ইসলামে নারীর অবস্থান (পূর্বে প্রকাশিতের পর)
কামাল হোসাইন
ভূমিকা : পরহেযগারিতা মানব জীবনের অমূল্য রতন। পরহেযগারিতাহীন জীবন ফলশূন্য বৃক্ষর ন্যায়। মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন সকল কল্যাণ নিহিত রয়েছে পরহেযগারিতার মধ্যে। অতএব সকল কল্যাণের চাবিকাঠির সন্ধান পেতে পরহেযগারিতার চর্চা প্রতিটি মুমিনের একান্ত করণীয়। নিম্নে এ বিষয়ে সবিস্তারে আলোকপাত করা হ’ল।
পরহেযগারিতার সংজ্ঞা :
অভিধানে এর অর্থ হ’ল, التحرج ‘সংকোচ বোধ করা। বলা হয়ে থাকে, وتَوَرَّعَ عن كذا ورعة ورَعاً يَرِعُ وَرِعٌ تحرج বিরত থাকা। কিন্তু শব্দটির মূল অর্থ হ’ল, الكَفّ عن المَحارِمِ ثُمَّ اِسْتَعِيْرُ لِلْكَفِّ عَنِ الْمُبَاحِ وَالْحَلَالِ ‘হারাম থেকে বিরত থাকা, তারপর শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহার করা হলে, তার দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, মুবাহ ও হালাল বস্ত্ত থেকে বিরত থাকা’।[1]
পারিভাষিক অর্থ বিদ্বানগণ বিভিন্নভাবে ব্যক্ত করেছেন। আল্লামা ফুযাইল ইবনু আইয়ায (রহঃ) বলেন, الورع: اجتناب المحارم ‘পরহেযগারিতা হ’ল, নিষিদ্ধ বিষয় হ’তে বিরত থাকা’।[2] আল্লামা ইবরাহীম ইবনু আদহাম (রহঃ) বলেন, اَلْوَرْعُ تَرْكُ كُلَّ شُبْهَةٍ وَتَرْكُ مَا لَا يُعْنِيْكَ هُوَ تَرْكُ الْفُضَلَاتِ ‘পরহেযগারিতা হ’ল, সন্দেযুক্ত বস্ত্ত, অনর্থক কর্মকান্ড ও অতিরঞ্জিত কোন কাজ করা হ’তে বিরত থাকা’।[3]
আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) পরহেযগারিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, اَلْوَرْعُ ةَرْكُ مَا يَخْشٰى ضُرُرَةِ فِي الآخِرَة ‘পরহেযগারিতা হ’ল, যে কাজ করলে আখেরাতের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে, তা পরিহার করা’।[4]
আল্লামা আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনু আলী আল-কাত্তানী (রহঃ) বলেন, اَلْوَرْعُ هُوَمُلَازِمَةُ الْأَدَبِ وَصِيَانَةِ النَّفْسِ ‘পরহেযগারিতা হ’ল, শিষ্টাচার অবলম্বন করা এবং আত্মার হেফাযত করা’।[5]
আল্লামা যুরকানী (রহঃ) বলেন,وَالْوَرْعُ تَرْكُ مَا لَا بَأْسَ بِهِ حَذْرًا مِنَ الْوُقُوْعِ فِيْمَا بِهِ بَأْسٌ ‘পরহেযগারিতা হ’ল, যাতে কোন ক্ষতি নেই তা ছেড়ে দেয়া যাতে করে যে কাজে ক্ষতি রয়েছে তা হ’তে বাঁচা যায়’।[6]
আল্লামা জুরজানী (রহঃ) বলেন,اَلْوَرْعُ اِجْتِنَابُ الشُّبْهَاتِ خَوْفًا مِنَ الْوُقُوْعِ فِي الْمُحْرِمَاتِ ‘পরহেযগারিতা হ’ল, সন্দেহযুক্ত বিষয়সমূহ হ’তে বেঁচে থাকা, যাতে করে হারামে লিপ্ত হ’তে না হয়’।[7]
কোন কোন আলেম পরহেযগারিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, اَلْوَرْعُ كُلُّهُ فِي تَرْكِ مَا يُرِيْبُ إِلٰى مَا لَا يُرِيْبُ ‘যে সকল বস্ত্ত তোমাকে সংশয়ের দিকে নিয়ে যায় তা ছেড়ে যেসব বস্ত্ত তোমাকে সন্দেহ বা সংশয়ের দিকে নিয়ে যায় না, তার দিকে ঝুঁকে পড়াকে পরহেযগারিতা বলে’।[8]
অপর একজন বিজ্ঞ আলেম বলেন, حَقِيْقَتُهُ تَوَقَّي كُلُّ مَا يَحْذُرُ مِنْهُ وَغَايَتُهُ تَدْقِيْقُ اَلنَّظْرُ فِيْ طَهَارَةِ الْإِخْلَاصِ مِنْ شَائِبَةِ الشِّرْكِ الْخَفِيُّ ‘মুত্তাক্বী বা পরহেযগারিতার হাক্বীক্বত হ’ল, যে বস্ত্তকে মানুষ আশঙ্কাযুক্ত মনে করে, তা হ’তে বিরত থাকা। আর তার শেষ গন্তব্য হ’ল, ছোট শিরকের আশঙ্কা হ’তে নিয়তকে পুত-পবিত্র করার প্রতি সূক্ষ্ম দৃষ্টি দেয়া’।[9]
পরহেযগারিতার সংজ্ঞায় আলেমগণের বিভিন্ন ধরনের মতামত পরিলক্ষিত হয়। সকলের মতামতকে একত্র করার লক্ষ্যে আমরা বলব, পরহেযগারিতার চারটি স্তর রয়েছে।
