মসজিদে হামলা : ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার নিকৃষ্টতম বহিঃপ্রকাশ

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 1559 বার পঠিত

গত ১৮ই নভেম্বর’২০ ফরিদপুরের সালথা উপযেলার কামদিয়া গ্রামে অবস্থিত একটি আহলেহাদীছ মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের উপস্থিতিতে বর্বরভাবে ভেঙ্গে-চুরে তছনছ করা হয়। ভারতের বাবরী মসজিদ ধ্বংসকারীদের মত হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ নয়, বরং তারা ছিল উলামা পরিষদ ও তাওহীদী জনতার ব্যানারে কয়েকশ’ কওমী মাদ্রাসার ছাত্র ও সাধারণ মুসলিম জনতা। সন্ত্রাসী কায়দায় লুট করে নেয়া হয় মাদ্রাসা ও মসজিদের যাবতীয় আসবাব-পত্র। শিক্ষার্থীদের লেপ-তোষক পর্যন্ত লুট করা হয়েছে। এমনকি শিক্ষার্থীদের ব্যবহৃত পবিত্র কুরআনকে পর্যন্ত তারা ছিন্নভিন্ন করেছে হামলাকারীরা। পরিশেষে মাদ্রাসার ধ্বংসস্ত্তপে তারা ব্যানার টাঙিয়ে দেয় সদম্ভ হুমকিবার্তা- ‘আহলে হাদীসের আস্তানা সালথা থানায় থাকবে না’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই নিকৃষ্ট ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় বিবিসিসহ শীর্ষস্থানীয় মিডিয়াগুলিতে ঘটনাটি বিশ্বব্যাপী প্রচার পায়।  

এখানেই থেমে থাকেনি বিষয়টি। এর মাত্র দু’সপ্তাহের ব্যবধানে একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছিল সুনামগঞ্জে। শহরের একমাত্র আহলেহাদীছ মসজিদটি উচ্ছেদের লক্ষ্যে ১লা ডিসেম্বর’২০ তথাকথিত একদল ‘তৌহিদী জনতা’ চেষ্টা করেছিল জমায়েত হওয়ার। তবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার মুখে প্রশাসন সজাগ হয় এবং তাদেরকে নিবৃত্ত করে। মাত্র বছরখানেক পূর্বে ২০১৯ সালের ১১ই জুলাই ভোলা সদরের একটি আহলেহাদীছ মসজিদকে ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। যার জ্বলন্ত ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। সেসময়ও সারা দেশব্যাপী ঘটনাটি আলোচিত হয়েছিল। ২০১৮ সালের মে মাসে সিলেট শহরের আত-তাকওয়া মসজিদকে ভেঙে সুরমা নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার জন্য প্রকাশ্য জনসভায় হুমকি দেয় সিলেট শহরের শীর্ষস্থানীয় আলেম সমাজ এবং সরকারী ও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম, বরিশাল, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া প্রভৃতি স্থানে আহলেহাদীছ মসজিদ ধ্বংসের জন্য বারবার পাঁয়তারা করেছে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে স্থানীয় হানাফী, কওমী কিংবা পীরপূজারী গোষ্ঠী।

বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হানাফী সমাজ কর্তৃক আহলেহাদীছ মসজিদ ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেয়া বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। বরং এধরণের ঘটনা বিগত দিনেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অহরহ ঘটেছে। বিশেষতঃ আহলেহাদীছ অধ্যুষিত এলাকার বাইরে নতুন কোন আহলেহাদীছ মসজিদ নির্মাণ করাকে মন্দির বা অন্য কোন ধর্মের উপসনালয় স্থাপনের চেয়েও নিকৃষ্ট কাজ মনে করা হয়। ভাঙচুর ও হামলার ঘটনা তো মাঝে-মধ্যে মিডিয়াতে আসে। এর বাইরেও সন্ত্রাসী হুমকি ও গালি-গালাজের মুখে কত যে মসজিদের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়েছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই। প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে কাটাতে হয় এসব মসজিদের মুছল্লীদের। অনেক মসজিদে ভয়ে যোহর ও আছরের ছালাতের আযান পর্যন্ত মাইকে দেয়া হয় না। প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব ঘটনা ঘটলেও তারা নির্বিকার। কেননা তারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থের বাইরে যেতে চায় না।

