায়গায় যবর, দাল(د)-যাল(ذ) ও আইন(ع)-গাইন (غ)-এর মধ্যে ভ্রান্তি ও বিভিন্ন স্থানে অযাচিতভাবে আলিফ সংযোজনসহ অসংখ্য টেক্সচুয়াল ভুল ছিল। এমনকি ভেনিসে ছাপানো সেই কুরআনের প্রথম পৃষ্ঠাতেও ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভুল।[21] ওছমানীয়রা যেখানে শত শত বছর ধরে পবিত্রতা ও চরম আধ্যাত্মিকতার সাথে হস্তাক্ষরে নির্ভুলভাবে কুরআন লিখতো, সেখানে প্রিন্টিংপ্রেসে তৈরী এমন বিশৃঙ্খল টেক্সট ও বিভ্রান্তিকর কুরআন দেখে তাদের অনুভূতি ছিল- ‘কেবলমাত্র শয়তান স্বয়ং পবিত্র গ্রন্থের এমন কুৎসিত ও জঘন্য সংস্করণ প্রকাশ করতে পারে’।
ওছমানীয় সাম্রাজ্যে কি সত্যিই প্রিন্টিং প্রেস নিষিদ্ধ ছিল?
কিছু অসৎ প্রাচ্যবিদরা পূর্ব ও পশ্চিমে খুবই ভালোভাবে এই মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করেছেন যে (এমনকি আজ পর্যন্ত এই মিথ্যা বহাল তবিয়তে জারি আছে), ‘ওছমানীয় সুলতান বায়েজিদ কর্তৃক ১৪৮৩ সালে জারিকৃত একটি ফরমানে প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন ও কেউ প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার করলে মৃত্যুদন্ডের বিধান চালু করেন পরবর্তীতে ১৫১৫ সালে সুলতান সেলিম এই বিধান নবায়ন করেন’।[22] প্রাচ্যবিদরা তাদের বইয়ে সরাসরি ধারণার ভিত্তিতে বর্ণনা করেন, ‘ফরমানটি স্পষ্টতঃ মুদ্রণকে নিষিদ্ধ করে’[23] ‘ধর্মীয় অনুমতির ভিত্তিতে লেখা মুদ্রণ’[24] ‘নির্দিষ্ট কয়েকটি ভাষায় টেক্সটের সীমাবদ্ধ মুদ্রণ’[25] ইত্যাদি। কিন্তু ইতিহাসের সাহায্যে আমরা প্রিন্টিং প্রেস নিয়ে মোট চারটি ফরমানের কথা জানতে পারি। সেগুলো হ’ল- দ্বিতীয় বায়েজিদ (১৪৮৩), প্রথম সেলিম (১৫১৫), তৃতীয় মুরাদ (১৫৮৮) ও তৃতীয় আহমদের (১৭২৭) ফরমান।[26] কিন্তু Kathryn A. Schwartz তাঁর Did Ottoman Sultans Ban Print? প্রবন্ধে বলেন, no one has claimed to have seen the firmans of Bayezid and Selim concerning print অর্থাৎ ‘বায়েজিদ ও সেলিমের ফরমানগুলো কেউ দেখেছেন বলে দাবি করেননি’।[27] নুসহাত গেরসেক ও ওছমান এরসয় ফরমানটির ‘অনিশ্চয়তা’ তুলে ধরেছেন ও এর ‘ঐতিহাসিক ভিত্তিহীনতা’ প্রকাশ করেছেন। এমনকি প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিকদেরও কেউ বায়েজিদ ও সেলিমের ফরমান প্রমাণ করতে পারেননি। অনেক প্রাচ্যবিদ অবশ্য বলেছেন তাদের ফরমান নাকি ইতিহাস থেকে হারিয়ে গিয়েছে!!
