ইয়াহইয়া জোয়ান সুকুইল্ল্যো
শাকিরুল ইসলাম
হিদার শাহ 1058 বার পঠিত
[লেখক
হিদার শাহ হলেন আমেরিকান নও মুসলিম। বর্তমানে তিনি মিশরে থাকেন যেখানে
তিনি পেশাদার অনুবাদক এবং আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজের খন্ডকালীন শিক্ষক। তিনি
আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবী ভাষা ও ইসলামিক স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রী
অর্জন করেন।]
একটি ধর্মীয় পরিবারে বড় হয়ে উঠার কিছু সুবিধা সবসময়ই থাকে। আমিও এর বাইরে নই। আমার বেড়ে উঠা একটি ধার্মিক খ্রিষ্টান পরিবারে। যার কারনে খুব ছোট বেলা থেকেই ধর্মের বিভিন্ন রীতিনীতি এবং বিশ্বাসের সাথে পরিচিত আমি। আমি নিজেও পালন করতাম এবং সেই ছোট বয়সেই গীর্জায় অন্য বাচ্চাদের ধর্ম শিক্ষা দান করতাম। বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না আমাদের। ফলস্বরূপ, হাতের অঢেল সময় পার করার জন্য পড়াশুনাকে বেছে নিলাম। আমি সব ধরনের বই পড়তাম, সাথে ধর্মীয় বইও। যখন আমার বয়স বারো তখন আমার সন্দেহ শুরু হয়ে যায় আমি যে বিশ্বাসের উপর আছি সেটা সঠিক কিনা। চেŠদ্দতে পা দিয়ে আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলাম যে, এটি সত্য হতে পারে না। সেইসাথে আমি এমন কিছু খুঁজেও পাচ্ছিলাম না যেটা কিনা আমার বর্তমান বিশ্বাসের জায়গাতে আসতে পারে। ঠিক তখন থেকেই আমি আমার জানামতে যেসব সত্যবাদী ধর্ম ছিল সেগুলো সম্পর্কে পড়াশুনা শুরু করলাম। আমি একটি কাঠামো দাঁড় করাতে চাইলাম। এই কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ উপাদান ছিল, যাকে আমরা সত্য ধর্ম বলে জানব সেটা অবশ্যই মানুষের প্রথম জ্ঞান হিসাবে বিবেচ্য হবে। এটি যখন পড়া হবে তখন সেটা হৃদয়গ্রাহী হবে এবং সেইসাথে এর প্রত্যেকটি কথা হবে মানুষের জীবন নির্ভর। যা মানুষকে দিবে জীবন পরিচালনার দিক নির্দেশনা। আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো এটি এক ঈশ্বরের দিকে আহবান করবে। কিন্তু আমি হতাশ হয়ে দেখলাম আমার তৈরি করা কাঠামোর ভেতর কোন ধর্মই আসল না। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি ইসলাম ধর্ম খ্রিষ্ট ধর্মের পরে এসেছিল। এই ভুল ধারণার কারনে আমার কখনো ইসলামকে জানার আগ্রহও তৈরি হয়নি। কিছুদিন পরে আমি খুব অসহায় বোধ শুরু করলাম। কোন কিছুর কূল কিনারা না পেয়ে বুঝে গেলাম আমার হয়ত সত্য ধর্ম খুজে পাওয়া হবে না। আমি কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পেলাম বৌদ্ধ ধর্মে। তথাপি আমি জানতাম এটাই সেই সত্য ধর্ম নয় যা আমি খুঁজে ফিরছি।
