অহংকার

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 1252 বার পঠিত

আল-কুরআনুল কারীম :

1- إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ قُلُوبُهُمْ مُنْكِرَةٌ وَهُمْ مُسْتَكْبِرُونَ- لَا جَرَمَ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْتَكْبِرِينَ-

(১) ‘তোমাদের উপাস্য মাত্র একজন। অতঃপর যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর হয় সত্যবিমুখ এবং তারা হয় অহংকারী। এটা নিঃসন্দেহ যে, আল্লাহ জানেন যা তারা গোপন করে এবং যা তারা প্রকাশ করে। নিশ্চয়ই তিনি অহংকারীদের পসন্দ করেন না’ (নাহল ১৬/২২-২৩)

2- وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ- وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنْكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ-

(২) ‘আর অহংকারবশে তুমি মানুষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না এবং যমীনে উদ্ধতভাবে চলাফেরা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাদ্ভিম ও অহংকারীকে ভালবাসেন না। তুমি পদ চারণায় মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং তোমার কণ্ঠস্বর নীচু কর। নিশ্চয়ই সবচেয়ে বিকট স্বর হ’ল গাধার কণ্ঠস্বর’ (লোকমান ৩১/১৮-১৯)।

3- وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولًا- كُلُّ ذَلِكَ كَانَ سَيِّئُهُ عِنْدَ رَبِّكَ مَكْرُوهًا-

(৩) ‘পৃথিবীতে দম্ভভরে বিচরণ করো না। নিশ্চয়ই তুমি ভূ-পৃষ্ঠকে বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় কখনো পাহাড় সমান হতে পারবে না। বর্ণিত বিষয়গুলির মধ্যে যেগুলি মন্দ, সেগুলি তোমার প্রতিপালকের নিকট অপসন্দনীয়’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৩৭-৩৮)।

4- تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ- مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ خَيْرٌ مِنْهَا وَمَنْ جَاءَ بِالسَّيِّئَةِ فَلَا يُجْزَى الَّذِينَ عَمِلُوا السَّيِّئَاتِ إِلَّا مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ-

(৪) ‘তবে আখেরাতের এই গৃহ (অর্থাৎ জান্নাত) আমরা প্রস্ত্তত করে রেখেছি ঐসব মুমিনের জন্য, যারা দুনিয়াতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে না এবং বিশৃংখলা কামনা করে না। আর শুভ পরিণাম হ’ল আল্লাহভীরুদের জন্য। যে ব্যক্তি (ক্বিয়ামতের দিন) সৎকর্ম নিয়ে আসবে সে তদপেক্ষা উত্তম ফল পাবে। আর যে ব্যক্তি অসৎকর্ম নিয়ে আসবে, সে তার কর্ম অনুপাতে তার মন্দ কর্মের বদলা পাবে’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩-৮৪)।

হাদীছে নববী :

5- عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ. فَقَالَ رَجُلٌ: إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنًا. قَالَ:إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ. الْكِبَرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ.

(৫) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন ‘ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকেরা চায় যে, তার পোষাক সুন্দর হৌক, তার জুতা জোড়া সুন্দর হৌক। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন। কিন্তু ‘অহংকার’ হ’ল ‘সত্যকে দম্ভের সাথে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা’।[1]

6- وَعَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: يُحْشُرُ الْمُتَكَبِّرُونَ أَمْثَالَ الذَّرِّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فِي صُوَرِ الرِّجَالِ يَغْشَاهُمُ الذُّلُّ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ، يُسَاقُونَ إِلَى سِجْنٍ فِي جَهَنَّمَ يُسَمَّى: بُولَسُ، تَعْلُوهُمْ نَارُ الْأَنْيَارِ، يُسْقَوْنَ مِنْ عُصَارَةِ أَهْلِ النَّارِ طِينَةَ الْخَبَالِ-