সাধারণতঃ সুলতান বায়েজিদ রাজকীয় কোন আইন পাশ করার পূর্বে বিতর্কের আয়োজন করতেন (অনেকটা আজকের সংসদের মতো)। কিন্তু প্রিন্টিং প্রেস নিষিদ্ধ নিয়ে তিনি কোন বিতর্কের আয়োজন করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা লিপিবদ্ধ করেননি। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হ’ল এত দীর্ঘকাল মৃত্যদন্ডের এই ফরমানটি জারি থাকলেও এই ফরমানের অধীনে মৃত্যুদন্ড তো দূরে থাক, সাধারণ কোন অভিযোগও লিপিবদ্ধ হয়নি ।[28] তবে কি আদৌ ‘ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া মৃত্যদন্ডের বিধান সংবলিত প্রিন্টিং প্রেস নিষিদ্ধের’ এই ফরমানটি জারি করা হয়েছিলো?? সেই প্রশ্নের জবাব পাঠকদের জন্যই থাকল।
ওছমানীয় সাম্রাজ্যে প্রিন্টিং প্রেসের প্রয়োজনীয়তা:
আমরা আগেই দেখেছি পঞ্চদশ শতাব্দীতে সাম্রাজ্যের প্রাশাসনিক কাজে প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার করা ‘লস প্রজেক্ট’ ছিল। এর বাহিরে শিক্ষার জন্য কিছু ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তক সবার কাছেই ছিল। এছাড়া নির্দিষ্ট কিছুদিন ইস্তাম্বুলের পাবলিক লাইব্রেরী খোলা থাকত যেখান থেকে পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনীয় টেক্সট কপি করত বা বই ধার নিত।[29] ফলে প্রথমদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রিনিটং প্রেস এত প্রয়োজনীয় ছিল না।
শুধুমাত্র ইউরোপের একটা শহরে যে পরিমাণ প্রিন্টিং প্রেস ছিল গোটা ওছমানীয় সাম্রাজ্যে ততগুলো প্রিন্টিং প্রেস ছিল না। অথচ ইউরোপে প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কারের প্রায় ৫০ বছরের মাথায় ওছমানীয় সাম্রাজ্যে প্রিন্টিং প্রেস স্থাপিত হয়। আসলে তখন ওছমানীয় প্রিন্টিং প্রেস ছাড়াই সামগ্রিকভাবে এতো ভালোভাবে সাবলীল জীবনযাপন করছিলো যে ইউরোপিয়ানদের মতো তারা এর গুরুত্ব অনুধাবন করেনি।
১৫৮৮ সালে সুলতান মুরাদের ফরমান নিয়ে এন্টন ও বদোনি নামক দুই ব্যবসায়ী ওছমানীয় সাম্রাজ্যে আরবী, টার্কিশ ও পার্সিয়ান বই আমদানী শুরু করে। সুলতানের ফরমানের কারণে তাদের বই ওছমানীয় বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে জব্দ হওয়া থেকে বেঁচে যায় ও তারা ওছমানীয় সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ব্যবসা করার অনুমতি লাভ করে। ১৫৯৪ সালে তারা Euclid’s Elements-এর আরবী সংস্করণ নিয়ে আসে ও পরবর্তীতে তারা ইবনে সিনার বিখ্যাত al-Qanun-এরও আরবী সংস্করণ আনে। কিন্তু বই দুইটি ইউরোপের তুলনায় খুব কম বিক্রি হয় ও তারা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এটি ওছমানীয়দের সামাজিক প্রেক্ষাপট, সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোকে প্রিন্টিং বইয়ের প্রতি তাদের অনীহা প্রকাশ করে।
শুক্রু হানিয়ুগ্লু তার বইয়ে দেখান যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রিন্টিংপ্রেস ব্যবহারের ঘোষণা দেয়ার পর থেকে অর্থাৎ ১৭২৭ থেকে ১৮৩৮ সালের মধ্যে ওছমানীয় রাজকীয় প্রিন্টিং প্রেস থেকে মাত্র ১৪২টি বই প্রকাশিত হয়।[30] এটা প্রমাণ করে যে, ওছমানীয়দের সাংস্কৃতিক জীবনে প্রিন্টিং প্রেস নিষ্প্রয়োজন ছিলো। ওছমানীয়রা ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে প্রাণবন্ত প্রিন্টিং প্রেসের উত্থানকে পুরোপুরি গ্রহণ করে।