প্রিয় পাঠক, আহলেহাদীছদের সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ হানাফী সমাজের মাযহাবী পার্থক্য নতুন কোন বিষয় নয়। হাদীছের নিঃশর্ত অনুসারী আহলুল হাদীছ এবং নির্দিষ্ট একজন ইমামের অনুসারী বা আহলুর রায়পন্থীদের মধ্যে পার্থক্য যুগ যুগ ধরে সুপরিচিত বিষয়। অথচ দুঃখজনক ব্যাপার হ’ল বাংলাদেশে আহলেহাদীছদের সাথে সহাবস্থান তো দূরে থাক, তাদেরকে ‘মুসলিম’ হিসাবেই স্বীকৃতি দিতে চান না হানাফী আলেমদের অনেকে। বরং ‘আহলেহাদীছ’ শব্দের প্রতি তাদের রয়েছে প্রচন্ড রকম স্পর্শকাতরতা। এত বিদ্বেষ ও আক্রোশ তারা এই পরিভাষার জন্য কেন বরাদ্দ রেখেছেন, তা গবেষণার বিষয়। জানি না তারা এই শব্দের মধ্যে তাদের আদর্শিক পরাজয়ের বার্তা খুঁজে পান কি-না। নতুবা কেন ফরিদপুরের আহলেহাদীছ মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদ করতে গিয়েও উদারমনা হানাফীরা পর্যন্ত আহলেহাদীছ বিশেষণের প্রতি তাদের সুপ্ত এ্যালার্জি লুকিয়ে রাখতে পারেন না? কেন তারা বিভক্তির হাযারো আক্বীদা ও মানহাজগত কারণকে গৌণ রেখে বিশেষভাবে ‘আহলেহাদীছ’ নামকেই ‘বিভেদ সৃষ্টিকারী’ মনে করেন?

আমরা বিস্ময় বোধ করি যে, আহলেহাদীছদের শিরক-বিদ‘আতের বিরুদ্ধে বক্তব্য তাদের কাছে উস্কানীমূলক মনে হয়। অথচ কিছুদিন পর পর যখন বিভিন্ন এলাকায় আহলেহাদীছ বিরোধী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে অত্যন্ত আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ ভাষায় আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হয়, তখন তারা কেন নীরব থাকেন? শুধু তাই নয় বিভিন্ন কওমী মাদ্রাসায় আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে বিশেষ বিভাগ পর্যন্ত খুলে কোমলমতি ছাত্রদেরকে বিদ্বেষের কলুষ শেখানো হচ্ছে। দিন দিন যত বেশী আহলেহাদীছ আন্দোলনের সংস্কার কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই তাদের অনুদারতার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাদের এই অসহিষ্ণুতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ কখনও মসজিদ ভাঙচুর পর্যন্ত গড়াচ্ছে!

আমরা আরও অবাক হই যখন তারা তথাকথিত উদারতা দেখিয়ে বলেন যে, মসজিদ আল্লাহর ঘর। অতএব আহলেহাদীছ মসজিদ বলা ঠিক নয়। আবার কেউ বলেন, ইসলামের ইতিহাসে ফিক্বহের ভিত্তিতে কখনো মসজিদ ভিন্ন করা হয় নি। অথচ ৮০১ থেকে ১৩৪৩ হি. পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫৪২ বছর যাবৎ মুসলমানদের কেন্দ্রস্থল কা‘বা গৃহের চারপাশে কি চার মাযহাবের মুছল্লীদের জন্য চারটি পৃথক মুছাল্লা ছিল না? 