(১) সাধারণ ব্যক্তির পরহেযগারিতা (ورع العدول) : আর তা হ’ল, হারাম বস্ত্ত থেকে বিরত থাকা।
(২) সৎ ব্যক্তিদের পরহেযগারিতা (ورع الصالحين) : যেসব কাজে হারামের সম্ভবনা রয়েছে, তা হ’তে বিরত থাকা।
(৩) মুত্তাক্বীদের পরহেযগারিতা (ورع للتقين) : যেসব কাজে কোন ক্ষতি নেই সেসব কাজকে ক্ষতি হয় এমন কোন কাজে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় ছেড়ে দেয়া।
(৪) সত্যবাদীদের পরহেযগারিতা (ورع الصديقين) : এমন কর্মকান্ড হ’তে বিরত থাকা, যাতে বিন্দু পরিমাণও ক্ষতি নেই। কিন্তু যে আশঙ্কা করে না জানি কাজটি ‘গাইরুল্লাহ্’ অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উদ্দেশ্যে হয়ে যায় অথবা না জানি কাজটি অপসন্দনীয় বা অপরাধের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ আশঙ্কা থেকে সে এ ধরনের কাজ করা হ’তে বিরত থাকে।
উপরে যে চারটি স্তরের কথা আলোচনা করা হয়েছে, তার কোন না কোন একটির ভিত্তিতে আলেমগণ পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারির সংজ্ঞা তুলে ধরেছেন।
বিষয়ের গুরুত্ব :
ত্বাউস (রহঃ) বলেন, مَثَلُ الاِيْمَانِ كَشَجَرَةٍ فَاَصْلُهَا الشَّهَادَةُ وَسَاقَهَا وَوَرَقَهَا كَذَا وَثَمَرُهَا اَلْوَرْعُ وَلَاخَيْرَ فِي شَجَرَةٍ لَا ثَمَرَ لَهَا وَلَا خَيْرَ فِي إِنْسَانٍ لَا وَرْعَ لَهُ ‘ঈমানের দৃষ্টান্ত হ’ল, বৃক্ষের মত, যার মূল কান্ড ও ডাল-পালা হ’ল, এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল। আর ঈমান বৃক্ষের ফল হ’ল, পরহেযগারিতা। যে বৃক্ষের ফল নেই তার মধ্যে কোন উপকারিতা নেই। আর যে ব্যক্তির মধ্যে পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারিতা নেই তার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই’।[10]
ক্বাসেম ইবনু ওছমান (রহঃ) বলেন, اَلْوَرْعُ، عِمَادُ الدِّيْنِ ‘পরহেযগারিতা হ’ল ঈমানের খুঁটি’।[11]
আসল ইবাদত হ’ল, পরহেযগারিতা অর্জন করা। হারেছ ইবনু আসাদ আল-মুহাসিবী (রহঃ) বলেন, أَصْلُ الطَّاعَةِ اَلْوَرْعُ ‘ইবাদতের মূল হ’ল, পরহেযগারিতা অর্জন করা।[12] ক্বাসেম আল-জু‘ঈ (রহঃ) বলেন, أَصْلُ الدِّيْنِ اَلْوَرْعُ দ্বীনের মূল হ’ল, পরহেযগারিতা অর্জন করা।[13] আর পরহেযগারিতা হ’ল, একজন বান্দার যোগ্যতার আসল প্রমাণ।
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) তারা উভয়ে বলেন, لَا تَنْظُرُوْا إِلَى صَلَاةِ أَحَدٍ وَلَا صِيَامِهِ وانْظُرُوْا إِلٰى صِدْقِ حَدِيْثِهِ إِذَا حَدَّثَ وَ إِلَى أَمَانَتِهِ إِذَا اِئْتَمَنَ و إِلَى وَرْعِهِ إِذَا أَشْفٰى ‘তোমরা কোন মানুষের ছালাত ও ছওমের দিকে দেখে তার পরহেযগারিতা বিচার করবে না। যখন সে কথা বলে তখন সত্য বলে কিনা তা দেখবে, যখন তার নিকট আমানত রাখা হয়, তখন তার আমানতদারিতার প্রতি লক্ষ্য করবে এবং যখন সে অসুস্থ হয়, তখন তার পরহেযগারিতার প্রতি লক্ষ্য করবে’।[14]
সালাফে ছালেহীনগণ পরহেযগারিতা কিভাবে অর্জন করতে হয়, তা শিখতেন। যাহহাক (রহঃ) বলেন,لَقَدْ رَأَيْتَنَا وَمَا يَتَعَلَّمَ بَعْضُنَا مِنْ بَعْضٍ إِلَّا الْوَرْعَ ‘আমাদের যুগে আমরা একে অপরের নিকটে পরহেযগারিতা শিখতাম’।[15] তিনি আরো বলেন, أَدْرَكْنَا أَصْحَابُنَا وَمَا يَتَعَلَّمُوْنَ إِلَّا الْوَرْعَ ‘আমরা আমাদের সাথীদের দেখতাম তারা কিভাবে পরহেযগারিতা অর্জন করা যায় তা শিখতো’।[16]
পরহেযগারিতার গুরুত্ব ও ফযীলত :
মহান আল্লাহর মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণ করার হিকমত অসংখ্য ও অগণিত। এসব হিকমতের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। তবে হিকমত সমূহের অন্যতম হিকমত হ’ল, মানুষকে পরহেযগার বা মুত্তাক্বী বানানো অর্থাৎ মানুষ যাতে তাক্বওয়া, পরহেযগারী বা দ্বীনদারীর গুণে গুণান্বিত হ’তে পারে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ অর্জনে সক্ষম হয়, সেজন্যই কুরআন অবতীর্ণ করা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَكَذَلِكَ أَنْزَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا وَصَرَّفْنَا فِيهِ مِنَ الْوَعِيدِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ أَوْ يُحْدِثُ لَهُمْ ذِكْرًا ‘এভাবে আমরা আরবী ভাষায় কুরআন নাযিল করেছি এবং তাতে বিশদভাবে সতর্কবাণী বিবৃত করেছি, যাতে তারা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে (অর্থাৎ আল্লাহভীরু হয়) অথবা তাদের জন্য এটা উপদেশ হয়’ (ত্বোয়াহা ২০/১১৩)।
মহান আল্লাহ কুরআনুল কারীমে পরহেযগার লোকদের সফলতা অর্জনের একাধিক দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। যাতে তারা তাদের প্রশংসনীয় অবস্থার উপর অবিচল থাকে। মহান আল্লাহ বলেন,أَفَلَمْ يَهْدِ لَهُمْ كَمْ أَهْلَكْنَا قَبْلَهُمْ مِنَ الْقُرُونِ يَمْشُونَ فِي مَسَاكِنِهِمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِأُولِي النُّهَى ‘এটা কি তাদের সুপথ দেখালো না যে, তাদের পূর্বেকার বহু সম্প্রদায়কে আমরা ধ্বংস করেছি। যাদের বাসভূমিতে এরা বিচরণ করে। নিশ্চয়ই এতে বিবেকবানদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে’ (তেবায়াহা ২০/১২৮)।
ক্বাতাদাহ (রহঃ) বলেন, أُوْلُوْ النُّهٰى هُمْ أَهْلُ الْوَرْعِ ‘জ্ঞানী তারাই যারা পরহেযগার’।[17] অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যিকির’ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, পরহেযগারিতা।[18]
মানুষ যাতে পরহেযগার হয়, সেজন্য মহান আল্লাহ তাঁর স্বীয় কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ করেন এবং কুরআনে বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন। এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, পরহেযগারিতা অর্জন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ যরূরী। আসরা যে পরহেযগারিতাকে বা দ্বীনদারীকে ওয়াজিব বলছি তা হ’ল হারাম বস্ত্তসমূহকে ছেড়ে দেয়া। আর সর্বশেষ ফলাফল হ’ল, সেদিকে নিয়োজিত থাকা।
পরহেযগারিতা অর্জনের ফযীলত :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিভিন্ন হাদীছে পরহেযগারিতা অর্জন করার অনেক ফযীলত বর্ণনা করেছেন। এখানে কিছু ফযীলত তুলে ধরা হ’ল। যেমন-
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَا أَبَا هُرَيْرَةَ كُنْ وَرِعًا تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ ‘হে আবু হুরায়রা! তুমি পরহেযগার হও, তাহ’লে তুমি সকল মানুষের চেয়ে বড় ইবাদতকারীতে পরিণত হবে’।[19]
সা‘দ বিন আবী ওয়াক্বাছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, خَيْرُ دِيْنِكُمُ الْوَرَعُ‘তোমাদের সর্বোত্তম দ্বীন হ’ল পরহেযগারিতা’।[20] হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হ’তেও অনুরূপ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে’।[21]
আমর ইবনু ক্বায়েস আল-মালায়ী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَلَاكُ دِيْنِكُمُ الوَرَعُ তোমাদের দ্বীনের রাজত্ব হ’ল, পরহেযগারিতা’।[22]
আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘مَا أَعْجَبَ رَسُوْلَ اللهِ شَيْءٌ مِنَ الدُّنْيَا وَلَا اَعْجَبَهُ مِنْهَا إِلَّا وَرْعًا ’ ‘দুনিয়ার কোন বস্ত্ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মুগ্ধ করতে পারেনি। পরহেযগারিতা ব্যতীত। আর কোন কিছুই তাঁকে সে পরিমাণ আনন্দ দিতে পারেনি যে পরিমাণ আনন্দ তাঁকে পরহেযগারিতা দিয়েছে’।[23]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যেভাবে পরহেযগারিতা অবলম্বনের গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অনুরূপভাবে আমাদের সালাফে ছালেহীনগণও পরহেযগারিতা অবলম্বনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন এবং তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তাদের কথা ও কর্মগুলো নিমেণ বর্ণনা করা হ’ল-
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, إِنَّ الدِّيْنَ لَيْسَ بِالطَّنْطَنَةِ مِنْ آخِرِ اللَّيْلِ وَلَكِنَّ الدِّيْنَ الْوَرَعُ ‘শেষ রাতে নড়াচড়া করা অর্থাৎ তাহাজ্জুদ পড়া বা যিকির আযকার করা প্রকৃত দ্বীন নয়, বরং প্রকৃত দ্বীন হ’ল পরহেযগারিতা অবলম্বন করা’।[24]
হাসান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,اَفْضَلُ الْعِبَادَةِ اَلتَّفَكَّرُ وَالْوَرْعُ ‘সর্বোত্তম ইবাদত হ’ল, সর্বদা দ্বীনী চিন্তা-ভাবনা রাখা এবং পরহেযগারিতা অবলম্বন করা’।[25] তিনি আরো বলেন, ‘اَلْحِكْمَةُ اَلْوَرْعُ ‘হিকমত বা বুদ্ধিমত্তা হ’ল, দ্বীনদারী বা পরহেযগারিতা’।[26]
সা‘ঈদ ইবনু মুসাইয়্যিব (রহঃ) বলেন, اَلْعِبَادَةُ اَلْوَرْعُ عَمَّا حَرَّمَ اللهُ وَالتَّفَكَّرُ فِيْ أَمَرَ اللهُ ‘ইবাদত হ’ল, আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন, তা হ’তে বিরত থাকা এবং আললাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের চিন্তা-ভাবনা করা’।[27]
পরহেযগারিতা অর্জন করা সফলতার কারণ :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى ‘অবশ্যই সফলতা অর্জন করবে যে আত্মশুদ্ধি করবে’ (আ‘লা ৮৭/১৪)। ক্বাতাদাহ (রহঃ) বলেন, ‘মুত্তাক্বী হিসাবে আমল করবে’।[28]
মুত্বার্রিফ ইবনু শিখি্খর (রহঃ) বলেন, خَيْرُ دِيْنِكُمُ الْوَرَعُ ‘তোমাদের সর্বোত্তম দ্বীন হ’ল পরহেগারিতা।[29]
তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা দু’জন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করলে দেখবে, একজন অধিক ছালাত ও ছিয়াম আদায় করে এবং বেশী বেশী আল্লাহর রাস্তায় দান করে। আর অপর ব্যক্তি যে বেশি বেশি ছালাত ও ছিয়াম আদায় করে না এবং বেশী বেশী ছাদাক্বাহও করে না। সে তার থেকে উত্তম। তাকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, তা কিভাবে সম্ভব? তখন সে বলল, লোকটি তার অপর ভাইয়ের তুলনায় আল্লাহ তা‘আলা যেসব বিষয়ে নিষেধ করেছেন, সে বিষয়ে অধিক সতর্ক ও পরহেযগার’।[30]
ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘সর্বোত্তম আমল হ’ল পরহেযগারিতা।[31]
পরহেযগারিতার সাথে শরী‘আতের জ্ঞান :
একজন জ্ঞানী ব্যক্তির পরহেযগারিতা সাধারণ মানুষের পরহেযগারিতার মত নয়। অর্থাৎ যারা জ্ঞানী তাদের তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা অধিক শক্তিশালী হয়ে থাকে। কারণ তাদের তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা দ্বারা তারা যে উপকার লাভ করে অন্যরা তা লাভ করতে সক্ষম নয়। একজন কবি বলেন,وَإِنَّ فَقِيْهًا وَاحِدًا مُتَوَرِّعًا + أَشَدُّ عَلَى الشَّيْطَانِ مِنْ أَلْفِ عَابِدِ ‘নিশ্চয়ই একজন দ্বীনদার বা পরহেযগার জ্ঞানী শয়তানের জন্য এক হাযার ইবাদতকারী হ’তে অধিক শক্তিশালী’।[32]
একারণেই আলেমগণ শর্তারোপ করেন, একজন বিচারক যিনি মানুষের মধ্যে বিচার ফায়সালা করবে, তাকে অবশ্যই শরী‘আতের বিধান সম্পর্কে জ্ঞানী হ’তে হবে। সে যদি শরী‘আতের বিষয়ে জ্ঞানী না হয়, তাহলে সে কিভাবে ন্যায়বিচার করবে। কারণ ন্যায়বিচারের উৎস হ’ল একমাত্র কুরআন ও সুন্নাহ তথা হাদীছ। সুতরাং যারা বিচারক হবে তাদের অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে ইলম বা জ্ঞান থাকতে হবে। অন্যথায় তাদের দ্বারা ন্যায়বিচারের আশা করা আকাশ কুসুম সমতুল্য। একারণেই বলা যায় যে, যারা মানুষের মাঝে বিচার ফায়সালা করবে তাদের অবশ্যই পরহেযগার বা দ্বীনদার ও জ্ঞানী হ’তে হবে।[33]
পরহেযগারিতার হাক্বীক্বত :
ক. সন্দেহযুক্ত বিষয়গুলো ছেড়ে দেয়া :
নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই হালালও স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট। আর এ দু’য়ের মাঝে রয়েছে বহু সন্দেহজনক বিষয়, যা অনেক মানুষই জানে না। যে ব্যক্তি সেই সন্দেহজনক বিষয়সমূহ হ’তে বেঁচে থাকবে, সে তার দ্বীন ও মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে। আর যে সন্দেহজনক বিষয়সমূহে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তার উদাহরণ সেই রাখালের ন্যায়, সে তার পশু বাদশাহর সংরক্ষিত চারণভূমির আশেপাশে চরায়, অচিরেই সেগুলোর সেখানে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জেনে রাখ যে, প্রত্যেক বাদশাহরই একটি সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে। আরো জেনে রেখ যে, আল্লাহর যমীনে তাঁর সংরক্ষিত এলাকা হ’ল তাঁর নিষিদ্ধ কাজসমূহ। জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরো আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখ, সে গোশেতের টুকরোটি হ’ল অন্তর’।[34]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الْإِثْمُ مَا حَاكَ فِي الْقَلْبِ وَتَرَدَّدَ فِي الصَّدْرِ ‘গুনাহ হ’ল, যা তোমার অন্তরে সংকোচ মনে হয় এবং মনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে’।[35]
হাসান ইবনু আবী সিনান (রহঃ) বলেন,هَلِ الْوَرْعُ اِلَّا إِذَا رَابَكَ شَيٌّء تَرَكْتَهُ ‘পরহেযগারিতা হ’ল, যখন কোন কিছু তোমাকে সন্দেহে ফেলে, তাকে তুমি ছেড়ে দিবে। এটাই হ’ল, তোমার পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারি।[36]
খ. কতক মুবাহ ও বা কিছু হালাল বস্ত্ত থেকেও বিরত থাকা :
ইবনু তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেন, পরহেযগারিতা হ’ল, যেসব কর্ম তোমার ক্ষতির কারণ হয়, তা হ’তে বিরত থাকা। সুতরাং বাহ্যত হালাল মনে হলেও সন্দেহযুক্ত বস্ত্তসমূহ হ’তে বিরত থাকা তাকওয়ার পরিচয়। কেননা সন্দেহযুক্ত বস্ত্তও অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয়। যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত কর্ম হ’তে বিরত থাকে, সে তার দ্বীন, ইযয্ত ও সম্ভ্রমের সংরক্ষণ করল। আর যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত কর্মে লিপ্ত হ’ল, সে অবশ্যই হারামে পতিত হ’ল। যেমন- একজন রাখাল সে ফসলের ক্ষেতের পাশে ছাগল চরাচ্ছিল, তার জন্য আশঙ্কা থাকে, তার ছাগলটি ফসলে মুখ দিবে এবং ফসলের ক্ষতি করবে।
সুতরাং, একজন মুসলিমের কর্তব্য হ’ল, আল্লাহ তা‘আলা যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তার নিকটবর্তী হওয়া থেকে বিরত থাকা। কারণ, তার নিকট যাওয়াতে তোমাদের জন্য হারামে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, تِلْكَ حُدُودُ اللهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا‘এসব আল্লাহর বিধান, কাজেই এগুলোর নিকটবর্তী হয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭)। তিনি আরো বলেন, تِلْكَ حُدُودُ اللهِ فَلَا تَعْتَدُوهَا‘এসব আল্লাহর বিধান, কাজেই এগুলোকে লঙ্ঘন করো না’ (বাক্বারাহ ২/২২৯)।
আল্লাহ তা‘আলার সীমানা দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, হালালের শেষ প্রান্ত যার নিকট যেতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে নিষেধ করেছেন। আর আল্লাহ তা‘আলার সীমারেখার অপর অর্থ, হারামের প্রাথমিক অবস্থা। তখন অর্থ হবে, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য যা হালাল বা বৈধ করেছেন, তা অতিক্রম করো না। আর তোমাদের জন্য যা হারাম করেছেন, তার কাছেও তোমরা যেওনা। সুতরাং পরহেযগারিতা হ’ল, আল্লাহ তা‘আলার বিধানের সীমারেখার কাছে যাওয়া ও অতিক্রম করা হ’তে নিরাপদ থাকা। হালাল বিষয়ে সীমা অতিক্রম করা দ্বারা কবীরা গুনাহ ও কঠিন হারামে পতিত হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
সালাফে ছালেহীন অনেক সময় হারাম বা নিষিদ্ধ কর্মে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় বিভিন্ন ধরনের মুবাহ বা বৈধ কর্ম হ’তেও বিরত থাকতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন,أِنِّي لَاَحَبُّ اَنْ اَدَعُ بَيْنِيْ وَبَيْنَ الْحَرَامِ سُتْرَةً مِنَ الْحَلَالِ وَلَا اَحْرَمُهَا ‘আমি আমার মাঝে এবং হারামের মাঝে হালাল দ্বারা একটি প্রাচীর তৈরী করতে চাই, যাকে আমি হারাম মনে করি না’।
‘আল্লামা সুফিয়ান ইবনু ওআ‘ইনা (রহঃ) বলেন, لَا يُصِيْبُ الْعَبْدُ حَقِيْقَةَ الْاِيْمَانِ حَتَّى يَجْعَلَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْحَرَامِ حَاجِزًا مِنْ اَلْحَلَالِ وَحَتَّى يَدَعَ الْاِثْمَ وَمَا تَشَابَهَ مِنْهُ ‘একজন বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানের হাক্বীক্বত উপভোগ করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার মাঝে এবং হারামের মাঝে হালাল দ্বারা প্রতিরোধ গড়ে না তুলে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত সে গুনাহ ও গুনাহের সাদৃশ্য বিষয়গুলো না ছাড়বে ততক্ষণ পর্যন্ত সে পরিপূর্ণ ঈমানদার হ’তে পারবে না’।[37]
মাইমুন ইবনে মিহরান (রহঃ) বলেন, لَا يَسْلِمُ لِلرَّجُلِ اَلْحَلَالَ حَتَّى يَجْعَلَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْحَرَامِ حَاجِزًا مِنَ الْحَلَالِ ‘একজন মানুষ যতদিন পর্যন্ত তার মাঝে ও হারামের মাঝে হালাল দ্বারা প্রতিরোধ গড়ে না তুলে, ততদিন পর্যন্ত সে ঈমানদার হ’তে পারবে না’।[38]
কতিপয় সালাফে ছালেহীন বলেন, একজন বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত তাক্বওয়ার সাধ গ্রহণ করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে ক্ষতি নেই এমন বস্ত্তকে যে বস্ত্ততে ক্ষতি রয়েছে তার থেকে বাঁচার জন্য পরিহার করবে না।[39]
কতিপয় মনীষী বলেন, ‘আমরা হালাল বা বৈধ বিষয়ের সত্তরটি বিষয় ছেড়ে দিতাম যাতে আমরা হারাম থেকে বাঁচতে পারি’।[40]
মনে রাখা ভাল যে, কোন কোন বৈধ বিষয় রয়েছে যেগুলো ছেড়ে দেয়া বৈধ নয়। কারণ এসব বৈধ কাজ ছেড়ে দেয়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত থেকে বিরত থাকার নামান্তর। যেমন- বিবাহ করা ছেড়ে দেয়া, ঘুম যাওয়া ও খাদ্য গ্রহণ ছেড়ে দেয়া। কেননা এগুলো সবই হ’ল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত। রাসূল (ছাঃ) বিবাহ করেছেন, তিনি ঘুমাতেন এবং তিনি খাদ্য গ্রহণ করতেন।
অনুরূপভাবে কোন কোন মুবাহ বা বৈধ কাজ রয়েছে যেগুলো নিয়ত ভাল হওয়ার কারণে ইবাদতে পরিণত হয়। যেমন- কোন ব্যক্তি খাবার গ্রহণ করল এবং নিয়ত করল, আমি খাদ্য গ্রহণ করে যে শক্তি অর্জন করব তা আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে ব্যয় করব। অথবা কোন ব্যক্তি তার স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে খেল-তামাশা করার নিয়ত করল, সে তার প্রবৃত্তির চাহিদা ও মানবিক চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যেই তা করছে, তাহ’লে তা দ্বারা সে অবশ্যই ছওয়াব পাবে এবং তার কর্মগুলো ইবাদতে পরিণত হবে। আর যে ব্যক্তি পরহেযগারিতা মনে করে বিবাহ করা ও স্ত্রী-সন্তানের সাথে খেল-তামাশা ইত্যাদি ছেড়ে দেয়, তাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এগুলো ছেড়ে দেয়া কোন ইবাদত নয়। বরং এগুলো হ’ল, বৈরাগ্যতা। আর তাদের আদর যত্ন করা হ’তে বিরত থাকার মধ্যে কোন পরহেযগারিতা নেই।
পরহেযগারিতার ব্যাপকতা :
মানুষ পরহেযগারিতার বা দ্বীনদারির বিবেচনায় চার শ্রেণীতে বিভক্ত। ইবরাহীম বিন আদহাম (রহঃ) বলেন, ‘পরহেযগারিতার বিবেচনায় মানুষ চার প্রকার। প্রথম শ্রেণীর মানুষ যারা কম ও বেশী উভয় প্রকার বস্ত্ত থেকে পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারী অবলম্বন করে। দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা শুধু কম বস্ত্ত থেকে বেঁচে থাকে। কিন্তু যখন তাদের সামনে বেশী বা অধিক সংখ্যার কোন বস্ত্ত আসে তখন তা থেকে তারা বেঁচে থাকে না। তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ, যারা অধিক বস্ত্ত থেকে বেঁচে থাকে, কিন্তু অল্প বস্ত্তকে তারা ছোট বা তুচ্ছ মনে করায়, তা থেকে বেঁচে থাকে না। চতুর্থ শ্রেণীর মানুষ, যারা কম ও বেশি কোন কিছু থেকে তারা তাদের নিজেদের বিরত রাখে না’।[41]
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক (রহঃ) বলেন, لَوْ أَنَّ رَجُلًا اِتَّقٰى مِائَةَ شَيٍّء وَلَمْ يَتَوَرَّعْ عَنْ شَيٍّء وَاَحَدٍ لَمْ يَكُنْ وَرْعًا যদি কোন ব্যক্তি একশটি বস্ত্ত হ’তে নিজেকে বিরত রাখল, কিন্তু একটি হ’তে সে নিজেকে বিরত রাখতে সক্ষম হ’ল না, তাহ’লে তাকে পরহেযগার বলা যাবে না’।[42]
একজন ব্যক্তিকে পরহেযগার বা মুত্তাক্বী বলে আখ্যায়িত করতে হলে, তার জন্য আবশ্যক হ’ল, সব অঙ্গ-প্রতঙ্গের হেফাযত করা। অঙ্গ-প্রতঙ্গ যাতে কোন প্রকার অপরাধে জড়িত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পরহেযগার তার অন্তর, জিহবা, হাত, পা, চোখ ও কান সব কিছুকে পরহেযগার বানাবে; অন্যথায় তাকে পরহেযগার বলা যাবে না। সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি তার কোন এক অঙ্গকে হেফাযত করল, আর বাকী অঙ্গ-প্রতঙ্গকে হেফাযত করল না, তাহলে তাকে পরহেযগার বলা যাবে না। যেমন কোন ব্যক্তি অন্তরকে বাঁচিয়ে রাখল, কিন্তু অঙ্গ-প্রতঙ্গকে অন্যায়-অনাচার বা অপরাধ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারল না, তাহলে তাকে পরহেযগার বা দ্বীনদার বলা যাবে না। অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি তার জিহবাকে হেফাযত করল, কিন্তু তার অন্যান্য অঙ্গকে যেমন চোখ, কান, হাত,পা ইত্যাদিকে সে হেফাযত করতে পারল না, তাহলে তাকে পরহেযগার বা দ্বীনদার বলা যাবে না।
হাসান ইবনে ছালেহ (রহঃ) বলেন,فَتَشْنَا اَلْوَرْعُ فَلَمْ نَجِدْهُ فِي شَيٍّء أَقَلُّ مِنْهُ فِي الْلِسٰانِ’ ‘আমরা পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারীর অনুসন্ধান করে দেখতে পাই যে, জিহবা ব্যতীত আর কিছুতে তা এত দুর্বল নয়। অর্থাৎ জিহবাতেই পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারির পরিমাণ নিহিত’।[43] ফুযাইল ইবনে আয়ায (রহঃ) বলেন, أَشَدُّ الْوَرْعِ فِي الْلِسٰانِ ‘সব চেয়ে বড় কঠিন পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারী হ’ল, জিহবা বা যবানে’।[44]
