মুসলিম সমাজে প্রচলিত হিন্দুয়ানী প্রবাদ-প্রবচন
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ
লিলবর আল-বারাদী 1323 বার পঠিত
ইসলামে কন্যা সন্তানের মর্যাদা :
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে অসম্মানের মনে করা হতো এবং অকল্যাণ মনে করে জীবিত প্রোথিত করা হতো। অথচ ইসলাম এসে দুনিয়ার বুকে অবহেলিত নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করলেন। কন্যা সন্তান জাহান্নামের অন্তরাল এবং জান্নাতে যাওয়ার অসীলা বা মাধ্যম। অথচ পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে এমন মর্যাদার কথা ইসলাম বলা হয়নি।
ক. কন্যা সন্তান জাহান্নামের অন্তরায় :
কন্যা সন্তানের মাধ্যমে পিতামাতা জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবেন। কন্যা সন্তান জাহান্নামের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে যদি সেই পিতামাতা তাদের কন্যাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে এবং যথার্থ শিক্ষা প্রদান করেন তবেই। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘একদিন জনৈকা মহিলা আমার কাছে এলো। তার সাথে তার দু’জন কন্যা ছিল। সে আমার কাছে কিছু ভিক্ষা চাইল। তখন আমার কাছে একটি মাত্র খেজুর ছাড়া কিছুই ছিল না। আমি সেটাই তাকে দিয়ে দিলাম। সে খেজুরটিকে তার দু’জন কন্যার মধ্যে ভাগ করে দিলো, তা থেকে নিজে তিনি কিছুই খেলো না। অতঃপর সে উঠে চলে গেল। তারপর নবী করীম (ছাঃ) ঘরে প্রবেশ করলেন, আমি ঘটনাটি তাঁর কাছে বললাম। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, مَنِ ابْتُلِىَ مِنْ هَذِهِ الْبَنَاتِ بِشَىْءٍ كُنَّ لَهُ سِتْرًا مِنَ النَّارِ. ‘যে ব্যক্তি এ কন্যাদের দ্বারা পরীক্ষিত হবে এবং সে কন্যাদের সাথে উত্তম আচরণ করবে, তবে এ কন্যারাই তার জন্য জাহান্নামের আগুনের মাঝে অন্তরায় হবে’।[1]
কন্যা সন্তানের লালনপালন সন্তুষ্টচিত্তে করা উচিৎ। কন্যা সন্তান জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنِ ابْتُلِىَ بِشَىْءٍ مِنَ الْبَنَاتِ فَصَبَرَ عَلَيْهِنَّ كُنَّ لَهُ حِجَابًا مِنَ النَّارِ. ‘যে ব্যক্তি তার মেয়ে সন্তানদের জন্য কোনরকম পরীক্ষার সম্মুখীন হয় (বিপদগ্রস্ত হয়), সে তাদের ব্যাপারে ধৈর্য ধরলে তার জন্য তারা জাহান্নাম হ’তে আবরণ (প্রতিবন্ধক) হবে’।[2]
খ. কন্যা সন্তান প্রতিপালনে জান্নাত :
কন্যা সন্তান প্রতিপালনকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন এবং জান্নাতে রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে অবস্থান করবেন। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (রাঃ) বলেন, مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ دَخَلْتُ أَنَا وَهُوَ الجَنّةَ كَهَاتَيْنِ، وَأَشَارَ بِإصْبعَيْهِ ‘যে ব্যক্তি দু’টি কন্যা সন্তানকে লালনপালন ও দেখাশুনা করল। সে ও আমি জান্নাতে এরূপ একসাথে প্রবেশ করব যেরূপ এ দু’টি আঙ্গুল। তিনি নিজের দুই আঙ্গুল মিলিয়ে দেখালেন’।[3] অন্যত্র, আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ يَكُونُ لأَحَدٍ ثَلاَثُ بَنَاتٍ أَوْ ثَلاَثُ أَخَوَاتٍ أَوِ ابْنَتَانِ أَوْ أُخْتَانِ فَيَتَّقِى اللَّهَ فِيهِنَّ وَيُحْسِنُ إِلَيْهِنَّ إِلاَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ. ‘যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনটি বোন আছে এবং সে তাদের সাথে মমতাপূর্ণ ব্যবহার করে, সে বেহেশতে প্রবেশ করবে’।[4]
গ. কন্যা সন্তানের সুশিক্ষার ব্যবস্থা করা :