উপরের দু’টি উদাহরণ থেকে বুঝা যায় প্রথকদিকে ওছমানীয় সাম্রাজ্যে প্রিন্টিং প্রেস খুব একটা প্রয়োজন ছিলো না। তবে শেষদিকে তারা এর জন্য কিছুটা পিছিয়ে যায়।
প্রিন্টিং প্রেস ও ধর্মীয় উন্মাদনা:
প্রিন্টিং প্রেস নিয়ে ওছমানীয়দের মধ্যে কোন ধর্মীয় উন্মাদনা ছিল না। তবে কুরআন বিকৃতির আশংকায় তারা দীর্ঘদিন প্রিন্টিং প্রেসে কোন ধর্মীয় গ্রন্থ ছাপায়নি। ১৫৩৮ সালের দিকে ভেনিসের প্রেসে ত্রুটিপূর্ণ কুরআন ছাপানো হ’লে ওছমানীয়দের এই আশংকা সত্য প্রমাণিত হয়। প্রাচ্যবিদরা প্রিন্টিং প্রেস নিষিদ্ধের সাথে আলেমদের সম্পৃক্ততার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা ভিত্তিহীন মিথ্যাচার। আদতে ওছমানীয় সাম্রাজ্যে কখনোই প্রিন্টিং প্রেস নিষিদ্ধ ছিল না। তৎকালীন শায়খুল ইসলামের ফতোয়া থেকেও প্রিন্টিং প্রেস সম্পর্কে আলেমদের মনোভাব বুঝা যায়। শায়খুল ইসলাম তাঁর ফৎওয়াতে বলেন, ‘শব্দ দিয়ে বাক্য তৈরি করে মুদ্রণ শিল্পীরা খুব সহজেই অনেক বই উৎপাদন করতে পাওে, যা খুব সস্তা। যেহেতু এটি কার্যকর পদ্ধতি তাই ইসলাম এটিকে অনুমতি দেয়। বই সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের উচিত প্রথমে বইটি সংশোধন করা। বই মুদ্রণের পূর্বে পর্যালোচনা করা ভালো ।
১৬৫২ সালে ওছমানীয় সাম্রাজ্যের জনৈক খ্রিষ্টান বর্ণনা করেন, তিনি প্রিন্টিং প্রেস থেকে হস্তলিপিকে বেশী প্রাধান্য দেন ও প্রিন্টিং প্রেসকে ‘বিদেশী’ ও ‘ফ্রাঙ্কিস’ হিসেবে গণ্য করেন।[31] এখন প্রশ্ন হচ্ছে ধর্মীয় উন্মাদনাই যদি মুসলিমদেরকে প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখত তাহলে অধিকাংশ খ্রিষ্টানরাও প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার করেনি কেন? প্রিন্টিং প্রেসের ব্যাপারে রাষ্ট্রের মতো ধর্মীয় আলেমরাও ছিলেন নিরপেক্ষ। তারা যেমন অমুসলিমদের বাঁধা দেননি তেমনি নিজেরাও প্রেস ব্যবহার করেননি। তবে ওছমানীয়দের মাটিতে কেউ প্রিন্টিং প্রেসকে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেনি। এইরকম একটি ঘটনা ঐতিহাসিকরা লিপিবদ্ধ করেছেন। ব্রিটিশ ও ডাচ সহায়তায় লুকারিস নামক এক ব্যক্তি ওছমানীয় সাম্রাজ্যে গ্রীক অর্থোডক্স প্রেস স্থাপন করে, যার উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় অর্থোডক্স শিক্ষাকে সহজ ও গতিশীল করা। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রেসটি তার উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয় ও তাদের প্রকাশনায় এন্টি-ক্যাথলিসিজম ও এন্টি-সেমিটিজম প্রোপাগান্ডা শুরু হয়। এর কিছুদিন পর তারা ইসলামের সমালোচনা করে একটি লেখা প্রকাশ করে যা স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত পাশার দৃষ্টিগোচর হয়। ফলে জেনেসারিরা সেই প্রেসে হামলা চালায়, সকল প্রিন্টিং উপকরণ জব্দ করে ও প্রেসটি ধ্বংস করে দেয়া হয়।[32]
ওছমানীয়দের পতনে প্রিন্টিং প্রেসের ভূমিকা :
ওছমানীয়দের পতনের কারণ অনুসন্ধানের জন্য অতীতে প্রচুর গবেষণা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। শেষদিকে ওছমানীয়রা যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ে, তেমনি যুগ যুগ ধরে অাঁকড়ে থাকা আধ্যাত্মিকতা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শেষদিকের বেশ কয়েকজন সুলতান ‘ইউরোপীয়’দের মত হওয়ার জন্য ইউরোপে শিক্ষানবিশ পাঠায় যারা পরবর্তীতে তানযীমাত ও অন্যান্য সংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলে। মুসলিম