(৬) হযরত আমর ইবনু শু‘য়াইব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘অহংকারী ব্যক্তিরা কিয়ামতের দিন উঠবে মানুষের চেহারা নিয়ে পিঁপড়া সদৃশ। সর্বত্র লাঞ্ছনা তাদেরকে বেষ্টন করে রাখবে। অতঃপর তাদের ‘বূলাস’ নামক জাহান্নামের এক কারাগারের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যেখানে লেলিহান অগ্নি তাদেরকে ঢেকে ফেলবে। সেখানে তারা জাহান্নামীদের পোড়া দেহের গলিত পুঁজ-রক্তে পূর্ণ ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ নামক নদী থেকে পান করবে’।[2]

7- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ: الْكِبْرِيَاءُ رِدَائِي، وَالْعَظَمَةُ إِزَارِي، فَمَنْ نَازَعَنِي وَاحِدًا مِنْهُمَا، قَذَفْتُهُ فِي النَّارِ.

(৭) হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, অহংকার হ’ল আমার চাঁদর এবং বড়ত্ব হ’ল আমার লুঙ্গি। যে কেউ এর কোন একটি নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব’।[3]

8- عَنْ عِيَاضِ بْنِ حِمَارٍ الْمُجَاشِعِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ اللَّهَ أَوْحَى إِلَيَّ: أَنْ تَوَاضَعُوا حَتَّى لَا يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ، وَلَا يَبْغِيَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ.

(৮) ইয়ায ইবনু হিমারিল মুজাশিঈ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ আমাকে প্রত্যাদেশ করেছেন যে, তোমরা বিনয়ী হও। তোমাদের কেউ যেন একে অপরের উপর গর্ব না করে এবং একে অপরের উপর ঔদ্ধত্য প্রদর্শন না করে’।[4]

9- عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم... وَأَنْهَاكَ عَنِ الشِّرْكِ وَالْكِبْرِ. قَالَ قُلْتُ أَوَ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ هَذَا الشِّرْكُ قَدْ عَرَفْنَاهُ فَمَا الْكِبْرُ قَالَ أَنْ يَكُونَ لأَحَدِنَا نَعْلاَنِ حَسَنَتَانِ لَهُمَا شِرَاكَانِ حَسَنَانِ قَالَ لاَ. قَالَ هُوَ أَنْ يَكُونَ لأَحَدِنَا حُلَّةٌ يَلْبَسُهَا قَالَ لاَ. قَالَ الْكِبْرُ هُوَ أَنْ يَكُونَ لأَحَدِنَا دَابَّةٌ يَرْكَبُهَا قَالَ لاَ. قَالَ أَفَهُوَ أَنْ يَكُونَ لأَحَدِنَا أَصْحَابٌ يَجْلِسُونَ إِلَيْهِ قَالَ لاَ. قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ فَمَا الْكِبْرُ قَالَ سَفَهُ الْحَقِّ وَغَمْصُ النَّاسِ.

(৯) আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, ...আর আমি তোমাকে নিষেধ করে যাচ্ছি দু’টি বস্ত্ত থেকে : শিরক ও অহংকার। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলা হ’ল, আমরা সুন্দর জুতা পরি, সুন্দর পোষাক পরিধান করি, লোকেরা আমাদের কাছে এসে বসে- এগুলি কি অহংকার হবে? তিনি বললেন, না। বরং অহংকার হ’ল, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা ও মানুষকে হেয় জ্ঞান করা’।[5]

10- وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ثَلَاثٌ مُنْجِيَاتٌ، وَثَلَاثٌ مُهْلِكَاتٌ؟ فَأَمَّا الْمُنْجِيَاتُ: فَتَقْوَى اللَّهِ فِي السِّرِّ وَالْعَلَانِيَةِ، وَالْقَوْلُ بِالْحَقِّ فِي الرِضَا وَالسُّخْطِ، وَالْقَصْدُ فِي الْغِنَى وَالْفَقْرِ. وَأَمَّا الْمُهْلِكَاتُ: فَهَوًى مُتَّبَعٌ، وَشُحٌّ مُطَاعٌ، وَإِعْجَابُ الْمَرْءِ بِنَفْسِهِ، وَهِيَ أَشَدُّهُنَّ.

