সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটে তিনদিন
মুকাররম বিন মুহসিন
আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দিক 792 বার পঠিত
নতুন কোনো শহরে ঘুম থেকে জেগে উঠা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। পৃথিবী যদি একটি কাব্যগ্রন্থ হয়, তাহলে যে ভ্রমণ করেনা সে কোনো কবিতার অংশ হতে পারেনা। ভ্রমণ পিপাসু প্রতিটি মানুষই সদা নিত্য-নতুনের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়; ঘুরেফিরে আর নতুনত্বে নিজেকে হারিয়ে আবার খুঁজে পায়।
কুরআন স্বীকৃত অন্যতম হালাল বিনোদন হচ্ছে পৃথিবী পরিভ্রমণ। আল্লাহ বলেন, ‘বলে দাও! তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর, অতঃপর দেখ মিথ্যারোপকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছে’ (আন‘আম ৬/১১)। তবে চলুন! এবার আমরা প্রসঙ্গের প্রারম্ভিকায় প্রবেশ করি।
শৈশবের ভালোলাগা আর যৌবনের হেদায়াতী প্রিয় কাফেলা ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’। প্রতিবছর গ্রীষ্মের তৃষ্ণার্ত কাকের ন্যায় ক্ষণ গণনায় মুখিয়ে থাকি, কখন আসবে তাবলীগী ইজতেমা! কখন আসবে কর্মী সম্মেলন! প্রিয় মানুষদের সদা কাছে পাওয়ার আকুলতাকে মনে হয় আল্লাহর জন্যে ভালোবাসার অফুরন্ত জান্নাতী নহর। এসবের পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যোগ হয়েছে শিক্ষা সফরের মতো নান্দনিক কর্মসূচি। কিন্তু সময় এবং শিক্ষাসফর কারো জন্য অপেক্ষা করেনা, কিন্ত অপেক্ষার পালাই যেন আর শেষ হচ্ছিল না। অবশেষে ২৯ ও ৩০ই অক্টোবর ২০২০ কেন্দ্র কর্তৃক শিক্ষাসফরের জন্য নিকলী হাওর ও মিঠামইন (কিশোরগঞ্জ) এবং বিরিশিরি ও চিনামাটির পাহাড় (নেত্রকোনা) নির্ধারিত হলো। মনের মধ্যে আনন্দের সুর বেঁজে উঠল। শুরু হ’ল ক্ষণ গননা। অবশেষে চলেই এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২৮ই অক্টোবর, বুধবার রাত ১০ টার মধ্যে বেশীরভাগ যেলার দ্বীনী ভাই ও কর্মীরা সংগঠনের নারায়ণগঞ্জ অফিস তথা কাঞ্চনে চলে আসলে। রাতে থাকলাম সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মুস্তাফিযুর রহমান সোহেল ভাইয়ের বাসায়। নারায়ণগঞ্জ যেলা যুবসংঘের ভাইদের আন্তরিক আতিথেয়তায় রীতিমত জামাই আদরে আমরা আপ্যায়িত হলাম। সে রাতে আর তেমন ঘুম হয়নি। গল্প-আড্ডাতেই কেটে গেছে বেশ। বাদ ফজর কেনদ্রীয় সভাপতি ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব ভাইয়ের দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে সফরের আবেগী পারদ যেন নতুন উষ্ণতার ছোঁয়া পেল। অতঃপর আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম স্যারের নছীহতপূর্ণ প্রাণবন্ত বক্তব্য শেষে সফর শুরু হ’ল। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক আহমাদুল্লাহ ভাই এবং ছাত্র বিষয় সম্পাদক আব্দুন নূর ভাইদ্বয় সবাইকে দু’দিনের সফর পরিকল্পনা এবং দু’টি বাসে বসার আসন বিন্যাস বুঝিয়ে দিলেন।