ঐতিহাসিকরা ওছমানীয়দের পতনের কারণ হিসাবে ইজতিহাদের অভাব, ওছমানীয় শাসন পদ্ধতি এবং সাম্রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যকে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য করতে না পারাকে দায়ী করেন। জামালুদ্দিন আফগানীর মতো সংস্কারকরা ইসলামী যুক্তিনির্ভর দর্শন ও বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল দমন করার জন্য ওছমানীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতাকে দায়ী করেন। অন্যদিকে পশ্চিমা ঐতিহাসিক যেমন বার্নার্ড লুইস তাঁর What Went Wrong? বইয়ে ‘ইসলামী সংস্কৃতির বাধা, রাজনৈতিক সেক্যুলারিজমের অনুপস্থিতি, শিল্পায়নের অভাব ও আধুনিকতাকে আলিঙ্গন করার অনীহাকে’ ওছমানীয়দের পতনের জন্য দায়ী করেন।[33] যদিও পরবর্তীতে তিনি তার প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সমালোচিত হন। ওছমানীয়দের পতনের কারণ হিসাবে খুব কম ঐতিহাসিকই প্রিন্টিং প্রেসকে দায়ী করেছেন। ওছমানীয়দের পতনের অনেকগুলো কারণের মধ্যে প্রিন্টিং প্রেস খুবই গৌণ একটা কারণ। আসলে ইউরোপিয়ান হেজিমনিতে ভোগা অনেকেই ইউরোপীয় ও ওছমানীয়দের তুলনামূলক আলোচনা করে দেখান যে, ‘ইউরোপীয়রা প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার করে প্রটেস্ট্যান্ট মুভমেন্ট, এনলাইটেনমেন্ট ও শিল্প বিপ্লব সংঘটিত করে যার কারণে তারা উন্নত হয় ও ওছমানীয়রা প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার না করায় তারা পিছিয়ে পড়ে’। আসলে মূল ব্যাপারটি তা নয়। প্রটেস্ট্যান্ট মুভমেন্টের কারণে ইউরোপে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এনলাইটেনমেন্টের মাধ্যমে সংঘটিত হওয়া ফরাসি বিপ্লব রীতিমত ‘রক্তাক্ত বিপ্লবে’ পরিণত হয়।
এখন প্রশ্ন হলো তাহলে ইউরোপের উন্নয়নের মূলমন্ত্রটি কি? ইউরোপের উন্নয়নের মূলমন্ত্রটি হ’ল কলোনিয়ালাইজেশন। একটা সময় ইউরোপ ওছমানীয়দের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। কিন্তু কলোনিয়ালাইজেশনের পর থেকে তারা কলোনিগুলোকে এমনভাবে শোষণ করতে থাকে যে, অল্প কয়েক যুগের মধ্যেই তারা অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে উঠে। ফলে তারা সামরিক ও শিক্ষায় ব্যাপক বিনিয়োগ করতে থাকে যা শিল্পবিপ্লব বয়ে আনে। অন্যদিকে ওছমানীয়দের জিযিয়া, যাকাত, ওয়াকফ থেকে প্রাপ্ত অর্থ ইউরোপের ধারে কাছেও ছিল না। এইসব অর্থের বড় একটি অংশ আবার সাম্রাজ্যের বিদ্রোহ দমন করতে ব্যয় হত। ফলে অমানবিক শোষণ ও অত্যাচারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে উঠা ইউরোপের সাথে ন্যায় ও ইনছাফের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ওছমানীয়রা পাল্লা দিতে পারেনি।
পরিশেষে বলব, সামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে ওছমানীয় সাম্রাজ্যে প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় নি। কিন্তু প্রিন্টিং প্রেসের সাথে জড়িয়ে মুসলিম স্বর্ণযুগের রূপকার আলেম ও সুলতানদের চরিত্র হননের যে হীন প্রয়াস প্রাচ্যবিদরা শুরু করেছিল তা আজও বহাল তবিয়তে চলছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, মুসলিমরাও প্রাচ্যবিদদের সাথে এই হীন কাজে যোগ দিয়েছে।
[লেখক : নানজিং, চীন]
[1]. Kinross, Patrick Balfour. 1977. The Ottoman Centuries: The Rise and Fall of the Turkish Empire. New York, NY:Morrow;155.