নারী-পুরুষের উভয়ের শিক্ষাগ্রহণ করা অপরিহার্য। যে ইলম মানুষকে জান্নাতের পথ দেখায়, সেটাই হ’ল প্রকৃত ইলম। আর সেই ইলম শিক্ষা করা নারী ও পুরুষ প্রত্যেক মুমিনের উপর ফরয। ইলম অর্জনের নির্দেশনা স্বরূপ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘প্রত্যেক মুসলিমের উপরে জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরয’।[5]
ইসলামের প্রাথমিক যুগে জ্ঞানচর্চার যে প্রবাহ শুরু হয়, নারীরাও সেখানে শামিল হয়েছিল। পরবর্তীতে আববাসীয় ও উমাইয়্যা যুগে নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে’।[6] নারী শিক্ষা এমন হ’তে হবে, যাতে সে সেরা সম্পদে পরিণত হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَخَيْرُ مَتَاعِ الدُّنْيَا الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ. ‘দুনিয়া পুরাটাই সম্পদ। আর দুনিয়ার সেরা সম্পদ হ’ল পুণ্যশীলা নারী’।[7] অন্যত্র তিনি বলেন, لِيَتَّخِذْ أَحَدُكُمْ قَلْبًا شَاكِرًا وَلِسَانًا ذَاكِرًا وَزَوْجَةً مُؤْمِنَةً تُعِينُ أَحَدَكُمْ عَلَى أَمْرِ الآخِرَةِ. ‘সোনা-রূপার চেয়ে মূল্যবান তোমাদের প্রত্যেকেই যেন অর্জন করে কৃতজ্ঞ অন্তর, যিকিরকারী জিহবা এবং আখিরাতের কাজে স্বামীকে ঈমানের পথে সহযোগিতা করে সে স্ত্রী’।[8]
পুণ্যবতী স্ত্রী হ’তে চাইলে অবশ্যই তাকে আলিমাহ হ’তে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ إِنَّ اللهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ ‘নিশ্চয় তাঁর বান্দাদের মধ্যে কেবল আলেমগণই আল্লাহ্ ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ্ মহাপরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল’ (ফাত্বের ৩৫/২৮)। পৃথিবীতে যত মহিয়সী নারী রয়েছে সকলে তাক্বওয়ার ভিত্তিতে হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَفْضَلُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ خَدِيجَةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ وَفَاطِمَةُ بِنْتُ مُحَمَّدٍ وَمَرْيَمُ بِنْتُ عِمْرَانَ وَآسِيَةُ بِنْتُ مُزَاحِمٍ امْرَأَةُ فِرْعَوْنَ. ‘পৃথিবীর সেরা নারী হ’লেন চার জন। খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে খাদীজা, (ফেরাঊনের স্ত্রী) আছিয়া বিনতে মুযাহিম ও (ঈসার মা) মারিয়াম বিনতে ইমরান’।[9]
ঘ. কন্যার বিবাহ ও সুপাত্রস্থ করণ :
কন্যা সন্তানকে ইলম শিক্ষা ও বিয়ে দিয়ে সুপাত্রস্থ করলে অভিভাবকের জান্নাতের পথ সুগম হয়। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ عَالَ ثَلاَثَ بَنَاتٍ فَأَدَّبَهُنَّ وَزَوَّجَهُنَّ وَأَحْسَنَ إِلَيْهِنَّ فَلَهُ الْجَنَّةُ. ‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তানকে লালন-পালন করলো, তাদেরকে আদব শিক্ষা দিলো, বিয়ে দিলো এবং তাদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করলো, তার জন্য জান্নাত রয়েছে’।[10]
শায়খ মুকবিল আল ওদায়ী (রহঃ) বলেন, আল্লাহর কসম আপনি যদি আপনার বোন অথবা কন্যাকে তালিবুল ইলমের সাথে বিয়ে দিতে পারেন; তাহ’লে তা দুনিয়া এবং এর মধ্যে থাকা সবকিছুর চেয়েও উত্তম’।[11]
বিবাহের আগে মহিলাদের সম্মতি নিতে হবে। তাদের মতামত কীভাবে বুঝা যাবে সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَتُنْكَحُ الْأَيِّمُ حَتَّى تُسْتَأْمَرَ وَلاَتُنْكَحُ الْبِكْرُ حَتَّى تُسْتَأْذَنَ، قَالُوْا يَارَسُوْلَ اللهِ وَكَيْفَ إِذْنُهَا قَالَ أَنْ تَسْكُتَ. ‘প্রাপ্ত বয়ষ্কা বিবাহিতা নারীকে তার সুস্পষ্ট অনুমতি ব্যতীত বিবাহ দেওয়া যাবে না। বালেগা কুমারী নারীকেও তার অনুমতি না নিয়ে বিবাহ দেওয়া যাবে না। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তার অনুমতি কিভাবে বোঝা যাবে? তিনি বললেন, চুপ থাকাই তার অনুমতি’।[12] অন্যত্র রয়েছে, আয়েশা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কুমারী মেয়ে তো লজ্জা করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, رِضَاهَا صُمَتُهَا ‘নীরব থাকাই তার সম্মতি’।[13]
কিন্তু বিধবা মেয়ের সম্মতি থাকতে হবে। খানসা বিনতু খিদাম বলেন, ‘তার পিতা তাকে বিবাহ দেন। তিনি ছিলেন বিধবা। তিনি তা অপসন্দ করলেন। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট আসলেন। তিনি তার বিবাহ বাতিল করে দিলেন’।[14]
ঙ. মীরাছে কন্যা সন্তানের অধিকার :
জাহেলী যুগে উত্তরাধিকার লাভের তিনটি মাধ্যম ছিল। ১. আত্মীয়তার সম্পর্ক (النسب والقرابة) ২. পালকপুত্র হওয়া (التبني) ও ৩. চুক্তি (الحلف)।[15]
জাহেলী যুগে নারীদের কোন সামাজিক মর্যাদা ছিল না। চতুষ্পদ জন্তু বা ভোগ্যপণ্যের ন্যায় তাদেরকে উত্তরাধিকার সম্পদ রূপে গণ্য করা হত। এমনকি পুরুষদের জন্য এমন কিছু খাবার নির্দিষ্ট ছিল, যা নারীদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ।[16]
শুধু তাই নয়, জাহেলী যুগে নারীরা মীরাছ লাভ থেকে বঞ্চিত হত। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, ‘জাহেলী যুগের লোকেরা নারী ও শিশুদেরকে উত্তরাধিকারী করত না। এমনকি শিশু পুত্রসন্তান হলেও। তারা বলত, মীরাছ কেবল তাকেই দেওয়া হবে যে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে যুদ্ধ করে, বর্শা দ্বারা আঘাত করে, তরবারী দ্বারা যুদ্ধ করে এবং গনীমত লাভ করে’।[17]
আধুনিক মুফাসসির শায়খ আব্দুর রহমান বিন নাছির আস-সা‘দী (রহঃ) বলেন, ‘জাহেলী যুগের আরবরা তাদের শক্তিমত্তা ও নির্দয়তার কারণে দুর্বলদেরকে উত্তরাধিকারী করত না। যেমন নারী ও শিশু। তারা বীর পুরুষদের জন্য মীরাছ নির্ধারণ করত। কারণ তাদের ধারণা অনুযায়ী পুরুষরাই যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং লুণ্ঠন করার যোগ্য’।[18] মোদ্দাকথা, জাহেলী যুগে উত্তরাধিকার লাভের মানদ- ছিল পৌরুষ ও শক্তি-সামর্থ্য। সুতরাং পুত্র সন্তানের মত কন্যা সন্তানও পিতা-মাতার সম্পদের হক্বদার।
নারী-পুরুষের মীরাছ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَفْرُوضًا ‘পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদের অংশ রয়েছে এবং পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের সম্পত্তিতে নারীদের অংশ রয়েছে, কম হৌক বা বেশী হৌক। এ অংশ সুনির্ধারিত’ (নিসা ৪/৭)।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের (মধ্যে মীরাছ বণ্টনের) ব্যাপারে তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান। যদি তারা দুইয়ের অধিক কন্যা হয়, তাহ’লে তারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে। আর যদি কেবল একজনই কন্যা হয়, তবে তার জন্য অর্ধেক। মৃতের পিতা-মাতার প্রত্যেকে পরিত্যক্ত সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ করে পাবে, যদি মৃতের কোন পুত্র সন্তান থাকে। আর যদি না থাকে এবং কেবল পিতা-মাতাই ওয়ারিছ হয়, তাহ’লে মা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। কিন্তু যদি মৃতের ভাইয়েরা থাকে, তাহ’লে মা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ মৃতের অছিয়ত পূরণ করার পর এবং তার ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রদের মধ্যে কে তোমাদের জন্য অধিক উপকারী, তা তোমরা জানো না। এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ৪/১১)।