সকাল ৭টায় দো‘আ পাঠের মাধ্যমে বাস যোগে ২১টি যেলার প্রায় ১০২ জন সদস্য বিশিষ্ট কাফেলা ছুটে চললো দেশের সবচেয়ে নিম্নভূমি হাওরের দেশ মাননীয় রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের দেশ কিশোরগঞ্জের দিকে। মোট যাত্রীর তুলনায় আসন সংখ্যা সীমিত হলেও ক্ষণিকের এ বিড়ম্বনা সবাই হাসিমুখে মেনে নিলাম।
হাইওয়ে রোড ধরে আপন বেগে ছুটে চলল যাত্রী ভরা বাস দু’টি। বাস ছাড়তেই আমাদের হ্যান্ড মাইকগুলো বেজে উঠল। দ্বীনী ভাইদের সুললিত কন্ঠে ক্ষণিক বাদে থেমে থেমে চলছে জাগরণীর মুর্ছনা। মাঝেমধ্যে চলছে আনন্দ আয়োজন, খোশগল্প আর খুঁনসুটি। দ্বীনী ভাইদের আবেগ, উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ছিল বাসের কোণায় কোণায়। ইতিমধ্যে নারায়নগঞ্জ যেলা যুবসংঘের সৌজন্যে সফরের টি-শার্ট, কলম, চাবির রিং বিতরণ হ’ল। সংক্ষিপ্ত পরিসরে সকালের হালকা নাস্তাও বিতরণ হ’ল। ছিল সবার জন্য চকলেটও।
অতঃপর দুপুর ১১টার দিকে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপযেলার গজারিয়ায় স্থানীয় কিছু দ্বীনী ভাইদের যাত্রা বিরতি দেওয়া হলো। সেখানে স্থানীয় একটি মসজিদে সাথে তাদের সাথে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হলো। কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী আবুল কালাম ভাই জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের উপর সংক্ষিপ্ত অথচ তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করলেন। কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. ছাকিব ভাই সবাইকে সংগঠিত থেকে দ্বীনের উপর ইস্তেকামাতের আহবান জানিয়ে বক্তব্যের ইতি টানলেন। অতপর সেখানেই সকালের নাশতা পরিবেশন করা হলো। খাবার শেষে চা চক্রের আড্ডাটা বেশ ভালোই জমে উঠল। দূরীভূত হ’ল সফরের কিছুটা ক্লান্তি। কর্মীরা নতুন ভাইদের আলিঙ্গন ও আতিথেয়তায় মুগ্ধ হ’লা। হকের মিছিলে যুক্ত হওয়া নতুন ভাইয়েরা পেল জামা‘আতী যিন্দেগীর অনুপ্রেরণা ও দ্বীনী ভালাবাসার স্বাদ।
তারপর বাস আবার ছুটে চললো। কিশোরগঞ্জের ছয় জন ভাই আমাদের সাথে যুক্ত হ’ল। বাংলার সবুজ প্রকৃতি ভেদ করে লক্ষ্যপানে অবিশ্রান্ত ছুটা চলা। ভৈরব পার হওয়ার পর বাধলো বিপত্তি, মিঠামইনগামী সরু রাস্তায় পান থেকে চুন খসতেই লেগে যায় জ্যাম। এতকিছুর মধ্যেও থেমে ছিলনা কর্মীদের পারস্পরিক দ্বীনী ভালোবাসার আদান-প্রদান আর আনন্দ আয়োজন। অবশেষে দুপুর আড়াইটার দিকে আমরা নিকলী বেড়ীবাঁধে এসে পৌঁছালাম।
তারপর হাওর ঘুরে মিঠামইন যাওয়ার জন্যে দু’টি বড় লঞ্চ ভাড়া নেওয়া হ’ল। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে একটি টিম প্রথম লঞ্চে উঠলো, আর বাকীরা অপর লঞ্চে উঠলাম। যথারীতি ছেড়ে দিল লঞ্চ। অবারিত সবুজে ভরা এই হাওর বর্ষায় হয়ে উঠে পানিতে টইটুম্বুর। যেন মিঠাপানির অথৈ সাগর। মুহুর্মুহু আল্লাহ আকবার আর সকল বিধান বাতিল করো, অহির বিধান কায়েম করো ধ্বনিতে জলরাশি ভেদ করে লঞ্চ ছুটে চললো মিঠামইনের দিকে। প্রকৃতির এ মন মাতোয়ারা দৃশ্যে পুলকিত হয়ে থেমে নেই আমাদের কারো কন্ঠ। সমস্বরে আল্লাহর প্রশংসা স্ত্ততিময় জাগরণীসমুহ অনুরণিত হচ্ছিল। তার সাথে স্পিকার বক্সে মাঝেমধ্যে বেজে চলছিলো শফিকুল ইসলামের কালজয়ী জাগরণী সমুহ। দু’চোখ যতদূর যায় মাছ ধরার ছোট ডিঙি নৌকা, জেলেদের জীবনসংগ্রামের দৃশ্যপট ভেসে বেড়াচ্ছে ।
