ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সমূহ
এ. এইচ. এম. রায়হানুল ইসলাম
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 1396 বার পঠিত
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। আল্লাহ প্রদত্ত এই মৌলিক অধিকার খর্ব করা উচিত নয়। এরপরেও নশ্বর এই দুনিয়ায় মানুষের জীবন চরাচরের ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে স্বাধীনতার মধ্যেও সীমারেখা অঙ্কন করা হয়েছে। যখন মানুষ সেই সীমারেখা অতিক্রম করে ঠিক তখনই বিশৃঙ্খলা ঘটে। সম্প্রতিক একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তথা বাকস্বাধীনতা শব্দটি পুনরায় পৃথিবী জুড়ে আলোচিত ও সমালোচিত হচ্ছে।
ঘটনার সূত্রপাত ইউরোপ মহাদেশের অত্যাধুনিক দেশ ফ্রান্সের চমৎকার দৃষ্টিনন্দন শহর প্যারিস নগরীর এক স্কুলে। স্যামুয়েল প্যাটি (৪৭) নামক জনৈক ‘ভূগোল ও ইতিহাসের’ শিক্ষক বাক-স্বাধীনতা বিষয়ে ১২-১৪ বছরের শিক্ষার্থীদের পড়াতে গিয়ে ফ্রান্সের স্যাটারিকাল নিউজ পেপার শার্লি হেবদোতে প্রকাশিত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ব্যাঙ্গাত্মক ছবি দেখাচ্ছিলেন। এ ঘটনার দিন দশেক পরে গত ১৬ই অক্টোবর ঐ শিক্ষককে চেচনিয়ান বংশোদ্ভূত ১৮ বছরের এক তরুণ গলা কেটে হত্যা করে।
পুলিশ ঐ তরুণের পিছু ধাওয়া করে তাকেও গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার জেরে ফরাসীরা স্যামুয়েল প্যাটির স্বপক্ষে বাকস্বাধীনতার প্লাকার্ড হাতে রাস্তায় বিক্ষোভ করে। এ ব্যাপারে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো বলেছেন, He taught students about freedom of expression freedom to believe or not believe. It was a cowardly attack ‘তিনি (শিক্ষক) স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের বিষয়টি ছাত্রদের শিক্ষা দান করছিলেন। তিনি শিক্ষা দান করছিলেন বিশ্বাস করা ও না করার স্বাধীনতা বিষয়ে। এই হত্যার কাজটি অত্যন্ত কাপুরুষোচিত’।[1]
ঘটনা এখানেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারত, কিন্তু ফরাসী প্রধানমন্ত্রী ঐ শিক্ষককে দেশের সর্বোচ্চ পদকে ভূষিত করে একটি অনুষ্ঠানে তথাকথিত বাকস্বাধীনতার নামে আবেগের আতিশয্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ব্যাঙ্গচিত্র বড় বড় ভবনের দেওয়ালে আলোকরশ্নির মাধ্যমে প্রদর্শনের আদেশ দেন। শুধু তাই নয় ইসলাম সংকটে রয়েছে এবং ব্যাঙ্গচিত্র প্রচার বন্ধ করবে না বলেও মন্তব্য করেন। মুহূর্তের মধ্যে এ খবর মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে ২০০ কোটি মুসলিমের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। বাকস্বাধীনতার অপব্যবহারের প্রতিবাদে দেশে দেশে রাস্তায় নামে মুসলিম জনতার ঢল। প্রতিবাদস্থলগুলোতে আল্লাহু আকবার ধ্বনি, ফরাসী প্রধানমন্ত্রীকে নিন্দা ও ফরাসী পণ্য বয়কটের হিড়িক পড়ে যায়। এতে বিচলিত হয়ে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সুর পাল্টে যায়। কাতার ভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ব্যাঙ্গচিত্র প্রদর্শন করা ফ্রান্সের কোন সরকারী প্রকল্প বা উদ্যোগ ছিল না। এটি একটি বেসরকারী স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সংবাদপত্রের কাজ। পত্রিকাগুলো সরকারের অনুগত নয়। কার্টুন এঁকে রাসূল (ছাঃ)-এর অবমাননা করায় মুসলমানদের অনুভূতি কেমন হ’তে পারে তা আমি বুঝতে পারি’।[2]২০১৫ সালেও শার্লি হেবদো রাসূল (ছাঃ)-এর ব্যাঙ্গচিত্র অঙ্কন করে। তাহ’লে কোন বেসরকারী স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সংবাদপত্র হলেই কী কোন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতায় আঘাত করার লাইসেন্স পেয়ে যায়? কোন ধর্মের নবী, প্রধান পুরুষ কিংবা সম্মানীত ব্যক্তিকে অপমান, হেয়-তুচ্ছ করা যদি বাকস্বাধীনতা হয়ে থাকে তাহ’লে বাকসন্ত্রাসের সংজ্ঞা কি? মানুষ হিসাবে প্রত্যেকের বাকস্বাধীনতা থাকবে, কিন্তু তার কোন সীমারেখা থাকবে না? খোদ কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘বাকস্বাধীনতা লাগামহীন নয়, সব ধর্মের প্রতি সম্মান জানানো উচিত’।[3]