তিনি আরো বলেন, ‘আর তোমাদের স্ত্রীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে তোমরা অর্ধেক পাবে, যদি তাদের কোন সন্তান না থাকে। যদি থাকে, তবে তোমরা সিকি পাবে, তাদের অছিয়ত পূরণ ও ঋণ পরিশোধের পর। আর তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে স্ত্রীরা সিকি পাবে, যদি তোমাদের কোন সন্তান না থাকে। যদি থাকে, তবে তারা অষ্টমাংশ পাবে, তোমাদের অছিয়ত পূরণ ও ঋণ পরিশোধের পর। আর যদি পিতা ও সন্তানহীন কোন পুরুষ বা স্ত্রী মারা যায় এবং তার একজন ভাই অথবা বোন থাকে, তবে তারা প্রত্যেকে এক ষষ্ঠাংশ করে পাবে। আর যদি তারা একাধিক হয়, তাহ’লে তারা সকলে এক তৃতীয়াংশে শরীক হবে, অছিয়ত পূরণ অথবা ঋণ পরিশোধের পর, কাউকে কোনরূপ ক্ষতি না করে। এটি আল্লাহ প্রদত্ত বিধান। আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সহনশীল’ (নিসা ৪/১২)।
নারীদের মীরাছ সম্পর্কে ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, قَالَ كَانَ الْمَالُ لِلْوَلَدِ ، وَكَانَتِ الْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ ، فَنَسَخَ اللَّهُ مِنْ ذَلِكَ مَا أَحَبَّ ، فَجَعَلَ لِلذَّكَرِ مِثْلَ حَظِّ الأُنْثَيَيْنِ ، وَجَعَلَ لِلأَبَوَيْنِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسَ ، وَجَعَلَ لِلْمَرْأَةِ الثُّمُنَ وَالرُّبْعَ ، وَلِلزَّوْجِ الشَّطْرَ وَالرُّبُعَ. ‘উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পদ পেত সন্তান আর পিতা-মাতার জন্য ছিল অসীয়ত। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর পছন্দ মত এ বিধান রহিত করে ছেলের অংশ মেয়ের দ্বিগুণ, পিতা-মাতা প্রত্যেকের জন্য এক ষষ্ঠাংশ, স্ত্রীর জন্য এক অষ্টমাংশ, এক চতুর্থাংশ, স্বামীর জন্য অর্ধেক, এক চতুর্থাংশ নির্ধারণ করেন।[19]
ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে মীরাছে কম-বেশী করা ইসলামে নিষেধ রয়েছে। ওয়ারিছগণ কে কতটুকু পাবে তা স্বয়ং আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন (নিসা ৪/৭, ১১)। তিনি আরো বলেন, وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِين ‘এবং তাঁর (আল্লাহর) নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করলে তিনি তাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করবেন; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শান্তি রয়েছে’ (নিসা ৪/১৪) সুতরাং সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে উক্ত নীতির ভিত্তিতেই ভাগ করতে হবে। এক্ষেত্রে মেয়েদেরকে অংশ না দেওয়া এবং ছেলেদের মধ্যে কমবেশী করা নিঃসন্দেহে কাবীরা গুনাহ এবং তা হক বিনষ্টের শামিল। তারা ক্ষমা না করলে আল্লাহ তা‘আলাও উক্ত পাপ ক্ষমা করবেন না। কিয়ামতের দিন পিতা-মাতার নেকী থেকে নিয়ে সন্তানদের হক্ব পূরণ করে দেওয়া হবে। যদি তার নেকীতে না কুলায়, তাহ’লে সন্তানদের পাপসমূহ পিতা-মাতার আমলনামায় যোগ করা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[20]