এখানে ২০ মিনিটের জন্য গোসলের সময় দেওয়া হলে মুহূর্ত দেরী না করে প্রায় শতজনের বহর একসাথে হাওরে নেমে গোসল শুরু করল। শুরু হ’ল আমাদের নাশকতা। পানি বেশি না থাকায় সাতার কেটে সুবিধা করতে পারছিলাম না। অধিক পানির আকাঙ্খায় আমরা ব্রীজের মাঝ বরাবর একদম নিচে চলে আসলাম। কিন্তু সেখানে বাঁধলো বিপত্তি, প্রবল স্রোত আঁচ করতে পেরে আশু বিপদ কাটিয়ে উঠতে আমরা অনেকেই একে অপরের হাত ধরে রাখলাম। জামাআতবদ্ধ জীবন যাপন যে সত্যিই রহমত স্বরূপ, তা আরও একবার বুঝতে পারলাম। সেই প্রবল স্রোত মাড়িয়ে সীসা ঢালা প্রাচীর হয়ে আমরা তীরে আসলাম। ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে সূর্য অন্তীম প্রস্থান করেছে। আজানও হয়ে গেছে। জলদি কাপড় পরিবর্তন করে সড়কে চলে আসলাম। ততক্ষণে শতাধিক কর্মী ভাই মাগরিবের জামা‘আতে দাঁড়িয়ে গেছে। রাস্তা এসে এমন বিরল দৃশ্যের মুখোমুখি হব, তা কল্পনাতেও ভাবি নাই। পশ্চিমে রক্তিম আকাশের আলোকচ্ছটা আর হিমশীতল বাতাসে কিছু মানুষ অবনত মস্তকে সিজদায় পড়ে আছে। দু‘ধারে শুধু পানি আর পানি, তার সাথে ঝিঝিপোকার ঝনঝনানি কানের কাছে এসে যেনো বলে যাচ্ছে, ‘প্রত্যেক মানুষের অন্তরে রয়েছে এক অস্থিরতা, আল্লাহর কাছে ফিরে গেলেই তা দূর করা সম্ভব’। প্রত্যেক মানুষের অন্তরে রয়েছে শুন্যতা, আল্লাহর পথে ফিরে আসলেই পাবে কেবল পূর্ণতা। ছোট্ট এ জীবনে কত পাহাড়, পর্বত, সাগর-নদী দাপিয়ে বেড়িয়েছি আমরা হয়ত অনেকেই। কিন্তু এত সুন্দর অনুভূতি হয়তবা কখনো কারো হয়নি।
ছালাতে এতো প্রশান্তি অনেকদিন লাগেনি। ছালাত শেষে দাঁড়িয়ে কর্মীদের উদ্দেশ্যে প্রিয় ড. ছাকিব ভাই হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য রাখলেন। তিনি যখন সূরা মুলকের আয়াতগুলো পড়ছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল এ যেন নতুন কিছু, সুবহানাল্লাহ! তিনি পবিত্র কুরআন থেকে পাঠ করলেন, تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (1) الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ (2) الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا مَا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِنْ تَفَاوُتٍ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَى مِنْ فُطُورٍ (3) ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنْقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيرٌ ‘বরকতময় তিনি, যাঁর হাতে সকল রাজত্ব এবং তিনি সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাশীল। যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন তোমাদেরকে এই পরীক্ষার জন্য যে, কে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর আমল করে। আর তিনি মহাপরাক্রান্ত ও ক্ষমাশীল। তিনি স্তরে স্তরে সাত আসমান সৃষ্টি করেছেন। দয়াময়ের সৃষ্টিতে কোন ত্রুটি দেখতে পাও কি? আবার দৃষ্টি ফিরাও। কোন ফাটল দেখতে পাও কি? অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরাও। তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে’ (মুলক ৬৭/১-৪)। তাঁর বক্তব্যের সারসংক্ষেপ ছিল এমনই যে, এ অপূর্ব সৃষ্টিজগত বলে দেয় আমাদের একজন রব আছেন। আমরা তারই ইবাদত করি, আমরা সবাই তারই বান্দা এবং তারই দাসত্ব করি। ততক্ষণে পূর্বাকাশে চাঁদ মামা পূর্ণ আভা ছড়িয়ে সবাইকে সাদর সম্ভাষণ জানাতে অপেক্ষায় আছে। কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করে লেগুনায় চেপে বসে আবার লঞ্চে ফিরে আসলাম। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় নিকলী হাওরের বুক চিরে আমাদের লঞ্চ ছুটে চলল। সেখানে কত গান, কত কবিতা। বিশেষকরে আল-হেরার বহুল প্রসিদ্ধ গানগুলো আমাদের দ্বীনী ভাইদের মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি জাগ্রত করল। আর সঙ্গে বয়ে চলছিল অভূতপূর্ব মনোরম চাঁদনী রাতের দৃশ্য। এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ পেলে যে কোন কবি, সাহিত্যিকদের মুন্সিয়ানা বেশ জমে উঠে।
রাত ৮টায় নিকলী বেড়ীবাধে এসে যাত্রাবিরতি। সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র তাওহীদী মহিমা ছড়িয়ে দেওয়ার অংশ হিসাবে বই ও লিফলেট বিতরণ চলল। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আলাপচারিতায় উঠে এল তাদের অনুভূতির নানা কথা। তাদের মধ্যে এক কলেজ অধ্যাপক ও এক প্রবাসী ভাই অকপটে বলেই ফেলল এমন সুশৃংখল সুন্নাতের পাবন্দ যুবসমাজ তাদের কখনো চোখেই পড়েনি। তারা আমাদের সাধুবাদ জানিয়ে বিদায় দিলেন। এখানে পূর্বেই এক হোটেলে রাতের খাবার অর্ডার করে রাখা হয়েছিল। সুস্বাদু হাওরের তাজা মাছ আর হাঁসের গোশত সবার মন ভরিয়ে দিল।
রাতের খাবার শেষে সবাই বাসে উঠলাম। বাস ছুটে চললো নতুন গন্তব্য বিরিশিরি নেত্রকোনার দিকে। অতঃপর রাত আড়াইটার দিকে নেত্রকোনা দূর্গাপুরে পূর্বে নির্ধারিত গেস্টহাউজে এসে পৌছালাম। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে কিছুক্ষণের জন্য বিছানায় পিঠ হেলিয়ে দিলাম। ফজরের ছালাত শেষে কেউ হাটতে বের হ’ল, কেউ দ্বিতীয় দফায় ঘুমাতে গেল। কেউ কেউ কাউকে বেজার না করে প্রথমে কিছুক্ষণ হাটল, তারপর এসে ঘুম দিল। বেশিক্ষণ ঘুমানো যায়নি। পাশেই সোমেশ্বরী নদীতে বেড়াতে যাওয়া ও গোসল করার হিড়িক পড়ে গেল। কেউ কেউ রিসোর্টের সামনে ফুটবল খেলায় মেতে উঠল। কুমিল্লা বনাম অন্যান্য যেলার মধ্যে এক শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে কুমিল্লা যেলা ৩-১ গোলে হেরেও জিতে গেল। একটু আনন্দ এই আরকি। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। আমরা সকলে অজানা অচেনা দশ মায়ের দশ সন্তান। সংগঠনের এই শিক্ষাসফর আমাদের অজান্তে এক অজানা আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে।