[2]. Bloom, Jonathan M. 2001. Paper Before Print: The History and Impact of Paper in the Islamic World. New Haven, CT: Yale University Press;221.
[3]. Levey, Michael. 1975. The World of Ottoman Art. London, United Kingdom: Thames and Hudson;60; Atıl, Esin. 1987. The Age of Sultan Süleyman the Magnificent. Washington, D.C.: National Gallery of Art;3.
[4]. Kreiser, Klaus. 2001. Causes of the Decrease of Ignorance? Remarks on the printing of books in the Ottoman Empire;13.
[5]. Rogers, J. M. and R. M. Ward. 1988. Süleyman the Magnificent. London, United Kingdom: British Museum Publications 8-59.
[6]. Kunt, I. Metin. 2005a. Interview with author. October 18, 2005. Amman, Jordan.
[7]. https://www.youtube.com/watch?v=4dEvEFBpVjg
[8]. Atıl, Esin. 1987. The Age of Sultan Süleyman the Magnificent. Washington, D.C.: National Gallery of Art;30-31,289-297.
[9]. Bloom, Jonathan M. 2001. Paper Before Print: The History and Impact of Paper in the Islamic World. New Haven, CT: Yale University Press;222; Faroqhi, Suraiya. 2000. Subjects of the Sultan: Culture and Daily Life in the Ottoman Empire. New York, NY: I.B. Tauris Publishers; 96 ; Oman, G. 1960. ÒMatba’a.Ó In The Encyclopaedia of Islam, Vol. 6: 794-799. Leiden, The Netherlands: Brill;795.
[10].https://www.dailysabah.com/feature/2015/06/08/myths-and-reality-about-the-printing-press-in-the-ottoman-empire .
[11]. Tamari, Ittai Joseph. 2001. Jewish printing and publishing activities in the Ottoman cities of Constantinople and Salonika at the dawn of early modern Europe.; Finkel, Caroline. 2005. Osman's Dream: The Story of the Ottoman Empire, 1300-1923. London, United Kingdom: John Murray;366.
[12]. Tamari, Ittai Joseph. 2001. Jewish printing and publishing activities in the Ottoman cities of Constantinople and Salonika at the dawn of early modern Europe, 9
[13]. Krek, Miroslav. 1979. The Enigma of the First Arabic book Printed from Movable Type.;209
[14]. Abdulrazak, Fawzi A. 1990. ÒThe Kingdom of the Book: The History of Printing as an Agency of Change in Morocco Between 1865 and 1912.Ó Ph.D. Dissertation. Boston University, 76; Tamari, Ittai Joseph. 2001. Jewish printing and publishing activities in the Ottoman cities of Constantinople and Salonika at the dawn of early modern Europe, 9.
[15]. Abi Farès, Huda Smitshuijzen. 2001. Arabic Typography: A Comprehensive Sourcebook. London, United Kingdom: Saqi, 65; Steinberg, S. H. 1996. Five Hundred Years of Printing. London, United Kingdom: The British Library and Oak Knoll Press, 53.
[16]. .Bloom, Jonathan M. 2001. Paper Before Print: The History and Impact of Paper in the Islamic World. New Haven, CT: Yale University Press, 221; Kut, Günay Alpay. 1960. ÒMatba’a: In Turkey. In The Encyclopaedia of Islam, Vol. 6: 799-803. Leiden, The Netherlands: Brill, 799.