(১০) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনটি নাজাত দানকারী ও তিনটি ধ্বংসকারী বস্ত্ত থেকে মানুষকে সাবধান করেছেন। নাজাত দানকারী তিনটি বস্ত্ত হল, (১) গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করা। (২) খুশীতে ও অখুশীতে সত্য কথা বলা এবং (৩) সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতার মধ্যবর্তী অবস্থা বেছে নেওয়া। অতঃপর ধ্বংসকারী তিনটি বস্ত্ত হ’ল, (১) প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া (২) লোভের দাস হওয়া এবং (৩) আত্ম অহংকারী হওয়া। তিনি বলেন, এটিই হ’ল সবচেয়ে মারাত্মক’।[6]

মনীষীদের বক্তব্য :

১. আবু ওয়াহাব আল-মারওয়াযী বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারককে প্রশ্ন করলাম, অহংকার কাকে বলে? তিনি বললেন, মানুষকে হেয় জ্ঞান করা।[7]

২. শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহ.) বলেন, ‘অহংকার শিরকের চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা অহংকারী ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্বের বিরুদ্ধে অহংকার করে। আর মুশরিক ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্ব করে এবং সাথে অন্যেরও করে’।[8]

৩. হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহ.) বলেন, সমস্ত পাপের উৎস হ’ল তিনটি- (১) অহংকার, যা ইবলীসের পতন ঘটিয়েছিল। (২) লোভ, যা জান্নাত থেকে আদম-কে বের করে দিয়েছিল। (৩) হিংসা, যা আদম (আঃ)-এর এক সন্তানের বিরুদ্ধে অপর সন্তানকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছিল। যে ব্যক্তি উক্ত তিনটি বস্ত্তর অনিষ্ট হ‘তে বেঁচে থাকতে পারবে সে যাবতীয় অনিষ্ট হ‘তে বাঁচতে পারবে। কেননা কুফরীর মূল উৎস হ’ল ‘অহংকার’। পাপকর্মের উৎস হ’ল ‘লোভ’। আর বিদ্রোহ ও সীমালংঘনের উৎস হ’ল ‘হিংসা’।[9]

সারবস্ত্ত :

১. অহংকার বান্দার জন্য মহান আল্লাহর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির প্রশস্ত রাস্তা অবমুক্ত করে।

২. আল্লাহর স্নেহ ও ভালবাসা থেকে অহংকারী চিরবঞ্চিত হয়। সাধারণ মানুষেরও চরম অপ্রিয়পাত্রে পরিণত হয়।

৩. অহংকার মানুষের আত্মমর্যাদাবোধ ধ্বংস করে এবং বরকতময় জীবনকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়।


[1]. মুসলিম হা/৯১; মিশকাত হা/৫১০৮।

[2].তিরমিযী হা/১৮৬২, ২৪৯২, মিশকাত হা/৩৬৪৩, ৫১১২।

[3]. আবূদাউদ হা/৪০৯০; ইবনু মাজাহ হা/৪১৭৪।

[4]. মুসলিম হা/২৮৬৫; মিশকাত হা/৪৮৯৮।

[5]. আহমাদ হা/৬৫৮৩; ছহীহাহ হা/১৩৪।

[6]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ); সনদ হাসান; মিশকাত হা/৫১২২; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫০।

[7].ঐ।

[8]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ৩য় প্রকাশ ১৯৯৬ খৃঃ) ২/৩১৬ পৃঃ।

[9].ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১৩৯৩/১৯৭৩) ৫৮ পৃঃ।



বিষয়সমূহ: শিষ্টাচার
আরও