খেলা শেষে গোসল করে নাস্তা পর্ব সেরে সবাই বাকী দিনের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে নিলাম। ইতিমধ্যে নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ যেলার কিছু দ্বীনী ভাই নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা করে গেলেন। সবাইকে পরিপাটি হয়ে বের হয়ে হলরুমের সামনে আসার নির্দেশ দেওয়া হলো। সেখানে সফরের আমীর অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম স্যার সারগর্ভ বক্তব্য এবং সাংগঠনিক জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। অতঃপর বাসে দূর্গাপুর থেকে বিরিশিরি আসা হলো। সেখানে রাস্তার দুই ধারে সাংগঠনিক বিভিন্ন বই-পুস্তক, আক্বীদা সংক্রান্ত লিফলেট বিতরণ করা হলো। উলেলখ্য যে, দুই দিনের শিক্ষাসফরে দাওয়াতী কাজ এবং ঘুরাঘুরি চলেছে প্রায় সমানতালে।
সোমেশ্বরী নদীর পাড় ঘেঁষে মাটির রাস্তায় খুব একটা মন্দ লাগছিল না। সোমেশ্বরী নদী পারাপার হওয়ার একমাত্র মাধ্যম হ’ল নৌকা। এখানকার মানুষজন তাদের মোটর সাইকেল, গরু-ছাগল এবং বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য পারাপার করে থাকেন এই নৌকার মাধ্যমে। সোমেশ্বরী নদী থেকে মেশিনের সাহায্যে পাথর উত্তোলনের কারণে সারাক্ষই মেশিনগুলোর ঠ্যা ঠ্যা শব্দ কানে বাজছিল। আমরা বেশ কিছুক্ষণ সময় সোমেশ্বরী নদীর বুকে জেগেওঠা বালুচরে হাঁটাহাঁটি করলাম। আবার কখনো মেঘালয় থেকে নেমে আসা সোমেশ্বরীর বুক দিয়ে প্রবাহিত হওয়া শীতল পানিতে পা চুবিয়ে সময় কাটালাম। সোমেশ্বরী নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে মনে পড়ে যাবে সুনামগঞ্জের জাদুকাটা নদীর কথা। নদী পার হয়ে স্থানীয় বাজারে সারাদিন ঘুরার জন্যে অটোরিকসা রিজার্ভ নেওয়া হলো।
বিজয়পুর জিরো পয়েন্ট যাওয়ার জন্য অটোরিকসায় চেপে বসলাম। জিরো পয়েন্টে যাওয়ার সময় একটি মজার ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। জিরো পয়েন্টের পথে দু’পাশেই ভারত এবং কিছুটা দূরে গিয়ে তিন দিক থেকেই ভারত বেষ্টিত আমরা।
পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখা যাচ্ছিলো বেশ। এ পাহাড়সমূহ হয়তো আমাদেরই হওয়ার কথা ছিলো। সীমান্ত কাটাতার দিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করা যায় বটে; কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন চাইলেই তো আর কেড়ে নেওয়া যায় না। বিজিবি ক্যাম্প পার হয়ে আমরা জিরো পয়েন্ট পৌছালাম। এপারে বাংলা, ওপারে ভারত মাঝখানে বুক পেতে দাঁড়িয়ে আছে সোমেশ্বরী নদী। এই পয়েন্টের সৌন্দর্য সিলেট জাফলংয়ের সৌন্দর্যের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। দুইটি ইঞ্জিনচালিত বোট দ্বারা জিরো পয়েন্ট ঘুরে আসা হলো। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে খুব কাছ থেকেই দেখা মিললো জাতীয়তাবাদী বিচ্ছেদরেখা তথা সীমান্ত কাটাতার। কেন এ বিচ্ছেদ, জাতি যা আজ তা ভুলতে বসেছে। তা হ’ল শুধুমাত্র ইসলাম ও মুসলমানদের স্বাধীন ভূমির জন্য ব্যাকুলতা, যা আমাদের পূর্বপুরুষরা নির্ধারণ করে গেছেন।
সেখান থেকে পায়ে হেটে সবাই ছুটে চললাম কমলাবাগানের দিকে। সুউচ্চ এক পাহাড়ের চূড়ায় এ স্পটটি অবস্থিত। পাহাড়ের চূড়ায় ক্ষণিকের অবকাশ ভালোই কাটল। তাড়াতাড়ি ফিরতে ইচ্ছা না করলেও আমরা সময়ের ফ্রেমে বন্দী। সুতরাং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নতুন গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। এবারের গন্তব্য চিনামাটির পাহাড়।