জুনাঈদ (রহঃ) বলেন, اَلْوَرْعُ فِي الْكَلَامِ أَشَدُّ مِنْهُ فِي الِاِكْتِسَابِ ‘কথার মধ্যে তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা অবলম্বন করা অন্যান্য অঙ্গের বিষয়ে তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা অবলম্বন করা হ’তে কঠিন’।[45]الاكتساب অর্থাৎ অঙ্গ-প্রতঙ্গ। আর তা দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল অঙ্গ-প্রতঙ্গের আমল।
ইসহাক্ব ইবনু খালফ (রহঃ) বলেন, اَلْوَرْعُ فِي الْمَنْطِقِ أَشَدُّ مِنْهُ فِي الذَّهْبِ وَالْفِضَّةِ ‘কথার মধ্যে পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারীতা অবলম্বন করা সোনা ও রূপা বিষয়ে পরহেযগারিতা অবলম্বন করা হ’তেও কঠিন’।[46]
(চলবে)
মুহাম্মাদ হাফীযুর রহমান
[লেখক : শিক্ষক, ইক্বরা ইসলামিয়া মডেল মাদরাসা, বি-বাড়িয়া]।
[1]. লিসানুল আরব ৮/৩৮৮পৃঃ।
[2]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৮/৯১।
[3]. মাদারিজুস সালেকীন ২/২১পৃঃ।
[4]. আল-ফাওয়ায়েদ ১১৮পৃঃ।
[5]. তারীখে দিমাশক ৫৪/২৫৭পৃঃ।
[6]. মানাহি’লুল ‘ইরফান ২/৪২পৃঃ।
[7]. আত-তা‘রীফাত ১/৩২৫, হা/১৬১২।
[8]. ফাইযুল কাবদীর ৩/৫২৯পৃঃ, হা/৪২১৪।
[9]. ফাইযুল ক্বাদীর ৩/৫৭৫পৃঃ।
[10]. আব্দুল্লাহ ইবনু আহমাদ, আস-সুন্নাহ ১/৩১৬, হা/৬৩৫ সনদ ছহীহ।
[11]. তারীখে দিমাশক ৪৯/১২২।
[12]. হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/৭৬।
[13]. তারীখে দিমাশক ৪৯/১২৩।
[14]. শু‘আবুল ঈমান হা/৫২৮১, ৫২৭৮।
[15]. ইবনু আবীদ্দুনিয়া, আল-ওয়ার‘ঊ হা/২৭।
[16]. প্রাগুক্ত, হা/২৬।
[17]. তাফসীরে ত্বাবারী ৮/৪৭৫।
[18]. তাফসীরে ত্বাবারী ৮/৪৬৪।
[19]. ইবনু মাজাহ হা/৪২১৭, হাদীছ ছহীহ।
[20]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৩১৪; যাহাবী হাদীছটি ছহীহ বলেছেন।
[21]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৩১৭; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৩৯৬০, আলবানী (রহঃ) হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[22]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৬১১৫; ইবনু আবীদ্দুনিয়া, আল-ওয়ার‘ঊ হা/১৪।
[23]. ত্বাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৫৩৫।
[24]. ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহদ, ১২৫পৃঃ।
[25]. ইবনু আবীদ্দুনিয়া, আল-ওয়ার‘ঊ ১/৫৩, হা/৩৭।
[26]. তাফসীরে বাগাবী, ১/৩৩৪; তাফসীরে কুরতুবী, ৩/৩১৩।
[27]. তাফসীরে কুরতুবী ৪/৩১৪।
[28]. তাফসীরে ত্বাবারী ১২/৫৪৬।
[29]. তাফসীরে ত্বাবারী ২৩/২৪৭।
[30]. তাফসীরে ত্বাবারী ২৩/২৪৭; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৫৪৯১।
[31]. শু‘আবুল ঈমান হা/৮১৪৯।
[32]. নুশরাতি আত-তা‘রীফ ১/১৯৯।
[33]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১৫৪।
[34]. বুখারী হা/৫২; মুসলিম হা/১৫৯৯।
[35]. আহমাদ হা/১৮০৩০ আলবানী (রহঃ) হাদীছটিকে হাসান বলেছেন।
[36]. ইবনু আবীদ্দুনিয়া, আল-ওয়ার‘ঊ হা/৪৬।
[37]. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, আল-ওয়ার‘ঊ ৫০পৃঃ।
[38]. হি’লয়াতুল আউলিয়া ৪/৮৪।
[39]. মাদারিজুস সালেকীন ২/২২পৃঃ।
[40]. মাদারিজুস সালেকীন ২/২২পৃঃ।
[41]. তারীখু বাগদাদ ৬/১৯৯পৃঃ।
[42]. হি’লয়াতুল আউলিয়া ৮/১৬৭পৃঃ।
[43]. হি’লয়াতুল আউলিয়া ৭/৩২৯পৃঃ।
[44]. হি’লয়াতুল আউলিয়া ৮/৯১পৃঃ।
[45]. হি’লয়াতুল আউলিয়া ১০/২৬৯পৃঃ।
[46]. তারীখে দিমাশক ৮/২০৫।