স্মরণযোগ্য যে, এই ফ্রান্স আলজেরীয় মুসলমানদের রক্তের নদীতে জাহাজ ভাসিয়ে তাদের ‘ফ্রান্স’ নামক রাষ্ট্রের অভিষেক করেছে। পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশী মুসলিম যে দেশে বসবাস করে, সে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নাম করে ২০১০ সালে মুসলিম নারীদের বোরকা পরার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। আবার এর ব্যত্যয় ঘটলে ৩২ হাযার মার্কিন ডলার পর্যন্ত জরিমানার আইন পাশ করে রেখেছে। যেই ফ্রান্সের নিকট মানুষের এই ধরণের একান্ত মৌলিক অধিকারের কোন মূল্য নেই, তাদের কাজে বাকস্বাধীনতার গল্প নিতান্তই বাতুলতা মাত্র।
ফ্রান্সে ইসলামের রাজনৈতিক বিকাশের ইতিহাস পড়লে আমরা দেখি যে, স্পেন বিজয়ী মুজাহিদ সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের মাধ্যমে স্পেনে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে, মুসলিম সেনাপতিরা পার্শ্ববর্তী দেশ ফ্রান্সের দিকে মনোনিবেশ করেন। ১০১ হিজরীতে কর্ডোভার শাসক সামাহ বিন মালিক আল-খাওলানী ফ্রান্সের সেপ্টিম্যানিয়া শহর জয়ের মাধ্যমে সর্বপ্রথম সেখানে ইসলাম প্রবেশ করে বলে অনুমিত হয়। সেপ্টিম্যানিয়া জয়ের পর তিনি ম্যাজিলিন কারাখিশোনা ও আরবোনা শহর জয় করে তুলুজের দিকে ধাবিত হন। তুলুজ শহর জয় করবেন এমন মুহূর্তে একুইটেনিয়ানের শাসক ডিউক উডোর অতর্কিত হামলায় মুসলীম বাহিনী পরাজিত হয় এবং সামাহ শহীদ হন। অতঃপর আমবাসা ইবনে সাহিম আল-কালবী ক্ষমতাসীন হয়ে সেপ্টিম্যানিয়াসহ আশপাশের আরও সাতটি বৃহৎ শহর পুনরুদ্ধার করেন। প্রোভিন্স ও লিয়ন শহর জয়ের পাশাপাশি ১০৭ হিজরীতে উতুন শহর জয় করেন। কিন্তু স্থানীয়দের বিশ্বাসঘাতকতায় আমবাসাও শহীদ হলে স্পেনে বিশৃঙ্খলতা দেখা দেয়।
৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুর রহমান গাফেকি শাসক হওয়ার মাধ্যমে স্পেনে রাজনৈতিক স্থিরতা আসে। তিনি তুলুজ শহরে মুসলিম বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলার প্রতিশোধ নিতে ডিউক উডোকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই মোতাবেক এক লক্ষ সৈন্যের বিশাল সমারোহ নিয়ে জারুনের দিকে অগ্রসর হন এবং শহরের প্রায় অর্ধেকটা জয় করে ফেলেন। এমনকি প্যারিসের একশ মাইল দূরে অবস্থিত সন্স শহরও মুসলিমদের অধিকারভুক্ত হয়। এমন শোচনীয় পরাজয়ে ভূমি হারানোর পর ইউরোপের অন্যান্য শাসকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুনরায় যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১১৪ হিজরী মোতাবেক ৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে বিলাতুশ শুহাদা নামক স্থানে ৭দিন ব্যাপী উভয় বাহিনীর রক্তক্ষয়ী তুমুল সংঘর্ষে অষ্টম দিনে মুসলিম বাহিনী পরাজিত হয়। এরপর মুসলিম বাহিনীর ছোট ছোট বিজয় আসলেও আর স্বগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। সর্বশেষ ১৪২ হিজরীর ৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে সেপ্টিম্যানিয়া শহর মুসলমানদের হাতছাড়া হয়’।[4]