অটোতে ওঠে কিছুক্ষণ চললাম এবং স্থানীয় একটি মসজিদ সবাই জুম‘আর ছালাত আদায় করলাম। অতঃপর ছালাত শেষে উপস্থিত মুছুল্লীদেরকে উদ্দেশ্যে সুন্নাতের অনুসরণ এবং বিদ‘আতের ভয়াবহতার উপর শায়খ শরীফুল ইসলাম মাদানী চমৎকার বক্তব্য রাখলেন। মুছল্লীরাও মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শায়খের বক্তব্য শ্রবণ করলেন। সেখানে মুছল্লীদের নিকট আহলেহাদীছ আন্দোলন কর্তৃক প্রকাশিত সংগঠনের বিভিন্ন বই ও সমাগত ঈদে মিলাদুন্নবী বিষয়ে লিফলেট বিতরণ করা হ’ল।
ছালাত শেষে সবাই এসে পৌঁছালাম। বহুল আকাঙ্ক্ষিত দেশের একমাত্র চিনামাটির পাহাড়ে। চিনামাটির পাহাড় থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ায় সেখানে বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আর সেখানেই পানি জমে সৃষ্টি হয়েছে স্বচ্ছ পানির লেক। মূলত সেখানে লেক দু’টি। একটি বেশ বড়। আর সেটাতে অনেক পর্যটকই লম্ফঝম্ফ মেরে গোসল সেরে নেন। পার্শ্বে সাইনবোর্ডে লেখা আছে গোসল করা নিষেধ। অথচ এত সুন্দর স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটতে কার না মন চায়? তাই আমরা অল্পকিছুক্ষণ পানিতে সাঁতার কেটে চলে আসলাম। বিদায় নেয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছিলো সূর্যি মামার বিদায়ঘন্টা। পাহাড়ের দৃশ্যও ততক্ষণে সুন্দর লাগছিলো বেশ। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো সবুজ চাদর বিছিয়ে রেখেছে কেউ। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে সবাই রিসোর্টে ফিরে আসলাম। এবার নতুন গন্তব্য। নেত্রকোনা সদরের মদনপুর মুহাম্মাদিয়া জামে মসজিদ। নেত্রকোনার আহলেহাদীছ ভাইদের আমন্ত্রণে সেখানে প্রোগ্রাম হ’তে যাচ্ছে। আমাদেরকে পেয়ে তারা খুব খুশী হলেন। আমরাও সকলে উচ্ছ্বসিত। সেখানে অত্যন্ত পরিপাটিভাবে প্রোগ্রাম হলো, আলোচনা হলো এবং রাতের খাবারও হলো। ফালিল্লাহিল হামদ। অতঃপর চলে এলো বিদায়ের পালা! বিদায়ের বিষাদ বেদনা। এক দেহ এক প্রাণ আমাদের। নাহি যেতে দিতে চায়, তবু যেতে দিতে হয়; তবুও চলে যায়। সকল যেলার দ্বীনী ভাইদের সাথে কুশল বিনিময় শেষে ঢাকার উদ্দেশ্য বাস ছাড়লো। রাতেও বাসে বিদায়ের বিষাদ দেখা যায়নি, বরং পূর্বের মতোই খুনসুটি চলছিলো। একসময় গভীর রাত নেমে এলো, দুই দিনের ক্লান্তি আর বাহিরের বৃষ্টিতে সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন হলো। হারিয়ে গেল সবাই বিস্মৃতির অন্তরালে। এভাবেই শেষ হলো বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র দুই দিনের শিক্ষাসফর। প্রিয় মানুষদের সাথে কাটানো এই মধুর স্মৃতি চাইলেও কি ভোলা যায়? নিশ্চয়ই দেখা হবে ইনশাআল্লাহ কারণে-অকারণে, অন্য কোন জান্নাতী স্পটে। আল্লাহ যেন জানণাতের নির্মল ঝর্ণার পাশে প্রিয় দ্বীনী ভাইদের সাথে কোনো এক মিলন মেলায় আবারো যেন একত্রিত করে দেয়-আমীন!
আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দিক
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্র বিএসএস সম্মান ৪র্থ বর্ষ, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।
চিনামাটির পাহাড় (নেত্রকোনা)