[17]. Füssel, Stephan. A. 2003. Gutenberg and the Impact of Printing. Burlington, VT: Ashgate Publishing Company; Lunde, Paul. 1981. ÒArabic and the Art of Printing.Ó Saudi Aramco World, March/April 1981: 20-35; Eisenstein, — 2005. The Printing Revolution in Early Modern Europe. Second edition. Cambridge, United Kingdom: Cambridge University Press.
[18]. .Eisenstein, — 2005. The Printing Revolution in Early Modern Europe. Second edition. Cambridge, United Kingdom: Cambridge University Press, 303; Abdulrazak, Fawzi A. 1990. The Kingdom of the Book: The History of Printing as an Agency of Change in Morocco Between 1865 and 1912. Ph.D. Dissertation. Boston University;78.
[19]. .Krek, Miroslav. 1979. The Enigma of the First Arabic book Printed from Movable Type; AbiFarès, Huda Smitshuijzen. 2001. ArabicTypography: A Comprehensive Sourcebook. London, United Kingdom: Saqi, 45; Bloom, Jonathan M. 2001. Paper Before Print: The History and Impact of Paper in the Islamic World. New Haven, CT: Yale University Press,219; Pedersen, Johannes. 1984. The Arabic Book. Princeton, NJ: Princeton University Press;13.
[20]. Nuovo, Angela. 1990. A Lost Arabic Koran Rediscovered.Ó The Library: The Transactions of the Bibliographic Society s6-12, 4 (December 1990): 273-292.
[21]. Abdulrazak, Fawzi A. 1990. The Kingdom of the Book: The History of Printing as an Agency of Change in Morocco Between 1865 and 1912.Ó Ph.D. Dissertation. Boston University, 66-67; Mahdi, Mushin. 1995. From the Manuscript Age to the Age of Printed Books. In The Book in the Islamic World: The Written Word and Communication in the Middle East, edited by George N. Atiyeh, 1-15. Albany, NY: State University of New York Press.
[22].https://en.wikipedia.org/wiki/Global_spreadof_the_printing_press
[23]. Finkel, Osman’s Dream, 366.
[24]. Dagmar Glass and Geoffrey Roper, Part I: The Printing of Arabic Books in the Arab World, in Middle Eastern Languages and the Print Revolution: A Cross-Cultural Encounter, ed. Eva Hanebutt-Benz, Dagmar Glass, and Geoffrey Roper [Westhofen: WVAVerlag Skulima, 2002];177.
[25]. Bernard Lewis, The Emergence of Modern Turkey [London: Oxford University Press, 1961]; 50
[26]. Kathryn A. Schwartz, Did Ottoman Sultans Ban Print, 6.
[27]. Refer to the above-listed [40]
[28]. Faroqhi, Suraiya. 2000. Subjects of the Sultan: Culture and Daily Life in the Ottoman Empire. New York, NY: I.B. Tauris Publishers, 95.
[29]. Nuhoğlu, Hidayet Y. 2000. Mütefferika's Printing Press: Some Observations. In The Great Ottoman-Turkish Civilization, edited by Kemal Çiçek, Vol. 3: 83-90. Ankara, Turkey: Yeni Türkiye Publications.
[30]. Şükrü Hanioğlu, A Brief History of the Late Ottoman Empire, Princeton University Press (2010)
[31]. Faroqhi, Suraiya. 2000. Subjects of the Sultan: Culture and Daily Life in the Ottoman Empire. New York, NY: I.B. Tauris Publishers;95
[32]. Runciman, Steven. 1968. The Great Church in Captivity: A Study of the Patriarchate of Constantinople from the Eve of the Turkish Conquest to the Greek War of Independence. Cambridge, United Kingdom: Cambridge University Press;272-273; Faroqhi, Suraiya. 2000. Subjects of the Sultan: Culture and Daily Life in the Ottoman Empire. New York, NY: I.B. Tauris Publishers;70.
[33]. https://www.islamiqate.com/830/ottomanist-scholars-researchers-alleged-ottoman-decline