কারা করেছিল এটা? এখনো কি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হানাফী বা শাফেঈ নামাংকিত মসজিদ নেই? আমরা কথিত উদারতার বার্তাবাহকদের কাছে জানতে চাই, তারা কি কখনও কোন হানাফীদের পরিচালিত মসজিদে এক ওয়াক্তের জন্যও কোন আহলেহাদীছকে ইমামতির সুযোগ দিবেন? কিংবা বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে বছরে মাত্র একটি জুম‘আয় কোন আহলেহাদীছ আলেমকে খুৎবা দেয়ার প্রস্তাবকে স্বাগত জানাবেন? নিশ্চয়ই না। তবে কেন আপনারা উদারতার ভনিতা করে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের চেষ্টা করেন? বরং বাস্তবতা হ’ল এই যে, বহু হানাফী মসজিদে আহলেহাদীছদের প্রবেশ নিষেধ করা হয় কিংবা তাদেরকে ছালাত আদায় করতে দেখলে হরহামেশা কটূক্তি করা হয়। কিন্তু কোন আহলেহাদীছ মসজিদে ভিন্ন কোন মাযহাবের অনুসারীদের ছালাত আদায়ে বাধা দেয়া হয়েছে বা কটূক্তি করা হয়েছে, এমন একটি প্রমাণও কি কেউ দেখাতে পারবেন? সুতরাং এইসব বিভ্রান্তিকর উদারতার চর্চা বন্ধ করুন এবং দ্বিমুখী নীতি পরিহার করুন।

পরিশেষ বলব, আমরা চাই এদেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসা আহলেহাদীছ-হানাফী পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহাবস্থানের পরিবেশ অক্ষুণ্ণ থাকুক। দ্বীনী ও সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হোক। আলোচনার মাধ্যমে পরস্পরের বিভেদের দরজাগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হোক।

আমরা বিশ্বাস করি, যদি সত্যিকার অর্থেই আমরা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে জীবন পরিচালনার সর্বসম্মত নীতির উপর ঐক্যবদ্ধ হ’তে পারি এবং রাসূল (ছাঃ) নির্দেশিত ‘মা আনা ‘আলাইহে ওয়া আছহাবী’-এর মূলনীতি সুরক্ষায় নিজেদের জান-মাল উৎসর্গ করতে পারি, তবেই কেবল ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার গাঢ় অন্ধকার থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। আমাদের ঐকান্তিক কামনা এটাই যে, একদিন দেশের সকল হানাফী ও আহলেহাদীছ মসজিদ থেকে একযোগে তাওহীদ ও সুন্নাতের পক্ষে আওয়াজ উঠুক এবং শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে উঠুক। সেটা সম্ভব হ’লেই কেবল মুসলিম উম্মাহর মধ্যে প্রকৃত ঐক্য ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ। আহলেহাদীছ আন্দোলন ও তার সংস্কার প্রচেষ্টার মূল বার্তা এটাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ হানাফী সমাজ কি হকের এই আওয়াজ শুনতে পান? যদি শুনতে না পান, তাহ’লে অন্ততপক্ষে যারা শুনতে পেয়েছেন, তাদের প্রতি ইহসান করুন। সহনশীলতার চর্চা করুন। বৈরিতা ও উস্কানীমূলক কার্যক্রম পরিহার করুন। ফরিদপুরে মসজিদ ধ্বংসের মত বর্বর ও লজ্জাকর ঘটনার প্রেক্ষিতে আমরা আবারও দেশের সকল দল ও মতের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামের নিকট এ ব্যাপারে আন্তরিক পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেদায়েতের পথে অটুট রাখুন এবং যাবতীয় যুলুম-নির্যাতন থেকে হকপন্থীদের রক্ষা করুন- আমীন!



বিষয়সমূহ: মসজিদ
আরও