এভাবে যুদ্ধ-বিক্ষুদ্ধ অস্থিতিশীল রাজনৈতিক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে মুসলিম শাসনের সমাপ্তি ঘটে। আর ইসলাম পূর্বযুগে ফ্রান্সকে শাসন করেছে রোমানরা। তখন থেকে এটি কেল্টীয় গল (Gaul) নামে পরিচিত ছিল। খ্রিষ্টীয় ৫ম শতকে রোমান সভ্যতা ধ্বংস হলে পর্যায়ক্রমে ফ্রান্স রাজবংশের মাধ্যমে শাসিত হয়। সর্বশেষ রাজা ষোড়শ লুই-এর সময়ে নেপোলিয়ন বোনাপোর্টের নেতৃত্বে ১৭৮৯-১৭৯৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের জোয়ারে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। অতঃপর ফরাসী বিপ্লবের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির দ্বন্দ্বে এবং প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ফ্রান্সের রাজনীতি অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যায় বটে; কিন্তু তারা সে সংকট কাটিয়েই আধুনিক ফ্রান্সে রূপান্তরিত হয়েছে।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী মুসলমান ফ্রান্সে বসবাস করে। তার কারণ হ’ল- সাম্রাজ্যবাদী রাজা ষোড়শ লুই-এর আদেশে সামান্য অযুহাতে ১৮৩০ সালে ফ্রান্স আলজেরিয়া আক্রমণ করে ১৮৪৭ সালের মধ্যে সিংহভাগ ভূমি দখল করে এবং ঔপনিবেশিক শাসন জারি করে। আলজেরীয়রা ১৯৫৪-১৯৬১ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে ১০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। ফ্রান্সে মুসলিম শাসনকাল ও উপনিবেশের সময় থেকে মুসলমানরা বসবাস করে আসছে। তৎপরবর্তীকালে কখনো শ্রমিক হিসাবে আবার অভিবাসন সমস্যার কারণে আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া ও মরক্কো থেকে মুসলমানরা ফ্রান্সে বসতি গড়ে। প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানীর হাত থেকে ফ্রান্সকে রক্ষার জন্য ৩৮ হাযার মুসলমান প্রাণ উৎসর্গ করে। এ সমস্ত আত্মত্যাগীদের সম্মানে ১৯২৬ সালে প্যারিসে গ্র্যান্ড মসজিদ নির্মাণ করে দেয় তৎকালীন ফ্রান্স সরকার’।[5]
এভাবে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও কার্যত ইসলামী শাসনের সোনালী যুগ হারানোর কারণে আজ তারা জিঘাংসার শিকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে পুঁজি করে ফরাসীদের ইসলাম অবমাননার রাষ্ট্রীয় চক্রান্তের এ অভিলাষ বহু পুরাতন। ফ্রান্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ রোমান ক্যাথলিকদের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য ফরাসী বিপ্লবের পর রাষ্ট্রের সাথে গির্জার সম্পর্ক খারাপ হ’তে থাকে। সে সময় রাষ্ট্র পরিচালিত হ’ত গির্জার পোপদের বানানো নিয়ম-রীতিতে। পোপরা সেটিকেই ধর্ম বলে চালিয়ে দিত। এই ধর্ম থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য ১৯০৪ সালে সমস্ত ধর্মীয় স্থানগুলিতে সকল প্রকারের ধর্মীয় তৎপরতা বন্ধ করতঃ পোপের সঙ্গে বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থাপনার যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। গীর্জার দালান-কোঠা পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করে সরকারী মালিকানায় নেওয়া হয়। এ পর্যায়ে শুধুমাত্র গির্জাগুলোকে শিক্ষাদানের জন্য সরকারী সনদ দিয়ে অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল। আর শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারী নির্দেশনা মোতাবেক ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে নৈতিকতা শিক্ষা চালু করা হয়, যা প্রকারান্তরে সরকারীভাবে নাস্তিকতা শিক্ষার দুয়ার খুলে দিল। ১৮৮০ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও ধর্ম তুলে দেওয়া হয়েছিল। এই সময় ইংল্যান্ড ও ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষতার গণজোয়ার চলছিল। ফ্রান্স সে সুযোগে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পুরোপুরি বিলুপ্ত করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করে নাম দিল অধর্মীয় ব্যবস্থা বা Laicisom (লেইসিজম)। ১৯৫৪ সালে লেইসিজমের তাৎপর্যে বলা হয়েছিল, ‘রাষ্ট্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ কোন সাম্প্রদায়িকতার অধীন হবে না। সেগুলোর বিশেষ কোন নামও রাখা হবে না। বরং সেগুলি হবে নিরপেক্ষ। না ধর্মের পক্ষে কোন কথা বলবে, না তা ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করবে’।[6]