অতঃপর গবেষণার গভীরতার শুরু হয় জাপানে। সেখানে কাটানো সময়টি আমার জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জাপানে মূলত আমি আমার উচ্চ বিদ্যালয়ের শেষের বছরটি কাটাই। আমার চিন্তা ভাবনায় ব্যাপক প্রভাব পড়ে এই সময়টিতে। আমার পরিবারের দেয়া শিক্ষা, সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন রীতি নীতি বা নারীবাদ সম্পর্কে যে ধারনা আমার ছিল সেখানে অসম্ভব প্রভাব ফেলেছিল। আমি এটা জাপানেই অনুধাবন করতে পারি যে, পুরুষ এবং মহিলা আসলেই একই অধিকার পেতে পারে। সমাজে সম্মানের সাথে একই ভূমিকা পালন করতে পারে। জাপানের পরিবারগুলোর কাছ থেকে আমি যে সহায়তা পেয়েছি সেটা আমাকে আরো বেশি অনুভব করিয়েছে এদের গভীর সংহতি। যা দূর্ভাগ্যক্রমে আমরা পশ্চিমা বিশ্বে খুজে পাইনা। আমি এই সময়ে বৌদ্ধদের অনুশীলনগুলো পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আমি যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসি, তখন একটি গাড়ি দূর্ঘটনার শিকার হই। আমি একজন মেকানিকের সন্ধান পেলাম যে কিনা অল্প খরচেই গাড়িটি ঠিক করে দিতে পারবে। আমি যখন আমার গাড়িটি তার কাছে নিয়ে পৌছালাম তখন তার স্ত্রী আমাকে ভেতরে আমন্ত্রণ করলেন। আমি খুব অবাক হয়ে দেখলাম তিনি একটি দীর্ঘ স্কার্ট পড়েছিলেন। সেইসাথে মাথার উপর জড়ানো ছিল হিজাব। এ ধরনের পোশাক আমি শুধুমাত্র জিওগ্রাফি চ্যানেলেই দেখেছি। আমি আস্তে ধীরে তাকে তার বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে চাইলাম।
আমার একের পর এক প্রশ্নের উত্তর সে দিচ্ছিল বেশ সাবলীল এবং সুন্দর ভাবে। আমার মনে হচ্ছিল আমি যে মূলনীতির কাঠামো তৈরি করেছিলাম তার উত্তরগুলো পেয়ে যাচ্ছি। তার স্বামী আমার গাড়িটির কাজ শেষ করার আগে তিনি আমাকে তার বাড়িতে অনুষ্ঠিত মহিলাদের জন্য একটি সাপ্তাহিক স্টাডি সার্কেলে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি সেখানে ছয় মাস পর্যন্ত উপস্থিত ছিলাম। আর একদিন আসলো যখন আমার কাছে জানতে চাওয়া হ’ল আমি ইসলাম গ্রহণ করতে প্রস্ত্তত কিনা। আমি একমত হলাম তাদের সাথে। কেননা, আমি বুঝতে পেরেছিলাম ইসলাম সেই ধর্ম যা আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। কিন্তু এর ভেতর বাহির জানার জন্য আমাকে এর মাঝেই প্রবেশ করতে হবে। পূর্ণ জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা করতে হবে। আমি যদি পেছন ফিরে তাকাই তাহলে দেখা যাবে, আমার সকল ধর্ম থকে ফিরে আসার কারণ হ’ল সন্দেহ এবং বিশ্বাসের অভাব। আমার কাছে বিশ্বাসের প্রধান শর্ত হলো সেটার সত্যতার প্রমাণ। আমার জন্য সন্দেহ একটি নিয়ম ছিল। এমনকি সর্বাধিক প্রদর্শিত বৈজ্ঞানিক আইনও সন্দেহের শিকার হতে পারে। আর সেখানে অদৃশ্যে বিশ্বাস করতে হয়েছিল আমাকে। যদিও এমন নয় যে, আমি প্রকৃতপক্ষে মুসলিম ছিলাম সেই সময়। আমি মাত্র শুরু করেছিলাম জানতে। একটি ছোট শিশুর মত হাটি হাটি পা করে শিখছিলাম। এটি আমার জন্য একটি নতুন সূচনা ছিল যেখানে আমি শিখছিলাম এবং বড় হচ্ছিলাম। তবে এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে যখন মনে হত আমি অনেক কিছু জেনে গিয়েছি, ঠিক তখনি কেউ না কেউ এসে আমাকে নতুন কিছু জানিয়ে যেত।