সন্তানের মধ্যে মীরাছ বণ্টনে কমবেশী করা নিষেধ রয়েছে। যারা কমবেশী করেন তারা সন্তানের হক্ব নষ্ট করেন এবং যুলুম করে থাকেন। ভুলের বশবর্তী হয়ে কেহ এমন করলে তা ফিরিয়ে নিতে হবে এবং সমান বণ্টর করতে হবে। নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তাঁর পিতা তাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, আমি আমার এই পুত্রকে একটি গোলাম দান করেছি। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, أَكُلَّ وَلَدِكَ نَحَلْتَ مِثْلَهُ. ‘তোমার সব পুত্রকেই কি তুমি এরূপ দান করেছ। তিনি বললেন, না; তিনি বললেন, فَارْجِعْهُ. ‘তবে তুমি তা ফিরিয়ে নাও’।[21] আবার অনেকে পরিমাণে সমান করলেও মূল্যের দিক বিবেচ্য না করেই কমবেশী করে থাকে। যেমন ছেলেদের দামী সম্পদ প্রদান করে এবং মেয়েদেরকে কম মূল্যের সম্পদ প্রদান করেন।
পিতা-মাতা সন্তানকে অথবা ভাই-বোনকে ঠকায় বা যুলুম করে এর পরিণাম অনেক ভয়াবহ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কারো এক বিঘত পরিমাণ যমীন যুলুম করে নেয়, ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় সাত তবক যমীন বেড়ী পরানো হবে’।[22]
অন্য হাদীছে এসেছে, مَنْ أَخَذَ أَرْضاً بِغَيْرِ حَقِّهَا كُلِّفَ أَنْ يَحْمِلَ تُرَابَهَا إِلَى الْمَحْشَرِ. ‘কোন ব্যক্তি অধিকার ব্যতীত জমি অধিগ্রহণ করে, তবে ক্বিয়ামতের দিন ঐ মাটির বোঝা তার গর্দানে চাপিয়ে দেওয়া হবে’।[23]
সুতরাং কন্যা সন্তান যথাযথভাবে লালন-পালন এবং তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে আমরা সহজেই জান্নাতে নিজেদের স্থান করে নিতে পারি। সুতরাং কন্যা সন্তানের প্রতি অবহেলা নয়, যত্নশীল হতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন-আমীন!
লেখক : যশপুর, তানোর, রাজশাহী|
[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪৯৪৯।
[2]. তিরমিযী হা/১৯১৩; ছহীহুল জামি‘ হা/১০৮৭৫; হাসান হাদীছ।
[3]. তিরমিযী হা/১৯১৪; সিলসিলা ছহীহা হা/২৯৭।
[4]. আহমাদ হা/১১৪০২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৯৪।
[5]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮; সনদ হাসান।
[6]. ফাতেমা আলী, ইসলামে নারী, পৃঃ ৩৫-৪১।
[7]. মুসলিম হা/১৪৬৭।
[8]. ইবনু মাজাহ হা/১৮৫৬।
[9]. আহমাদ হা/২৯০৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৫০৮।
[10]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৯৪; জামি‘ আছ-ছাগীর হা/৮৮৪৭।
[11]. আল বাশায়িরু ফিস সিমায়িল মুবাশশির, পৃষ্ঠা-১৯।
[12]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩১২৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৯৯২।
[13]. বুখারী হা/৫১৩৭; আস-সুনানুল কুবরা (মুলতান : মাতবা‘আহ নাশরুস সুন্নাহ), ৭/১১৮।
[14]. নাসাঈ হা/৩২৬৮; ইবনু মাজাহ হা/১৮৭৩; হাদীছ ছহীহ।
[15]. ইসলাম কা কানূনে ওয়ারাছাত, পৃঃ ৩৫-৩৭।
[16]. নিসা ১৯; আন‘আম ১৩৮-৩৯; আবুল হাসান নাদভী, আস-সীরাতুন নাবাবিইয়াহ (জেদ্দা : দারুশ শুরূক, ১৯৮৪ খ্রিঃ), পৃঃ ৩২; আববাস মাহমূদ আল-আক্কাদ, আবকারিয়্যাতু মুহাম্মাদ (কায়রো : দারু নাহযাতি মিসর, ২০০২ খ্রিঃ), পৃঃ ১২১।
[17]. তাফসীরে কুরতুবী (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, ১৯৯৩ খ্রিঃ), ৫ম খ-, পৃঃ ৩১।
[18]. আব্দুর রহমান বিন নাছির আস-সা‘দী, তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৪২৩ হিঃ/২০০২ খ্রিঃ), পৃঃ ১৬৫, নিসা ৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.।
[19]. বুখারী হা/২৭৪৭, ৪৫৭৮; দারেমী হা/৩২৬২; সনদ ছহীহ।
[20] বুখারী হা/২৪৪৯, মিশকাত হা/৫১২৬-২৭।
[21] বুখারী হা/২৫৮৬; মুসলিম হা/১৬২৩; মিশকাত হা/৩০১৯।
[22]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৯৩৮।
[23]. আহমাদ হা/১৭৫৯৪ ও ১৭৬০৫; ছহীহাহ হা/২৪২; সনদ হাসান।