উপরোক্ত ইতিহাস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ফ্রান্স তাদের অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় কোন্দলকে উপলক্ষ করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করে। সে হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনা, অর্থনীতি কিংবা শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রাধান্য থাকবে না এটাই সেক্যুলারিজমের শিক্ষা। কেননা সেক্যুলারিজম কিংবা লেইসিজম শিক্ষা ব্যবস্থায় অথবা রাষ্ট্র পরিচালনায় না ধর্মের পক্ষে কথা বলবে আর না বিপক্ষে, না ধর্ম প্রত্যাখ্যান করবে আর না ধর্মবিশ্বাসের পক্ষে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক মন্তব্য করবে। সুতরাং ধর্মের সাথে কোনরূপ ইতিবাচক বা নেতিবাচক সম্পর্ক না রাখাই যদি ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শন হয়, তাহ’লে স্যামুয়েল প্যাটি কীভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলাম ধর্মের নবী করীম (ছাঃ)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করে? কীভাবে পত্রিকার ব্যানারে শার্লি হেবদো ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করে? শার্লি হেবদোর দুঃসাহসিক অপকর্ম তাদের ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের বিরোধী হয় না? ফ্রান্স সরকারের বর্তমান পদক্ষেপও কি তাদের দর্শনবিরুদ্ধ হয় না?
অপরপক্ষে, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অবমাননার বিষয়টি বাকস্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত ধরলেও যে সেটা ধোপে টিকে না তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। কারণ প্রথমতঃ যে প্রধানমন্ত্রী নিজের প্রতি অসম্মানজনক মন্তব্য হজম করতে পারে না, তুর্কি প্রেসিডেন্টের সামান্য কিছু মন্তব্য যার কাছে চরম অপমানজনক ও নিন্দাযোগ্য মনে হয়, সেই তার মুখে বাকস্বাধীনতার বুলি আওড়ানো ‘এক চোখে তেল অপর চোখে নুন বিক্রি’ করার নামান্তর। দ্বিতীয়তঃ ১৯৪৯ সালে গৃহিত জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ১৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘Everyone has the right to freedom of opinion and expression; the right includes freedom to hold opinions without interference and to seck, receive and impart information and ideas through any media and regardless of frontiers.’ অর্থাৎ ‘প্রত্যেকের নিজের মতামত ও অভিব্যক্তি প্রকাশের অধিকার রয়েছে। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে কোনরূপ বিঘ্নতা ব্যতীত নিজের স্বাধীনচেতনায় অটল থাকা; বিশ্বের যেকোন মাধ্যম থেকে তথ্য আহরণ করা এবং অন্য কোথাও সে তথ্য বা চিন্তা জ্ঞাপন করার অধিকার’।[7]
এই অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে পৃথিবীর প্রতিটি ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু জাতিসংঘ পরবর্তীতে এই আইন কিছুটা সংশোধন করে লিখেছে যার সারমর্ম হ’ল ‘এই সব অধিকারের চর্চা বিশেষায়িত নিয়ম এবং দায়িত্বকে ধারণ করে। তবে যদি এই চর্চার দ্বারা কারো সম্মানহানি হয় বা জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তবে কিছু ক্ষেত্রে এর অবাধ চর্চা রহিত করা হয়’।[8] অর্থাৎ জাতিসংঘও বাকস্বাধীনতার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারকে রোধ করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
প্রিয় পাঠক! ইসলাম প্রতিটি মানুষের বাকস্বাধীনতার অধিকার সংরক্ষণ করে। বরং প্রকৃতপক্ষে একমাত্র ইসলামই জনসাধারণের মতপ্রকাশের প্রকৃত স্বাধীনতা দিয়েছে, এমনকি অত্যাচারী শাসকের রক্ত চক্ষুর সম্মুখে দাঁড়িয়েও। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أفضلُ الجهاد كلمةُ حقٍّ عند سلطانٍ جائرٍ ‘শ্রেষ্ঠ জিহাদ হ’ল অত্যাচারী শাসকের নিকটে হক্ব কথা বলা’।[9]
কিন্তু ইসলাম মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ব্যানারে স্বেচ্ছাচারিতার অনুমোদন দেয় না। আজকে যারা বাকস্বাধীনতার অপব্যবহারকে বৈধতা দিতে ব্যতিব্যস্ত; তারাও নিজেদের সম্মানহানিকর ব্যাপারকে নিজের জন্য মেনে নেন না। তাই ইসলাম স্বেচ্ছাচারিতার অপনোদনের জন্য নির্দিষ্ট সীমারেখা ঠিক করে দিয়েছে এবং মানুষের জিহবার ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। বিধায় ইসলামে মতপ্রকাশের নামে সাধারণ মানুষের দুর্নাম করা, গীবত করা, মন্দ নামে ডাকা, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, উপহাস করা ইত্যাদি বিষয়কে গুরুতর অপরাধ হিসাবে গণ্য করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! কোন সম্প্রদায় যেন কোন সম্প্রদায়কে উপহাস না করে। হ’তে পারে তারা তাদের চাইতে উত্তম। আর নারীরা যেন নারীদের উপহাস না করে। হ’তে পারে তারা তাদের চাইতে উত্তম। তোমরা পরস্পরের দোষ বর্ণনা করো না এবং একে অপরকে মন্দ লক্ববে ডেকো না। বস্ত্ততঃ ঈমান আনার পর তাকে মন্দ নামে ডাকা হ’ল ফাসেক্বী কাজ। যারা এ থেকে তওবা করে না, তারা সীমালংঘনকারী’ (হুজুরাত ৪৯/১১)।
আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্মানহানি বা অন্য কোন বিষয়ে যুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ হতে মাফ করিয়ে নেয়, সেদিন আসার পূর্বে যেদিন আর কোন দিনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোন সৎকর্ম না থাকলে তার যুলুমের পরিমাণ তার নিকট হ’তে নেয়া হবে আর তার কোন সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ হ’তে নিয়ে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে’।[10]
পরিশেষে বলব, আমাদের হ’তে হবে তেজদীপ্ত ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান। আজ সেই ঈমানী শক্তি না থাকায় চক্রান্তকারী ইহুদী-খ্রিষ্টান চক্র বারবার আমাদের বিরুদ্ধে সুযোগ গ্রহণ করতে চায়। তারা ইসলামী বিশ্বকে ধোঁকায় ফেলে পরিবেশ ঘোলাটে করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই যুবসমাজের প্রতি আহবান থাকবে, কোন অবস্থাতেই যেন আমরা তাদের পাতানো ফাঁদে পা না দেই। আমাদেরকে যেকোন ইসলাম বিদ্বেষী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ঈমান নিয়ে নির্ভিক চিত্তে রুখে দাঁড়াতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সকল কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী ভূমিকা পালনের তাওফীক দান করুন।-আমীন!
আব্দুর রঊফ |
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
১. দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ই অক্টোবর ২০, পৃ. ৯।
[2]. দৈনিক যুগান্তর, ৩১শে অক্টোবর ২০।
[3]. এনটিভি অনলাইন ডেস্ক, ১লা নভেম্বর ২০২০।
[4]. ফ্রান্সে মুসলিম শাসনের স্মৃতিচিহ্ন, কালের কণ্ঠ, পৃ. ১০, ১ নভেম্বর ২০১৮।
[5]. মুসলমানদের আত্মত্যাগের সাক্ষী ফ্রান্সের গ্র্যান্ড মসজিদ, ১৯ জানুয়ারী ২০১৬, পৃ. ১৫; কালের কণ্ঠ; উইকিপিডিয়া।
[6]. পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি, মাওলানা আব্দুর রহীম, খায়রুন প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ. ৩৬-৩৯।
[7].Universal Declaration of Human Rights, WWW.un.org: https://en.wikipedia.org/wiki/Freedom_of_speech
[8]. International convenant on Civil and political Rights, Office of the united nations high Commissioner for human rights, adopted and opened for signature, ratification and accession by UN general assembly resolution 2200A (XXI) of 16 December, entry into force 23 March 1976
[9]. আবূদাঊদ হা/৪৩৪৪; তিরমিযী হা/৩৭০৫
[10]. বুখারী হা/২৪৪৯; আহমাদ হা/৯৩৩২