মসজিদে আরব বোনরা তাদের বোনদের আরবী ভাষায় শিক্ষা দিত এবং পাকিস্তানীরা উর্দুতে। কিন্তু ইংরেজিতে কিছু শেখানোর উদ্যোগ কেউ নেননি তখনো। সুতরাং যদিও আমি ইসলামের নবীন, তবুও আমি পাঠ প্রস্ত্তত করার চেষ্টা করতে শুরু করেছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ এটা করতে গিয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমি নিজে ছিলাম নতুন এবং সেইসাথে আমি ইংরেজিতে পাঠদানের কাজও করছিলাম। কারো কোন দিক- নির্দেশনা ছাড়া এই কাজটি ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। বেশ কয়েক বছর পর আমি ফিকহ, আক্বীদা এবং কুরআনের বিজ্ঞান সম্পর্কে পড়াশুনা শুরু করলাম। এই পড়াশুনায় আমি যেমন প্রতিবার বিস্মিত হচ্ছিলাম ঠিক তেমনি আমি দ্বিধা-দ্বন্দ্বেও পড়েছিলাম। আমার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করার জন্য আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কিছু শায়খের সাথে কথা বলাছিলাম। তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করতে। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট না হয়ে বরং হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।
অন্যান্য সময় এই যুক্তিতেই আমি ধর্মান্তরিত হতাম। কিন্তু এখানে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি এর সঠিক উত্তর পাই আমি এর গভীরে ডুবে যাব। প্রায় এক বছর পরে আমি এক সকালে জেগে দেখলাম আমার সমস্ত জয়েন্টগুলি ফুলে গেছে এবং ব্যথা হচেছ। আমার অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে এবং আমার স্মরণ শক্তি হ্রাস পেতে থাকে। যার ফলে গুরুতর সমস্যা শুরু হয়। আমার জন্য এক বিরাট ধাক্কা! একমাস পরীক্ষার পরে চিকিৎসকরা আমাকে জানিয়েছিল যে, তারা বিশ্বাস করেন আমি লিম্ফোমার শেষ পর্যায়ে আছি এবং বেঁচে থাকার জন্য আমার খুব কম সময় হাতে আছে। পরে অবশ্য তারা তাদের মতামত পরিবর্তন করে আমাকে সারকয়েডোসিস রোগ নির্ণয় করে। যা একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ, যা দেহের বিভিন্ন অঙ্গকে প্রভাবিত করতে পারে। আমি যেন হাতে আরো কিছুটা সময় পেলাম নিজের জীবনকে জানার। যদিও আমার অবস্থা তখন খুব বেশী ভালো ছিল না। তবে ধীরে ধীরে আমার অবস্থার উন্নতি হতে থাকে।
আলহামদুলিল্লাহ শরীরের উন্নতির সাথে সাথে আমি আরো একটি সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি স্থির করলাম ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহযুক্ত কিছুর সামনে আমি আর দাঁড়াবো না। তবে আমি পূর্বের ন্যায় অন্যদের অনুবাদের উপর নির্ভরশীলও আর হবো না। আমি স্থির করেছিলাম যে, এর সাথে মোকাবিলা করার একমাত্র উপায় হল অনুবাদ পড়ার পরিবর্তে আরবী শেখা এবং নিজের জন্য গবেষণা করা। এরপরেই আমি মরক্কো এবং সিরিয়ায় পড়াশোনা করা অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে এবং মিশর এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে বসবাসকারী লোকদের সাথে পরামর্শ করেছি এবং শেষ পর্যন্ত আমি স্থির করেছিলাম যে মিশর আমার পক্ষে সেরা হবে। (তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট)